এ যুদ্ধ শেষ হবেই

এ যুদ্ধ শেষ হবেই
অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী

এরকম বিপদে আগে কখনও পড়িনি। তাও আবার বিদেশে। দেশের মাটি থেকে আটহাজার কিলোমিটার দূরে। আত্মীয়-পরিজন, চেনাজানা সব মানুষের থেকে অনেক অনেক দূরে। যেখানে শিকড় থাকে না, সেখানে উৎখাত হতে বড় ঝড়ও লাগে না। এখানে ইংল্যান্ডে এখন পরিস্থিতি ঝড়ের থেকেও খারাপ। কোভিড যেন কিছুদিনের জন্য সবকিছু স্তব্ধ করে দিয়েছে। একই সঙ্গে স্তব্ধ করে দিয়েছে আমার ভবিষ্যৎ। আমার কেরিয়ার। এখন নভেম্বরের শুরুর দিক। বাড়ীর পিছনের দিকে একটা বড় মাঠ। তারপরে একটা চার্চ আছে। চার্চ লাগোয়া একটা বড় কবরখানাও আছে। এই মাঝের খোলা মাঠ আর ঘাসজমিকে ঘিরে বেশ কিছু ওক, সিলভার বার্চ, হর্স চেস্টনাট আর হথহর্নের মতো বড় বড় গাছ আছে এখানে। এখন অবশ্য তাদের সব পাতা পড়ে গেছে। রিক্ত কঙ্কালসার চেহারায় তারা এখন সব বসন্তের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। ঘাসের উপরে শুধুই শুকনো পাতার ভিড়।

শেষ ক’দিন হঠাৎ করে বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। দিনেরবেলাতেও জবুথবু হয়ে বসে থাকি। আমার একমাত্র পুরনো রংজলা লংকোটটা পরে। এখন দিনের বেলা বেশ ছোট হয়ে এসেছে। বিকেল পাঁচটা নাগাদ গাছের উপরের দিকের ডালগুলো ডুবন্ত সূর্যের সোনালি আলোয় সেজে ওঠে। তারপরে ছ’টায় চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। তবু বসে থাকি। একজনের অপেক্ষায়। গত কয়েকমাস আলাপ হয়েছে। সে অবশ্য আরেকটু রাত হলে এখানে আসে। তার কথায় পরে আসছি। তার আগে আমার কথা বলি।

দেড়বছর হল ইংল্যান্ডে একটা নামী ইউনিভার্সিটিতে অঙ্ক নিয়ে বিএ পড়তে এসেছি। দেশ থেকে পরীক্ষা-ইণ্টারভিউ-এর পরে যখন এই বিশ্ববিখ্যাত ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ পেলাম, তখন মনে হল হাতে চাঁদ পেয়েছি। কতদিনের স্বপ্ন এই আটশো বছরের পুরনো বিখ্যাত ইউনিভার্সিটিতে পড়ব। এ সুযোগ ছাড়া যায়! আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবার। বাবা এডুকেশন লোন নিয়ে অনেক কষ্ট করে ইউনিভার্সিটি ফি-র ব্যবস্থা করলেন। এতটা অবধি সব ঠিক ছিল। যেন এক অত্যন্ত সফল ছাত্রের সিঁড়িভাঙ্গার গল্প। কিন্তু তারপরেই সব কিছু পাল্টে গেলো। এ বছরে মার্চ মাসে ইংল্যান্ডে ও সারাবিশ্বে হঠাৎ করে কোভিড শুরু হয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে সব কিছু বন্ধ হয়ে গেল। এমন কি দেশে ফেরার উপায়ও। এখানে কিছু ছোটখাটো কাজ করে পড়াশোনার খানিকটা খরচ জোগাব, সেরকম ভরসায় এসেছিলাম। সে সব কাজ পাওয়ার কোন উপায় থাকল না। লকডাউনে কাজের সুযোগ প্রায় নেই। পড়াশোনার খরচের বাইরে ইউনিভার্সিটির হোস্টেলের খরচ, সে আরেকটা বড় খরচ। বাধ্য হলাম খুব ছোটখাটো কোন থাকার জায়গার খোঁজ করতে, যেখানে খুব কম ভাড়ায় থাকা যায়।

শেষে পেলামও। একটা ছোট একতলা বাড়ী। বাড়ী বলতে একটাই বড় ঘর। তার একপাশে রান্নার ব্যবস্থা। সঙ্গে একটা ছোট টয়লেট। এর সামনে একটা ছোট বাগান আছে। এটা আসলে একটা বড় বাড়ীর পিছনের দিকের একটা আলাদা ঘর। মূল বড় বাড়ীতে অন্য এক পরিবার ভাড়া থাকেন। পিছনের দিকে অবহেলায় পড়ে ছিল এই ঘরটা। এর বয়স কত হবে বলা মুশকিল। মনে হয় একটা সময় আস্তাবল ছিল। তারপরে এটা পড়ার ঘর হিসেবে কেউ ব্যবহার করত।

পাথরের বাড়ী। উপরে অনেক পুরনো দিনের স্লেট পাথরের ছাদ। সে ছাদ ধরে রেখেছে বড় বড় ওক কাঠের বিম। কাঠের মেঝে। জানলাগুলো ঘরের তুলনায় ছোট। সে জন্য ঘরে আলো একটু কম। এটা ফাঁকা পড়ে ছিল। খুব কম ভাড়ায় পেয়ে গেলাম। যদিও সেটাও কতদিন দিতে পারব জানি না। বিদেশে আসার এরকম স্বপ্ন দেখাটাই ভুল হয়েছিল। বুঝতে পারি বাবা কত কষ্ট করে ইউনিভার্সিটির পড়ার খরচ যোগাচ্ছে। তার উপরে যদি থাকার খরচ দিতে হয় ভারত থেকে!

এ বাড়ীটার পিছনেই এই মাঠটা। যখনই মন খারাপ হয় ফেন্সের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এখানে এসে বসি। এখানেই ওই মহিলার সঙ্গে আলাপ। প্রথম আলাপে বেশ চমকে উঠেছিলাম। কখন যে ওই মহিলা পাশের বেঞ্চিতে এসে বসেছিল, জানি না। ভারী মিষ্টি গলা। স্কটিশ উচ্চারণ। প্রশ্নটা করেছিল। প্রশ্ন অবশ্য ঠিক নয়। মন্তব্যই বলা যায়।

-যুদ্ধ যে কবে শেষ হবে, কে জানে!

-হ্যা, এটা যুদ্ধের মতোই বটে। কবে যে শেষ হবে কে জানে!

অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, যুদ্ধের মতো কেন! যুদ্ধই তো! ফ্রান্সে যে যুদ্ধ চলছে আমি তার কথা বলছি।

এবার আমার একটু অবাক হওয়ার পালা। ব্রেক্সিট নিয়ে কিছু কি বলতে চায়? ইংল্যান্ডের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার ব্যাপারে কিছু? কিন্তু সেক্ষেত্রে ব্রাসেলস বলা উচিত। এই বিষয়ে কিছু বলতে চায়?

একবার কিছু দূরে বসে থাকা ওই মহিলার মুখ দেখে নিলাম।

ভারী সুন্দর চোখ দুটো। চোখের মনি নীল। বড় বড় চোখের পলক। মুখে কোন প্রসাধন নেই। কিন্তু তাতেই যেন বেশ আকর্ষণীয় লাগছে। বয়স কুড়ির কাছাকাছি হবে। মুখে গভীর বেদনার ছাপ। যেন হঠাৎ করে এক সোনালি বিকেল কালো মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেছে।

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ফের বলে উঠল, জন যখন প্রথম গেল বলেছিল একমাসের মধ্যে ফিরে আসবে। তারপরে দেখতে দেখতে যে কত মাস কেটে গেলো। তারপর মাস কেটে বছর। কিন্তু কবে যে যুদ্ধ শেষ হবে!

আবার আড়চোখে তাকালাম। ঠিক পাগল বলে মনে হয় না। তবে যে পোশাক পরে আছে, এখন সেরকম পোশাক কম দেখি। পা অবধি গ্রে লংকোট। কোমরে বেল্ট। পায়ে গামবুট।

ফের বলে ওঠে, জন শুরুর দিকে অনেক চিঠি লিখত। এখন খুব কমই লেখে। একদম সময় পায় না। সব চিঠি নাকি সিকিউরিটি চেক হয়ে আসে। সব কথা লেখার নিয়ম নেই। এমনকি কোথায় আছে, সে বিষয়েও লিখতে পারে না। ও আছে যুদ্ধের ফ্রন্টলাইনে, ট্রেঞ্চের মধ্যে। আগে নাকি ট্রেঞ্চের পরিবেশ অনেক শান্ত ছিল। শুধু সতর্ক হয়ে অপেক্ষা করতে হত, কখন শত্রুট্রেঞ্চ থেকে গোলাগুলি শুরু হয়। এখন আর সে পরিস্থিতি নেই। প্রায় রোজই মর্টার ফায়ার হচ্ছে। বড় বড় গোলা এসে পড়ছে। মাঝে মধ্যেই ট্রেঞ্চের বড় ক্ষতি হয়। তখন ওদের চটজলদি আবার ট্রেঞ্চ মেরামতি করতে হয়। সবসময় খুব ব্যস্ত থাকে।

একটু থেমে মহিলা ফের বলে উঠল, তুমি হয়ত এসব বুঝতে পারছ না। অনেকেই এই যুদ্ধ কিভাবে হচ্ছে তা জানে না। আমি ওর চিঠি থেকেই জেনেছি। কথা শুনে বিড়বিড় করে বলে উঠলাম, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।

মহিলা যেন না শুনেই বলে উঠল, আমাদের বিয়ের ছয় মাসের মাথায় জন যুদ্ধে গিয়েছিল। আমার রোজ খুব চিন্তা হয়, কোন বিপদ হল না তো? ফিরে আসতে পারবে তো? রাতে এসব চিন্তায় ঘুমই আসে না।

একটু থেমে মহিলা ফের বলে উঠল, তা তুমি যাও নি?

-কোথায়?

-যুদ্ধে! আবার কোথায়? সবারই তো যুদ্ধে যাওয়া উচিত। নিজের দেশকে বাঁচানোর জন্য। তাই না?

-মানে, আমি আসলে..

কি আর বলব। চুপ করে থাকি।

আমার বিব্রত মুখ দেখে মহিলা ফের বলে উঠল, বুঝেছি, তুমি ভারতীয়, তাই না?

আমি এতক্ষণে একটা বোধগম্য কথা শুনে মাথা নাড়লাম।

–হ্যাঁ ভারতীয়।

মহিলা মাথা নাড়ল।

–ঠিক কথা। তুমি কেন যাবে? আমরাও তো তোমাদের সঙ্গে সঠিক কাজ করি নি। তাই না? তোমাদের দেশ তোমাদের থেকে কেড়ে নিয়েছি।

বলে আমার দিকে তাকিয়ে ফের বলে উঠল, আমি কিন্তু কাগজ নিয়মিত পড়ি। তোমাদের ওখানে কি হচ্ছে সব কিছুর খবর রাখি। এই তো কিছুদিন আগে দেখলাম তোমাদের দুই দলের নেতা, একজনের নাম জিন্না, অন্যজনের নাম বাল গ্যাঙ্গা না কি যেন – তাদের মধ্যে কি এগ্রিমেন্ট হয়েছে।

মহিলা কি ১৯১৬ এর ডিসেম্বর- এর লখনউ-এ ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতা বাল গঙ্গাধর তিলক ও ইন্ডিয়ান মুসলিম লীগের মহম্মদ আলি জিন্নার মধ্যে সেই এগ্রিমেন্টের কথা বলছে?

বলে উঠলাম, বাল গ্যাঙ্গা নয় বাল গঙ্গাধর তিলক।

-হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। তোমাদের কিছু কিছু নাম এত শক্ত হয়। আগে আমি কাগজ পড়তাম না। জন যাওয়ার পর থেকে যুদ্ধের সব খবর রাখতে কাগজ পড়ি। তুমি তাহলে কি করো?

-আমি এখানে ইউনিভার্সিটিতে পড়ি।

-বাহ। তুমি খুব ভাল ছাত্র তাহলে! কি বিষয় নিয়ে পড়ো?

-কম্পিউটার সায়েন্স।

-কি সায়েন্স? যাক, সেসব অবশ্য আমার মাথায় ঢুকবে না। আমি স্কুলে পড়ার পর আর পড়িনি। তার পরপরই আমাদের বিয়ে হয়ে গেলো। এই দু’বছর হল। জন এখানকার একটা কটন মিলে কাজ করত। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হতে ওকে আর্মিতে জয়েন করতে হল। আমার একটা ছোট মেয়ে হয়েছে, তাকেও জন এখনও দেখেনি।

সেদিন এরকম আরও কিছু কথার পরে, হঠাৎ দেখি সে মহিলা উধাও।

সেদিনই প্রথম আলাপ। তারপরে মাঝে মধ্যেই দেখা হয়। ওর নাম জেনেছি। ইভা।

ঠিক যখন দিনের আলো ফুরিয়ে যায়, দূরে রাস্তার আলো জ্বলে ওঠে, বাসায় ফেরা পাখির ডাক কমে এসে শুধু মাঝে মধ্যে অচেনা রাতপাখির মিশ্রস্বর শোনা যায়, দূর থেকে শেয়ালের ডাক শোনা যায়, তখন ও আসে। আমার থেকে খানিক দূরে এসে বসে।

ও অবশ্য একা আসে না। সঙ্গে সঙ্গে ঘন কুয়াশাকে ডেকে আনে। আর থাকে একটা ভিজে মাটির গন্ধ। মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়া চাঁদের মতো ও সেই কুয়াশার মধ্যে হারিয়ে যায় মাঝে মধ্যে। তার মধ্যে থেকেই ওর কথা ভেসে ভেসে আসে দূর থেকে ভেসে আসা রেডিও স্টেশনের চ্যানেলের মতো।

প্রথম দিন ভেবেছিলাম মহিলার বোধহয় মাথা খারাপ। এখন আর তা ভাবি না। ও কে তা আমি বেশ আন্দাজ করতে পারি। একটু যে ভয় করে না, গা ছমছম করে না, তা বলব না। কিন্তু তবু আসি। কি এক অজানা আকর্ষণে আসি।

ও হয়ত আমার মতোই বন্ধু খোঁজে। কথা বলার লোক খোঁজে। মন খারাপের কথা কারোর সঙ্গে শেয়ার করতে চায়। ঠিক আমার মতোই। একইসঙ্গে নানান প্রশ্ন। বুঝতে অসুবিধে হয় না ও এখনও পড়ে আছে একশ বছর আগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে।

-আচ্ছা, তুমি জানো, ওখানে ট্রেঞ্চে শুধু মানুষ থাকে না। কী থাকে আন্দাজ করতে পারো?

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে দ্বিগুন উৎসাহে বলে ওঠে, জন বলে বিশাল বিশাল বিশাল ইঁদুর থাকে ট্রেঞ্চে।

আমিও আমার সদ্য পড়া জ্ঞান ফলাই।

-হ্যাঁ, ওদের বলা হয় মৃতদেহের ইঁদুর। কর্পস র‍্যাট। এরা নাকি মৃতদেহ খেয়ে খেয়েই বড় ও মোটা হয়ে ওঠে। দুই ট্রেঞ্চের মধ্যে পড়ে থাকা অজস্র মৃতদেহ খেয়ে খেয়ে ওরকম চেহারা হয়।

বলেই বুঝতে পারি কথাটা বলা ঠিক হয়নি। ও একটু চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফের বলে ওঠে, ঠিক বলেছ। বিশাল বিশাল ইঁদুর। জন চিঠিতে বলে ও নাকি প্রথমদিকে রাতে ভয়ে ঘুমোতে পারত না। ও যে ডাগ আউটে শোয় সেখানেও ওর গায়ের উপর দিয়ে বড় বড় ইঁদুর ছুটে যায়। এখন নাকি ওর অভ্যেস হয়ে গেছে।

-হ্যাঁ, তাই তো শুনেছি। জন ট্রেঞ্চে জল-কাদার কথা বলে নি? ট্রেঞ্চের মধ্যে অনেক জল-কাদা থাকে।

-হ্যাঁ, ও বলেছিল যে অনেকসময় জামা কাপড় সব জলকাদায় ভিজে যায়। যেখানে দাঁড়িয়ে থাকে, সেই কাঠের ডাকবোর্ডেও অনেক সময় জল জমে যায়। সে জলে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অনেকের নাকি ‘ট্রেঞ্চফুট’ হয়। ওর একজন বন্ধুর তার জন্য পা হাঁটু থেকে কাটা গেছে। তবে এখন ও এসব কথা আর লেখে না। জানে আমি কষ্ট পাবো। আমার এক বন্ধু আছে। শেলী। এসব কথা এখন আমি শেলীর মুখে শুনি। এখন অনেকে নাকি গুরুতর আহত হচ্ছে। অনেকের হাত পা কাটা পড়ছে।

-অনেক সময় আবার হঠাৎ করে ট্রেঞ্চ অ্যাটাক হয়। শত্রুসেনা হ্যান্ড গ্রেনেড দিয়ে ওদের ট্রেঞ্চ আক্রমণ করে। গোলাগুলি শুরু হলে মনে হয় যেন চারদিকে পেরেক বৃষ্টি হচ্ছে। সে পেরেক আর লোহার টুকরো ছিটকে এসে শরীরের মধ্যে ঢুকলে আর দেখতে হবে না!

-সত্যি এরকম হয়?

ওর মুখে দুশিন্তা ফুটে ওঠে। কুয়াশার আড়াল থেকে কথা বললেও বুঝতে পারি ওর চোখ ছলছল করছে। সাহস যোগাই।

-সবসময় যে হয়, তা নয়। ওরা তো ট্রেঞ্চে প্যারাপেটের আড়ালে থাকে। বালির বস্তার আড়ালে থাকে। তার আড়ালে থেকে হেলমেট পরে শত্রুট্রেঞ্চের উপর নজর রাখে। জনের কিছু হবে না।

ইভা যেন নিশ্চিন্ত হয়।

-ঠিক বলেছ। জন ওর মেয়েকেও দেখেনি এখনও। নিশ্চয়ই সে কথা খেয়াল রেখে খুব সাবধানে যুদ্ধ করছে।

আমি চুপ করে থাকলাম। গত ক’দিন ট্রেঞ্চ নিয়ে কিছু পড়াশোনা করেছি, যাতে ওর প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারি।

আবার ও বলে উঠল, জার্মানরা খুব বাজে লোক হয়। ওদের জন্যই এত সমস্যা। যুদ্ধে না গেলে জন এতদিনে এখানে একটা বড় বাগান করত। আপেল, পিয়ার, কমলালেবুর বাগান। আমরা সবাই একসঙ্গে থাকতে পারতাম। আমার বাগান খুব ভালো লাগে। তোমার?

-হ্যাঁ, আমারও খুব পছন্দ।

-তোমার ভারতের কথা মনে পড়ে না?

-হ্যা, মনে পড়ে। খবর পাই। কিন্তু তবু খুব চিন্তা হয়।

ফোনের কথা আর বলি না ওকে। শুধু বলি বাড়ীর কথা। বাবা মায়ের কথা। বোনের কথা। রীমার কথা। ও যেন খুব কৌতূহলের সঙ্গে শোনে। বিশেষ করে রীমার কথা।

আমাকে অবশ্য বেশী কিছু বলতে হয় না। ও আবার বলে ওঠে, জন আগে রক্তারক্তি খুব অপছন্দ করত। কিন্তু এখন ও এসব দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। সেদিন লিখেছে বন্দুকের বেয়নেট নাকি এক শত্রুসেনার পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমি ভাবতেই পারি না যে ও এরকম হিংস্র হয়ে উঠতে পারে! যে একটা পোকাকেও মারে না, সে এরকম কাজ করতে পারে!

ও ফের বলে ওঠে, যুদ্ধ নাকি এখন খুব ভয়ানক হয়ে উঠেছে। রোজ অনেক সেনা মারা যাচ্ছে। দু’পক্ষেই। মাঝে মধ্যে যেন বোমা বৃষ্টি হয়। ওর ডাগ আউটও নাকি ক’দিন আগে ভেঙে গিয়েছিল। ওরা ফ্রন্ট লাইন থেকে পিছিয়ে রিজার্ভ ট্রেঞ্চে চলে এসেছে। যখন হাওয়া দেয়, তখন বাতাসে ভেসে আসে বারুদের আর পচা মৃতদেহের গন্ধ। আমি বলেছি যুদ্ধ ছেড়ে চলে আসতে। আচ্ছা বলো তো, ও তো ওর মেয়েকেই দেখেনি। একবার কি ফিরে আসতে পারে না!

গলায় যেন কাকুতি। কথা বলতে বলতে কান্নায় গলা বুজে আসে।

অবাক লাগে। আমাদের মধ্যে কত তফাৎ। বলতে গেলে কোন মিলই নেই। কিন্তু তবু এ দূরত্ব কোথায় যেন মুছে যায়।

আমারও যেমন প্রতি মুহূর্তে মনে হয় রীমার কথা। জানি সেও সব সময় আমার অপেক্ষায় থাকে। রোজ ফোনে কথা হলেও কবে যে আবার ওকে সামনা সামনি দেখব। কে জানে! মাঝে মধ্যে মনে হয় এ জীবনে হয়ত আর দেখাই হবে না। আমি যেন এক দ্বীপে বন্দী হয়ে পড়ে আছি। ও আরেক দ্বীপে।

ইভা একদিন একটা চিঠি পড়ে শোনায়। জনের চিঠি।

‘তোমরা সবাই ভালো আছো তো? মেরী কেমন আছে? কতটা বড় হল। কী কী কথা বলতে শিখেছে? আমি এখানে একরকম আছি। আমার কথা চিন্তা কোর না। এখানে দুপুরে রোজ ‘কর্ন বীফ’ টিনে খাই। আজ চীজ আর সিগার দিয়েছিল। মনে হয় সামনে কোন বড় হাঙ্গামা আছে। এটা আমাদের চাঙ্গা করার একটা উপায়। এখানে আমরা কয়েকজন মিলে মাঝে মধ্যে তাস খেলি। তোমার কয়েকটা ছবি এঁকেছি। খুব ভালো অবশ্য হয়নি। তোমার সেই মায়াবী চোখের চাহনি যেন কিছুতেই আঁকতে পারি না। পরে ভাবি খারাপ আঁকা হতে পারে, কিন্তু তার মধ্যে তুমি তো আছো!’

চিঠি পড়তে পড়তে ইভার গলা কান্নায় বুজে আসে।

বড় চিঠি। শুনে বুঝি এ চিঠিতে লেখা শব্দের আড়ালে আসল কথাগুলো শুধু না লেখা শব্দ দিয়ে সাজানো। এ চিঠি শুধু প্রতীক্ষার আর ভালোবাসার। এসব চিঠির কাছে যুদ্ধের রঙ ফিকে হয়ে যায়।

ইভা ফের বলে ওঠে, ও অনেক দেরী করে উঠত। এখন সে অভ্যেস বদলে গেছে। সকাল সকাল উঠে পড়ে। রোজ নাকি পাঁচটায় উঠে পড়তে হয়। সকালের দিকে আর সন্ধের ঠিক আগে ওই দুটো সময়েই সবথেকে বেশী আক্রমণ হয়। খুব সাবধানী হতে হয় ওই সময়ে। একদিন দেখলাম ও বেশ চিন্তিত। বেঞ্চিতে এসেই বলে উঠল, জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। এখন ছাড়া পেয়েছে। বোমা ফেটে ওর মাথা ছুঁয়ে একটা পেরেক চলে গিয়েছিল। ভাগ্য ভালো। কোনরকমে বেঁচে গেছে। আমি ওকে বলেছি আবার হাসপাতালে যেতে। ওখানে আরও কিছুদিন বিশ্রাম নিতে। আবার ট্রেঞ্চে ফেরার কী যে দরকার ছিল। যদি আবার এরকম হয়!

আমার দিকে তাকিয়ে ইভা ফের বলে ওঠে, আচ্ছা বন্ধু, বল তো, ও সত্যি ফিরবে তো! আমি যে আর অপেক্ষা করতে পারছি না। মনে হচ্ছে এভাবেই যেন অপেক্ষা করে আমার সারা জীবন কেটে যাবে।

আমি ভরসা দিই। যুদ্ধ শেষ হলেই চলে আসবে। এ যুদ্ধ তাড়াতাড়ি শেষ হবেই।

ওর মুখটা যেন সামান্য উজ্বল হয়ে ওঠে। কষ্ট করে হেসে ওঠে।

তারপর আমরা দুজনেই চুপ করে বসে থাকি। দূরে যতদূর দেখি শুধুই অন্ধকার। তারারাও যেন এ অন্ধকারে মেঘের আড়ালে মুখ লুকোয়।

আবার কোন একদিন আমার মনমরা ভাব দেখে জিজ্ঞেস করে ওঠে, তুমি আজ খুব চিন্তায় পড়েছ দেখছি।

-কি করে বুঝলে?

-এতদিন তোমায় দেখছি, আমি বুঝব না! আজ তুমি যেরকম অন্যমনস্ক আছো, যেভাবে শুধু ‘হুঁ’ ‘হুঁ’ করে উত্তর দিচ্ছ, তাতেই বুঝেছি। বাড়ীর সবাই ঠিক আছে?

-ঠিক ধরেছে। ফোনে গতকাল শুনলাম মায়ের শরীর খুব খারাপ। স্টমাক ক্যান্সার বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। অনেক খরচ। আমি যে এর মধ্যে কিভাবে কবে ফিরব কে জানে! এতদিন বন্ধ থাকার পরে আবার ইউনিভার্সিটির ক্লাস চালু হয়েছে। এখন ফিরতেও পারব না। তাছাড়া যাতায়াতেও অনেক খরচ। মাকে যে কবে দেখতে পাব! মা আজ ফোনে কথা বলছিল না। জানি কাঁদছিল। হয়ত ভাবছিল আমাকে আর দেখতে পাবে না। আমাকে যেতেই হবে। খুব শিগগিরি। আরেকটা বড় সমস্যা দেখা দিচ্ছে। কবে অবধি যে এ বাড়ীতে থাকতে পারব কে জানে! ভাড়া দেব কি করে?

কোভিড বা এসবের কথা ও বুঝবে না। শুধু ওর প্রশ্নের বলি, আমাকে শিগগিরই এ বাড়ী ছেড়ে দিতে হবে। ভাড়া দিতে পারছি না।

ও শুনে হেসে ওঠে।

-এই কথা! এ তো আমারই বাড়ী। তুমি চিন্তা কোর না। এখান থেকে কেউ তোমাকে সরাতে পারবে না। তুমি এখানেই থাকবে।

বলে গভীরভাবে আমার চোখের দিকে তাকায়। নীল চোখ যেন অন্ধকারে জোনাকির মতো জ্বলে ওঠে। তারপর আবার কুয়াশায় হারিয়ে যায়।

কিছুদিন বাদে বাড়ী ছাড়ার নোটিস আসে। আমি নিরুপায়। উত্তর দিই না। বাড়ীভাড়া দেব কোথা থেকে! আবার চিঠি আসে। আবার।

তারপরে একদিন ওরা আসে। আমার রেন্টাল এজেন্সীর এজেন্ট। জানি আমাকে আর ওরা থাকতে দেবে না।

কিন্তু তা বলে কি আর ওদের এড়িয়ে থাকা যায়! কিছুক্ষণ জানলায় উঁকিঝুঁকি মারার পরে দরজায় ধাক্কা দিতে শুরু করে।

আমি চুপচাপ ঘরের মধ্যে অপেক্ষা করি। অন্ধকারে। মুখ দেখানোর উপায় নেই। লজ্জায় মাথা নীচু করে বসে থাকি।

ওরা বারবার জোরে জোরে ধাক্কা দেয়। শেষে দরজার লক ভেঙে ঢোকে।

ঘরে ঢুকে ওরা আলো জ্বালায়। তারপরে আমাকে খাটের উপরে শুয়ে থাকতে দেখে যেন চমকে ওঠে। কাছে এসে দেখে। দেখে আমার অসাড় দেহ পড়ে আছে। উত্তেজিত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

আমার আর ভাড়া লাগবে না এ বাড়ীতে।

আমি এখন এখানকার চিরকালের অতিথি। ইভাও শুনেছিলাম এ ঘরেই আত্মহত্যা করেছিল যুদ্ধে জনের মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পরে।

বাইরে আজ বিকেলের আলো ঘন কালো একটা মেঘ এসে চুরি করেছে। খানিকক্ষণের মধ্যে টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হল। সঙ্গে ঠাণ্ডা ঝোড়ো হাওয়া। আমি মাঠের সেই বেঞ্চিতে এসে বসি।

খানিকবাদেই আবার ইভার সঙ্গে দেখা হবে। আমরা আবার আমাদের যুদ্ধের গল্প একে অন্যকে শোনাব। একজন আরেকজনকে আশ্বস্ত করব, বলব এ যুদ্ধ শেষ হবেই। তারপরে আবার চুপ করে বসে থাকব। প্রতীক্ষায়।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

9 thoughts on “এ যুদ্ধ শেষ হবেই

  1. মনটা ভারী হয়ে গেলো এবং যথারীতি শেষে চমক যে থাকবে তা আন্দাজ করেইছিলাম

  2. খুব সুন্দর গল্প। আপনার মায়াময় লেখনী মন ছুঁয়ে গেল।

  3. প্রিয় অভিজ্ঞান, এ গল্প তুমিই লিখতে পারো ! আমি বহুক্ষণ ধরে অবাক হতে হতে মানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ইভার সঙ্গে ২০২০ সালের করোনা আবহে লেখকের সংলাপ প্রায় রোজই চলছে কেমন করে, এই ভাবনার শেষে উত্তর পেলাম যখন, তখন আমি বাকরুদ্ধ আর কোনও অবাস্তবতা নেই… কী অসাধারণ মুনশিয়ানা ! এর বেশি খোলসা করে বললে সাসপেন্স নষ্ট হয়ে যাবে, তাই এখানেই থামলাম । এমন শারদ উপহারের জন্যে কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয় অভিজ্ঞান ! তোমার জন্যে থাকছে শুভেচ্ছা এক আকাশ ।

  4. শতাব্দী পেরিয়ে দুই যুদ্ধের দর্শক। যাঁরা জীবনযুদ্ধের কাছে হার মানেন, নাকি মানেন না? প্রতীক্ষা করেন যুদ্ধ থামার, অনন্ত অপেক্ষা। কিছুদিন আগে 1919 ছায়াছবিটা দেখেছিলাম, এ গল্পের কিছু জায়গার বর্ণনা এত প্রাঞ্জল, আবার সেই ছবিটির কিছু দৃশ্য মনে পড়ে গেল। ধীরে অথচ নিশ্চিত একটি সমাপ্তির দিকে ক্রমশ এগিয়ে গেছে এই কুয়াশাঘেরা মায়াবী আখ্যান। মন ভারী হয়, থেমে যায়, সময় আর স্থান কোথাও গিয়ে একটা অলীক বিন্দুতে কাটাকুটি খেলে…

  5. অসাধারণ। দুই যুদ্ধের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন দারুণ মুনশিয়ানায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *