দোলনচাঁপা

দোলনচাঁপা
জয়শ্রী দাস

বয়স প্রায় সাঁইত্রিশ এখনো বিয়ে করেনি। সে একটি হাসপাতালের সিনিয়র নার্স। ছোট বড় সকলের সেবা করা তার দায়িত্ব। সকাল আটটায় সে হাসপাতালে আসে, বের হয় সন্ধ্যা সাতটায়। কাজ না থাকলেও মানবসেবার কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন ওয়ার্ডে গিয়ে রোগীদের খোঁজখবর নেয়। নামটি তার ফুলের নামে, দোলনচাঁপা। তার একমাত্র বন্ধু তানভীর, স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর গত সাত বছর ধরে সে একা। দোলন তানভীরের এক্কেবারে ছোটবেলার বন্ধু। সম্পর্কটি তাদের তুই তুই। বহুবার তানভীর দোলনকে বলেছে, ‘আমাকে তুই বিয়ে কর, আমিও একা তুইও একা সমস্যা কোথায়?’
দোলন স্বভাবগতভাবেই শান্ত, সে শান্তভাবে জবাব দেয় ‘কোন সমস্যা নেই, তবে সাধারণ মানুষরা আমাদের এ পেশাটাকে সহজভাবে নেয় না, বিয়ের পরে অনেকের চাকরি ছাড়তে হয়েছে।’
তানভীর পিছন ছাড়ে না, প্রতিদিন নিয়ম করে দশ বার ফোন করে। প্রথম প্রথম দোলন বিরক্ত হলেও এখন বরং ফোন না করলে, সে কাজে মন বসাতে পারে না। সারাদিন মনে হয় কখন ফোন করবে তানভীর, কেন ফোন করে না? কোন অসুবিধায় পড়লে নাকি? এমন অনেক প্রশ্ন মনের কোণে উঁকি দেয়। আজ হাসপাতালে অনেক বেশি অসুস্থ রোগী আসায়, দোলন খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ে, ফলে তানভীরের ফোন ধরতে পারেনি। তানভীর সরকারি অফিসের বড় কর্মকর্তা।
তার কাজের অভাব নেই, কিন্তু যখন দোলন ফোন না ধরে তখন তার মন খারাপ লাগে। অফিস শেষে আজ তানভীর সোজা দোলনের হাসপাতালে উপস্থিত হয়। সে দোলনের জন্যে একটি শাড়ি ও একটি সোয়েটার উপহার হিসেবে এনেছে। প্রায় ছয় ফুটের কাছাকাছি লম্বা তানভীর সকলের কাছে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব কিন্তু দোলনের কাছে অবহেলিত।
বাইরে খেতে যায় দুজন। ক্যান্ডেল লাইট ডিনার। তানভীর খুব মন খারাপ করে একটু অভিমানের সুরে দোলনকে বলে ‘তোকে বিয়ে করতে চাই।’
-দেখ তোকে আগেও বলেছি, তুই কয়েকদিন পরেই আমার পেশাকে সহজভাবে মেনে নিতে পারবি না। তার উপর আমার মা বাবাকে আমার দেখাশোনা করতে হয়, তাদের প্রতি মাসে টাকা পাঠাতে হয়।
তানভীর মুচকি হেসে বলে, ‘ঠিক আছে, তুই তোর চাকরি করবি বাবা মাকে দেখবি, সব ঠিক থাকবে তোর টাকা, আমার দরকার নেই, তুই শুধু আমাকে বিয়ে কর, তুই দেখ আমার মনে কত কষ্ট, বিয়ের কয়েক দিনের মাথায় বউটা রাগ করে ডিভোর্স দিয়ে চলে গেল, তার অন্য ছেলের সাথে প্রেম, এ কথা যখন আমাদের বিয়ের কথা আলোচনা হচ্ছিল, তখন তার প্রেমের কথাটা জানালে কি হতো বল? দুইজনের ভালো হতে। বিশেষ করে আমার।’
তানভীরের কথাগুলো শুনে মনে মনে কী যেন ভাবে দোলন অসহায় ভাবে বলল, ‘ঠিক আছে, আমি তোকে বিয়ে করবো।’
দোলনের কথা শুনে তানভীর মনের আনন্দে এই মুহূর্তে আবেগের কোনো কথা বলতে পারল না। মনে মনে কি যেন অনুভব করতে লাগল…।
বাইরে অন্ধকার, দোলনের মনের মধ্যে কেমন জানি করে উঠলো, বিয়ে করলে কোন অশান্তি হবে নাতো!
রাস্তার উল্টো পাশে একটা টেলিভিশনের শোরুম, দোলন স্বাভাবিকভাবে তানভীরকে বলল, ‘চল একটু টিভির শোরুমে যাই।’
-কেন রে? এখনই সংসার সাজানোর চিন্তা করছিস?
ছোটবেলার বন্ধু। তানভীর এর আদ্যোপান্ত সবই জানা দোলনের, তবুও দোলনের গালটা কেমন লাল হয়ে গেল। বিয়ে মানেই একটু লজ্জার বিষয় থাকে।
আকাশে মিটিমিটি করে তারা জ্বলছে, সেই আলোতে মেয়েটির লজ্জায় রাঙা গাল ছেলেটির দেখা হলো না।
শোরুমে গিয়ে দোলন আস্তে আস্তে তানভীরকে বলল ‘দেখ বাবার জন্য কিনবো।সবচেয়ে সেরাটা বাবা-মাকে দিতে ইচ্ছে করে।’
টেলিভিশন কেনার পরে দাম দোলন পরিশোধ করলো যদিও তানভীর অনেক চেষ্টা করেছিল টাকাটা দেবার কিন্তু দোলন দিতে দিল না। দোলনের এ ব্যক্তিত্ব তানভীরের ভালো লাগে।
-বৃহস্পতিবারের বাড়ি যাব তখন টিভিটা নিয়ে যাব।
-দোলন, তুই এবার আমাকে তোদের বাড়ি নিয়ে যা। বাবা মারা যাওয়ার পর বাড়ি যাওয়া ছেড়েই দিয়েছি।
-আমার লজ্জা লাগবে।
-ওরে বাবা এরমধ্যে আবার লজ্জা কোথা থেকে এল। আমাদের তো বাড়ি একই জায়গায়। তোর মা বাবা আমাকে চেনেন।
-না নেব না, আজ সারারাত দুজন ঘুরে বেড়াই, চল?
-চল।
এ শহরে খোলা জায়গা নেই যা আছে তাও আবার ঘেরাটোপের বেড়াজালে আবদ্ধ।
-আচ্ছা তানভীর যারা এভাবে প্রথম প্রথম প্রেম করে তাদের বুঝি একটু হাত ধরে খোলা জায়গায় রাতের আকাশের নীল সাদা খেলা দেখতে ইচ্ছে হয় না?
-হয় হয়তো, তোর কপালে একটু চুমু দিয়ে আদর করি, তুই রাগ করবি?
-রাগ করবো কেন? আমার তো তোকে বুকে পিষে আদর করতে ইচ্ছে করছে। কি যে ভালো লাগছে!
-মানে, তুই কি আমাকে ভালবাসিস?
-খুব খুব ভালোবাসি, বলা হয়নি কখনো। আমার পেশা আর পরিবারের কারণে মুখ ফুটে বলতে পারিনি।
সারারাত ওরা দুজন অনেক পাগলামি করলো, শেষ রাতের আকাশে শুক্লপক্ষের প্রথম চাঁদ ডুবে যাচ্ছে, লেকের ধারে কৃষ্ণচূড়ার তলে যে দুজন বসে রইল। এতো আকর্ষণ আগে কেনো অনুভূত হয়নি, দুজন দুজনাকে নতুন করে জানতে লাগে, নতুন দিনের সূর্য উঠছে, সেই আলোতে তার কপালে তানভীর আদরে আদরে ভরিয়ে তোলে। দোলন ব্যস্ত হয়ে যায়। এরপরও তার কাছে তানভীরের দশবারের ফোন চাই চাই। না দিলেই অভিমান। বুধবার তাদের দেখা হয়। একশ একটি দোলন চাঁপা উপহার দিয়ে তানভীর হাসতে থাকে। চমকে উঠে দোলন।
-কি করে তুই পারলি? এত ফুল তুই কোথা থেকে পেয়েছিস?
দোলন একটা বিষয়ে চিন্তা করে একটু অবাক হচ্ছে তার এত লজ্জা লাগছে কেন? তানভীরকে দেখতে দেখতে বড় হওয়া, এরপরও এত লজ্জা।
তানভীর আস্তে করে বলল, ‘শোনো না, কাল আমি তোমার সঙ্গে যাই, আর শুক্রবারে বিয়ে করি।’
-এই তুই আমাকে তুমি বলছিস কেন?
-প্র্যাকটিস করছি, বিয়ের পর তো তুমিই বলতে হবে, কাল আমি তোর সঙ্গে যাই? ঠিক আছে।
-না আগে মা বাবাকে বলি।
খুব দেরী করবো না, আমার মন বলছে ওরা রাজি হয়ে যাবে।
সাদা শাড়ি, লাল পাড়, কপালে লাল টিপ, দোলনকে যেন ঠিক নতুন বউয়ের মত লাগছে।
বৃহস্পতিবার এ বারোটার সময় দোলনের বাস। দোলনের বাড়ি শহর থেকে দুই আড়াই ঘণ্টার দূরত্ব। দোলন সকাল থেকেই হাসপাতালের সব কাজ খুব দ্রুত করছে, এগারোটার মধ্যে বের হয়ে যেতে হবে, হঠাৎ করেই আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে এমন একজন রোগী আসে, ডাক্তার নার্স সবাই মিলে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। তার অবস্থা একটু ভালোর দিকে গেলে দোলন হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসে।
বাসস্টপে এসে তিনটার বাস ধরে।
বাসের শেষের আসনটিতে দোলন বসল। বাস পথে পথে দাঁড় করানো হচ্ছে, দোলন আজ কেন জানি বিরক্ত লাগছে না। সবকিছুতেই আনন্দ। এরমধ্যে তানভীরের তিনবার ফোন দিয়েছে।কথামালা হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছে।
আজ আকাশটা কি একটু বেশি নীল! গাছের পাতা কি বেশি সবুজ!
যাহোক ঘণ্টাখানেক হল বাস ছেড়েছে এর মধ্যেই শক্ত ব্রেক কষে বাস থামানো হয়েছে।দোলন পিছন থেকে জিজ্ঞেস করল কি হলো?
সামনে থেকে পান খাওয়া নোংরা দাঁত বের করা এক লোক বলল ‘চাক্কা নষ্ট হইছে, দেরি হবে, না থাকতে চাইলে নামেন।’
শীতের সন্ধ্যাটা কেমন জানি টুপ করে নেমে পড়ে, কেবল সাড়ে চারটা এখনই কেমন জানি আকাশের মুখের কালো ভাব। দোলন দুটো আসন নিয়ে বসেছে তার কোলের উপর টেলিভিশনটি। সে খেয়াল করল অনেক লোক তখনই গাড়ির দেরি দেখে এই নির্জন রাস্তায় নেমে পড়েছে, হয়তো তাদের বাড়ি কাছেপিঠে কোথাও। দোলন ভাবছে কি করবে। ঠিক এরইমধ্যে গাড়ির স্টার্ট হওয়ার শব্দ পেল দোলন। মনটা তার খুব ভাল হয়ে গেল। ভাবলো তানভীরকে একটা ফোন করবো,মোবাইলের চার্জ শেষ।
গাড়ির অধিকাংশ লোকই নেমে গেছে সামনে কিছু লোক আছে, গাড়ি চলছে তাদের বাড়িটি বেশি আর দূরে নেই। গাড়ির মধ্যে কেমন একটা দম বন্ধ ভাব, দোলন ভাবল একটু সামনের দিকে গিয়ে বসি, গাড়িতে একটি লাইট জ্বলছে নিভু নিভু করে।
দোলন উঠে দাঁড়ালো। অবাক হয়ে দেখল সামনে চার/পাঁচ জনলোক ছাড়া আর কেউ নেই, সামনে থেকে একটা লোক পিছনে আসতে আসতে কর্কশ স্বরে বলল,
দাঁড়ান কেন? বসেন।
-আমি সামনে যাব? আমার নামার সময় হয়েছে।
দোলন সামনে এগোনোর চেষ্টা করল, লোকটি তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল, দোলন চিৎকার করে উঠলো, সামনের দিকে হাসির শব্দ। তার মাথা বাসের পাটাতনের সাথে কে যেনো চেপে ধরল ধরলো। দোলন অবাক হয়ে ভাবছে, লোকগুলো এমন করছে কেন?
অজ্ঞান হবার আগে বারবার তানভীরের নাম ধরে ডাকলো।
পৃথিবীর সবাই কান বন্ধ করে বসে আছে। প্রিয় তানভীর কেন, কেউ তার ডাক শুনতে পেল না।
পরের দিন সেই নির্জন রাস্তার ধারে দোলনের লাশ পাওয়া গেল। দোলন পৃথিবীর আদিম হিংস্রতার শিকার হয়েছে।একটি পিচাশের নিকট থেকে টেলিভিশন আর দোলনের ব্যাগ উদ্ধার করলো পুলিশ।
তানভীর একা ক্লান্ত শরীরে হাসপাতালের বারান্দায় বসে আছে। দোলনচাঁপার গন্ধে তার চারপাশ ভরে উঠেছে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *