short-story-hibernation

হাইবারনেশন
অদিতি সেন চট্টোপাধ্যায়


সড়সড় করে পায়ের পাতার প্রায় ওপর দিয়ে চলে গেল মস্ত মোটা মস্ত লম্বা চমকানো গমের মত রঙের সাপটি। হেমন্ত শেষ হয়ে এলো। আর কিছুদিন পর সাপেরা সব শীতঘুমে যাবে। সারাটা শীতকাল মাটির তলায় ঘুমিয়ে থেকে আবার যখন জেগে উঠবে সেই বসন্তের গোড়ায়, তখন খোলস ছেড়ে একেবারে নতুন সাপটি হয়ে উঠবে, ঠিক যেন বিউটি পার্লারে ফেসমাস্ক টেনে তুলে ঝকঝকে ত্বকটি নিয়ে। কোলের মেয়েটাকে মনসার থানের ওপর শুইয়ে দিল তাপসী। মনসার থানের সামনের মাঠে পাড়ার কচিকাঁচারা খেলছে এখন। তাপসী একবার ভালো করে গুনে নিল বাচ্চাগুলোকে। সাতটা ছেলে আর চারটে মেয়ে। এই চারটে মেয়ের মধ্যে ওই যে সবচেয়ে সুন্দর, ঝাঁকড়াচুলো, খুব জোরে জোরে হাসছে, রিঙ্কি, সে তাপসীর বড় মেয়ে। সবে চার বছর বয়স হয়েছে ওর। কোলেরটার সবে দুবছর বয়স। তাপসী তার নাম রেখেছে পিংকি। আজ তিনদিন ধরে পিংকির ভারি জ্বর। বাসুকে আজ সকালে প্রায় পায়ে ধরেছে, একবার ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ে আসার জন্য মেয়েটাকে। বাসু তখন তাপসীকে এক লাথি মেরে বেরিয়ে গেছে আপিসে।

বাসু, তাপসীর বর, শহরের একটা ইস্কুলে পিওনের চাকরি করে। সে ইস্কুল তাপসী কোনোদিন দেখেনি। তাপসী এই বুড়োতলা গ্রামে ক্লাস সিক্স অব্দি পড়েছে জুনিয়র হাই ইস্কুলে। সেই যে বছরে সে সিক্স থেকে সেভেনে উঠল, সেই বছর ওর বাবা মাথার শিরা ছিঁড়ে মারা গেল। তার কদিন পর, তাপসীর মনে নেই ঠিক কতদিন পর, ওর মেজমামা মাকে এসে বলল, ‘হ্যাঁরে, মেয়েটার বিয়ে দিবি? আমাদের দীনুর ছেলে সরকারি চাকরি পেয়েছে। শহরে ছেলেদের বড়ো ইস্কুলের পিওন। আমাদের তাপসীকে ওদের খুব পছন্দ। দেনা পাওনা কিছু নেবে না। এক কাপড়ে মেয়ে ঘরে নেবে ওরা।’ তাপসীর মা তখন উদাস চোখে উঠোনের নিম গাছটার দিকে চেয়ে দাওয়ায় বসে ছিল। নিম গাছের পাতা ঝরে ঝরে পড়ছিল খুব। একটু একটু ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছিল। গা শিরিশির করছিল তাপসীর। মা খুব ভাসা গলায় নিজেকেই যেন বলেছিল, ‘ওর বাবার খুব ইচ্ছা ছিল, মেয়েটাকে পড়ায়। ভালো মাথা ওর।’ তারপর আর কেউ কোনো কথা বলেনি। তাপসী আর দীনুর ছেলে বাসুর বিয়েটা হয়ে গেছিল। একই গ্রাম, শুধু দুটো পাড়া পরেই শ্বশুরবাড়ি। বিয়ের প্রথম দুটো বছর খুব আনন্দে কেটেছিল তাপসীর। শাশুড়ি বেশ আদর আহ্লাদ দিয়ে আগলে রেখেছিল ছেলের বৌকে। দুই বেয়ানের মধ্যেও ভাব ভালবাসার কমতি হয়নি। বাসু তার সদ্য কিশোরী বৌকে চোখে হারাচ্ছিল। স্মার্ট ফোন কিনে দিল সে বউকে। ইস্কুলের টিফিন টাইমে বউকে ভিডিওকল করত সে। তারপর যখন পনের বছর বয়স হল, প্রথমবার মা হল তাপসী। বুড়োতলা হেলথ সেন্টারে নাড়ি কাটা হল তার কন্যাশিশুটির। মা এসে মেয়েকে বাপের বাড়ি নিয়ে গেল।

আঁতুরে দুদিন কেটে গেলে তাপসী মোবাইলে ভিডিও কল করল বাসুকে। সাড়া না পেয়ে এমনি ফোনও করল। তিন তিনবার বাসুর ফোন ব্যস্ত দেখানোর পর রেগেমেগে আর ফোন করল না সে। ক’দিন পর সকালের দিকে বাসু হুড়মুড় করে এসে বসল তাপসীর বাপের বাড়ির দাওয়ায়। তারপর বসে থাকল তো বসেই থাকল। উঠল না, ঘরে ঢুকলো না, মেয়ের মুখ দেখল না সে। তাপসীর মা প্লেটে করে জল মিষ্টি এনে মুখের সামনে ধরল জামাইয়ের। তাপসীর ক্লাস সেভেনে ওঠা ভাই দাওয়ার বাঁশের খুঁটি ধরে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল, মায়ের হাতে ধরা মিষ্টির প্লেট জামাইবাবু এক ঝটকায় উড়িয়ে দিল আর সেই প্লেট গিয়ে পড়ল কলাগাছের ঝোপে। বাসু যেমনভাবে এসেছিল, তেমনভাবেই চলে গেল। তাপসী ঘরে বসে বসে অপেক্ষা করছিল, কখন বাসু দরজায় এসে মুখ বাড়াবে মেয়ের মুখ দেখতে। অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়েও পড়েছিল সে। মা দুপুরের ভাত নিয়ে এলে তাপসীর ঘুম ভাঙলো। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু জিজ্ঞাসা করেনি মেয়ে। ভারি আঁধার জমাট বেঁধে ছিল মায়ের মুখে। তাপসী নিঃশব্দে ভাতের দলাগুলো গিলে নিয়েছিল, মায়ের হাতের রান্না করা আদা-মরীচ দিয়ে পোনা মাছের ঝোল দিয়ে। পরের তিনমাসে আর কেউ আসেনি। পাড়া প্রতিবেশী শুনিয়ে গেছে, কি রে, মেয়ে বিয়োলে বুঝি ঘরে নেয় না তোর শ্বশুরবাড়িতে? কেউ কেউ এসে উপদেশ দিয়েছে পঞ্চায়েতে সালিশি দেওয়ার। কিন্তু দুই ভাইবোন আর মায়ের মুখে যেন কথা নেই, চোখে যেন ঘুম নেই।

তিনমাস পর দীনু এলো। স্বাভাবিক ভাবেই বলল, ‘কই গো মা লক্ষ্মী, নিতে এলাম তো! চলো, ঘরে চলো, মা। কই দেকি, আমার দিদুনকে দেকি!’ বলে একখান সোনার আংটি বের করল সার্টের পকেট থেকে। তাপসীর মা চোখ মুছতে মুছতে মেয়ের থলেখানি গুছিয়েগাছিয়ে দিল। নাতনির কপালে কাজলের এই বড়ো একখান টিপ পরিয়ে তার ওপর পাউডার লাগাতে লাগাতে কতবার যে চুমো খেল নাতনির মুখে, তার ইয়ত্তা নেই। তারপর হরেনের রিক্সা ডেকে নিয়ে এলো তাপসীর ভাই। সেই রিক্সায় শ্বশুরের সঙ্গে বসে কোলে মেয়ে নিয়ে সে দুটো পাড়া পরের শ্বশুরবাড়ি চললো। কিন্তু সেই শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছে ইশতক কেউ আর তার সঙ্গে কথা বলল না। খিদে পেলে রান্না ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও শ্বাশুড়ি ফিরে তাকালো না তার দিকে। বাসু তাপসীর সাথে নয়, তার মা-বাবার ঘরে শুচ্ছিল। একলা মেয়ে নিয়ে প্রায় বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছিল তাপসী আর বুঝবার চেষ্টা করছিল, কোন ভারি অন্যায়টা সে করেছে এদের সঙ্গে।

তারপর ধীরে ধীরে ম্যাজিকের মতো সব ঠিকঠাক হয়ে গেল। যেমন জায়গার জিনিস সব জায়গায় গুছিয়ে দিল কে। কচি মেয়ের খিলখিল হাসিতে, কপালের টিপে, ঘুরন্ত ফ্রকে, কোঁকড়ানো চুলে সবাই মজে গেল। বাসু আবার মেয়ে বৌয়ের সঙ্গে শুতে লাগলো। আর বছর না ঘুরতেই এ বাড়ির বেয়ান ও বাড়ির বেয়ানকে মোবাইলে কল করে জানালো- ‘এ বার গোপাল আসবেই। বুড়োবাবার থানে আমার মানত করা আছে কি আর এমনিই!’ শুনে ফোনের এপারে তাপসী এবং ওপারে তাপসীর মা, দুজনের বুকটাই ধক করে উঠলো কেন, কে জানে!

কিন্তু এবারেও গোপাল এলো না। তাপসী আবার একটি কন্যাশিশুর জন্ম দিল। ফুলো ফুলো হাত-পা আর নরম গোলাপী রঙের ত্বক সে কন্যার। এবারে তাপসীর বাপের বাড়িতে বাসু একদিনের জন্যও তাপসী আর মেয়েদের দেখতে এল না। ফোনে খবর নিল না কেউ। তবে হ্যাঁ, দীনু এলো পাঁচমাস পরে। আবার নিয়ে গেল তাপসীকে। কিন্তু এবারের নিয়ে যাওয়ার মধ্যে কোনো হইচই ছিল না। খুব নিঃশব্দে, সলজ্জে যেন নিয়ে গেল দীনু আদরের বৌমাকে তার। এখন আর তাপসীর সঙ্গে শ্বাশুড়ি কথা বলে না। এ বাড়িতে এসে অব্দি বাসুকে চোখে দেখেছে সে দু-তিনবার, কিন্তু কথা হয়নি। সে তার মায়ের ঘরেই থাকে। সকালে চাকরিতে যায়, সন্ধ্যেবেলা ফেরে। দীনু তার অভিমানী বৌমা আর বড় নাতনিটাকে ডেকে ডেকে খেতে দেয়। সেই কাকভোরে উঠে ছোট নাতনির জন্য দুধ নিয়ে আসে গয়লার বাড়ি থেকে। বিকেলবেলাটা বড় নাতনিকে নিজেই সাজিয়েগুজিয়ে নিয়ে পাড়ায় বেড়াতে বেরোয়। কেউ কেউ তখন জিজ্ঞেস করে তাকে, ‘ও দীনু, শুনলাম বাসুর বৌয়ের এবারেও মেয়ে হয়েছে?’ দীনু হেসে উত্তর দেয়, ‘হ্যাঁ গো, বড় সুন্দর নাতনী হয়েছে আমার’। সে উত্তরের পিঠে কেউ আবার বলে, ‘আহা গো, এবারেরটা ছেলে হলে বাসুর মায়ের বুক জুড়াতো। কত আশা ছিল তার, গোপাল আসবে এবার!’ শুনে দীনু বড় নাতনির হাত ধরে চলে যেতেযেতে উত্তর দিয়ে যায়, ‘সবই তাঁর ইচ্ছা। আমাদের আশার ওপর কি তিনি নির্ভর করেন গো!’ এভাবেই বছর ঘুরে যায়। শ্বাশুড়ি এক দুটো কথা এখন মাঝে সাঝে বলে ওঠে তাপসীকে। কিন্তু সে সবই বড়ো হা হুতাশের কথা। মেয়েবিয়োনো ছেলের বৌকে মুখে আগুন দিয়ে মেরে ফেলার ইচ্ছার কথাও মাঝে মাঝে ব্যক্ত করে ফেলে বাসুর মা। বাসু ইদানিং মদ খাওয়া ধরেছে, যেমন ধরে আরও পাঁচটা প্রতিবেশী জোয়ান মদ্দ পুরুষ এই বয়সে। খুব বেশি যেদিন মদ খাওয়া হয়ে যায়, সেদিন বাড়ি এসেই সোজা তাপসীর ঘরে ঢোকে। প্রথমে গুমগুম করে কিল মারে তার পিঠেবুকে। তারপর কয়েকগাছি চুল ছিঁড়ে নেয় মাথা থেকে। ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার মুখে ঘুমন্ত মেয়েদুটোকে লাথি মেরে যায়। মেয়েদেরকে শান্ত করতে গিয়ে তাপসীর নিজের মার খাওয়ার ব্যথা আর তেমন করে টের পাওয়া হয়ে ওঠে না সেই মুহূর্তে। কিন্তু পরের দিন সকালে আর সে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না ব্যথায়। দীনু এসে তাপসীকে দুটো ট্যাবলেট আর এক গ্লাস হলুদ দেওয়া দুধ দিয়ে যায় চুপিচুপি, তার বউ সকালে স্নানে গেলে নাতনিদের দীনুই স্নান করায়, খাওয়ায়।

এভাবেই সবাই বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। তাপসী বাপের বাড়ি যায় অবরে সবরে। তার ভাইয়ের গোঁফের রেখা উঠেছে ঠোঁটের ওপর। সামনের বছর সে মাধ্যমিক দেবে। তাপসী তার ভাইয়ের বইগুলো মন দিয়ে পড়ে। ভাইয়ের স্কুলের ব্যাগটা নাকের কাছে এনে শোঁকে। কীসের গন্ধ যে পেতে চায়, সে নিজেই জানে না, তবু শোঁকে। মাকে দেখে দাওয়ায় বসে বসে। দিন দিন কেমন শুকিয়ে যাচ্ছে তার মা, লক্ষ্য করে। দুদিন পরে মেয়েকে ব্যাগ গুছাতে দেখে মা বলে, ‘চললি?’ মেয়ে বলে, ‘হ্যাঁ মা, যাই’। পঁয়তিরিশ বছরের মা দেখে, তার উনিশ বছরের মেয়ের ঠোঁটের কোণে তখনো রক্ত জমাট বেঁধে আছে। কানের পাশের অনেকখানি জায়গায় চুল নেই। নাতনিদের ফিরতে দেখে দীনু খুশি হয়, কিন্তু কড়া অনুযোগও করে তাপসীকে ‘আর কটাদিন কাটিয়ে এলি না, মা? মায়ের কাছে কটাদিন বেশি থাকতে পারলি না?’

অভ্যাসটা দীনুই করিয়েছে তাপসীকে। বিকেলে মেয়েদের নিয়ে তাপসী নিজেই বেড়াতে আসে মনসাবাড়ির মাঠে ইদানিং। পিংকির মাথায় হাতটা দিয়েই বসে আছে সে। শ্বশুরমশাই দুপুরবেলা ওষুধ এনে খাইয়ে দেবার পর জ্বরটা নেমেছিল একটু। এখন আবার আসছে, কপালটা গরম হয়ে আসছে বেশ। ঝুপ করে সন্ধে নামার আগেই বাড়ি ফিরে যেতে হবে। জ্বর গায়ে মেয়েকে বের করবে না ভেবেছিল, কিন্তু মেয়েটা নিজেই এমন ঘ্যানঘ্যান করতে শুরু করল, যে বের হয়ে এলো শেষ অব্দি। মনসাথানের ডানপাশে একটা অনেক পুরনো উইয়ের ঢিবি। তাপসী জানে, এর নীচে অজস্র সুড়ঙ্গের মতো পথ চলে গেছে। একটু আগে সাপটা ওই ঢিবির তলাতেই ঢুকেছে। ঠান্ডা রক্ত ওর। তাই শীতকালে মাটির ওপরের ঠান্ডায় ও বেঁচে থাকতে পারবে না। মাটির ভিতরের ওমের মধ্যে কাটাবে তখন। শীতটা চলে গেলেই আবার উঠে আসবে মাটির ওপর। শরীরটা বড়ো হবে যেই, খোলস ছেড়ে দেবে। সাপের চামড়া বড়ো হয় না। তাই শরীর বড়ো হয়ে গেলে পুরনো ছোট হয়ে যাওয়া চামড়াটা ছোট হয়ে যাওয়া জামার মতো ফেলে দিতে হয় তাদের। তাপসী পিংকিকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। রিংকিকে হাঁক পেরে ডেকে নেয়। ওর হাত ধরে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। কদিন ধরে তাপসীর নিজের শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। গত মাসে একদিন বাসু মদ খেয়ে এসে মারধোর করার পর হঠাৎ বিছানায় ফেলে ঠেসে ধরলো ওকে। তারপর নিজের যৌনসুখ মিটিয়ে নিল শরীর ভরে। সে সুখ মিটিয়ে নেবার এতো জোর, যে তাপসী প্রায় অজ্ঞান হয়ে গেছিল। পিংকির কান্নায় মাঝরাতে জ্ঞান এসেছিল যেন, এমনটাই মনে হয় তার। এখন শুধু একটাই ভয়, আবার মা হবে না কি সে? আবার যদি গোপাল না আসে? আবার যদি মেয়ে বিয়োয় সে? তাহলে এবারে হয়তো তাপসীকে প্রাণেই মেরে ফেলবে বাসু আর তার মা।

রবিবার দিন বাসুর ছুটি থাকে ইস্কুলে। সেদিন সে তাপসীকে সদরে নিয়ে গেল ডাক্তার দেখাবে বলে। ডাক্তারের চেম্বারে একটা পর্দা ঢাকা ঘরের মধ্যে তাকে নিয়ে গেল একজন আয়া ধরনের মেয়ে। সেখানে সোনোগ্রাফি মেশিন রাখা। সে তো আগের দুবারেও সোনোগ্রাফি হয়েছে, কিন্তু এতো প্রথম দিকে তো নয়! বাসুর দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো সে। বাসু চোখ ঘুরিয়ে নিল।

চেম্বার থেকে বাড়ি ফেরার পথে একটাও কথা বললো না বাসু। টোটোর বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলো। বাড়ি ঢুকেই মায়ের সঙ্গে গুজগুজ করে কী সব কথা সারলো। তারপর বেরিয়ে গেল আবার। ফিরে এলো একটা ওষুধের প্যাকেট নিয়ে। প্যাকেটটা হাতে নিয়েই চমকে উঠলো তাপসী। খবরের কাগজ পড়া ওর অভ্যাস। কাগজের বিজ্ঞাপনে এই ওষুধটার ছবি দিয়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা থাকে, ‘সাবধান! গর্ভাবস্থায় গর্ভপাত ঘটাতে পারে!’ তাপসী ঘাড় গোঁজ করে বলল, ‘আমি খাবো না এটা’। ‘তোর চোদ্দোগুষ্টি খাবে, শালী! আবার মেয়ে এসেছ পেটে তোর!’ বলে জোর করে মায়েতে আর ছেলেতে ধরে ওষুধটা গিলিয়ে দিল ওকে। তাপসী গলায় আঙুল দিয়ে বমি করতে যাচ্ছিল। বাসু ওর হাতদুটো পিছমোড়া করে বেঁধে দিল। ওর মা মুখের মধ্যে একটা রুমাল ঢুকিয়ে দিল, যাতে সে বমি না করতে পারে। সারাদিন ওইভাবে পড়ে রইল সে ঘরের মেঝেয়। পেচ্ছাপ হয়ে গেল বিকেলের দিকে ওই অবস্থাতেই। ঘরের শিকল বাইরে থেকে টানা। মেয়েদের গলার আওয়াজ, কান্নার আওয়াজ, তাদেরকে মারধোরের আওয়াজ, সবই কানে আসছে তার। শ্বশুর আজ বাড়ি নেই তার। পিসশ্বাশুড়ির বাড়ি গেছে। রাতে ফিরবে। পেটে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়েছে তাপসীর। ব্লিডিং হচ্ছে টের পাচ্ছে এবার। পেচ্ছাপে রক্তে কাপড় ভেজা, ঠান্ডা মেঝের ওপর পড়ে কেঁপে যাচ্ছে সে হি হি করে। একটু যেন পায়খানাও হয়ে গেল এবার। প্রাণপনে গোঙাচ্ছে তাপসী। মেয়েদুটোকে খুব পেটাচ্ছে বাসু। ওরা মাঠে যেতে চাইছে। ঘ্যান ঘ্যান করছে। বাসু তত পেটাচ্ছে। এমন সময় দীনুর গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। চীৎকার করে মেয়েদুটোকে ছিনিয়ে নিল সে বাসুর হাত থেকে। ঝনাৎ করে শিকল খোলার আওয়াজ পেল তাপসী। তাপসীকে মেঝেতে ওই অবস্থায় দেখে আর্তনাদ করে উঠল দীনু। চীৎকার করে আশেপাশের কয়েক বাড়ি থেকে লোক ডেকে এনে প্রথমে তাপসীকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করল। প্রচুর ব্লিডিং হয়ে গেছে। শরীরের তাপমাত্রা কমে গেছে। ‘সদর হসপিটালে নিয়ে যান’, বলে দিল নার্স দিদি। ডাক্তার নেই আজ এখানে, রবিবারে থাকে না। তাপসী বলল, ‘মার কাছে যাব, বাবা, আমাকে মার কাছে নিয়ে চলুন।’ দীনু এক মুহূর্ত ভাবলো, তারপর তাপসীকে তার মায়ের কাছে রেখে আসলো সে। নাতনি দুটোকে কিছুক্ষণ আগেই রেখে এসেছিল সে বেয়ানের বাড়িতে। ফিরে যাবার আগে তাপসীর মাথায় অনেকক্ষণ ধরে হাতটা রাখল দীনু। ওষুধগুলো সব বুঝিয়ে দিল ওর মা আর ভাইকে।

সাতদিন কেটে গেছে। তাপসী দাওয়ায় এসে বসেছে আজ প্রথম। আজ পূর্ণিমা। চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে উঠোন, কলাবাগান, গাঁদা গোলাপ চন্দ্রমল্লিকার চারাগুলো। ওদিকে পুকুরধারে যাবার রাস্তায় একটা উইয়ের ঢিবি ছিল। এখনও আছে কি না কে জানে। মা রান্নাঘরে। ভাই পড়ছে। তাপসী দাওয়া থেকে উঠে ঘরে এলো। ঠান্ডা পড়েছে বেশ। চাদরটা গায়ে জড়াতে গিয়ে কী যে হল, চাদরটা চেপে ধরল ঘুমন্ত মেয়েদুটোর মুখের ওপর, চেপে, খুব চেপে। মেয়েদুটোর শরীরদুটো একটু ছটফট করেই শান্ত হয়ে গেল। তাপসী দুজনকে দুই কাঁধে নিয়ে চাদরটা চাপা দিয়ে ঘর পেরিয়ে দাওয়া থেকে নেমে উঠোন পেরিয়ে সোজা হাঁটা লাগালো উইঢিবির দিকে। সেখানে পৌঁছে মেয়েদুটোকে মাটিতে শুইয়ে দিল। একটা গাছের ডাল কুড়িয়ে এনে ঢিবির মাটি খুঁড়তে লাগলো। অনেকখানি ঝুরঝুরে মাটি তুলে ফেললো হাত দিয়ে খুঁড়ে। বাহ, বেশ সুন্দর হয়েছে, মনে মনে ভাবলো তাপসী। তারপর পাশাপাশি সেখানে শুইয়ে দিল তার রিংকি আর পিংকিকে। চাদরটা দিয়ে ঢাকা দিল ওদেরকে যত্ন করে। তারপর ঝুরঝুরে মাটি দিয়ে ঢেকে দিল দুজনকে। ‘থাক রে সোনামেয়েরা, শীতঘুমে রেখে গেলাম তোদেরকে। মাটির ওপরে আদর, যত্ন বড্ড কম। ভালোবাসার ওম নেই। এখানে থাক। ওম পাবি।’ তারপর পুকুরধারের পাশ দিয়ে যে পথটা জঙ্গলের দিকে চলে গেছে, সেই পথটা ধরে হি হি করে হাসতে হাসতে সে এগিয়ে গেল। শীতকালে দরজা জানালা বন্ধ করে বসে থাকা বাড়ির লোকগুলো কেউ তাপসীর সেই হি হি হাসির মধ্যেকার হাহাকার শুনতে পেল না।



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *