নাসিমা আনিস
হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে ভাবতে চেষ্টা করলাম কয়টা বাজে। অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করেও যখন আলো ফোটার লক্ষণ পেলাম না তখন দেখি মোটে রাত তিনটা। এত রাতে ঘুম ভাঙার কারণ কী হতে পারে ভাবতে দূরে যাওয়া লাগল না মোটে। সকালে ইলিশ কিনেছিলাম, বুকের ভিতর সেই খচখচানিটাই! নাকি বিকেলে আবোল তাবোল খেয়ে পেট শুলাচ্ছে! না, পেটে সামান্য একটু গ্যাস গ্যাস ভাব হচ্ছে এর বেশি কিছু না। তবে ইলিশ! ছয়শ টাকা কেজিতে পাঁচ কেজি পঞ্চাশ গ্রাম ছয়টা মাছ কিনেছি, এটা ঠিক আছে। কিন্তু নয়শ টাকা কেজির দুই কেজি চারশ গ্রাম ওজনে দুই হাজার একশ পঞ্চাশ টাকার মাছ দুইটা নিয়া কথা! হ্যাঁ ঠিক তাই।
বলি তবে, সকালেই গেছি কারওয়ান বাজার, হিসাব করলে এক বছর নয় মাস পর। বাসা থেকে কারওয়ান বাজার থুথু ফেলার দূরত্ব, হলে কি, করোনা তো আরও কাছের বাসিন্দা, না! তো ছেলে দেশে আসলে দুটো ভালো ইলিশ খাওয়াব এই তো বাসনা মা হিসেবে!
কারওয়ান বাজারে মাছের আড়তে মহিলা ঢুকে মাছ কিনছে, এটা দুর্লভ নয় কিন্তু। তবে নিজের গা বাঁচিয়ে মাছ কিনতে পারা একজন মহিলার পক্ষে সত্যি অসম্ভব, যে ভাবেই হোক আপনার গায়ে হারামিরা খোঁচা দিয়ে সটকে পড়বে। একটু বেশি সকালে, মানের ক্রেতা সমগ্র না, বিক্রেতা সমগ্র না আসার আগেই কাজটা সারতে পারলে মান রক্ষা, মানে গা রক্ষা। তো কোনও রকমে সে কাজটা সেরে মাছ নিয়ে বিজয়ীর বেশে বাড়ি ফিরে মনে বেশ আনন্দ হলো। মাছ দেখাতে মেয়ে, মেয়ের বাপকে ডেকে আনলাম। মেয়ে মাছের কী বোঝে, ভাজা এক টুকরা পাতে পড়লেই খুশি। ঘুম জড়ানো চোখে হাই তুলতে তুলতে প্রস্থান করলেন। মেয়ের বাপ দাঁড়ালেন, দেখলেন, ধন্যবাদ দিতে গিয়ে যথারীতি মুখ থেকে নেতি সব বেরিয়ে এলো। ‘জান তো ফেসবুক ছেয়ে গেছে, ইলিশ নামে এগুলো আসলে কী মাছ!’
আমি চমকে গিয়ে তাঁর মুখপানে চাই, সেই নেতি নিয়েই হাজির আমার বিজয়া সকালে! জনম জনম হাজার বছরের নেতি!
একটু কাছে এসে চোখ চিকন করে আবার বললেন, ‘ছোটগুলো তো ঠিকই আছে। হাপ ছাড়লাম, ছোট মাছই তো বেশি, ছাড়পত্র পাওয়া গেল! ‘আচ্ছা নাসিম, তুমি তো ইলিশ বিশেষজ্ঞ, তুমিই আমায় মাছ কেনা চিনিয়েছ, ঘাড়ের দিকটা মোটা হবে, মাথা ছোট আর মাছটা হবে গোলাকৃতি, মোটেই লম্বা নয়।’
হাঁ করে মাছ দেখি একবার তাঁকে একবার, রেগে যাওয়ার কথা ছিল প্রথমেই তার বদলে মাছ দেখতে দেখতে আনন্দ সমগ্র গাতায় গিয়ে পড়ে। হায়, বড় একটা মাছ সত্যি লম্বাটে ঘাড় চিকন আর মাথাটা বেঢপ বড়!
তিনি ব্রাশ করতে করতে চলে গেলেন সান্তনাবাণী দিয়ে, ‘আরে ঠিকই আছে, বাদ দাও তো, মাছই তো, সোনারুপা তো না!’
আমার সোনারুপায় আগ্রহ নাই কোনও কালে, মাছে খুব আগ্রহ সেও পৈত্রিকসূত্রে প্রাপ্ত। পাতে এক টুকরা বড় মাছের খাড়ি পড়লে বাকুম বাকুম! অহ্, খাড়ি মানে আস্ত টুকরা।
মাছ ধুয়ে ব্যাগে ভরছি শ্লথ হাতে, মানে মনটা খচখচ করছে আর কী। বড় মাছ দুইটা বিশেষ বন্দোবস্ত করে অনেকদিন রাখতে হবে। সব মাছ বড়ো ফ্রিজটায় রাখব, ভালো থাকবে স্বাদ। গোসল সেরে নাস্তা খাই কিন্তু কোথায় একটু অস্বস্তি। জানালা দরোজা খুলেও আলো অক্সিজেন সবই কম লাগে। শেষে বলেই ফেললাম, ‘মাছই তো দিয়েছে, সাপ তো না, কী বল!’
‘সাপ কিন্তু বিদেশে অনেক দাম দিয়ে খায়, জ্যান্ত সাপ দোকানে ঝুলতে থাকে, লোকে পছন্দ করে দেয়, সুস্বাদু খাদ্য।’
তারপর সাপ নিয়ে অনেক কথা, পানক নামে এক ধরনের সাপ আছে, নানাবাড়িতে দেখেছি, কুৎসিত তার কথাও। সাপের কলরোলে সকালটা কিছুটা হালকা হয়ে এল মনে হয়। কিন্তু হালকা খুব হতে পারলাম না, একটা ছোট ইলিশ কাটা হয়েছে, মেয়ের অফিসের জন্য দুই টুকরা ভেজে দিতে গিয়ে মনে হলো লোকটার কাছে অনেক মাছ ছিল। আমি বেছে বেছে নিলাম মাত্র দুইটা, তাহলে এই চিকন পিঠের মাথা মোটা মাছটা আমি কেন নিলাম, কেন নেব! না, আমি তা নেইনি, মাছ বদলে দিয়েছে ফলওয়ালাদের মতো! মাছ ভাজার চুলা নিভিয়ে শোয়ার ঘরে গিয়ে স্বামীর পাশে দাঁড়াই। যেন কিছুই হয়নি, হলেও তেমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়।
‘শোন!’
‘কী হলো, মাছ নিয়ে কিছু! একটা মাছ খেয়ে ফেললে চুকে যাবে, ছাড় তো!’
‘বলছি একটা মাছ বদলে দিয়েছে, আমি টাকা বের করতে করতে ঘটেছে ঘটনাটা!’
‘হুম হতে পারে, তুমি এই মাছ কেনার লোক না!’
যাক, একটু সান্তনা পাওয়া গেল, আমি এই মাছ কেনার লোক না।
কিন্তু ছেলের পাতে এই অখাদ্য দেয়া যাবে না, ওটা আগেই খেয়ে ফেলব।
বিকালে সিনেমাটা শেষ হলো যেন আচমকা, শেষটা অবরুদ্ধতা, পুরো ছবি জুড়ে তো অবরুদ্ধতাই সারকথা। উনি মুখের দিকে চেয়ে বলেন, ‘কেমন দেখলে!’ ‘ভালো!’ ভালোর পর নিশ্চুপ দুজনেই। মানে ভাবছি, রেহানাকে কেন এ দেশের দর্শক মানসিক রোগী বলে খাট করতে চাইছে। কোনও কথা নাই কারো মুখে ছবি নিয়ে, আচমকা শেষ হলো ছবি, মানে পরে ধীরে সুস্থে ভাবোগে। বের হয়ে ওয়াশরুম খোঁজ, ‘ডুব’ সিনেমার পর এই আসা, বহুদিন পর। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে প্রথম কথা, ‘যা হোক পরিষ্কার বাথরুম পাওয়া বিরাট ভাগ্য, না!’ ‘ঠিক।’
তারপর সুন্দর সময় শর্মার আলুপরোটা ঘুগনি আচার চমৎকার সালাদে আর কফি একটা দুজনে। একটা কফি দু’জনে খাওয়া দশ বছরের রেওয়াজ, পয়সা বাঁচে, কিডনি কম চাপে পড়ে। এক কফি দুইজনে শুনে ভাববেন কি প্রেম তাদের! বেশি দুশ্চিন্তা করবেন না, এখানেও আছে সব, ঘৃণা, পরশ্রীকাতরতা। হ্যা, ভাঁজে একটু প্রেম না হলে চলে! ঝগড়া জমে! এই সব খেতে খেতেও বার কয়েক সকালের ইলিশ মাথায় নড়েচড়ে ওঠে, ওরে ইলিশ!
তো রাত তিনটায় ঘুমটা ভাঙলে ফেসবুকে একটা আধ পড়া গল্প পড়তে পড়তে পরিকল্পনা করে ফেলি তারপর ভোর অব্দি ফেসবুক স্ক্রল করে করে দমন করি পরিকল্পনার বাস্তবায়নের উদ্বেগকে।
আজকেও মাস্ক দুইটা, মাথা মুড়ে ঘোমটা। পরিকল্পনা মতো কেয়ারটেকারের বউটাকে পাওয়া গেল না, পেলে বুকে বল পেতাম। কাল লিফটে বলেছিল, আমারে নিয়েন খালাম্মা আপনের না হাড়ক্ষয়!
প্লাস্টিকের থলেতে বরফজমা কুচকে থাকা একটা ইলিশ নেয়া ঠিক হলো কিনা রিকশায় উঠে ভাবি! ওর দোকান থেকে কিনেছিলাম তো দুইটা, দুইটা নিলে তুলনা করা যেত কী সমস্যা, কেন ফেরত আনলাম। দেখ, তোমার কাছ থেকে এই দুটো মাছ কিনেছিলাম, কিন্তু দুটো মাছ দুই প্রজাতির। একটা ঠিক আছে, বরিশাল কি চাঁদপুরের হবে কিন্তু এটা তো ফেসবুকের অদ্ভুত প্রকৃতির মাছের মতো, মাথা মোটা পিঠ চিকন, লম্বা মাছ! আমি এইটা পছন্দ করি নাই, তোমাদের হাতের কারসাজিতে ব্যাগে পুরে দিয়েছ, এটা বদলে দাও!
রিকশা থেকে নামতে নামতে আমার ঘাম ছুটে যায় ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের হালকা শীতে। মাথার কাপড়টা কী মাস্কটা ইচ্ছা করে খুলে ফেলি। বাস্তবিকই শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। রিকশাটা অনেক দূরে থামল, সামনে জ্যাম শুরু হয়ে গেছে সকাল সাতটায়।
প্রথম গলি দ্বিতীয় গলি তৃতীয় গলি… ঠিক এই রুইমাছওয়ালাদের বাঁয়ে রেখে সামনে গেলেই ইলিশমাছের সেই দোকান। চিৎকার করে দৌড়ে দৌড়ে মাছ নিয়ে ঢুকছে পাইকাররা। এক স্তূপ পাঁচমিশালি মাছে চোখটা আটকালো ক্ষণকালের জন্য, খুব প্রিয়।
একা আসা ঠিক হয় নাই। বুকটা ডিপডিপ করছে, গলা শুকাচ্ছে। বলব, কিছুতেই এই মাছ আমি পছন্দ করি নাই। আমি ভালো ইলিশ চিনি। ভালো ইলিশের পিঠ মোটা মাথা ছোট গোল মাছ। এটা কী মাছ দিয়েছেন, এটা আমি নিতেই পারি না। না, টাকা আপনার দিতে হবে না, পাল্টে দেন। সেপ্টেম্বরে প্রতি বছর অনেক মাছ কিনি, এবার খুব ঝামেলায় ছিলাম, খুবই ঝামেলায়, এত ঝামেলায় জীবনে থাকি নাই। তাই ডিসেম্বরে আসছি। তাই বলে কি আপনি আমাকে মাছ পাল্টে দিতে পারেন! পারেন না। ভালোয় ভালোয় দেন নইলে আমি লোক ডাকব।
ঠিক দোকানটার কাছেই এসেছি, অনেক মাছ আজকেও, ভালো ভালো সব মাছ, এখান থেকেই কাল মাছ বাছাই করেছি। চার পাঁচটা মাছ নেড়েচেড়ে তবে দুইটা নিয়েছিলাম। সব মাছই ভালো ছিল।
থলে থেকে মাছটা বের করতেই তিনজন ঘিরে ধরে, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আরো দু’জন, চারদিক থেকে।
‘কী সমস্যা!’
‘মেয়ে মানুষ!’
থলে থেকে লেজ ধরে টেনে বের করি উহাকে, বুকের ভিতর দ্রিম দ্রিম, একা আসা ঠিক হয় নাই!
‘এইটা কী!’
আমি চেয়ে দেখি আমার থলে থেকে একটা বিরাট সাপ বের করে আমি ওদের দেখাচ্ছি, ‘এটা আপনারা দিয়েছেন, কেন দিলেন এটা! আমি কি টাকা দিয়ে এটা কিনতে এসেছিলাম!’
সাপটা কুৎসিত, মানে সাপটা তো সুন্দরও হতে পারত, হলে একটু ভালো লাগত। সাপের লেজ ধরে আমি হতবিহ্বল, আমি কী বলব ভাবতে ভাবতে লোক পাঁচজন উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করে, হাসির শব্দ ছড়িয়ে পড়ার কথা, আরও আরও লোকের আগমন হওয়ার কথা কিন্তু সেসব কিছু হচ্ছে না, ভাগ্যিস! মানে ‘লোকটা মারা গেলেও চোখে গুলি লাগে নাই’, এই গল্প মনে আসছে। আমি মাছের মাথা মাছের পিঠ নিয়ে এদের বলে চলেছি, বলতে বলতে আমি লক্ষ্য করি বাইরে আলো কমে আসছে, আসার সময় ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছিল, এখন নিশ্চয় জোরেসোরে নামবে। ‘শোনেন এই মাছটা বদলে দিয়েছে, ফলের দোকানের মতো…’ ততক্ষণে লেজটা ছেড়ে দিয়েছি, এবড়ো খেবড়ো ইট, কোথাও খোয়ার ঢালাই, ময়লা পানির সপসপে মেঝেতে একবেঁকে চলতে শুরু করেছে সাপটা। মাথায় মাছের ঝুড়ি দ্রুত ধাবমান মোটা মোটা মানুষগুলোর পা বাঁচিয়ে চলছে কুৎসিত সাপটা। লোকজন কিছুই বলছে না, ভয় পাচ্ছে না। নাকি এ সব নিত্যই হয়! আমি শুধু একবার বললাম, ‘আমার ইলিশ!’ পাঁচজন লোক সরে যাচ্ছে তারা কেউ আমার কথা শুনতে পায় না। যেন তাদের মিশন শেষ, আর কথা কিসের!
কখনও এইসব মদিরতন্দ্রা আপনাকে সমূহ অপমানের হাত থেকে পরম যত্নে বাঁচাতে পারে, একটা ইলিশই তো, আসল নকল যাই হোক! এত কান্ডের দরকার কি!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন