short-story-ghor-kaal

ঘোরকাল
কাজল মালেক


জানালার ওপাশে অবরুদ্ধ এভালন এপার্টমেন্টসের প্রাচীর। তার ওপারে মুক্ত প্রকৃতি। কালো আকাশের দৃশ্যমান অংশে নুয়ে পড়া মেঘের নীরব আনাগোনা। বাইরে তুষারকণা অথবা বৃষ্টির ঘন কুচিতে দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে এল পলাশের। চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নিল। রুমহিটারের মাধ্যমে উষ্ণতাকে নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও শীত শীত অনুভূত হচ্ছে তার। এক কাপ কফি হলে মন্দ হতনা। কে করে দেবে। হাসপাতালের চাকুরী সোহানার। কোভিড অতিমারির এই দুঃসময়ে সবাই যখন হোম অফিস করছে, তখন সোহানাকে হাসপাতালে উপস্থিত থেকে করোনার রোগীর সেবায় আরও বেশি সময় দিতে হচ্ছে। পিপি পরে সকালে ঘর থেকে বেরোয় আবার সন্ধ্যায় ফিরে আসে সেই পিপি পরেই। এসে সোজা ওয়াসরুমে ঢোকে। আধাঘন্টার আগে বের হয়না। ফ্রেস হয়ে বেডরুমে আসে আরও পরে। আজ ক’জন মারা গেল, নিঃশ্বাস নিতে না পেরে মৃত্যু যন্ত্রণায় করোনার পেশেন্ট কিরকম ছটফট করছিল সেইকথা একাধিকবার শুনতে হয় পলাশকে। হাসপাতালের পরিবেশ ঘরে নিয়ে আসাআর ভাল লাগেনা। আজ পলাশ ছুটি নিয়েছে। হোম অফিসের কোন সময় অসময় নেই। হঠাৎ ফোন, মিটিং লেগেই থাকে। কদিন থেকে শরীরটা ভাল যাচ্ছেনা তার। সোহানা সতর্কতা বশতঃ করোনার আগাম কিছু ওষুধ দিয়ে গেছে। আলস্যের জন্য খাওয়া হয়নি। ওষুধ রয়ে গেছে দেখলে সোহানা মেজাজ খারাপ করবে। সেগুলো বিছানা থেকে ট্রাসে ছুঁড়ে ফেলল। শরীর ব্যথা করছে, নাকে পানি জমছে, জ্বরও এল বোধ হয়। মাথাটা ঝিম মেরে আছে। এখন কয়টা বাজে? নিজেকেই প্রশ্ন করে পলাশ। ঘড়িটা ওপাশে টেবিলের উপর রাখা। বিছানা থেকে উঠে গিয়ে সময় দেখার ইচ্ছে হলনা। ক্ষিদে পেল কিনা তাও বুঝতে পারছেনা। স্বচ্ছ পুরো কাচে আবৃত জানালার ওপারে বাড়িগুলো সারিবদ্ধ, তার উপর ঝিরিঝিরি বারিপাত। ছেঁড়া তুলার মতন। ঘন সাদা। বরফ পরছে না তো? ক’বছর থেকে ওয়াশিংটন স্টেটের সিয়াটলে বসবাস করছে পলাশ। গতবার বরফ পড়েছিল, তবে যুক্তরাষ্ট্রের ইষ্টকোস্টের মত বিশেষ করে নিউইয়র্ক,বোস্টন, নিউজার্সির ভারী তুষারপাত ওয়েস্ট কোস্টে দেখা যায়না। থার্মোমিটারে জ্বরটা দেখে নেবে কি? না, দরকার কি, হলে তো দেখলে জ্বর আর কমবেনা। চোখ দুটো বন্ধ করে রেখেছে পলাশ। মাথার যন্ত্রণা ক্রমশঃ বাড়ছে। খুক খুক কাশছে। নিঃসন্দেহে তাকে করোনা পাকরাও করেছে। টীকা নিয়েছে সে, তারপরও যেরকম মনে হচ্ছে, বাড়াবাড়ি রকম কিছু না আবার ঘটে যায়। চাদরের উপর কম্বল টেনে নেয় পলাশ। সোহানাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করেনা। শুধু শুধু ডিউটি থেকে ডেকে এনে বিরক্ত করা। ঘুমোতে পারলে ভাল হত। নিঃসঙ্গতার ঘুমে স্বপ্ন দেখে সে। কোনটা সুখস্মৃতির, কোনটা ভয়াবহতম। জ্বরে পলাশ কখনো প্রলাপ বকেনা। তবে অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে। ছেলেবেলার কথা মনে পড়েছে তার।কোন একটা বহুতল ভবনের উপরতলায় উঠে আর নামতে পারছেনা। যেদিকে সিঁড়ি সেদিকটা বন্ধ। আবার যদি বা সিঁড়ি পেল তা মাঝখানের কয়েক ধাপ নেই। কেমন শূন্যে ঝুলে আছে। অস্থির হয়ে ঘুরছে কেবল। জ্বরের ঘোরের এরকম স্বপ্ন তাকে মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দেয়। কখনো স্বপ্নে দেখে বাইকে চড়ে অজানা কোথাও চলে গেছে। বাড়ি ফেরার পথ খুঁজে পাচ্ছে না। সামনে নদী, পার হওয়ার কোন বাহন নেই। আরও দূরে ঘুরে ঘুরে সে একটা সাঁকো পেয়ে যায়। সরু সাঁকোর উপর মোটর সাইকেল তুলে দিয়ে আরও বিপদে পড়ে সে। অসম্পূর্ণ সেতু মাঝনদী পর্যন্ত গিয়েছে। তারপর অথৈ পানি। হঠাৎ তার মনে হয় চলমান বাইকের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ছিটকে নিচে পড়ে যাচ্ছে, প্রাণপণে বাইক ধরে রেখেছে সে। পানিতে নিমজ্জিত হওয়ার শব্দ শোনে পলাশ। তলহীন জলগুহায় নেমে যাচ্ছে তার বাইক। মনে হল নিচে কোন মাটি বা পানি নেই, শুধু অতল।

প্রায়ই সুন্দরবনে আটকা পড়ার স্বপ্ন দেখত সে। আজ তন্দ্রাঘোরে সুন্দরবনের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে পলাশের। সেবার একজন শিকারীকে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী সুন্দরবন দেখতে গিয়েছিল। দেশী নৌকায় বসে নদী থেকে তারা সুন্দরবনের দৃশ্য দেখছিল। উঁচু গাছের ডালে কয়েকটি শামুক কোঁচা পাখি দেখে শিকারী বনের পাশ ঘেঁষে মাঝিকে নৌকা ভেড়াতে বললেন। শিকারীর সঙ্গে কয়েকজন ছাত্র দ্রুত নৌকা থেকে নেমে বনের ভেতরে ঢুকে পড়ে। পাখির গতিবিধি লক্ষ্য করে শিকারী সন্তর্পনে সেই গাছের নিচে চলে গেলেন। বন্দুক তাক করে মুহূর্তে গুলি করেন তিনি। একসঙ্গে চারটি পাখি ভূপতিত হয়। পতিত পাখি ধরার জন্য ছাত্ররাও সেদিকে ছুটে যায়। সেই মুহূর্তে হঠাৎ এক বাঘ পাখির বদলে ছাত্রদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সকলেচ সজোরে চিৎকার ও দিকবিদিকে ছুটে যাওয়ার মুহূর্তে বিশালাকৃতির বাঘটি একজন হতভাগা ছাত্রের গলা কামড়ে ধরে এবং হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে বনের গভীরে নিয়ে যায়। সুন্দরবনের ভেতরে খালের উপর নৌকা নিয়ে বেড়াতে গিয়ে পলাশ মাঝির গল্পটা শুনেছিল।

বাঘের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এই ঘটনা সেই সময় সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার মানুষের মুখে মুখে ফিরত। কতরাত এরকম স্বপ্ন দেখে ঘর্মাক্ত হয়ে পলাশের ঘুম ভেঙেছে। বাঘের মুখে পড়ে সে বাঁচার আকুতি জানিয়েছে, কেউ তাকে উদ্ধার করতে আসেনি। আজ করোনাবাঘের মুখোমুখি সে। কে জানে আজই তার শেষ দিন কিনা। মৃত্যুর ছায়া ঘুরছে তার সামনে। মৃত্যুর ৩০ সেকেন্ড আগে মানুষের অতীতের সব ঘটনা মনে পড়ে। এরকম শুনেছে সে। তখন তার এক পা থাকে ইহ জগতে আরেক পা পরজগতে। এরকম একটি অবস্থা হয় প্রতিটি মৃত্যুপথযাত্রীর। দুই জীবনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে সে তার পৃথিবীর সমুদয় ভালমন্দ কর্মের ছবি অবলোকন করে। নিজেই উপলব্ধি করতে পায় তার কর্মফল পরজীবনে তার পরিণতি। পাপপুণ্যের হিসেবে মৃত্যু পরবর্তী অনন্তকাল তার সামনে প্রতিভাত হবে। এই দৃশ্য শুধু মুমূর্ষু ব্যক্তিই দেখবে,তার পাশের উদ্বেগাকুল স্বজন প্রিয়জন কেউ তা বুঝতে পারবেনা। পলাশের মনে হল আজ সেই ঘোরকাল উপস্থিত। তা-না হলে জীবনের সব ঘটনা মনে পড়ছে কেন? ভাল কাজগুলো মনে করার চেষ্টা করছে সে। খুব একটা খারাপ মানুষ ছিল না পলাশ। জেনে বুঝে কারো ক্ষতি করেনি। সৎ চিন্তা করেছে, সৎ কর্ম করার চেষ্টা করেছে। কর্মজীবনে কখনো অসৎ হওয়ার কথা চিন্তা করেনি। ভুলভ্রান্তি যে করেনি তা নয়। তবে তা বিচ্ছিন্ন। কৈশোরে তাকে বন্ধুরা বোকা ভাবতো। নিজের প্রাপ্য সে কোনদিন চেয়ে নেয়নি। তবু কি সে শুদ্ধ মানুষ? কিশোরকালে এক দুর্বল মুহূর্তে জঘন্য কাজে জড়িয়ে পড়েছিল সে। সেই তার প্রথম পাপ। আজ মনে পড়ছে। কি বিশ্রী আর সাংঘাতিক ঘটনা। আজ একযোগে সব মনে পড়ছে কেন? তাহলে কি তার মৃত্যু আসন্ন? আজ কোথায় বেলা? কেমন আছে সে। দেশ থেকে এসেছে সেও ১২ বছর হল। যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করতে এসে বিয়ে করে এখানেই স্থায়ী হয়েছে সে। সোহানার সঙ্গে ৫ বছরের বিবাহিত জীবনে তারা এখনো সন্তানের মুখ দেখেনি। স্বামী স্ত্রী দু’জনই চাকুরীরত থাকলে একে অপরের প্রতি ভালবাসার আবেগ থাকেনা। বাস্তবতার কাছে হার মানে অবুঝ হৃদয়ের চাওয়া পাওয়া। চুক্তিবদ্ধ যান্ত্রিক জীবন তাদের। সন্তান নেই বলে সোহানার আফসোস নেই। কেরিয়ার নিয়ে ব্যস্ত সে। যদি বেলার সঙ্গে তার বিয়ে হত কেমন হত, ভেবে আজও রোমাঞ্চিত হয় পলাশ। কলেজে সবে ভর্তি হয়েছে সে। এরইমধ্যে বড়বোন পরীর বিয়ে উপলক্ষে বাড়ি আসতে হল তাকে। বেশ শীত পড়েছিল সেবার। গ্রামের বাড়িতে বিদ্যুত নেই, জেনারেটর চালিত আলোক সজ্জায় চারদিক তবু আলো জ্বলমল। কাল আসবে বরযাত্রী।

বহির্বাটীতে থেকে থেকে ব্যান্ডপার্টির বাদন, মাইকে বাজছে জনপ্রিয় গান। মধ্যরাতে পলাশ শীতে কাঁপছে। তার গায়ে জ্বর এসে গেছে। আনন্দ হৈচৈ রেখে ঘুমাতে গেল সে। লোকজনের ভিড় এড়াতে দক্ষিণের দোতলায় গিয়ে ওঠে পলাশ। মাটির ঘর, কাঠের সিঁড়ি আর পাটাতন। কাঠের মেঝেতে বিছানা পাতা। আবছায়া অন্ধকার ঠেলে শুয়ে পড়ল সে। আরও দু-তিনটে বাচ্চার পাশাপাশি লেপ গায়ে শুয়ে একটা মেয়ে, ঘুমঘোরে তাকে জিজ্ঞেস করে, “কে? মামা নাকি?” পলাশ বলে,”ও। বেলা, তুমি এখানে? আমার বোধ হয় জ্বর এল।”

“শুয়ে পড়।” বেলা একটু সরে তাকে শোওয়ার জায়গা করে দিল। ঠান্ডায় জ্বরের ঘোরে কখন বেলার লেপের নিচে চলে গেছে পলাশ। ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। হঠাৎ জেগে বুঝতে পারে সে পাশ ফিরে শোয়া বেলাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আছে। তার নাকে মুখে বেলার মাথার বেণীখোলা চুল। মিষ্টি একট গন্ধ পাচ্ছে। তার ডান হাতটি বেলার বুকের উপর। মুহূর্তে হাতের আঙ্গুলগুলো সক্রিয় হয়ে উঠে। আতিপাতি করে কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে তার হাত। বেলার পরনের কামিজের নিচে পলাশের হাতের উন্মাদনা। জ্বর নেই এখন। বেলা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। এক অদ্ভুত সুখ আর আনন্দের শিহরণ তার সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। ঘুমের মধ্যে নড়ে উঠে বেলার শরীর। “উঁহু উঁহুম” বলে তার বুকের উপর থেকে পলাশের হাত সরিয়ে দেয়। আবার ঘুমিয়ে পড়ে সে। হাত সরায়না পলাশ। সে বেলার সালোয়ারের ফিতা খুলে টেনে হাঁটুর নিচে নামিয়ে আনে। এবার ঘুমের ঘোরে বেলা তার দিকে ফিরে শোয়। আর তাকে জোরে চেপে ধরে পলাশ। সিঁড়ি বেয়ে উপরে কে যেন আসছে। কাঠের সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনে পলাশ বেলাকে ছেড়ে পাশ ফিরে ঘুমের ভান করে। বাইরের আলো ঘরের ভেতরের অন্ধকারকে ঘন হতে দেয়নি। অস্পষ্ট হলেও দেখা যায়। বেলার মায়ের কন্ঠ শোনে সে। “বেলা। এই বেলা। এখানে এভাবে শুয়ে আছিস যে। নিচে নেমে আয়। পরী তোকে ডাকছে।” বলতে বলতে বিছানার কাছে এসে দাঁড়ালেন তিনি।

“আহ। একটু ঘুমাব তার উপায় নেই।আসছি মা। তুমি যাও।” – বেলার কন্ঠ স্বাভাবিক। ঘুম জড়ানো নয়। “শিগগির আয়” বলে তিনি আবার নিচে নেমে গেলেন। পলাশের বুক থেকে ভয় আর লজ্জার একটা পাথর সরে যায়। কী ভয়াবহ কান্ড ঘটতে যাচ্ছিল। বেলা কি জেগেছিল? তাহলে তারও কি এসবে নীরব প্রশ্রয় ছিল? সংশয় কাটেনা পলাশের। চুপচাপ শুয়ে বেলার দিকে তাকিয়ে আছে সে। বেলা বিছানা থেকে উঠে সালোয়ারের ফিতায় গিট্টু দিল। কারো দিকে না তাকিয়ে তর তর করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল সে।

পরদিন বেলার সঙ্গে দেখা হলে চোখ তুলে তাকাতে পারেনি পলাশ। সেও সারাদিন দূরে দূরে থেকেছে। হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে তার আচরণে কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করেনি পলাশ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কী লজ্জা কী লজ্জা। এমন ভালমানুষের এই কান্ড। তাহলে সেকি একজন ভন্ড, প্রতারক। অনুশোচনা জাগে। বেলার শরীরের স্পর্শ মনে করে আবার অদ্ভুত আনন্দের সেই অনুভূতি তাকে উন্মন করে তুলে।

পরীকে বরের সঙ্গে পাল্কিতে তুলে দেয়ার সময় কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল দু’জন। না দেখার ভান করে চুরি করে পলাশ বারবার দেখছিল তাকে। বেলাকে জোছনা ঝরানো চাঁদের চেয়ে সুন্দর লাগছিল। একবার পলাশের ইচ্ছে করল তার কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নেয়। আবার ভাবে বেলা কিছুই জানেনা। তার ঘুমের মধ্যে হয়েছে সব। নিরন্তর সংশয় আর অনুশোচনা তাকে মুহূর্মুহূ বেদনা বিদ্ধ করছিল। যদি রাতের ঘটনা তার অজান্তে ঘটে থাকে, যদি তা তার বোধগম্যের মধ্যে না থাকত; কোন সর্বনাশের অতল অন্ধকারে পলাশ তাকে নিমজ্জিত করেছিল তা যদি কখনো সে না জানত, তাই যদি হত; পলাশ স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করে। তার বিকৃত রুচির অনিয়ন্ত্রিত বাসনা চরিতার্থের অশুভ প্রচেষ্টার কথা মনে করে অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হয়েছে সে। ভাবনার অন্তহীনতায় আবার হারিয়ে যায় পলাশ।এভাবে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ক্লান্তি এসে গেছে তার। জ্বরটা বোধ হয় ছাড়ল। ঘোর কাটতে শুরু করেছে। তার মানে মৃত্যুকাল দুয়ারে এসে ফিরে গেছে। উঠে বসল পলাশ। খুব ক্ষিধে পেয়েছে। টেবিল থেকে ভরা গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে সবটুকু পানি পান করল। দুর্বল শরীর এগুতে চায়না। তবু রান্না ঘরে গিয়ে ফ্রিজ থেকে প্রস্তুত করা স্যান্ডুইচ বের করে সে। ওভেনে গরম করে পুরোটা উদরস্থ করে। অনেকটা হাল্কা লাগছে। যম বেটা সুবিধা করতে পারেনি। নিজেই হেসে ফেলে সে। পরকাল দেখা হলনা তার, মাত্র দরজায় পা রেখেছিল। আর সঙ্গে সঙ্গে সব অতীত তার সামনে এসে দাঁড়াল। এখনো ছবির মত ভাসছে ফেলে আসা তার ভাল মন্দের জীবন। বেলার বিয়ের কথা উঠলে চঞ্চল হয়ে উঠেছিল তার মন। একদিন হঠাৎ করে উপস্থিত হল তাদের বাড়ি। তার মা নূরভানুকে বুবু বলে ডাকে সে। নূরভানু বাবার চাচাতো ভাইয়ের মেয়ে। কলেজের পড়াশোনা নিয়ে ঢাকায় ব্যস্ত থাকে পলাশ, গ্রামে আসার সুযোগ মেলে দীর্ঘ ছুটি পেলে। নূরভানু তাকে পেয়ে খুব খুশি হন। কি খেতে দেবেন, কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। পলাশ বেলার প্রসঙ্গ তোলে। “বুবু বেলা কই, দেখছিনা যে।” নূরভানু হেসে ফেলেন, “লজ্জা পেয়েছে। বিয়ের কথা হচ্ছে তো। তা তুই ঘরে যা না। নিজে গিয়ে দেখে আয়। লাজুক মেয়ে আমার।” বেলার ঘরে ঢুকে পলাশ। হাতের বইটা রেখে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে শান্ত কন্ঠে বেলা শুধায়,”কেমন আছ মামা।”

“এ বিয়ে ভেঙ্গে দিতে বল বেলা” কোন ভনিতা না করে কথাটা সরাসরি বলে ফেলে পলাশ। অনেকদিন পর বেলা এই প্রথম তার দিকে চোখ তুলে তাকায়। এক অদ্ভুত নির্মমতা তার চোখে। ফোঁস করে বলে উঠে, “কেন? তোমার কি সমস্যা।” এরকম উত্তর আশা করেনি পলাশ। মাথা নত করে বলে, ” না। সমস্যা থাকবে কেন। আমি মনে করেছিলাম তোমার মত নেই।”

“সবকিছু তোমার মত ভাব কেন মামা? মমতাকে তুমি কি বলেছ? কি সব বল,তার মানে বোঝ?”

“কি বলেছি?”

“সে তুমি জান। আমি ভাবতে পারিনি। সত্যি করে বলতো, আমি কখনো সেরকম তোমাকে কিছু বলেছি? তুমি আমার মামা।”

“ঠিক আছে আর কখনো হবেনা। তুমি নিশ্চিত থাকো।” পলাশ ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে অস্ফুটে বলে,”তুমি যদি ভুলে যেতে পার, আমি পারবনা কেন?”

“ভুলে যাওয়াই মঙ্গল। যা অসুন্দর, অশুভ,যা অনুচিত তা ভেবে কেন কষ্ট পাবে পলাশমামা।” বেলার কন্ঠ স্তিমিত হয়ে আসে।

“হয়েছে হয়েছে, আর বলতে হবেনা।” বলতে বলতে বেরিয়ে যায় পলাশ। তার পেছনে ছুটে গিয়ে নূরভানু ডাকেন,”পলাশ। বস ভাই। তোদের আবার কি হল। বুঝিনা বাবা। আমি নারকেল নাড়ু নিয়ে এলাম। খেয়ে যা ভাই।”

পলাশ দ্রুত বাড়ি চলে আসে। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন নূরভানু।

সেদিন কেমন বেপরোয়া হয়ে পড়েছিল পলাশ। মায়মুনা তার ছোট খালা। অসচ্ছল ঘরে বিয়ে হয়েছিল তার। তাদের বাড়ির পাশে খালাদের ছনের ঘর। সামান্য জমি। তার উপর খালু প্রায়ই অসুস্থ থাকেন। পলাশদের বাড়িতেই বেশিরভাগ সময় থাকেন মায়মুনা। সত্যি বলতে পলাশ আর পরী তার পরিচর্যাতেই বড় হয়েছে। তাদের বড় সংসারে মায়ের পাশে থেকে প্রায় সব কাজ করেন তিনি। পলাশ তার কাছে গিয়ে বলে, “একটা কথা বলি মুনা খালা। বেলাকে তোমার কেমন লাগে?” মায়মূনার পান খাওয়ার অভ্যাশ। পান সুপারি আর খয়েরের রসে সবসময় তার ঠোঁট লাল হয়ে থাকে। মাটির ঘরের জানালা দিয়ে পিচ করে পিক ফেলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, “কেন?”

“খালা। তুমি সাহায্য কর। বেলাকে আমি বিয়ে করতে চাই।” পলাশের কথা শুনে চমকে উঠেন তিনি। অনুচ্চ কন্ঠে বলেন, “যা বলছিস, বাজান, আর কখনো মুখে আনবিনা। তোর কি মাথা খারাপ হল। এও কি কখনো হয়। অই বেশরম, বেলা না তোর ভাগ্নী হয়।”

“আপন ভাগ্নি ত আর না।” যুক্তি দেখায় পলাশ। “চুপ। কত সম্মানী ঘরের ছেলে তুই। লোকে বলবে কি? কেউ মেনে নেবেনা। তোর মা শুনলে গলায় দড়ি দেবে। বাবা তোকে কেটে টুকরা টুকরা করবে।” মুনাখালার ধমকের মুখে আর কোনদিন এসব তার মাথায় আনেনি পলাশ। শুধু মাঝে মধ্যে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠেছে। বেলার নির্লিপ্ততা তাকে আরও বেশি দূরে ঠেলে দিয়েছে।

মাথা ঘুরছে তার। দু’হাতে কপাল চেপে ধরে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। আবার শুয়ে পড়ে পলাশ।

সোহানার ফোন আসে। মাথার কাছে মোবাইলটা হাতে তুলে নেয়, বল।

এখন জ্বর কেমন?

নেই।

কিছু খেয়েছ?

খেয়েছি।

টেবিলে ফ্রুটস রাখা আছে। আপেল, চেরি, আঙ্গুর। ক্র্যানবেরিও আছে। তুমি আপেল আর ক্র্যানবেরি খেতে পার। হেলদি ফ্রুটস।

আচ্ছা।

কথোপকথন শেষ হলে পলাশ চোখ বন্ধ করে। কত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে প্রাণঘাতী এই করোনা। আমেরিকাতেই মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। মৃত্যু কত কাছে। নিজের ঘাড়ের চেয়েও কাছে। নিশ্বাসে বিশ্বাস নেই। নিশ্বাসই প্রাণ। বন্ধ হয়ে গেলে অপ্রাণ দেহ মূল্যহীন। জীবন কত ছোট। অথচ এই ছোট জীবনেই কতো ঘটনা ঘটে। অম্লমধুর স্মৃতিময়। আনন্দ বেদনা আর বঞ্চনার সব স্মৃতি। মৃত্যুর মাধ্যমেই ঘটনাবহুল জীবনের সমাপ্তি। মরার পর আত্মাকে আবার জাগ্রত করা হয়। তার পরপরই কি মানুষের পাপপুণ্যের হিসাব শুরু হয়ে যায়? পাপাচারীরা কি মুক্তি পাবেনা? জীবন বড় জটিল। লোভ,লালসা আর প্রবৃত্তির নিয়ন্ত্রণহীনতা মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলে। অনিবার্য হয়ে উঠে এই ভ্রান্তির ঘোর। অনিচ্ছাতেও কখন অনৈতিক কাজে সেই থেকে জড়িয়ে পড়ে নিজেও জানেনা। পলাশ ভাবতে চেষ্টা করে। ভ্রান্তি, অন্যায় আর পাপ মানুষের কর্মের মধ্যেই নিহিত। জীবন তো ভুলে ভরা। প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গানটা মনে পড়ে তার, “জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা সে ভুল, ভুল,সবই ভুল।”

ভুলের হিসেবের খাতার পাতা খুলে বসে পলাশ। যৌবনের দূরন্ত দিনগুলোতে শুদ্ধতা তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। সমবয়সী বন্ধুরা জীবনকে উপভোগ করার নেশায় যখন যা খুশি তাই করছে। কঠোর ব্রতের অনুশীলনে নিজেকে আলাদা করে রাখতে পেরে মনের জোর খুঁজে পেয়েছে সে। নেয়ামত মামাকে গ্রামের মানুষ পীরের মত শ্রদ্ধা করতেন। স্বল্প শিক্ষিত হলেও প্রভূত জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন তিনি। অসাধারণ সম্মোহনী ক্ষমতা ছিল তার। পলাশকে খুব স্নেহ করতেন। ডেকে বলতেন,”বাবা। তুমি খুব ভাল ছেলে। কোন অন্যায় তোমার মধ্যে নাই। তুমি তোমার মত থাক। শান্তি পাবা।”

নিজের ভালত্বের এই তমকার কারণে বেলাকে নিয়ে বেশি দূর এগোয়নি পলাশ। তারপরও শয়তান তাকে প্ররোচিত করেনি এমন তো নয়। তার জীবনেও কিছু অনিবার্য গোপন আছে যা অনুচ্চারণীয়। কিছু দুর্বলতা আছে অসংগত হলেও তা ছিল প্রাসঙ্গিক, নিরুপায় সময়ের কাছে অনিবার্য অসহায় আত্মসমর্পণ মাত্র। অপ্রতিরোধ্য যাত্রার অন্ধকারের সেই পথ থেকে ফেরার প্রাচীর ছিল অনতিক্রম্য। সেই না পারার যন্ত্রণা তাকে আজ আর সংশয়াকুল করেনা, নিরন্তর গ্লানিতে নিমজ্জিত করেনা। ধর্মবেত্তারাও এইসব পাপমুক্তির ছাড়পত্র পাওয়ার পথ বাৎলে দিয়ে গেছেন। মানুষের সত্যিকার পাপ হল তা, যার জন্য তার বিবেক তাকে ক্ষমা করতে পারেনা। মানুষের আত্মোপলব্ধির মধ্যেই ঈশ্বর তার মুক্তির রহস্য উদঘাটন করে রেখেছেন। এইসব বিষয় পলাশকে সংশয়াকুল করে, মনস্তাত্ত্বিক কষ্ট দেয়।

মাঝে মধ্যে নিজেকে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধী মনে হয়। মানুষ ভেতরে ভেতরে কতটা স্বার্থপর,কতটা ভন্ড তার স্বরূপ উন্মোচিত হলে বোঝা যেত। তাহলে শুদ্ধতম কে? কতটা খাঁটি হলে তাকে সর্বজনীন শুদ্ধ মানুষ বলা যায়? বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন কালে তার ঘনিষ্ঠ সহপাঠীরা তাকে শুদ্ধতম ছেলে বলে পরিহাস করত। কিছু ভাল কাজ তো সে করেছে। নিশ্চয়ই মৃত্যুর পর মহান আল্লাহ কর্তৃক তা মূল্যায়িত হবে। নীরার কথা মনে পড়ে তার। এই মেয়েটির সঙ্গে প্রেমে জড়িয়ে পড়েছিল সে। বন্ধুরা জানত, তারা সব সময় তাদের প্রেমে সহযোগিতা করেছে। পলাশ নিজের অদম্য এক সর্বনাশের ভাবনা থেকে বাঁচতে চেয়েছে। নীরা ছিল তার অবলম্বন। তাকে কতটা ভালবেসেছিল তা জানেনা পলাশ। নীরার সঙ্গ ভাল লাগত, তার পরিণতি কি তা কখনো ভাবেনি। পথ হারানো মানুষকে পথে নামালেও আবার সে বেপথু হয়। নীরার প্রেম ছিল আগ্রাসী, উগ্র, ভোগের নেশায় উন্মত্ত। অনেকবার ক্লাস পালিয়ে তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এসে তিন চারঘন্টা সময় কাটাত। এভাবে ঘোরাঘুরি করার মত ইচ্ছে এবং অর্থ কোনটাই পর্যাপ্ত ছিলনা পলাশের। মনে পড়ে একদিন দিনশেষে বাসায় ফেরার পথে নীরা তাকে বলেছিল, “একটা মেয়ে নিজেকে উজার করে দেবার জন্য প্রতিদিন তোমার কাছে ছুটে আসে, তুমি তাকে একদিন একটু ছুঁয়েও দেখলেনা। কেমন পুরুষ তুমি। আমি কি শুধু দু’টাকার বাদাম চিবুতে পার্কে আসি?” পলাশ বিষ্ময় নিয়ে কেবল তার দিকে নিষ্পলক তাকিয়েছিল। নীরার সম্পর্কটা দীর্ঘায়ত হয়নি। বিদেশ ফেরত ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে যায়। এজন্য পলাশের মনে কোন দুঃখের জন্ম হয়নি, কোন প্রতিক্রিয়া অনুভব করেনি সে।

নিজেকে সংশয়বাদী ভাবে পলাশ। স্থির কোন বিশ্বাস তারমধ্যে স্থায়ী কোন বোধের সৃষ্টি করতে পারেনা। তবে ধর্ম এবং তার বিধানের প্রতি অসংশয় বিশ্বাসী সে। সেও ধর্ম নিয়ে কখনো যুক্তি তর্কে যায়নি। এর গূঢ় তত্ত্ব বিশ্লেষণের চেষ্টা করার নাম বাড়াবাড়ি। সত্য মিথ্যা অনুসন্ধান কিংবা যাচাইয়ের কোন ইচ্ছা তার মনে কখনো ঠাঁই দেয়নি। ধর্মীয় অনুশাসন নিয়ে কোন প্রশ্ন তুলতে নেই, প্রবলভাবে এই সত্য সে শিরোধার্য ভেবেছে। নিশ্চয়ই পরকালে ভালমন্দের হিসাব নেয়া হবে। অন্যায়ের শাস্তি অবধারিত যদি সে স্রষ্টার নিকট থেকে ক্ষমাপ্রাপ্ত না হয়। আবৃত্তির মত উচ্চারণ করে,”আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন, তুহিব্বুল ওয়া আফওয়া ফাহ ফুয়ান্নি।” তার হৃদয়ে গাঁথা আছে এই প্রার্থনা যার অর্থ “হে আল্লাহ, আপনি মহানুভব ক্ষমাশীল। আপনি ক্ষমা করা পছন্দ করেন। অতএব আপনি আমাকে ক্ষমা করুন।”

অদৃশ্য প্রতিপালকের প্রতি ধ্যানে নিবিষ্ট হয় পলাশ। নিশ্চয়ই তিনি তাকে ক্ষমা করবেন। সব অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা চাইবে সে। যৌবনের বাঁধন হারা দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীদের সঙ্গে স্মৃতি সুখের দুরন্ত দিনগুলোতে কখনো কখনো নিভৃত বিচ্যুতির কথা পীড়া দেয় তাকে। এসবের অস্বীকৃতি মানে বিধাতার সামনে মিথ্যাচার করা। বন্ধুরা বুঝতে না পারলেও নিজের বিবেককে তো আর ফাঁকি দিতে পারবেনা সে। তার কাছে সব দৃশ্যমান। তিনি প্রত্যক্ষ করেন সকল কিছু। অতীত – বর্তমান – ভবিষ্যত, যা গোচর তা,যা অগোচর তাও। জানা অজানা, বোধের অতীত সব তিনি পর্যবেক্ষণ করেন।

তিনি আসমানজমিনের মালিক, যিনি সৃষ্টি করছেন অরণ্যবন, নদী,পাহাড় ও সমুদ্র, সৃষ্টি করেছেন মানুষসহ সকল প্রাণী। তার কাছে কি করে লুকাবে সে সকল গোপন,সকল পাপ। সবাই তাকে চরিত্রবান বলে, সৎ বলে। কতটুকু সৎ সে,আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে নিজেকে প্রশ্ন করে সে, সেকি নিজের লালসাকে প্রশ্রয় দেয়নি? অবশ্যই দিয়েছে। তারজন্য আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে আল্লাহর কাছে তওবা করতে হবে। অনন্তকালের জীবনে মুক্তির জন্য তা অপরিহার্য।

ইংলিশ রোডের আউট অব বাউন্ডে পরিচয় হয়েছিল সখিনামাসীর সঙ্গে। তিনি ছিলেন এর সর্দারণী। কবি সুমিত আর সাংবাদিক বন্ধু সরোজ সেখানে নিয়ে গিয়েছিল তাকে। উদ্দেশ্য নিষিদ্ধ জগতের অসহায় রমণীদের জীবনমান নিয়ে গবেষণার জন্য একটা জরীপে অংশ নেয়া। মুদ্রিত ফরমে ওদের থেকে ২০টা প্রশ্নের উত্তর নিতে হবে। তার হাতে কয়েকটি ফরম দেয়া হল। সখিনা তার গাল টিপে বললেন,”এই নাবালককে দিয়ে কিছু হবেনা। শুধু সময় নষ্ট করবে।” সুমিত তার জবাবে বলে, “না সখিনা মাসী। পলাশ কবিতা লেখে। তার কাছে জীবনের বোধটা একটু আলাদা।” মনে হল মাসী কবিতা বোঝেন।

ঘরে আর কেউ নেই। সুমিত আর সরোজ ভেতরের দিকে চলে গেছে। দুপাশে ছোট ছোট খুপড়ি ঘর,তার মাঝখান দিয়ে করিডোর, চলাচলের পথ। ঘরের সামনে দৃষ্টিকটু রকমের উৎকট আর শিথিল পোশাক, ঠোঁটে চকচকে লিপস্টিকের গাঢ় রং, জীর্ণ দেহের মেয়েরা তাকে ইশারায় আহবান জানায়। চোখ টিপে। তাদের স্থূল আহবান পলাশকে আহত করল। সখিনা বললেন,”দু’মুঠো খাবারের জন্য এরা শরীর বেচে। পাশের ঘরটা খালি। যাকে খুশি নিয়ে যাও।” একটা দীর্ঘদেহের সদ্য যৌবনা তার হাত ধরে টেনে বলে, আসেন বাবু। আমার সাথে আসেন। কি আলাপ করতে চান করবেন। আগে তো একটু আরাম করে নেন।” সখিনা শিখিয়ে দেয়, “মল্লিকা। নতুন মানুষ। দেখে শুনে যত্ন করিস।” যন্ত্রচালিতের মত মেয়েটার সঙ্গে তার কক্ষে প্রবেশ করে পলাশ। সমস্ত ঘর জুড়ে একটা সিঙ্গেল খাট পাতা রয়েছে। তার উপর আধোয়া মলিন স্বল্পমূল্যের চাদরে লিপস্টিকের দাগ লেগে আছে। পলাশকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে দিয়ে দরোজার পর্দা টেনে দেয় মল্লিকা। পর্দাই এই কক্ষের দরোজা। যেটুকু কাপড় তার দেহে ছিল তাও খুলে পাশে এসে বসে। বলে, “শরীর টিপে দেব?” পলাশ উঠে বসে। জিজ্ঞেস করে,”তুমি মল্লিকা?”

“হ্যাঁ। তবে তুমি নতুন নাম দিতে পার। কবিরা এসেই আমাকে একটা নাম দেয়। সুমিতদাদা এই নামটা দিয়েছেন। আমার আসল নাম কেউ জানেনা।”

“সুমিতদা বুঝি প্রায় আসেন?”

‘তা আসেন। একা না। বড়ো বড়ো নামী মানুষকে নিয়ে আসেন।”

“তারা কেন আসেন?’

“এই তুমি যে জন্য এসেছ।”

“আমি কি জন্য এসেছি তুমি জান?”

“জানি। প্রথম প্রথম সবাই সাধু হয়ে আসে। তারপর একসময় পুরোনো আর রেগুলারদেরও ছাড়িয়ে যায়। ভন্ড। টাকা না দেয়ার বাহানা।”

“মল্লিকা। বিশ্বাস কর আমার সাথে টাকা নেই।”

চমকে উঠে মল্লিকা। “কি কইলা। টাকা নাই ত আইলা ক্যান। আমার শইল্যের কোন মুল্য নাই।” খিঁচিয়ে উঠে সে। এতক্ষণ শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছিল। ক্রোধ তার ভদ্রতা আর ভাষার মাধুর্যটুকু কেড়ে নিয়েছে। পলাশ হতবাক হয়ে পড়ে। তার মাথায় টোকা দিয়ে মল্লিকা আবার বলে, “তুমি না হইলে আমি অন্য আর কেউকে নিতাম। শরীর বেইচ্চা খাই। আইজ কোন কাম পাইনাই। যতসব হিজরা আর ভঙ্গ ( অশালীন শব্দ) সামনে আসে।” কানে আঙুল দেয় পলাশ। বলে, “মল্লিকা। তোমার মজুরি আমি দিয়ে দেব। সুমিতদাকে বলে টাকা ম্যানেজ করে দিচ্ছি।”

“দাঁড়াও তোমার মানিব্যাগ চেক করবো আমি। টাকা ছাড়া কেউ ঢাকায় চলে নাকি” পলাশের প্যান্টের পেছনের পকেটে হাত দেয় মল্লিকা। মানিব্যাগে গুনে ১৪ টাকা পায় সে। বলে, “ফকির। তুমি দেখছি আমার চাইতে গরীব।”

মানিব্যাগে রাখা কয়েকটি ভিজিটিং কার্ডের সাথে একটা ছবি বেরিয়ে আসে। মল্লিকা সেটা তুলে আনে। বলে, “ওমা। তুমি এই মাইয়ার জন্য সাধু সাইজা বইসা আছ। খাড়াও তোমার সাধুগিরি ছুটাইয়া দেই।” নীরার পাসপোর্ট সাইজ ছবিটা পলাশের মুখের উপর ছুঁড়ে মারে। তার হাত ধরে টেনে বলে, “আহো, শোও আমার সঙ্গে। টাকা নিমুনা। টাকা বহুত কামাই করি। প্রেমিক পাইনা। কি হইল শোও।” মানিব্যাগটা পকেটে পুরে ঘর থেকে তৎক্ষণাত বেরিয়ে আসে পলাশ। সখিনামাসী তাকে দেখে সোৎসাহে বলে,”ভাগিনা। সাক্ষাৎকার নিলা।”

পলাশ তাকে পাল্টা প্রশ্ন করে,”মাসী। সুমিতদা কই?”

সেদিন সুমিত তাকে আউট অব বাউন্ডে যাওয়ার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেছিল। স্বার্থ চরিতার্থ করতে মানুষ কতরকম বাহানা ধরে, কত ধরনের শঠতার আশ্রয় নেয় তা কিঞ্চিৎ হলেও সকলে তা বুঝতে সক্ষম। তারপরও দিনের পর দিন মানুষের হাস্যকর, অযৌক্তিক এবং অপ্রয়োজনীয় অভিনয় চলে। এই ভন্ডামী নিজের মধ্যেও প্রত্যক্ষ করেছে পলাশ। কখন অবচেতন মনে সেও এই অভিনয়ে জড়িয়েছে। কোন জিনিস ভাল না লাগলে নির্বিকারে ভালো বলতে হয়। এটাই সৌজন্যের শিক্ষা, এটাই ভদ্রতার মহিমা। সোহানার সঙ্গে অনেক বিষয়ে মতের অনৈক্য বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায়। তবু সমঝোতা করতে হয়। সোহানাও করে। এটাই সম্পর্ক রক্ষার সর্বোত্তম উপায়। বুদ্ধিমানেরা অর্থহীন তর্কে জয়ী হওয়ার চেয়ে প্রতিপক্ষের জেদের কাছে হার মানার আনন্দ খুঁজে। অসার বিজয়ের চেয়ে ত্যাগের পরাজয় উত্তম। এতে অনৈতিকতার প্রশ্ন আসেনা। তবে সমঝোতার মধ্যে মিথ্যাচার কখনো কখনো উভয়ের জন্য উল্টো ফল নিয়ে আসতে পারে। মিথ্যাই ভন্ডদের বড় অস্ত্র। সুমিতকে পলাশ ভাল করে চেনে। অন্যসব দিক দিয়ে সে সৎ, সত্যবাদী, পরোপকারী, নিরহংকারী। তার মানবিক গুণাবলি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কতদিন না খেয়ে তার নিজের টিফিনের টাকা দিয়ে দরিদ্র বন্ধুদের খাইয়েছে সে। পলাশকে ঢাকা শহরের অলিগলি চিনিয়েছে। নিজের বাসায় রেখে তাকে হলে থাকার খরচ বাঁচিয়ে দিয়েছে। কখনো হাত খরচার টাকা দিয়ে বলেছে, তোমার কাছ থেকে নোট নিয়ে পড়ি। আমার স্বার্থে আমাদের বাসায় রাখি তোমাকে। মনে করনা ফ্রীতে থাক, খাও। এই টাকা কয়টা রাখ। বিকেলে দোকানে একটু বসো।” তাদের ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ছিল। সেখানে সুযোগ পেলে পলাশকে নিয়ে বসতো। মিছেমিছি কাজে লাগাত। ঘন্টা খানেক কর্মচারীদের সঙ্গে থেকে কাজ করে ফিরে আসতো তারা। পলাশের বুঝতে অসুবিধা হতনা এটা তাকে বোঝানো যে তাদের বাসায় সে অনাহূত নয়। সুমিতদের প্রয়োজনে তাকে এখানে থাকতে হয়। অথচ এই সুমিতের একটা খারাপ দিক আছে। একাধিক মেয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়েছে। এছাড়াও আজেবাজে জায়গায় যাতায়াতে অভ্যস্ত সে। ঘরে তার বউ বাচ্চা আছে। এসবের তোয়াক্কা না করে সে মদ্যপ বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয়। মাঝরাতে মাতাল হয়ে বাসায় ফেরে। পলাশকে কখনো সঙ্গে নিয়ে গিয়ে কোথাও কোন স্টলে বসিয়ে রাখে। বলে, “তুমি তো শুদ্ধতম। আমার সব জানতে চেয়োনা।” তার বন্ধুরা পলাশকে দেখে সুমিতকে বলত, “ফাউটারে নিয়া ঘুরস ক্যান। একটা বকধার্মিক। পয়সা নাই তাই সাধু।” সুমিত উত্তরে বলত,”তোদের মদের খরচ আমি জোটাই। ভাবিস ক্যান ওরটা জোটাতে পারবনা। আসলে আমি ওকে আমাদের মত নষ্ট হতে দিতে চাইনা।”

পাশের ঘরে মদ আর নারীর জলসা। চুড়ির টুংটাং, হাসির শব্দ আর উৎকট গন্ধ; কি হচ্ছে বুঝতে অসুবিধা হয়না পলাশের। চুপ করে খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছিল সে। হঠাৎ করে সুমিতের মাতাল সঙ্গী দরজা ঠেলে তার ঘরে ঢোকে। হাতে মদের বোতল। বলে,”তুমি নাকি শুদ্ধতম। তবে এখানে কি করছ। এটা তো জাহান্নাম। একবার ঢুকলে তাকে আগুনে পুড়তে হয়। আসো, আমাদের সঙ্গে আসো। জাহান্নাম থেকে বেরোনোর উপায় নাই, দেখইনা একবার, বলতে বলতে তাকে ভেতরের ঘরে টেনে নিয়ে যায়। চারজন গোল হয়ে বসে মদ গিলছে। দুটি মেয়ে গ্লাসে ঢেলে দিচ্ছে। পলাশকে দেখে সংক্ষিপ্ত পোশাকের লম্বাটে মেয়েটা এগিয়ে এসে তার গলা জড়িয়ে ধরে। তার মুখে মুখ ঘষে। বিশ্রী গন্ধের ঝাঁঝে মুখ সরিয়ে নেয় পলাশ। সুমিত বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

ওরা বিছানায় বসাল পলাশকে। গ্লাসে লাল পানীয় ঢেলে মেয়েটা তার মুখে তুলে দেয়। এক চুমুক খেয়ে ফেলে সে। দুর্গন্ধ আর বিস্বাদ। মুখ বিকৃত করে পলাশ। গলার ভেতরটা পুড়ে যেতে থাকে। সুমিত আবার ঘরে প্রবেশ করেই চিৎকার করে উঠে, কি হচ্ছে এসব। এই পলাশ। ওঠ। বাসায় যাবি। তাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে সুমিত রিকশা ডাকে।

বলে, “দুঃখিত পলাশ। আমি ভেবেছিলাম নিজেকে তুমি রক্ষা করতে পারবে।” মাথা নত করে আছে সে। সুমিত জিজ্ঞেস করে, “মেয়ে মানুষের ছোঁয়া কি প্রথম? নীরার সঙ্গে কিছু ঘটেনি?”

পলাশ মুখ খোলে, “নীরা ওরকম মেয়ে না।”

“তাকে তুমি ভালবাস। এসব হতেই পারে। আর তুমি না চাইলে হবেনা। মেয়েরা কখনো নিজে থেকে কিছু বলবেনা।”

রাতে বাসায় ফিরেও আর কোন কথা হয়নি তাদের মধ্যে। খালি বাসা। তার স্ত্রী গ্রামে গিয়েছেন, বাপের বাড়ি। কাজের মেয়েটা রান্না করে বাসায় ফিরে গেছে। খাবার ঠান্ডা হয়ে গেছে। সুমিত কিছু মুখে দিলনা। পলাশের খুব ক্ষিধে পেয়েছে। ঠান্ডা ভাত তরকারী খেল সে। সুমিত বলল,”কাল সকাল সকাল উঠো। তরগাঁ যাব।” তরগাঁ মানে সুমিতের শ্বশুরবাড়ি।

কিন্তু সে কাহিনি মনে করতে চায়না পলাশ। এমন ঘটনা ঘটতে পারে ভাবতেও পারেনি সে।

ঘোরকালের ঘোরলাগা সময়। টলছে সে। সুমিতের শশুরবাড়িতে তার স্ত্রীর সঙ্গে অসংলগ্ন কি ঘটেছিল মনে করতে চাইল পলাশ। শুধু মনে পড়ছে সুন্দরী মহিলা তার গলা জড়িয়ে ধরে তার মুখে ঠোঁটে অবিশ্রাম চুমু খাচ্ছে। রাত না দিন বুঝতে পারছেনা সে। বারবার দুচোখ বন্ধ হয়ে আসছে। বমি আসছে। ওয়াসরুমে যেতে হবে। বিছানা থেকে উঠতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হল পলাশ। কাত হয়ে বমি করল।

মানুষের কোলাহল কানে আসছে। নদীর পাড়ে চলে এসেছে সে। কারা যেন মরা পোড়াচ্ছে। করোনার ছোবলে এত এত মানুষ মরছে যে দাহ কিংবা কবর ছাড়াই নির্জন জায়গায় মরা ফেলে আসছে। পাশের খাটে শুয়ে আছে রোগী। এটা তো হাসপাতাল। পলাশ বিছানায় উঠে বসে।

কিছু লোক ঘিরে ধরেছে পলাশকে। এ কোথায় এসে পড়েছে সে। অচেনা স্থান,লোকগুলোকেও চিনতে পারছেনা। তাদের একজন রাসকোলোনিকভ। চেনা চেনা লাগছে। বিমর্ষ বেচারা। টলছে। মাতাল। কোথায় যেন দেখেছে তাকে। খুন করে অনুশোচনার শাস্তি পাওয়া মানুষটা কবরে এসেও শান্তি পেলনা। কী অদ্ভুত। এ তো পরলোক। আরও কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তির সাক্ষাৎ লাভের সুযোগ হল পলাশের। রাসকোলোনিকভ এগিয়ে এসেফিউদর দস্তয়েভস্কি’র সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। মুখ ভর্তি তার দাড়ি গোঁফ। রাসকোলোনিকভ বলল, আমার সৃষ্টিকর্তা। কালো চুরুটে দীর্ঘ দম নিয়ে মুখ দিয়ে সাদা ধোঁয়া ছেড়ে চলেছেন তিনি। পলাশ ভাবে, এটা তো আমেরিকা। ওরা রাশিয়া থেকে এখানে এল কি করে। এখানে ও’হেনরী আর আর্নেস্ট হ্যামিংওয়েদের থাকার কথা।

মৃত মানুষের নিজের কোন দেশ থাকেনা। পৃথিবীর সর্বত্র ঘুরে বেড়াতে পারে। হতে পারে তা স্বর্গ কিংবা নরক। মৃতলোক কোন সীমিত সীমানায় নির্দিষ্ট নয়। এর বাসিন্দাদের পাসপোর্ট ভিসা লাগেনা।

কী সব হচ্ছে। নির্বোধের মত কী ভাবছে সে। অসুস্থতা তাকে আবোল তাবোল ভাবাচ্ছে। মাঝে মাঝে পলাশের ঘোর কাটে। মৃত্যু ভয় জাগে। মরণ আর জীবনের সন্ধিক্ষণে তার অবস্থান। ব্যথায় ভরা সমস্ত শরীর। সর্বাঙ্গে বিষ ছড়িয়ে গেছে। চারদিকে শুধু রোগী আর মৃত্যু। স্বজনহারা মানুষের আর্তনাদ। কেউ একজন বলল, প্লেগে পুরো গ্রামের মানুষ মরছে। শিশু জোয়ান বৃদ্ধের মরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দাহ করার লোক আর সরঞ্জাম নেই। এটা একটা হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম। দৃশ্যটাও প্রায় একশো বছর আগের। ওখানে অধোবদনে বসে আছে শীর্ণকায় এক যুবতী। শোকে বেদনায় জীর্ণ দীর্ণ সে। বিভক্ত রমনী অচলা। পাশে মুমূর্ষু লোকটা কে? সুরেশ না? হ্যাঁ। পলাশ ঠিক চিনতে পেরেছে ওদের। ওই যে মহিমের হাত ধরে সুরেশ কথা বলছে। কী দৃঢ় অথচ শান্ত তার কন্ঠস্বর। অচলাকে পাওয়ার জন্য কি না করেছে সে। প্রিয় বন্ধুর ঘর ভেঙেছে। লোভ আর প্রতারণার ফাঁদে ফেলে অচলাকে নষ্ট জীবনের অধিকারীকরেছে। মহিমকে বলছে, অচলা তোমাকে কতটা ভালবাসত সে তুমি বোঝনিহয়ত, অচলা নিজেও তা বুঝতে পারেনি।

হায় অচলা! কর্মের চেয়েও ভাগ্য তাকে বেশি বিড়ম্বিত করেছে। মুখভরে বমি আসছে পলাশের। বালিশ থেকে মাথা তুলতে পারছেনা। চিৎ হয়ে শোওয়া সে নিজের বুকের উপর বমি করল। ধবধবে সাদা দুটো হাতে দু’গাছি সোনার বালা, তার কপাল স্পর্শ করল। আনত চোখে মুখে সকরুণ দৃষ্টি। নববধূর সাজে বেলা এসেছে।

বেলা। আমি তোমাকে ভালবাসি। খুব। গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না পলাশের। প্রাণপণে চিৎকার করে ডাকে সে,বেলা। বেলা নির্বিকার। হয়তো তার কোন কথা শুনতে পাচ্ছে না। পলাশ দু’হাত বাড়িয়ে দিতে চাইল। প্রসারিত হচ্ছেনা তার হাত। তাহলে সে কি মৃত। কোনদিন দেখবেনা আর পৃথিবীর মুখ। স্বজন, প্রিয়জনদের কাউকে দেখবেনা সে। সমস্ত শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। পলাশ আবারও সজোরে চিৎকার করে,আমি মরিনি।

ডাক্তার এসে একটা ইনজেকশন পুশ করলেন। বললেন, খুব ক্রিটিকাল অবস্থা যাচ্ছে এখন। আজকের রাতটা পার করতে পারবে কিনা সন্দেহ।

হো হো করে কেঁদে ওঠে সোহানা। বলে, না না না। আমি তোমাকে যেতে দেবনা পলাশ।

পলাশের জ্ঞান ফিরে আসে। স্পষ্ট,টনটনে, পরিপূর্ণ চেতনা ফিরে পেয়েছে সে। বুঝতে পারল তাকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। এতক্ষণ সে ঘোরকাল পার করেছে। ঘোরের বশে পরকাল পরিদর্শন করেছে সে। পরম স্নেহে পলাশ সোহানার একটা হাত বুকে টেনে নেয়। বলে,শান্ত হও। জীবন খুব ছোট। আমাকে মাফ করে দিয়ো। আমি তোমাকে কিছুই দিতে পারিনি। তারা দু’জন দু’জনের চোখের দিকে তাকাল। পলক পড়েনা। যেন এটাই তাদের প্রথম দৃষ্টি বিনিময়। ভালবাসা জাগে। সোহানা এখন কোন নারী নয়, পৃথিবী। ধরিত্রীর সব সৌন্দর্য এসে ভর করেছে তারমধ্যে, অপরূপ করে তুলেছে তাকে। সোহানার কোলে পলাশের মাথা। দু’জন দু’জনকে দেখছে। অন্তহীন।



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *