অজিতেশ নাগ
“এট্টুন ভাত? আর নাই?”
সন্ধে গড়িয়েছে অনেকক্ষণ। একটু আগেও ঈশার নমাজের ইবাদত ভেসে আসছিল মসজিদ থেকে। সেই আওয়াজ কানে নিতে নিতে হা-ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে হাত-পা ধুয়ে দাওয়ায় উবু হয়ে বসেছে কল্লা। সামনে একটা লম্ফ জ্বলছে পিটপিট করে। সেই আধো-আলো-আধো-অন্ধকারে চারটি প্রাণীর ছায়া মাটির দেওয়ালে হুমড়ি খেয়ে পড়ে কাঁপে। কল্লা, তার স্ত্রী আর দুটি পুত্র-সন্তানের ছায়া। অবশ্য দেওয়াল বা ছায়া কোনওটারই দিকে তাকানোর সময় কল্লার নেই। পেটে তার আগুন যেন দাউ দাউ। ভাত চাই, এক থালা গরম গরম লাল চালের ভাত। সঙ্গে কিছু হলেও চলে, না হলেও চলে। শূন্য উদর-পূর্তির জন্য হাড়ি-ভর্তি ভাতই হল পোলাও, কালিয়া, গোস্ত, কাবাব।
অবশ্য শুরুতেই তার নাম কল্লা ছিল না। ঠাকুর্দা জনাব মহিউদ্দিন আলি বড় আয়েস করে নাতির নাম রেখেছিলেন কলহন। সব মিলিয়ে দাঁড়িয়েছিল কলহন আলি। সেই শুনে সবাই এক বাক্যে শুধিয়েছিল, এ এবার কেমন নাম রে বাবা? মানেই বা কী? ঠাকুর্দা দন্তবিহীন মুখে হাসতেন আর ভারি গর্বের একটা হাসি ঠোঁটের কোনে ঝোলাতেন। যেন হুহু বাওয়া। কল্লা শুনেছিল অনেক পরে, তার আব্বুর মুখে। কে জানি কবে এক ভারি দিগগজ ব্যক্তি এসেছিলেন তাদের এই দোহারপুর গাঁয়ে। সবাই ছেঁকে ধরেছিল তাকে। হাজার হোক রাজধানী শহরের লেখাপড়া জানা মনিষ্যি, একটু খাতির তোয়াজ না করলে চলে? প্রতি সন্ধ্যেবেলা শূন্য হাটের চৌতালায় বসত সেই মেহমানের দরবার। রোজ নিত্য-নতুন কাহানী। যন্ত্রের গল্প, আলোর গল্প, কারখানার গল্প, পেটপুরে চার বেলা খেতে পাওয়ার মত স্বপ্নময় গল্প ছিল সে সব। তো সেই দিগগজ ব্যক্তির মুখেই ঠাকুর্দার এই নাম শোনা। শোনা ইস্তক ভারি পছন্দ হয়ে গিয়েছিল ঠাকুর্দার। জমিয়ে রেখেছিলেন মনের কুলুঙ্গিতে। পরে নাতি জন্মালে তিনি তার জন্য কুলুঙ্গি থেকে পেড়ে আনেন এই নাম। নইলে এমন নাম আর কোথায় পাওয়া যাবে? এই গাঁয়ে তো সব মোল্লা নাম। হয় সালাম, নয় মইনুর, নয় কবীর, নয়ত সিদ্দত, জাকির, আব্দুল এই সবই প্রচলিত নাম। তারই মাঝে দুম করে কলহন। উৎপত্তি কী? না, কোন এক দূরদেশে নাকি এক মহারাজার এক মন্ত্রীর নাম ছিল কলহন। সে নাকি আবার ছিল হিঁদু। মোল্লার ঘরে হিঁদুর নাম? কিন্তু কে শোনে কার কথা। তো গাঁয়ের লোকের তো মুখ-খসা কথার ঢল। ফলে যা হওয়ার হল। কলহন থেকে কল্লা। ঠাকুর্দা অবশ্য তার আগেই কবরের নিচে শায়িত হয়েছেন। অবশ্য কল্লার বাপ ছবিরুদ্দিন আয়েস করে কল্লার একটা ভালো নাম রেখেছিল, এখন সবাই ভুলেছে।
কল্লার স্ত্রী, খাদিজা, ঝামড়ে ওঠে, “তয়? আফনে কি এক থাল ভাত খাইবান ভাবতে ভাবতে আইতেছিলেন নাকি?”
“নাই? সব হান্দাইয়া ফ্যালাইছস?” গুমরে ওঠে কল্লা।
খাদিজা ঝরঝর করে বলে যায়, “একবার হান্ডির ভিতরে ফুচি মাইর্যা দ্যাহেন, বুজবেন, কেমুন এক্কেরে চাল উপচাইয়া পড়তাছে।”
কল্লা স্থির দৃষ্টিতে স্ত্রীর চোখের দিকে তাকায়। উপরে উপরে ধমক-চমক দিলে কী হবে, স্ত্রীকে সে ডরায় বিস্তর। তার স্ত্রী হক কথা ছাড়া বলে না, সেটা সে বিলক্ষণ জানে।
খাদিজা আঁচল দিয়ে কপাল মোছে, যেন স্বগতোক্তি করে, “পোলাপান দু’ডারে যে কী কইরা বাচাইয়া রাখছি, একমাত্র আল্লায় জানে।”
কল্লা দুটো পেট-ডিগডিগে বাচ্চার দিকে তাকায়। একটির বয়স পাঁচ, অপরটির তিন গড়াচ্ছে। দু’জনেরই চার চোখে লম্ফ’র আলো প্রতিফলিত হয়। শুধু কল্লা দেখে, আলো নয়, আব্বার থালার দিকে তাকিয়ে আছে দুই জোড়া প্রলুব্ধ চোখের মণি।
কল্লা সবই জানে, সবই বোঝে। সে তাকিয়ে দেখে, ভাতের পরিমাণ অর্ধেক থালাও ভরাতে পারেনি। পাশে কী একটা। হয় কলমি শাক, নয় গেঁড়ি’র ঝাল। কল্লা অপেক্ষাকৃত নরম সুরে বলে, “তমাদের আছে তো?”
খাদিজা রুদ্ধস্বরে বলে, “আফনে খাইয়া উঠেন তো। লম্ফে ত্যাল বেশি নাই।”
কল্লা সব কিছু এক সঙ্গে মেখে ফেলে চার গ্রাসেই থালা শূন্য করে ফেলে। তারপর ঢকঢক করে এক ঘটি জল খায়। বাইরে গিয়ে উঠোনের উপরে গামছা পেতে শুয়ে পড়ে। খানিক পরে অন্ধকার ফুঁড়ে খাদিজা’র কন্ঠস্বর ভেসে আসে, “ঘরে আইয়া শোয়েন, যা গরম পড়ছে, সাপ-খোপ বাইড়াইব।”
বাগঝোড়া সাব-ডিস্টিক্টের অধীনে দোহারপুর। নিতান্তই অজ পাড়া গাঁ। যে চল্লিশ-পঞ্চাশ বিঘা জমিজিরেত আছে, সাকুল্যে, তার মালিক ঠাকুরসাহেব। গাঁয়ের একদম মধ্যিখানে তার আটচালা মকান। ইয়া বড় বড় ধানের গোলা, ফল-ফুলুরির বাগান আর কত কী। তবে ঠাকুরসাহেব শুধু তো আর দোহারপুরের মালিক নয়, এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খান সাতেক গাঁয়ের মাথা।
গত সনে বৃষ্টি হয়েছিল নামমাত্র। এবারেও তাই। আল্লাতালার দোয়ায় জল যা নেমেছিল, তাতে ধানের গলাও ভেজে না, বুকে দুধ জমবে কী করে? “ধানের দুধ হয়? কুনোদিন খাই নাই তো।” কল্লার প্রশ্ন শুনে আব্বু হাওয়ায় দাড়ি ভাসিয়ে হেসেছিল, “ধানেরও দুধ হয় রে, পোলা। মাটি পানি দেয় আর পোয়াতি মাইয়ামানুষের লাহান হেই পানি দুধ হইয়া গভ্ভে জমা হয়, তবেই তো ধান ফলফলন্ত হয়।” কল্লা হেসেছিল, খানিক বুঝে, খানিক না বুঝে। শুধু এটা বুঝেছিল, গোছা গোছা ধান ঠাকুরসাহেবের ঘরে না উঠলে, তাদের মত মুনিষজনের কপালে ফক্কা। তার আব্বু ছিল চাষি। কল্লাকে টেনে চাষের মাঠের জলকাদায় নামাতে চেয়েছিল আর কল্লা চেয়েছিল লেখাপড়া করে শহরে পাড়ি জমাতে। কিন্তু কপালে যার ইবলিশ খোঁচা মেরে জিল্লতের মাটি লেপে দিয়েছে, তার কীই বা হওয়ার থাকতে পারে। চাষের মাঠেই সাপের কামড়ে মরল বাপটা। কল্লার না হল ঠিক করে পড়াশোনা, না শিখল চাষের আঁটঘাট। আম্মু সেলাইফোঁড়াই জানত, তাই দিয়ে ক’মাস ঠেকনা দেওয়া গেল। তারপরেই এক ঝড়জলের রাতে আম্মুর এন্তেকাল। কল্লা পড়ল জলে। একে তাকে ধরে রসুলগঞ্জের হাটে মনসুর মিঞার দোকানে লেগে গেল। দু’বেলা খাওয়া আর মাসে পঞ্চাশ টাকা হাতখরচা। হাতে পায়ে মদ্দ জোয়ান হতেই ঠাকুরসাহেবের লোকজনের নজরে পড়ে গেল কল্লা। মোল্লা গাঁয়ের হিঁদু জমিন্দার ঠাকুরসাহেব। ঠাকুরসাহেবের মকানে মুনিষ খাটবি? তিন বেলা খাওয়া আর মাসে আশি টাকা পাবি। সানন্দে রাজি কল্লা। কাজ? মুড়ি ভাজা, ধান সেদ্ধ করা আর যা যা হুকুম কত্তার হয়। লেগে গিয়েছিল কল্লা। তবে শুধু কি সিদ্ধ আর ভাজা? ঠাকুরসাহেবের যে কত্ত কাজ, করতে করতে জান কয়লা, ভুলচুক হলেও কড়া কড়া গালি, পরে সব টের পেয়েছিল সে। তবে ধীরে ধীরে সব কিছুই সহ্য হয়ে যায়, গিয়েওছিল কল্লার।
কিন্তু ধানে টান পড়লে যে তার মাসমাইনেতেও টান পড়বে, তিনবেলার খাওয়া গিয়ে একবেলায় ঠেকবে, কে জানত? ঠাকুরসাহেবের সাফ কথা, “গোলায় ধান না উঠলে, গঞ্জে সেই ধান না গেলে, বিক্রি-বাট্টা না হলে তোদের কি এমনিই বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াব? পয়সা সস্তা?” কিন্তু গোলায় তো এখনও প্রচুর ধান সঞ্চিত। ঠাকুরসাহেবের কৈফিয়ত, এ বছর নাকি ধানের দাম তেমন ওঠেনি। হক কথা। ফলতঃ, খাওয়া কমে, রোজগার কমে, বাজারে আনাজপাতির দাম বাড়ে, পাল্লা দিয়ে খিদে বাড়ে।
এখন কল্লার অনেক উপরে বিস্তীর্ণ আকাশ। তাতে কত যে তারা চিকমিক করছে, গুনে শেষ করা যায় না। সে যখন ছোট ছিল, আব্বুর পাশে শুয়ে, মাথার নিচে হাত দিয়ে, ঠায় আকাশ দেখত। দেখতে দেখতে কেমন নেশা লেগে যেত। দু’চোখ বুজে আসত। আব্বু টের পেয়ে বলত, “ঘুম লাগে, বাপ?”
কল্লা মিথ্যে বলত, “পায় না তো।”
“তাইলে আসমানের পানে তাকাইয়া তারা গোন। সব তারা গুইন্যা শ্যাস করতে পাল্লি, কাল হাট থিক্যা দিলখুশ আইন্যা দিমু নে।”
কল্লা এখন শুয়ে শুয়ে বাপের কথা ভাবে, চাচার কথা ভাবে, ঠাকুর্দার কথা ভাবে, আম্মুর কথা ভাবে। কাছের কাল-কাসুন্দে আর বনচাঁড়ালের ঝোপ থেকে বিচিত্র গন্ধ বাতাসে ভাসে। খাদিজাকে ডেকে কল্লা বলে, “পুলা দুইখান হুইছে?”
“হ।”
“তয় আইয়া বও দিহি। টুকুস মনের কথা কই।”
খানিক পরে আঁচল দিয়ে কপাল, ঘাড় মুছতে মুছতে, খাদিজা এসে বসে স্বামীর পাশে। কল্লা খাদিজাকে দেখে। প্রথম যখন খাদিজা তার এই আঙনে পা দিয়েছিল, কী ঢলঢলে ছিল মুখখানি। রাতের চাদর দশ দিক ঢেকে দিলে, কল্লা খাদিজার শরীর নিয়ে খেলা করত। নারীর গতরের ভাঁজে ভাঁজে এত রহস্য আগে কে জানত? প্রতি রাতে রহস্য উদ্ঘাটনে নেমে যেত কল্লা। শান্ত পুষ্করিণীতে ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ, শেষে উথালপাথাল সমুদ্দুর। কল্লা ভাসত, কল্লা ডুবত, কল্লা হাবুডুবু খেত।
“কয়েন।” খাদিজার সুর এখন অনেক নরম। নারকেল গাছের ঝিরঝিরে হাওয়া খানিক স্বস্ত্বি দেয়।
“তয় করছি, কাজ ছাইড়া দিমু।”
“অ্যাঁ?” নিমেষে চমকায় খাদিজা, “হায় আল্লা। কন কী? খাইবান কী?”
তার কথা যেন কল্লার কানে যায় না, “চাচার কুথা মনে আছে তুমার?”
কল্লার বাপ ছবিরুদ্দিন চাষি ছিল, ঠাকুর্দা মহিউদ্দিন চাষি ছিল, ঠাকুর্দার বাপেও সম্ভবত তাই ছিল। কেবল ঠাকুর্দার অন্য দুই ছেলে ভিন্ন পথ নিল। কল্লার বাপ মেজ। বড় হমিরুদ্দিন আগে চাষের কাজই করত বটে, তবে শাদি হয়ে যাওয়ার পরে খুলনা চলে গেল। শ্বশুরমশাইয়ের ব্যবসায় হাত জমাতে। এক কথায় ঘর-জামাই হয়ে গেল। ঠাকুর্দা খুব রাগ করে ত্যাজ্যপুত্র করলেন, রীতিমত হলফনামা দিয়ে। লোকে কইল, করেন কী। কুরআনে কোনও আয়াতেই ত্যাজ্যপুত্র করার অনুমোদন দেওয়া হয়নি। ঠাকুর্দা শোনেননি। অবশ্য কল্লার জ্যাঠার তাতে বয়েই গিয়েছিল। আগে তবু ছ’মাসে ন’মাসে গাঁয়ে আসত, পরে তাও ঘুচে গেল। কল্লার খুব পছন্দের মানুষ ছিল বদরুদ্দিন চাচা। কল্লার বাপের ছোট ভাই। সে ছিল বহুরূপী। গাঁয়ের লোকরা বলত বউরুপি। কত রকম পোশাক যে ছিল চাচার তোরঙ্গে। সেই তোরঙ্গ ছিল কল্লার বিশেষ আগ্রহের বস্তু। কিন্তু চাচা কাউকে তাতে হাত লাগাতে দিত না। এক একদিন এক এক রকমের বেশ সেই তোরঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসত। আর সেইসব জোব্বা-জাব্বা গায়ে চাপিয়ে, মুখে বিচিত্র রঙ করে চাচা কখনও শিব, কখনও রাজা, কখনও জাদুকর, কখনও মুরশিদ, কখনও বা গয়লানি। মেয়ের সাজ হোক বা পুরুষের, চাচার হাতযশ ছিল। এক এক রকম পোশাকে চাচাকে প্রায় চেনাই যেত না। চিরকুমার চাচা নানান গ্রামে গ্রামে, হাটে, মাঠে বহুরূপী সেজে ঘুরে ঘুরে বেড়াত। ছড়া কাটত মুখে মুখে। পয়সা ভালই কামাত, তবে নেশা করতেই উড়ে যেত বেশিরভাগ। কল্লাকে চাচা খুব ভালবাসত। যেদিন কাজে যেত না, বাড়িতে বসে বসে গাঁজার কল্কেতে টানের পর টান দিত। মাঝে মধ্যে কল্লা, সামান্য দূর থেকে, লক্ষ্য করত চাচাকে। নজরে পড়লে লাল চোখে চাচা তাকে কাছে ডাকত। বলত, “কী দেহিস, পুলা?”
“আফনারে।” সাফ জবাব দিত কল্লা।
“ক্যান?”
“আফনে কী সোন্দর সাজেন। চ্যাননই যায় না।”
চাচা উদাত্ত গলায় হাসত। হাসতে হাসতে কাশির দমক আসত। সামলে নিয়ে বলত, “তুই বউরুপি হবি?”
“হ্যাঁ।” লম্বা ঘাড় নেড়ে দিত কল্লা।
“সে হবে ‘খন। এখন পালা।”
মেজাজ আরও খুশ থাকলে যত্ন করে কল্লাকে সাজাত। সাজিয়ে কল্লার মাকে ডেকে বলত, “দেহ দিহি, মোদের কেষ্টঠাউরকে। চিনতে পারোনি?”
কল্লার মা, কৃষ্ণরূপী পুত্রকে দেখে, বলত, “নিজে বিধম্মী সাজেন, ভালা কথা, আমার পুলাডারে ছাইড়া দ্যান। মেহেরবানি অইব।”
শুনে জোরে হেসে উঠে চাচা বলত, “কেষ্ট অইল চক্ষের পানি, কেষ্ট মোহাম্মদ / ভেতর পানে আসল মানুষ, বাইরে পরিচ্ছদ।”
সে কবেকার কথা। আব্বু বেহেস্তে যাত্রা করবার মাসখানেক আগেই সেই চাচা পাগল হয়ে বিবাগি হয়ে গেল, আর ফিরল না। শুধু রয়ে গেল তাদের স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়িটা। আগে অনেকটাই বড় ছিল, উত্তর-পশ্চিমে বিস্তৃত। এখন তাদের ঘর দুটো বাদ দিয়ে বাকি অংশ ধ্বংসস্তুপ হয়ে পড়ে আছে। সারানোর জন্য প্রচুর টাকার দরকার, যা কল্লার নেই।
“চাচার সেই তোরঙ্গটা আছে?”
কল্লার আচমকা প্রশ্নে হকচকিয়ে যায় হাদিজা, আমতা আমতা করে, “আছে নিচ্চয়। ক্যান শুধান?”
মনে হয় না কল্লার কানে যায়। সে খানিক নিজের মনে বিড়বিড় করে নিয়ে মৃদু হাসে তারপর গড়গড় করে বলে যায়,
“আমি লিজেরেই লিজে বুজি নে
কওনো সূখ্যু, কওনো উস্থুল
কওনো ভগমান, কওনো হয়বান,
তাই সাদাকালো কাউরে খুঁজি নে
মাই রে, আমি লিজেরেই লিজে বুজি নে।”
“এই গান কুতায় শোনলেন?”
“গান না, ছড়া। আমার চাচার ছড়া। ভাবছিলাম ভুইল্যাই গেছি গা, অহন দেহি ভুলি নাই। আরও আছে, শোনবা?”
ঘুমে দু’চোখ টানে খাদিজা। জড়ানো গলায় বলে, “শোনান।”
“আমি ছদমবেশী, আমি বউরুপি, ডুব দিয়্যা তুল্যা আনি অতীত
রাতের বুক চিঁড়্যা সুযয ফিরি করি, লিজ্যেরে করি পতিত
ঘুমের ঘোরে ঘুমরে ডাহি, এক চালাতেই স্বপন রুজি নে
আমি লিজেরেই লিজে বুজি নে
হো মাইইইইইইইই।”
বলেই গলা তোলে কল্লা। তারপর হাসিতে ভেঙে পড়ে। খাদিজার মাথা ঢলে পড়তে যাচ্ছিল, আচমকা উচ্চস্বরে ‘মাইইইইইইইই’ শুনে ঘোর কেটে যায়। সে বলে, “আফনের মতলবটা কী কয়েন তো। চাকরি ছাড়বেন ক্যানডা?”
“ভাবতাছি চাচার লাইন ধরুম। আর মুনিষ খাটতা পারতাছি না।”
উঠে বসে খাদিজা, “আফনের মাথাডা এক্কেরে গ্যাছে। আজকালকার দিনে বউরুপিগিরি চলে?”
“চলবে না?”
“ক্যামনে চলবে? আফনারে বুজাইয়া কই, শোনেন। লোকধাঁধাঁ, শিলুক, বারোমাইস্যা গান, ঘাটু গান, আমতলার সঙযাত্রা, ধান ভানার গান, বাউল-মুর্শিদী, মারফতি, ভাটিয়ালী, কোড়া শিকারের গান, হালকার গান, কবিগান, পল্লীগান, ফকিরালী জিকির গান এইসব কেউ শোনে? তারপর ধরেন খেয়ালী, রাখালী গান, পালা-গীতি, বারনী-আড়ং, গাইনের গীত, হিরালী আরও কত্ত কী। আজকাল চলে?”
দীর্ঘশ্বাস চাপে কল্লা। অনেককিছু তার বাপের আমল থেকেই উঠে গেছে, কিছু কিছু উঠে যাচ্ছে। আজকাল লেটো, আলকাপ এইসব দেখাই যায় না। কল্লা উঠে পড়ে, দেখাদেখি খাদিজাও।
পরদিন কাজ থেকে একটু তাড়াতাড়িই ফেরে কল্লা। তখন সূর্য মধ্যগগনে। ফেরার পথে সে ভাবছিল, খাদিজাকে কী বলবে। আজ সে কাজে ইস্তফা দিল। কারণ সে নয়, তার মালিক। সারা সকাল নারকেল পাড়িয়ে নিয়ে শেষে বলে, দুপুরের খাবার সব শেষ। আবার ভাত চড়িয়েছে, হতে হতে দুপুর গড়িয়ে যাবে। এমনিতেই হাতের ছাল উঠে গিয়েছিল, পেটের গহ্বর শূন্য, তার উপরে এই বার্তা। খিদেতে মাথায় রাগ চড়ে ভাল। জুড়ে দিল চেঁচামেচি। ভেতরবাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন স্বয়ং ঠাকুরসাহেব। সব শুনে একটা নোংরা গালাগাল দিয়ে মারল এক লাথি। ছিটকে পড়েছিল কল্লা।
“করব না কাজ, আর আফনের কাজ করব না।”
শুনেই ঠাকুরসাহেব হাঁকিয়ে দিচ্ছিলেন।
“আমার পাওনা মিটায়ে দ্যান, নইলে আল্লায় ভালা করবে না।”
শুনে আরেকটা লাথি কষাতে যাচ্ছিলেন, কী ভেবে গেঁজ থেকে কুড়িটা টাকা বের করে ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, “তোর আল্লাকে নিয়ে বিদেয় হ’ নচ্ছার।”
মন্দের ভাল। লাথি খেয়ে কোঁকসা ব্যথা করছিল, পরে দোকান থেকে সেই টাকা দিয়ে চাল কিনতেই কোথায় যেন ব্যথা হারিয়ে গেল। গামছায় পুঁটুলি বেঁধে খুশি মনে কল্লা বাড়িতে ঢুকেই দাঁড়িয়ে গেল। রোদে-ভাসা উঠোনে চাচার তোরঙ্গের ঢাকনা খোলা আর উঠোনের উপরে সব সরঞ্জাম শুকোচ্ছে। নকল দাড়ি-মোচ, জড়িদার আলখাল্লা, ঝলঝলে পাতলুন, রাংতা, কালো-বেগুনি-নীল-লাল রঙয়ের বোতল, আরও কত কী। বাচ্চাদুটো তার থেকে দু’একটা সরঞ্জাম নিয়ে ভারি মনোযোগের সঙ্গে নিরীক্ষণ করছে।
কল্লার উচ্চারণে খুশির সঙ্গে একপ্রকার লজ্জা জড়ায়, “ই সব বাইর করলা কখন?”
“চাকরি যখন গ্যাছে, তহন দেহ, মনের সাধ মিটাইয়া লও। নইলে ভুখা প্যাডে মরব নে।”
এত তাড়াতাড়ি খাদিজার কাছে খবর পৌঁছে গেছে! কে দিল! নিশ্চয়ই মনসুর। ব্যাটার বাড়ি পাঁচটা বাড়ি পরেই। ঠাকুরসাহেবের সে-ও একজন মুনিষ। মনসুরকে একদম না-পসন্দ কল্লার। সে না থাকলে খাদিজার কাজে এসে খুব ‘ভাবি’ ‘ভাবি’ করে। কল্লা, না জানি কার প্রতি রাগে, ছেলেদুটোকেই ধমকায়, “রাখ, রাখ। যেখানকার জিনিস সেখানেই রাখ। একডাতেও হাত দিবি না, কয়ে দিলাম।”
খাদিজা কাছে ঘনিয়ে আসে, “শোনেন। আজ মনসুর ভাইয়া আইছিল।”
চোখ সরু করে কল্লা, “কী মতলবে?”
“মতলব ভালা। মনসুরভাইয়ার খালাতো ভাইয়ের ইঁটভাটা আছেনি? মৈমনসিংয়ে? বেবাক লোক কাজ করে। মনসুরভাইয়া কইয়া দিলে, আফনের একটা কাজ লাইগ্যা যাইব।”
কল্লা ভাবে সে আর মাথা গরম করবে না। পরে খাদিজাকে বুঝিয়ে বলবে। অতই যদি ভাল সুযোগ, তবে মনসুর যায় না কেন? খালি তাকে বাইরে পাঠাবার চেষ্টা। খাদিজা সরল মনের মেয়েমানুষ। কল্লা মুখে বলে, “সে দ্যাখা যাবে ‘খন।”
পরদিন থেকেই কল্লা বেরোয়। তার আগে অবশ্য ঘণ্টাখানেক লেগেছে নিজেকে মেছুনির সাজে সাজাতে। মাথায় নিয়েছে ভাঙা একখানা ঝাঁকা, তাতে রাজ্যের বাতিল জিনিস। শাড়ি চেয়ে নিয়েছে খাদিজার কাছ থেকে। অবশ্য নিজে সবটা পেরে ওঠেনি। খাদিজা সাহায্য করেছে। সব শেষে খাদিজা মুখে আঁচল চাপা দিয়েছে। বলেছে, “খাসা। আফনারে নিজের সতীন মনে অইতাছে।”
বাচ্চাদুটো তাদের আব্বাকে এমন সাজে দেখে ব্যোমকে গেছে। হয়ত চিনতে না পেরে নিজেদের আম্মুর পেছনে গিয়ে লুকিয়েছে।
“আসি?”
“আসেন। দ্যাহেন চ্যাষ্টা কইরা। বেশি রোদ লাগাইয়েন না। না পাইরলে ভাইব্যান না। মনসুরভাইয়া…”
আর কিছু শোনার আগেই কল্লা বেরিয়ে পড়ে। পথচলতি মানুষ ঘুরে তাকায়, সম্ভবত চিনতে পারে না। আগে থেকেই ভেবে রেখেছিল কল্লা। যাই হোক, প্রথমেই দোহারপুর গাঁয়ের বাইরে যেতে হবে। গেলও সে। চক পুরন্দরপুরের গঞ্জ এলাকাটা অনেকটাই বড়। এটা প্রধানত হিঁদুর গাঁ। সেখানে ঢুকেই সে কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে শুরু করে দিল,
“লাইলি লুইলি বাঁশের চোঙ
বাঁশ কাটলে টাকা থোং
ইত্ত টাকা লিবো না
লাইলির বিয়া দিবো না
লাইলির আম্মা কাঁন্দে
গলায় রশি বান্দে।”
এবারে কিন্তু অবাক হওয়ার পালা কল্লার। সে ভেবেছিল, লোকে তাকে পাত্তা দেবে না, বিরক্ত হবে। কিন্তু হল উল্টো। একটা নতুন আমোদ খুঁজে পেয়ে লোকে তাকে ঘিরে ধরল। কে যেন হাততালিও দিল। কে বলল, “আরিব্বাস, বহুরূপী। এখনও এরা বেঁচেবর্তে আছে?”
কে বলল, “আছে, তবে অনেক কমে এসেছে। এ আবার কোত্থেকে এল?”
কে আবার এগিয়ে এসে বলল, “ও মাছুনি, তোমার মাছ কত করে দিচ্ছ? বেশ নরম দেখে দিও, যাতে চেপে ধরলে গরম লাগে।”
স্পষ্টতই অসভ্য ইঙ্গিত। আর তাতেই সম্মিলিত হাসির হররা উঠল। উৎসাহিত হয়ে লাল আলতায় রাঙানো ঠোঁট বেঁকিয়ে কল্লা ধরল,
“লাইলির চোঙে গত্ত গভীর
সেই গত্ত খোঁড়ে টাকার কুমির
টাকা লিতে পারব লাই
চল লাইলি ঘর পলাই
লাইলির বাপে হাস্যে
পরান জলে ভাস্যে।”
হাততালির জোয়ার উঠল। কেউ কেউ অবশ্য, “কী সব ফালতু” বলে ভুরু কুঁচকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। কেউ ঠোঁট বেঁকাল। কিন্তু মোটের উপরে ‘দাও গো, মাছ কিন্যা দাম দিবা না?’ বলতেই তার বাড়িয়ে ধরা ঝোলায় ঝনাৎঝন সিকি আধুলি পড়ল মন্দ নয়। এই শত-তাপ্পি-মারা ঝোলাটাও চাচারই। সব মিলিয়ে বেশ অবাক কাণ্ড বটে, কিন্তু কল্লা অবাক হল নিজের প্রতিই। সেই কবে শোনা চাচার মুখে এই সব ছড়া। কাল রাতে শুয়ে শুয়ে মনে করবার কত চেষ্টা করেছে। কিছু মনে পড়েছে, কিছু ফিকে হয়ে এসেছে। কিন্তু আজ ধরতাই ধরতেই সব লেড়ো গোবরের মত হলহল করে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে। সে ছড়া কাটতে কাটতে কোমর দুলিয়ে এগিয়ে চলল, পেছন পেছন একটা ছোট্ট ভিড়।
শেষ দুপুর নাগাদ ঝোলায় উঁকি দিয়ে কল্লা দেখল, দু’একটা ময়লা নোট আর রেজগি মিলিয়ে কামাই মন্দ হয়েছে বলে তো মনে হচ্ছে না। অথচ খাটনি সেই হিসেবে তেমন কিছুই হল না। কত হল? কল্লার খুব ইচ্ছে হল গুনে দেখে। এদিকে ততক্ষণে হাট ফাঁকা হয়ে এসেছে। খিদেও পেয়েছে কষে। চক পুরন্দরপুরের গঞ্জের এক দোকান থেকে এক প্লেট ঘুগনি আর এক ভাঁড় চায়ে খিদের আপাতত উপশম ঘটিয়ে গ্রামের প্রায় শেষ প্রান্তে একটা বুড়ো নিমগাছের নিচে বসে সবে ঝোলার মুখটা খুলেছে, কে একজন হাত চেপে ধরল। কল্লা চমকে উঠল। দুনিয়ার কোনও জায়গাতেই বাটপাড়ের অভাব নেই। তেমন কেউ নাকি? সে ঘুষি পাকাবার আগেই একটি কচি-পুরুষ-মুখ সামনে। সে বলল, “আহাহা, করো কী, করো কী। পাওয়া গোনা বারণ।”
“মানে?” কল্লা চোখ পাকায়।
“গুরুর মানা যে। তুমি বউরুপি আর তুমি নিজেই জানোনি?”
কল্লাকে নিরুত্তর দেখে ছেলেটি জানায়, বহুরূপীরা ঝোলা পেতে সংগ্রহ করে। সে টাকাকড়ি হতে পারে কিংবা যে যা দেয়। সে সব একটা একটা করে গুনতে নেই। আল্লাহ্ পয়গম্বর হোক কী মহান ঈশ্বর, তারা কি মানুষদের গুনে গুনে আশীর্বাদ করেন? বলেই ছেলেটি অবাক হয়ে তাকায়, “আরে, তুমি আমাকে চিনতে পারলেনি, কল্লাদাদা?”
একসময় চিনতে পারে কল্লা, “তুই মদনা না?”
“হ। চিনছ তাইলে?” মদন একগাল হাসে, “চাচাজী আছে কিমন?”
অনেক কথা হয়। চাচার অনেক আগেই এন্তেকাল হয়েছে জেনে মদন বিমর্ষ হয়। চাচা যখন বেঁচে ছিলেন, তখন তার আরও কিছু বহুরূপী সাঙ্গোপাঙ্গ আসত তাদের বাড়িতে, তার মধ্যে একজন মধু-কাকা। সঙ্গে নিয়ে আসত মা-মরা এত্তটুকুন ছেলেটাকে। সেই ছেলে এত বড় হয়েছে? কল্লা জানতে পারে, মদনের বাপও আজ বেঁচে নেই। দোহারপুরের কড়ে গোনা ক’টি হিঁদু-পরিবারের একটি মধু-কাকাদের।
“এহানে ক্যামনে?”
“সদয় কত্তে আইছিলাম। তমারে দেইহাই চিনছি। একটা হাচা কথা কমু?”
“ক।”
“আমার তো আর কেউ নাই। ভাবছিলাম বাপের লাহান বউরুপি হমু। ঠিকঠাক পারতাছি না। প্যাডে খিদা, মুখে লাজ। তমার রক্তে বউরুপি। আজ দ্যাখলাম তো। আমারে লইবা তমার লগে? ভাইব্বো না। তমার জামা-পিরান সব ফাটাফুটি অইয়া গেছে। আমার লগে বাপের সব সরঞ্জাম আছে। শিবের জটা, কেষ্ট’র বাঁশি, দরগা-বাবার জোব্বা, জাদুকরের জুতা, রাজার তলোয়ার, হনুমানের মুকোশ, ইয়াব্বড় ল্যাজ, মা কালীর জিব্বা, হক্কলডি। সব তমারে দিমু।”
মজা পেল কল্লা, “আমার লগে থাইক্যা তুই করবিডা কী?”
“লগে লগে ঘুরুম। ট্যাহা-পয়সা তুলুম। ধরো, তুমি শিব অইলা বা মা কালী। তহন তুমি তো আর মাঙ্গন চাইতে পারবা না।”
“পারুম না ক্যান?”
মা কালীর মতই জিভ বের করে ফেলে মদন, “এ মা ছিছি। ভগবানের কি ভক্তের সামনে হাত পাইততে আছে?”
খানিক কী ভেবে নেয় কল্লা। বলে, “আমার ঘরে কিন্তু পোলাও কোর্মা হয় না।”
“ভাত হয়? তাইলেই অইব। অ্যাদ্দিন তো মুড়ি-চানাচুর দিয়া কাটতাছে। তাও ধারবাকিতে। কদ্দিন ভাতের মুহ দেহি না।”
“তাইলে চ।”
ঘরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল কল্লা। বুঝতে পারছিল বহুরূপী সাজা তার রক্তে ছিল, এখন ঢেউ তুলেছে। সে সাজবে। রোজ রোজ নতুন নতুন সাজে নিজেকে সাজাবে। নতুন নতুন গ্রামে যাবে। একটা হারাতে-বসা শিল্পকে সে কিছুতেই হারতে দেবে না, নিজেও হারবে না। সে শিব সাজবে, মুরশিদ সাজবে, গয়লানি সাজবে, রাজপুত্র সাজবে, পাদ্রী সাজবে, জাদুকর সাজবে, লেঠেল সাজবে, থুত্থুড়ে বুড়ো সাজবে, হনুমান-বাঁদর-গোড়িলা সব সাজবে…
ভাবতে ভাবতে কল্লা দাঁড়িয়ে পড়ে। নাহ, সে কিছুতেই জমিদার সাজবে না।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন