short-story-e-ek-onno-nari

এ এক অন্য নারী
তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

 

আবারও প্রায় দু–বছর পরে, গতকাল সন্ধের ফ্লাইট ধরে দিব্যজেঠু এসে পৌঁছেছেন কলকাতায়৷ এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি ধরে যখন পৌঁছোলেন ডোডোদের বাড়িতে, রাত্রি প্রায় এগারোটা৷ সঙ্গে প্রচুর ব্যাগ–ব্যাগেজ৷ তার মধ্যে একটা অদ্ভুত গড়নের লাল রঙের ব্যাগ৷ অনেকটা হৃৎপিণ্ডের আকারের কিন্তু কী দারুণ দেখতে ব্যাগটা। রাতে তাদের সঙ্গে তেমন কথা হয়নি দিব্যজ্যেঠুর৷ ব্যাগগুলো দোতলার ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে, সোফায় গা ছেড়ে দিয়ে বসে মাকে বললেন, চন্দ্রা, তোমার ডিনার নিশ্চয় তৈরি৷ দাও, খেতে দাও৷

টানা অনেকগুলো ঘন্টা প্লেনের মধ্যে কেটেছে বলে বেজায় ক্লান্ত ছিলেন৷ ডাইনিং টেবিল থেকে সোজা গেস্টরুমে৷ ডোডোকে বললেন, এবার একটা মস্ত সারপ্রাইজ দেব সবাইকে৷ ওয়েট৷

কী সারপ্রাইজ তা জানার জন্য ডোডোর ভিতরে কী আকুলিবিকুলি।

আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে বললেন, কাল রাতে খুব চমৎকার ঘুম হয়েছে৷

কলকাতায় আসার মাত্র তিনদিন আগে ডোডোকে মেইলে জানিয়েছেন দিব্যজ্যেঠু, ঠিক একদিন থাকবেন কলকাতায়৷ এই শহরের বিজ্ঞানমহল তাঁর জন্য একটা বড়ো প্রেক্ষাগৃহে বেলা একটায় সংবর্ধনার আয়োজন করেছে, সেই সভায় তিনি জানাবেন তাঁর সর্বশেষ আবিষ্কারের কাহিনি৷ সেখান থেকে তিনি চলে যাবেন কলকাতার বিখ্যাত বিজ্ঞানী সুপ্রকাশ সিংহের বাড়িতে৷ সেখানেই ডিনার খেয়ে রাতে ফিরবেন ডোডোদের বাড়ি রাতটা কাটাতে৷ পরদিন ভোরের ফ্লাইটে যাবেন দিল্লিতে৷ সেখানেও একই রকম আয়োজন, তার পরদিনই ফিরে যাবেন আমেরিকায়৷ যাকে বলে ঝটিতি সফর৷

ডোডোর খুব ভোরে ওঠার অভ্যাস৷ ঘুম ভাঙার পর থেকেই টানটান উত্তেজনায় অপেক্ষা করছিল কখন দিব্যজ্যেঠু দোতলা থেকে নীচে নামবেন, ড্রয়িংরুমে বসে জমিয়ে বলবেন তাঁর সর্বশেষ  আবিষ্কারের কাহিনি৷ গত কয়েকমাস ধরে ইন্টারেনেট খুলে জানতে পারছিল দিব্যজ্যেঠু নতুন নতুন আবিষ্কার করে বিস্মিত করে দিচ্ছেন বাকি বিশ্বকে৷ কিন্তু নেট থেকে আর কতটুকু জানা যায় তার পুরোটা শুনতে হবে তাঁর সঙ্গে মুখোমুখি বসে৷   

দিব্যজ্যেঠু মানে ড. দিব্যজ্যোতি আচার্য এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম জিন–বিশেষজ্ঞ৷ ডোডোর বাবার এই জ্যেঠতুতো দাদাটির জন্য তাদের পরিবারের সবাইকার গর্বের অন্ত নেই৷ প্রতি বছর তাঁর কলকাতায় আসা মানে অজস্র ফোনাফোনি আর সারা কলকাতার বিজ্ঞান কলেজ আর বিজ্ঞান–সংস্থাগুলো থেকে আমন্ত্রণের ছড়াছড়ি৷

কিন্তু এবার সময় কম বলে তাঁর জন্য ব্যবস্থাপনা অন্যরকম৷

বেলা সাড়ে আটটা বাজতে ডোডো গুটিগুটি পায়ে গিয়ে হাজির হল দিব্যজ্যেঠুর ঘরে৷ কিন্তু অবাক কাণ্ড, সে যাওয়ার অনেক আগেই ড্রয়িং রুমে এসে গেছে একটি তরুণী, খুবই সুন্দরী, পরনে আকাশি–রঙা জিনসের টাইট প্যান্ট আর গাঢ় রোদ–রঙের টপ৷ যাকে অতি–আধুনিক বলে এমনই ঝকঝকে চেহারা, তেমনই তার দু–চোখের বুদ্ধিদীপ্ত চাউনি৷

মেয়েটি ডোডোর চেয়ে দু–তিন বছরের ছোটোই হবে৷ তার প্রধান বৈশিষ্ট্য দুটি চোখ৷ দু–চোখের মণি না–কালো না–নীল, মাঝামাঝি কোনও একটা রঙের৷ সেই চোখদুটোয় বুদ্ধি ছাপিয়েও যা নজর কাড়ছে তাকে ডোডো এককথায় ভাবতে পারল মায়াচুম্বক বলে৷ তার দিকে একবার চোখ পড়লে দ্বিতীয়বার তাকাতে ইচ্ছে হয়, দ্বিতীয়বার তাকালে তৃতীয়বার৷ উফ্, কী দারুণ টান 

ডোডোর শরীরের ভিতরটা কীরকম শিরশির করে উঠল৷

সে অনুমানই করতে পারল না কে এই মেয়েটা, এত সকালে কীভাবে ঢুকে পড়ল এ–ঘরে, কোথায়ই বা থাকে। নিশ্চয় এ–পাড়ার মেয়ে নয়, তা হলে ডোডো অবশ্যই চিনত এ–পাড়ার মেয়েদের প্রত্যেকের বায়ো–ডেটা আর ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস ডোডোর মুখস্থ৷ 

মেয়েটি তখন প্রবল উৎসাহে তর্ক জুড়ে দিয়েছে অত বড়ো একজন বিজ্ঞানীর সঙ্গে৷ ডোডো ঢুকে শুনল মেয়েটি বেশ জোরের সঙ্গে বলছে, জ্যেঠু, তোমাকে বলতেই হবে আমার প্রশ্নের উত্তর৷ প্রশ্নটা আমি এ পর্যন্ত তোমার অনেক বিজ্ঞানী–বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছি, কেউই তার একরকম উত্তর দেননি৷ তোমাকেও আমি কয়েকবার জিজ্ঞাসা করেছি৷ তুমিও প্রতিবার বলেছ, ‘পরে বলব’৷ আজ তোমাকে ছাড়ছি না তুমি সেই বিজ্ঞানী যিনি মানুষের জিন মানচিত্রের খুঁটিনাটি জানেন, একমাত্র তুমিই বলতে পারো মানুষ আজ বহু বছর ধরে ঈশ্বরকে নিয়ে বহু চিন্তাভাবনা করছে, সেই ঈশ্বর আছেন কি নেই যদি বলেন নেই, তা হলে আমার মনে একশো প্রশ্ন আছে যার অন্তত কয়েকটির উত্তর আমি জানতে চাইব৷ আর যদি বলো ঈশ্বর আছেন, তা হলে জানতে চাইব কীভাবে তিনি নিয়ন্ত্রণ করছেন এই জীবজগৎকে। দিব্যজ্যেঠু হো হো করে হেসে বললেন, কী আশ্চর্য, জিনের মানচিত্র আবিষ্কার করা গেছে মানেই ঈশ্বর আছেন কি নেই তা বলতে পারা যাবে

মেয়েটি অবাক হয়ে বলল, জিনের মানচিত্র খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে তুমিই তো সেদিন বললে, ‘কী অপরূপ সৃষ্টি তাঁর এই বিপুল বিশ্ব, মহাকাশ এক মহাশ্চর্যের আধার৷ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীরা একযোগে একশো বছর চেষ্টা করেও একটা মানুষ তৈরি করতে পারেনি আজও’ বলোনি?

ডোডো দুজনের কথাবার্তা শুনে একটুও আন্দাজ করতে পারল না মেয়েটির সঙ্গে দিব্যজ্যেঠুর এত চেনাজানা হল কী করে দিব্যজ্যেঠু কলকাতায় এলেনই তো প্রায় দু–বছর পরে৷ অথচ মেয়েটি এমন সব কথাবার্তা বলছে যাতে মনে হচ্ছে দিব্যজ্যেঠু আর তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে তার প্রায়ই এরকম ভারী ভারী বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় তা হলে কি এ সব আলোচনা হয় টেলিফোনে? আমেরিকা থেকে টেলিফোনে বহুক্ষণ আলোচনা করা তো আজকাল কোনও ব্যাপারই নয়। এই তো তাদের সুদীপা পিসি আমেরিকায় তাঁর মেয়ে পুপুর বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার পর রোজই আধঘন্টা–চল্লিশ মিনিট ধরে কথা বলেন তার মায়ের সঙ্গে৷ পুপু নাকি প্রতিমাসে চুক্তিভিত্তিক কত টাকা দিয়ে রাখেন, তাতে সারা পৃথিবীর যে কারও সঙ্গে যতক্ষণ খুশি কথা বলা যায়৷ এই মেয়েটি কি সেরকমই কথা বলে রোজ দিব্যজ্যেঠুর সঙ্গে? মেয়েটি কি এ পাড়াতেই থাকে? কিন্তু ডোডো তাকে চেনে না, তাই কি হয়?

ডোডোর মুখভঙ্গি দেখে দিব্যজ্যেঠু যা বোঝার বুঝলেন, অমনি সেই মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, ডোরা, এ হল ডোডো৷ ওয়ান অফ মাই বেস্ট ফ্রেন্ডস৷ আর ডোডো, এ হল ডোরা৷ ডোরা ইজ নাউ মাই বেস্ট ফ্রেন্ড৷

নাউ শব্দটা ভারী অবাক করল ডোডোকে৷ ডোরার দিকে তাকিয়ে দেখল সে মিটিমিটি হাসছে ডোডোর দিকে তাকিয়ে৷ ডোডোর অল্পঅল্প রাগ হল না তা নয়, কেননা তার এতদিন ধারণা ছিল সে–ই দিব্যজ্যেঠুর বেস্ট ফ্রেন্ড৷ প্রতি মাসে নিয়ম করে একবার বা দুবার তাকে টেলিফোন করেন দিব্যজ্যেঠু৷ তাঁর সর্বশেষ গবেষণা কী বিষয়ে হচ্ছে তার টুকটাক আন্দাজ দেন তাকে৷ ডোডো তার সামান্যই বুঝতে পারে৷ তবু ভালো লাগে দিব্যজ্যেঠু তাকে এতটা গুরুত্ব দেন বলে৷ কিন্তু তা হলে এই মেয়েটাই এখন শ্রেষ্ঠ বন্ধু?

ডোরার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে দিব্যজ্যেঠু হাসতে লাগলেন, বললেন, তুই নিশ্চয় ভাবছিস মেয়েটা কোথায় থাকে? তুই একে চিনিস নে কেন, তাই না?

ডোডো ঠিক তাই ভাবছিল, বলল, ঠিকই বলেছ, জ্যেঠু৷ আমাদের এলাকায় থাকে বলে মনে হচ্ছে না তোমার সঙ্গে নিশ্চয় টেলিফোনে আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা ছিল না হলে এত সকালে কী করে এসে পৌঁছোল তোমার সঙ্গে দেখা করতে?

দিব্যজ্যেঠু হেসে উঠে বললেন, ঠিক আছে, তোর প্রশ্নের জবাব দেব রাতে ফিরে৷ ঠিক আছে? এর মধ্যে লুকিয়ে আছে একটা মস্ত ম্যাজিক৷

বলতেই ডোরা হেসে উঠল খিলখিল করে৷ তাতে ডোডো বেশ অপ্রতিভ৷

তার প্রশ্নের কোনও জবাব তো দিলেনই না দিব্যজ্যেঠু, বরং তাকালেন ডোরার দিকে, বললেন, দ্যাখো, আগেকার দিনের বিজ্ঞানীরা বরাবরই অস্বীকার করেছেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ে৷ কিন্তু এখন পৃথিবীর বহু বিজ্ঞানীই ভাবতে শুরু করেছেন ঈশ্বর আছেন কি না৷ তবে এখনই তোমাকে সেই প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারছি না৷ কারণ আমিও এ–বিষয়ে নিশ্চিত নই৷ তবে অনেক ভাবছি এ–বিষয়ে৷ মানুষের জিনের মানচিত্র আবিষ্কৃত হয়েছে তাও কয়েক বছর হয়ে গেল, এখনও তার অন্দরমহলের অনেককিছু জানা বাকি৷ সব জানতে পারলে তবেই হয়তো জবাব মিলবে আমাদের অনেক প্রশ্নের৷ তখন হয়তো কিছু বলতে পারব তোমাকে৷ ঠিক আছে, তুমি কিছুক্ষণ গল্প করো ডোডোর সঙ্গে৷ আমি স্নান–খাওয়া সেরে প্রস্তুত হয়ে নিই৷ তারপর তোমাকে নিয়ে বেরোব সংবর্ধনা সভায়৷ 

দিব্যজ্যেঠু উঠে গেলেন দোতলায়৷ তাঁর শেষ কথা শুনে ডোডো আরও অবাক৷ তিনি কিনা সংবর্ধনা সভায় যাবেন এই মেয়েটিকে নিয়ে। কে এই মেয়েটা কেন দিব্যজ্যেঠুর কাছে তার এত প্রাধান্য

ডোডো তখনও অপ্রস্তুত মুখে বসে আছে, তার বিব্রত ভাবটা কাটাতে ডোরাই বলল, তোমাকে দেখতে কিন্তু খুব কিউট৷ 

ডোরার গলার স্বর এমনই সুন্দর, সেই কণ্ঠস্বরে কিউট শব্দটি কীরকম রোমাঞ্চিত করে তুলল ডোডোকে৷ সেও সম্মোহিতের মতো বলল, তোমাকেও দেখতে খুব সুন্দর৷

––তাই নাকি? ডোরা ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠে বলল, বাহ, বেশ বলেছ তো আমাকে কেউ সুন্দর বলে না ঠিক আছে জ্যেঠুর সঙ্গে ঘুরে এসে রাতে তোমার সঙ্গে একটু ভাব করতে হবে৷ ঠিক আছে? এখন বলো, তোমার স্টাডিজ কীরকম হচ্ছে? তুমি তো ম্যাথ্সে খুব ভালো?

ডোডো বলল, তুমি কী করে জানলে?

ডোরা ডত্তর না দিয়ে হাসছে মিটিমিটি৷ পরক্ষণে জিজ্ঞাসা করল, তুমি তো ক্রিকেটটাও ভালো খেলো? স্কুল–ক্রিকেটে নাকি আটটা সেঞ্চুরি আছে তোমার?

ডোডো ভাবছিল ডোরাকেই জিজ্ঞাসা করে ডোরার পরিচয়, কিন্তু তার পরিবর্তে ডোরাই নানা প্রশ্নে জেরবার করছে তাকে। ডোডো বিস্মিত হয়ে আবিষ্কার করল ডোডো তাকে না চিনলেও ডোরা তাকে ভালোমতো চেনে৷ কথা বলতে বলতে ডোরার সঙ্গে ভাব হয়ে গেল তার৷ কিন্তু সে তখন বিস্মিত হয়ে দেখছে দিব্যজ্যেঠু দিব্যি পঞ্চব্যাঞ্জন দিয়ে লাঞ্চ করলেন, কিন্তু ডোরারস্নান–খাওয়ার কোনও পাট নেই, দিব্যি সোফায় বসে গল্প করে গেল ডোডোর সঙ্গে৷ দিব্যজ্যেঠুর খাওয়া শেষ হতে বললেন, চলো, ডোরা৷ ডোরা তৎক্ষণাৎ উঠে পড়ল ডোডোকে টা টা করে, বেরিয়ে পড়ল দিব্যজ্যেঠুর সঙ্গে৷ কী আশ্চর্য, পোশাক পর্যন্ত বদলাল না ডোডোর মা যখন জানতে চাইল, ‘কী দাদা, ও কিছু খাবে না?’ দিব্যজ্যেঠু হেসে বললেন, ও এসব কিছু খায় না৷ ওর জন্য অন্য ব্যবস্থা৷

কিছুক্ষণ আগেই বাড়ির বাইরে আয়োজকদের গাড়ি এসে পিঁক করে একটা শব্দ করে জানান দিয়েছে তার উপস্থিতি৷ ডোডোদের একগলা রহস্যের মধ্যে রেখে দিব্যজ্যেঠু আর ডোরা গাড়িতে উঠে বেরিয়ে গেল সংবর্ধনার সভায়৷ দিব্যজ্যেঠুর হাতে শুধু সেই লাল সুন্দর ব্যাগটা৷

ডোডো সারাদিন রহস্যের মধ্যে হাবুডুবু খেতে খেতে অপেক্ষা করতে লাগল কখন ডোরাকে নিয়ে বাড়িতে ফেরেন দিব্যজ্যেঠু৷ বসে থাকতে থাকতে ঘুম পেয়ে যায় তার৷ শেষে বাইরে গাড়ির পিঁক শব্দ শুনেই লাফিয়ে গিয়ে দরজা খোলে৷ খুলে কিন্তু প্রবল হতাশ৷ গাড়ি থেকে নামলেন একা দিব্যজ্যেঠু৷ শুধু তাঁর হাতে সেই লাল ব্যাগটা৷   

ডোডোর মনে প্রশ্নটা ঘুরঘুর করছিল, কিন্তু সে জিজ্ঞাসা করার আগেই ডোডোর মা চন্দ্রা জিজ্ঞাসা করলেন, ডোরাকে কোথায় রেখে এলেন, দাদা?

দিব্যজেঠুর মুখে সেরকমই মুচকি হাসি, সোফায় বসে ডোডো আর চন্দ্রার বিস্ময়ে টইটম্বুর মুখের দিকে তাকিয়েহে হেসে বললেন, তোমরা দুজনে নিশ্চয় ভাবছ মেয়েটা কে, হঠাৎ আজ সকালে কী করে এসে পৌঁছোল এখানে তা হলে বলি, মেয়েটা আমার সঙ্গেই এসেছে কাল৷

––কাল ডোডোর মা অবাক, ডোডোর বিস্ময় আরও চতুর্গুণ, বলল, তুমি তো একলা এসেছ৷ সঙ্গে গুচ্ছের লটবহর৷

––হ্যাঁ, দিব্যজ্যেঠুর ঠোঁটদুটোয় মুচকি হাসি, হ্যাঁ ওই লটবহরের সঙ্গে ডোরাকেও নিয়ে এসেছি৷ ওই লাল ব্যাগটায় করে৷ 

ডোডোর আরও বিস্ময়, কী করে?

––সেই কথাটাই তখন বলা হয়নি৷ ডোরা আমার ব্রেনচাইল্ড৷ জিনরহস্য অনেকটাই জানতে পেরে যাওয়ায় আমি চেষ্টা করছি মানুষের মতো অবিকল একটা জীবন তৈরি করতে৷ রোবট খুব জনপ্রিয় হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার অনেক খামতি আছে৷ আমি চাইছি এমন এক–একটি প্রাণ তৈরি করতে যা প্রায় মানুষের মতো দেখতে, খুব বুদ্ধিমান হবে, মানুষের যা যা ইনস্টিংক্ট সবই থাকবে তার৷

তারপর তাকালেন ডোডোর দিকে, তোর নিশ্চয় মনে আছে ক্রেগ ভেন্টারের কথা বলেছিলাম যিনি হিডম্যান জেনোমের মানচিত্র তৈরি করতে বড়ো ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁর নানা সৃষ্টির মধ্যে একটা হল সিনথেটিক জীবন তৈরি৷ তাঁর দলের বিজ্ঞানীরা সাধারণ মাইক্রোবের জেনোমকে বিশ্লেষণ করেছিলেন, তারপর সেটিকে ল্যাবোরেটরির রসায়ন থেকে পুনর্নিমাণ করেন, সবশেষে সেই ডিএনএ–টি স্থাপন করেছিলেন একটি ব্যাকটেরিয়ার কোষের মধ্যে৷ সেই কোষটি তখন বৃদ্ধি পেতে শুরু করে, সৃষ্টি করতে থাকে আরও আরও কোষ৷ বিষইয়টি খুব জটিল, কিন্তু তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন ক্রমে বিষয়টি সহজ হয়ে ডঠবে৷ তিনি এও আশা প্রকাশ করেছিলেন এরকম কমপিডটারের ডিজাইন করা সফটওয়্যার থেকে রাশি রাশি সিনথেটিক কোষ তৈরি করা সম্ভব৷ এই কোষগুলির ঠিকঠাক ব্যবহার হলে তা নিয়ে আসবে এক বিপুল সম্ভাবনা৷

বলে আবার হাসলেন দিব্যজ্যেঠু, বললেন, ক্রেগ ভেন্টার বলেছেন মানুষের শরীরের কোষগুলি আসলে এক–একটি মেসিন, আর ডিএনএ–গুলি একধরনের সফটওয়্যার যা নির্দেশ দেয় কোষগুলিকে তারা কী করবে না করবে৷ তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, একটি জীবন আসলে নানা রাসায়নিক প্রক্রিয়ার এক জটিল চক্র৷ চেতন আর অচেতনের ভিতর যে দেওয়াল তা নিয়ে যদি আমরা গবেষণা চালিয়ে যাই তা হলে মানবজীবনের সংজ্ঞাও নির্ধারণ করতে সক্ষম হব৷

ডোডো তখনও অপেক্ষা করছে ডোরা সম্পর্কে কী বলেন দিব্যজ্যেঠু।

কিন্তু দিব্যজ্যেঠু তখন বলছেন, ডোডো, ভেন্টার যেখানে থেমেছিলেন, আমি ঠিক সেখান থেকে শুরু করেছি কাজ৷ ডোরাকে তৈরি করেছি একেবারে কৃত্রিম উপায়ে৷ ডোরার শরীর তৈরি খুব সূক্ষ্ম রাসায়নিক বস্তু দিয়ে৷ তার শরীরের ভিতর এমন একটা সফটওয়্যর আছে যার মধ্যে মানুষের মতোই জিনের সমাহার৷ সবটাই তৈরি করা হয়েছে কম্পিউটারের কারসাজিতে৷ যেদিন প্রথম তার মধ্যে জীবনের সঞ্চার করতে পেরেছিলাম সে ছিল এক মহা আনন্দের দিন৷ কৃত্রিম উপায়ে তৈরি  ডোরার মধ্যে ভরে দেওয়া হয়েছে মানুষের শরীরের প্রায় সব কারুকাজ৷ তারপর তাকে গত এক বছর ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে নানা প্রোগ্রামিংয়ের মধ্যে৷ ডোরা ইতিমধ্যে অর্জন করেছে নানা বিষয়ে অগাধ জ্ঞান, কিন্তু বাস্তব হল, এখনও পুরোপুরি মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি সে৷ এখন তাকে কতখানি পরিপূর্ণ মানুষ করে গড়তে পারব সেটাই আমাদের গবেষণার বিষয়৷ বলা যায় খোদার উপর খোদকারি করতে চলেছি আমরা৷

অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল, কাল সকালেই দিল্লিগামী ফ্লাইট ধরবেন দিব্যজ্যেঠু৷ তাই আলোচনা শেষ করে বললেন, আজ সকালে ডোরাকে ব্যাগ থেকে বার করে চালু করে দিয়েছিলাম নির্দিষ্ট প্রোগ্রামিং৷ তাকে নিয়ে বৈজ্ঞানিকদের সামনে হাজির করে দেখিয়েছি কী করেছি আমরা, কী করতে চাই কিন্তু বারো ঘন্টা পর তাকে বিশ্রাম দিতে হয় বলে সুপ্রকাশদার বাড়িতে গিয়ে তাঁকে দেখিয়ে আবার ভরে নিয়েছি ব্যাগের ভিতর৷ কাল দিল্লিতে গিয়ে আবার চালু করে দেব মেশিনটা৷

ডোডো আর ডোডোর মা কথাই বলতে পারছে না বিস্ময়ে৷ 

––ডোরাকে হয়তো সামনের বছর আবার নিয়ে আসতে হবে৷ হয়তো দু–চার মাস থাকতে হবে এখানে৷ তখন ডোডোকে আমার খুব প্রয়োজন হবে৷ তাকে আরও ভাব জমাতে হবে ডোরার সঙ্গে৷ ডোডোর সাহায্যেই হয়তো বাকি কাজটা সেরে নিতে পারব আমরা৷ ডোডো আর চন্দ্রাকে অগাধ বিস্ময়ে ভরপুর করে রেখে দিব্যজ্যেঠু পরের দিন সকালে আবার ব্যাগ–বাগেজ নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন দিল্লির উদ্দেশে৷ ডোডোর চোখ তখন আর দিব্যজ্যেঠুর দিকে নয়, হৃৎপিণ্ডের আকারের লাল ব্যাগটার উপর৷ তার মনে হচ্ছিল দিব্যজ্যেঠু এ যাত্রা কলকাতা এসে ফিরে যাওয়ার সময় তার হৃৎপিণ্ডটাই নিয়ে চলে গেলেন।         

মনে মনে বিড়বিড় করছিল, কবে তুমি ফিরে আসবে, হৃৎপিণ্ড?

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *