মনি হায়দার
গোলাম কবির যাত্রার মানুষ। বিয়ে করেছে যাত্রাদলের মেয়ে কাকলীকে। কিন্তু এখন আর যাত্রার বাজার নেই। পেটের ধান্ধায় গোলাম কবির যাত্রা ছেড়ে রাজমিস্ত্রিগিরির যোগানদার হিসেবে কাজ করেছে তিন চার বছর। এখন নিজেই রাজমিস্ত্রি। কাজ করে খুব যত্ন করে। ফাঁকি দেয় না। ফলে পসার বেড়েছে। শুরুতে রাজমিস্ত্রির কাজটা করতে চায়নি গোলাম কবির। খুব পরিশ্রমের কাজ। লেখাপড়া একটুও আধটু জানে। কিন্তু নিজের মতো করে কোনও কাজ না পেয়ে শেষে রাজমিস্ত্রির কাজে নামে। গুলশান বারিধারার বড় বড় বাড়ির দেয়াল ও ছাদ রঙ করে সে। বিশাল বাড়ির ছাদ থেকে শক্ত দড়ি ঝুলিয়ে ক্রেনে উঠে রঙ করে।
নতুন একটা বাড়ির দেয়াল রঙ করার জন্য নতুন দড়ি কিনে বাসে করে বাসায় ফিরছিল। গুলিস্তান থেকে দড়ি কিনে পোস্তাগোলা গিয়েছিল ছোট বোনের বাসায়। ছোট বোন রাবেয়াকে খুব ভালোবাসে গোলাম কিবরিয়া। রাবেয়ার বাসা থেকে বের হতে দেরী হয়ে গেছে। পোস্তাগোলা থেকে রাত এগারটায় টেম্পুতে চড়ে এসেছে গুলিস্তান। গুলিস্তানে এসেই বাস পেযেছে কুড়িলের। গোলাম কিবরিয়ার বাসা কুড়িলে। বাস অতিক্রম করছে কাকরাইল। রাত বারোটার কাছাকাছি। বাসে যাত্রী কম। বসেছে বাসের পিছনের দিকে, পা ছড়িয়ে। কিনেছে বেশ মোটা দড়ি। দড়ির প্যাকেট পায়ের কাছে রাখা। প্যাকেট থেকে দড়ির মোটা একটা মাথা বের হয়ে আছে। দুইজনের একটা সিটে বসে মোবাইল হাতে কাকলীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে শোনে কেউ একজন পাশ থেকে কথা বলছে। আশেপাশে কেউ পরিচিত নেই। নিজের মনে প্রশ্ন করে গোলাম কিবরিয়া, ‘কেডায় কথা কয়?’
‘আমি, আমি বলছি।’
পায়ের কাছে রাখা দড়ির গোছার একটি মাথা বের হয়ে আছে। সেই মাথাটা একটু একটু দুলছে আর কথা বলছে। অবাক চোখে দড়ির দিকে তাকিয়ে গোলাম কবির।
‘আমাকে কিনে ভালো করোস নাই। শীগগির ফালাইয়া দে।’
‘ক্যান?’
‘আমারে ফালাইয়া দিয়া বাসায় যা।’
‘আরে মর জ্বালা। মহাজনের নগত টাকা দিয়া কিনছি। হালার দড়ি তোরে হালামু ক্যান?’
‘আমারে লইয়া ঘরে গেলে তোর বিপদ অইবে।’
গোলাম কবির হাসে, ‘দড়ির আবার বিপদ। রাজমিস্ত্রির আট নয় বচ্চরে কতো দড়ি কিনলাম আর হালাইলাম। কোনও দড়ি কোনওদিন টা-টো শব্দ করে নাই। আর তুই কিনা কইতেছোস, তুই আমারে বিপদে ফালাবি?’
‘কইছিতো, তুই আমারে লইয়া তোর ঘরে গেলে বিপদে পড়বি।’
‘পড়লে পড়বো।’
গোলাম কবির একটা পা দিয়ে দড়ির মাথাটা চেপে ধরে। কয়েক মুহুর্ত পর গোলাম কবিরের মনে হয়, পায়ের তলায় সাপের মতো দড়িটা মোচড়াচ্ছে। যত মোচড়ায় গোলাম কবির তত জোরে চেপে ধরে। এক সময়ে মনে হয়, দড়ির মোড়ানো থেমেছে। রাত সাড়ে বারোটার দিকে বাস কুড়িলে গেলে কিবরিয়া খুব দ্রুত নেমে যায়। কাঁধে দড়ির প্যাকেট। মেইন রোড থেকে বাসা খুব কাছে। হাঁটা পথে তিন থেকে চার মিনিট। ডান হাতের মধ্যে দড়ির বান্ডিলটা ঢুকিয়ে বাসার দিকে হাঁটতে শুরু করে। মেইন রাস্তা থেকে একটু ছোট রাস্তায় পড়লেই দড়ি খিক খিক হাসতে থাকে।
‘তুই কিন্তু কামডা ভালো করলি না গোলাম কবির।’
‘তুই তো দড়ি। ছিরবি আমার বালডা।’
‘ভাইরে বাল তো ছেঁড়া যায় না। কেউ কোনওদিন ছেড়েও নাই। গোলাম কবির, তোরে কিন্তু আমি সাবধান করতেছি। আমারে বাসায় নিলে তুই বিপদে পড়বি। শেষে কিন্তু কানবি। জম্মের কানদোন কানবি। আমারে কিন্তু দোষ দিতে পারবি না। আগেই কইলাম।’
ধ্যাৎ, দড়ির বান্ডিলটা ধরে দেয়ালের সঙ্গে একটা আছাড় দেয়। কবিরের মনে হলো দড়িটার মাথা নেতিয়ে পড়েছে। এবং গুমরে গুমরে কাঁদছে। এক ধরনের বিরক্তি আর বিমমিষা নিয়ে বাসায় ঢোকে গোলাম কবির।
বাসায় গেলে কাকলী খেতে দেয়। গরুর মাংস দিয়ে ভাত খেতে খেতে কাকলীকে বলে ‘হোনো এক আজব ঘটনা। হালার দড়িও আইজকাল মাইনষের মতো কতা কয়।’
অবিশ্বাস্য চোখে তাকায় কাকলী, ‘কী আবোল তালোর কতা কও? দড়ি কেমনে মাইনষের মতো কতা কয়?’
‘হেইডাইতো তাজ্জব ঘটনা।’
কাকলী আর গোলাম কবির খেয়ে ঘুমুতে যায়। দড়ির বান্ডিলটা ছিল খাটের নিচে। অনেক রাত হওয়ায় শোওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ে গোলাম কবির। রাত অন্ধকার। প্রধান সড়ক ধরে রাত জাগা ট্রাকগুলো সব ভেঙেচুরে ছুটছে দিকবিদিক। ভ্যাপসা গরমে হাঁসফাস করে পাশে শুয়ে থাকা কাকলী। কিন্তু গোলাম কবিরের মনে হচ্ছে কে যেন তাকে পা থেকে ধীরে ধীরে পেঁচিয়ে ধরছে। ক্রমে ক্রমে পেঁচানোর শক্তিটা বুকের উপর এসে দশ সেকেন্ড বিরতি নিয়ে আবার ওকে পেঁচাতে শুরু করে। বুক থেকে দড়ির মাথা উঠে আসে গলার কাছে। শ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম গোলাম কবিরের। ঘুম ছুটে যায়। উঠে বসে লাইট জ্বালায়।
টেনে হিঁচড়ে পেঁচানো দড়ি গলা থেকে নামায়। রাগে হিস হিস করে গোলাম কবির ‘কী অইচে তোর? কাইল আমার মেলা কাম। আমারে কি ঘুমাইতে দিবি না?’
দড়ির গলা এখন ঠান্ডা, গম্ভীর। ‘গোলাম কবির তোরে না কইলাম, আমারে তোর ঘরের বাইরে হালাইয়া দে। আমারে ঘরে রাকলে তোর বিপদ।’
থু ফেলে কবির, হালার দড়ি। আমার লগে মশকরা! বলতে বলতে বিছানা থেকে নামে।
‘আমারে বিশ্বাস কর।’
‘করতেছি, ভালো কইরা বিশ্বাস করতেছি।’
কবির বিছানা থেকে নেমে বাসার পিছনে একটা বস্তায় অনেক আগের পুরোনো দড়ি বের করে এনে সেই দিয়ে নতুন মোটা দড়িটাকে আচ্ছা করে বাঁধে। বাঁধার সময়ে নতুন মোটা দড়ি মোচড় খায়। কিন্তু দুই পায়ের নিচে ফেলে টাইট করে বাঁধায় মোটা দড়ি আর কিছু করতে পারে না। নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে। কিন্তু থেকে থেকে সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করে। দড়ি দিয়ে আচ্ছা করে দড়ি বেঁধে বস্তায় ভরে খাটের নীচে রেখে দেয় ‘যা শালার দড়ি। দড়ির মতো থাক।’
দড়ি যদিও বস্তার মধ্যে কিন্তু দড়ির ফোস ফোস শব্দ ক্রমশ বাড়ছে। ছোট ঘরটা দড়ির ফোঁস ফোঁস শব্দে কাঁপছে। দু’চোখ এক করতে পারছে না কবির। রাতের ঘুমের ডিসটার্ব সহ্য করতে পারে না গোলাম কবির। সারাদিন গাধার খাটুনি খেটে রাতে নিঃশব্দে ঘুম দরকার।
পাশে ঘুমিয়ে থাকা স্ত্রী কাকলীকে ধাক্কা দেয়, কিন্তু কাকলী নাক টেনে ঘুমচ্ছে। বাধ্য হয়ে গোলাম কবির আবার খাট থেকে নামে। লাইট জ্বালায়। বাথরুম থেকে বালতি ভরা পানি এনে দড়ির উপর ঢেলে দিলে আর ফোঁস ফোঁস শব্দ শোনা যায় না। নতুন এবং পুরোনো সব দড়ি নিস্তেজ হয়ে যায়।
গোলাম কবির হাসে, ‘শালার দড়ি আমারে দুলাভাই পাইচো? আমার লগে চলুকানি? এখন করো ফোঁস ফোঁস। কাইল আরও পানি দিয়া ভিজাইয়া রাখমু।’
বিছানায় আবার শুয়ে পড়ে গোলাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে বস্তাটা কোথাও নেই। নতুন দড়ির বান্ডিল ঠিকই আছে। পুরোনো দড়িগুলো কোথাও নেই। রাতে যে বালতি ভরে পানি দিয়েছিল সেটাও বাথরুমে। ঘরের মেঝের কোথাও পানির চিহ্ন নেই। কাকলী রাতের মতোই ঘুমে বিভোর। কবিরের মনে হচ্ছে নতুন দড়ি ফিক ফিক হাসছে। বিশ্রী আর ভয়ানক উপহাসের হাসি। বিরক্তিতে গোলাম কবির দড়ির বান্ডিলটা বের করে লাথির পর লাথি দিতে থাকে। লাথি দিতে দিতে হাঁপায় গোলাম কবির। হাঁপানোর শব্দে কাকলীর ঘুম ভেঙে যায়। উঠে ধরে গোলাম কবিরকে, ‘তুমি কি পাগল অইয়া গেলা? দড়ি কেমনে কতা কয়? মানুষে হোনলে তোমারে পাগলা গারদে পাডাইবে।’
গোলাম কবির খাটের উপর বসে। কাকলী দড়ির বান্ডিলটাকে মেঝে থেকে উঠিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে একটা হাজিতে রাখে। অনেকক্ষণ ধরে গোলাম কবির বাথরুম, খাট, খাটের নিচে, বারান্দার বস্তাবান্দা পুরোনো দড়িগুলো খোঁজে। কিন্তু কোথাও পুরানো দড়িগুলো দেখে না। কোথায় গেলো দড়িগুলো? হঠাৎ একটা ভাবনায় গোলাম কবিরের মেরুদন্ড দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। নতুন দড়ির বান্ডিল কি পুরোনো দড়িগুলো খেয়ে ফেলেছে?
বিছানায় বসে নিজের মনে ভাবে গোলাম কবির, আমারে কি পাগলে পাইচে? আমার বংশে তো কোনো পাগল ছিল না। মানুষে হুনলে কি কইবে? দড়ি কেমন করে দড়ি খায়? ঘটনাটা কি? যাত্রায় যখন বিবেকের পাঠ গাইতাম, তখন কত আজগুবি গান গাইতে হতো। সেইসব গান কি আমার মনে ভর করছে? আমার কি ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার?
মোবাইল বাজে। হাতে নিয়ে দেখে গুলশান থেকে ফোন দিয়েছে সহকারী ওসমান।
‘ওস্তাদ আপনে কই?’
‘আইতেছি। তোরা কাম শুরু কর।’
গুলশানে বড় একটা বিল্ডিংয়ে রংয়ের কাজ নিয়েছে গোলাম কবির। সকাল ছ’টায় যাওয়ার কথা ছিল, অথচ এখন বাজে সাতটা। বাসা থেকেই বের হতে পারেনি। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। বুঝতে পারে গোলাম কবির, গত রাতে ঠিকমতো ঘুমুতে পারেনি। ঘুম ঠিক মতো না হলে শরীরটা ছেড়ে দেয়। আবার মেজাজ খিঁচড়ে ওঠে নতুন দড়ির উপর, গত রাইত থেকে দড়ির বান্ডিল আমার লগে বিটলামি শুরু করেছে। দড়িগুলো কেটে টুকুরো টুকরো করে ভাসিয়ে দেবে নাকি!
দড়ি ধ্বংসের ব্যাপারটা মাথায় আসার সঙ্গে সঙ্গে গোলাম কবিরের শরীরে বিদুৎ তরঙ্গ বয়ে যায়। দ্রুত সে খাটের নীচে তাকায়। হাজিতে দড়ির বান্ডিল মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ন্যাকা!
‘এই লও তোমার নাস্তা।’
কাকলী নাস্তা নিয়ে ঘরে ঢোকে। কাকলীর সামনে দড়ি কাটা যাবে না। ধীরে সুস্থে নাস্তা খেতে শুরু করে। রুটি আর গরুর মাংস। খেতে খেতে এক সময়ে মনে হয় গোলাম কবিরের, আরে আমি কী খাইতেছি? আমি তো দড়ি খাইতেছি। মুখের ভেতরে গরুর মাংসের টুকরোগুলো দড়ির মতো লাগছে। সামনে বসা কাকলী। কাকলীর দিকে তাকায় গোলাম কবির। মুখ নড়ে না কবিরের।
কাকালী চোখে বিষ, ‘কী হইচে তোমার?’
কিছু না, নাস্তা অর্ধেক খেয়ে উঠে পড়ে গোলাম কবির। গামছায় মুখ মুছে একটা বিড়ি ধরায়। খাটেরই উপর বসে ধীরে ধীরে বিড়ি টেনে দাঁড়ায়। যাবার সময়ে খাটের নীচ থেকে দড়ির বান্ডিলটা নিয়ে যায়। দড়ির বান্ডিল নেওয়ার সময়ে কাকলী বলে, ‘দরকার কী তোমার ওই দড়ি নেওয়ার। থাউক ঘরে।’
‘দড়ি না নিলে কাম করুম তোর বাল দিয়া? এগারো তলা বিল্ডিংয়ের কাম- ঝুলতে হবে না?’
গোলাম কবিরের বাল সংক্রান্ত কথায় ফিচকি দিয়ে হাসে কাকলী। ওর মনে দারুণ একটা চিত্রকল্প জেগে ওঠে। বাল দিয়া কি বিল্ডিংয়ে রঙের কাম করা যায়? আর একজনার দিয়া অইবে? হাজার হাজার মাইনষের জিনিষ লাগবে।
‘আবার মাগি হাসে’, কাঁধে দড়ির বান্ডিল নিয়ে যেতে যেতে আপন মনে গজ গজ করে গোলাম কবির।
সারাদিন কাজ করেছে বিল্ডিয়ে। রঙ দিতে দিতে বেলা গড়িয়ে দুপুর হলে নীচে নামে ওসমান আর গোলাম কবির। ওসমান বাসা থেকে এসেছে শুকনো রুটি আর পাকা কলা। গোলাম কবির কিছুই আনেনি। রাস্তার ধারে একটা সস্তা হোটেলে যায় দুজনে। রুটি আার ভাজি নিয়ে দুজনে ভাঙা একটা বেঞ্চে বসে খেতে থাকে।
‘ওস্তাদ?’ ওসমানের দিকে তাকায় গোলাম করিব।
‘কী?’
‘একটা ঘটনা’, ওসমান খেতে খেতে বলে যায় আপন মনে, ‘আপনার লগে তো অনেক দিন ধরে কাজ করতেছি। কিন্তু আজইকা একটা ব্যাপার দেখলাম…’
‘কী ব্যাপার?’
‘আজকের যে নতুন দড়িটা আনছেন, দেহি কি হেই দড়ির মাতাটা আপনার দিকে কটমট কইরা চাইয়া রইচে। আপনেরে খাইয়া হালাইতে চায়।’
গোলাম কবির রাগে ঘরঘর করে। হালার দড়ি আমারে থুইয়া এহন ধরছো ওসমানরে। কিন্তু ওসমানকে কিছু বুঝতে দেয় না, ‘তোর মাতা ঠিক আছে ওসমান?’
নিজের মাথার উপর হাত ঘুরাতে ঘুরাতে জবাব দেয় ওসমান, ‘আমিও হেইডা ভাবতেছি ওস্তাদ। আমার মাতা কি ঠিক আছে? কিন্তু ওস্তাদ বিশ্বাস করেন, যতবার দড়ির মাথার দিকে তাকাইছি, মুই দেখছি আপনার দিকে দাঁত কটমট কইরা চাইয়া রইছে।’
‘তোরে হেমায়েতপুরে পাঠাইতে অইবে’, পানি খায় ঢকঢক করে দুই গ্লাস গোলাম কবির।
‘হেমায়েতপুরে ক্যান যামু?’
হাসে গোলাম কবির, ‘হেমায়েতপুরে পাগলদের চিকিৎসা অয়। তোরে হেইহানে পাঠাইতে অইবে।’
গম্ভীর গলায় জবাব দেয় ওসমান, ‘আপনে যাই কন ওস্তাদ আমি কিন্তু হাচাই কইচি। আমি যহনই দড়ির দিকে তাকাইচি, দেখছি দড়ির মাথা আপনার দিকে দাঁত মুখ খিচাইয়া চাইয়া রইচে। পারলে আপনেরে ধাক্কা দিয়া নিচে হালাইয়া দেয়।’
‘ধাক্কা দিলে আমারে দেবে? তোরে দেবে না?’
‘না। আমার লগে দড়ি কথা কইছে।’
গোলাম কবিরের মুখের রুটি আটকে যায়। দড়ি কথা বলছে ওসমানের সঙ্গে? দড়ি কি আমার বিরুদ্ধে ওসমনাকে দিয়ে কোনও ষড়যস্ত্র করতেছে? এই দড়ি কোন পক্ষে? নির্মম রাজাকার? বিষাক্ত আলবদর? নাকি নিমকহারাম আলশামস? নাকি পক্ষের মুক্তিযোদ্ধা?
আবার পানি খায় দুই গ্লাস। মুখটা নোনতা লাগছে। ইচ্ছে করছে ওসমানের গালে কষে গোটা কয়েক থাপ্পড় দিতে। কিন্তু নিজেকে সামলে নেয় শেষ রুটিটুকু খেয়ে চায়ের কাপে চুমুক দেয় গোলাম কবির, ‘ওসমান?’
‘জে ওস্তাদ?’
‘দড়ি নামাইয়া আন।’
‘ক্যান ওস্তাদ?’
‘আইজ আর কাম করমু না।’
বিড়ির গোড়ায় টবটব কয়েকটা টান দিয়ে ওসমান কাছে আসে, ‘ওস্তাদ? আপনে কি আমার লগে লাগ করছেন?’
‘আরে না।’ গোলাম কবির নিজেকে ঢেকে রাখে, ‘তোর লগে রাগ করুম ক্যা। আমার শরীরটা ভালো লাগেতেছে না। কাইল খুব ভোরে আইয়া কাজ করুম। এহন যা, দড়ি কাচি সব লইয়া আয়।’
ওসমান বিরস মনে চলে যায়।
সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরতে দেখে কাকলী অবাক। সাধারণত কাজে গেলে গোলাম কবির কাজ শেষ করে মহাজনের হিসাব মিটিয়ে সন্ধ্যার পরেই ফেরে। অনেক সময়ে আড্ডা দিয়ে বিড়ি-টিরি টেনে আরও পরের দিকে ফেরে বাসায়। সেই লোক আজ দুপুরের পর পরই এসেছে? কারও সঙ্গে রাগ করেছে নাকি? দরজায় এসে দাঁড়াইতেই কাকলী জিজ্ঞেস করে, ‘নতুন দড়ি কই?’
‘ক্যান? গলায় দড়ি দিবি?’
হাসে কাকলী, ‘তুমি থাকতে ওই চ্যাটের দড়ির লগে মরবো ক্যান? মরলে মরবো তোমার লগে। কও দেহি দড়ি কিরছো? হালাইয়া দিয়া আসছো?’
বাসায় ঢোকা আগে দড়ি সামনের ছোট্ট বারান্দার উপর ফেলে দিয়েছে কবির। ঘরে ঢুকে খাটের উপর বসতে বসতে জবাব দেয়, ‘যে হরম দড়ি দড়ি করতেছো. মনে হয় তুই আমারে বিয়া করো নাই। বিয়া করছো দড়িরে। আমি যে শরীর খারাপ লইয়া বাসায় আইলাম, হেই খবরতো লইলি না।’
কাকলী দু’হাতে জড়িয়ে ধরে গোলাম কবিরকে, ‘আমার রসের নাগরের আইজ কি অইচে? এতো চটচট কতা কয় ক্যা?’
কাকলীর আদর বিষাক্ত লাগছে গোলাম কবিরের। কাকলীর দু’হাত থেকে ছাড়িয়ে নিজেকে বিছানায় স্থাপন করে। কাকলী বারান্দায় গিয়ে দড়ি দেখে দু’হাতে করে ভিতরে নিয়ে আসে। খাটের নীচ থেকে আগল বের করে দড়ি সুন্দরভাবে গুছিয়ে রেখে, আবার আগলটাকে খাটের নীচে পাঠিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ে গোলাম কিবরিয়ার পাশে। কিবরিয়ার মুখে চটাস করে একটা চুমু খেয়ে জড়িয়ে ধরে। দুপুরের এই আদরকে কিবরিয়ার কাছে পীড়ন মনে হয়। এক ঝটকায় কাকলীকে খাট থেকে ফেলে দেয় নীচে। নীচে পড়ে কাকলী অবাক, মুহুর্তে দড়ি আগল থেকে বের হয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে পর পর কয়েকটা চুমু খায়। হঠাৎ দুপুরে কামকাতর আঠালো চুমু কাকলীকে অবস করে দেয়। অদ্ভুত আনন্দে, শিহরণে দড়িটাকে বুকের সঙ্গে পেঁচিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়ে কাকলী।
সন্ধ্যার আগে আগে ঘুম ভাঙে গোলাম কবিরের। অবাক হয়ে দেখে, কাকলী দড়িটাকে বুকের মধ্যে পেঁচিয়ে ঘুমিয়ে আছে। মগজের মধ্যে আগুন লেগে যায় গোলাম কবিরের। শালার দড়ি! কাকলীর কাছ থেকে দড়িটাকে কেড়ে নিয়ে ফেলে দেওয়ার জন্য হাত বাড়ায়, সঙ্গে সঙ্গে দড়িটা বিকটা একটা সাপ হয়ে লকলকে জীহব্বা বের করে ওকে দংশন করতে চায়। গোলাম কবির এক টুকরো পাউরুটির মতো বিছানার উপর উঠে বসে। সাপটাকে মারার জন্য একটা কিছু খোঁজে, খুঁজতে খুঁজতে হাতের কাছে পেয়ে যায় দরজার দাসা। দাসা হাতে নিয়ে কাকলীর দিকে তাকায় বিভ্রান্ত গোলাম কবির, দড়িটা আর কাকলীকে পেঁচিয়ে নেই। দড়ি! কোথায় গেলো দড়ি?
নুয়ে খাটের নীচে তাকালে দেখতে পায়, দড়ি আগলের মধ্যে চুপচাপ শুয়ে আছে।
গোলাম কবিরের এখন নীচে নামতেই ভয় পায়। দড়ি যদি সাপ হয়ে যায়? সাপ হয়ে কামড়ায়? ছোটবেলা থেকে সাপকে খুব ভয় পায় গোলাম কবির। একবার বাড়ির সামনে প্রায় গভীর জঙ্গলে গিয়েছিল পাকা কাঁঠালের তালাশে। কাঁঠাল গাছের পাশেই বড় একটা গর্ত। মাত্র কাঁঠাল গাছের পাশে দাঁড়িয়েছে কবির, গর্তের মুখে শুয়ে থাকা বিরাট লাল রঙের একটা সাপ গোলাম কবিরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভয়ে এবং ত্রাসে গোলাম কবির সেদিন অলিম্পিক বিজয়ের দৌড় দিয়েছিল বাড়ির দিকে। দৌড়ায় আবার পিছনে ফিরে তাকায়, ওর সঙ্গে সাপটা অনেক দূর এসেছিল। মনে হয়েছিল, লাল টকটকে সাপ থেকে মুক্তি নেই। দৌড়ে উঠোনে পৌঁছানোর পর পিছনে তাকিয়ে দেখে, সাপটা নেই।
সেই থেকে সাপ গোলাম কবিরের চোখে ভয়ংকর কদাকার একটা প্রাণী। সেই কদাকার প্রাণী এখন তার বাসায়, খাটের নিচে সাজিতে!
‘কাকলী?’ গম্ভীর স্বরে ডাকে বৌকে।
কাকলী এক ডাকেই জাগে এবং উঠে বসে। চারদিকে তাকিয়ে প্রথমেই জিজ্ঞেস করে, ‘দড়িটা কই?’
প্রবলভাবে নিজেকে ঠান্ডা রাখে গোলাম কবির। ধীরে সুস্থে বিড়ি ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে, ‘দড়ি আছে দড়ির জাগায়। তুই আমারে খেতে দে। আমার খিদা লাগছে।’
‘দিতাছি’, উঠতে ঊঠতে কাকলী মাথা নীচু করে খাটের নীচে তাকায়। আগলে দড়ি আছে। কাকলীর মুখে একটা প্রশান্ত প্রসন্ন ভাব দেখে কবির। বিড়ি টানতে টানতে গোলাম কবির সিদ্ধান্ত নেয়, দড়িটা আসলে একটা শনি। যেদিন জোর করে বাসায় নিয়ে আসার পর থেকেই একটার পর একটা অঘটন ঘটেই চলেছে। আাবার দেখো, খানকি দড়িটার সঙ্গে কাকলীর কীরকম ভাব হয়েছে? শেষ পর্যন্ত দড়িটা কি আমার কাকলীর মধ্যে সাপ হয়ে উঠবে? নাহ, সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথম কাজ হবে গুলিস্তান গিয়ে দোকানে দড়ি ফেরত দেয়া। না, টাকা পয়সার দরকার নাই। দড়ির দড়াদড়ি থেকে মুক্তি পাওয়াই এখন বড় কাজ।
রাতে ঘুমুতে যাওয়ার সময়ে গোলাম কবির দড়িটাকে পুরোনো কয়েকটা বস্তার মধ্যে ভরে মুখ শক্ত করে বাঁধে। কিন্ত বেঁধেও সন্তষ্ট হতে পারে না সে। বস্তার মুখ বাসায় থাকা গজাল লোহা দিয়ে পিটিয়ে আটকে দিয়ে কিছুটা সন্তষ্ট হয় কবির। যখন গজাল লোহা দিয়ে বস্তার মুখ পিটিয়ে আটকে দিচ্ছিল, তখন কাকলী ওর দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে ছিল, খেয়াল করেনি গোলাম কবির। তাকালে বা খেয়াল করলে দেখতে পেতো তখন কাকলীর চোখের দৃষ্টিতে কয়েক শত নাগ নাগিনী ফণা বিস্তার করে নাচছিল। এবং আরও দেখতে পেতো কাকলীর চোখের ভেতরে শৈশবে ভয় দেখানো লাল টকটকে সাপটাও সাঁতার কাটছে।
বস্তাটা আজ আর বাসায় রাখে না গোলাম কবির। সাপটাকে না দড়িটাকে আর বিশ্বাস করতে পারছে না রাজমিস্ত্রি গোলাম কবির। দড়ি ভরা বস্তাটাকে বাসার বাইরে ময়লা আবর্জনা ফেলে এলাকার মানুষ, সেখানে রেখে আসে। ঘরে ঢুকে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ে কবির। অন্ধকারে গোলাম কবির দেখতে পায়নি, কাকলী অন্ধকারে দড়ি হয়ে গেছে। সারাদিনের ধকলে, মানসিক পীড়নে দ্রুতই ঘুমিয়ে যায় গোলাম কবির।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে, বিছানায় কাকলী নেই। হাই তুলে বিছানা থেকে নামে গোলাম কবির। রান্নাঘর থেকে কোনও শব্দ না পেয়ে যায় সামনের বারান্দায়। দরজা খুলতেই মুখের উপর দেখতে পায় একজোড়া আলতা মাখানো পা। আলতার একটু উপরে শাড়ির গোলাকার ভাজ। পা এবং শাড়ির ভাজ ধরে ধরে উপরে তাকায় গোলাম কবির। কাকলী দড়ি গলায় দিয়ে ঝুলে আছে কড়িকাঠের সঙ্গে। আর ঝুলে থাকা দড়ির মাথাটা গলার পাশ দিয়ে নীচের দিকে ঝুলে আছে খুব নীরিহভাবে। হতবাক গোলাম কবির বসে পড়ে কাকলীর পায়ের সোজা, নীচে। কী করবে, কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না কবির। তাকায় কাকলীর গলার কাছে। দড়িটা চমৎকার আদরে আটকে রেখেছে কাকলীর মসৃন গলাটাকে। গলা বেয়ে বেয়ে টাটকা রক্ত পড়ছে ফোটা ফোটা করে গোলাম কবিরের মাথার উপর।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন