short-story-ichhevuter-apekshai

ইচ্ছেভূ্তের অপেক্ষায়
সুমন মহান্তি



মর্নিং ওয়াক সেরে কমলেশ চেয়ারে বসেছেন। টেবিলে ল্যাপটপ, মাথায় হাজার চিন্তার বুড়বুড়ি। অনেকদিন হল গল্প লেখা হয়নি। উপন্যাস শেষ করেই কমলেশ গল্পের জন্য ছটফটানি টের পাচ্ছেন। একটা নতুন গল্পের সৃষ্টি না করে শান্তি পাবেন না তিনি।
সবে ল্যাপটপ খুলে মাইক্রোসফট উইনডোজে ঢুকেছেন এমন সময় কানের কাছে ফিসফিস শুনতে পেলেন কমলেশ। অবাক হয়ে পেছনে তাকিয়েও কাউকে দেখতে পেলেন না। নিজের মনেই হাসলেন একবার, কাল্পনিক ফিসফিসানি নিয়ে বিক্ষিপ্ত হওয়া ঠিক নয়।
“ওদিকে দেখছ কী? আমাকে দেখা যায় না, টের পাওয় যায়।’’
কমলেশ চমকে উঠে জিজ্ঞাসা করেন, “কেন? আপনি কি অদৃশ্য মানুষ?’’
“না। আমি একজন ভূত। শুনে আঁতকে ওঠার কিছু নেই। ভয় পেয়ো না। লেখকদের আমি খুব পছন্দ করি। ইহজীবনে প্রচুর লেখালেখি করতাম। তুমিও একই লাইনের। তাই টের পেয়ে তোমার কাছেই এলাম।’’
“ও!’’
“আসল পরিচয়টা দিয়েই ফেলি। ভূতেদের সমাজেও লেখকদের জায়গা আছে, তাদের বিশেষ পরিচয় রাখা হয়। আমি হলাম গিয়ে ‘গ’ ভূত।”
“বুঝলাম না।”
“গল্পের ভূতেদের ওখানে সংক্ষেপে ওই নামে ডাকা হয়। মানে যারা গল্প লেখেটেখে তাদের ওই ক্লাসে ফেলা হয়েছে। এখন ভূতলোকে মাত্র একডজন ‘গ’ ভূত রয়েছে।’’
কমলেশ মজার ছলে জানতে চাইলেন, “সংখ্যাটা কম না বেশি?’’
“একেবারেই কম। তার জন্য তোমরাই দায়ী।”
অবাক হলেন কমলেশ, “আমরা?’’
“হ্যাঁ, তোমরাই। ইহলোকের ট্রেন্ড ওখানেও ফলো করা হয়। তোমরাই তো যা তা শুরু করেছ। গল্পে কাহিনী রাখছ না। বলছ যে ছোটগল্প, এদিকে গল্পের গ-টুকুও নেই। তেঁতুলজলে তেঁতুল থাকবে না, এ কেমন কথা? তেঁতুল ছাড়া ফুচকায় স্বাদ আসে? বাকি লেখকভূতেরা একদম পাত্তা দেয় না। উলটে ঠেস মারে। আমি নাকি অচল, সেকেলে! ওখানে আমরা এই কয়েকজন বলতে গেলে একঘরে হয়ে আছি। কেউ ডাকে না, আলোচনার যোগ্যই মনে করে না। তা তুমি গল্পে কাহিনী রাখ তো?’’
“না। মানে— ওই আসলে।’’
কমলেশকে থামিয়ে দিয়ে ‘গ’ ভূত বলল, “বুঝেছি। তোমাকেও রোগে ধরেছে। আধুনিকতার নামে কি যে সব অনাসৃষ্টি করে চলেছ! তোমাদের ঠেলায় আমাদের অস্তিত্বটাই বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে। এই টুলটার ওপর বসি?’’
কমলেশ ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন। যেখানে ইচ্ছে বসুক, তাঁর কোনও সমস্যা নেই। তিনি তো আর চোখে দেখতে পাচ্ছেন না।
ছিঁচকাঁদুনে সুরে ‘গ’ ভূত বলে চলল, “মনের ক্ষোভ কাকে আর বলি? এককালে আমার কি সাংঘাতিক দাপট ছিল। চারদিকে শুধু আমাদের শ্রেণীর জয়জয়কার। আহা, ঠাসবুনোট কাহিনী, কাহিনীর মোচড়, পরতে পরতে চমক, মাঝেমধ্যে নাটকীয়তা, জমজমাট কান্ড। পাঠক ধরলে ছাড়তে পারত না, নাওয়া-খাওয়া ভুলে যেত। গল্প ছাড়া কি গল্প-উপন্যাস জমে?’’
কমলেশ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তাঁর শেষ চারটি উপন্যাসই মুখ থুবড়ে পড়েছে, বিক্রি তেমন হয়নি। প্রকাশক-পাঠক অভিযোগ করেছেন যে গল্প জমাতে পারছেন না তিনি। একঘেয়ে, ক্লান্তিকর বর্ণনা এবং অকারণ কাব্যিক ভাষা, মন্থর গতি। জোর করে ধ্রুপদী রীতি আনতে গিয়ে লেখাগুলো ডুবিয়েছেন।
‘গ’ ভূত উত্তরের অপেক্ষা না করে বলল, “জম্পেশ কাহিনী ছাড়া কথাসাহিত্য জমে না হে। এখনও পাঠকেরা একখানা নিটোল কাহিনী পেলে খুশি হয়। না হলে কোনও আকর্ষণই থাকে না। বাজারে কাহিনীই চলে, বিকোয়, প্রশংসা পায়। কয়েকপিস গম্ভীরমুখো আঁতেলদের খুশি করার জন্য অস্থির হওয়াটা ভুল। মনের দুঃখে ওরা মাথা নেড়ে ‘রাবিশ’ ‘ক্লিশে’ ‘ব্যাকডেটেড’ এইসব শব্দে আক্রমণ করবে। পাত্তা না দিলেই হল। তা তুমি বাপু ওই সব ছন্নছাড়া অনামুখোদের দলে যোগ দিয়ো না। মনে রেখো গোলগাল কাহিনী ছাড়া যে গল্প-উপন্যাস তা উইপোকার পেটে যায়, বইগুলোর ওপরে আরশোলা ভারতনাট্যম নৃত্য করে। উপদেশটা মাথায় রেখে পরের লেখাগুলো ভাববে, বুঝেছ?’’
কমলেশ মৌন থাকলেন।
‘গ’ ভূত বলল, “ডিসটার্ব করব না। তুমি দেখছি কি-বোর্ডে আঙুল রেখে বসে আছ। একখানা জমজমাট কাহিনী নামিয়ে ফেল এবার। এমন লেখা লেখ যা সবাইকে চুম্বকের মতন টানবে। আমি তাহলে এখন আসি।’’
আর কোনও ফিসফিসানি, নাকি কাঁদুনি শুনতে পেলেন না কমলেশ। বুঝলেন যে ‘গ’ ভূত আপাতত অন্তর্হিত হয়েছে।

মুচকি হেসে গল্পের শিরোনামের প্রথম অক্ষরটি টাইপ করলেন কমলেশ। পরের অক্ষর টাইপ করার আগেই বাঁদিকে কারও ঝটপটানি শুনতে পেলেন তিনি।
“রক্তিম সেলাম। পরিচয়টা দিয়েই ফেলি আগে। আমি হলাম ‘ক’ ভূত। তুমি দেখছি লিখতে চলেছ। তা লিখবে কী?’’
কমলেশ বিনীতভাবে বললেন, “ওই, যা হোক একটা কিছু, এখনও সেভাবে ঠিক করিনি। নামকরণ করি আগে।”
“যা হোক একটা কিছু! বলছ কি তুমি! লেখালেখি হল বৈপ্লবিক কর্মকান্ডের এক অঙ্গ। সেখানে ব্যক্তিগত ইচ্ছে-অনিচ্ছে গুরুত্ব পাবে না।’’
তর্কে না গিয়ে কমলেশ হাসেন, “আচ্ছা। একটু বুঝিয়ে দিলে ভাল হত।’’
“অবশ্যই। তবে টুলে না দাঁড়িয়ে কিছু বলতে পারব না।’’
“বেশ তো। দাঁড়িয়েই পড়ুন তাহলে।”
“ঘুরে দাঁড়ানোর কথা তো ভাবতেই হবে,’’ ‘ক’ ভূত বলল, “শুরু করি তাহলে?’’
“হ্যাঁ।’’
‘ক’ ভূত বলে চলল, “শোন, কলম হল সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার। ল্যাপটপের কী-বোর্ডকেই কলম ভেবে নিতে হবে। সামাজিক দায়বদ্ধতা যার নেই সে কোনও লেখকই নয়। লেখক দেখাবে দুনিয়া বদলের স্বপ্ন, সংগ্রামের নতুন দিশা। প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা লেখার লাইনে লাইনে তুলে ধরতে হবে, বঞ্চনা এবং শোষণের বিরুদ্ধে আগুন হয়ে উঠতে হবে। পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী ফ্যাসিস্ত শক্তি ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লেখক জেহাদ ঘোষণা করবে। তার কলম কাম কী-বোর্ড হয়ে উঠবে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের এক অস্ত্র।’’
কমলেশ বলে ফেললেন, “আজ্ঞে, ল্যাপটপ ছেড়ে কোদাল বা টাঙি ধরলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। লিখে কী হবে?’’
ঝাঁঝিয়ে উঠল ‘ক’ ভূত, “প্রতিক্রিয়াশীলদের মতন কথা বলো না। নিশ্চয়ই তুমি প্রতিষ্ঠানের কাগজে লেখ?’’
“আজ্ঞে, টুকটাক, মাঝেসাঝে বেরোয়।”
“খবরদার, লিখবে না ওখানে। পেটি-বুর্জোয়া, রুলিং ক্লাসের ধামাধরা লেখকেরাই প্রতিষ্ঠানের কাগজে লেখে। ওরা তোমাকে বিপথগামী করবে, ফরমায়েশি লেখা লিখিয়ে নেবে, দরকার ফুরোলে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। বাণিজ্যিক কাগজের পা-চাটা ক্রীতদাস হবে না একদম।’’
কমলেশ জিজ্ঞাসা করলেন, “ওখানে লিখলে জাত যায় বলছেন? মানে বলছিলাম যে বাণিজ্যিক কাগজে না লিখেই কি বিপ্লবী সাজা যায়?’’
“অবশ্যই। তুমি কমল মিত্রর নাম শুনেছ?’’
কমলেশ ঘাড় নাড়েন, “শুনেছি। বিজ্ঞাপনে দেখি, এতবছর লিখিয়াও যিনি বাণিজ্যিক কাগজে একটি অক্ষরও লেখেন নাই। সেই তিনি?’’
“হুম, তিনিই। শুনলে খুশি হবে যে কমল মিত্র ইহলোক ছেড়ে এখন ভূতলোকেই আছেন। যদ্দিন বেঁচে ছিলেন কলমটিকে রিভলভারের নল বানিয়ে আগুন ঝরিয়েছেন। তোমার কী-বোর্ড আগুন হয়ে উঠুক, নল হয়ে গর্জে উঠুক।”
কমলেশ একটু সাহসী হয়ে জানতে চাইলেন, “ভূতলোকে সংখ্যা কত আপনাদের?’’
“সংখ্যায় কিছু এসে যায় না। ওখানেও ঘুরে দাঁড়ানোর কঠিন সংগ্রাম চলছে,’’ ‘ক’ ভূত উত্তর এড়িয়ে গেল, “সমাজ পরিবর্তন ওখানে হবেই।”
কমলেশ মৃদু হেসে বললেন, “একদা আগুনখোর নেতা কিন্তু প্রতিষ্ঠানের কাগজেই ধারাবাহিক লিখছেন এখন। আর একজন আগে প্রচুর ফিচার লিখতেন বিভিন্ন বাণিজ্যিক পত্রিকায়। খবর রাখেন?’’
‘গ’ ভূত বিভ্রান্ত হল, “সত্যি বলছ?’’
“মিথ্যে হলে ঘাড় মটকে দেবেন আমার।’’
“আসি তাহলে। এ নিয়ে পলিতকেশ গলিতমজ্জায় মিটিং করতে হবে। কোথাও একটা মিথ্যা প্রচার চলছে।’’
টেবিলের ও-প্রান্ত নীরব হতেই কমলেশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। এবার নির্বিঘ্নে লেখা শুরু করা যাবে।

কমলেশ বিরক্ত হলেন, কানের কাছে ফিসিফিস ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। আশ্চর্য ব্যাপার, ভূতলোক থেকে এসে সবাই কি তাঁর ঘাড়েই ভর করছে আজ!
“লিখছ?’’
“লিখতে আর পারছি কোথায়? আপনি কোন ভূত?”
“আমি ‘র’ ভূত। অর্বাচীন সমালোচকেরা আমাকে ‘য’ ভূতই বলে।’’
“হুম,’’ কমলেশ বিরক্তি চেপে বললেন, “আপনি নিশ্চয়ই কিছু বলবেন?’’
“ঠিক ধরেছ। সেজন্যই তো এসেছি। লেখকভূতের সমাজে আমাদের এখন খুব বাড়বাড়ন্ত। মুশকিল হল যে বিছানায় না শুলে আমি ঠিক সেভাবে গুছিয়ে বলতে পারি না।”
“শুয়ে পড়ুন তাহলে।”
“তা তোমার লেখায় নারীপুরুষের সম্পর্ক নিয়ে কেমন ট্রিটমেন্ট রাখ?”
কমলেশ উত্তর দিলেন, “তেমন বিশেষ কিছু না।’’
“বুঝেছি, একেবারে গোড়ায় গলদ। সাহিত্য কোনও সমাজতত্ত্ব নয়, ইতিহাস নয়, রাজনীতি নয়। সাহিত্য মানেই হল নারীপুরুষের রক্তমাংসময় জীবন আর সম্পর্ক। ওটা নিয়েই জীবন, ওটা নিয়েই জগৎ চলছে। কিছু ভূত তা মানবেই না। ভারী ব্যাকডেটেড, গেল-গেল রব তোলে, সব নাকি অশ্লীল। কেন রে, তোরা কি শুতি না? ইডিয়টের দল, সেক্স ছাড়া কোনও প্রগ্রেসিভ লিটারেচার সম্ভব?’’
কমলেশ বললেন, “মানলাম। তবে ইয়ে, বলছিলাম, ওটাই কি সব?’’
“হ্যাঁ। ওটাই লাইফফোর্স। কাম বাদ দিয়ে জীবন হল মরুভূমি। তা নিয়ে অত ঢাক গুড়গুড় কেন? ফ্রয়েড পড়েছ?’’
“আজ্ঞে, হ্যাঁ।’’
“তাহলে?’’ ‘য’ ভূত খুশি হল, “যত্তসব ভিক্টোরিয়ান শুচিবাইগিরি। এইজন্যই আমি দেবাঞ্জনকে খুব পছন্দ করি। যেমন রগরগে ভাষা, তেমন ফুটন্ত বর্ণনা। পড়লে মনে হবে যে খাটের তলায় লুকিয়ে থেকে রতিলীলা দেখেছে। গীতিকাটাও সেক্স ভালোই ছড়াত, হস্তমৈথুন নিয়েও সাহসী গল্প লিখেছে, তবে আজকাল লেখে কম।’’
কমলেশ মনে মনে বললেন, “কী আর লিখবে? উঁচুতলার লোক সব, জীবন দেখেও না, জানেও না। সফট পর্নোর মালমশলা দিয়ে উতরে যাওয়ার চালাকি।”
“তুমি কি কিছু বলছ?’’
কমলেশ বললেন, “একটা প্রশ্ন ছিল। ভূতসমাজে তো যৌনতা থাকার কথা নয়। আপনি অকারণ আগ্রহ দেখাচ্ছেন কেন?’’
“ওরে, অপগন্ড লেখক, সেক্সুয়াল ফিলিংস আত্মার মতোই অবিনশ্বর, অমর। আমাদের হরমোন নেই কিন্তু তার অনুভূতি আছে। আমাদেরও ইয়ে হয়।’’
“শুনে খুব আনন্দ হল। সত্যিই তো, ওই রসে কেন বঞ্চিত হবেন? আপনি এখন আসুন। মনে উত্তেজনা হচ্ছে, কাছা খুলে যৌনতা লিখব এখন।’’
‘য’ ভূত প্রসন্ন হল, “লেখ, লিখে যাও, রক্তমাংসময় লেখা চালিয়ে যাও। রতিক্রিয়া এবং শয্যাদৃশ্য ফাটিয়ে লেখ। পাবলিক খাবে, আমরাও ওপরে বসে উল্লাস করব।’’

কমলেশ যেন পরবর্তী ভূতের প্রতীক্ষাতেই ছিলেন।
অনুমান মিলেও গেল, বিচিত্র এক গলা শুনতে পেলেন তিনি।
“কিছু লিখছেন?’’
“হুম।’’
“কী লিখবেন?’’
“এক চৌত্রিশ বছরের বেকার যুবকের মানসিক অবস্থা নিয়ে লিখব ভাবছি,’’ কমলেশ উত্তরে বললেন।
“ছো! সেই জীবনের সুখ-দুঃখ, ক্ষোভ-প্রেম-অপ্রেম-বিরহ, সমস্যা-অভাব নিয়ে লেখা? এ তো সাতের বা আটের দশকে চলত। অমন হাঁ করে তাকিয়ে আছ কেন?’’
কমলেশ হতবিহ্বল স্বরে বললেন, “ওসবই তো জীবন। ঠিকঠাক লিখতে গেলে তুখোড় পর্যবেক্ষণ শক্তি লাগে, অনুভব লাগে। অবশ্য আমার ঘাটতি আছে। তা আপনার পরিচয়?’’
“আমি ‘জঁ’ ভূত।”
কমলেশ বিরক্ত হলেন, “একটু আগেই আপনাদের প্রতিনিধি ঘুরে গেলেন যে!’’
“মূর্খ! জঁর ফিকশন বোঝো? ভূতলোকে আমাদের দলে লেখক বাড়ছে। এই বিষয়ে আমিই ভূতলোকের দক্ষ প্রতিনিধি।’’
“আচ্ছা। মুশকিল একটাই। জঁর ফিকশন যে সাহিত্যের এত গুরুত্বপূর্ণ অংশ তা ইউনিভার্সিটিতে শেখায়নি। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়লেও কল্পবিজ্ঞানের বেশি কিছু বুঝি না, জানিও না।’’
‘জঁ’ ভূত বলল, “চিন্তিত হয়ো না। সোজা ব্যাপার, বুঝিয়ে দিচ্ছি। হরর, ফ্যন্টাসি, সায়েন্স ফিকশন, ভূত-প্রেত, ডার্ক ফ্যান্টাসি, এলিয়েন এগুলো নিয়েই জঁর ফিকশন। মাস্টার ডিগ্রিটাই করেছে, কিছুই জান না দেখছি।’’
কমলেশ বললেন, “বুঝলাম। ওসব স্বাদবদলের জন্য লেখা বা পড়া ভাল। তবে গাঁজা না টানলে শুধু ওইটা নিয়ে থাকা অসম্ভব। এই বয়সে শরীর গাঁজার ধকল নিতে পারবে না।’’
“সুস্থ মস্তিষ্কেই লেখা যায় হে। তুমি গাজু গাংগুলির কাছে টিপস নাও। সে শুধু জঁর ফিকশন পড়ে, লেখে, খায়, চিবোয়। ওই সব সামাজিক মানবিক লেখাকে সে সাহিত্য বলে মনেই করে না। আসল কথা হল মেধা। উচ্চমানের মেধা ছাড়া জঁর ফিকশন লেখা যায় না। তাছাড়া বাজারে গরম কচুরির মতো অগুনতি বিক্রি। তোমাদের ওই জীবনমুখী প্যানপ্যানানি পড়ে পাঠকের বোর হতে বয়েই গেছে।’’
“তাই? শুনেছি যে অধিকাংশই বিদেশি সিনেমা ও বই থেকে ঝাপা।’’
“বাজে কথা। ঝাপা নয়, অনুপ্রাণিত বলতে পারো। তোমার দুটো উপন্যাস যে প্রকাশক খুলেও দেখেনি, উলটে জমিয়ে জঁর ফিকশন লিখতে বলেছে, সে গুহ্য কথাটি জানি না ভেবেছ?’’
কমলেশ থতমত, “আজ্ঞে, এ-জন্মে পারব না যে!’’
“তাহলে চোখের জলে সাঁতার কাটো, পাঠকের অভাবে শ্বাসকষ্টে মরো,” ‘জঁ’ ভূত তেড়িয়া হল, “বই কেউ ছাপবে না, ছাপলে ঠোঙার দরে বিকোবে। যতই সামাজিক সিরিয়াল লেখো কিছুতেই কলকে পাবে না। ভূতলোকে ওরকম বইকে আমরা পাশবালিশ করে শুই।’

কমলেশ স্বস্তির শ্বাস নিয়ে চেয়ারে হেলান দিলেন। ঝাঁ করে কারও আগমন হল। কমলেশ বুঝতে পেরে জিজ্ঞাসা করেন, “আপনি?’’
“আমি ‘ফ’ ভূত। বাঙালি ভূতেরা আমাকে ‘আ’ ভূত বলেও ডাকে। এখন এই ত্রিকোণ শো-কেসটায় বসি। এর গঠনটা বেশ পছন্দ হয়েছে। তা কী লিখবে?’’
“দেখি। মাথায় অনেক প্লট ঘুরছে। কোনটা নামানো যায় ভাবছি।’’
বিদ্রুপে ‘ফ’ ভূতের গলা শানিত হল, “প্লট? জমির প্লট আছে বলে জানি, তার চড়া দাম হচ্ছে তা-ও শুনেছি, তা বলে লেখার প্লট? থিম, বিষয়বস্তু নিয়ে পড়ে আছ? শোন, না লিখে পুজো প্যান্ডেলের থিম নিয়ে কোনও শিল্পীর আন্ডারে কাজ কর। হাউ ফানি! বিষয়ের মৃত্যুঘন্টা পৃথিবীতে বহুকাল আগেই বেজে গিয়েছে।’’
কমলেশ ঘাবড়ে গেলেন, “কী নিয়ে লিখব তবে?’’
“কী নিয়ে মানে? কিছু নিয়েই লেখার নেই আর। সমস্ত কিছু নিয়েই লেখা হয়ে গিয়েছে। তোমার চিন্তা হবে শুধু ফর্ম। আঙ্গিক, গঠন, পরিবেশন। সব ভেঙেচুরে দিয়ে নতুন ফর্মে লেখা হবে। কী বলা হচ্ছে তা নিয়ে মাথামোটা পাঠকেরাই মাথা ঘামায়। ফর্ম নিয়ে শুধু পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে যাবে। প্রচলিত ধারাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে দিতে সঠিক ফর্ম খুঁজে হয়রান হতে হবে।’’
কমলেশের চোখে শাবল, গাঁইতির ছবি ভেসে উঠল। বলতে ইচ্ছে করল যে লেখা কি গিনিপিগ না রিসার্চ ল্যাবরেটরি? বলার সাহস পেলেন না। সমস্ত তেটিয়া ভূত, কোনও যুক্তিই শুনতে নারাজ। তার চেয়ে ঘন ঘন সায় জানিয়ে মাথা নেড়ে যাওয়াই নিরাপদ।
‘ফ’ ভূত বলল, “বলতে ভুলে যাচ্ছিলাম। বস্তাপচা বিষয় বা আইডিয়া নিয়ে ভাবাটা ছেড়ে দাও।’’
কমলেশের মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেল, “কিন্তু আমি যে ভাবছিলাম ভাদুগান নিয়ে, কীর্তন সম্প্রদায়ের জীবন নিয়ে দুটো বড় গল্প লিখব! এ নিয়ে খুব কমই লেখা হয়েছে।’’
‘ফ’ ভূত বিরক্ত হল, “বোগাস! আবার সেই বিষয় নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করছ? এই দশকে সাহিত্যে বিষয় বলে কিছু থাকবে না। শুধু শিল্প থাকবে। ভাঙা আর গড়া। জেনে রাখ, এ নিয়ে ভূতলোকে জোরদার আন্দোলন চলছে। তা ‘গ’ ভূতটা এসেছিল তোমার কাছে?’’
“এসেছিল।’’
“ওই ছিচকাঁদুনে বুড়োটার চক্করে একদম পড়বে না। লেখকভূতের সমাজে কেউ ওকে বৃদ্ধাশ্রমেও ঠাঁই দেবে না। বসে পড়ো। নতুন আঙ্গিক নিয়ে তোলপাড় শুরু করে দাও। আমি এখন আসি।’’


কিছুক্ষণ পরে কমলেশের নাকে সুন্দর ঘ্রাণ ভেসে এল। সারা ঘরেই সুগন্ধটা ছড়িয়ে পড়ছে। কমলেশ বললেন, “স্বাগতম। আপনি পরিচয় দিলে ভালো হয়।’’
সুরেলা মিষ্টি গলা ভেসে আসে, “আমি ‘ন’ ভূত। ভূতের স্ত্রীলিঙ্গ পেত্নি হলেও ওখানে তা অচল। নো পেত্নি, অল ঘোস্টস।’’
“আচ্ছা।’’
“আপনার লেখায় নারীরা কীভাবে আসে?’’
কমলেশ বললেন, “আসে, এমনিই আসে।’’
“বুঝতে পারছি, সেভাবে ভাবেননি কখনও। পুরুষ লেখক, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের জয়গান গাইবেন, তোতাপাখির মতন বুলি কপচে যাবেন। তবে জেনে রাখুন, আমাদের দাপট কিন্তু বাড়ছে।”
“কীভাবে?’’
“নারীর অধিকার, কামনা-বাসনা, বিদ্রোহ খুব দেখান হচ্ছে। নারীরা পুরুষ লেখকদের নাকে ঝামা ঘষে দিচ্ছে আজকাল। মেয়েদের কথা মেয়েরাই লিখবে।’’
“অবশ্যই। পুরুষ হিসেবে নারীবাদী সাহিত্য করলে তা বিশ্বাসযোগ্য হয় না,’’ কমলেশ স্তুতি করলেন।
‘ন’ ভূত খুশির গলায় বলল, “আপনার বেলায় হবে। পাবলিক প্রগতিশীল লেখক ভেবে আপনাকে মুকুট পরাবে। তেমন দরকার পড়লে মহিলার ছদ্মনাম নেবেন। আপনাকে পুরুষ নয়, মানুষ মনে হচ্ছে, তাই একটা সাজেশন দিচ্ছি। নারীর জীবন আসলে প্রেমশূন্য, কোনও পুরুষই ভালবাসতে জানে না, পুরুষদের শুধু ভোগের ইচ্ছে, মনটন নেই এইসব রাখবেন। সাহসী মেয়ের চরিত্র রাখবেন, দুটো লিভ-ইন, দুটো বিয়ে, সেক্সুয়ালি ফ্রি, কোনও ট্যাবু মানে না। কতজন তো এই ফর্মূলাতেই ফাটিয়ে দিচ্ছে! বাই।’’
কমলেশ হাত নেড়ে বললেন, “বাই।’’
তখনই কারও আগমন হল।
“আপনি কোথায় বসবেন?’’
“বসতে আসিনি। শুনলাম সমস্ত গোষ্ঠীর লেখকেরা প্রচার সেরে যাচ্ছে। আমাকে অবশ্য তেমন কিছু বলতে হয় না। ওহ, নামটাই বলা হয়নি, আমি হচ্ছি ‘ত’ ভূত।”
“বুঝলাম না।’’
“তন্ত্র-মন্ত্র-থ্রিলার। মাথায় ঢুকেছে এবার? ভূতলোকে বাকি লেখকেরা হিংসায় মরে যায়। কেন জান? রমরমা বাজার, এডিশনের পরে এডিশন, পাঠক হামলে পড়ে কেনে।”
কমলেশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “খুব বিক্রি হয়। সে কথা আমিও জানি। পাবলিশাররাও থ্রিলার পেলে খুব খুশি হয়। ওখানেও নিশ্চয়ই আপনাদের বাড়বাড়ন্ত।’’
“হতেই হবে। ওসব লেখার মুরোদ তোমার নেই। কষ্ট করে কি যে লেখো! কেউ তো পড়ে না। সামনের অমাবস্যায় মন্ত্র দিয়ে তোমায় ঝাড়ফুঁক করব। তখন তুমিও পারবে।’’
কমলেশ আর কারও উপস্থিতি টের পেলেন না। বোধহয় ‘ত’ ভূত মহাব্যস্ত, বেশি সময় দিতে পারলেন না।

অনেকক্ষণ সাগ্রহে বসে থাকার পরে কমলেশ নিশ্চিন্ত হলেন। আর কেউ আসেনি, আসবে না আপাতত। এবার তিনি লেখায় মন দিতে পারবেন।
একটি শব্দও লিখতে পারলেন না কমলেশ। মাথায় হরেক রকম ভাবনার ভিড়, গিঁট বেঁধে রয়েছে, খুলছে না কিছুতেই। মাথা কাজ করছে না। সিগন্যাল না পাওয়া ট্রেনের মতো আটকে রয়েছে মন, থমকে গেছে ভাবনা, থেমে গিয়েছে আঙুল।
ভেবেছিলেন লিখবেন। আজ ছুটির দিনে সারাক্ষণ সৃষ্টির আনন্দে লিখেই যাবেন। সমস্ত কিছু কেমন যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে তাঁর।
কোনও এক ইচ্ছেভূতের জন্য তিনি জানলার দিকে কাতরভাবে তাকিয়ে রইলেন।
সে এলেই তাঁর মন শান্ত হবে, খুলে যাবে লেখার জানলা।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

2 thoughts on “short-story-ichhevuter-apekshai

  1. চমৎকার। কিছু লোকের মুখ একেবারেই পষ্ট ভেসে উঠল— ক্রোধে জঁর জঁর।

  2. দুর্দান্ত। সব ভূত ছবির মতো ভেসে উঠল চোখের সামনে। তবে যা বুঝলাম ‘গ’ ভূতেরই একমাত্র অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। বাকিদের বিষয়ে সন্দেহ আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *