short-story-gondhogokul

গন্ধগোকুল ও এক নিঃসঙ্গ উজাগর
দেবারতি মুখোপাধ্যায়


দেড়দিনের পচা ডাল। বুড়বুড়ি কেটে তাতে ফেনা উঠছে। কলাই করা হলদেটে সাদা থালা বেয়ে সেই ডাল গড়িয়ে চলে গেছে চৌকো খোপ কাটা মেঝের দিকে। সেখানে জমে আছে দু তিনদিনের পায়খানা। নর্দমার মুখের কাছটা জ্যাম। সেখানে পড়ে থাকা আধখাওয়া মগের পাশে ডাল আর পায়খানা একসঙ্গে মিশছে।

আসা আর যাওয়ার সার্থক মেলবন্ধন।

সীতারাম উদোম গায়ে বাঁ হাতটা ওপরে তুলে ওই অপরূপ দৃশ্যটা দেখতে দেখতে ভাবছিল। ডাল শরীরে আসে, পায়খানা শরীর থেকে যায়। আসা যাওয়া। আসা যাওয়া না বলে দেওয়া নেওয়াও তো বলা যায়। শরীরে খাবার দাও, বিনিময়ে শরীর পায়খানা দেবে। নাহ, দেওয়া নেওয়া বললেই কেমন উত্তম তনুজার সিনেমা মনে পড়ে যায়। তার থেকে ভোগ আর ত্যাগটা ভাল। সেই লাইনটা কী ছিল যেন? হ্যাঁ, তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা। ত্যাগের মাধ্যমে ভোগ করো।

সীতারাম নিজের মনে হাসল। এভাবে শোয়ার একটা আলাদা তৃপ্তি আছে। কাঁচা পাকা লোমে ভর্তি বুক পেট আর ঘামে জবজবে হয়ে থাকা বগল থেকে উদ্গত হয় একটা তীব্র দুর্গন্ধ। নাকে বেশ জোরে জোরে ঝাপটা মারতে থাকে।

সেই বদগন্ধের প্রতিটি প্রশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে সীতারাম আশ্বস্ত হয়। হ্যাঁ। পচা ডাল। জমা পায়খানা। ঘেমো বগল। সব গন্ধ ও পাচ্ছে। ও বেঁচে আছে। এখনো বেঁচে আছে। নিশ্চিন্ত মনে ও ঘ্যাস ঘ্যাস করে দাড়ি চুলকোয়। হঠাৎ অনুপ্রবেশে বিরক্ত হয়ে দুটো ছোট উকুন লাফিয়ে পড়ে দাড়ি থেকে, বুকের লোমে কামড়ে দিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

সাড়ে ছয় ফুট বাই সাড়ে আট ফুটের একখানা ঘর। ঘর না বলে খুপরি বলাই ভাল। মেঝেতে শুতে হয়। একখানা তেল চিটচিটে চাদর ছিল আগে, কোথায় চলে গেছে। হাত দুয়েক দূরেই শৌচকর্মের জন্য সেই পূতিগন্ধময় গর্ত।

এর আগে সীতারাম যখন সাব ডিভিশনের জেলে ছিল, সেখানে ওর আলাদা সেল ছিল না। পাঁচ ছ’জনের সঙ্গে গাদাগাদি করে থাকতে হত। সেন্ট্রাল জেলে আসার পর ওর ভাগ্যে প্রাইভেসি জুটেছে। কথাটা মনে হওয়া মাত্র সীতারামের বুক থেকে বুড়বুড়িয়ে হাসি উঠে এল। এ যেন চন্দন কাঠে পোড়ার জন্য মড়ার আন্দোলন।

দূর থেকে কী সব হইচইয়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। নান্টু আর শাকিলের দলের মধ্যে আবার ঝামেলা লেগেছে বোধ হয়। সীতারাম হঠাৎ জোরে জোরে নাক টানতে থাকে। মনের মধ্যে আবার সেই গন্ধটা আসছে। পচা ডাল, জমা পায়খানা ছাপিয়ে সেই গন্ধটা যেন অবধ্য স্রোতের মত এসে প্রাণপণে ঢুকতে চাইছে তার মনের নাসারন্ধ্রে। ওফ! সীতারাম চোখ বুজে ফেলে। না চাইতেও বন্ধ চোখের সামনে উজ্জ্বল হয়ে উঠতে থাকে ছেঁড়া ছেঁড়া দৃশ্য। হাইওয়ের পাশের প্লাস্টিকের ছাউনি। স্টোভের আগুনে গবগব করে ফুটছে দুধ। মা বসে আছে সামনে। তেজপাতা আর এলাচ দেওয়ামাত্র গন্ধে ম ম করছে চারপাশে। মা ঘং ঘং করে কাশছে, কাশতে কাশতে খুন্তি নাড়াচ্ছে, সীতারামের জন্মদিন যে। অন্য সব সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠ এই পুত্রটিই এখনো লেখাপড়া ছাড়েনি, ফি বছর রেললাইনের ধারের ইস্কুল থেকে প্রাইজ আনে। সীতারাম চোখ বুজে দেখতে থাকে, খুন্তি নাড়াতে নাড়াতে মা বাঁ হাত দিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

সীতারাম মোলায়েম সুরে ডাকল, “সাব! ও সাব!”

চারবার ডাকার পর গরাদের সামনে কাউকে দেখা গেল। ক্রুদ্ধ চাপা স্বরে বলল, “কী হয়েছে রে শালা?”

সীতারাম চমৎকৃত হল। জেলে বসে কোনরকম গালাগালি ছাড়া সম্বোধন খুবই কালেভদ্রে ঘটে। ওর সেলের ভেতর আলো ঢোকে না সেভাবে। আবছা অন্ধকারে থাকতে থাকতে বেশি আলো সয়ও না ওর। সীতারাম চোখ কুঁচকে দেখার চেষ্টা করল। প্রতিকৃতি দেখে মনে হচ্ছে, সনাতন হাবিলদার। বেঁটেখাটো ঘাড়ে গর্দানে চেহারা।

সীতারাম হলদে দাঁত বের করে হিসহিস করল, “ওষুধটা দিলেন না সাব?”

“কীসের ওষুধ? বললাম তো, তোর এখন আর কোন ওষুধ নেই। এক কথা বারবার বলিস কেন?” বলতে বলতে সনাতন হাবিলদারের গলা কেমন খাদে নেমে গেল। বেশ জোরে জোরে কয়েকবার নাক টানল সে। তারপর বলল, “কীসের গন্ধ আসছে ভেতর থেকে?”

“কীসের আবার, হাগার। ও আমার সয়ে গেছে।”

“না না। কেমন একটা মিষ্টি গন্ধ।” সনাতন হাবিলদার ঈষৎ কাঁপা গলায় বলল, “শিউচরণও সকালে বলছিল।”

“মিষ্টি গন্ধ?” “হ্যাঁ। পায়েস পায়েস গন্ধ।” আরো দু’বার নাক টেনে সনাতন হাবিলদার বিড়বিড় করল। যে সেলের সামনে সে দাঁড়িয়ে আছে, সেটার নম্বর তেষট্টি। সেলের কয়েদির ফাঁসির তারিখ ঠিক হয়ে আছে ঠিক চারদিন পর। এই ক’দিন জেলার সাহেবের হুকুম, আসামীর সঙ্গে যেন নরমসরমভাবে কথা বলা হয়।

কিন্তু এই গন্ধটা কোথা থেকে আসছে?

সনাতন হাবিলদার প্রথম যখন এই জেলে ট্রান্সফার হয়ে এসেছিল, নিজে থেকে দেখে গিয়েছিল তেষট্টি নম্বর সেলের কয়েদিকে। আড়াই বছরের একটা বাচ্চা মেয়েকে রেপ করে খুন। নৃশংস সেই কাণ্ডে দেশজুড়ে তোলপাড় পড়ে গিয়েছিল। সীতারাম থাকত বাজারের পাশের বস্তিতে। বিয়ে থা করেনি, একা মানুষ, বাচ্চা পড়িয়ে দিন গুজরান হত। পাশের ঝুপড়িতে আড়াই বছরের লখিয়া থাকত তার বাবা মা’র সঙ্গে। তার বাবা ছিল সিকিউরিটি গার্ড, মা সবজি বিক্রি করত। লখিয়া সীতারামকে খুব ভালবাসত, প্রায়ই তার কাছে এসে থাকত, গল্প শুনত।

এক নিষ্পাপ শিশুর ভালবাসার সুযোগ সীতারাম যেভাবে নিয়েছিল, তা বিচারকের চোখে ছিল বিরলের মধ্যে বিরলতম অপরাধ। মিডিয়াও ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। দিনের পর দিন সব কাগজে ছাপা হত অপরাধের নাট্যরূপ।

সনাতন হাবিলদারের বন্ধু কিচলু ওকে প্রথম দিন সীতারামের এখানে আসার গল্প বলেছিল। থিকথিক করতে থাকা মিডিয়ার বুম আর ক্যামেরার মাঝে সেন্ট্রাল জেলের সামনে পুলিশ ভ্যান থেকে নেমেছিল সে। মুখ ঢাকার কোন ব্যাপার নেই। মরা গরুর মত ভাবলেশহীন চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নীচের ঠোঁটটা জিভ দিয়ে ভাল করে চেটেছিল সীতারাম। ঠোঁটের ডানকোণে ফুটে উঠেছিল তাচ্ছিল্যের একটা হাসি। তারপর চুপচাপ ঢুকে গিয়েছিল ভেতরে। তাও সে প্রায় চারবছর হল। মাঝেমাঝে হিয়ারিং এর তারিখ পড়েছে, সীতারাম নিরুপদ্রবে কোর্টে গেছে, এসেছে। ধীরে ধীরে তাকে ঘিরে কৌতূহল জেলের কর্মীদের মধ্যে স্তিমিত হয়ে গেছে।

“আহ!” সনাতন হাবিলদার গরাদের মধ্যে নাক ডুবিয়ে আবার গন্ধ নিল।

দুধ, চাল চিনি আর তেজপাতা। কী সুন্দর গন্ধ!

সনাতন লাঠি ঠুকতে ঠুকতে আবার তাকাল ভেতরের দিকে। আবছা আলোয় সীতারামের ঘামে ভিজে ওঠা তেলতেলে মুখটা দেখা যাচ্ছে। কৌতুকমাখা চোখে সে এদিকে তাকিয়ে রয়েছে।

সীতারামের সেলের মধ্যে যে কয়েকদিন ধরে একটা অন্যরকম গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে, তা অন্য হাবিলদাররাও বলেছে। যতদিন যাচ্ছে, সেই গন্ধ যেন জোরালো হচ্ছে। কিন্তু সীতারাম নিজে গন্ধটা পাচ্ছে না কেন?

সনাতন চিন্তিতমুখে গরাদের ওপারে চোখ রাখল। এমনিতে সীতারামের মধ্যে অস্বাভাবিকত্ব কিছু নেই। ঠিকঠাক খাওয়াদাওয়া করছে, ঘুমোচ্ছে। শীর্ষ আদালত থেকে সীতারামের ফাঁসির রায় বেরনোর পর থেকে তার ওপর বিশেষ নজর রাখা হচ্ছে। ফাঁসির আদেশের পর অনেক আসামীরই মস্তিস্কবিকৃতি দেখা দেয়। কেউ একেবারে চুপচাপ হয়ে যায়। খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দেয়। কেউ আবার উন্মাদের মধ্যে চিৎকার করতে থাকে, হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে, মাথার চুল ছেঁড়ে। দেওয়ালে মাথা ঠোকে।

কিন্তু সীতারামের মধ্যে এর কোনটাই দেখা দেয়নি। আদালতের রায় শুনে সে শান্তভাবেই এসে ঢুকেছিল নিজের সেলে। রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমাভিক্ষার দিকেও যায়নি। রাতের খাবার খেয়েছিল বিনাবাক্যব্যয়ে।

সনাতন দ্রুত চিন্তা করতে লাগল। জেলার সাহেবকে কি ডেকে আনবে গিয়ে? নাকি ডাক্তারকে এত্তেলা পাঠাবে? ফাঁসির রায় বেরনোর পর থেকে সীতারামকে ওষুধ খাওয়ানো বন্ধ করা হয়েছে। জেলে সব কয়েদীকে প্রতিদিন ওষুধ খাওয়ানো হয়। লিবিডো কমানোর ওষুধ। সেই ওষুধ খেলে যৌন ইচ্ছা জাগে না। সেলের মধ্যে কোনরকম বিকৃত কাজকর্ম হওয়ার সম্ভাবনাও কমে যায়। সীতারাম বলে লোকটার তো এমনিই আলুর দোষ ছিল। ওষুধ বন্ধ হয়েছে বলে কি এইসব বিকার দেখা দিচ্ছে নাকি?

সনাতন কথা বাড়াল না। একটু পরেই বিকেলের চা খাওয়ার ঘন্টি বাজবে। কাজ পড়ে আছে অনেক। লাঠি ঠুকতে ঠুকতে বলে গেল, “তু আরাম কর। বাদমে আ কে দেখতা হু!”

সব শুনে জেলার সাহেব খুব একটা পাত্তা দিলেন না। জেলারের নাম শঙ্খপদ্ম বিশ্বাস। তরুণ চনমনে অফিসার, কীভাবে জেলের কয়েদীদের সৃজনশীল কাজে যুক্ত করা যায়, তাই নিয়ে খুব উৎসাহ। প্রায়ই শহরের গায়ক, নাট্যকর্মী, চিত্রশিল্পীদের আমন্ত্রণ করে এনে গানের, অভিনয়ের, আঁকার ওয়ার্কশপ করান। বড় দু-একটা খবরের কাগজের সাংবাদিকের সঙ্গে ভাল যোগাযোগ রেখে দিয়েছেন, ফি মাসে জেলের নাম, জেলারের নামসুদ্ধু খবর বেরোয়। জেলের আরেক নাম যে ‘সংশোধনাগার’, তা বারেবারে প্রমাণিত হয়। ওপর মহল থেকে পিঠ চাপড়ানো চিঠি আসে। জেলারের বুক আরো চওড়া হয়।

সামনের মাসে ভাবছেন, জম্পেশ করে একখানা পদ্য লেখার ওয়ার্কশপ করাবেন। আসামীরা অনেক দিকে নিজেদের প্রতিভার প্রমাণ দিয়েছে, কেবল কবি এখনো একখানাও বেরোয়নি শঙ্খপদ্ম বিশ্বাসের হাত দিয়ে। জেল থেকে একজন কবি বের করতে পারলে এবারে প্রমোশন আটকায় কে! যে আর একসপ্তাহও পৃথিবীতে নেই, তাকে নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় তাঁর নেই।

সনাতন আরো একবার বলার চেষ্টা করে, “সাহেব! সীতারাম লুকিয়ে লুকিয়ে ভাল ভাল খাবার খাচ্ছে না তো?”

“ভাল ভাল খাবার!” শঙ্খপদ্ম বিশ্বাস সনাতনের কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লেন, “পাবে’টা কোথায়? আর যদি পায়, তোরা কি চোখে ঠুলি বেঁধে বসে আছিস? মারব কানের গোড়ায় এক রদ্দা!”

সনাতন আর কিছু বলতে পারে না। চুপচাপ চলে যায় নিজের কাজে।

জেলের হেড রাঁধুনি বয়স্ক বৃন্দাবনদা বলে, “আচ্ছা, গন্ধগোকুল হতে পারে কিন্তু!”

“গন্ধগোকুল!” ওয়ার্ডবয় বলরাজ, প্রদীপ থেকে সনাতন, কিচলুর মত হাবিলদাররা ঝাঁপিয়ে পড়ে, “সেটা আবার কী!”

“একধরণের জন্তু। কিছুটা বিড়াল, কিছুটা গাছ খটাশের মত দেখতে। গাছেই থাকে। প্যাঁচার মত, দিনে ঘুমোয়, রাতে জাগে।”

“তা সেই গন্ধগোকুল এখানে আসবে কীকরে?” ওয়ার্ডবয় প্রদীপ ফুঁৎকারে উড়িয়ে দেয়, “কী যে বলো না বৃন্দাবনদা।”

“থাম। সেদিনের ছেলে, বড় বড় কথা বলছে। জন্মে থেকে তো কলকাতার নর্দমার পাশে মানুষ হয়েছিস, গ্রামেগঞ্জে গেছিস কখনো?” বৃন্দাবনদা এবার ধমকে উঠল, “গন্ধগোকুলের গা থেকে গোবিন্দভোগ চালের মত গন্ধ ছাড়ে।”

“অ্যাঁ!”

“হ্যাঁ। আগে সেই গন্ধ থেকে আতরও তৈরি হত। এখনো অবশ্য আর দেখতে পাওয়া যায় না। আমার দেশের বাড়ি তো মুর্শিদাবাদে। ছোটবেলায় মনে আছে, দেখতাম, দিনের বেলা কোন গাছের ডালে লম্বা হয়ে ঘুমোচ্ছে। লেজটা ঝুঁকে রয়েছে নীচের দিকে।” বৃন্দাবনদা হাই তুলল, “সুইপারদের বল, ওর সেলটা ভাল করে পরিষ্কার করতে। কোন গন্ধগোকুল আস্তানা গেঁড়েছে নির্ঘাত!”

“জেলার সায়েবের হুকুম, সীতারাম চলে গেলে একবারেই কিলিন করা হবে।” সুইপার অজয় হাত উল্টে বলল।

“তবে আর কী! নাক দিয়ে পায়েস খা আর পাছা উল্টে ঘুমো।”

***

সনাতন হাবিলদার আবার ডিউটিতে এল পরেরদিন বেলায়। এই সপ্তাহটা তার ডে ডিউটি। হ্যান্ড ওভারের সময় কিচলু বলল, “সীতারাম কিন্তু হেব্বি বাড়াবাড়ি শুরু করেছে সনাতনদা!”

“কেন আবার কী করল?”

“কাল রাতে কিছুতেই ডাল রুটি খাবে না। পায়েস খাবে।” কিচলু চোখ পিটপিট করল, “আশপাশের সেলের সবাই উঁকিঝুঁকি মারছে, এদিকে সে’ব্যাটা কিছুতেই শান্ত হয় না।”

“তার মানে ও-ও গন্ধটা পাচ্ছে?”

“না, বলছে তো পাচ্ছে না। কিন্তু পায়েস খাবে। সে কী লাফড়া মাইরি! কিছুতেই থামে না।”

“এত চেঁচাচ্ছে?”

“না না চেঁচায় নি। কাঁদছে।”

“কাঁদছে!”

“হ্যাঁ। হাউ মাউ করে আছারিপিছারি সেকি কান্না গো। মাইরি বলছি, সে কান্না দেখলে তোমারও চোখে জল এসে যাবে।”

“পায়েস না খেতে পেয়ে অমন কাঁদছে?”

“হ্যাঁ গো। জানো, প্রহ্লাদ কী বলছিল?”

প্রহ্লাদ একজন আসামী। সে আবার বাড়ি বাড়ি পুজো করত। তা কোন বাড়িতে শান্তি স্বস্ত্যয়নে গিয়ে চুরি করেছিল, এখন জেল খাটছে। জেলে এসেও তার পুরোহিতপনা অক্ষুণ্ণ আছে। নাপিত চুলদাড়ি কাটতে এলে সে ন্যাড়া হয়, টিকিও রাখে।

সনাতন বলল, “কী?”

কিচলু এদিক ওদিক তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, “কোন ভাল মানুষ মরার আগে তাকে পবিত্র আত্মা নিতে আসে। পবিত্র আত্মার গন্ধও নাকি পায়েসের মত সুন্দর!”

“ধুর!”

“হ্যাঁগো। আচ্ছা সনাতনদা!” কিচলু কানের কাছে এসে ফিসফিস করে, “সীতারামের মা যে গলা ফাটিয়ে বলেছিল, সীতারাম নির্দোষ, মেয়েটার নিজের বাপই নাকি কুকর্ম করে ওর ঘাড়ে চাপিয়েছে, সেটা সত্যি নয়তো?”

“মানে?”

“আহা, মনে নেই? চারপাশে সীতারামকে নিয়ে এমন ছিছিক্কার উঠল, ফেসবুক থেকে শুরু করে সব আলোচনায়, মেয়েদের সুরক্ষা নিয়ে আন্দোলন শুরু হল, আর সরকার থেকেও সাত তাড়াতাড়ি চাপ দিয়ে …!” কিচলু থমকে গেল, “ওই মরা বাচ্চাটা … কী নাম যেন, লখিয়া, সে-ই কি সীতারামকে নিতে এসেছে নাকিগো?”

“ভাং টাং খাচ্ছিস নাকি?” সনাতন অদ্ভুত মুখব্যাদান করে, “ফাঁসির আগে অনেকরকম পাগলামি দেখা যায়। সীতারামও তেমনই খ্যাপামি করছে গন্ধ পাচ্ছে না বলে। ওর ঘর খুঁজলেই ওই গন্ধগোকুল বেরোবে।”

****

সীতারামের যেদিন ভোরে ফাঁসি হল, সেদিন জেলের বাইরে উপচে পড়ছিল ভিড়। জেলের ভেতরে প্রদীপ, সনাতন হাবিলদার, ওয়ার্ডবয় বলরাজরা দলবেঁধে গিয়ে ঢুকল তেষট্টি নম্বর সেলে। বালতি ঝাঁটা ন্যাতা নিয়ে। তন্নতন্ন করে খুঁজল। কিন্তু গন্ধগোকুল নামের কোন নিশাচর প্রাণী সেখানে দেখতে পেল না।

জমে থাকা মূত্র ও পুরীষের দুর্গন্ধে সবাই নাক চাপা দিল।

প্রহ্লাদ পুরোহিত বৃন্দাবন রাঁধুনির দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচাল।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

5 thoughts on “short-story-gondhogokul

  1. অসাধারণ প্রাঞ্জল। ধনঞ্জয়কে মনে পড়িয়ে দেয়।

  2. পড়লাম,খুব ভালো লাগলো, এভাবেই কত নির্দোষ পার্থিব শাস্তি ও অপার্থিব পুরষ্কার পেয়েছে,পাচ্ছে ও পাবে,,।🙏🙏🙏

  3. এত ভাল প্লট এবং Sprititual গল্প বাংলায় খুব কম পড়েছি।

  4. দুর্দান্ত লেখা। পড়ে কেঁপে উঠলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *