short-story-ghungur

ঘুঙুর
দীপু মাহমুদ

 

৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, শুক্রবার।

 

সকাল। রিনা কাঁচাবাজারে সবজির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সবজির দোকানে প্রচন্ড ভিড়। জিনিসপত্রের দাম মানুষের কেনার সামর্থের বাইরে চলে গেছে। এক পিস লেবুর দাম ২০ টাকা। বেগুনের দাম কমেছে। এক কেজি বেগুন ৬০ টাকা। রোজা আসছে। জিনিসপত্রের দাম আবার বাড়বে। মানুষজন দম বন্ধ করে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।

ওপাশে ফুলকপি সাজানো। এখন বাজারে সাদা ফুলকপির সঙ্গে হলুদ আর পার্পেল কালারের ফুলকপি পাওয়া যায়। রিনা সেদিকে তাকিয়ে শুক্রবার সকালে বাজারে আসার বিরক্তি খানিকটা ভুলে গেল। জিনিসের দাম একটু বেশি নিলেও শুক্রবারে টাটকা শাকসবজি, মাছ-মাংস পাওয়া যায়। প্রচন্ড ভিড় হয় বলে শুক্রবারে বাজারে আসতে চায় না। বাজারে না এলে চলবে কীভাবে!

সবজিওয়ালা খেয়াল করেছেন। তিনি গলা বাড়িয়ে সঙ্গের ছেলেটাকে বললেন, সাইদুল, আপার হাত থিকে বাজারের ব্যাগ নে, আর কী কী লাগবে দে।

সাইদুল নামের ছেলেটা ভীষণ ব্যস্ত তখন তরকারি গুছিয়ে দিতে। রিনার দিকে তাকিয়ে হাসল। হাত বাড়িয়ে বাজারের ব্যাগ নিয়ে বলল, আপা, শিম, শশা, বেগুন, শাক সবই তো দেব?

রিনা নরম গলায় জিগ্যেস করল, বেগুনি রঙের ফুলকপি কত করে?

সাইদুল বলল, আপনার কাছ থিকে কি বেশি নিছি কুনোদিন। এইটা দিলাম। আর একটা হলুদ কপিও নিয়া যান আপা। মিক্সড ভাজি করবেন।

সবজি নিয়ে রিনাকে আবার মাছের বাজারে যেতে হবে। সেখানে মাছ কিনে কাটতে দিয়ে এসেছে। ভিড়ের ভেতর রিনার অস্থির লাগে। কতক মানুষ যেন ইচ্ছে করে ভিড় বাড়ায়। কাছে এসে শরীরের সঙ্গে চাপ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ভিড় বাড়লে শরীরের সঙ্গে শরীর ঘসতে থাকে। ইচ্ছে করে এদের পায়ের স্যান্ডেল খুলে পেটাতে। পায়ের স্যান্ডেল খোলার জন্য ভিড়ের ভেতর উবু হতে গেলে শরীরের ওপর নতুন উৎপাত শুরু হয়।

বাজার নিয়ে রিনা যখন বাসায় ফিরেছে তখন বাজে সকাল সাড়ে এগারোটা। বাইরে থেকে চাবি দিয়ে দরজার লক খুলেছে। কিচেনে বাজারের ব্যাগদুটো রেখে দম ছাড়ল। ছেলেমেয়ে দুজন আর তাদের বাবা যার যার ঘরে ঘুমুচ্ছে। কে কখন ঘুম থেকে উঠবে ঠিক নেই। জাকির অবশ্য গতরাতে ঘুমানোর আগেই বলেছে তাকে যেন দুপুর একটার আগে ডাকা না হয়। সে ঘুম থেকে উঠে একবারে লাঞ্চ করবে। রিনার স্বামীর নাম জাকির। রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের ইঞ্জিনিয়ার। তাদের দুই ছেলেমেয়ে। বড়জন ছেলে। নাম পাবলো। প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করেছে। শহরের এক ক্লিনিকের মেডিকেল অফিসার। মেয়ে অবনি। ভার্সিটির ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী।

 জাহান আসতে আসতে বারোটা বাজাবে। জাহান ঘরের কাজে সাহায্য করে। ঘড়িতে তিনটে বাজার আগেই সে চলে যায়। জাহানকে আজ একটু আগে আসতে বলেছিল। আসবে কিনা কে জানে! আগামীকাল রিনার বন্ধুদের গেটটুগেদার আছে। তাদের ভার্সিটির মাস্টার্স ব্যাচের ছেলেমেয়েরা একত্রিত হবে। সারাদিন থাকবে।  

ভার্সিটির কোনো অনুষ্ঠানে রিনা কখনো যায় না। ভার্সিটি এলামনাই এসোসিয়েশন মাঝেমধ্যে প্রোগ্রাম করে। তাকে যেতে বলে। তার ভার্সিটির ডিপার্টমেন্টের ছেলেমেয়েরা এর ভেতর দুবার একত্রিত হয়েছিল। একবার সব ইয়ারের ছেলেমেয়ে, আরেকবার শুধু তার ইয়ারের বন্ধুরা। রিনা যায়নি। যেতে ইচ্ছে হয়নি। কবে কবে যেন সে নিজেকে নিজের ভেতর গুটিয়ে নিয়েছে। সবকিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। তার আর কিছু ভালো লাগে না। সংসারে সময় দেয়। ছেলেমেয়ে দুজনার পড়াশোনার পেছনে তাদের প্লে থেকে লেগে আছে। সংসার, স্বামী আর ছেলেমেয়ে সামলাতে ইউএন-এর চাকরি ছেড়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে। কেন জানি আগামীকালের এই অনুষ্ঠানে যেতে ইচ্ছে করছে। হয়তো অনেক দিন আটকে থাকা দম মনের ভেতর বিষাক্ত গ্যাস তৈরি করে ফেলেছে। ভার্সিটির বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে ভালো লাগবে। কারও কারও সঙ্গে দেখা হবে ৩৪ বছর পর। ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে আসার পর প্রথম দেখা।  

অ্যাই শুনছ!

জাকির ডাকছে। ঘুম থেকে উঠেছে। সে এখন কেন উঠেছে বুঝা যাচ্ছে না।

ইন্টারকম বাজছে। অ্যাপার্টমেন্টের রিসেপশন থেকে গার্ড কিংবা কেয়ারটেকার কল করতে পারে।

জলি মোবাইলে কল করেছে। মোবাইলের রিং টোনের আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ছে।

রিনা বেডরুমে উঁকি দিলো। জাকির চোখ বন্ধ করে আছে। রিনা বলল, ডাকছিলে?

জাকির বলল, ঘুম ভেঙে গেল। চা খাব। চা খেয়ে আবার ঘুমাব।

বন্ধ হয়ে গিয়ে ইন্টারকম আর জলির ফোনের রিং একসঙ্গে বেজে উঠেছে। রিনা দুটো কল একসঙ্গে রিসিভ করল। গার্ড বলল, মতিন নামে একজন এসেছে আপনার কাছে। একটা প্যাকেট নিয়ে এসেছে।

জলি বলল, তোর শাড়ি পাঠিয়েছি আমার ড্রাইভারের হাতে। সে তোদের বাসার নিচে।

গার্ডকে রিনা বলল, মতিনকে ওপরে আসতে বলো।

জলিকে বলল, তোর ড্রাইভার শাড়ি নিয়ে এসেছে। থ্যাংকস।

জলি বলল, লেট করিস না। তোর জন্য নিচে ওয়েট করব। সকাল নয়টার ভেতর চলে আসিস।

মতিন এসে শাড়ির প্যাকেট দিয়ে চলে গেল। জাকিরকে চা দিয়ে এসে শাড়ি দেখবে। ইলেক্ট্রিক কেতলিতে পানি গরম হচ্ছে। রিনা কল রিসিভ করার আগে কেতলির সুইচ অন করে দিয়েছে। কেতলিতে পানি ছিল।

এই বুদ্ধি জলি করেছে। বান্ধবীরা সবাই আগামীকাল হালকা হলুদের ওপর সবুজ রঙের শাড়ি পরে অনুষ্ঠানে যাবে। শাড়ির ব্যবস্থা জলি করেছে। যে যার শাড়ি নিয়ে গেছে। রিনা যেতে পারেনি। রিনার শাড়ি জলি পৌঁছে দিয়েছে।

চায়ের পানি ফুটে গেছে। ইলেকট্রিক কেতলি থেকে ওলটপালট হয়ে যাওয়ার মতো গুড়গুড় আওয়াজ আসছে। জাকিরের জন্য চা বানিয়ে নিয়ে গিয়ে রিনা হতভম্ব হয়ে গেল। জাকির ঘুমাচ্ছে। তার নাক ডাকার শব্দ হচ্ছে। ঘুম থেকে ডাকলে সে বিরক্ত হবে। চিৎকার চেঁচামেচিও করতে পারে।

জাহান কথা রেখেছে। সে আজ তার নির্ধারিত সময়ে এসেছে। বাসায় ঢুকেই জোরে জোরে কথা বলতে শুরু করেছে। জাহানের এই এক সমস্যা। সে আস্তে কথা বলতে পারে না। এমনভাবে কথা বলে শুনলে মনে হয় ঝগড়া করছে। জাহান বলল, যুদ্ধ কইরে আসছি, আন্টি। টাইমের আগে কেউ ছাড়তে চায় না। আপনার কথা বলে আসছি। বলছি যে, আন্টি মরা বাড়ি যাবে। অতি কাছের আত্মীয়ের মউত।

অবাক হয়ে রিনা বলল, মরা বাড়ি যাব মানে!

বিয়ে বাড়ি যাবেন বললে আইতে দিত না। সত্য কথার দাম নাই আন্টি। মিথ্যা কথার ভরি দেড় লাখ।

বিরক্ত লাগছে রিনার। এ ধরনের কথা সে পছন্দ করে না। বিরক্ত হয়ে বলল, আমি তো বিয়ে বাড়িতেও যাচ্ছি না, জাহান।

কথা তো আপনি বলেন নাই। আপনার লাগতেছে ক্যান। দোষ, জাহান্নাম যা হয় আমার হইবে। চা খাইতেছেন কী দিয়া?

চা তোমার আঙ্কেল চেয়েছিল। চা চেয়ে ঘুমিয়ে গেছে।

জাহান বলল, চা আমাকে দেন। চায়ে পাউরুটি চুবাইয়ে খাই। যুদ্ধ করতে গিয়ে খাওয়া পাই নাই।

অবনি উঠে এসেছে। চোখ ডলতে ডলতে বলল, কী হইসে জাহান? পুলিশ আসছিল? ধরসে কাউরে।

জাহান নিজের কাপে চা ঢেলে নিয়েছে। চায়ে পাউরুটি চুবিয়ে তুলতে তুলতে বলল, পুলিশের খবর জানি না, আপা। চুরি ডাকাতির মধ্যে নাই।

তাইলে চিৎকার করতিছ ক্যান? আমি তো ভাবছি পুলিশ তোমার স্বামীরে ধরে নিয়ে গেছে।

সে বাদ্যাইম্যাকে ধরলে তো শান্তি পাইতাম। মেয়েমানুষের শান্তি নাই।

শাড়ির প্যাকেট হাতে নিয়ে অবনি বলল, মা শাড়ি কার?

রিনা বলল, আমার। কালকের প্রোগ্রামে পরে যেতে হবে। তোর জলি আণ্টি অ্যারেঞ্জ করেছে। তুই কি নাস্তা খাবি নাকি বাবার মতো আবার গিয়ে ঘুমাবি?

বেরুব। কাজ আছে।

শুক্রবারে কী কাজ? কোথায় যাবি?

এত কথা আস্ক করতেছ কেন?

আমি একটু বেরুব।

কোথায় যাবে?

সামনের পার্লারে। অনেক দিন তো যাইনি।

অবনি হাসল। কেমন যেন হালকা ধরনের হাসি। হেসে বলল, তোমার তো ঈদ লেগে গেছে। যাও। ফ্যাসিয়াল, পেডিকিওর, ম্যানিকিওর, হেয়ার ট্রিটমেন্ট করে এসো। তিন ঘণ্টার ধাক্কা। তাহলে আর আমি কোথায় যাচ্ছি জেনে তোমার কী হবে!

হতবাক লাগছে রিনার। কেমনভাবে ছেলেমেয়ে দুজন তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এমনভাবে তার সঙ্গে কথা বলে যেন সে তাদের ছোটবেলা থেকে একটু একটু করে বড় করে তোলেনি। যেন সে তাদের মা নয়। অন্য কেউ। অন্য কোনোখান থেকে সে এসেছে। শুধু এসেছে তাই নয়, উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। তাকে মাঝেমধ্যে দুই ছেলেমেয়ে যেন সহ্য করতে পারে না। তারা কেন এমন করে!

অবনি ঘুরে ঘরে চলে গেল। মায়ের গেটটুগেদার প্রোগ্রামে তাকে আর পাবলোকে মনির আঙ্কেল ইনভাইট করেছে। মনির আঙ্কেল মায়ের ভার্সিটির ক্লাসমেট। আগামীকালের প্রোগ্রামে তাদের ইনভাইট করার কথা মাকে জানাতে নিষেধ করেছে । মনির আঙ্কেলরা কয়েকজন এই প্রোগ্রামের আয়োজক। অবনির যাওয়ার ইচ্ছে নেই। পাবলো গেলে যাবে। পাবলোরও যাওয়ার ইচ্ছে আছে বলে মনে হচ্ছে না। তবে তারা মাকে কিছু বলেনি।

 

 

৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, শনিবার।

 

খামারবাড়ির বিশাল দোতলা অডিটরিয়াম। নিচতলায় বন্ধুরা আনন্দ করছে। উপরে ব্যালকনিতে ছেলেমেয়েদের জন্য আয়োজন করা হয়েছে। বেশির ভাগ বাবা বা মা জানে না ব্যালকনিতে তাদের সন্তানরা আছে। সেভাবেই বলে দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ আবেগে বাবা বা মাকে জানিয়ে দিয়েছে হয়তো। তবে কাউকে এখনো উপরের দিকে তাকাতে দেখা যায়নি। ছেলেমেয়েদের জন্য উপরেই চা-নাস্তা আর খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের ওঠানামার সিঁড়িও ভবনের অন্য দিকে।

তুমুল আড্ডা শুরু হয়েছে বন্ধুদের। আড্ডা থেকে বেশি হচ্ছে ছবি তোলা। এক একজনের সঙ্গে কতদিন পর দেখা। আলাদা আলাদা ডিপার্টমেন্টের ছেলেমেয়েরা ছবি তুলছে। আবার সবাই একসঙ্গে ছবি তুলছে। মঞ্চে কেক কাটার জন্য ডাকা হচ্ছে। কেউ কথা শুনতে পাচ্ছে বলে মনে হলো না।

পাবলোকে খোঁচা দিয়ে অবনি বলল, ভাইয়া, কাজটা খারাপ করছিস। এই বুড়ো-বুড়িদের বাচ্চাদের মতো লাফালাফি দেখানোর জন্য তুই নিয়ে আসছিস। ডেটিংয়ে না যাস, হলে গিয়ে একটা মুভি দেখতে পারতিস। বাবা সকালে বের হয়ে গেছে। উইকএন্ডে বাবা কোই গেল!

বাবার কাজ আছে।

বাবা কাজ বানাইছে। মায়ের এই ছেলেমানুষি ডিসিশন বাবার ভালো লাগে নাই। মা ক্যান আসছে এইখানে!

পাবলো কিছু বলল না। সে নিচে অডিটরিয়ামের দিকে তাকিয়ে আছে। ধ্রুব আঙ্কেল পডিয়ামের সামনে দাঁড়ানো। মাইকে কিছু বলছে। সে তার ভার্সিটি লাইফের স্মৃতির কথা বলছে।

ধ্রুব অভিনয়ে বেশ নাম করেছে। বলা যায় গুরুত্বপূর্ণ একজন সেলিব্রেটি। সে এখানে এসে সময় দেবে অন্যরা ততটা নিশ্চিত ছিল না। তবে ধ্রুব আছে। এনজয় করছে। ধ্রুব বলল, জীবনে একবার প্রেমে পড়েছি। সেই প্রথম, সেই শেষ। ভার্সিটিতে। রিনার প্রেমে পড়েছিলাম।

অবনি আর পাবলো একসাথে মনোযোগ দিয়েছে। এখানে রিনা নামে আর কেউ আছে কিনা খুঁজছে। সবাই মায়ের দিকে তাকাচ্ছে। এখানে রিনা নামে আর কেউ নেই।

ধ্রুব বলল, নিশ্চিত করে বলতে পারব না, ঠিক রিনার প্রেমে পড়েছিলাম নাকি রিনার অপূর্ব নাচের! নাচের এমন নিখুঁত মুদ্রা আর কারও দেখিনি।

অডিয়েন্স থেকে কারা যেন চিৎকার করছে, রিনাকে বলেছিলি? ছ্যাকা খেয়েছিস?

ধ্রুব বলল, রিনাকে বলতে পারিনি। খুব নার্ভাস টাইপের ছিলাম। যখন সাহস সঞ্চয় করলাম তখন রিনার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।

অবনি বিস্মিত হয়ে বলল, মা নাচত! নাকি অন্য কোনো রিনা?

পাবলো বলল, মায়ের নাচ দেখে মুগ্ধ হয়ে বাবা বিয়ে করেছিল মাকে।

তারপর, মা নাচ ছেড়ে দিলো কেন?

পরিষ্কার জানি না।

তুই কখনো মাকে আস্ক করিসনি?

বাবা চাইত না যে মা কোনো প্রোগ্রামে নাচুক। ইশকুলে পড়ার সময়ও বাড়িতে মায়ের নাচের ঘুঙুর দেখেছি। ঘরের ভেতর মাকে নাচ প্রাকটিস করতেও দেখেছি। মায়ের সঙ্গে দু-একবার নাচের প্রোগ্রামেও গেছি। ফুলের গাজরা, চোখে টানা কালো কাজলের টান, পায়ে ঘুঙুর আর নাচের শাড়ি পরে মাকে যে কী অসাধারণ লাগত দেখতে! দেবী মনে হতো।

এটা আনফেয়ার। বাবা ঠিক করেননি। এটা মায়ের পার্সোনাল চয়েজ। সে নাচবে। বাবা কেন তার নাচ বন্ধ করে দেবে! নট ফেয়ার।

এ নিয়ে মা কিন্তু কখনো কোনো কমপ্লেইন করেনি।

ফাক। লেট মাদার্স কমপ্লেইন্ট গো টু হেল।

নিচে চেঁচামেচি হচ্ছে। সকলে রিনার নাচ দেখতে চাইছে। মনির এসেছে মাইক্রোফোনে। মনির জানাল কালচারাল প্রোগ্রামে রিনা অবশ্যই নাচবে।

রিনা নাচতে রাজি হচ্ছে না। সে নাচতে পারবে না বলে জানিয়েছে। এই নিয়ে চেঁচামেচি। ছেলেমেয়েরা অডিটরিয়ামে স্লোগান দিচ্ছে, আমাদের দাবি মানতে হবে, রিনা তোমায় নাচতে হবে।

লাঞ্চের পর হাউজি খেলা শুরু হয়েছে। হাউজি শিট বিক্রি হচ্ছে তিনশ টাকায়। তিনটে শিট তিনশ টাকা। জলি কিনেছে। রিনার কাছে এসে বলল, তুই খেলবি না?

রিনা বলল, আমি হাউজি খেলতে পারি না।

সবকিছু পারতে হয় না। শিখতে হয়। এখানে তো আমরা আমরাই।

রিনা রাজি হচ্ছিল না। জলি তখন রিনাকে হাউজি খেলা শিখিয়ে দিলো। মজা পেয়েছে রিনা। সে খেলতে আগ্রহী হয়েছে। হাউজির তিনটে শিট কিনে খেলতে বসে গেছে।

হাউজির কল হচ্ছে, টিক্কা পালায় নিয়ে গান, সেভেন অ্যান্ড ওয়ান সেভেনটি ওয়ান।

রিনা তার হাউজি শিটে একাত্তর খুঁজে বের করে কেটেছে।

পরের কল, সখিপুরের সখির মনটা ঘুরঘুর করে চব্বিশ ঘণ্টা। টু অ্যান্ড ফোর টুয়েন্টি ফোর।

রিনার ভেতর প্রবল উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে। তার চোখমুখের ভাব টানটান। দুটো নম্বর মিলে গেলেই লাইন মিলে যাবে। জীবনের প্রথম হাউজি খেলা।

পাবলো বলল, মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখ।

অবনি বলল, হাউজি খেলছে। শি লুকস ভেরি ইয়াং!

বন্ধুদের সঙ্গে মিলতে পারলে সবার বয়স সেই বন্ধুত্বের বয়সের কাছে চলে যায়।

ইয়েট শি ইজ সিক্সটি ইয়ারস ওল্ড।

এখানে যারা আছে সকলের বয়স সিক্সটি। তারা সমান বয়সের। বয়স কমলে সকলের একসঙ্গে কমবে। এখন ধর তাদের বয়স বিশ-বাইশ। যখন তারা ভার্সিটিতে ছিল।

হাউজি মেলাতে পারেনি তবু রিনা উত্তেজিত। যেন সে জীবনের বিশাল কিছু অর্জন করেছে। কতদিন পর সে নিজেকে এমন মুক্তভাবে মেলে ধরতে পেরেছে। বেশ ফুরফুরে বোধ হচ্ছে। সে আছে ভার্সিটির সেই সময়ে। নরম একজন মানুষ। ফুল ভালোবাসে। নাচতে ভালোবাসে। মাঝেমধ্যে গান গায়। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনে মিছিলেও গেছে। সেখানে আছে রিনা।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। অডিটরিয়াম জুড়ে আওয়াজ হচ্ছে রিনা, রিনা, রিনা, রিনা।

রিনাকে নাচতে হলো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রক্তকরবী’র গান। নন্দিনী প্রতীক্ষা করছে রঞ্জন আসবে। ‘যুগে যুগে বুঝি আমায় চেয়েছিল সে। সেই বুঝি মোর পথের ধারে রয়েছে বসে।’

পাবলো ঘাড় ঘুরিয়ে অবনির দিকে তাকাল। অবনি কাঁদছে। তার শান্ত চোখ থেকে গাল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। পাবলোর মনে হলো মা এত সুন্দর নেচেছে অবনি হাতে তালি না দিয়ে কাঁদছে কেন!

অনুষ্ঠান শেষ হওয়ামাত্র রিনা বাড়ি ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রাত হয়ে গেছে। রাত সাড়ে আটটা বাজে। ছেলেমেয়েদের খেতে দিতে হবে। জাকির হয়তো ফিরে এসেছে। সে সন্ধ্যায় কিছু খেয়েছে কিনা কে জানে। সন্ধ্যায় কিছু খেয়ে চা খেতে না পারলে জাকিরের মাথাখারাপ অবস্থা হয়ে যায়। ছেলেমেয়ে দুজনও তাই করে। তাদের জন্য নুডুলস জাতীয় কিছু রান্না করে রেখে এলে ভালো হতো। দুপুরের খাবার রেডি করেছে। তারপর তাড়াহুড়ো করে বেরুতে গিয়ে সন্ধ্যার নাস্তার কথা ভুলে গেছে। ভুলে যাওয়া ঠিক হয়নি। এখন গিয়ে রাতের খাবার চুলায় দিতে হবে।

অডিটরিয়াম থেকে বের হয়ে এসে রিনা হকচকিয়ে গেল। পাবলো আর অবনি দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মুখ শুকনো। তারা এখানে কেন! শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে! জাকিরের কিছু হলো নাকি। আতঙ্কিত গলায় রিনা জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? তোমরা এখানে কেন এসেছ?

অবনি মাকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল। রিনা আরও বেশি ভয় পেয়ে গেছে। সে জোর করে অবনিকে বুক থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়েছে? কাঁদছ কেন? বাবা কোথায়?

অবনি আবার মাকে জড়িয়ে ধরে মায়ের বুকে মুখ ঘসতে ঘসতে বলল, তুমি এত ভালো নাচো, মা! এত ভালো। তোমাকে আমরা কোনোদিন বুঝতে পারিনি।

বিস্মিত গলায় রিনা বলল, তোমরা আমার নাচ দেখেছ!

পাবলো বলল, মা চলো। আমরা রাতে বাইরে খাব। তিনজন একসাথে সারারাত এই শহরে ঘুরে বেড়াব।

রিনা বলল, তোদের বাবা!

পাবলো বলল, বাবার খাবার অর্ডার করে দিয়েছি। সময়মতো বাসায় খাবার পৌঁছে যাবে। বাবার সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। বাবা বলেছে ডিনার খেয়ে বই পড়বে। ভোরে আমরা যখন ফিরব তখন আমাদের চা বানিয়ে খাওয়াবে।

কেন জানি রিনা হেসে ফেলল। ছেলেমেয়েদের পাগলামি দেখে তার ভালো লাগছে। ভালোলাগার হাসিতে তার মুখ ভরে উঠেছে।

রিনাকে সঙ্গে নিয়ে পাবলো আর অবনি যাচ্ছে শহরের অভিজাত এক রেস্টুরেন্টে। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। রিনা বলল, তোদের বাবাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলে হতো না!

অবনি বাবাকে কল করল। জাকির তাদের সঙ্গে যাবে বলেছে। পাবলো বলেছে তবে রেষ্টুরেন্টের বিল সে দেবে। জাকির তাতেও রাজি হয়েছে।

নৃত্য রং নামে এক দোকানের সামনে গাড়ি এসে থেমেছে। তারা সবাই গাড়ি থেকে নেমেছে। মায়ের হাত ধরে পাবলো বলল, বাবা তোমাকে ঘুঙুর গিফট করবে, মা। তুমি আবার নাচবে।

রিনা বিস্ময় আর মুগ্ধতা মেশানো চোখে জাকিরের দিকে তাকাল। জাকিয়ের চোখে প্রশান্তি আর প্রশ্রয়। এখানে আসার আগে পাবলো আর অবনি তাকে সব জানিয়েছে। তাদের ইচ্ছের কথা বলেছে। জাকির বলল, তোমার জন্য এই দোকান মুক্ত করে দিলাম। যেটা পছন্দ হয় তুমি শুধু সেটা ছুঁয়ে দেবে। আমার ইচ্ছে তুমি নাচো।

রিনার কেমন যেন লাগছে। জাকির, পাবলো, অবনি খুব আগ্রহ নিয়ে কথা বলছে। কোনো কথা তার কানে ঢুকছে না। তার মনে হচ্ছে বিশাল অডিটরিয়ামে মঞ্চের ওপর সে নাচছে। আলো অনুসরণ করছে তাকে। চারদিকে থেকে বাজনা বাজছে। সে ঘাসফড়িংয়ের মতো নেচে যাচ্ছে। যেন কত্থক নয়, ব্যালে। নাচ শেষ করে দর্শকদের দিকে মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করেছে। উজ্জ্বল আলোতে ভরে উঠেছে অডিটরিয়াম। সেখানে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে জাকির, পাবলো আর অবনি। তারা হাততালি দিচ্ছে। তারা যেন হাতে তালি দেওয়া বন্ধ করতে ভুলে গেছে। রিনার ভীষণ ভালো লাগছে। তার দুই চোখ উপচে পানি পড়ছে। রিনা কাঁদছে। সে কাঁদছে আনন্দে।       

         

 



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *