আফসানা বেগম
ব্যাপারটা প্রথম চোখে পড়েছিল যখন পিপাসায় গলা শুকিয়ে পানির বোতলের খোঁজে আমি ড্রিংক র্যাকের দিকে যেতে শুরু করলাম। দেখলাম যেতে পারছি না। সামান্যই তো জায়গা, দু’শ নব্বই বর্গফুট। কোনওদিকে যাব ভাবলে চোখের পলক ফেলার আগেই পৌঁছে যাওয়া যায়। তাই মুহূর্তেই র্যাকের সামনে পৌঁছে যাবার কথা। পরমুহূর্তে নির্দিষ্ট পানীয়ের বাটনে আঙুল ছোঁয়ালে নীলাভ ট্রে-তে বেরিয়ে আসার কথা পৃথিবীর স্বচ্ছতম পানি; সবচেয়ে বেশি পরিশোধিত। কিন্তু র্যাকের দিকে যেতে চাইতেই মনে হলো কেউ পিছন থেকে আমাকে টেনে ধরছে, কিংবা ঘুরিয়ে দিচ্ছে অন্যদিকে। কোমরের উপর থেকে শরীরটা একদিকে হেলে আছে তো নীচের দিকটা আরেকদিকে। আমি তাই নিজের উপরে জোর খাটিয়ে টেনেটুনে মিনিট পনের পরে ড্রিংক র্যাকের সামনে পৌঁছলাম। তারপর বাটন টিপতেই পানি। ঢক ঢক করে খেয়ে আবারও যেন অনিচ্ছাকৃত ফিরে এলাম স্লিপিং ব্যাগে। ব্যাগের জিপ ভীষণ মোলায়েম, টানার আগেই হাঁটু থেকে গলার কাছে উঠে এল। ছাদের দিকে তাকিয়ে ‘সময়’ বলতেই অন্ধকারে জোছনা পড়ার মতো দেখা গেল, রাত তিনটা চৌদ্দ বাজে। মাটির নীচে ‘মাইনাস ২৩’ তলায় জোছনা বা রোদের প্রশ্ন নেই। আমি বিশেষ স্পেসিফিকেশন দিয়ে ছাদে অদৃশ্য স্ক্রিন লাগিয়েছি। তাতে কখনও জোছনা, কখনও কড়া বা হালকা রোদ খেলে। জোছনা আর রোদের ঘড়িও বানিয়ে নিয়েছি। মাটির নীচের অ্যাপার্টমেন্টে থাকি, তাতে কী, রোদেলা আকাশ দেখতে আমার ভালো লাগে। রোদের ঘড়িও। সত্যি বলতে কী, আমার ব্যবহারের প্রায় সমস্তকিছুই বিশেষভাবে বানানো যাকে বলে কাস্টমাইজড। প্রত্যেকটা জিনিস আমার চাই সবচেয়ে ভালো। যেমন, আমার পায়ের পাতার জায়গায় আটকানো আটটা ছোট চাকা- এমন বিরল ধরনের টাইটেনিয়াম সংকর ধাতুর তৈরি যে পালকের চেয়েও হালকা। মাথা থেকে আদেশ পাওয়া মাত্র এক মুহূর্তে পৌঁছে যাওয়ার ব্যাপারে এর জুড়ি নেই। লাইফ টাইম গ্যারান্টি; যদিও জীবন শেষের এখন আর গ্যারান্টি নেই তেমন। শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গ দোকানে জারের মধ্যে সাজানো থাকে, মানবিক কিংবা কৃত্রিম। যখন যার যা লাগে, সময়মতো বসিয়ে নিলে আর মৃত্যু ছোঁবে কীভাবে! কিন্তু সে যাই হোক, আজ আমার পায়ের বিশেষ চাকাগুলোর কী হলো যে, যেদিকে যেতে চাচ্ছি সেদিকে যাওয়াই যাচ্ছে না?
স্লিপিং ব্যাগের ভিতরে মুখটা ঢুকিয়ে নিলে সবদিকে গাঢ় অন্ধকার। সমস্ত ইন্দ্রিয় কিছুক্ষণের জন্য থামিয়ে রেখে আমি ভাবতে থাকি, কাল সন্ধ্যায় কী হয়েছিল। কাল বিকেলের পরপর র্যাগিন এসেছিল। আমরা দুজনে দীর্ঘসময় বসে ওয়াইনের অনুকরণে বানানো একটা সিনথেটিক ড্রিংক খাচ্ছিলাম। রঙটা অবিকল আসল ওয়াইনের, গলানো রুবি যেন। পুরো একটা বোতল সাধারণত এক রাতে শেষ হয় না আমার। বহুদিন বাদে অতিথি আসায়, তা হয়েছিল। গল্পে গল্পে সিনথেটিক ওয়াইনটা কেন যেন এত মজা লাগছিল, একেবারে আসল ওয়াইনের মতো। পৃথিবীতে কি এখনও কাঠের পিপায় ওয়াইন তৈরি হয়? আঙুর জাতীয় ফল কোথাও টিকে আছে কি? কেবল অগুনতি প্রাচীন ওয়াইনের বোতল আছে বিশেষ গুদামে, আধশোয়া অবস্থায়। সেসবের দাম এত বেশি যে একজন মানুষের জীবনে এক-দুবারের বেশি খাওয়ার সৌভাগ্য হয় না। তাই সিনথেটিক ওয়াইনেই চলে যায়। তবে, বছর পনেরো আগে আসল ওয়াইন খাওয়ার যে স্বাদ জিভে আজও লেগে আছে, কাল রাতে সেই স্বাদ মনে পড়ছিল। তুমুল তৃপ্তিতে সমানে ওয়াইন খেলেও, যথেষ্ট পানি খাওয়া হয়নি। তাই মাঝরাতে পিপাসায় স্লিপিং ব্যাগ থেকে বেরোতে হলো। তখন অবশ্য বেশ গুছিয়ে শুয়ে পড়লাম, কিন্তু কেন যেন পা দুটো… ঠিক পা দুটো নয়, পায়ের পাতার জায়গায় লাগানো আটটা চাকা মৃদু কাঁপতে লাগল। মনে হলো আমি ব্যাগের ভিতরে থাকলেও, তারা থাকতে চায় না। এরকম অদ্ভুত ব্যাপার ২২০৩ সালে পা কেটে চাকা লাগানোর পর থেকে আজ পর্যন্ত ঘটেনি।
আমার মতো যারা পা প্রতিস্থাপন করে চাকা বসিয়েছে, তাদের কারো এমনটা হয়েছে বলেও শুনিনি। নাকি হয়েছে? আমি খোঁজ রাখিনি। স্লিপিং ব্যাগের ভিতরে বন্ধ চোখে শরীরটা কেঁপে উঠল। পায়ের জায়গায় চাকা লাগিয়ে ভুল করিনি তো? অবশ্য দেখেশুনেই তো সবচেয়ে ভালোটা লাগিয়েছিলাম- আমার যেমন স্বভাব। চাকাগুলো ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মোটর কোম্পানি, জেনারেল মোটর্স-এর। কয়েকশ’ বছর ধরে গাড়ি আর মানুষসহ মানুষের ব্যবহারের নানান জিনিসের চাকা বানানোর অভিজ্ঞতা আছে তাদের। তাদের বিরুদ্ধে হুট করে একটা অভিযোগ করলেই হবে না, প্রমাণ করতে হবে। ভাবতেই ব্যাগের ভিতরে হালকা শীত শীত করতে লাগল আমার। ঋতুর পরিবর্তন বোঝানোর জন্য আজকাল বিল্ডিঙের নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রার হেরফের করানো হচ্ছে হয়ত। এখন সম্ভবত শীত আসবে আসবে করছে। সুইচ টিপে ব্যাগের তাপমাত্রা এক ডিগ্রি বাড়িয়ে দিলাম। অথচ তার পরেও মাথার ভিতরে আমার পায়ের চাকাজনিত বিভ্রান্তি কাটল না।
২১৯০ সালের দিকে শোনা যাচ্ছিল, মানুষের শরীরের যে কোনো অঙ্গকে প্রতিস্থাপন করে অনেক বেশি কর্মক্ষম যান্ত্রিক অঙ্গ লাগানোর প্রক্রিয়া শুরু হবে। যারা কাজ করতে সারাক্ষণ হাতের ব্যবহার করে, তারা শুনে উত্তেজনায় ফেটে পড়ল। পৃথিবীতে একের পর এক যুদ্ধ আর মহামারিতে মানুষ প্রায় সাফ। কম মানুষের জন্য কাজের চাপও তাই ছিল অনেক বেশি। কাপড়ের, জুতার, এমনকি গাড়ির কারখানার লোকেরা তো তখন থেকে দিন গুনতে লাগল, কবে বাজারে যান্ত্রিক হাতগুলো এসে পড়বে। তারপর মূল্য সাধ্যের মধ্যে এলেই হলো। কোনও কোনও বড় কোম্পানি থেকে ঠিক করা হলো, প্রধান কর্মীরা চাইলে বায়োনিক হাত প্রতিস্থাপনের খরচ তারাই বহন করবে। যারা হাত কেটে ফেলে যান্ত্রিক হাত লাগাবে, তাদের জন্য বাড়তি বেতনের কথাও ঘোষণা করা হলো। আশেপাশের অবস্থা দেখেশুনে তাই তখন থেকেই আমি টাকা জমানো শুরু করলাম, যান্ত্রিক পা কিনব। ব্যাংকে সারাদিন চক্কর দিতে দিতে আমার পা দুটো ভেঙে আসে। চক্কর মানে হলো গিয়ে ম্যানেজমেন্ট বাই ওয়াকিং, টহলদারি চাকরি আর কী। ব্যাংকের বিল্ডিঙে সাতাশটা ফ্লোর। সবখানে কাজ ঠিকমতো চলছে কি না দেখতে আমার দিনের পাঁচ ঘণ্টা হাঁটতে হয়। লকার আর ভল্টের ঘরে বহুবার চক্কর লাগাই। জায়গাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ কত কত মাইক্রোচিপ থেকে শুরু করে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পর্যন্ত লুকিয়ে রেখেছে ভল্টে! ওই জায়গাটায় অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়। কাস্টমারকে সুরক্ষা দিতে না পারলে আর ব্যাংক কীসের?
তাই ভাবলাম নিজের পা বদলে দুটো বায়োনিক পা লাগাবো। দুপুরের পর থেকে হাঁটতে গেলে হাঁটুতে ব্যথা করে, এই ফালতু পা দুটো রেখেই বা আমার লাভ কী? নিজের শরীরের সঙ্গে প্রায় পঞ্চাশ বছর আছে দেখে মায়া পড়ে গেছিল বটে, তবে মায়া কাটিয়ে বায়োনিক পা লাগালে কদিনে ওটার উপরেও মায়া পড়বে। চোখের সামনে নতুন চশমা যেমন শরীরের অঙ্গ হতে সপ্তাহ দুয়েক লাগে, পা-এর ক্ষেত্রে তার চেয়েও কম সময় লাগবে বলে আমার ধারণা। কারণ, পা শুরু হবে কোমরের ঠিক নীচ থেকে, আসল পায়ের মতো। তাতে চশমার মতো খুলে রাখা নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, বাজারে স্বয়ংক্রিয় পা আসতে আসতে পায়ের দাম আমি জমিয়ে উঠতে পারলাম না। একে একে পরিচিত অনেকে নিজের অকার্যকর অঙ্গ ফেলে দিয়ে যান্ত্রিক অঙ্গ লাগিয়ে দিব্যি দ্বিগুণ-তিনগুণ টাকা আয় করতে লাগল। তারপর সময় বাঁচিয়ে অবসরে কৃত্রিমভাবে তৈরি আইস স্কেটিং স্কোয়্যারে গিয়েও মহা আনন্দে স্কেটিং করে কাটাতে লাগল। দেখেশুনে আমার আর তর সইল না। ওদিকে মিডিওকার কোম্পানির পা কমদামে কেনার মানুষ আমি নই। আমার সবকিছু হতে হবে সবচেয়ে ভালো জাতের। তাই অপেক্ষায় থাকলাম। একদিন এক হাসপাতালের সামনের দোকানে দেখি জেনারেল মোটর্স-এর দারুণ কতকগুলো চাকা। দেখতে অনেকটা স্কেটিং-এর জুতোর মতো; বলতে গেলে স্কেটিং জুতোই। যারা প্রচুর স্কেটিং করতে পছন্দ করে, বরফের উপরে হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী ব্যালে নাচ দিনরাত চর্চা করতে চায়, তাদের মনের মতো হবে হয়ত। কৌতূহল হল আমার, মানুষ এগুলো কেনে কেন? পায়ের পাতা কেটে এত কষ্ট করে এটা আটকে দেয়ার চেয়ে স্কেটিং জুতো পরে নিলেই কি চলে না? কিন্তু খানিক ভাবতেই বুঝতে পারলাম, জুতো তো আর মাথার কথা শোনে না, পা-কেই চলাফেরার জন্য সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এই চাকা শরীরে নিজস্ব অঙ্গ, তাই স্কেটিং জুতোর চেয়ে ১৮৩.৫৬ শতাংশ সময় আগে কাজ করে ফেলবে বলে চাকার গায়ে দাবি করা হয়েছে। আমি স্কেটিং মোটেও পছন্দ করি না। পৃথিবীর প্রায় বেশিরভাগ বরফ গলে গেছে দেখে আমি অনেকটা স্বস্তি বোধ করি। কিন্ত প্রায় প্রতি শহরেই কৃত্রিম আইস স্কেটিং গ্রাউন্ড আছে। বংশ পরম্পরায় যে কোনো ঋতুতে মানুষ সেসবে স্কেটিং করছে। যা হোক, আমি স্কেটিং না করলেও এই চাকাগুলো লাগালে সহজেই সাতাশ তলা চষে ফেলতে পারব, একটাও পা সামনে না বাড়িয়ে। বুদ্ধিটা আসতেই আমাকে আর পায় কে! মজার ব্যাপার হলো, চাকাগুলোর দাম আমার কিনতে চাওয়া আস্ত পায়ের দামের বিশ ভাগের এক ভাগ, যে টাকা আমার মাস চারেক আগেই জমে গেছে। যেই ভাবা সেই কাজ, পরের সপ্তাহে হাসপাতালে বুকিং পেয়ে গেলাম। শেষবারের মতো হাঁটুর ব্যথা সহ্য করে প্রায় লাফিয়ে গিয়ে বেডে শুয়ে পড়লাম। অপারেশনে লাগল তেত্রিশ ঘণ্টা সাত মিনিট। পায়ের পাতা হাওয়া করে দুই পায়ে চার চার করে আটটা চাকাসমেত গড়িয়ে গড়িয়ে পাঁচ দিন পরে বাসায় পৌঁছলাম।
জেনারেল মোটর্স কোম্পানির হেড অফিসের মাদার কম্পিউটারের সঙ্গে চাকাগুলোর যোগাযোগ। জানলাম, কোনও সমস্যা দেখা দিলে সেখান থেকে নাকি ঠিক করে দেয়া হবে। স্লিপিং ব্যাগে শুয়ে এই কথাটা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার স্বস্তি লাগতে শুরু করল। এতক্ষণে সেখানকার মাদার কম্পিউটারে নিশ্চয় আমার পায়ের সমস্যার ব্যাপারে খবর চলে গেছে। প্রোগ্রামের কিছু উলটোপালটা হলে কাল সকালের আগেই ঠিক হয়ে যাবার কথা। এর চেয়ে বেশি সময় লাগলে তাদের কৃত্রিম অঙ্গ বিক্রির ব্যবসা লাটে উঠবে। আমি তাই নিশ্চিন্ত মনে চোখ বুজে ফেললাম। ওয়াইনের খানিক প্রভাব হয়ত শরীরে তখনও ছিল, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালে চোখ কচলে ছাদের আলোছায়ার দিকে তাকিয়ে ‘খবরের কাগজ’ বলতেই খবরের কাগজের অ্যাপ চালু হয়ে গেল। সকালের হালকা আর মিহি রোদের মতো ঘরটাতে কালো কালো কলাম ভেসে উঠল ছাদ জুড়ে। পৃথিবীর প্রধান সব কয়টি পত্রিকার প্রথম পাতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হেডলাইন হিসেবে একটাই খবর বারবার ভেসে উঠতে লাগল, ‘জেনারেল মোটর্স কোম্পানির মাদার কম্পিউটার হ্যাকারের দখলে। লক্ষ লক্ষ কৃত্রিম অঙ্গ পরিচালনায় ব্যর্থতার অভিযোগ।’
এক মুহূর্তে আমার সমস্ত শরীরে ঝিঁ ঝিঁ ধরে গেল। বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নামতে গিয়ে মেঝেতে পা লাগতেই পিছলে গেলাম। পায়ের চাকাগুলো অনেক বেশি গতিসম্পন্ন। সিলিকন রাবার দেয়া সামান্য নরম মেঝেতে পড়লেও, আমি নিয়ন্ত্রণহীন শরীরসমেত সোজা গিয়ে ড্রিংক র্যাকের সঙ্গে ধাক্কা খেলাম। আমার ধাক্কায় র্যাক থেকে ছোটো ট্রে বেরিয়ে এল, তাতে এক কাপ কৃত্রিম লেবু চা। র্যাক ধরে কোনওরকমে উঠে আমি চায়ে চুমুক দিলাম। চা পেটে পড়লে মাথা অনেকটা কাজ করতে শুরু করল। আমার পায়ের চাকার নিয়ন্ত্রণ তাহলে এখন অন্য কারো হাতে। হ্যাকার সনাক্ত না হওয়া পর্যন্ত কোম্পানির কিছুই করার নেই- এই হলো ব্যাপার। কিন্তু কিছু মানুষের চোখ-কান-হাত-পায়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কারো কী লাভ হতে পারে আমার চিন্তায় কুলাল না। ঠিক তখনই পরপর দুটো মেইল আসার আওয়াজ পেলাম। মেইল দুটো পাশাপাশি দেয়ালে ভেসে উঠল। একটি জেনারেল মোটর্স থেকে। তারা খুবই দুঃখিত। পরিস্থিতি তাদের কল্পনার এবং নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। তবে চেষ্টা চলছে। দ্রুত আমি আমার পায়ের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাব বলে ভরসা দেয়ার চেষ্টা। আরেকটি মেইল আমি তিনবার পড়লাম। যতবার পড়লাম ততবারই চমকে উঠলাম। মেইলে লেখা, ‘তোমার পায়ের নিয়ন্ত্রণ এখন আমাদের হাতে। আপাতত চাকার কার্যক্ষমতা বন্ধ করা আছে। তুমি তো জানো, পায়ের পাতা কেটে বাদ দিয়ে চাকা সহজে লাগাতে পারলেও, চাকা থেকে আর পায়ে ফেরা যায় না। এখন একমাত্র তুমি যদি আমাদের ইচ্ছেমতো কোনও জায়গায় গিয়ে আমাদের কথামতো কিছু কাজ করে দিতে রাজি হও, তবেই পায়ের কার্যক্ষমতা ফিরে পাবে। বাকিটা তোমার ইচ্ছা। পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করলে আর কখনো হাঁটতে হবে না তোমাকে।’
আমি কাঁপা কাঁপা আঙুল ছুঁইয়ে দেয়ালে লিখলাম, ‘আমাকে কী করতে হবে?’
মাত্র তেরো ন্যানো সেকেন্ড পরে উত্তর এল, ‘তোমার ব্যাংকের বেশ কিছু ক্যামেরা আর অ্যালার্ম ডিজেবেল করবে। তারপর ভল্টে যাবে। সেখানে কোথায় কী আছে সব তোমার মুখস্ত। আমি যা বলব তা উঠিয়ে নিয়ে আসবে।’
বুঝলাম, মেইলের উত্তর হয়ত আগেই তৈরি করা ছিল, কিংবা ওপাশে বসে আছে কোনও রোবট। অর্ধমানবও হতে পারে। আমি মেইলটির দিকে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম। কিছুক্ষণ পরে টুপ করে আরকেটি মেইল এল, ‘তুমি কিন্তু ইতিমধ্যেই সাত মিনিট তেত্রিশ সেকেন্ড পাঁচ ন্যানো সেকেন্ড নিয়েছ। তোমার মাথার ভিতরে কী চলছে? চালাকি করে লাভ নেই।’
আমি আসলে চালাকি করতে চাচ্ছিলাম না। বরং মনে মনে ব্যাংকের ভল্টের বিভিন্ন ড্রয়ার আর তাকগুলোতে চোখ বোলাচ্ছিলাম। কে হতে পারে এই হ্যাকার ওরফে চোর! কী দরকার থাকতে পারে তার… বেশি কিছু ভাবার আগেই আরেকটি মেইল, ‘কী ভাবছ তুমি, কথা বলছ না কেন?’
‘আশ্চর্য, তুমি কি আমার মাথাটাও হ্যাক করতে চাও?’
‘পারলে করতাম। কিন্তু তুমি এখনও মাথায় কোনো বায়োনিক পার্টস লাগাওনি। তাই সেটা পারছি না।’
হ্যাকারের স্পষ্ট উত্তর। ওই মুহূর্তে মাথায় বায়োনিক পার্টস লাগাইনি বলে মনে মনে অদ্ভুত আমোদ হলো। একবার ভেবেছিলাম ব্যাংকের বড় বড় সংখ্যার গুন আর ভাগ করার জন্য কিছু নিউরন বদলে নেবো, শুধু শুধু কম্পিউটার বা ক্যালকুলেটরের উপরে নির্ভরশীলতা কমবে। কিন্তু নিইনি, নিউরনের দাম ছিল আমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ভাবনা থেকে বেরিয়ে আমি টয়লেটের দিকে যেতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু ড্রিংক র্যাক ছেড়ে দিতেই আবার আরেকদিকে পিছলে পড়লাম। আছাড় খাওয়ার পরে হুঁশ হলো, আমার পা আর আমার অধীনে নেই!
‘তুমি হাঁটার চেষ্টা করছ নাকি? আশ্চর্য তো! তোমার কি বিশ্বাস হয়নি যে আমি তোমার পায়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছি? মাথাটা হ্যাক করতে পারিনি বটে, তবে পায়ের ভিতর দিয়েই তোমার মাথাকে নিয়ন্ত্রণ করব। আরেকবার হাঁটতে চেষ্টা করলে এর চেয়ে বড়ো আছাড় খাওয়াব, জেনে রেখো।’
কোমরে মারাত্মক ব্যথা পাওয়ায় মেঝেতে সটান শুয়ে পড়লাম। সিলিকনের আরামদায়ক মেঝে আঁকড়ে মনে মনে ভাবলাম, ‘আমি কি ওর হাতে বন্দি!’
‘তুমি আমার হাতে বন্দি। এতক্ষণে বুঝতে পেরেছ নিশ্চয়।’
কথাটা শুনে চমকে উঠলাম। আমার মাথাটাও সত্যি সত্যি হ্যাক হয়ে গেল নাকি!
‘এবারে বলো, যাবে তো আগামীকাল রাতে? কাউকে বললে কিন্তু…’
মেঝে থেকে কোঁকাতে কোঁকাতে উঠে দেয়ালের দিকে আঙুল বাড়ালাম, ‘যাবো,’ লেখাটা কেঁপে বেঁকে গেল। ক্ষতি নেই, সে অবশ্য তার সেট করা ফন্টেই দেখবে।
উত্তর এল, ‘ধন্যবাদ। পুরো এলাকার যোগাযোগ জ্যাম করে দেবো। তোমার অবস্থান কেউ জানবে না। তা ছাড়া, সবাই জানে তোমার পা হ্যাক হয়েছে, হাঁটতে পারছ না। কেউ তোমাকে দেখলেও প্রমাণ করতে পারবে না। বাদ দাও, আসল কথা হলো, জিনিসের নামটা ব্যাংকের গেটের সামনে ময়লা ফেলার ঝুড়ির উপরে পাবে।’
পায়ের নিয়ন্ত্রণ নেই দেখে অফিসে যেতে পারলাম না সেদিন। অফিস থেকে মেসেজ পাঠিয়ে সমবেদনা জানানো হলো। কে না জানে, বায়োনিক হাত-পাওলা মানুষদের আজ কী দুর্দশা! মন খারাপ করে বসে থাকলাম। কিন্তু সন্ধ্যার দিকে আকস্মিক সব ঠিক। নিজেই উঠে দাঁড়ালাম। দরজা খুলে লম্বা করিডোর ধরে লিফটে উঠলাম। রাস্তায় যখন বেরিয়েছি তখন আকাশটা লালচে। সোজা ব্যাংকের দিকে বয়ে যেতে লাগলাম। পায়ের চাকা যেন আগের চেয়েও সহজে গড়াচ্ছে। কিন্তু ব্যাংকের দিকে কেন যাচ্ছি আমি? এতক্ষণে ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাবার কথা। আমি তবু হনহন করে সেদিকেই ধাবমান। নিজেকে কিছুতে ঠেকাতে পারছি না। ঘোরাতে পারছি না কোনওদিকে। বুঝতে পেরে আমার শরীর হিম হয়ে এল, হ্যাকার আমার পায়ের চাকাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে! আমার বাকি শরীর তার দখলে নেই, কিন্তু পায়ের সঙ্গে না গিয়ে শরীরের উপায়ও নেই।
ব্যাংকে কোথায় কোথায় ক্যামেরা লাগানো আছে আমি জানি। ময়লা ফেলার ভান করে প্রথমে ঝুড়ির উপর থেকে নামটা নিয়ে নিলাম। গেট থেকে একটা একটা করে ক্যামেরা নষ্ট করতে লাগলাম। কোনটা টেনে নামিয়ে, কেনোটা ঢিল দিয়ে, কোনোটার উপরে জ্যাকেট চড়িয়ে। তারপর এগোলাম। করিডোরে কয়েকটা পাহারাদার রোবট এলোমেলো ঘুরছে। চেনা মানুষ দেখে কোনও প্রতিক্রিয়া দেখাল না। কন্ট্রোল রুমের দুজন অফিসার গেটের দিকে আসছিল, আমাকে দেখে বলল, “তিনটা ক্যামেরা ডিসকানেক্টেড হয়েছে, কাউকে দেখেছ নাকি এদিকে?” আমি ঠোঁট উলটে ডানে-বামে মাথা নাড়লাম। হঠাৎ মনে হলো, চারদিকে এতগুলো ক্যামেরা… এসব নষ্ট করতে করতে রাত ভোর হয়ে যাবে। তাই সরাসরি কন্ট্রোল রুমে ঢুকে গেলাম। তখন রাত হয়ে গেছে। একজন মাত্র অফিসার অগুনতি মনিটরের সামনে বসে আছে। আমাকে দেখতেই চেয়ার ঘুরিয়ে নিল, “আরে, রুহান যে! তোমার পায়ের চাকা কাজ করছে? তবে যে শুনলাম…”
পায়ের দিকে ঝুঁকে তাকাতেই আমি তার ঘাড় বরাবর কনুই দিয়ে আঘাত করলাম। সে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ল। কন্ট্রোলারে এক সপ্তাহ আগের রেকর্ড করা দৃশ্য চালিয়ে দিলাম। মনিটরগুলোকে দেখতে তখন একইরকমের, কেবল নীচে তারিখ আলাদা। খুবই ছোট করে লেখা তারিখ চট করে চোখে পড়ে না। তবু, কাজ সারতে হবে দ্রুত। আঙুলের ছোঁয়ায় একটার পর একটা দরজা খুলে গড়িয়ে গড়িয়ে সোজা ভল্টে ঢুকে গেলাম। পকেট থেকে বের করে দেখলাম, স্বচ্ছ প্লাস্টিকের টুকরোয় ভল্টের ড্রয়ারের নম্বর আর জিনিসের নাম লেখা। একটা মাইক্রোচিপ চায় হ্যাকার। একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ীর শরীরে লাগানো ছিল। মৃত্যুর পরে পরিবার তার মাইক্রোচিপটা খুলে ভল্টে রেখেছে। বুঝতে বাকি থাকে না, হ্যাকার ওই পরিবারেরই কেউ যে ব্যবসায়ীর স্মৃতিগুলো চায়। ব্যবসার বা মালিকানার গোপন কিছু জানতে চায়। যা হোক, কেন চায় সেটা হ্যাকারের ব্যাপার। আমার সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর আগ্রহ নেই। আমার দরকার নিজের পায়ের নিয়ন্ত্রণ। তাই চিপটা নিয়ে গিয়ে তার হাতে তুলে দিলেই হলো।
ভল্টে ঢুকে সবসময় যা করি, তখনও তাই করলাম। বামদিকে ঝোলানো ‘মাস্টার কি’ হাতে নিলাম। তারপর নির্দিষ্ট লকারের সামনে গিয়ে আমার চোখ, আঙুল আর মাস্টার কি-এর মোচড়, সব মিলিয়ে তাকটা খুললাম। ধনাঢ্য পরিবারের অভিজাত জিনিসপত্রের স্তূপের সামনে কাচের ছোট বাক্সে মাইক্রোচিপটা রাখা। সাবধানে হাতে তুলে নিতেই চোখ পড়ল পাশে রাখা প্রাচীন মখমলের রক্তলাল একটা বাকসের দিকে। কাঁপা কাঁপা হাতে বাক্সটা খুললাম। ভিতরে অজস্র অমূল্য রত্ন। ভল্টের আলো হীরা-রুবিতে ঠিকরে আমার চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দিল। রত্নগুলোর দিকে অপলক তাকিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলাম। হঠাৎ কেমন গা ছমছমে একটা অনুভূতি হলো। এই এলাকায় যোগাযোগের উপায়গুলো আর কোনওদিন জ্যাম হবে না। এটাই সুবর্ণ সুযোগ… সারাজীবন আমি যা যা কিছুর জন্য টাকা জমাতে চেয়েও পারিনি… প্রথমেই নিউরনগুলো বদলে ফেলব, নতুন কিছু করে সারা পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দেব। কয়েক সেকেন্ডের দ্বিধার পরেই মখমলের বাকসোটা জ্যাকেটের পকেটে পুরলাম। আরও কিছু বাক্সও ভরে নিলাম হাতের ব্যাগে। আমার জানা আরও কয়েকটা লকার খুলে ভয়ানক মূল্যবান কিছু জিনিস ব্যাগে ভরে ফেললাম। তারপর বেরিয়ে এলাম। মাইক্রোচিপের বাক্সটা ময়লার ঝুড়ির পাশে ফেলে রাখলাম, হ্যাকার যেমনটা চেয়েছিল। ইচ্ছে থাকলেও, তাকে দেখার আশায় ওখানে দাঁড়িয়ে থাকার প্রশ্ন নেই। আমার নিজেরই তখন দ্রুত সটকে পড়া দরকার। লম্বা করিডোর আর মসৃণ রাস্তা ধরে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি গতির চাকাগুলোয় গড়িয়ে বাসার সামনে এসে পৌঁছতে সময় লাগল মাত্র কয়েক মিনিট। তারপর আত্মগোপনের মতো মাটির নীচের মাইনাস ২৩ তলায় ঢুকে গেলাম।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই ওই এলাকায় যোগাযোগের জ্যাম ছুটে গেছে। কন্ট্রোল রুমেও আবিষ্কার করা হয়েছে যে পুরোনো রেকর্ড দেখানো হচ্ছে। খতিয়ে দেখতে গিয়ে জানা গেছে যে ভল্টে কত বড় রকমের চুরি হয়ে গেছে… আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এল। আমি তো কোনওদিন চুরির কথা ভাবিনি! এত বছর ব্যাংকে চাকরি করছি, চাইলে কত আগেই… যা হোক আমার পা এখন ভালোমতো কাজ করছে। যেমন খুশি নড়াচড়া করতে পারছি। শরীরে পঙ্গুত্বের অনুভূতি আর নেই। কিন্তু কাল যখন জানা যাবে ভল্টে কী কী নেই, তখন এই হীরা-জহরত আমি কোথাও বের করতে পারব না। মাটি থেকে ২৭০ ফুট নীচে ওগুলো নিয়ে বসে থাকতে হবে আমাকে। কেন যেন আগের চেয়েও বেশি পঙ্গুত্বের অনুভূতি আমাকে ঘায়েল করে ফেলল। একাকী জীবনের এই যেন এক কারাগার আমার। এমনভাবে পা ছড়িয়ে চুরির মালামালভরা ব্যাগটার পাশে ধপাস করে বসে পড়লাম যেন এখনও আমার পায়ের উপরে নিয়ন্ত্রণ নেই!
সিলিকনের মেঝেতেই হিম হয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম সারা রাত। সকালে চোখ মেলতেই দেয়ালে আলোছায়ার মতো মেসেজ ভেসে উঠল, ‘তোমাকে যা ভেবেছিলাম, তুমি মোটেও তা নও। তুমি তো দেখি পাকা চোর! তোমার পা দুটো তাহলে আমার দখলেই থাক।’
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন