মৃন্ময়ার গায়ে হলুদ সোমবার। মাঝে কয়েক ঘন্টা। এরমধ্যে হয়ে গেছে পানচিনি, প্রপসাল সিরেমনি, এনগেইজমেন্ট, ব্রাইডাল শাওয়ার, ব্যাচেলরস পার্টি, সংগীত। হলুদের পরদিন মেহেদি। আত্মীয়, অনাত্মীয় স্বজনরা হিমসীম খাচ্ছেন সাজু-গুজু আর খাওয়া-দাওয়া, অনুষ্ঠান আনন্দ-ফুর্তির ঠেলা-ঠেলিতে। অনেকেই ভিড় টপকে বেরুতে পারছেন না বলে এ ক’দিন ডায়াটের রশিটা ছেড়ে দিয়েছেন।
একমাত্র ছেলের বউ, আর একমাত্র মেয়ে হওয়ার ঝক্কি সামলাচ্ছে মৃন্ময়াও। মাথা ঠান্ডা রাখতে হচ্ছে নাছির উদ্দিনকে। মেয়ে অন্তঃপ্রাণ বাবা তিনি। যদিও প্রায় দশবছর অনুরূপের সাথে দেখা নেই মৃন্ময়ার। তবু তার আপত্তিও নেই এই বিয়েতে। অনুরূপ হ্যান্ডসাম, এডুকেডেট ছেলে। ওকে নিয়ে অনেক স্বপ্নও দেখেছে মৃন্ময়া। যে স্বপ্নগুলো শুধু তারই।
একমাত্র মেয়ের বিয়েতে সামান্য কমতি রাখতে চান না নাছির উদ্দিন। প্রত্যেক অনুষ্ঠানের গেস্টদের শাড়ি, পাঞ্জাবী, বাচ্চাদের ড্রেস। এগুলোর কালার ডিজাইন ভিন্ন ভিন্ন। এতো সব মাথায় রাখতে পারবেন না বলেই ছোট ভাই মিতুল ও তার বউ বেবীকে দায়িত্ব দিয়েছেন। বেবীর আজ সকাল থেকেই হেডেক। সে তাকাতে পর্যন্ত পারছে না। চোখ পিটপিট করে ভাসুরকে বলছে,
-দাদা, আমি আর পারছি না।
-কেন হঠাৎ তোমার কী হয়েছে? নাছির উদ্দিন বললেন।
এমন কথায় বেবীর সন্দেহ হচ্ছে, একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে বলে নাছির উদ্দিনের মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে না তো? তিনি দেখেও দেখছেন না। প্রচন্ড মাথাব্যথা নিয়ে তার সামনে জলজ্যান্ত মানুষটা দাঁড়িয়ে। অথচ তিনি জানতে চাইছেন,
“কী হয়েছে?” সে সন্দেহটা ফরখ করবার জন্য ফের বলল,
-দাদা, আপনি দায়িত্বটা অন্য কাউকে দিন। আমার দ্বারা সম্ভব নয়।
নাছির উদ্দিন অবাক দৃষ্টিতে বেবীর দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন,
-তোমরা মেয়েরা অল্পতেই মান-অভিমান কর। বিয়ের সময় এসব দূর করে দাও। যা হবার পরে হবে।
বেবী মন খারাপ করে নাছির উদ্দিনের সামন থেকে চলে গেলেন। মৃন্ময়ার মা বীণা একটি ফর্দ হাতে স্বামীর সামনে দাঁড়ালেন। কোন ভনিতা না করেই বললেন,
-এই জিনস পত্রগুলো ছেলের বাড়িতে মেহেদি ও বিয়ের জন্য পাঠাতে লাগবে।
নাছির উদ্দিন ফর্দটি পরখ করে বললেন,
-এসব আনানো হয়ে গেছে। ওগুলোর র্যাপিংয়ের দায়িত্ব রফিকুলের। ও বাড়িতে কে কে যাচ্ছে সে লিস্ট করেছো কি? নাকি তাও আমাকেই দেখতে হবে। তুমি চিরকাল অপদার্থই রয়ে গেলে। মেয়ের বিয়ে কোথায় কী হচ্ছে না হচ্ছে সে নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। যে কাজ হয়ে যাচ্ছে তার ফর্দ নিয়ে আসছো। যা হয়নি তা অন্তত মনে করিয়ে দাও।
বীণার কালো মুখটা আরো কালো হয়ে গেলো। সত্যি এপর্যন্ত সে একটা কাজও নাছির উদ্দিনের আগে আগে ভেবে করতে পারেনি। এটা কি সে কখনও কতৃত্ব পায়নি বলেই হচ্ছে? হয়ত সে কারণেই সাহস করে কিছু করা হয়ে উঠছে না।
নাছির উদ্দিন বললেন,
-যাও, ও বাড়িতে কে কে যাবে তাদের জানিয়ে দাও। কেউ পার্লারে যেতে চাইলে তাকে পাঠিয়ে দাও। বসিরকে বললে সে গাড়ি ম্যানেজ করে দিবে।
বীণা বলে,
-বেবীর মাথা ব্যথা মেয়েটা শুয়ে আছে সকাল থেকে।
-আরে কী বলছো শুয়ে আছে? সামান্য আগেই এসেছিল আমার কাছে। গিয়ে দেখ মাথা ব্যথা-ট্যাথা কিছুই নয়। অভিমান হয়েছে কোন কারণে। তুমি ওসব নিয়ে ভেব না। আমি ওকে বুঝিয়ে দিয়েছি।
বীণা স্বামীর কথায় আহত হয়। লোকটা মেয়ের বিয়ের আনন্দে উন্মাতাল হয়ে গেছে নাকি? মানুষের শরীর খারাপটাও চোখে পড়ছে না? বীণা কথা না বাড়িয়ে চলে যায়। তার উপর অর্পিত দায়িত্বটা সে ভালো ভাবে সম্পূর্ণ করতে চায়।
বীণার পশ্চাত পথের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাছির উদ্দিন। মনে মনে বলে, “না বর্জন করতে পেরেছি, না গ্রহণ। জীবনটা খোরমা হয়ে গেল।” সাদা পাঞ্জাবির উপর পরা উত্তরিয়টা খুলে এসিসটেন্ট বসিরের হাতে দিলেন। ঐ মুহূর্তে অনুশ্রী একমগ জুস এনে তার সামনে দাঁড়ালো। অনুশ্রীকে দেখলেই তার মাথা ঘুরে যায়। একথা অনুশ্রী ভালো করেই জানে। ওর বডি সেভটা ষোলবছরের যুবতীর মতো। এই চল্লিশ বছর বয়সেও গেঞ্জি টাইটস কিংবা টপস্ প্লাজু পরে বেড়ায়। ওকে দেখলে কেউই বলবে না মৃন্ময়ার মায়ের ইমিডিয়েট ছোট। মনে হবে মৃন্ময়ার ছোটবোন। দু’বোনের চালচলন, কথা-বার্তায় আকাশ-পাতাল তফাত।
অনুশ্রী এখন পরে আছে সাদার উপরে হাল্কানীল টপস্ তার সাথে নীল সরু ওড়না, সাদা প্লাজু, নীল স্যান্ডেল। কপালে নীল টিপ। ওর টপস্ এর ভেতর কালো অন্তর্বাসের অবয়ব স্পষ্ট।
নাছির উদ্দিন জুসের গ্লাসটি নিতে নিতে নিচু গলায় বললেন,
-মাথা নষ্ট করিস না। বাড়ি ভর্তি গেস্ট দেখিস না?
অনুশ্রীর চোখ হাসে। সে আরো ফিসফিস করে বলে,
-অন্য কোথাও চলো। অনেকদিন কেটেছে। আর সম্ভব নয়।
-বুঝতে চেষ্টা করো অনু! প্লীজ!
-কাজ হবে না। শরীর বুঝলে মন বুঝবে। আমি নাকাল। তোরে খেতে হবে।
নাছির উদ্দিন অনুশ্রীর এ ভাষার অর্থ ভালো করেই বুঝে। তিনি বুঝতে পারেন ওকে আর দমিয়ে রাখা যাবে না। ক্ষুধার্ত মানুষকে খাবার না দিয়ে অর্থ জৌলুসের লোভ দেখানো নিরর্থক। তিনি জুসের খালি মগটি ট্রেতে রাখতে রাখতে বললেন,
-সন্ধ্যায়।
অনুশ্রী ডিভোর্সি। তারপরও নাছির উদ্দিন তাকে বিয়ে করতে দেয়নি। অনুশ্রীও এ নিয়ে মাথা ঘামায়নি। নাছির উদ্দিনের মতো বিত্ত-বৈভব আর সুঠাম দেহের অধিকারীকে ছেড়ে কোন পাগল অন্য কোথাও যায়? সে নাছির উদ্দিনের দলিলহীন বউ হয়ে রইল। দুজন দুজনাকে প্রচন্ড ফিল করে। তবে ভালোবাসে কিনা তারা জানে না। নাছির উদ্দিনের যেমন অন্য মেয়েদের প্রতি মোহ আছে। তেমনি অনুশ্রীরও আছে অন্য পুরুষের প্রতি লোভ। এটি জানে নাছির উদ্দিন। এনিয়ে তার মাথা ব্যথা নেই। সুন্দরকে বন্দি না রেখে বিলিয়ে দেওয়াই মজা।
অনুশ্রী রহস্যময় হাসে। ওর স্টেট করা চুলগুলো হাওয়ায় উড়ে নাকে মুখে পড়ে ওকে আরো সুন্দরী করে তুলেছে। ওকে এখুনি খুন করতে ইচ্ছে করে নাছির উদ্দিনের। কিন্তু ফুল নিয়ে আসা লোকগুলো ডাকে,
-ফুল রাখবার জায়গা দেখিয়ে দিন।
তুর্য, তৃষা, তিতলি, কর্ণিয়া, মিনহাজ ও স্বপ্নকে এগুলো সাজানোর দায়িত্ব দিয়েছেন। ফুল নিয়ে এসেছে অথচ একজনেরও পাত্তা নেই। বেলা দশটা বাজে। এরা কখন কী করবে?
তিনি চিন্তিত হলেন। সবাই এমন গা ছাড়া ভাব করছে কেন? এতো রিচপনসিবল হলে চলবে কি করে? এরা সবাই লা’পাত্তা হয়ে কোথায় গেল?
এসময় মৃন্ময়া এসে বলল,
-বাবা! তোমার ড্রেস ডিজাইনার কি করেছে দেখ। আজ আমার হলুদ, আর সে মেহেদির ড্রেসের ডেলিভারি দিয়ে গেছে। এখন?
-আমি দেখছি মা, তুমি চিন্তা করো না! তোমার হলুদের আগেই পেয়ে যাবে।
-হুম! দেখ, মেহেদি ইভেন্টে আর বিয়ের ড্রেসে যেন গরমিল না হয়। আর শোন, হল রুমের প্রজেক্টর কাজ করছে না ঠিকমত। কাল আমার মেহেদি। প্রজেক্টর ছাড়া কিভাবে হবে বাবা!
-আহারে! এত টেনশান করলে হয়! বাবা আছি টেনশান করবার জন্য। তুমি যাও, তোমার প্রস্তুতি নাও। আমি দেখছি এসব। কাল মেহেদিতে ফটোশুট আছে। আমার মাকে রাজকন্যার মতো দেখতে লাগে যেন। ফ্রি মুডে থাক মা। তোমার প্লানগুলো বাবাকে বলে যাও। আমি রফিকুলকে বলে দিচ্ছি। ও খুব একটিভ ছেলে। হলুদের আগেই প্রজেক্টর ঠিক হয়ে যাবে। আর ড্রেস নিয়েও ভাবনা করিও না।
রফিকুল সুদর্শন ছেলে। মৃন্ময়ার মামাতো ভাই। আমেরিকায় থাকে। ব্যারিস্টারি পড়তে গিয়ে আর ফেরেনি। সিটিজেনশীপ পেয়েছে গত চারবছর। সহপাঠি অরুনিবাকে বিয়ে করেছে। তাদের দু’ মেয়ে। নব আর বর্ষ।
মূলত মৃন্ময়ার বিয়ে কেন্দ্র করে সপরিবারে আসা গত মাসের শুরুর দিকে। অরুনিবার বাড়ি, নিজ বাড়ি, ভাই-বোনদের বাড়ি, ক্লাব, হাট-বাজারে ঘোরা সব মিলিয়ে একমাস শেষ হয়ে গেল। তারপর থেকে ফুফুর বাড়িতেই আছে। একমাত্র ফুফুর একমাত্র মেয়ের বিয়ে প্রস্তুতির শেষ নেই। গত পনেরো দিন থেকে চলছে একের পর এক অনুষ্ঠান। ইটালির ছেলে। ফুফা আর তার বাবা এক্সপোর্ট-ইনপোর্ট বিজনেস পার্টনার। তাছাড়া নিজস্ব জাহাজ, প্লেন, হোটেল, ঢাকা চিটাগাং রুটে চারটে এসি হিনো বাস আছে সেয়ারে। তারা তাদের সাথে জালের মতোই জড়িয়ে আছে।
-উফ! বাবা! রফিক ভাই এসব পারবে? সে কখনও এসব করেছে? ও একটা হাদারাম। সব গুবলেট করে দিবে।
-ওহ! হ্যাঁ, হ্যাঁ, রফিক কখনও এসব করেনি। কিন্তু মা ছেলেটি বিদেশ ফেরত এবং রুচিশীল। তাছাড়া তোর ছোট বেলাকার বন্ধু।
-ধুর বাবা! ওনাকে আমি ভরসা পাচ্ছি না।
-হা-হা-হা!
-তুমি হাসছো?
-একটা কাজ দেখ তার। যদি পছন্দ না হয় তবে অন্য কাউকে দিবো। আর ড্রেসের দিকটা তবে অনুশ্রী আর আমি দেখছি। ওকে নিয়ে তোর ড্রেস ডিজাইনারের কাছে এখুনি যাচ্ছি। আমরাই দেখি এ বিষয়টি। বসির আমার গাড়িটি বের করতে বল। মৃন্ময়া তুমি কুইকলী অণুশ্রীকে পাঠাও।
মৃন্ময়া বাবার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকায়। বাবা আর অনুশ্রী আন্টির বিষয়টি সে প্রথমে আবিষ্কার করেছে। মাকে বলেছে। এ নিয়ে পরিবারের অশান্তির শেষ হয়নি। শেষে বাবা মাকে সাফ সাফ বলে দিয়েছে,
-তোমার এতে আপত্তি থাকলে রাস্তা মাপো। কখনো অনুশ্রীকে এ নিয়ে কিছু বলবে না। যদি বল তবে তালাকনামা পেয়ে যাবে।
মা কেন যে আর কিছু বলে নি, সব চেপে গেছেন মৃন্ময়া জানে না। আজ মেয়ের হলুদের দিনেও তারা ডেটিং করতে যাবে? যেতেই হবে? মৃন্ময়া তার অভিব্যক্তি সন্তর্পনে গোপন করে।
এদিকে দায়িত্ব পেয়ে অতিদ্রুত জেনারেটর ঠিক করিয়ে নেয় রফিকুল। রফিকুলকে মৃন্ময়া স্মিত হেসে বলল,
-থ্যাঙ্কস্!
রফিকুল কোন জবাব না দিয়ে মাথা নেড়ে অন্যদিকে চলে গেল। মৃন্ময়া বুঝল না তার কি হয়েছে? যার জন্য সৌজন্যতাটুকু দেখাতে পারল না?
কাল রফিকুল গিয়েছিল মৃন্ময়ার হবুবর অনুরূপদের বাড়ি আত্মীয়-স্বজনদের সাথে হলুদের জিনিসপত্র পৌঁছে দিতে। কথায় কথায় অনুরূপ বলেছে,
-বিয়েটা যত তাড়াতাড়ি হয় ততই মঙ্গল। দেরি করলে হবে কিনা সন্দেহ আছে। কিন্তু আত্মীয়-স্বজন, মা-বাবা, এবাড়ি সেবাড়ির অনুষ্ঠানের শেষ নেই।
রফিকুল বলল, তাতে কী হয়েছে অনুরূপ? বিয়ে একবারই করবে। একবার একটু গেদারিং সইলে।
-আমার ইচ্ছের কথা বাদ দিন। মা বাবার ইচ্ছে ছিল পরিপূর্ণ আনন্দ ভোগেই বিয়ে করাবে। কিন্তু তারা এতো সময় নিচ্ছে যে অস্থির লাগছে। কোন এক অজানা শঙ্কায় মন খচখচ করছে।
রফিকুল ভাবে মৃন্ময়ার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে অনুরূপ। সে রহস্যময় হেসে বলে,
-কেন এমন মনে হচ্ছে? আর মাত্র তিনটে দিন। তারপর রাজকন্যা একেবারেই তোমার।
ইয়ার্কিটা অনুরূপ গায়ে মাখে না। সে নিজের কথা বলে,
-দু’দিন হলো শরীরটা ম্যাজম্যাজ করায় ভীত হয়ে চিকিৎসক বন্ধুকে ফোন দিলাম, সর্দি কাশি না থাকায় সে প্রচুর পানি, ভিটামিন সি আর প্যারাসিটামল খেয়ে রেষ্ট নিতে বললো।
-শরীর যদি খারাপ করে ফোনে ফোনে কেন? ডাক্তার দেখিয়ে নিন। এখন সিজন চেঞ্জ হচ্ছে। সবারই একটু-আধটু শরীর ম্যাজম্যাজ করে।
অনুরূপ অন্যমনস্ক হয়ে রফিকুলের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারে না। সামনে রাখা নাস্তা নিতে অনুরোধ করে রফিকুলকে। রফিকুলও আনমনা হয়ে পড়েছিল। সে অনুরূপের কথায় সম্বিৎ ফিরে পেয়ে অরেঞ্জজুসের গ্লাসটি তুলে নিল। অনুরূপকেও বলল নিতে।
অনুরূপ মনে মনে ভাবে বিষয়টি রফিকুলকে বলা ঠিক হবে কী? ইতিমধ্যে রফিকুলের সাথে বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে। ইতালি যাবার আগে বাবার বন্ধু মানে মৃন্মময়াদের বাড়ি যাওয়া-আসায় দেখাও হয়েছে। বেশ আন্তরিক সে এবং ধীর স্থির ছেলে, এককথায় যাকে বলে গুরুগম্ভীর। অনুরূপ রফিকুলকে সব বলবে বলে স্থির হলো। ছেলেরা বুঝি এমনি খুব সহজে মিশে যেতে পারে একে অন্যের সাথে।
তেরোদিন আগে ইটালি থেকে ফিরেছে অনুরূপ। করোনা আতঙ্ক তখনো এতোটা ভয়াবহ হয়নি। সেখানে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিলো ১০০-১২০ জন। প্রশাসন একে সাধারণ জ্বর বলে অবজ্ঞা করছিলো, জনসাধারণও তোয়াক্কা করেনি। সবাই দেদারসে ক্লাবে যাচ্ছে, ঘুরছে, ফিরছে। ভ্রমণ ভিসা সস্তা হয়ে যাওয়ায় পাগলের মতো ভ্রমণও করেছে। ঘুরেছে, ক্লাবে গিয়ে ফুর্তি করেছে অনুরূপও। তারপর বাবার আদেশে ছুটে আসতে হলো। বাবা চিরকাল অযথাই তার আদেশ চাপিয়ে দেন। একমাত্র ছেলে হওয়ায় আপত্তি সত্বেও মেনে নেয় শেষ পর্যন্ত অনুরূপ।
মৃন্ময়ার সাথে বিয়েটা বছর তিনেক থেকেই ঘুরছে। অনুরূপ কোন ভাবেই দেশি মেয়েকে বিয়ে করতে চায়নি। বাবা মানতেই রাজি নয়। এবার তাই তার ফেরার আগেই বন্ধুর সাথে কথা বলে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে ফেলেছেন। বিভিন্ন প্রোগ্রাম এগিয়ে নিয়েছেন। অভিমানে একবার ভেবেছে ফিরবেই না। কিন্তু মা ফোন করে অনুনয় করে। শেষ পর্যন্ত এন্থেনাকে রেখে ফিরতে হলো।
ফেরার দিন ওর মুখটা আপেলবর্ণ এবং বেড়ালরঙা চোখগুলো লাল হয়ে উঠেছিল, জল গড়ায়নি। হয়ত এন্থেনা বাঙালি মেয়েদের মতো কেঁদে অভিব্যক্তি ব্যক্ত করতে জানে না। অনুরূপ ভেবে পায় না বাঙালি মেয়েরা এতো কাঁদে কেন?
বিদায় দিতে এন্থেনা এয়ারপোর্ট এসেছিল। জড়িয়ে ধরে বলেছিল,
– I miss you. I love you. I’ll wait for you. See you again.
তারপর ওর উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়ায় শিহরণ তুলে দিল।
ওর ছোঁয়া সব সময় উপভোগ করে অনুরূপ। ওকে তখন মনে হয় ঐশ্বরিক।
ঢাকা এয়ারপোর্টে থার্মাল স্ক্যানার পার হয়ে একটি ফর্ম ফিলআপ করতে হলো আর আক্রান্ত দেশ সমূহের একটি কার্ড হাতে ধরিয়ে দেয়া হলো। সেই কার্ড পূরণ করে জমা দিল কর্তৃপক্ষকে।
দেশে হোম কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন এসব শব্দ তখন কেউ জানতো বলে মনে হয় না। দেশে ছড়িয়ে পড়েনি রোগটি। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ভিনদেশের নানান খবর দেখলেও জর্জরিত এই ছোটদেশের মানুষ পড়ে থাকেনি সেসব নিয়ে। কেউ কেউ নতুন ভাইরাসটি নিয়ে আগ্রহ দেখায়নি তা নয়। তবে এরা সতর্কের চেয়ে সমালোচনা এবং উপদেশে পটু একটা জাতি। নিজের গায়ের উপর আছড়ে পড়লে তবে বিশ্বাস করবে।
অনুরূপ ঢাকায় থেকেছে দু’দিন। কাছের দুই তিনজন বন্ধুর সাথে দেখা করেছে। এরপর বাসায় চলে এলো। সে এমনিতেই ঘরে থাকা টাইপের ছেলে। এসেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জ্যামে পড়ল। সময় করে করে এন্থেনার খোঁজ নিচ্ছে। হঠাৎ তিন চারদিন আগে ও বলল ওর জ্বর জ্বর করছে। পরশু বলল কাশি, শ্বাস কষ্ট হচ্ছে। কাল বলল ওকে আইসোলেশনে নিয়ে যাচ্ছে।
লাইন কেটে গেলো তারপর। ফোনের পর ফোন করেও ওর খবর পাওয়া যাচ্ছে না। কোন বন্ধুরাও খোঁজ নিয়ে দিতে যেতে রাজি নয়। ইতালিতে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। অনুরূপের ভাঙামন কোনভাবেই অতি সামাজিক অ্যকটিভিটি সইতে পারছে না। সবাই কাছে আসছে হাস্যসেল্ফি বা ডিএসেলারে তাক লাগানো ছবি তুলে উৎফুল্ল বোধ করছে। ওর অসহ্য ফিল হচ্ছে।
সন্ধ্যার অনেক পরে সবাই বেরিয়ে পড়ল বিদায় নিয়ে। রফিকুল করমর্দনের জন্য অনুরূপের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলে অনুরূপ বলে,
-আরেকটু বসুন। সবাই চলে যাক। আপনি কিছু সময় থাকুন।
অনুরূপ এমনভাবে কথাটা বলে রফিকুল না করতে পারে না। অনুরূপ রফিকুলকে নিয়ে ছ’তলার ছাদে চলে যায়। মনোরম ছাদে পাতানো টেবিলের দু’পাশে দুটো চেয়ারে তারা বসে। কফি আনিয়ে নেয় অনুরূপ। কফিতে ছোট ছোট চুমুক দিয়ে খেলে গরম কফির বেশ স্বাদ পায় রফিকুল। ও সেভাবেই কফি খাচ্ছে।
অনুরূপ কফিমগটি হাতে নিয়ে আলতো ঠোঁটে ছোঁয়া। তার কাশির বেগ হলে টিসু চাপা দেয়।
দু’তিনটে কাশি দিয়ে থেমে দম নেয়। রফিকুল বলে,
-আপনি ভীষণ অসুস্থ। ডাক্তারকে ফোন করি?
অনুরূপ বাধা দেয়। বলে,
-স্মোকারের এমন কাশি না থাকলে চলে?
তারপর হো-হো করে হেসে উঠে ঝলমলে আকাশের দিকে আঙুল তুলে সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটির দিকে দেখিয়ে বলে,
-বলুন তো রফিকুল, যখন কোন প্রাণের মানুষ এমন তারা হয়ে যায়, তখন কেমন লাগে? তারপর ঘোরের মধ্যে চলে যায়। একে একে খুলে বলে এন্থেনার কথা।
বলা শেষ হলেও ঘোর কাটে না অনুরূপের। ওর কাঁধে হাত রাখে রফিকুল। সান্ত্বনা দেয়। সে জানে বিভীষিকার পরেও আলো দেখা দেয়। অল্প ক’দিনের মধ্যে সত্যি বিশ্বের পরিস্থিতি এতো বেশি খারাপের দিকে যাচ্ছে। অবাক না হয়ে পারা যায় না। এমন বড় বড় রাষ্ট্র সবাই পরাস্ত হয়ে যাচ্ছে একটা ভাইরাস মোকাবেলায়? বাংলাদেশ এখনো সেফ। তবু মনে মনে তো ভয় থাকেই কবে কখন এই মরণব্যধির উদয় হয়। উদয় হলে এই গরিব দেশটি সামাল দিবে কী করে? তাছাড়া যেখানে বেশিরভাগ মানুষ অসচেতন। তার আগেই ভালোয় ভালোয় বিয়েটা হয়ে যাক। অনুষ্ঠানের ভিড়ে শেষে না সব আয়োজন বন্ধ হয়ে যায়।
হঠাৎ রফিকুলের চিন্তা হলো অনুরূপ বিয়ে ভেঙে দিতে চাইছে না তো? তাহলে যে তীরে এসে তরী ডোবার মতো অবস্থা হবে। ফুফা প্রেসারের রুগি। নির্ঘাত স্ট্রোকে মৃত্যু হবে। আবার এও মনে হচ্ছে অনুরূপের শরীরে যদি এন্থেনা ঢুকিয়ে দিয়ে থাকে মরণ ভাইরাস? সন্দেহটা ফেলে দেয়া যায় না। অনুরূপের কথা হিসেবে বিদায়ের সময় তারা আলিঙ্গন করেছে। এন্থেনা যদি আইসোলেশনে থাকে তবে রেহাই পাবে কী অনুরূপ?
আল্লাহ্ তুমি সব সামলে নাও। রাত বাড়ছে অনুরূপকে বলে,
-আপনি কি বিয়েটা এ পর্যন্ত এনে আর টানতে চাচ্ছেন না?
আচমকা এমন প্রশ্নে অনুরূপ চমকায়। সে শান্ত কণ্ঠে বলে,
-আমি যে পুতুল মাত্র। আমি না করবার কে? তবে তাড়াতাড়ি হলেই ভালো হতো। আমাকে জানিয়ে প্রোগ্রাম সেট করলে আমি হয়ত কমিয়ে দিতাম।
রফিকুল নিমগ্ন ভাবে অনুরূপের দিকে তাকিয়ে বলে,
-আপনি কি অন্য কিছু সন্দেহ করছেন?
-ভাবনাটা যে অমূলক নয় তা আপনিও স্বীকার করবেন। মহামারি যেভাবে শুরু হয়েছে, কখন কার কী হয় বলা যায়? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম এমন বিপাকে পড়েছে বিশ্ববাসী।
রফিকুল সত্য মেনে নেয়। তবু কিছু চরম সত্য মানতে মন চায় না। সে কিছুতেই মৃন্ময়া, ফুফু বা ফুফাকে বলতে পারবে না তার সন্দেহের কথা। ফিরে এসেও মন কু’ডাকছে। মনের চিন্তাকে মুখে প্রকাশ করে এতোগুলো মানুষের আনন্দকে মাটি করতে পারবে না রফিকুল। তাই তখন মৃন্ময়া থ্যাঙ্কস্ বলাতেও তাকে সৌজন্যতা দেখাতে পারেনি। মৃন্ময়ার মুখের দিকে তাকালেই বুকটা শূন্য হয়ে যাচ্ছে অজানা শঙ্কায়।
নাছির উদ্দিনের মেয়ের বিয়ে। আয়োজনে কোন কমতি রাখতে চান না তিনি। একটামাত্র মেয়ে তার। অনেক আদরের। আর অনেক ভাগ্যবতী। তার জন্মের পরপরই ব্যবসার চাকাটা ঘুরে গিয়েছিল। আর তার স্থাবর-অস্থাবর যা আছে সবই তো মৃন্ময়ারই।
-স্যার, হলুদের গেস্টদের শাড়ি পাঞ্জাবী চলে এসেছে।
নাছির উদ্দিন তাকিয়ে দেখলেন তার পেছনে এসিসটেন্ট বসির। তার সাথে শাড়ি পাঞ্জাবি আনা লোকগুলো। তিনি বসিরকে বললেন,
-গুড, ওগুলো রফিকুলকে বুঝিয়ে দাও। ফটোশুটের পর মৃন্ময়া পার্লারে যাবে, সাথে তার মেইডসও। গাড়ি যেন সময় মত তাদের নিয়ে যায়। ও হ্যাঁ, ফরেইন ডেলিগেইটস আর মৃন্ময়ার অস্ট্রেলিয়ান ফ্রেন্ডদের জন্য যে ডিলাক্স রুম বুক করতে বলেছিলাম, তার কি অবস্থা?
-আপনি একদম চিন্তা করবেন না। সব ঠিক করে রেখেছি।
-আচ্ছা বশির কাল মেহেদি দু’পক্ষের একসাথে হওয়ার কথা। সে দিকটি ভালো করে দেখো। প্রয়োজন হলে আরো কাউকে তোমার সাথে নাও। দেখ দেশি বিদেশি গেস্ট আত্মীয়-স্বজনদের কাছে আমার মাথা যেন হেঁট না হয়।
-আপনি চিন্তা করবেন না স্যার। আমি কখনোই আপনার সম্মান ক্ষুণ্ণ হতে দেব না।
-তোমার উপর ভরসা আছে রে বসির। যাও এখন লিস্ট বের করে ভালো ভাবে দেখে নাও কোন কাজ পড়ে আছে কি না।
রফিকুল কাউকে কিছু না বললেও নিজ স্ত্রী ও সন্তানদের হুট করেই নিজের বাড়িতে পাঠিয়ে দিল। স্ত্রী তিতলিকে সন্দেহের কথা খুলে বলল। আর বলল, “এদের বলিও, বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। বিয়ের দিন আসবো।” তিতলি বিষয়টির গুরুত্ব বুঝল।
ওদের পাঠানো নিয়ে পরিবার থেকে বেশ আপত্তি এলো। তবু পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত হলো রফিকুল। মনে মনে আতঙ্কিত। ভাবছে সারাক্ষণই, অনুরূপের করোনা নয়তো? এই ক’দিনে ইতালিতে যা ভয়াবহ অবস্থা আসবার আগে ভাইরাস ঢুকে পড়েছে কি ওর শরীরে? কিছুই বলা যাচ্ছে না। হয়ত ওর থেকে বয়ে বেড়াচ্ছি নিজেরাও।
মৃন্ময়ার মেহেদী পরদিন বুধবারে। দেশে আসার প্রায় দু’মাস রফিকুলের। ঠিক দুপুরে খেতে বসার আগেই জেলা প্রশাসন থেকে রফিকুলের ডাক এলো। বিয়ে বাড়ি থমথমে হয়ে উঠলো পুলিশের লোকজন দেখে। এ আত্মীয়কে ও আত্মীয় ফোন করে নতুন খবর দিচ্ছে। যেন আত্মীয়তার ভিত মজবুত করছে। কিন্তু ঘটনার পেছনের ঘটনা উদঘাটনে কেউ এগিয়ে এলো না। ফোন করে প্রশাসনকে বিষয়টি জানিয়ে ম্যানেজ করতে চাইল রফিকুল। কিন্তু না তাকে যেতেই হলো। ইতিমধ্যে আমেরিকায় গণপরিবহনসহ অফিস, আদালত সীমিত আকারে বন্ধ করা হয়েছে। সেখানেও চলছে শহর থেকে শহর লকডাউন। কোয়ারেন্টাইনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে অনেককে।
প্রশাসনের লোকদের সাথে বের হতে হলো রফিকুলকে। হোম কোয়ারান্টাইনে থাকার নির্দেশ দিলেন। নির্দেশ অমান্য করার ইচ্ছে নেই রফিকুলের। সে ভাবছে প্রায় দেড়মাস পেরিয়েছে দেশে আসবার। ছড়াতে হলে এতোদিনে ছড়িয়েই দিয়েছে সে। গতকালও অনুরূপ ও মৃন্ময়ার বিদেশি বন্ধু, দেশি বন্ধু আত্মীয়-স্বজন মিলেমিশে আনন্দ করেছে। বুঝতে পারছে না এখন এসবে কী হবে? তবু প্রশাসন যখন সতর্ক করেছেন তখন তাঁদের কথা অমান্য করা যায় না। বাড়িতে গিয়ে তিতলি আর বাচ্চাদের থেকে চৌদ্দ দিন নিজে আলাদাই থাকবে ভাবল।
সরকারের নির্দেশে মুজিববর্ষ উদযাপন থেকে শুরু করে সব অনুষ্ঠান স্থগিত। বিয়ের পরদিন থেকেই অনুরূপ তার বাবা মা নিকটতম আত্মীয় এবং মৃন্ময়া ও তার বাড়ির লোকজনকে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশ দিল প্রশাসন।
কোয়ারান্টাইনেই রয়েছে মৃন্ময়া অনুরূপদের বাড়িতেই। মুঠোফোনে কথা বলে। ভিডিও কনফারেন্স করে। গভীর রাতে লুকিয়ে দেখাও করে। এর আগে অনুরূপ মৃন্ময়াকে সেভাবে লক্ষ্য করেনি। ওযে বিস্ময়কর সুন্দরী তা অজানাই ছিল। হয়ত এন্থেনার মোহে আচ্ছন্ন থাকায় এমন হয়েছে। এখন তারা অনেক ঘনিষ্ঠ। অনুরূপের মন উড়ে যায় মৃন্ময়ার জন্য ক্ষণে ক্ষণে। মৃন্ময়ারও তাই। এর মাঝে দেশে করোনা ভাইরাস ছড়ালো, মানুষের চেয়ে বেশী সোশাল মিডিয়াকে আক্রান্ত করলো। বটতলার বিজ্ঞ ডাক্তার, হাতুড়ে কবিরাজ ও পথে-ঘাটে পদক প্রাপ্ত সাহিত্যিক, আলেম, বুদ্ধিজীবীগণ নানান পরামর্শ দিচ্ছেন আর সরকারের নানান দোষ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কালিজিরা, রসুন, থানকুনি পাতাসহ নানা অব্যার্থ মুশকিল আসানের ছবক দিতে লাগলেন অনেকেই।
অণুশ্রী ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ল। শ্বাসকষ্টটা তার ছোটবেলাকার রোগ। কোন সামান্য টেনশানে পড়লেই তাকে রোগটায় ভুগতে হয়। এখন একটু বাড়াবাড়িই। ইনহেলারেও কাজ হচ্ছে না। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করলেন। দু’দিন থেকে আইসিউতে। তার শরীরে করোনা ভাইরাস আছে কিনা পরীক্ষাগারে পরীক্ষা হচ্ছে। তাকে নিয়ে নাছির উদ্দিনের টেনশনের অন্ত নেই। টেনশনে নিজেও ঝুঁকির মুখে পড়লেন। এই অসহনীয় সমস্যায় বাণী সবকিছু থেকে যেমন নিজেকে সরিয়ে রাখেন তেমনি রাখলেন। যারা তাকে পছন্দ করে না তাদের কাছে যাবার কোন মানেই নেই।
চারপাশে ঝুঁকে আসছে বিপদ। কিন্তু মৃন্ময়া এবং অনুরূপ কোয়ারান্টাইনের আইন ভেঙে একে অন্যের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। কেউ জানবার আগে ফের যার যার অবস্থানে চলে যায়। দুজন দুজনার জন্য মাতালের মতো টান অনুভব করে। অনুরূপ এন্থেনার চেয়েও বেশি পাগল হয়ে উঠেছে মৃন্ময়ার জন্য। ওর মুখে, বুকে, হাতে, নাকে, চুলের পরতে পরতে সবুজের গন্ধ। এতো সতেজ নারীস্পর্শ সে পায়নি আগে। সে ভাবে “ভালোবাসা কী তবে ফিরতি ঢেউ? সাগরের বুকে মিশে নানান রূপে ফিরে ফিরে আসে?” সে বাঁচতে চায় মৃন্ময়ার চোখে, ওর অনুভবে। কোয়ারান্টাইন আজ বারোদিন শেষ। অনুরূপের হাঁচি-কাশি, জ্বর কমছে না। ও ঢাকা মেডিকেল কলেজে করোনা পরীক্ষা করতে দিয়ে এসেছে। আজ রিপোর্ট আনতে গেছে। বাড়ির অন্যদের হাঁচি-কাশি, জ্বর কিংবা ডায়েরিয়া দেখা দেয়নি এখনও। মৃন্ময়া তার রুমে বসে আছে ফোন নিয়ে। এখান থেকে সামনের জানালা দিয়ে গেইট দেখা যায়। অবশ্য সিসি ক্যামেরার মনিটরেও ইচ্ছে করলে দেখতে পারে। তবে সেদিকে তার মন নেই।
সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসে অণুশ্রী আন্টির মৃত্যু সংবাদটি পেয়ে। সে বুঝতে পারে দু-পরিবারের অনেককেই হারাতে হবে। বিদায়ের ঘণ্টা দ্রিম-দ্রিম শব্দে স্পন্দন বন্ধ করে দিতে চায়। মন নরকের বাসিন্দা হয়ে উঠে। কিছুতেই কিছু মেলাতে পারে না।
আবার ফোন আসে। তড়িগড়ি ফোন রিসিভ করতে গিয়ে কেটে যায়। নিজে ডায়াল করতে গিয়েও নিজের লক নম্বর ভুলে যায়। ওপ্রান্ত থেকে ফের ফোন আসে। ফোনের কাঁপনে মৃন্ময়া ভীত হয়ে পড়ে। কেটে যায় ফোন। আবার আসে, আবার। শেষবার ও রিসিভ করে। অনুরূপের কণ্ঠ খুব দূর্বল শোনায়।
–হ্যালো! মৃন্ময়! পজেটিভ।
-মিথ্যে বলছো!
–একদম না বাবু।
মৃন্ময়া ভাষা হারিয়ে ফেলে। সে জানে না অনুরূপের পজেটিভ হলো কেন? তবে তো তারও পজেটিভ হবে! ও প্রান্ত থেকে আবার শোনা যায়,
-যাবার আগে দেখা হলো না। আমাদের দেখা হবে ফের। দেখা হবেই।
মৃন্ময়ার পৃথিবী টুকরো টুকরো হয়ে যায়। ও জানে না ইতিমধ্যে এবাড়িটি লকডাউন করা হয়েছে। ও দৌড়ে বেরিয়ে পড়ে। গেইটে তাকে প্রশাসনের পোশাকপরা লোক আটকে দেয়।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে এখানে ক্লিক করুন
ভাল লাগল৷শেষাংশ ছোট গল্পের শর্ত পূরণ করেছে৷আর একটু অন্য রকম হতে পারত!