মোহিত কামাল
যানজটে স্থির হয়ে আছে যাত্রাপথ। অপেক্ষা করতে করতে ঘড়ির দিকে তাকাল সিমু। সময়ের কাঁটা স্থির নয়; কেঁপে কেঁপে ঘুরছে নিঃশব্দে। মনোযোগ দিয়ে তাকানোর পর বুঝতে পারল ঘড়ির কাঁটা কাঁপছে না। এগোচ্ছে থেমে থেমে। সময় চলে যাচ্ছে। ঠায় পঞ্চাশ মিনিট সিমু সিএনজি অটোরিকশায় বসে আছে তো আছেই।
যাত্রীর সিটের দুপাশে রয়েছে চিকন রডের গ্রিল। ভেতর থেকে গ্রিল আটকিয়ে যাত্রীর নিরাপত্তাব্যবস্থা বাড়ানো হয়েছে অটোরিকশায়। হুক লাগিয়ে গ্রিল আটকিয়ে রেখেছে সিমু। মনোযোগ দিয়ে হুকটা দেখে নিল এবার। মৃদু হাসি ফুটল মুখে। এ হুক লাগিয়ে কি ছিনতাইকারীদের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে যাত্রীদের? বাহির থেকে আঙুল ঢুকিয়ে সহজে খোলা যাবে হুকটা। একজন যাত্রী ভেতরে থাকলে দুদিক থেকে সহজে উঠে যেতে পারে দুই ছিনতাইকারী! ছিনতাইয়ের কথা মনে আসার সঙ্গে সঙ্গে ভয় জাগল মনে, বেড়ে গেল হৃদক্রিয়া; বুক ধড়ফড়।
ফুটপাত ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে একজন ট্রাফিক পুলিশ। অসহায় ভঙ্গিতে একাকী দাঁড়িয়ে থাকলেও উদ্বেগের চিহ্ন ফুটে আছে তার চোখেমুখে। সামনের অটোরিকশার একজন যাত্রী ট্রাফিক পুলিশকে প্রশ্ন করল, “ভাই, যানজট কি খুলবে?”
পুলিশ জবাব দিল, “জানি না।”
“কী হয়েছে, জানেন?”
“মারপিট হয়েছে ঢাকা কলেজের সামনে। গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। তাই জ্যামে পড়েছে পুরো মিরপুর রোড।”
আশায় আশায় ছিল, এই বুঝি ছুটবে গাড়িজট। পুরোনো, নতুন, অত্যাধুনিক গাড়িময় মিরপুর রোড দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চুপ; ভটভটানি নেই, ধোঁয়া নেই, পোড়া তেলের ঝাঁজ নেই। আহা, কত সুন্দর পরিবেশ! জটে থাকলেও থেমে ছিল পরিবেশের কষ্টভোগ। অস্থির হলেও মেনে নিচ্ছিল জটের শহর ঢাকায় চলাচলের ঝক্কি-ঝামেলা। ট্রাফিক পুলিশের উত্তর শুনে বুকে চাপ বোধ করতে লাগল। অসহায়ভাবে ভোগ করতে লাগল সময়দূষণের পীড়ন। শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, পরিবেশদূষণ―এসব শব্দের সঙ্গে ইতিমধ্যে ঘটে গেছে জীবনযাপনের ঘনিষ্ঠতা। নতুন শব্দ ‘সময়দূষণ’ চাপ তৈরি করছে বুকে। জ্বলে উঠছে বুক। কাঁধের ক্যাজুয়েল ব্যাগ থেকে সিমু বের করল মিনারেল ওয়াটারের একটা ছোট বোতল। এক ঢোক চালান করে দিল গলার ভেতরে। কিছুটা কমে এল জ্বলুনি।
আকস্মিক জেগে উঠেছে ঘুমন্ত মৃতপ্রায় মিরপুর রোড। সময়দূষণের বিপর্যয় কাটিয়ে নড়ে উঠেছে গাড়ির চাকা। স্টার্ট নিয়েছে সবগুলো গাড়ি। শুরু হয়েছে বিভিন্ন ধরনের শব্দ -প্যাঁপ্যাঁ, পিঁপিঁ, ক্যারক্যার, হিসহিস, ফোঁসফোঁস। উচ্চ ডেসিবেলের ভয়ঙ্কর শব্দদূষণ কান দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে মস্তিষ্কে। আক্রমণ করছে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ, নিউরন। এখন মনে হচ্ছে, সময়দূষণই ভালো ছিল। এ বোধ টিকল না বেশিক্ষণ। ডানপাশের বাসের তল থেকে হুঁস করে কালো ধোঁয়ার এক টানেল ঝড় এসে আক্রমণ করল সিমুকে। জ্বালা ধরে গেছে চোখে। শুরু হয়েছে নাকজ্বলা। কাশতে গিয়েও থেমে গেছে কাশি। দম বন্ধ হয়ে আসছে।
হায়! একেই কি বলে পরিবেশদূষণ, ব্যক্তিআক্রমণ? গ্রিনহাউস দূষণ?
বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের ছাত্রী সিমু বুঝতে পারল, কার্বনের নিজের নিঃসৃত হওয়ার কোনো ক্ষমতা নেই। নির্ভেজাল কার্বন কখনো কয়লা, কখনো হীরা। যখন কয়লা পোড়ানো হয় কিংবা জীবাশ্ম-জ্বালানি জ্বালানো হয়, কার্বনের সঙ্গে অক্সিজেন যুক্ত হয়ে তখন তৈরি হয় বিষাক্ত কার্বন মনোক্সাইড কিংবা গ্রিনহাউস গ্যাসের মূল উপাদান কার্বন ডাই-অক্সাইড। অন্য দুটি গ্রিনহাউস গ্যাস হচ্ছে, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড। বিশ্বে লাল ঘণ্টা বাজিয়ে দিচ্ছে এ তিনটি গ্রিনহাউস গ্যাস―বিশ্বব্যাপী এগুলো কমাতে হলে কমাতে হবে পেট্রলের ব্যবহার। এসব কথা জানা আছে সিমুর। সবার দাবি এক হলেও, এ মুহূর্তে ও গ্যাসের আক্রমণে দিশেহারা হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে ফুসফুসের শাখা-প্রশাখা বেয়ে নির্ভেজাল কার্বন পৌঁছে গেছে রক্তের লোহিতকণিকার সঙ্গে। কার্সিনোজেনিক এ কার্বন জাগিয়ে তুলতে পারে ক্যানসারের সেলকোষ। ভয়াবহ এ গ্যাসের দাপট ও আক্রমণ থেকে কীভাবে বাঁচবে নিরীহ যাত্রীরা? কেন তারা বিষ নেবে পথেঘাটে বসে? কে রুখবে এ সর্বনাশ?
ভাবনার চাকা থামিয়ে মিনারেল ওয়াটার ছুঁড়ে নাকে পানির ঝাপটা দিল সিমু। অটোরিকশা চলতে শুরু করেছে। দুলুনিতে পানির ছাট উড়ে এসে কামিজ ভিজিয়ে দিল। ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে ও নাক মুছে নিল। কয়েকবার কাশি দেওয়ার পরও জ্বলুনি কমছে না। মাথা চক্কর দিয়ে ওঠায় সামনের গ্রিলের সঙ্গে দু’হাতে ঠেস দিয়ে বসে থাকল সিমু। ঢাকা শহর ঘিরে জলপথ, উড়ালপথ, পাতালপথের কথা ভাবা হচ্ছে। সময়দূষণ থেকে বাঁচার জন্য পথগুলো কবে তৈরি হবে, বলা যাচ্ছে না। তবে মেট্রোরেল পথ নির্মাণের কাজ এগিয়ে যাওয়ায় আশাবাদী হচ্ছে মন। যে পার্টি রাজনৈতিক ইশতিহারে তিন পথ তৈরির বিষয়টিকে গুরুত্ব দেবে, সেই পার্টিকে ভোট দেবে সিমু। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, ও রাজনৈতিক কর্মসূচিকেই বেশি গুরুত্ব দেবে। জনগণকেও গুরুত্ব দিতে হবে একইভাবে। নইলে কোনও সরকারের টনক নড়বে না। নিত্যদিনের ভোগান্তি সইবে মানুষ। সইতে সইতে অসুস্থ হয়ে পড়বে। আক্রান্ত হবে ক্যানসারে, হাইব্লাডপ্রেশারে। দৈনন্দিন যাত্রায় যানজটের চাপে পড়ে চাকরি হারাবে অনেকে, ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘমেয়াদি রোগের বীজ রোপণ করবে দেহে। এসব হতে দেওয়া যায় না। ভাবতে লাগল সিমু।
রাজনৈতিক ভাবনা ঝেড়ে এবার ও সামনে তাকাল। ঝাপসা দেখছে চোখে। জ্বালাপোড়া কমলেও ঝাপসা দেখছে কেন? ভয় পেয়ে গেল। কোনো ক্ষতি হয়ে গেল না তো চোখের! ভীত হয়ে অটোরিকশাচালককে জিজ্ঞেস করল, “ভাই, পাশের বাসটাকে এড়ানো যায় না কোনওভাবে?”
কথার অর্থ ধরতে না-পেরে পেছনের দিকে তাকিয়ে চালক বলল, “কী কন, বুঝবার পারি নাই।”
“ওই যে, পাশের বাসটা ভসভস করে ধোঁয়া ছাড়ছে, ওই দানব থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকুন; হয় সামনে বাড়ান অথবা নিরাপদ দূরত্বে পিছিয়ে থাকুন।”
“আফা, সামনে যাওনের উপায় নাই! গাড়ি তো আমি চালাই না। রাস্তার টানে গাড়ি চলে। অহন দাঁড়ালেই পেছনে জ্যাম বাইরা যাইব। চিৎকার করব পিছনের গাড়ির ড্রাইভার। আর দেখতেই পারছইন, ইচ্ছামতো আগানো যাচ্ছে না সামনে। সাইডে সরারও কুনু উপায় নাই। এ দুর্ভোগ সইতে হইব, উপায় নাই। আফনি তো অহন কষ্ট পাচ্ছেন। আমরা হগলে প্রত্যেক দিনই কষ্ট পাই; গ্যাস পুড়াই, আয়-রোজগার হয় না। হের লাইগা চাই বাড়তি বকশিশ।”
কী কথার টানে ঢুকে পড়েছে কী কথা! নিজেকে শাসাল সিমু। পকেটে আছে মাত্র একশ টাকার একটা নোট। বিল এখনই উঠে বসে আছে সত্তর টাকায়-আরও কত উঠবে বুঝতে পারছে না। ইঞ্জিন বন্ধ থাকে জ্যামে আটক থাকার সময়, গ্যাস পোড়ে না; সময় খরচ হয়, সেটা ঠিক। বসে থাকার জন্য এক্সট্রা ভাড়া দিতে হবে কেন? এ কথার কোনও জবাব নেই। গাড়ি চলছে হেঁটে হেঁটে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। এভাবে চললে তেল-গ্যাস বেশি পুড়বে-এটা সত্যি। চালককে পুরো দোষ দিতে পারল না সিমু। বাড়তি ভাড়ার কথা শুনে গলা বসে গেল। ধোঁয়ার চাপে নাক জ্বলছে, চোখ জ্বলছে। আবার বাড়তি ভাড়ার কথা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতরটা জ্বলা শুরু হয়েছে।
হঠাৎ বড় বাসটার দিকে খেয়াল করল ও। বাইরের রং দেখে বোঝা যায়, বহু পুরোনো বাস এটা। রংচং মেখে নতুন করার চেষ্টা করা হয়েছে। ইঞ্জিন যে ভালো নেই, বোঝা যায় এর নির্গত ধোঁয়ার পরিমাণ থেকে। পুরোনো গাড়ি রাস্তা থেকে উঠিয়ে দেওয়ার একটা নীতিমালার কথা শুনেছিল সিমু। মনে হচ্ছে, নীতিমালার ভয়ে মালিকরা বাইরের রং মেখে দায় সেরেছে। চালিয়ে যাচ্ছে পুরোনো গাড়ি। এ গাড়ি তার মতো নিরীহ পথচারী কিংবা যাত্রীদের বড় শত্রু। এ শত্রু রুখবে কীভাবে সাধারণ মানুষ?
থেমে থেমে চলছে গাড়ি। ইঞ্জিন বন্ধ হচ্ছে না গাড়িগুলোর। কিছুক্ষণ পর ফোঁসফোঁস করছে ইঞ্জিন, যেন চলতে গিয়ে গাড়িগুলো দম ছাড়ছে। তখন ভস করে বের হয় কালো ধোঁয়া। পৃথিবীর গর্ত থেকে সব জ্বালানি বের করে এনে, বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি গাড়ি চালানো হচ্ছে রাস্তায়। জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে গিয়ে মানুষই তৈরি করছে পৃথিবীর জন্য মরণফাঁদ; তৈরি করছে কয়লা, গ্যাস বা কার্বন ডাই-অক্সাইড। এ গ্যাসের স্তর সূর্যরশ্মি আটকাতে পারে না, কিন্তু ঊর্ধ্বমুখী সঞ্চালিত পৃথিবীপৃষ্ঠের তাপ আটকে যায় কার্বন ডাই-অক্সাইডের স্তরে। ফলে উষ্ণতা বাড়ছে পৃথিবীর। ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে পৃথিবী, সভ্যতা। এ ধ্বংস রোধ করতে হলে কমাতে হবে কার্বন ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ-মাত্রা। কমাতে হবে কৃষিজাত আরও দুটি গ্রিনহাউস গ্যাস-মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড। সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য এগিয়ে আসতে হবে বৃক্ষবিজ্ঞানকে। গড়ে তুলতে হবে সবুজ প্রকৃতি। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গাছ লাগাতে হবে। বন্ধ করতে হবে বৃক্ষনিধন। অকস্মাৎ থেমে গেল সিমুর সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন, সুন্দর আর বৈজ্ঞানিক ভাবনা। পেছনের একটা গাড়ি ধাক্কা দিয়েছে তাকে বহন করা অটোরিকশাকে। বুকটা ধক করে ওঠে সিমুর। বাঁ হাতটা সামনের গ্রিলের সঙ্গে ঠেস দেওয়া ছিল। ভয়াল ধাক্কা সামলে উঠে দেখে, তার চালক নেমে গেছে, সিটে নেই। অটোর পেছনে লেখা থাকে ‘আমি ছোট, আমাকে মেরো না।’ অটোর সেই আহ্বান শোনেনি একটা মিশুক। এক ছোট আরেক ছোটকে ধাক্কা দিয়েছে। ও ব্রেক নিয়ন্ত্রণহীন মিশুকে চড়তে ভয় পায়। হালকা যানগুলো কেন যে রাস্তা থেকে উঠিয়ে দেওয়া হয় না, বুঝতে পারে না সিমু। বাইরে এসে দেখে, তার চালক ঘুষি চালিয়ে দিয়েছে মিশুকের চালকের মুখে। নাক ফেটে রক্ত ঝরছে ওই চালকের। ভয়ংকর দৃশ্য! রক্তপাতের মতো কাণ্ড ঘটে গেছে মুহূর্তে! কী করবে সিমু? রুমাল আছে নিজের ব্যাগে। এ মুহূর্তে হেলপ করতে হবে মিশুকের চালককে। রক্তাক্ত হয়ে গেছে এক জ্যান্ত মানুষ। কেউ এগিয়ে আসছে না তাকে সাহায্য করতে। এখনও ওর চালকের মেজাজ কমছে না। নতুন করে সিমু দেখল আরেক জীবনদর্শন―মেজাজদূষণ।
আক্রমণকারী চালককে থামতে বলছে সে, থামছে না। উড়ে উড়ে যাচ্ছে রক্তাক্ত চালকের দিকে।
ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে মিশুকের চালকের হাতে দিয়ে সিমু বলল, “ভাই, নাক চেপে ধরুন রুমাল দিয়ে; রক্ত থামান।” বলতে বলতে দুই চালকের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেল সিমু।
কিছুটা সচল হয়েছে জ্যামের চাকা। মোটামুটি স্পিডে চলা শুরু করেছে পাশের গাড়িগুলো। ওদের পেছনের গাড়ির চালকেরা চিৎকার করছে। একজন চেঁচিয়ে বলছে, “এই খানকির পো, গাড়ি চালা।”
গালি শুনে নিথর হয়ে গেল সিমু। বোঝে, শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, সম্মানদূষণ, মেজাজদূষণ, সব ছাড়িয়ে ভয়ংকর গালিদূষণও ভারী করে তুলছে চারপাশ। রক্তাক্ত ড্রাইভার নাকে রুমাল চেপে উঠে বসেছে মিশুকে। অটোর চালকও গিয়ে বসেছে সিটে। ভয়াল দৃশ্যপট মগজে গেঁথে সিমুও উঠে বসল নিজের সিটে। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। জ্যাম ছুটে যাচ্ছে। জীবন আবার চলতে শুরু করেছে স্বাভাবিক নিয়মে। মুহূর্তের অসর্তকতার কারণে পেছন থেকে আকস্মিক আঘাত করেছিল মিশুক, রক্তাক্ত হয়ে গেছে একজন চালক। কারও ভ্রুক্ষেপ নেই, যে যার মতো চলছে। এটাই জীবন। জীবন থেমে থাকে না। এ ধরনের জীবনদর্শন মানুষ মনে রাখে না। মনে রাখলে নিশ্চয় ঘটত না এমন মেজাজদূষণ, ঘটত না সহিংসতা, জানে সিমু। মনে হচ্ছে, গ্রিনহাউস দূষণের চেয়েও বড় দূষণ হচ্ছে মানুষের এ ভয়ংকর মেজাজদূষণ। কোনও কোনও সময় আকস্মিক তাণ্ডব ঘটিয়ে দেয় মেজাজ, যেমনটি ঘটেছে এখন। কোনও কোনও মেজাজের ঊর্ধ্বগতি ঘটে পরিকল্পনার ছক অনুযায়ী। যেমন-টুইন টাওয়ার ধ্বংস, ইরাক ধ্বংস, আফগানিস্তান ধ্বংস, পাকিস্তানও এগিয়ে যাচ্ছে ধ্বংসের দিকে। পৃথিবীর এ ধ্বংসের তুলনায় গ্রিনহাউস গ্যাসের ধ্বংসাত্মক দানবটাকে মনে হয় শিশুদানব। তবু আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলনে যৌক্তিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি বিশ্বের নেতারা! সিমু ভাবল, আগে সচেতন হতে হবে ব্যক্তিকে; মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তারপর হয়তো বা রোধ করা যাবে সভ্যতার বিনাশ। তারপর হয়তো শাণিত হবে মানুষের মস্তিষ্কজাত চিন্তার ধার। সেই ধার হয়তো জলবায়ুর উষ্ণতারোধ করে সভ্যতার ধ্বংস ঠেকাতে পারবে।
হলের যত কাছে পৌঁছাচ্ছে তত শঙ্কা বাড়ছে সিমুর। পকেটে আছে একশ টাকা। মিটারও প্রায় একশ ছুঁইছুঁই করছে। রাস্তা ফাঁকা না-পেলে নীলক্ষেত থেকে হলে পৌঁছতে আরও কত টাকা বিল উঠবে, বুঝতে পারছে না। সভ্যতার উন্নতি নিয়ে চিন্তা সরে গেছে মাথা থেকে। রক্তাক্ত চালকের অসহায় মুখও ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে মনের চোখ থেকে। সময়দূষণ, গালিদূষণ, মেজাজদূষণ থেকেও মুক্তি ঘটেছে। গাড়িজটের দূষণ থেকে এখনও মুক্ত হয়নি মন। গ্যাস পুড়ছে সিএনজি অটোরিকশার। সেই সঙ্গে বিলদূষণ ঘটছে। অর্থনৈতিক দূষণের চাপ ক্রমেই বাড়ছে। বারবার হাত চলে যাচ্ছে ছোট্ট পার্সটার ওপর। ছোট জিনিসের এত মহৎ গুণ! মন দখল করে আছে পার্সটি। নীলক্ষেতের মোড়ে থেমে আছে অটোরিকশা। ইচ্ছা করছে নেমে যেতে। নেমে গেলে উদ্ধার পাওয়া যাবে একশ টাকা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে। এ পথটুকু হেঁটে যাওয়ার শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। নামার শক্তি নেই। তবু ও বাঁপাশের হুক খুলল নামার জন্য। এ সময় ফুটপাত থেকে ঝুপ করে অটোর পাশে এসে দাঁড়াল বদিউল আলম বদি। সহপাঠী বদি বলল, “হলে যাচ্ছিস?”
“হুঁ”, কাতর স্বরে জবাব দিল সিমু।
“আমিও যাচ্ছি টিএসসির দিকে। ওঠব? নিবি আমাকে?”
“ওঠ। এমন অসহায়ভাবে বলছিস, মনে হয় তাড়িয়ে দেব তোকে?”
“তাড়িয়ে দিবি ভাবিনি। তোর মুখের যে রকম অভিব্যক্তি দেখছি, মনে হচ্ছে কঠিন চাপে আছিস। আমাকে উটকো ঝামেলা ভাবতে পারিস। ফুটপাত থেকে খেয়াল করছিলাম বিষয়টা।”
“না, উটকো ঝামেলা ভাবছি না। ত্রাণকর্তা ভাবছি এখন তোকে।”
“কেন? ত্রাণের কী করলাম?”
“ওই দেখ, মিটারের রিডিংটা একশ ছাড়িয়ে গেছে। আমার পার্সে আছে মাত্র একশ টাকা। বকশিশসহ বাকিটা তুই চালিয়ে নিবি।”
বদি বলল, “সর্বনাশ! আমার পকেট শূন্য, এই দেখ! হাতের প্যাকেটটা দেখিয়ে বলল, নোটগুলো ফটোকপি করতে গিয়ে বিশ টাকা শর্ট পড়েছিল। টাকাটা বাকি রেখে এসেছি। ভেবেছিলাম পথটা হেঁটে যাব। তোকে দেখে ভাবলাম ত্রাণকর্তা হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিস। এখন দেখছি মূর্তিমান বিপদকর্তার ঘাড়ে এসে পড়েছি!”
সিমু বলল, “বিপদকর্তার ঘাড় থেকে নেমে যা। বাকি পথ হেঁটে যাব।”
বদি বলল, “কী করা, তাই চল।”
এ সময় সেলফোন বেজে উঠল। ফোন করেছে জয়, সিমুর ফিঁয়ানসে। ফোন পেয়ে শঙ্কা বেড়ে গেল। কী বিপদ আবার ঘাড়ে এসে চাপে, ভাবতে গিয়ে কল অ্যাটেন্ড না-করে বসে রইল ও। এ ফাঁকে প্রথম পালস রিং হয়ে থেমে গেল কল। আবার রিংটোন বেজে উঠল। এবার কল অ্যাটেন্ড করে সিমু জিজ্ঞেস করল, “কোথায় তুমি?”
উত্তর না দিয়ে জয় বলল, “তুমি কোথায়?”
“মহাসমুদ্র পাড়ি দিয়ে এখন নীলক্ষেতের মোড়ে বসে আছি অটোতে।”
“মহাসমুদ্র পাড়ি দেওয়ার প্রয়োজন হলো কেন?”
“সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি। পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছি। এখন তোমাকে বিশেষ প্রয়োজন। কোথায় তুমি?”
জয় জবাব দিল, “তোমার হলের সামনে বসে আছি।”
“ভালো করেছ, বসে থাকো। আমি ক্লান্ত, নইলে অটো ছেড়ে হেঁটে আসতাম।”
“তোমার গলা এমন লাগছে কেন? কোনও বিপদ?”
“না, বিপদ না। জীবনদূষণে আক্রান্ত হয়েছি। মন অতিষ্ঠ হয়ে গেছে ।
সান্ত্বনার সুরে জয় বলল, “শোনো, এক ঢোক মিনারেল ওয়াটার খেয়ে নাও; তিষ্ট হয়ে উঠবে তৃষ্ণার্ত মন।”
“ফাজলামো কোরো না।” ধমক দিয়ে লাইন কেটে দিল সিমু। হঠাৎ মনে পড়ল বদির কথা। বদি যে পাশে বসে আছে, বলা হয়নি জয়কে।
বদি বলল, “এ মুহূর্তে তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, জয়ের সঙ্গে কথা বলে টেনশন নিধন করে বিজয়ী হয়ে গেছ তুমি।”
সিমু বলল, “হ্যাঁ। কিছুটা বিজয়ী বলতে পারি আমাকে।”
সিমুর কথার সঙ্গে সঙ্গে চলতে শুরু করেছে সিএনজি অটোরিকশাটা।
চুপ হয়ে আছে ড্রাইভার। পেছনে ঘাড় ঘোরাচ্ছে না। কোনও শব্দও নেই মুখে। মনে হলো মিশুকের চালককে রক্তাক্ত করে অনুতপ্ত সে। সিমু ভাবল, উগ্র মেজাজের হলেও চালককে ভদ্রই মনে হচ্ছে। নিশ্চয়ই কিছু কম দিয়ে ভাড়াটা মিটিয়ে দেওয়া যাবে।
স্বস্তি নিয়ে সামনে তাকাল এবার। হঠাৎ খেয়াল করল ওর শরীর ঘেঁষে বসে আছে বদি। সামনে তাকিয়েও চোখের বাঁ ফিলডে ধরা পড়ল ওর দিকে অপলক তাকিয়ে আছে বদি।
সর্বনাশ! ভালোবাসার দূষণে আক্রান্ত হলো না তো বদি! গোপনে বদিও ইন্টারেস্টেড ছিল ওর প্রতি। জয়ের সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ার পর পিছুটান দিয়েছে সে। তবে ভালো বন্ধুত্ব বজায় রেখেছে। অশোভন কোনও আচরণ করেনি। বরং সে-ই তার সবচেয়ে উপকারী বন্ধু। নোটফোট জোগাড় করে দেয়। ভালো ছাত্র বদি নিরীহ ধাঁচের, আর জয় হচ্ছে ডেসপারেট। বেশি ভালো লেগেছে জয়ের ডেসপারেটনেস। জয়ের প্রপোজালই আবেগতাড়িত করেছে ওকে। সম্পর্ক হয়ে গেছে জয়ের সঙ্গে। এমনভাবে তাকিয়ে আছে কেন বদি!
বদির মনে কি দূষণ ঘটছে? সেই দূষণ কি ওকেও প্রভাবিত করছে?
ভাবতে ভাবতে দেখল হলের কাছে চলে এসেছে সিএনজি অটোরিকশা। হঠাৎ জয়ের কথা মনে হলো, একসঙ্গে বদিসহ অটো থেকে নামলে সন্দেহ করবে না তো জয়? চট করে আতঙ্কের কামড় বসে গেল বুকে। কামড় আর খোলার সুযোগ পেল না। রোকেয়া হলের গেটের সামনে দাঁড়াল অটো। প্রথমে নামল বদি, তারপর সিমু। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাচ্ছে জয়। সঙ্গে আছে সিমুর দুই রুমমেট রুমানা ও নাজমা। সিমুকে ইশারা করে দুই রুমমেট। হাসতে হাসতে রুমানা বলল, “জয়কে সিল দিলাম। তুইও অংশ নে আমাদের সঙ্গে।”
স্তব্ধ হয়ে গেছে জয়। ওর লুক থেকে ফেটে বেরোচ্ছে বিস্ময়। হা করে আছে।
নাজমা বলল, “জয়, মুখ বন্ধ কর, মুখে মাছি ঢুকে যাবে।”
রুমানা বলল, “কি রে, সিমুর সঙ্গে এক অটোতে বদিকে দেখে কামড় খেলি নাকি বুকে? ফুচকা খা। কামড় খাসনে।”
রুমমেটদের কথা উড়িয়ে দিয়ে জয়কে উদ্দেশ করে সিমু বলল, “ত্রিশ টাকা দাও। ভাড়া শর্ট পড়েছে।”
অকস্মাৎ কেঁপে ওঠল জয়। “বলো কি! আমার পকেটে আছে মাত্র ত্রিশ টাকা! ফুচকার বিল দিয়ে থাকবে শূন্য টাকা!”
“দুশ্ শা…লা… আজকের কপালটাই খারাপ।” সিমুর মুখ থেকে গালি বেরিয়ে গেল।
নাজমা বলল, “আমি ভেতরে যাচ্ছি, টাকা নিয়ে আসছি। ফুচকার টাকা আমি দেব। অস্থির হোসনে তোরা।” বলেই হলের ভেতরে ঢুকে গেল নাজমা।
বোকার মতো তাকিয়ে রইল বদি।
রুমানা বদিকে উদ্দেশ করে বলল, “কি রে, খুব তো চান্স নিলি জয়ের অবর্তমানে।”
হেসে বদি বলল, “কী করব আমি। কপালে উড়ে এসে বসেছে চান্সটা; সুযোগ নিতে হয়, আমিও নিলাম।”
নির্ভেজাল হাস্যরসের মধ্যেও একটা সুই ঢুকে গেল জয়ের বুকে, বুঝতে পারল সিমু। বুঝে ওর মন খারাপ হয়ে গেল। বদির সঙ্গে অটোতে চড়াটা সহজভাবে নিতে পারল না জয়! এত ছোট ওর মন! মন দূষিত হলে কি ভালবাসা টিকে থাকে! সব দূষণ ছাড়িয়ে এবার মনদূষণে আক্রান্ত হলো সিমু। কার্বন ডাই-অক্সাইডের দূষণের চেয়েও ভয়ংকর হচ্ছে মনদূষণ।
যে তাপ ইনফ্রারেড রশ্মির মাধ্যমে সঞ্চালিত হয়, আটকে যায় তা কার্বন ডাই-অক্সাইডের স্তরে, সূর্যরশ্মি আটকে যায় না এ স্তরে। ফলে উষ্ণতা বাড়ে পৃথিবীর। ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে সভ্যতার। আর একইরকমভাবে মনের সন্দেহ আটকে দেয় ভালোবাসা। এ দূষণে আটকা পড়লে ছারখার হয়ে যায় জীবন। কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়েও জটিল হচ্ছে সন্দেহদূষণ। এ দূষণ চলছে এখন জয়ের মনে। আর ক্ষোভ বাড়ছে সিমুর মনে।
ক্ষুব্ধ গলায় ও বলল, “দাও, ত্রিশ টাকা দাও।”
পকেট থেকে টাকা বের করে জয় তুলে দিল সিমুর হাতে। টাকাটা ছোঁ মেরে হাতে নিয়ে অটোর চালকের দিকে এগিয়ে গেল সিমু। নরম গলায় বলল, “নেন ভাইজান। আপনার মিটার রিডিং হচ্ছে এক শ দশ। দিলাম এক শ ত্রিশ। বিশ টাকা বকশিশ।”
সামনের দিকে তাকিয়ে ভয়াল কণ্ঠে চালক বলল, “দেড়শ টেহা দেন। একশ ত্রিশ টেহা নিমু না আমি।”
অবাক হয়ে চালকের দিকে তাকিয়ে রইল সিমু। এ মুহূর্তে ওর মনে হলো, সন্দেহদূষণ নয়, বড় দূষণ হচ্ছে অর্থনৈতিক দূষণ। এ দূষণই সবচেয়ে বেশি সর্বনাশ করে মানুষের এবং সভ্যতার।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন