বিনোদ ঘোষাল
প্রবল ঝড়জলের রাতে হারাধন পোদ্দার থানা থেকে বেরোলেন। রাত প্রায় একটা বেজে গেছে। আজ সন্ধে থেকেই আকাশের মুখ ভার ছিল, সঙ্গে গুমোট গরম, সন্ধের পর নামল বৃষ্টি। উফ সে কী বৃষ্টি! সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঝড়। যেন প্রকৃতির প্রলয়নাচন শুরু হয়েছে। ঘনঘন বিদ্যুত চমকানোর সঙ্গে গুরু গম্ভীর মেঘ ডাকা। থানায় আজও কোনও কাজ ছিল না। সত্যি বলতে গত তিন বছর ধরে হারাধন পোদ্দারের একমাত্র শুয়ে বসে থাকা ছাড়া আর বিশেষ কোনও কাজই নেই। পঁয়ত্রিশ বছরের সার্ভিস জীবনে আর মাত্র দুটো দিন বাকি, তারপর অফুরন্ত অবসর। এরপর কী করবেন তা জানা নেই। তবে শুয়ে বসে থাকার লোক হারাধন পোদ্দার নন। পুলিশ ফোর্সে জয়েন করার পর থেকেই তিনি অতি সক্রিয়। এই অতি সক্রিয়তার খেসারতও তাকে তার সার্ভিস-জীবনে বারংবার দিতে হয়েছে। হারাধন পোদ্দারের বাবা নিবারণ পোদ্দারও ছিলেন একজন পুলিশ। তিনি কোনও কর্তাব্যক্তি ছিলেন না। হাবিলদার পদে পৌঁছে রিটায়ার করেছিলেন। অবশ্য পদ যাই-ই হোক না কেন পুলিশের প্রতিটি স্তরেই কম বেশি দুর্নীতি করার সুযোগ থাকে। কেউ চাইলে অনায়াসেই অসৎ হতে পারে, কিন্তু নিবারণ পোদ্দার ছিলেন সৎ, ঈশ্বরভীরু মানুষ। লোভ বলতে তার কিছু ছিল না। তার ফলে তিনি পুলিশ ফোর্সে থেকেও আজীবন শুধু নিজের বেতনটুকু ছাড়া আর একটি টাকাও অধিক উপার্জন করেননি। খুব সাধারণ মধ্যবিত্ত জীবন কাটানো নিবারণের একটিই স্বপ্ন ছিল তা হল একমাত্র পুত্র ফোর্সে উচ্চপদে জয়েন করে পিতার মুখ উজ্জ্বল করুক, এবং একজন সৎ পুলিশ অফিসার হয়ে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠুক। তিনি সেই কারণে ছেলেকে খুব অল্প বয়স থেকেই নির্লোভ, সততার মূল্য ইত্যাদি শেখানোর পাশাপাশি পুলিশে যোগ দেওয়ার কতটা গৌরব, কতটা জীবনের সার্থকতা রয়েছে সেইসব গল্প করে শোনাতেন। বাবার কাছে সেইসব গল্প শুনতে শুনতে হারাধনের মনের ভেতরেও তৈরি হয়ে গেছিল একটা স্বপ্ন। একজন নির্ভীক, সৎ, আদর্শ পুলিশ অফিসার হওয়ার স্বপ্ন। উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় থেকেই নিজেকে প্রিপেয়ার করতে শুরু করে দিয়েছিলেন। দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় এসআই পদে যোগদান। বহুদিনের স্বপ্ন পূরণ হলে মানুষ আনন্দে, গৌরবে আত্মহারা হয়ে পড়ে। মনে হয় যেন জীবন বড় সুন্দর। যুবক হারাধনেরও সেটাই মনে হয়েছিল। বাবা তাকে পুলিশ ইউনিফর্মের মাহাত্ম্য, একজন আদর্শ পুলিশ কেমন হয়, পুলিশের বীরগাথা ভারি সুন্দর করে শুনিয়ে তার মনের ভেতরে পুলিশমাত্রই আদ্যন্ত সততার প্রতিমূর্তি, এমন একটা মনোভাব তৈরি করে দিয়েছিলেন কিন্তু এতদিনের কল্পনা বাস্তবের মাটিতে আছড়ে পড়ে শৌখিন কাচের ফুলদানির মতই চুরমার হয়ে গেছিল। ট্রেনিং শেষ করার অনতিকাল পরেই হারাধন টের পেয়েছিলেন পুলিশ জগতে প্রতি পদে রয়েছে দুর্নীতি, আপোষ, অসাধুতা। এ ছাড়াও রয়েছে অক্ষমতা। পুলিশেরও বাপ আছে, ঠাকুর্দা আছে। তাদের তুষ্ট করেই চলার রীতি, এবং সেই রীতি কেউ অমান্য করলে তার কপালে ঘোর শনি। আর গোটা পুলিশ জীবনে সেই শনি হারাধন পোদ্দারের পিছু ছাড়েনি। বারংবার এসেছে নানা প্রলোভন, প্রলোভনকে জয় করার পরে এসেছে উচ্চমহল থেকে নানা ধরণের চাপ। সেই চাপের কাছে নতি স্বীকার না করার ফলও ভুগতে হয়েছে তাঁকে। কখনও শো-কজ, কখনও হেনস্থা আর সবথেকে বেশি যেটা হয়েছে তা হলো বদলি। সরকার তাকে গোটা রাজ্যে হেন কোনও রিমোট জায়গা নেই যেখানে ট্রান্সফার করেনি। কিন্তু হারাধন পোদ্দার নির্বিকার। যেখানেই তাকে পাঠানো হয়েছে সেখানেই বিনা প্রতিবাদে চলে গেছেন। নিজের হয়ে কোনও তদ্বির করেননি। ওপরমহলে কোনও অনুরোধ করেননি তাকে যেন এমন দুর্গম অঞ্চলে ট্রান্সফার না করা হয়। বরং তার পোস্টিং যত দুর্গম অঞ্চলে হতো হারাধনের যেন ততই ভাল লাগত। নিজের স্বভাবকে খুব ভাল করেই জানতেন হারাধন তাই বিয়ে করেননি, একটি মেয়েকে নিজের জীবনে জড়িয়ে ফেলে তকে বিপদে ফেলার কোনও মানে হয় না, এই ছিল হারাধনের বক্তব্য। তাই তার যৌবন বয়সে তার আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবরা যখন পাত্রী খোঁজার চেষ্টা শুরু করেছিলেন তখন হারাধন তাদের স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি চিরকুমার থাকার পণ করেছেন। কোনওভাবেই তাকে তার জেদ থেকে টলানো যায়নি। শেষে সকলেই হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। পরিবারের পিছুটানহীন হারাধন নিজের ইচ্ছেমতো জীবন কাটিয়েছেন। কৈফিয়ত দিয়েছেন শুধু নিজের বিবেক এবং পুলিশের ওপরমহলের কাছে। তার অকুতোভয় স্বভাব, সত্যনিষ্টতার জন্য কোনও মেডেল না জুটলেও সাসপেনশন, শো-কজ এবং পান্ডববর্জিত জায়গায় পোস্টিং তার অহরহ হয়েছে এবং এগুলোকেই হারাধন তার কাজের পুরস্কার হিসেবে নিয়েছেন। তবে সংসারে সৎ হওয়ার একটা সুবিধা রয়েছে। আপনি সৎ হলে অপর একজন সৎ ব্যক্তি যেমন প্রকাশ্যে ও আড়ালে আপনার সততার জয়গান করবেন তেমনই অসৎ ব্যক্তি প্রকাশ্যে আপনার কুৎসা করলেও আড়ালে আপনার প্রশংসা করবেন আর আপনি যদি অসৎ হন তাহলে সৎ ব্যক্তি আপনার নামে আড়ালে ও প্রকাশ্যে নিন্দা করবেন এবং অসৎ ব্যক্তিরা আপনার সামনে আপনার সুখ্যাতি করলেও আড়ালে আপনার কুৎসা করবেন। হারাধনের সততার জন্য ডিপার্টমেন্টের অনেক ঘুসখোর পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ীরা তাকে অপছন্দ করতেন, তার সর্বনাশ চাইতেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ হারাধনকে ভালবাসতেন, হারাধন যেখানেই পোস্টেড হয়েছেন সাধারণ মানুষ তার দ্বারা উপকৃত হয়েছেন। শুধু পুলিশি কর্তব্য নয়, নিজের ডিউটির বাইরে গিয়েও তিনি মানুষের যথাসাধ্য সেবা করার চেষ্টা করেছেন, তার বিনিময় পেয়েছেন অনেক আশীর্বাদ, ভালবাসা।
তিন বছর আগে যেদিন এই সুখের খাল নামের জায়গাটিতে ওসি হয়ে এসেছিলেন হারাধন বেশ কিছুদিন পরেই বুঝেছিলেন যে ওপরমহল তাকে তার রিটায়ারমেন্টের আগেই কার্যত রিটায়ার করিয়ে দিয়েছে। জায়গাটিতে পুলিশের কোনও কাজই নেই। একে তো জনবসতি খুবই কম, যাও বা আছে প্রতিটি পরিবারই হতদরিদ্র, শান্তিপ্রিয়। নিজেদের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতেই তাদের দিন যায়। কোনও ক্রাইম নেই। থানার অবস্থাও তথৈবচ। প্রায় কোনও সুযোগ-সুবিধাই নেই। অন্য কেউ হলে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা হত, কিন্তু হারাধন পোদ্দারের এমনটাই ভাল লাগে। যত কঠিন পরিস্থিতি ততই চ্যালেঞ্জ গ্রহণের আনন্দ। যাই হোক তিনটি বছর প্রায় অবসর জীবন কাটিয়ে প্রকৃত রিটায়ারমেন্টের মুখে পৌঁছেছেন হারাধন পোদ্দার। এরপর কী করে সময় কাটাবেন সেটাও বেশ কিছুদিন আগেই ভেবে নিয়েছেন। সীমান্তপল্লি নামের একটি গ্রামে তিনি সস্তায় কয়েক বিঘে জমি কিনে রেখেছেন। ইচ্ছে রয়েছে রিটায়ারমেন্টের পর যা টাকা পাবেন তাই দিয়ে একটা ফার্মহাউজ করবেন। এবং মানুষের সেবা করবেন।
থানায় তিনি ছাড়া রয়েছে মাত্র দুজন কন্সটেবল। রামবিলাস আর নবীন। এ ছাড়া থানার ঝাড়াই সাফাই, চা-জল ইত্যাদি খিদমত খাটার জন্য স্থানীয় একটি ছেলে রয়েছে ওর নাম অনন্ত। ছেলেটি ভারি ভাল। রোজ সকালে আসে, সন্ধেবেলা ফিরে যায়। বাড়িতে নয়, থানার কাজ সেরে ও যায় হারাধন পোদ্দার গ্রামের যে বাড়িটতে ভাড়া থাকেন সেই বাড়িতে। সেটা থানা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে। হারাধনের কাছ থেকে চাবি নিয়ে ও চলে যায় সেই বাড়িতে। তারপর রাতের রান্না করে সাহেবের রাতের খাবার বানিয়ে ঢাকা দিয়ে চলে যায়। চাবি ঝুলিয়ে রাখা থাকে। দরজারই ফ্রেমের কোণের পেরেকে। রাতে থানা থেকে ফিরে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন হারাধন। রোজের রুটিন।
অন্যান্য দিনে রাত ন’টার মধ্যেই থানা থেকে বাড়িতে ফিরে আসেন হারাধন। আজ বৃষ্টির জন্য বড্ড দেরি হয়ে গেল। থানায় একটা লড়ঝড়ে জিপ রয়েছে, অনেক সময়েই সেটা অচল থাকে। রামবিলাস ওটা চালায় এবং সারায়। রামবিলাসের আফিম খাবার নেশা রয়েছে। শত বারণেও কিছুতেই এই নেশা ছাড়তে পারে না। সন্ধের পর আফিম গুলি খেয়ে ঝিমোতে থাকে। তবে ওর একটা মস্ত গুণ হ’ল চমৎকার রান্নার হাত। থানায় স্টোররুমে চা-টা বানানোর জন্য স্টোভ-কড়াই, কেটলি, সসপ্যান ইত্যাদি রয়েছে। রামবিলাস মাঝে মাঝে চমৎকার চায়ের সঙ্গে টা বানায়। বিশেষ করে তেলেভাজা বানাতে ওর জুড়ি নেই। আজ বৃষ্টির দিন ছিল তাই মুড়ি তেলেভাজা মাস্ট। মুড়ি সবসময়েই স্টকে থাকে। বড়বাবুর নির্দেশে রামবিলাস মুচমুচে বেগুনি বানিয়েছিল। তাই দিয়ে সকলে জব্বর খাওয়া হল। চা খাবার কিছু পরেই রামবিলাস আড়ালে চলে গেছিল। এবারে ওর আফিম খাবার সময়।
সন্ধের সময় যখন বৃষ্টিটা শুরু হয়েছিল তখন আন্দাজ করা যায়নি এতক্ষণ ধরে চলবে। যেমন ঝড়, তেমনই বৃষ্টি। যেন প্রলয় চলল কয়েক ঘন্টা। গ্রামের মানুষের কেমন ক্ষতি হয়েছে তা আজ রাতে আর দেখার উপায় নেই। আগামীকাল সকালে বেরিয়ে দেখতে হবে। বৃষ্টিটা সামান্য ধরে আসার পর হারাধন ঠিক করলেন এবারে ফিরতে হবে। রামবিলাসকে ডাকতে গিয়ে দেখলেন সে ব্যাটা খাটিয়ায় শুয়ে ঘুমিয়ে কাদা। ঠেলে তুলতে আর ইচ্ছে করল না হারাধনের। গাড়ির চাবিটা দেওয়ালের হুক থেকে নামিয়ে নিলেন। নিজেই ড্রাইভ করে ফিরবেন ঠিক করলেন। স্যারকে তৈরি হতে দেখে নবীন বলল, “স্যার এত বৃষ্টিতে আপনি একা যাবেন? আমিও সঙ্গে যাই?”
“কোনও দরকার নেই। থানায় একজন থাকা দরকার। ওই ব্যাটা তো মোষের মত ঘুমোচ্ছে। তুই সামলা।”
নবীন হেসে বলল “এতদিন তো এখানে রয়েছেন স্যার, লোকে দিনের বেলাতেই থানায় আসে না, তো রাতে কে আর আসবে?”
হারাধন বললেন “তাই বলে কর্তব্যে অবহেলা করা ঠিক নয়, কে বলতে পারে রাত দুপুরে আজই হয়তো কারও প্রয়োজন হল পুলিশের। আমাদের কাজই হল প্রতিমুহূর্তে সজাগ থাকা।”
নবীন বলল, “আপনার মতো করে যদি স্যার দেশের নেতা-মন্ত্রীরা ভাবতেন তাহলে দেশটার অবস্থা এমন হয়ে যেত না।”
“আমাদের রবিঠাকুর কী বলেছিলেন জানিস?
‘বিশ্ব যদি চলে যায় কাঁদিতে কাঁদিতে
আমি একা পড়ে রব কর্তব্য সাধিতে।’
বুঝলি?”
নবীন কতটা বুঝল জানা নেই, তবে মাথা নোয়াল। তারপর আবারও বলল, “তবু একবার ভেবে দেখতে পারতেন স্যার, এত রাতে ঝড়জলের মধ্যে বাড়ি ফেরারই বা দরকার কী? রাতটা আজ এখানেই তো থেকে যেতে পারতেন?”
“না রে, রাস্তাটাও ক্লিয়ার রয়েছে কি না সেটা একবার দেখে নিতে হবে। যদি গাছ-টাছ পড়ে গিয়ে থাকে তাহলে রাতের যাত্রীদের রাস্তা দিয়ে যাতায়াতে সমস্যা হতে পারে। সেটাও দেখা দরকার।” বলে আর অপেক্ষা করলেন না হারাধন। থানার উঠোনে রাখা জিপে উঠে ড্রাইভারের সিটে গিয়ে বসলেন। তারপর গাড়ি স্টার্ট করে বেরিয়ে গেলেন।
নিকষ অন্ধকার। এখনও ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়েই চলেছে। থানা থেকে বেশ কিছুটা কাঁচা রাস্তা পেরোনোর পর তারপরে হাইরোড। এই রাস্তা দিয়ে ট্রাক, প্রাইভেট কার ইত্যাদি যায়। সকালের দিকে কয়েকটা বাসও যাতায়াত করে। সদরে যাওয়ার ওটাই একমাত্র যানবাহন।
কাঁচা রাস্তা পেরিয়ে মেন রাস্তায় উঠলেন হারাধন। আজকাল নিয়মিত স্টিয়ারিং ধরা হয় না বলে একটা আড়ষ্টতা কাজ করছে, বয়সের কারণে চোখের ক্ষমতা কিছুটা তো কমেছেই তা ছাড়া বৃষ্টির জন্য রাস্তাও ঝাপসা। গাড়ি চালাতে চালাতে গুনগুন করে গান করছিলেন হারাধন। আর হাতে মাত্র দুটো দিন। তারপর এতবছরের চাকরিজীবন শেষ। এতগুলো বছর পুলিশের চাকরি করে কী পেলেন? ওপরওলার শাসানি, নেতা-মন্ত্রীদের ধমক। দুর্গম সব জায়গায় পোস্টিং। সরকারের পক্ষ থেকে সততার, কর্তব্যপরায়ণতার পুরস্কার এই। কিন্তু এর বাইরে আসল যে পুরস্কার তা হল আত্মতুষ্টি, কোনওদিন অন্যায়ের কাছে মাথা না নোয়ানোর অহংকার।
আবারও বৃষ্টিটা বাড়ল। চারদিকে ধোঁয়ার মতো বৃষ্টি। মুশকিল হল। এখনও পৌঁছতে অনেকটা পথ বাকি। বেশ খানিকটা পথ চলার পর দেখতে পেলেন উল্টোদিক থেকে ক্ষীণ একটা আলোর বিন্দু এগিয়ে আসছে। সম্ভবত কোনও দুইচাকার গাড়ি হবে। এই রাস্তায় দুই চাকার গাড়ি যথেষ্টই চলে, কিন্তু তাই বলে এত ঝড়বৃষ্টিতে মোটরসাইকেল চালানো উচিত নয়। হারাধন স্পিড আস্তে করে হেডলাইটের আলোর মুখ নিচু করলেন যাতে উল্টোদিকের গাড়িটির চোখ না ধাঁধিয়ে যায়। উল্টোদিকের গাড়িটা যখন খুব কাছে চলে এসেছে তখনই ঘটল এক ভয়ংকর ঘটনা।
মোটরবাইকটার চাকা আচমকাই পিছলে গেল। আর সেটা উল্টে গিয়ে তার আরোহী আছড়ে পড়ল রাস্তায়, আর লোকটা যাতে জিপের চাকার তলায় না পড়ে যায় অতি দ্রত স্টিয়ারিং ঘোরাতে গিয়ে সামলাতে না পেরে হারাধন পোদ্দারের জিপও রাস্তা থেকে নেমে গিয়ে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা লাগল একটা গাছের গুঁড়িতে। বুকে আর মাথায় এক মুহূর্তের জন্য অসহ্য যন্ত্রনা অনুভব করেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন তিনি।
চোখ মেলে তাকালেন বেশ অনেকক্ষণ পর। প্রথমে তাঁর কিছুই মনে পড়ল না। তারপর গাছের গায়ে ধাক্কা মেরে দাঁড়িয়ে থাকা জিপে ড্রাইভারের সিটে নিজেকে আবিষ্কার করে ধীরে ধীরে সবকিছু মনে পড়ল। গাড়ি থেকে নামলেন। নাহ কপাল ভাল ওর কিছুই হয়নি। আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে গেছেন শুধু নয় অক্ষতও রয়েছেন। তবে জিপের উইন্ডগ্লাস ভেঙে গেছে। একটা হেডলাইট পুরো গেছে। বনেট তুবড়ে গেছে বিশ্রীভাবে। স্টার্ট হবে কি না কে জানে। সেই বাইকআরোহীর কী হল? দৌড়ে গেলেন মেন রাস্তার দিকে। বৃষ্টি এখনও পড়ছে। চারদিকে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। এত অন্ধকারে কিছু দেখা সম্ভব নয়, জিপের মধ্যে একটা টর্চ রয়েছে মনে পড়তেই আবার ছুটে এনে গাড়ির কাছে। অতি কষ্টে গাড়ির ড্যাশবোর্ড থেকে টর্চটা বার করলেন। দুই একবার ঠোকাঠুকি করতে জ্বলে উঠল টর্চ। আবার গেলেন রাস্তায়। মোটর সাইকেলটা রাস্তার পাশে উলটে পড়ে রয়েছে, কিন্তু লোকটা কই? লোকটা… টর্চের আলো এদিক ওদিক ফেলতে ফেলতে হারাধন দেখতে পেলেন রাস্তার ওই পাড়ে আরেকটা গাছের সামনে একজন মানুষ উল্টে পড়ে রয়েছে। ছুটে গেলেন কাছে। লোকটার মাথায় হেলমেট নেই তবে বর্ষাতি পরা রয়েছে। আলো ফেলে দেখলেন মুখটা থেতলে গেছে। নাকের সামনে, গলার পাশে আঙুল রেখে বুঝলেন এখনও প্রাণ রয়েছে। আর এক মুহূর্তও দেরি করা চলবে না। যেভাবে হোক লোকটাকে বাঁচাতেই হবে। সদর হাসপাতাল এখান থেকে অনেক দূরে, অত দূরে নিয়ে যেতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে, বরং প্রাথমিক স্বাস্থকেন্দ্রটা কয়েক মাইলের মধ্যে। ওখানে সবসময় একজন আরএমও, দু’জন নার্স এবং দু’জন আয়া থাকেন। পাঁচটা মাত্র বেড। বাড়াবাড়ি রকমের পেট খারাপ, জ্বর জারি হলে মানুষ ভর্তি হয়। সকালে আউটডোরে খুব ভিড় হয় প্রতিদিন, সন্ধ্যে হলেই ফাঁকা। ওখানে আধুনিক চিকিৎসার কোনও সুযোগ নেই ঠিকই কিন্তু ডাক্তার তো রয়েছে। অন্তত স্যলাইন, অক্সিজেনের ব্যবস্থাটা রয়েছে। তাই আগে ওখানেই নিয়ে যাওয়া দরকার। লোকটাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে এসে গাড়ির পিছনের সিটে শোওয়ালেন হারাধন। গাড়ি স্টার্ট হবে কি না জানা নেই। ড্রাইভারের সিটে ছড়িয়ে থাকা কাচের গুড়ো সরিয়ে দিয়ে বসে স্টার্ট করার জন্য চাবি ঘোরালেন। বারকয়েক চেষ্টার পরেও গাড়িটা গোঁওওও শব্দ করেও থেমে গেল। ইস এবারে কী হবে! মা দুর্গার নাম জপ করে স্টীয়ারিং এ প্রণাম করে আবারও চাবি ঘোরাতেই এবারে অলৌকিকভাবে গাড়ি স্টার্ট হয়ে গেল। জয় মা দুর্গা বলে গাড়ি রিভার্স করে মেন রোডে উঠে ফোর্থ গিয়ারে গাড়ি চালালেন। আজ আর কপালে বাড়ি ফেরা, রাতের খাওয়া কিছুই নেই। না থাক। এমনটা হারাধনের জীবনে প্রথম নয়, চিরকাল নিজের কর্তব্যকে সবার আগে রেখেছেন। একজন পুলিশের কাছে ব্যক্তিগত জীবনের অনেক আগে হল ডিউটি। মানুষের সুরক্ষার দায়িত্ব তার কাছে। রিটায়ার করার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত সেই কর্তব্য তিনি অবহেলা করতে পারেন না।
রাস্তায় একটাও গাড়ি নেই। এত রাতে এই রাস্তায় আর কে গাড়ি চালাবে।
আধঘন্টার মধ্যে তিনি পৌঁছে গেলেন স্বাস্থকেন্দ্রে। দরজা বন্ধ। ছোট স্বাস্থকেন্দ্র, রাতে কেউ আসে না বলে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর আজ এমন দুর্যোগের রাতে বন্ধ তো থাকবেই। হারাধন এক লাফে সিট থেকে নেমে দরজায় ধাক্কা দিলেন। কোনও সাড়া নেই। আবারও ধাক্কা দিলেন। নাহ এবারেও ভেতরে সব চুপ। কেউ নেই নাকি! উঁহু এমন তো হতে পারে না। নিসচয়ই সবাই ঘুমোচ্ছে।
“আমি থানা থেকে আসছি, ওসি হারাধন পোদ্দার। দরজা খুলুন, সিরিয়াস পেশেন্ট রয়েছে।” বলতে বলতে আবারও জোরে দরজায় ঘুসি মারলেন তিনি। তাতেও সাড়া না পেয়ে বেশ ক্রুদ্ধ হয়ে এক লাথি কষালেন।
তখন দরজা খুলল একজন নার্স।
“আশ্চর্য তো আপনারা, কতক্ষণ ধরে দরজা ধাক্কা দিচ্ছি কেউ সাড়া দিচ্ছেন না কেন?”
নার্স হারাধনের কথা শোনা তো দূরের কথা ওর দিকে তাকালেনও না, শুধু পুলিশের জিপটার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
“এই সিস্টার আপনাকে বলছি, আমার গাড়িতে একজন উন্ডেড পেশেন্ট রয়েছে, এখনই ট্রিটমেন্ট করতে হবে। কুইক ব্যবস্থা নিন।”
এবারেও নার্সটি হারাধনকে পাত্তা না দিয়ে পুলিশের জিপটাকে অবাক হয়ে দেখল তারপর ভেতরে চলে গেল। মিনিট খানেকের মধ্যে আবারও ফিরে এল সঙ্গে ডাক্তারবাবু, একজন আয়া এবং এ্যাসিস্ট্যান্টকে নিয়ে।
হারাধন বললেন “এই যে ডাক্তারবাবু একজন পেশেন্টকে নিয়ে এসেছি…”
হারাধনের কথা যেন কেউ শুনতেই পেলেন না। ওরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে করতে সেই জিপের কাছে গেলেন। তারপর সেই মৃতপ্রায় ব্যক্তিটিকে দেখতে পেয়ে স্ট্রেচার আনিয়ে ভেতরে নিয়ে গেলেন।
হারাধন শুনতে পেলেন ডাক্তার সেই নার্সকে জিজ্ঞাসা করছেন, “পুলিশের গাড়ি তো। যিনি নিয়ে এসেছেন তিনি কই?”
“জানি না স্যার। দরজায় মনে হল ধাক্কা দিচ্ছে কেউ। তাই খুলে দেখলাম, দেখি শুধু জিপটা দাঁড়িয়ে আর কেউ নেই।”
“আশ্চর্য তো!…পুলিশের গাড়ি অথচ পুলিশ ভ্যানিশ!”
“আশ্চর্য মানে… এই তো এই যে আমি হারাধন পোদ্দার, আমাকে দেখতে পাচ্ছেন না আপনারা…!” চিৎকার করে বলে উঠলেন হারাধন পোদ্দার।
নাহ এবারেও কেউ শুনতে পেল না।
হারাধন যখন হতবাক হয়ে দেখতে থাকলেন ওই ডাক্তার এবং নার্সরা মুমুর্ষু ব্যক্তিটিকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন তখন ছেড়ে আসা সেই দুর্ঘটনাস্থলে, যেখানে জিপটা একটা গাছে ধাক্কা মেরেছিল তার সামনেই অন্ধকারে মুখ থুবড়ে পড়েছিল হারাধন পোদ্দারের রক্তাক্ত নিথর শরীরটা। ভিজছিল, রক্ত ধুয়ে যাচ্ছিল বৃষ্টির জলে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন