ডাক লেকের ধারে

ডাক লেকের ধারে
বিশ্বদীপ চক্রবর্তী

মিশিগানের বাসিন্দাদের হামেশাই একটি কেবিন থাকে। কেবিন মানে আসলে বাড়িই। কিন্তু কলেবরে ছোট, জাঁকজমকহীন। গ্রীষ্মের যে কোন শুক্রবার লাঞ্চের পর অফিসে যদি কাউকে জিজ্ঞেস করা যায়, কি করছ এই শনি-রোববারে? তুরন্ত জবাব আসে আপ নর্থ, মানে চলেছি আমার কেবিনে। আমার মত সদ্য আসা লোকেরা যদি বুঝতে না পেরে মাথা চুলকায় তখন সঙ্গে সঙ্গে মিসিগ্যান্ডাররা ডান হাতের উপর বাঁ হাত রেখে বিখ্যাত মিশিগান হ্যান্ড ম্যাপ বানিয়ে সোৎসাহে ভূগোল বোঝাতে শুরু করে দেবে। ডান হাতের বুড়ো আঙুলটাকে যতটা পারে বাঁকিয়ে তার উপর দিকে বাঁ হাতটা উল্টো করে আড়াআড়ি রাখবে। বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলটা কাঁচকলা দেখানোর ভঙ্গিতে ডান হাতের দিকে ফেরান। তারপর বোঝানো শুরু হবে। এই দেখো ডান হাতের তালুর একেবারে গোড়ায় ডেট্রয়েটে আছি আমরা, আমাদের ডানদিকে লেক ইরি। যদি ডান হাতের আঙুল ধরে সোজা উঠে যাও, পৌঁছে যাবে স্যাগিন। তার ডানদিকে পড়ে হুরন লেক। ওই বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলটা হল ম্যাকিনাক, যেখানে লেক হুরন আর লেক মিশিগান মিলেছে। তারপর আরও চলতে থাকলে পৌঁছে যাবে লেক সুপিরিয়ার।

মিশিগান যে গ্রেট লেকসের দেশ সেটা তো বুঝলাম, এর মধ্যে আপ নর্থ এলো কোথায়?

এই যে সোজা হাতের তালু বরাবর উঠে গেলে, উত্তরেই চলেছ তো। যত উপরে যেতে পারো, চলে যাও না।

তবে সবারই যে কেবিন আপ নর্থে থাকে না আমার সেই ভুল ভাঙালো আমার এক সহকর্মী, ভেসনা কিস্টোপ্যানাইডিটিস। গ্রীক নামের পদবীগুলো এমনিধারা খটমটো আর লম্বা। অবশ্য গ্রীক বললে ভেসনা খুশি হয়না, বলে আমরা ম্যাসিডোনিয়ান। দুই বছর বয়সে যখন বাবার সঙ্গে আমেরিকায় চলে এসেছিল তখনো ম্যাসিডোনিয়া দেশটার কোন অস্তিত্ব ছিল না। গ্রীস আর যুগোস্লাভিয়ার মধ্যে অতীতের ম্যাসিডোনিয়া ভাগাভাগি হয়ে ছিল তখনো। অনেকটা বাঙালীরা ভারত আর পাকিস্তানে আলাদা হয়ে যাওয়ার মত। দুই দশক আগে যুগোস্লাভিয়ার দিকের ম্যাসিডোনিয়ানরা নিজের দেশ কায়েম করেছে, বাকি ম্যাসিডোনিয়ানরা এখনো গ্রীসের মধ্যে।

এইটা জানার পর আমি ম্যাসিডোনিয়ানদের সঙ্গে খুব একাত্ম অনুভব করি, ঠিক যেন বাঙালীদের দশা। অবশ্য ভেসনা ছাড়া আর কোন ম্যাসিডোনিয়ান আমি চিনিও না।

ধান ভানতে শিবের গীত গেয়ে ফেলছি। কথা হল আমাদের ভেসনার একটি কেবিন আছে ডাক লেকের ধারে, শহর থেকে এমন কিছু দূরেও নয়। আমাদের ভারতের অফিসের দুই সহকর্মী কাজে এসেছে, কথা হচ্ছিল ওদের নিয়ে শুক্রবারে একটা টিম আউটিং করার। ভেসনা বলল, চলে এসো না আমার কেবিনে? আমার নৌকা এখনো জলে। সবাই মিলে লেকে ঘুরতে পারব।

কেন, এরপর নৌকো যাবে কোথায়?

কিছু কিছু লোক থাকে যারা সমস্ত শরীর দিয়ে কথা বলে। ভেসনা সেরকম। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বেশ ভরাট চেহারা, কথাও উচ্চগ্রামে। আমার অজ্ঞতায় ভেসনা তার সযত্নে আঁকা ভুরু কপালে তুলে হই হই করে সারা শরীর কাঁপিয়ে হেসে উঠল। সেপ্টেম্বার হয়ে গেল যে। কদিন বাদেই বরফ পড়া শুরু হবে না? নৌকা ঘাটে বেঁধে আগাপাশতলা মুড়ে দিতে হবে শীত আসার আগে।

ভেসনা বাংলা জানলে বলতাম আমি আদার ব্যাপারী, জাহাজের খোঁজ কি আর রাখি? কিন্তু প্রস্তাবটা মন্দ নয়। আমি হ্যাঁ বলতেই ভেসনা সব ব্যবস্থাপনা নিজের কাঁধে নিয়ে নিল। সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে গেলে হাঁটুতে তার নাকি ব্যাথা হয় আজকাল। কিন্তু শুক্রবার শেষ দুপুরে আমি, ক্যাথি, স্টিভ আর ভারত থেকে আসা কার্ত্তিক আর আদিলক্ষ্মী যখন ভেসনার কেবিনে পৌঁছালাম, ঘটিহাতা ফুলআঁকা শার্ট আর কেপরিস পড়ে ভেসনা লাফাতে লাফাতে লেকের ঢাল বেয়ে উঠে এলো। যেন সদ্য কিশোরী! আমরা আসবো সেই আয়োজন করতে সকাল থেকে চলে এসেছিল। কিছু কিছু লোক থাকে যাদের প্রতিটা কথায় ফুলঝুরির রোশনাই আর ঠোঁটের কোনায় দুধের সরের মত হাসি লেগেই থাকে। ভেসনা অমনিধারা, সব সময়েই আনন্দের হাট হয়ে বসে আছে। আমাদের আরেক সঙ্গী ক্যাথিরও কথায় কথায় অট্টহাস্যের অভ্যাস। সুতরাং খুব কম সময়ের মধ্যেই আউটিং মাদ্রাসি দইয়ের মত জমে জমাট।

খাবার ছিল স্যালাড, অলিভ, বাঁধাকপির রোল, দলমা আর স্প্যানাকোপিতা। স্প্যানাকোপিতা হচ্ছে পালং শাক আর ফেটা চিজ দিয়ে বানানো পাই। দলমা একধরনের ভরোয়া, সবজির খোলে পুর ঢুকিয়ে। ভেসনা বানিয়েছিল লাল ক্যাপ্সিকাম দিয়ে। কার্ত্তিক আর আদিলক্ষ্মী শাকাহারি, তাই ভেসনার সব খাবারই বুঝি ভেজিটেরিয়ান। ওদের জন্য ইয়োগার্ট ছিল আর কিছুতে জুত না হলে। স্প্যানাকোপিতা খেতে আমি খুবই ভালবাসি, তবুও আমার বাঙালি জিভ নিরামিষ দেখে একটু দুঃখিত বোধ করছিল। সেকথা জানাতে ভেসনা মুচকি হাসল। তোমার লাঞ্চ বক্স থেকে আমি রোজ মাছমাংসের গন্ধ পাই সাহিল, ভাবলে কি করে শুধু স্যালাড খাওয়াব? বাঁধাকপির রোলটা খাও, ওটার ভিতরে ভাত আর মাংস ভরা আছে।

শুনে আদিলক্ষ্মী আঁতকে উঠল। এই রে, এটার ভিতরে মাংস আছে নাকি? আমি যে প্লেটে নিলাম! ভারতনাট্যম নর্তকীদের মত বড় আর কাজল টানা চোখ তার। সেই চোখ কপালে উঠে মুখটা দেখার মত হয়েছিল বেশ। আদি তামিল আয়াঙ্গার, মাছ মাংসের নাম শুনলেও বুঝি কান ধুতে হয়। অচেনা খাবারের ভিড়ে বেচারি চিনে উঠতে পারেনি।

খাওনি তো এখনো, আমি নিয়ে নিচ্ছি। ফর্কে গেঁথে রোলটা তুলে নিল স্টিভ আদির প্লেট থেকে।

স্টিভ জাতে আইরিশ, আইস হকি খেলে বলে একেবারে পেটানো হিলহিলে চেহারা। অফিসে ওর সোনালি দাড়িতে ঢাকা মুখ সচরাচর গম্ভীর। ভেসনা কিংবা ক্যাথির মত এমন হুল্লোড়বাজ নয়। কিন্তু ডাক লেকের ধারে এসে দেখলাম সেই মুখের ফাটল দিয়েও হাসি চুঁইয়ে পড়ছে গোপন পাহাড়ি ঝর্নার মত।

হেমন্তে লেকের ধারের একটা সিরসিরানি থাকে। আমাদের টেবিলটা এতটাই ধার ঘেঁসে, জলো বাতাসের ঝাপটা এসে লাগছিল গায়ে। বেশ ধারালো ভাব সেই বাতাসে। লেকের ধার ধরে নানা বর্ণের নানান ধাঁচের সব বাড়ি। কদিন বাদে বাতাস আরও তীক্ষ্ণ হলে এই বাড়িগুলো জবুথবু হয়ে শীতঘুমে চলে যাবে। তার কিছু দেরী আছে। এখনো ঘাটে ঘাটে নৌকা বাঁধা। ছোট বড়। ছোট নৌকাগুলো তিরতির করে কাঁপছে যেন জলে নামার জন্য উতসুক। সেকথা বলতেই ভেসনা রিনরিন করে বেজে উঠল। যাবে এখন জলে?

লেকের জলে অনেক নৌকা এখন, কেউ একা ডিঙি নৌকায় দাঁড় বাইছে। এখানে বলে কায়াক। ভেসনার জেটিতে অমনি দুটো ডিঙি নৌকা। কমলা আর গাঢ় নীল রঙের। একটা বড় ইঞ্জিন বসানো সাদা নৌকাও পাশে। তার মাথায় ছাদ আর বসার জন্য নৌকার দুধার ঘেঁষে গদি এঁটে বসার সুন্দর ব্যাবস্থা। যাওয়াই যায়।

লেকের বাতাস উচ্ছল করে তুলেছিল আদিলক্ষ্মীকেও। দেখে ভাল লাগল। কারণ গাড়িতে আসার পথে বেশ মুখ শুকনো করে বসেছিল। হয় অনেকের, এক দুই সপ্তাহ বাড়ি ছেড়ে এসেই হোমসিক ফিল করে। প্রকৃতি এমন অবস্থায় মহৌষধির কাজ করে। আমরা টেবিলে বিয়ার নিয়ে বসে থাকলেও আদি ভেসনার বাগানময় উড়ে বেড়াচ্ছিল। আসলে উড়ছিল ওর ময়ুরপঙ্খি রঙের শাড়িটা। এদেশে এসেও শাড়ি পড়েই স্বচ্ছন্দ বোধ করে নাকি মেয়েটা। এখন লেকের হাওয়ায় আঁচল পড়ে গেছে গা থেকে। বাতাসে আঁচলের সঙ্গে উড়ছে এলো করে বাঁধা চুল। বাগান থেকে একটা জেরেনিয়ামের গুচ্ছ তুলে চুলে বেঁধেছিল বনদেবীর মত। সেটা হাওয়ায় উড়ে যেতেই ডানার মত দু হাত মেলে ধরতে ছুটছিল। সে যদি আরো হাত তোলে বাতাসে ভেসেই যেতে পারে বুঝি। আদির গলাতেও খেলছিল সেই এলোমেলো বাতাস। ভেসনা! আমার খুব উড়তে ইচ্ছে করছে আজ। একটু ওয়াইন খাই?

হা হা করে হেসে উঠল ক্যাথি। ওয়াইন তো আঙ্গুর দিয়ে তৈরী, এক্কেবারে ভেগান। খেতেই পারো।

আরেক ভেজিটেরিয়ান কার্ত্তিক বিয়ারে চুমুক দিচ্ছিল। আদি ওর সঙ্গেই এক গাড়িতে হোটেলে ফিরবে। ত্রস্ত চোখে তাকাল আদির দিকে। এসব খাওয়ার অভ্যেস আছে তো আদি?

আঁচল সামলাতে সামলাতে ধাপে ধাপে হাসল আদিলক্ষ্মী। এই নীল হ্রদের বাতাসের সঙ্গে লাল রঙের ওয়াইন, অভ্যেস হয়ে যাবে এমনিতেই! তখনই বলেছিল কথাটা আদি। মাথার অবাধ্য চুল হাতখোঁপায় বন্দী করতে করতে ভেসনার দিকে ফিরে। তোমাকে আমার খুব হিংসে হচ্ছে জানো। এমন জলের ধারে কাঠের বাড়ি, ঘাটে ছলছলাচ্ছে তোমার নৌকা। ঠিক যেন রূপকথা কোন।

চেন্নাই সমুদ্রের ধারের শহর। কিন্তু সমুদ্রে তো আর ডিঙি ভাসানো যায় না। সেই কথা ভেবেই হয়তো বলেছিল কথাটা। এমনিতে ভেসনা কথায় কথায় হাসে। আদি কথাটা তেমন খারাপ কিছুও বলেনি। প্রশংসারই। কিন্তু ভেসনার জলরঙা চোখের উপর কোন মেঘ ছায়া ফেলল যেন। হিংসে কোরো না আদি, ডোন্ট বি জেলাস! লেকের জলো হাওয়া ভেসনার গলায় আটকে গেল কেমন হঠাৎ।

বিভিন্ন দেশের মানুষ যখন এক জায়গায় জড়ো হয়, কিছু কিছু শব্দের ওজন আর তীব্রতা অনুভূত হয় ভিন্ন স্তরে। আমি আগেও দেখেছি এমন হতে। তাই কান খাড়া করে রইলাম শুধু।

আদি থমকে গেছিল। আমি কিছু ভুল বললাম ভেসনা? জলের কিনারা, উতলা বাতাস আদিকে একটু উচ্ছল করে তুলেছিল। ভেসনার কথায় একটা নির্মোক দূরত্বে ফিরতে চাইছিল।

ভেসনা ততক্ষণে নিজেকে সামলিয়ে নিয়েছে আবার। আরে না, না। তোমাকে ওয়াইন দিই, খাও তো।

পড়ন্ত বেলার রোদের মিঠে তাত পিঠে নিয়ে লাল মদে আমেজ আছে বেশ। উঁচু নীচু খানা খন্দ বুজিয়ে দেয় অনায়াসে। নরম গলার গল্পে কাছাকাছি হচ্ছিলাম সবাই। হঠাত স্টিভ চমক ভাঙালো। অ্যাডি! অ্যাডি! লুক! আদির দিকে তর্জনী তুলে বলতে বলতে গলায় হাসির বুদবুদ খেলছিল স্টিভের।

ওয়াইন খাওয়ার অভ্যাস নেই মোটেই। আদিলক্ষ্মী খুব ঘন ঘন খাচ্ছিল বুঝি, গলার সুর খানিক স্খলিত। খসে গেছিল আঁচলও। গাঢ় সবুজ ব্লাউজের উপর দিয়ে স্তনের ভার ঠেলে উঠেছে। স্টিভের আঙ্গুল ওদিকে দেখে চমকে গেছিলাম, কারন এদেশের পোষাকের তুলনায় এমন কিছু দৃষ্টিকটু নয়তো। আমরা তখনো কেউ মোটে বুঝিনি স্টিভের এমন ভাবে আদির বুকের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার কারণ কি। এতগুলো চোখ নিজের উপরে পেয়ে থতমত খেয়ে গেছিল মেয়েটা। দ্রুত টানে ময়ুরপঙ্খি শাড়ির আঁচল বুকে টানতে গেল। স্টিভ স্টপ! অ্যাডি স্টপ! বলে এমন হাঁ হাঁ করে উঠল যে আদি মধ্যপথে গো স্ট্যাচু খেলার মত থমকে থ। আমরা তখনো বুঝিনি স্টিভ কি বলতে চায়। স্টিভ নিজের চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল। দেখছো না প্রজাপতি, প্রজাপতি বসে আছে!

তখনই নজরে এলো আদির বাম স্তনের উপর একটা প্রজাপতি পাখা তুলে বসেছিল, বলতে বলতেই পাখা ছড়িয়ে নিজেকে পূর্ণ করে দেখাল। কমলা রঙের ছড়ানো পাখার উপরে কালো দাঁড়ি দাঁড়ি প্যাটার্ন, ডানার পাড় ঘেঁসে কালো বর্ডারের উপর চন্দনের ফোঁটা। তির তির করে কাঁপছে আদির শ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে একই ছন্দে।

মনার্ক! মনার্ক! মুখে হাত চেপে রুদ্ধশ্বাসে বলল ভেসনা। স্টিভের এগিয়ে যাওয়া দেখে ভয়ার্ত গলায় বলল, স্টিভ ডোন্ট হার্ট হার, প্লিজ।

আদির মুখটা দেখার মত হয়েছিল। চোখের মণি যতটা কোনাকুনি করা যায় করে প্রজাপতিটা দেখার চেষ্টা চালাচ্ছিল। অনেকটা ওয়াইন খেয়ে না থাকলে এতটা সাবলীল থাকতে পারত কি না চেন্নাইয়ের আয়াঙ্গার গোত্রীয় আদিলক্ষী, সেটা আমি জানি না। অফিসের বাইরে কখনো কথা হয়নি তেমন, সেই কথাও তো হয় ফোনে। কতটুকুই বা চিনি। কিন্তু ক্ষণিকের অস্বস্তি কেটে যেতেই ঝিকমিক করে উঠল আদির চোখ। চোখ থেকে হাসি চুঁইয়ে পড়ল ঠোটে। এই স্টিভ, তাড়াবে না এটাকে। আগে একটা ছবি তুলে দাও না সাহিল।

আমি আমার মোবাইল তুলতেই অবশ্য না না করে উঠল, আমার মোবাইলে, আমার।

মোবাইলের ক্যামেরায় ধরলাম আদিকে। ধনুকপানা ভ্রুভঙ্গী, খুশিতে ঝিলিক দেওয়া চোখ, ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে ঝিকমিক করা দাঁতের সারি, চিবুকের ভাঁজ, দীর্ঘ গলা থেকে পিছলে পায়রার ডিমের মত স্তনমূল। এই অপরূপ ব্যাকগ্রাউন্ডের সামনে রাজার বিভঙ্গে পাখনা মেলে বসেছিল সেই প্রজাপতিটা কমলা, কালো আর সাদার অপরূপ সাজে। নড়ছিল না, যাওয়ার কোন ইচ্ছাও বুঝি নেই। প্রজাপতিটাকে অসম্ভব সুন্দর লাগছিল দেখতে, আদিকেও। একসঙ্গে কাজ করি, মাঝে মাঝে দেখা হয়েছে। কিন্তু ক্যামেরার চোখ দিয়ে এমন নিবিড়ভাবে দেখার সুযোগ হয়নি আগে।

সাহিল, এবার আস্তে করে প্রজাপতিটা সরিয়ে দাও না, দেখো ওর যেন ব্যাথা না লাগে।

স্টিভ মাঝপথে থমকে ছিল। বলল, দেখো ডানা ধরে টান দিও না। ঠিক পাশটিতে আঙ্গুল মেলে দাঁড়াও, তারপর একসময় উড়ে যাবে নয়তো তোমার হাতে এসে বসে পড়বে। আমি হাত মেলে দিলাম মনার্কের কাছ ঘেঁসে। প্রজাপতি, আমার আঙুল দুইই কাঁপছিল তিরতির করে, আদির নিশ্বাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে।

আঙুলটা আর একটু কাছে নিয়ে যাও, স্টিভ আমাকে গাইড করছিল যেন।

আমার আঙুল আদিকে ছুঁয়ে দিতেই প্রজাপতিটা ডানা মেলে উড়ে গিয়ে বসে পড়ল আদির মাথায়।

থাক ওখানেই বসে, রাজা প্রজাপতির জন্য যোগ্য সিংহাসন। সবাই এতক্ষণ যেন দমবন্ধ উত্তেজনায় বসে ছিল। ক্যাথির এই কথায় পরিবেশের উত্তেজনার রাশ নিমেশে হালকা হয়ে গেল। কথার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাথি স্বভাবসুলভ হা হা হাসিতে ভেঙে পড়তেই প্রজাপতি মাথা ছেড়ে উড়ে গেল ফুলের সন্ধানে।

ইশ, ক্যাথিকে হাসতে বললেই হত, প্রজাপতি তাড়াতে তাহলে এত কসরত করতে হত না।

কার্তিকের এই কথায় আদি অবশ্য বলল, ভাগ্যিস আগে হেসে ফেলেনি ক্যাথি। তাহলে এত সুন্দর ছবিটা উঠত না আমার। আদি খুব মন দিয়ে নিজের ছবি দেখছিল এখন। আমি ওর বেশ কয়েকটা ছবি তুলেছিলাম। হঠাৎ আমার কেমন লজ্জা হল। আঙুলের ডগায় ওর বুকের স্পর্শের স্মৃতি তখনো যায়নি, মনে হল আমার ক্যামেরার চোখ ওর বুকের উপর জমাট বেঁধে থাকেনি তো?

আদি, কেমন হয়েছে ছবি?

ঝিকমিক করে উঠল আদির চোখ। ইস, প্রজাপতিটা তোমার হাতে নেমে গেলে বেশ হত। তাই না?

কেন বেশ হত সেটা ভাবার আগেই ভেসনা উঠে দাঁড়াল। আর বেশি দেরি করলে আমরা লেকে নামতে পারবো না, আলো কমে আসছে।

আমাকে বেরিয়ে যেতে হবে ভেসনা, ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়াল ক্যাথি।

কেন? নৌকাবিহারে যাবে না?

ক্যাথি হা হা হাসিতে ছড়িয়ে গেল। আজ হবে না গো। পল কেমো নিয়েছে কাল, ওকে আজ বাড়ি নিয়ে যাবো।

আদি চমকে উঠে মুখে হাত রাখল। আই আই আইও! চকিত ব্যাথায় ওর আয়ত চোখ করুণ হয়ে উঠল। তুমি কক্ষনো বলোনি তো ক্যাথি! কেন এলে আজ?

ক্যাথি যেতে যেতে থমকে দাঁড়াল। বহু বছরের ব্যাপার আদি, জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছি আমরা। সেইভাবেই বেঁচে থাকতে হয়। ক্যাথি ওর সিগনেচার হা হা হাসিতে ভাঙতে ভাঙতে পার্কিং-এর দিকে পা বাড়াল।

ভেসনা এগিয়ে এসে আদির কাঁধে হাত রাখল। চিন্তা করো না, ক্যাথি খুব স্ট্রং। আট বছর আগে পলের ক্যান্সার ধরা পড়ে, প্রস্টেট। রিল্যাপ্স করেছে আবার। দে উইল বি অলরাইট। কথার ছন্দ ফেরাতে নিজেই লাফালাফি করে বোটের নোঙর খুলতে চলল ভেসনা। চলো চলো চলো, ডাক লেকের জলে ভাসতে হলে আর দেরি না।

লেকের জলে অনেকেই দল বেঁধে নৌকা বিহারে। ভেসনার নৌকার মত ইঞ্জিনওয়ালা আরও একটা, তবে লেকের অন্যধারে এখন। কায়াক বেশি। সেইসব নানা রঙের ডিঙি নৌকায় একজন, কি বড়জোর দুইজন। অলস দাঁড় টানায় কোন কোনটা এগোচ্ছে, না দাঁড়িয়ে আছে তার ফারাক বোঝা যাচ্ছে না। ভেসনার নৌকাটা অবশ্য তরতরিয়ে ভেসে চলেছে। লেকের দুই পার ধরে ছোট বড় অনেক কেবিন। কোন কোনটা আবার বিশাল বড়, প্যালেসের মত। ভেসনাকে বলতে জানাল অনেকে এখানে সব সময়ের জন্যেও থাকে। তাদেরটা বড়। তবে বেশির ভাগ ভেসনাদের মত, গরমের চার মাস ঘনঘন থাকতে চলে আসে।

তোমরা কি প্রতি সপ্তাহে এখানে আসো?

না, এখন আর অত না। ছেলেরা যখন ছোট ছিল নিয়ম করে প্রতি শুক্রবার চলে আসতাম। জর্জ আর স্টিফান দুজনেই এই লেক খুব ভালবাসত। এখন আর অত আসা হয় না। তবে স্টিফান আসে ওর গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে। বলতে বলতে থেমে গেল ভেসনা।

জলের উপর যখন সন্ধ্যা নামে তখন সে বড় মায়াময়। এই সময়ের আলোকেই কি বলে কনে দেখা আলো? হয়তো জলের কাছাকাছি থাকার জন্য স্বর্ণাভ আলোয় জড়িয়ে যায় বিষাদ। বিষণ্ণতা মাখানো স্বরে ভেসনা বলল, আদি আমাকে একটু আগে বলেছিলে না হিংসের কথা? আমি বলেছিলাম হিংসে করো না। কার মনে কোথায় যে কি সুপ্ত আছে জানি কি আমরা?

মনে পড়ল, একটু আগে এমনই কথা হয়েছিল বটে। আমি তখন অবাক হয়েছিলাম। ভেসনা সেই কথাটা আবার তুলছে দেখে বিস্ময় আরও বেড়ে গেল।

আদি ভ্রু বাঁকিয়ে ভেসনার দিকে চেয়েছিল। একটু আগের উচ্ছলতা ভুলে গিয়ে খুব মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করছিল ভেসনার কথা। বোঝবার।

নিজেকেই যেন বলছিল ভেসনা, জলের উপর শেষ বিকেলের আলো যাচাই করতে করতে। সদা উচ্ছল ভেসনার ছোঁড়া শব্দেরা এমনিতে বাড়ির চালে বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা পড়ার মতন। কিন্তু এখন যেন গ্যাবেল ধরে ধীরে ধীরে বৃষ্টি শেষের টুপটাপ মাটিতে গড়াচ্ছে। জর্জ আর স্টিফান সারাদিন এই জলে দাপাদাপি করত। দিনভর। কখনো সাঁতার, আবার কখনো কায়াক নিয়ে। অ্যাডাম আর আমি বেশির ভাগ সময় জেটিতে বসে মাছ ধরতাম। বিকেলের দিকে সবাই মিলে এই বোটটাতে ঘুরতে বেরোনো, অনেকটা রুটিনের মত, কত কথা, খুনশুটি। তারপর – গলাটা একদম ধরে গেল ভেসনার, জর্জের তখন একুশ, আই নাইন্টিফোরে গাড়ি ক্র্যাশ করে – জলের ধারা আটাকানোর চেষ্টায় সারা শরীরটা থরথর করে কাঁপছিল ভেসনার।

ওর ছেলে মারা গেছে? কবে? আমি অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম ভেসনার দিকে। জানতাম না তো! আদি উঠে গিয়ে ভেসনাকে দুই হাতে জড়িয়ে ওর কাঁধে মাথা রাখল। ভেসনা কিন্তু সোজা হয়ে বসেছিল। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, স্টিফান আমায় এসে বলল মামা, জর্জ একবার আমাকে বলেছিল যে মরে গেলেও আমি এই ডাক লেক ছেড়ে কোথাও যাবো না।

আমার তখন মাথা কাজ করছে না। কবে বলল জর্জ এইসব কথা?

বলেছে, অনেকবার। আমি জানি ও এই ডাক লেককে খুব ভালবাসত। আমার একটা কথা শুনবে, মামা? ওকে কবর না দিয়ে এই লেকের জলে রেখে দেওয়া যায় না?

কি করবো আমি? জর্জ যদি সেটাই চায়, আমি কি সেটা না করে থাকতে পারি? ওর বিষণ্ণ নীল চোখ মেলে দিল ভেসনা। তোমরা যেমন মৃতদেহ পুড়িয়ে দাও, জর্জকেও তাই করলাম। তারপর আমি, অ্যাডাম আর স্টিফান এই লেকের জলের সব খানে ঘুরে ঘুরে সেই ছাই ছড়িয়ে দিলাম। এই লেকটা আমার জর্জের সমাধি আদি, এখানে যখন নৌকা বেয়ে যাই মনে হয় প্রতি মুহূর্তে জর্জের সঙ্গেই আছি আমি।

আদি অস্ফূটে বলল, সরি ভেসনা, আমি হয়তো তোমাকে কোনভাবে দুঃখ দিয়ে ফেলেছি। তোমার কষ্টটা আমি বুঝি। একটা কথা জানো, আমি আজ এখানে আসব কি আসব না সকাল থেকে শুধু সেটাই ভাবছিলাম। চেন্নাইতে আমার ছেলের খুব জ্বর, গত তিনদিন ধরে। আজ সকালে আমার হাজব্যান্ড ফোন করে জানাল ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। আমি সেই থেকে ভিতরে ভিতরে এত চিন্তায় আছি। মনটা ভাল ছিল না। ভাবলাম আমি গোমড়া হয়ে থাকলে তোমাদের এত সুন্দর পার্টিটা ভন্ডুল হয়ে যাবে! তাই হয়তো একটু বেশি উচ্ছল দেখাতে গিয়ে…না হলে কোনদিন ওয়াইন খাইনা আমি।

স্টিভ অনেকক্ষণ চুপচাপ ছিল, যেমন কম কথা বলার মানুষ ও। জল ধরে তরতর করে নৌকা এগিয়ে যাচ্ছিল। স্টিয়ারিঙে বসেছিল। ছায়া নেমে আসছে, তাই নৌকা এখন উল্টোমুখে। ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, আমাদের সবার মধ্যে অনেকগুলো আমি থাকে সেটা ডাক লেকের মত জায়গায় একসঙ্গে আসলেই শুধু বোঝা যায়।

কতদিন আগে ভেসনা? আমি ভেসনার কাঁধে আলতো চাপ দিয়ে বললাম।

চার বছর। একুশ বছরের ছেলে চলে যাওয়া এক মায়ের কাছে যে কি! জর্জ জানত সে কথা, ওকে ছাড়া যে আমি বাঁচব না। বাঁচতামও না, ও ফিরে ফিরে না আসলে।

ফিরে আসে? খুব চমকে তাকালাম ভেসনার দিকে। কে ফিরে আসে?

একটু আগে মনার্কটাকে দেখলে না?

মনার্ক, মানে ওই প্রজাপতিটা? কি বলতে চাইছে ভেসনা ভেবে পেলাম না আমি। শুধু আমি না সকলেই ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল।

গরমকালে এরকম মনার্ক হাজারে হাজারে পাবে মিশিগানে, কিন্তু গরম ফুরালেই ওরা চলে যায় অনেকদূরে মেক্সিকোয়। শীতকালে যখন এখানে বরফ পড়ছে একটাকেও খুঁজে পাবে না। কক্ষনো। শুধু যেবার জর্জ চলে গেল সেইবার থেকে প্রতি ক্রিসমাসে আমার ডেকে একটা প্রজাপতি ঘুরে বেড়ায়। মনার্ক। একটাই। প্রত্যেক বছর। আমি জানি ও আসবেই, না আসলে আমার ক্রিসমাসই হবে না। বিশ্বাসে ভরপুর গলায় আবার টগবগ করে উঠছিল ভেসনা, যদিও চোখের পাতায় জলের ফোঁটা তখনো পড়ন্ত রোদে ঝিকমিক করছিল।

আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মায়ের মনের স্বান্তনা হবে আর কি। এটা ভেবে ভেসনা যদি খুশি থাকে ভালই তো। আদির চোখটা কিন্তু আনন্দে চকচক করে উঠেছিল। হাউ অ্যামেজিং ভেসনা। তুমি ঠিক বলেছ, মায়ের ভালবাসা ছেড়ে ছেলে কোথায় যাবে।

কার্ত্তিক অনেকক্ষন কোন কথা বলেনি। এবার গলা খাঁখাঁরি দিয়ে বলল, তোমরা কুরিঞ্জি ফুলের কথা শুনেছ?

হ্যাঁ হ্যাঁ মুন্নার গিয়ে দেখেছিলাম। আদি চেন্নাইয়ের মেয়ে, ও তো জানবেই। ভেসনা আর স্টিভ জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে ছিল। আমারও সেরকম কিছু জানা ছিল না।

নীলাকুরিঞ্জি, বারো বছরে একবার ফুল ফোটায়, তারপরে শুকিয়ে যায়। আমরা সবাই মিলে গেছিলাম কোডাইকানাল, যেবার কুরিঞ্জি ফুটেছিল। আমার ছেলে রঘু সারা পাহাড় সেই নীল রং ছেয়ে যেতে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল। ওর তখন বারো বছর হবে হবে। খুব এক্সাইটেড হয়ে বলেছিল, পাপ্পা, তাহলে আমি জন্মাবার পর পৃথিবী এই প্রথম কুরিঞ্জি ফুল দেখছে?

আমরা জানতাম না ও কুরিঞ্জি ফুল নিয়ে এসেছে বড়িতে টবে পুঁতবে বললে। আমি দেখে বললাম, ধুর রঘু। এসব কি বাড়ির বাগানে হয় নাকি। আর হলেও আবার এক যুগ পরে যখন হবে তুই এই বাড়িতেই থাকবি না, কোথায় কোন দেশে পড়তে কি চাকরি করতে চলে যাবি হয়তো। এই কথা বলেই কার্ত্তিক চোখ মুছল। গলা বুজে আসছিল। এর এক মাস বাদেই নিউমোনিয়ায় চলে গেল ছেলেটা।

খুব চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল সারা নৌকাটা। জলের ছল ছলাত ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। কার্ত্তিক আবার নিজেই কথা বলল, তুমি মনার্ক প্রজাপতির কথা বললে, আমি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি সেটা ভেসনা। কারণ রঘু চলে যাওয়ার পর আমার বাড়ির সেই টবে প্রতিবছর একটা কুরিঞ্জি ফুল ফোটে। ফুটবেই।

সেটা তো অসম্ভব কার্ত্তিক। তুমি কোন জুলজিস্টের সঙ্গে কথা বলেছ?

কুরিঞ্জি ফুলের জন্য অসম্ভব ক্রিস। কিন্তু আমার টবে তো কুরিঞ্জি ফুল আসে না, আসে আমাদের রঘু। ও ফিরে ফিরে না আসলে আমরা কি নিয়ে বাঁচতাম এতদিন?

ডাক লেকের জলে এখন আর কোন ছলাত ছল নেই। আমরাও চুপচাপ নিজের নিজের ভাবনায়। জলের উপর আলো মরে আসছিল, কিন্তু পশ্চিম আকাশে এখন পাহাড়ি মুরগির ডিম ভেঙে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, গাঢ় কমলা তার রং। আমাদের সবার চোখেমুখেও তার ছিঁটেফোটা গড়িয়ে পড়ছিল।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *