দীপু মাহমুদ
তরুণের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বয়স আনুমানিক ২০ বছর। মাথাভর্তি ঘন কালো চুল। অসম্ভব সুন্দর দেখতে ছিল বলে পুলিশ কনস্টেবল জানিয়েছে। ফরসা মুখ। এখন সেখানে কালচে রক্ত জমাট বেঁধে বীভৎস হয়ে আছে। তিনদিন আগে পুলিশের সাথে এনকাউন্টারে মারা গেছে। দৌড়ে পালানোর সময় পুলিশ তাকে পেছন থেকে গুলি করেছে পরপর তিনটা। সে তখন হোঁচট খেয়ে পড়েছে পাথরের ওপর। তাতে তার মুখ থেঁতলে গেছে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট যদি বদলে ফেলা না হতো তাহলে দেখা যেত তরুণ গুলির সামনে বুক পেতে দিয়েছিল। তাকে গুলি করা হয়েছে সামনে থেকে আর তার মুখ থেঁতলে দেওয়া হয়েছে ভারী কোন পাথর ঠুকে।
এ সময়ের মোস্ট ওয়ান্টেড তরুণের মাকে নিয়ে আসা হয়েছে লাশ সনাক্ত করার জন্য। দেশের শাসন কিংবা বিচার ব্যবস্থা কোনোটাতেই তরুণ আস্থা রাখতে পারেনি। দেশের শীর্ষ প্রতারক আর স্মাগলারদের তালিকা তৈরি করে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়েছে তাদের ওপর। রাষ্ট্রের ক্ষমতাশালীদের সাথে থেকে যারা দেশের মানুষের সাথে চাতুরি করে হাজার কোটি অবৈধ টাকার মালিক হয়ে গেছে, তাদের তিনজনকে হত্যা করেছে। পুলিশ জানিয়েছে, ভোররাতে তরুণকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তার দলের অন্যদের ধরতে। এনকাউন্টারের ঘটনা তখন ঘটেছে। দেশের ভেতর বেশ শক্তিশালী দল গড়ে উঠেছে যারা দেশের বড় প্রতারকদের হত্যার মিশনে নেমেছে। এই দলের সকলেই বয়সে তরুণ।
হিমঘরে মা দাঁড়িয়ে আছেন। সামনে নম্বর লেখা সারিসারি বক্স। চারশো ছাপ্পান্ন নম্বর বক্সে তার সন্তানের লাশ রাখা আছে। তিনি ঠিক করেছেন কাঁদবেন না। মায়ের চোখ উপচে পানি বেরিয়ে আসতে চাইছে।
পুলিশ অফিসার বললেন, ছেলেটাকে মানুষ করতে পারলেন না?
মা ভেবেছিলেন কিছু বলবেন না। পুলিশ অফিসার আবার খরখরে গলায় বললেন, নষ্ট করে ফেললেন ছেলেকে!
শান্ত হয়ে এসেছেন মা। অনেকদিনের জমাট লড়াই তাকে শক্ত করে এনেছে। তিনি গভীর গলায় বললেন, সে কেবল ভাল থাকতে চেয়েছিল। দেশ ভাল থাকলে সে ভাল থাকত। সবাইকে নিয়ে ভাল থাকার স্বপ্ন দেখেছিল। আমরা তাকে ভাল থাকতে দেইনি।
চারশো ছাপ্পান্ন নম্বর বক্স বের করা হয়েছে। মা খেয়াল করলেন তিনি কাঁদছেন না। তার চোখ শুকিয়ে এসেছে। বক্সে তার সন্তানের লাশ। তিনি স্থির চোখে বললেন, মানুষ কখনো নষ্ট হয় না। তাকে নষ্ট বানানো হয়।
পুলিশ অফিসার ছাপানো ফর্ম এগিয়ে দিলেন। মনে হচ্ছে তার খুব তাড়াহুড়ো আছে। আচমকা তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অস্থির গলায় বললেন, এখন এসব বলে কী হবে? সিগনেচার করুন।
শুকনো চোখে মা বললেন, নষ্ট শব্দটা একটা লেবেল। যেটা সময় সুযোগমতো সেঁটে দেওয়া হয়।
থমকে গেছেন পুলিশ অফিসার। তার মনে হলো ঝাঁকুনি খেয়ে লাশ নড়ে উঠেছে। তিনদিনের হিমশীতল লাশ নড়ে ওঠার কথা না। তিনি তাড়াতাড়ি লাশ গাড়িতে তুলতে চাইলেন। সন্তানের মুখের ওপর থেকে কাপড় সরানো হয়েছে। পুলিশ অফিসার বললেন, ভালো করে দেখে নিন। যদিও পাথরে থেতলে মুখ চেনার কোনো উপায় নেই। শরীরে অন্য কোনো চিহ্ন দেখতে পারেন।
লাশের শরীর ঢাকা আছে যে কাপড় দিয়ে সেটা সরিয়ে নেওয়া হলো। লাশের বা হাতের কড়ে আঙুলের সাথে পাশের আঙুল জোড়া লাগানো। বুড়ো আঙুলের পাশে ছোটো আরেকটি আঙুল। মা নিশ্চিত হয়ে গেলেন এ তার সন্তানের লাশ।
মায়ের হাত কাঁপছে। তার হাতে ছাপানো ফর্ম। তিনি সন্তানের লাশ বুঝে নেবেন।
মা শুকনো চোখে শীতল গলায় বললেন, এ লাশ আমার সন্তানের নয়।
চমকে উঠেছেন পুলিশ অফিসার। তিনি হতভম্ব চোখে তাকালেন মায়ের মুখের দিকে। মায়ের চোখমুখে অনিশ্চয়তার ছায়া। লাশ সনাক্ত করতে আসার আগে সন্তানের বাবা বললেন, যে গেছে তাকে কোনোদিন ফিরে পাব না। এ সমাজে বেঁচে থাকতে হবে আমাদের। কেউ বলবে না দেশের মানুষের মুক্তির জন্য আমাদের সন্তান বিপ্লব করতে চেয়েছিল। সে বিদ্রোহ করেছিল তাও বলবে না। বলবে সে ছিল সন্ত্রাসী। তুমি-আমি একজন নামকরা সন্ত্রাসীর মা-বাবা হয়ে যাব!
পুলিশ অফিসার ফর্ম বদলে দিলেন। বললেন, এ লাশ আপনার সন্তানের নয়, ফর্মে সেকথা লেখা আছে। সিগনেচার করুন।
মা ফর্মে সিগনেচার করলেন। তার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। চোখের পানি পড়েছে সিগনেচারের ওপর। চোখের পানিতে সিগনেচার লেপটে গেছে। তিনি নিজের অস্পষ্ট নামের দিকে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে আছেন। আশপাশ ঝাপসা হয়ে আসছে। আকুল হয়ে মা একবার সন্তানের মুখ দেখতে চাইলেন। ঝাপসা চোখে তিনি কিছুই দেখতে পেলেন না।
মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল মেয়েটি। পেশায় সাংবাদিক। ফ্রিল্যান্স। মেয়েটি পুলিশ অফিসারের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ আগেও তার চোখে ক্রোধ ছিল। এখন বিষণ্ণতা। মেয়েটি বিষণ্ণ চোখ তুলে বলল, অস্থির সময় তাকে নিয়ে গেছে ভুল পথে। তরুণের কোন দোষ ছিল না।
পুলিশ অফিসার রাগ করলেন না। তাকে বেশ সহানুভূতিশীল দেখাচ্ছে। তিনি নরম গলায় বললেন, তার লাশ কেউ দাবি করছে না! লাশের পরিচয় কী?
মেয়েটি তখনও একইভাবে বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। পুলিশ অফিসার বললেন, আপনি নিশ্চয় বলবেন, লাশের পরিচয় এ প্রজন্মের বিভ্রান্ত তরুণ? সে দায়ও তো কেউ নিচ্ছে না! একটা প্রজন্ম তো বেওয়ারিশ হয়ে যেতে পারে না।
এই প্রথম মেয়েটির চোখের তারা ঝিলিক দিয়ে উঠল। সে গলায় জোর এনে বলল, এ লাশ আমাকে দিয়ে দিন।
পুলিশ অফিসার বললেন, কে হয় সে আপনার?
মেয়েটি বলল, সে আমার পরমজন।
পুলিশ অফিসার বললেন, আপনিও তো এ প্রজন্মের একজন!
মেয়েটির মুখে অদ্ভুত হাসি দেখা গেল। সে হাসি ক্রোধ, ঘৃণা, বিদ্বেষ আর ভালোবাসা মেশানো। মেয়েটি স্থির গলায় বলল, সেজন্যই এ দায় আমি নিচ্ছি। আমরা পথ খুঁজে নিতে পারিনি।
মা আঁচল ছড়িয়ে মেয়েটিকে বুকের ভেতর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠলেন।
এ সময়ের মোস্ট ওয়ান্টেড তরুণের মাকে নিয়ে আসা হয়েছে লাশ সনাক্ত করার জন্য। দেশের শাসন কিংবা বিচার ব্যবস্থা কোনোটাতেই তরুণ আস্থা রাখতে পারেনি। দেশের শীর্ষ প্রতারক আর স্মাগলারদের তালিকা তৈরি করে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়েছে তাদের ওপর। রাষ্ট্রের ক্ষমতাশালীদের সাথে থেকে যারা দেশের মানুষের সাথে চাতুরি করে হাজার কোটি অবৈধ টাকার মালিক হয়ে গেছে, তাদের তিনজনকে হত্যা করেছে। পুলিশ জানিয়েছে, ভোররাতে তরুণকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তার দলের অন্যদের ধরতে। এনকাউন্টারের ঘটনা তখন ঘটেছে। দেশের ভেতর বেশ শক্তিশালী দল গড়ে উঠেছে যারা দেশের বড় প্রতারকদের হত্যার মিশনে নেমেছে। এই দলের সকলেই বয়সে তরুণ।
হিমঘরে মা দাঁড়িয়ে আছেন। সামনে নম্বর লেখা সারিসারি বক্স। চারশো ছাপ্পান্ন নম্বর বক্সে তার সন্তানের লাশ রাখা আছে। তিনি ঠিক করেছেন কাঁদবেন না। মায়ের চোখ উপচে পানি বেরিয়ে আসতে চাইছে।
পুলিশ অফিসার বললেন, ছেলেটাকে মানুষ করতে পারলেন না?
মা ভেবেছিলেন কিছু বলবেন না। পুলিশ অফিসার আবার খরখরে গলায় বললেন, নষ্ট করে ফেললেন ছেলেকে!
শান্ত হয়ে এসেছেন মা। অনেকদিনের জমাট লড়াই তাকে শক্ত করে এনেছে। তিনি গভীর গলায় বললেন, সে কেবল ভাল থাকতে চেয়েছিল। দেশ ভাল থাকলে সে ভাল থাকত। সবাইকে নিয়ে ভাল থাকার স্বপ্ন দেখেছিল। আমরা তাকে ভাল থাকতে দেইনি।
চারশো ছাপ্পান্ন নম্বর বক্স বের করা হয়েছে। মা খেয়াল করলেন তিনি কাঁদছেন না। তার চোখ শুকিয়ে এসেছে। বক্সে তার সন্তানের লাশ। তিনি স্থির চোখে বললেন, মানুষ কখনো নষ্ট হয় না। তাকে নষ্ট বানানো হয়।
পুলিশ অফিসার ছাপানো ফর্ম এগিয়ে দিলেন। মনে হচ্ছে তার খুব তাড়াহুড়ো আছে। আচমকা তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অস্থির গলায় বললেন, এখন এসব বলে কী হবে? সিগনেচার করুন।
শুকনো চোখে মা বললেন, নষ্ট শব্দটা একটা লেবেল। যেটা সময় সুযোগমতো সেঁটে দেওয়া হয়।
থমকে গেছেন পুলিশ অফিসার। তার মনে হলো ঝাঁকুনি খেয়ে লাশ নড়ে উঠেছে। তিনদিনের হিমশীতল লাশ নড়ে ওঠার কথা না। তিনি তাড়াতাড়ি লাশ গাড়িতে তুলতে চাইলেন। সন্তানের মুখের ওপর থেকে কাপড় সরানো হয়েছে। পুলিশ অফিসার বললেন, ভালো করে দেখে নিন। যদিও পাথরে থেতলে মুখ চেনার কোনো উপায় নেই। শরীরে অন্য কোনো চিহ্ন দেখতে পারেন।
লাশের শরীর ঢাকা আছে যে কাপড় দিয়ে সেটা সরিয়ে নেওয়া হলো। লাশের বা হাতের কড়ে আঙুলের সাথে পাশের আঙুল জোড়া লাগানো। বুড়ো আঙুলের পাশে ছোটো আরেকটি আঙুল। মা নিশ্চিত হয়ে গেলেন এ তার সন্তানের লাশ।
মায়ের হাত কাঁপছে। তার হাতে ছাপানো ফর্ম। তিনি সন্তানের লাশ বুঝে নেবেন।
মা শুকনো চোখে শীতল গলায় বললেন, এ লাশ আমার সন্তানের নয়।
চমকে উঠেছেন পুলিশ অফিসার। তিনি হতভম্ব চোখে তাকালেন মায়ের মুখের দিকে। মায়ের চোখমুখে অনিশ্চয়তার ছায়া। লাশ সনাক্ত করতে আসার আগে সন্তানের বাবা বললেন, যে গেছে তাকে কোনোদিন ফিরে পাব না। এ সমাজে বেঁচে থাকতে হবে আমাদের। কেউ বলবে না দেশের মানুষের মুক্তির জন্য আমাদের সন্তান বিপ্লব করতে চেয়েছিল। সে বিদ্রোহ করেছিল তাও বলবে না। বলবে সে ছিল সন্ত্রাসী। তুমি-আমি একজন নামকরা সন্ত্রাসীর মা-বাবা হয়ে যাব!
পুলিশ অফিসার ফর্ম বদলে দিলেন। বললেন, এ লাশ আপনার সন্তানের নয়, ফর্মে সেকথা লেখা আছে। সিগনেচার করুন।
মা ফর্মে সিগনেচার করলেন। তার চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। চোখের পানি পড়েছে সিগনেচারের ওপর। চোখের পানিতে সিগনেচার লেপটে গেছে। তিনি নিজের অস্পষ্ট নামের দিকে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে আছেন। আশপাশ ঝাপসা হয়ে আসছে। আকুল হয়ে মা একবার সন্তানের মুখ দেখতে চাইলেন। ঝাপসা চোখে তিনি কিছুই দেখতে পেলেন না।
মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল মেয়েটি। পেশায় সাংবাদিক। ফ্রিল্যান্স। মেয়েটি পুলিশ অফিসারের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ আগেও তার চোখে ক্রোধ ছিল। এখন বিষণ্ণতা। মেয়েটি বিষণ্ণ চোখ তুলে বলল, অস্থির সময় তাকে নিয়ে গেছে ভুল পথে। তরুণের কোন দোষ ছিল না।
পুলিশ অফিসার রাগ করলেন না। তাকে বেশ সহানুভূতিশীল দেখাচ্ছে। তিনি নরম গলায় বললেন, তার লাশ কেউ দাবি করছে না! লাশের পরিচয় কী?
মেয়েটি তখনও একইভাবে বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। পুলিশ অফিসার বললেন, আপনি নিশ্চয় বলবেন, লাশের পরিচয় এ প্রজন্মের বিভ্রান্ত তরুণ? সে দায়ও তো কেউ নিচ্ছে না! একটা প্রজন্ম তো বেওয়ারিশ হয়ে যেতে পারে না।
এই প্রথম মেয়েটির চোখের তারা ঝিলিক দিয়ে উঠল। সে গলায় জোর এনে বলল, এ লাশ আমাকে দিয়ে দিন।
পুলিশ অফিসার বললেন, কে হয় সে আপনার?
মেয়েটি বলল, সে আমার পরমজন।
পুলিশ অফিসার বললেন, আপনিও তো এ প্রজন্মের একজন!
মেয়েটির মুখে অদ্ভুত হাসি দেখা গেল। সে হাসি ক্রোধ, ঘৃণা, বিদ্বেষ আর ভালোবাসা মেশানো। মেয়েটি স্থির গলায় বলল, সেজন্যই এ দায় আমি নিচ্ছি। আমরা পথ খুঁজে নিতে পারিনি।
মা আঁচল ছড়িয়ে মেয়েটিকে বুকের ভেতর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠলেন।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন