short-story-isabel-samoner-sakhyatkar

ইসাবেল সিমোনের সাক্ষাৎকার
দীপেন ভট্টাচার্য



পৃথিবীতে ভাইরাসের তাণ্ডবের একটি বছর যখন পূর্ণ হতে চলেছে তখন ফেসবুকে আমার দেয়ালে একটা প্রস্তাব দেখলাম, আমার ফেসবুকে এ যাবত প্রকাশ করা সব ছবি সংকলন করে এক কোম্পানি একটা বই করে আমাকে পাঠাতে পারে। কিছু পয়সা লাগবে। প্রথমে অগ্রাহ্য করলেও পরে অর্ডারটা দিয়ে দিলাম। কয়েক সপ্তাহ পরে একটু সুন্দর বাঁধানো বই ডাকযোগে বাড়িতে উপস্থিত হল। বহু মাস খরার পরে সেদিন সকাল থেকে অল্প বৃষ্টি হচ্ছিল। আধো-অন্ধকারে বসে বইয়ের ছবিগুলো দেখছিলাম, বেশিরভাগই প্রকৃতির ছবি, কিছু মানুষের, সেগুলো অনেক পুরোনো স্মৃতি মনে করিয়ে দিল – বন্ধুদের, আত্মীয়, স্বজন – যাদের মধ্যেই অনেকেই আর বেঁচে নেই। এর মধ্যে একজনের ছবি দেখলাম, তাকে চিনতে পারলাম না। একটা ক্যাফেতে বসে সেল্ফি তুলেছে, তার সামনের টেবিলে কফির কাপ ও খোলা একটি বই। কেমন করে এই ছবিটি আমার ফেসবুক বইয়ে ঢুকল বুঝতে পারলাম না। পরে কয়দিন তন্নতন্ন করে দশ বছরের সময়রেখা দেখলাম, ওই ছবিটি কোথাও পেলাম না। অবশেষে, যখন হাল ছেড়ে দেব, এমন সময় মেসেঞ্জারে তার একটি চিঠি চোখে পড়ল। সরাসরি চিঠির বাক্সে নয়, অনুরোধের বাক্সে। ফেসবুকে তার সঙ্গে আমার সরাসরি বন্ধুত্ব ছিলনা, কাজেই এই বাক্সটিতে তার চিঠিটি আমার অলক্ষে থেকে গেছে। এক বছর আগের একটি চিঠি, বেশ বড়, ইংরেজীতে। চিঠির সাথে একটি ছবি জোড়া দেয়া, সেই ক্যাফের সেল্ফি। তার নাম ছিল আবু মাশার।

আবু মাশারের নামের সূত্র ধরে তাকে ফেসবুকে খোঁজ করলাম, তাকে পেলাম – তার দেয়ালে একটিই পোস্ট – একটি ছবি, ক্যাফেতে তোলা সেই সেল্ফি। পোস্টটি এক বছর আগের, সেই ছবিতে কোনো ‘লাইক’ নেই, কোনো মন্তব্য নেই। ফেসবুকে তার পরিচিতিতে কিছুই লেখা নেই, কোন শহরে সে থাকে সেটা নেই, তার বন্ধুদের তালিকা বাইরের মানুষের কাছে বন্ধ। আবার মেসেঞ্জারে ফিরে গেলাম। তার চিঠিটি পড়া শুরু করলাম। পাঠকদের জন্য চিঠিটার বাংলা অনুবাদ করে দিলাম।

আবু মাশারের চিঠি

শ্রদ্ধেয় মিস্টার অমল,

আপনার লেখা একটি গল্পের ইংরেজী অনুবাদ আমি পড়েছি, তারপর ফেসবুকে আপনাকে খুঁজে পেয়ে লিখছি। আশা করি এই চিঠিটা আপনার চোখে পড়বে। আপনার লেখা পড়ে আমার মনে হয়েছে আমি এখানে যা লিখব তা আপনি বুঝতে পারবেন। আমার জীবনের দোষে-গুণে-ব্যথায় জর্জরিত আখ্যান আপনার কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হয়তো অন্যায় হচ্ছে, এই অধিকার আমার নেই, তবু যেহেতু আমার বর্তমান আপনার ভবিষ্যৎ তাই যেটুকু না বললে নয় সেটুকুই বলব। এই কথাটা – “আমার বর্তমান হল আপনার ভবিষ্যৎ” – আপনার গল্পে উল্লেখ করেছেন, সেই জন্য মনে হল আপনিই আমার বর্তমান অবস্থাটি উপলব্ধি করার জন্য সঠিক ব্যক্তি।

আমার মূল বক্তব্যে যাবার আগে আমার শহরটি সম্পর্কে একটু ধারণা দিই। এক সময় এই শহরটি চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য খুব বিখ্যাত ছিল। এক ধরণের স্থাপত্যের দালানে, যাকে আর্ট ডেকো বলা হত, ভরা ছিল আমাদের শহর যে দালানগুলোর অনেককটাই সিনেমা দেখানোর জন্য ব্যবহার করা হত। সন্ধ্যা হলে, কাজ ফেরৎ সব মানুষ সেখানে ভীড় জমাতো, কেউ কেউ ছবি দেখে রেস্তোঁরায় খেতে যেত, অন্যরা নৈশভোজ সেরে বেশি রাতের শো’তে যেত। শহরের একপ্রান্তে পাহাড়, তার পাদদেশে ছিল বড় বড় স্টুডিও। সেখানে সেট বানিয়ে তৈরি হত অনেক সিনেমা। সারা পৃথিবীতে বিখ্যাত ছিল আমাদের শহর চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য। এরপরে কম্প্যুটার বিপ্লব এল। এল আন্তর্জাল। ধীরে ধীরে মানুষ ছবিঘরে যাওয়া বন্ধ করে দিল। কিন্তু তারপরে যে বিভাজন এল তার জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না।

আমাদের শহরের নাগরিকেরা দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একদল ধর্মীয় উন্মাদনার কবলে পড়ল আর একদল ত্রিমাত্রিক ভিডিও খেলায় নিয়োজিত হল। প্রথম দলে আমি নাম লিখতে অপারগ ছিলাম, মনে হয়েছিলে তাদের দর্শন অগভীর আর দ্বিতীয় দলের কোনো দর্শন ছিল না, সেখানে ঢুকতেও মন সায় দিল না। দ্বিতীয় দল টি নানা পেশায় নিয়োজিত ছিল, তাদের মধ্যে দোকানদার, ব্যবসায়ী, ছাত্র, তথ্যপ্রযুক্তির মানুষ, ধাতব কারিগর, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কেরানি, পরিবহন শ্রমিক, বস্ত্রকর্মী সবই ছিল, কিন্তু তারা গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য যতটুকু দরকার তার বেশি তাদের পেশায় সময় দিতে অনিচ্ছুক ছিল এবং তাদের সমস্ত অবসর সময়টা তারা ত্রিমাত্রিক খেলায় নিয়োজিত করেছিল। প্রথম দলটি আদৌ কোনো পেশায় নিয়োজিত ছিল কিনা বলতে পারব না, তবে নির্দিষ্ট কাজের জন্য দক্ষতা তৈরি করতে যে সময়টুকু দেয়া দরকার সেই সময়টুকু তারা দেবার দরকার মনে করত না, কারণ এই গ্রহের বুকে তারা নিজেদের ক্ষণিকের অতিথি মনে করত। অন্যদিকে ত্রিমাত্রিক খেলায় নিয়োজিত কিছু মানুষের দয়া-দাক্ষিণ্যের ওপর তারা নির্ভরশীল ছিল যদিও ত্রিমাত্রিক খেলাকে তারা ঘৃণা করত (এই ব্যাপারটাকে আপনি irony বলতে পারেন)। ও হ্যাঁ, তৃতীয় একটি দল ছিল বৈকি – যারা ত্রিমাত্রিক খেলা তৈরি করছিল। বলাই বাহুল্য এদের সংখ্যা বেশি ছিলনা, কিন্তু তারা কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট সমস্ত আলোর মাধ্যমকে ত্রিমাত্রিকভাবে পরিবেশনের জন্য কাজ করে যাচ্ছিল।

শহরের শুধুমাত্র গুটিকয়েক মানুষ বিভাজন পূর্ববর্তী সময়ের অভ্যাস বজায় রেখেছিল। তার মধ্যে আমি একজন। আমাদের শহরে খুব সুন্দর সূর্যাস্ত হয়। দিনের বেলা অফিসে বসে আমি একটা বড় কোম্পানির ব্যবসার খতিয়ান করি, সন্ধ্যার আগে অফিস থেকে বেরিয়ে সমুদ্রের দিকে হাঁটি। আমি পৃথিবীর অনেকে জায়গায় গেছি, কিন্তু জানেন, আমাদের শহরের মত সুন্দর সূর্যাস্ত কোথাও দেখিনি। সূর্য ডুবে গেলে আকাশের মেঘে যেন আগুন লেগে যায়। আকাশ অন্ধকার হয়ে এলে আমি ছবিঘরে যেতাম, কোনো কোনো সময়ে প্রেক্ষাগৃহে একাই দর্শক থাকতাম। অন্য সময় হলে একজনের জন্য ছবি চালাত না, কিন্তু ছবিঘরের মালিক আর মেশিন চালক আমাকে চিনে গিয়েছিল, তারা আমাকে প্রশ্রয় দিত। এই সময়টা জুড়ে সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, আমরা তিনজনই জানতাম ওই প্রেক্ষেগৃহের আয়ু আর কয়েকমাস মাত্র।

সেই ছবিঘরেই তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়, ধীরে ধীরে তাকে আমি চিনি, ইসাবেল সিমোনে। আপনি কি তার ছবি দেখেছেন, কি নাম শুনেছেন? তার প্রতিটি ছবিই ছিল ভিন্ন, কিন্তু যে চরিত্রেই সে অভিনয় করুক না কেন – উচ্চাভিলাষী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, মুক্ত চিন্তার জীবনকে নিয়ে পরীক্ষারত ছাত্রী, কর্মক্ষেত্রে উপেক্ষিতা শ্রমিক, ঘরে নিগৃহীতা কিন্তু বাইরে পারিবারিক সম্মান রক্ষার ভূমিকায় অভিজাত গৃহবধূ, দস্যুদের হাতে থেকে পলায়নরতা রমণী – তার অন্তর্নিহিত উজ্জ্বলতাকে ঢাকা যেত না। যেরকম চরিত্রই হোক না কেন – ত্রিকোণ প্রেমে আটক দোদুল্যমান নারী, কিংবা চরম স্বার্থপর বিশ্বাসঘাতক – সে পর্দায় এলে আমি সব ভুলে যেতাম, আমার মনোজগতের বুদ্ধিবৃত্তিকে বিসর্জন দিয়ে নিমজ্জিত হতাম তার উচ্চারণ, চোখের মণি, ভুরু, কান্না, গালের টোল, বাহুর কোমলতা, স্তনযুগলের ভাঁজ, উরুর বক্রতায়। আমি নিশ্চিত ছিলাম পৃথিবীতে আমিই একমাত্র সেই উজ্জ্বলতা দেখতে পাই, যেন সে তার সমস্ত অভিনয় ক্ষমতা ঢেলে দিয়েছিল আমার জন্য, যেন সে জানত এক বিশাল নগরীর পরিত্যক্ত ছবিঘরে একজনই দর্শক থাকবে যে তার সত্তাকে চিনবে। একে আপনারা এক ধরণের আসক্তি বলতে পারেন কারণ দ্বিমাত্রিক তলের এক অধরা মানুষের সঙ্গে কি প্রেম করা সম্ভব? তবু বলব, আপনারা যাঁরা এই লেখা পড়ছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই এই আসক্তির সাথে লড়াই করেছেন, ত্রিমাত্রিক খেলা আপনাদের মস্তিষ্ক পুরোপুরি অধিকার করার আগে।

ইসাবেল সিমোনে আমার সমস্ত কিছুকে অধিকার করে নিল। আমার এক বন্ধু, গৌতম সিদ্ধ, একটি শিল্পকলা পত্রিকার সম্পাদক ছিল। সেই পত্রিকাটি সিনেমা শিল্পীদের সাক্ষাৎকার নিত। গৌতমের কাছ থেকে ইসাবেল সম্পর্কে আমি অনেক তথ্য পেলাম, জানলাম সে আমাদের শহরেই থাকে, একাই থাকে, গৌতমের জানামতে তার কোনো স্থায়ী জীবনসঙ্গী নেই। গৌতমকে বললাম আমাকে সাংবাদিক করে ইসাবেল সিমোনের কাছে পাঠাও। গৌতম বলল, পাগল নাকি, আমার কোন সাংবাদিক অভিজ্ঞতা নেই, আমি তার পত্রিকার সাথে যুক্ত নই, সর্বোপরি আমি ইসাবেল সিমোনে নিয়ে পুরোপুরি আচ্ছন্ন, আসক্ত। কাজেই সে আমাকে নিয়ে কোনো পরীক্ষা করাতে চায় না। এরকম কয়েক মাস গেল, আমার অবস্থার আরো অবনতি হল। অবশেষে গৌতম রাজি হল, বলল, “মাশার, তুমি যেতে পারবে, কিন্তু শর্ত হল তোমার সাথে একজন চিত্রগ্রাহক যাবে, আর আমি তোমাকে কী প্রশ্ন করবে তা ঠিক করে দেব এবং ওখানে যেয়ে কোনো অশালীন আচরণ করবে না।”

ইসাবেল সিমোনের সঙ্গে কথা বলে গৌতম আমার সাক্ষাৎকারের দিন ঠিক করে দিল, এক সপ্তাহ পরে বুধবার বিকেল পাঁচটায়, আমার সঙ্গে যাবে চিত্রগ্রাহক ইয়োহানেস। এই ছিল পরিকল্পনা, কিন্তু আমার মাথায় ইয়োহানেসকে নিয়ে যাবার কোনো চিন্তা ছিল না, ইসাবেল সিমোনের সঙ্গে প্রথম দেখা হবে, তাতে তৃতীয় একজন থাকবে তা আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারলাম না। গৌতমের কাছ থেকে ইয়োহানেসের ফোন নম্বর চেয়ে নিলাম, দিন কয়েক বাদে তাকে ফোন করে বললাম বুধবারের সাক্ষাৎকার বাতিল হয়ে গেছে, পরে কোন একদিন হবে।

বুধবার সকাল থেকে আকাশে কালো ছেঁড়া মেঘ ভেসে যেতে থাকল, দুপুরের দিকে অল্প বৃষ্টি পড়ল। ইসাবেল সিমোনে যে রাস্তায় থাকে সেখানে দশ বারো তলা উঁচু সব বাড়ি, সবই ফ্ল্যাট বাড়ি, আর্ট ডেকো স্টাইলের, সুনিপুণ সরলরেখার কংক্রিট গঠন। বাড়িগুলোর বয়স একশ বছরের কাছাকাছি হবে, দেয়ালে ফুল ও লতার ফ্রেস্কো, ওপরে নীল-সবুজ রঙের তামার গম্বুজ কি চুড়ো। এককালে এই তামার রঙ লাল ছিল, বায়ুর সাথে বিক্রিয়ায় ধীরে ধীরে এই মোলায়েম শান্ত রঙটি ধারণ করেছে। প্রশস্ত রাস্তাটি পুব থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত, সমুদ্রে যেয়ে শেষ হয়েছে যদিও এখান থেকে সমুদ্র দেখা যায় না। দিনটি হয়তো ছিল জলবিষুবের কাছাকাছি কোনো একটা সময়, দু-পাশের উঁচু বাড়িগুলোর দুটি সমান্তরাল রেখা পশ্চিমে কাছাকাছি এলেও তাদের মধ্যে অল্প ফাঁক ছিল, সেখানে সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। লাল, গাঢ় লাল, রক্তিম লাল, বেগুনি, ল্যাভেন্ডার আর গোলাপি মেঘের পেছনে। ল্যাভেন্ডার ফুলে ভরা এক মাঠের স্বপ্ন দেখি আমি, বৃষ্টিস্নাত হেমন্তের বিকেলে আমার কল্পনায় ল্যাভেন্ডারের গন্ধ আমাকে শান্তি দেয়। ল্যাভেন্ডার নাকি লাইলাক? কোনো একদিন এক কবিকে আমি পড়েছিলাম, তার হৃদয় ছিল লাইলাক রঙের।

আমার হাতে এক গুচ্ছ ফুল, লাইলাক। ভেতরে ঢুকলে বড় একটা অভ্যর্থনার জায়গা, কিছু চেয়ার ও সোফা, দৌবারিক একটি টেবিলের পেছনে বসা। বললাম, “ইসাবেল সিমোনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি ‘কসমো’ পত্রিকার পক্ষ থেকে।” সে ওপরে ফোন করে, আমার নাম বলে, তারপর ফোনটি আমার দিকে এগিয়ে দেয়। ফোনটি ঠাণ্ডা হয়ে থাকে আমার করতলে, অথচ কপালে ঘাম জমে, হৃদপিণ্ড দ্রুত চলে, কিন্তু তারপরই মুহূর্তের মধ্যে আমি পরিণত হই আত্মবিশ্বাসী এক যন্ত্রে –
“হ্যালো, আমার নাম আবু মাশার, ‘কসমো’ পত্রিকার গৌতম সিদ্ধ আমাকে পাঠিয়েছেন।”

ওপাশ থেকে একটি প্রশ্বাসের শব্দ বোধহয় শুনি। ইসাবেল সিমোনের সঙ্গে আমার প্রথম উপস্থিত যোগাযোগ, গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। শুনি তার কন্ঠ – “আচ্ছা, আমি এখনো প্রস্তুত নই, আমাকে পনেরোটা মিনিট সময় দিন, নিচে বসার জায়গা আছে, ওখানে একটু বসুন।” আমি এই কন্ঠের সাথে পরিচিত, তার কন্ঠনালীর ওঠা-নামা, অক্ষরমালার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ আমি জানি।
নিচে বসার জায়গাটিতে চেয়ার, সোফা ও টেবিল আর্ট ডেকো স্টাইলের, তাদের পায়াগুলি উল্টানো জ্যামিতিক মিনারের মত। ওপরে স্ফটিক ঝাড়বাতি, ওক কাঠ ও ট্রাভেরটাইনের দেয়াল। একদিকের দেয়ালে বিরাট একটি আর্ট – একজন আবক্ষ নারীর পার্শ্বচিত্র, তার লাল স্কার্ফ বাতাসে উড়ছে। তার মাথার ধূসর হাতে-বোনা কান-ঢাকা টুপির নিচ দিয়ে কালো চুলের গোছা গালের ওপরে বেরোনো। শ্বেত-হলুদ ত্বকের ওপর স্ফারিত ঠোঁট লাল লিপস্টিকে উদ্ভাসিত। তার চোখ নিচের দিকে কিছু একটা দেখছে কিছুটা অবজ্ঞায়, কিছুটা উদাসীনতায়। তার চোয়াল, থুতনি, গলার মাংসপেশী সবই আঁকা হয়েছে জ্যামিতিক সরল রেখায়। আমি পনেরো মিনিট ধরে এই চিত্রে নিমজ্জিত থাকি, ধীরে ধীরে অঙ্কিত নারীর মুখাবয়ব পরিণত হয় ইসাবেল সিমোনের।
ওপর থেকে ফোন আসে দৌবারিকের কাছে, সে আমার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছিল, কিন্তু আমার সম্মোহন না ভাঙাতে পেরে কাছে এসে আমার কাঁধ নাড়ায়। হাত দিয়ে লিফটের দিক নির্দেশ করে, বলে আট তলার চার নম্বর ফ্ল্যাট।

লিফটে উঠে আট নম্বর বোতামে চাপ দিই। লিফট ওপরে উঠতে থাকে, মনে হয় লিফট একটা রকেট, আমাকে নিয়ে মহাকাশে যাচ্ছে। আমি এক মহাকাশচারী চাঁদে যাচ্ছি। চাঁদের দীর্ঘ নির্জনতায় অপেক্ষা করছে লাল স্কার্ফ পরা, লাল ঠোঁটের এক নারী। লিফট থেকে বের হয়ে চার নম্বর ফ্ল্যাট সামনেই। কলিং বেল টেপার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দরজা খুলে আমার সামনে দাঁড়ালেন ইসাবেল সিমোনে। এত সহজেই এমন পুরস্কার পাওয়া কী সম্ভব? সম্ভব, কারণ পৃথিবীতেই আমি একমাত্র পুরুষ যে কিনা ইসাবেলকে বুঝতে পারে। তাই ভাগ্য আমার সহায়। এরকম এক ধরণের সহায়তা কল্পনা করে মনে বলিষ্ঠ হই।

ইসাবেল সূর্যের মত জ্বলতে থাকে। রক্তাভ লাল স্কার্ট হাঁটুকে অল্প ঢাকা, ওপরে সাদা একটি জামা যেটির হাতা কব্জির অল্প আগে শেষ হয়েছে। খোলা হাল্কা বাদামী চুল কাঁধে এসে পড়েছে, নিতান্ত আলস্যভরে যেন তাদের আর কোথাও যাবার নেই। সে বলে, “আপনার চিত্রগ্রাহক কোথায়?”

“সে আজ একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছে,” আমি বলি, “কিন্তু আপনি আজ সময় দিয়েছেন, আর কোনদিন দিতে পারবেন সেটা ভেবে আমি একাই এসেছি।” আমি লাইলাকের তোড়া এগিয়ে দিই।
ইসাবেলের মুখে কি একটা সন্দেহের ছায়া দেখা গেল? আশঙ্কা? ক্ষণিকের জন্য হলেও। ডান হাত বাড়িয়ে সে আমার ফুলের তোড়া গ্রহণ করে। এই প্রথমবার আমি তার করতলের রেখাগুলি স্পষ্ট করে দেখি। আশা করেছিলাম তার আঙুল আমাকে হাত ছোঁবে, সেটা হল না, কিন্তু আমার হাতে সময় আছে অনেক।

একটা ছোট করিডরের পরই বড় বসার ঘর, একদিকের জানালা দিয়ে অস্তগামী সূর্য দেখা যাচ্ছে, কেমন করে, ভাবি আমি। এই ফ্ল্যাটের পশ্চিম দিক থেকে কিছু দেখা যাবার কথা নয়। দেয়ালে একটি বেশ বড় চিত্র – সবুজ কাপড়ের ওপর হলুদ ফুল আঁকা স্কার্ট-পরা এক নারী একটি ইজি–চেয়ারের মত বিছানার ওপর আধো-শোয়া, তার এক হাতে একটি সবুজ টিয়া। মেঝেতে বসে আছে পাগড়ি–পরা এক বালক, তার হাতে ধরা একটা লাঠি, লাঠির মাথায় ঝালর, সে নারীকে বাতাস দিচ্ছে। নারীটির মুখে উদাসীনতা, কিংবা অহঙ্কার।

“এখানে বসুন।”

যেখানে ইসাবেল আমাকে বসতে বলল সেটি একটি সোফা, উজ্জ্বল চোখ-ধাঁধানো লাল কাপড়ে মোড়া। লাল রঙটি সোফা থেকে বিচ্ছুরিত হছে এমনভাবে যে সোফার তলটি ঠিক কোথায় বোঝা যাচ্ছে না, ফোকাস করা যাচ্ছে না সেরকম একটি ছবি। সোফাটির দিকে এগিয়ে হাত দিয়ে হাতড়ে বুঝতে হল সোফাটি কোথায় শেষ হয়েছে। বসে ইসাবেলের মুখ দেখলাম। মনে হল সে আমার এই বিভ্রান্তিটুকু উপভোগ করেছে। কিন্তু তার মুখাবয়ব দেখে নিজেকে আবার হারিয়ে ফেললাম। তার ঠোঁটের দুই কোনায় অল্প ভাঁজ পড়েছে, যেটা তার ছবিগুলোয় খেয়াল করিনি। আর তার স্ফারিত ঠোঁট লাল ছিল না, ছিল ল্যাভেন্ডার রঙের। নাকের দুপাশ থেকে আরো দুটি ভাঁজ এসে সেখানে মিলিত হয়েছে। কবে এটা হল? তার শেষ ছবিটি মাত্র ছ’মাস আগে বের হয়েছি। এই ভাঁজগুলো তো সেখানে দেখিনি। কিন্তু এসব ভুলে গেলাম, তাঁর চোখের হাল্কা বাদামী মণির গভীরতা আমাকে প্রশান্ত মহাসাগরের অতলে নিয়ে গেল।

“আমার সহকারি পল একটা কাজে বের হয়েছে, এখনই এসে পড়বে, সে আমাদের কফি করে দেবে। আপনি কফি খান তো?”

আমি মাথা হেলিয়ে শুধু হ্যাঁ বলতে পারি, ভাগ্য আমাকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে, এটা যে মহাবিশ্বের কার্যকারণের একটা প্রক্রিয়া এই বিষয়ে সন্দেহ থাকেনা।

“এবার বলুন আপনার কী প্রশ্ন আছে?” এই বলে ইসাবেল একটা ডিভানে বসল যার গদিও লাল রঙের কাপড়ে মোড়া ছিল। ইসাবেল সিমোনের লাল রঙের স্কার্ট সেটার সঙ্গে মিশে তার দেহের একটা অংশকে অদৃশ্য করে দিল। স্কার্টের নিচে এবার তার হাঁটু দেখা গেল যার আকার আমার মনে ছিল পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রোথিত। হাঁটু থেকে গোড়ালির অংশটি ছিল গভীর অরণ্যে সরু জলস্রোতের ওপর সেতু, সেটি শেষ হয়েছিল ব্যালে নর্তকীরা পরে এমন সমতল তলের লাল জুতোয়। জুতোজোড়াকেও আমার চোখ ফোকাস করতে পারল না, সেগুলো জ্বলতে থাকল লাল আভা নিয়ে। কী প্রশ্ন তাকে আমার করার ছিল? তাকে আমার কোনো প্রশ্নই করার ছিল না। তার বুকে, জামার ওপরের খোলা অংশে, একটি উপবৃত্তাকার রুপোর লকেট, সেই লকেটটি খুললে কী পাওয়া যাবে এই প্রশ্নটিই শুধু মনে এল। তবু আমার মনের শেষপ্রান্ত থেকে আমার যৌক্তিক জীবনের ছিঁটে-ফোঁটা উদ্ধার করে বললাম, “আমি আপনার কথা রেকর্ড করব যদি আপনার আপত্তি না থাকে।”

ইসাবেল সায় দেয়। কোটের পকেট থেকে ফোনটা বার করে রেকর্ডের বোতামটা টিপে সামনের কফি টেবিলের ওপর রাখি। বলি, “আপনার আসল নাম তো ইসাবেল সিমোনে না? কিন্তু কেউ আপনার সেই নামটি জানে না। আমি কি সেটা জানতে পারে?”

সে হেসে ওঠে, গালে টোল পড়ে (ত্রিকোণ, কিন্তু খুব তীক্ষ্ণ নয় এমন থুতনিতে টোল থাকে সবসময়ই)। তার হাসি ছিল গিটারের তারের মৃদু কম্পন, তার বেয়ে সেই কম্পন বায়ুতে উছলে উঠে ঘরে ছড়িয়ে পড়ল। সে বলে, “একটা নাম হল বাতাসের মত, সে একটা পাহাড়কে খোদাই করে তার রূপ দেয়। এখন আর সেই বাতাসকে বদলাতে চাইনা। আপনার পাঠক, শ্রোতা, দর্শকদের এটুকু না জানলেও চলবে। এই ধরুণ আপনার নামটি, মিস্টার মাশার, আপনার নাম শুনে আপনাকে একভাবে ভেবে নিয়েছিলাম, আন্তর্জালে চেষ্টা করিনি আপনার ছবি খোঁজার। আজ আপনাকে সাক্ষাতে দেখে আমার ভাবনার সাথে চেহারাটির কতখানি মিল সেটা বার করাই একটা আনন্দ। এটা হল একটা ধাঁধা, পাজল।”

“কিন্তু এই নামটি আপনার মা–বাবার দেয়া। আপনি কি নাম বদলে শৈশবের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করছেন?” জিজ্ঞেস করি আমি।

“না, সম্পর্ক ত্যাগ নয়, নিজেকে নতুন করে গড়ার প্রচেষ্টা।” আমার দিকে তাকায় ইসাবেল সিমোনে, কপালের সমতলের নিচে ভুরুর সরু বনশ্রেণী আমার হৃদপিণ্ডকে দ্রুত করে।

সূর্য ডুবে যায়, ঘরটা অন্ধকার হয়ে ওঠে, কিন্তু ইসাবেল ঘরে বাতি জ্বালাবার কোনো উদ্যোগ নেয় না। এর মধ্যে ঘরের কোনায় একটা তেপয়ার ওপর রাখা বাতি জ্বলে ওঠে, তার চারদিকের আবরণ একটা হাল্কা হলুদ আলোয় ঘরটাকে ভরিয়ে দেয়। একটা হাল্কা ট্রাম্পেটের শব্দ ভেসে আসে, সাহসী উজ্জ্বল বাজনা, সাথে পিয়ানোর মৃদু বোতাম। সেই আলো আর বাজনা তার মুখাবয়বকে রহস্যময় করে তোলে। সেই রহস্য আমাকে যেন বাধ্য করে বলতে, “পৃথিবীতে যদি কেউ আপনার অভিনয়ের এক নম্বর অনুরাগী হয় সে হল আমি। আমি আপনার অভিনীত প্রতিটি ছবি অন্তত তিনবার করে দেখেছি। আপনার প্রতিটি ডায়ালগ আমার মুখস্থ, প্রতিটি ছবিতে আপনার পোষাক, মুখাবয়ব সব আমার স্মৃতিতে গাঁথা, আপনার পেশা আমার মত কেউ অনুসরণ করেনি।” কথাগুলো এত আগে বলার আমার কোনো ইচ্ছেই ছিলনা, কিন্তু নিজেকে সামলাতে পারলাম না।

ইসাবেলের মুখমণ্ডলে পরিবর্তন হয়, ভুরুর বনশ্রেণী কুঁচকে ওঠে। “আপনি তাহলে আমাকে অনুসরণ করছেন, ভাল অর্থে বলছি না, একজন ফেউয়ের মত, নাকি? তাহলে আপনি সাংবাদিক নন?”

এত সহজে আমি ধরা পড়ে গেলাম? ঘরের কোনায় হলুদ ল্যাম্পটি যে এর জন্য দায়ী এ বিষয়ে সন্দেহ রইল না। “আপনার ল্যাম্পটির আলো কী দিয়ে তৈরি?” বিড়বিড় করে বলি আমি।

হেসে ওঠে ইসাবেল আবার। উচ্ছল, নির্দোষ হাসি। সেই হাসিতেই যেন ঘরের অন্য আর একটি কোনায় রাখা বাতি জ্বলে উঠল ঘরটাকে আলোয় ভরিয়ে দিয়ে। যে জ্যাজ বাজনাটি শোনা যাচ্ছিল ইসাবেলের হাসি শুনে সেটি যেন তাল পরিবর্তন করল। “কঠিন আলো অভিনেতাদের সুনির্দিষ্ট ছায়া তৈরি করে যাতে তাদের দেহ ও মুখমণ্ডলের দিকে দর্শকদের নজর নিয়ে যায়, আর নরম আলো সৃষ্টি করে সাম্যের, সেখানে কোনো কড়া ছায়া নেই। এই হল আলোর নন্দনতত্ত্ব।” ইসাবেলের কথাগুলো শেষ হতে না হতেই মাথার ওপরে একটা কড়া আলো জ্বলে ওঠে, আমার চোখ কুঁচকে যায়, ছায়া পড়ে মেঝেতে। কিন্তু ইসাবেলের কোনো ছায়া তৈরি হয়না, আগের মতই সে নরম আলোতে ভেসে থাকে, তার পা দুটো সে তুলে দেয় ডিভানের ওপর, আধ-শোয়া অবস্থায় সে যেন উপভোগ করে আমার অস্বস্তি। “আর অভিনয়ের মূলমন্ত্র হল চরিত্রের অস্বস্তি, ভয়, দুঃখ, আনন্দকে আত্মস্থ করা। আমি কে? আমি কী চাই? যা চাই তা আমি কেমন করে পাব? স্তানিস্লাভস্কি পদ্ধতি বলতে পারেন।”

উজ্জ্বল আলোর অস্বস্তি কাটিয়ে উঠতে চাই। অস্বস্তি ধীরে ধীরে পরিণত হতে চায় ক্রোধে। ইসাবেলের আধ-শোয়া ভঙ্গীটি দেয়ালে ঝোলানো চিত্রকর্মের নারীটির মতই, তাহলে আমি কি মেঝেতে বসা ক্রীতদাস বালক? ইসাবেল আমার দিকে তাকায় না, তার ডান হাত ওপর দিকে উঠিয়ে বলে যেতে থাকে, “কিন্তু ছবিতে অভিনয় পুরোপুরি বাস্তবসম্মত হতে পারে না, সেটা হয় বাস্তব অনুসারে কিন্তু উঁচু লয়ে, সেই উঁচু লয়ের মধ্যে দর্শককে প্রবেশ করানোই আমার কাজ।” আমার মাথার ওপরের আলোটি আরো তীব্র হতে থাকে, ওপরে তাকিয়ে আলোটির উৎস খুঁজে পাই না। ইসাবেল বলতে থাকে, “আন্তন চেখভের এক ভাইপো ছিল, মিখাইল চেখভ। মিখাইল বলল, হাত পা ছুঁড়তে হবে, শারীরিক অনুশীলন, তার মধ্যে দিয়ে ভেতরের মনোজগতকে বার করে নিয়ে আসতে হবে। দেহ আর মন এই দুটোর মধ্যে সাম্য থাকতে হবে। সাধনা, চর্চা, রিহার্সাল দিয়ে ভেতরের অধরা অনুভূতিকে বাইরের জগতের কাছে প্রকাশ করতে হবে।” ইসাবেলের কথাগুলো অনুধাবন করা আমার জন্য কঠিন কিছু ছিল না, কিন্তু আমি অশান্ত হয়ে উঠছিলাম। ইসাবেল ডিভান থেকে পা নামিয়ে নেয়। বলে, “কিন্তু এই অভিনয় তত্ত্বের কচকচানি আপনার পছন্দ হবে না। আপনার আর কী প্রশ্ন আছে?” আমার বৌদ্ধিক জগৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে ইসাবেল সিমোনে, আমার অহংবোধ খুব আহত হল, ক্ষুব্ধ হলাম। অস্বস্তি, ক্রোধ ও ক্ষুব্ধতা অবচেতন থেকে উঠিয়ে নিয়ে এক চাপা-দেয়া আসক্তি।

ছবির পর্দায় ইসাবেল সিমোনের দেহকে যতদূর দেখিয়েছে সেই দেহ আমার মুখস্থ, কিন্তু তার উন্মুক্ত পিঠ আমি কখনো দেখিনি, বিশেষত তার অংসফলক, সেই জায়গাটা পিঠে ঘাড়ের নিচে, দুদিকে যে প্রশস্ত হাড়দুটি থাকে, যেখানে মনে হয় উড়ে যাবার ডানা থাকবার কথা ছিল। ইসাবেলা তো স্বর্গ থেকে নেমে এসেছিল, তার তো ডানা থাকার কথা ছিল। আমি স্বপ্ন দেখেছি ইসাবেলা তার পিঠ আমাকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে তার অংসফলক দেখার জন্য। আমি কি অভিনেতা হতে পারতাম না? পর্দায় কি হতে পারতাম না ইসাবেলের অনুরাগের পাত্র? স্তানিস্লাভস্কি, চেখভ, মেথড অ্যাকটিং এসব আমার প্রতিদিনের খাদ্য। চেয়ার ছেড়ে উঠে ইসাবেলের পেছনে হেঁটে গেলাম। ইসাবেল কী বুঝতে পারল জানি না, সে চিৎকার করে উঠল, “আপনি কী করছেন?” সোফা ছেড়ে ইসাবেল দাঁড়ালো, ততক্ষণে আমি তার পেছনে। আমার অভিনয় বুদ্ধিবৃত্তির ওপর নির্ভর করে না, আমার অভিনয় সহজাত, প্রবৃত্তি দিয়ে তাড়িত। আমার দু’হাত তার পিঠের ওপরের দিকে এগোয়, ছিঁড়ে ফেলতে হবে তার জামার ওপরের অংশ, দেখতে হবে তার অংসফলক, কেমন করে সেটি জেগে থাকে তার পিঠের ওপর?

আমার চেয়ার ছেড়ে উঠে ইসাবেলের জামার দিকে হাত বাড়ানো, পাঁচ সেকেন্ড সময়ও হয়তো এর মধ্যে অতিবাহিত হয়নি, ইসাবেল দাঁড়িয়ে থাকে আমার দিকে পিছন ফিরে, নির্বাক নিস্পন্দ। আমার ডান হাত এগিয়ে যায়, এগিয়ে যেতে থাকে, আমার সমস্ত আসক্তি, ঘোর, আবেশ, লালসা ও হিংস্রতা নিয়ে। তার জামা ছিঁড়ে দুটি অংসফলকের ওপর আমার হাত দুটি রাখার, শুধুমাত্র এই চিন্তাটুকু আমার মনকে অধিকার করে রাখে। কিন্তু আমার হাত ইসাবেলের পিঠ স্পর্শ করতে পারে না যদিও সে ঠিক আমার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। কিছু একটা ঠিক নেই, কী ঠিক নেই? ইসাবেল যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেটা কতদূর আমি বুঝতে পারছিলাম না। আমি গভীরতার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি। পৃথিবী একটা দ্বিমাত্রিক চিত্রকর্ম, এটা ভাবতে ভাবতেই আমার হাত ইসাবেলের পিঠ ছোঁয়, আর ছোঁয়া মাত্র ইসাবেল ঘুরে তার হাতে ধরা কিছু একটা দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করে। জ্ঞান হারবার আগে, শরীরটা পড়তে পড়তে মনে হয় মেঝেটা আমার চোখের থেকে কতদূর সেটা বুঝতে পারছি না। জ্যাজ বাজনাটাও বন্ধ হয়ে যায়।

জ্ঞান যখন ফিরল শুনলাম ইসাবেল কাকে যেন বলছে, “না, পল, আমি পুলিশ ডাকতে চাইনা, আমার মনে হয় এই লোকের যথেষ্ঠ শিক্ষা হয়েছে, তুমি একে নিচে নামিয়ে দিয়ে এসো। আর ওর ফোনটা ওর কোটের পকেটে রেখে দাও।” আমার মুখ থেকে হয়তো গোঙানীর শব্দ বেরিয়েছিল, ইসাবেল ও পলকে আমার ওপর ঝুঁকে পড়তে দেখি, কিন্তু তাদের মুখমণ্ডল আমার থেকে কতদূর বুঝতে পারি না। মনে হল আমার চোখ গভীরতার মাত্রা হারিয়ে ফেলেছে, আমার বিশ্ব দ্বিমাত্রিকতায় পর্যবসিত হয়েছে। কীভাবে পল আমাকে নিচে নামিয়ে আনে সেই স্মৃতি আমার নেই। পল একটা ট্যাক্সি ডেকে আমাকে উঠিয়ে দেয়, জানি না সে আমার ঠিকানা কেমন করে জেনেছিল, সে চালককে ভাড়াও দিয়ে দিয়েছিল অগ্রিম। ট্যাক্সি আমাকে বাড়ির কাছেই নামিয়ে দেয়, কিন্তু আমি আমার বাসা খুঁজে পাই না, কারণ আমার বিশ্বের কোনো গভীরতা ছিল না। রাস্তার বহু ওপরে বাতিগুলো জ্বলে, সেগুলো আশে পাশের বাড়িগুলোকে আমার কাছে পুরোপুরি স্পষ্ট করতে পারে না। আমি অন্ধ হইনি, কিন্তু গভীরতা ব্যতিরেকে এই বিশ্বে চলাফেরা সেই মুহূর্তে অসম্ভব ছিল। এর মধ্যে আমার সামনে একটি পুলিশের গাড়ি থামল, বুঝলাম তাতে দুজন পুলিশ আছে, একজন চিৎকার করে বলল, “জানো না এখন কারফিউ চলছে!” কারফিউ? “কিসের কারফিউ?” চিৎকার করে বলি আমি, “কারফিউ কেন?” শুনি এক পুলিশ আর এক পুলিশকে বলছে, “এই যে পাওয়া গেছে আর একজনকে, এরা সব জেনে না জানার ভান করে।”

আমি ততক্ষণে আমার সম্বিত অনেকখানি ফিরে পেয়েছিলাম, অল্প অল্প করে পুলিশের গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেলাম, বললাম, “আমি আমার দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছি, পুরোপুরি হারাইনি, কিন্তু আমার এমন কিছু হয়েছে যা বুঝতে পারছি না। আমাকে বলুন কেন কারফিউ। আমি আসলেই জানি না।”

পুলিশ দুজনের বোধহয় দয়া হল আমার প্রতি। বুঝলাম তাদের মুখে মাস্ক লাগানো। “মড়ক লেগেছে শহরে, তা কি আপনি জানেন না?” মড়ক, আমি আশ্চর্য হই, কিসের মড়ক, কেমন মড়ক? আজ বিকেলে ইসাবেল সিমোনের বাড়ির সামনে যখন দাঁড়িয়ে ছিলাম, এই শহর তার দিনের কাজ শেষ করছিল, রাস্তা গাড়িতে পূর্ণ ছিল, লোকজন মেট্রো স্টেশনে দল বেঁধে ঢুকছিল। “না, আমি আসলেই জানি না, আমাকে বলুন, আমি আজ বিকেলে এক জায়গায় গিয়েছিলাম। এখন আপনাদের দেখে মনে হচ্ছে আজ নয়, বহুদিন আগে সেখানে গিয়েছিলাম।”

পুলিশ দুজন গাড়ি থেকে বের হয়ে আসে, আমার হাতে একটা মাক্স ধরিয়ে দিয়ে সেটা পরতে বলে। আমার বাড়ির ঠিকানা জিজ্ঞেস করে, তারপর আমার হাত ধরে আমার বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়।

এই হল আমার কাহিনী, মিস্টার অমল। আমি একটা ভয়ানক অপরাধ করতে যাচ্ছিলাম, বা হয়তো করেছি, সেটার স্মৃতি আমার এখন আর নেই। ইসাবেল সিমোনে আমাকে শাস্তি দিয়েছে। তার হাতের ব্যাগ বা অন্য কিছু দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করেছিল, সেজন্যই হয়তো আমি ত্রিমাত্রিক দৃষ্টি হারিয়েছি। না, ঠিক বলছি না, ইসাবেল আমাকে আঘাত করার আগেই আমার গভীরতার জ্ঞান চলে গিয়েছিল, আমার প্রসারিত হাত তার পিঠ ছুঁতে পারছিল না। যেটাই হোক এক অর্থে এটা ভালই হয়েছে, বলতে পারেন। ইসাবেল সিমোনের জগৎ তাকে দেখার আগে চলচ্চিত্রের দ্বিমাত্রিক পর্দায় নিবদ্ধ ছিল, এখন আমি পুরোপুরি দ্বিমাত্রিকতায় নিমজ্জিত, তাই আমার এই নতুন বাস্তবতার সঙ্গে ইসাবেলের অভিনয় জগতের কোনো তফাৎ নেই। ত্রিমাত্রিক খেলা আমি খেলতাম না, তাই সেটার জন্য আমার কোনো দুঃখবোধ নেই, কিন্তু মিস্টার অমল, কোটি কোটি বছর আগে বিবর্তনের ফসল হিসেবে প্রাণীরা ত্রিমাত্রিক স্টেরিও দৃষ্টি পেয়েছিল, একটি বোকামি সেই অর্জনটিকে মুহূর্তে ধ্বংস করে দিতে পারে। ইসাবেল আমার হঠকারিতার জন্য আমাকে এই জগতে নিক্ষেপ করেছে, আমার তার প্রতি তো কোনো অভিযোগ তো নেইই, বরং বলব আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ। তার অংসফলক আমার স্পর্শ করার কথা নয়। মাঝে মাঝে মনে হয় তার ওখানে যাওয়া, তার সঙ্গে কথা বলা এই নতুন মহামারীর অংশ। কল্পনা বা ভ্রান্ত স্মৃতি বলতে পারেন। ইসাবেলের লাল স্কার্ট আর লাল সোফাকে আমার দৃষ্টি ফোকাস করতে পারেনি। যেটাই হোক আমি তাকে যেমনভাবে চেয়েছি আজ সেভাবেই পেয়েছি। আমার জগৎ এখন এডগার ডেগার চিত্রকর্ম। আমার হৃদয় এখন লাইলাক রঙের। রঙের কি মাত্রা আছে? আমার হৃদয় এখন দ্বিমাত্রিক লাইলাক রঙের।

এলসা

চিঠিটা এইভাবে হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেল। ক্যালিফোর্নিয়ার আকাশ সেদিন ছিল উজ্জ্বল, বৃষ্টি হয়েছে গতকাল, দূরে পাহাড়ের মাথায় জমেছিল বরফ, বাড়ির কাচের জানালা বেয়ে নেমে আসছিল সূর্যরশ্মি। আমরা বসেছিলাম ভাইরাসের ভ্যাক্সিনের অপেক্ষায়। আবু মাশারের চিঠিটা ছাপিয়ে এলসাকে দেখালাম, সে বলল, “ফেসবুক তোমার মাথা খেয়েছে। বাড়ির কোনো কাজ কোরো না, খালি ফেসবুকিং করে মূল্যবান সময় নষ্ট করছ, খালি তাই নয় তোমার বিচার বিবেচনাও ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে।” বললাম, “এর সঙ্গে আবু মাশারের চিঠির সম্পর্ক কী? আর আবু মাশারের ছবিই বা কেমন করে আমার ওই ছবির বইতে আসবে?” এলসা বলল, “আবু মাশার না ছাই? সব তোমার কল্পনা।” আমার কল্পনা? আকাশ থেকে পড়লাম।

এলসা বলল, “লেখাটি যে তোমার সেটা তো আমি বুঝতেই পারছি, তোমার স্টাইল বোঝাই যাচ্ছে।” মহা মুশকিলে পড়া গেল, বললাম, “কিন্তু এই চিঠি আসলেই আমি লিখিনি।”
এলসা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, “শোনো, ফেসবুকে তুমি কত বছর হল আছো?”
বললাম, “তা বছর দশেক হবে।”
“তা এই দশ বছরে তোমার জীবনকে উজাড় করে দিয়েছ ফেসবুকে?”
“তা বটে,” স্বীকার করি আমি।
“তোমার পছন্দ অপছন্দ লেখালিখি সব ফেসবুক জানে?”
“জানে মানে কী?”
“মানে তোমার যাবতীয় গল্প ফেসবুকে দিয়েছ?”
“তা বটে।”
“ফেসবুক তোমার পাতায় কার পোস্ট দেখাবে, কোন বিজ্ঞাপন দেবে তার জন্য একটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার, যাকে আমরা AI বলি, তার ওপর নির্ভর করে?”
“তা করে, গুগল এসবের সঙ্গে যোগ আছে মনে হয়।”
“তুমি এর আগে কম্প্যুটার গল্প লিখতে পারে, উপন্যাস লিখতে পারে এরকম গল্প লিখেছ?”
“লিখেছি।”
“হুমম…” এই বলে এলসা আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, “এখন মনে কর ফেসবুকের AI দলছুট হয়ে গেল, নিজে নিজেই ফেসবুক সদস্যদের নিয়ে গল্প বানাতে শুরু করল।

যে যেরকম ভাবে তার জন্য সেরকম। তোমার গল্পগুলো আন্তর্জালে আছে, কাজেই তোমার লেখার স্টাইলটিও সে রপ্ত করেছে। তারপর ধর তোমার গল্পের চরিত্ররা হল আবু মাশার, গৌতম সিদ্ধ আর ইসাবেল সিমোনে। আমার নিশ্চিত ধারনা এদের সঙ্গে জ্যোতির্বিদ্যা আর ফরাসী চলচ্চিত্রের কোনো যোগাযোগ আছে। আর দেখ ফেসবুক AI দ্বিমাত্রিকতার গল্প বানাতে গিয়ে ভাইরাসের মহামারী নিয়ে এসেছে। আবু মাশার ইসাবেলের বাড়িতে যখন ঢুকল তখন মড়ক ছিলনা, আর বের হল যখন তখন মড়ক লেগেছে। এর ব্যাখ্যা কী?”

আন্তর্জালে অনুসন্ধান করে দেখলাম নবম শতাব্দীতে আবু মাশার নামে পারস্যে এক জ্যোতির্বিদ ছিলেন, তাকে জ্যোতিষীও বলা চলে, ওই সময়ে জ্যোতির্বিদ ও জ্যোতিষীদের মধ্যে খুব পার্থক্য ছিল না। বলা হয়ে থাকে তিনি কাশীতে দশ বছর সময় কাটিয়েছিলেন। আর অষ্টম শতাব্দীতে গৌতম সিদ্ধ নামে এক ভারতীয় বংশোদ্ভূত চীনা জ্যোতির্বিদ ছিলেন, তিনি নাকি চীনদেশে ভারতীয় শূন্যের ব্যবহার চালু করেছিলেন। চিত্রগ্রাহক ইয়োহানেসের নামটা খোঁজ করলাম না, সেটা যে রেনেসাঁ সময়ের জার্মান জ্যোতির্বিদ জোহানেস কেপলার সেটা বোঝাই যাচ্ছিল।

“আর ছবিটা? আবু মাশার যদি একটা সম্পূর্ণ বানানো চরিত্রই হয় তবে সেটা কার?”
“দেখি তো ছবিটা।” এলসাকে ছবিটা দেখাই। সে হেসে ওঠে, হাসি থামেই না।
“কী হল?”
“ছবিটা তোমারই।”
“অসম্ভব,” বলি আমি।
“ভাল করে দেখ, তোমার তরুণ বয়সের ছবি, ফেসবুক ঠিকই বের করেছে, শুধু পোশাক বদলে দিয়েছে, চুলটা বড় করেছে, চোখে চশমা লাগিয়েছে।” ছবিটা আমারই।

“আর ইসাবেল সিমোনে দুজন ফরাসী অভিনেত্রীর নামের সম্মিলন। তবে ইসাবেল আর এলসা তো একই জিনিস, অর্থাৎ এলসার আর একটি নাম হল ইসাবেল,” বলে এলসা।
“কিন্তু ফেসবুক তো তোমার নাম জানেনা, তুমি ফেসবুককে এত অপছন্দ কর, তোমার নিজের অ্যাকাউন্ট নেই, আর আমি তোমার নাম কোথাও দিইনি।”
“এক কবি লিখেছিলেন তাঁর হৃদয় তৃণসম, আর এক কবির হৃদয় ছিল লাইলাক রঙের, আন্তর্জালের আচরণ রহস্যময়, সে কীভাবে কাজ করে কেউ জানেনা, হয়তো এই মহামারীর সময় সে মানুষের আর্তনাদ আত্মস্থ করেছে,” এটুকু বলে এলসা জানালা দিয়ে বাইরে দিকে চায়।
আকাশে আবার মেঘ করে আসছে, বৃষ্টির মেঘ, বৃষ্টি এখানে বড় দুর্লভ। ঘর অন্ধকার হয়ে ওঠে। এলসা বলে, “সেই AI আবু মাশারকে এমন একজন পুরুষে রূপান্তরিত করেছে যে তার বুদ্ধিমত্তা ত্যাগ করে প্রবৃত্তির আশ্রয় নিয়েছিল। তোমাকে কি আমার নতুন করে চিনতে হবে?” এলসার দিকে তাকাই, তার চোখ জানালার বাইরে বৃষ্টির দিকে তাকানো, আমি সেই চোখের দৃষ্টি পড়তে পারি না। ‘লেখকের বর্তমান হবে পাঠকের ভবিষ্যৎ’ কোন গল্পে লিখেছিলাম মনে করতে চাইলাম।


পুনশ্চ – পাঠক বুঝতেই পারছেন ফেসবুক বা আন্তর্জাল এখনো এত পরিশীলিত হয়নি যে আবু মাশার হয়ে এরকম চিঠি লিখতে পারবে। তবে ভাইরাসের তাণ্ডবের দীর্ঘ স্বেচ্ছা নির্বাসনের সময় বাইরের বস্তুজগতের পরিচয় যেমন ম্লান হয়ে আসছিল, নিজের স্মৃতি নির্মাণও কেমন ভঙ্গুর হচ্ছিল। তাই আবু মাশারের চিঠিটি আমিই লিখেছিলাম কিনা মনে করতে পারলাম না।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

8 thoughts on “short-story-isabel-samoner-sakhyatkar

  1. অসম্ভব বলিষ্ঠ গদ্য৷ ভাবনার ধারাবাহিকতা বুদ্ধির ব্যাপ্ত দিগন্তকে চোখের সামনে মেলে ধরে৷ এর ভিতরে লুকিয়ে ছিল: “কিন্তু ছবিতে অভিনয় পুরোপুরি বাস্তবসম্মত হতে পারে না, সেটা হয় বাস্তব অনুসারে কিন্তু উঁচু লয়ে, সেই উঁচু লয়ের মধ্যে দর্শককে প্রবেশ করানোই আমার কাজ।” এমন একটি বাক্য, যার মধ্যে অভিনয় ও বাস্তবতার ভেদ স্পষ্ট রেখায় উচ্চকিত৷ অনুবাদ যে নয় সেটা ঠিক৷ নিজের ভাবনার অনুবাদ – একথা অবশ্য বলা যেতে পারে৷ কিন্তু গোটা লেখাটিই একটা ছবির মত৷ যে ছবির ছক আমরা অদিতার আঁধারে পেয়েছি৷ এবং আরও কিছু লেখায়৷ ক্যানভাস বিশাল৷ আমরা ছবিটা দেখি৷ শব্দের কথা, বাক্যের কথা টের পাই না৷ একটা উঁচু লয়ে বিধৃত আছে তার চলনভঙ্গী৷
    বাংলা সাহিত্যে একটা নতুন অতিথি এল…

  2. Could finish reading of it. A mysterious story. Possibly written from a nostalgia for the past by the imaginary future.

  3. অপূর্ব গল্প।সময়ের থেকে এগিয়ে শুধু এইটুকু বলতে পারি।

  4. “এক কবি লিখেছিলেন তাঁর হৃদয় তৃণসম, আর এক কবির হৃদয় ছিল লাইলাক রঙের, আন্তর্জালের আচরণ রহস্যময়, সে কীভাবে কাজ করে কেউ জানেনা, হয়তো এই মহামারীর সময় সে মানুষের আর্তনাদ আত্মস্থ করেছে!”- কী দারুণ কথা!
    নবম শতাব্দীর জ্যোতির্বিদ আবু মাশার, বলা হয়ে থাকে তিনি কাশীতে দশ বছর সময় কাটিয়েছিলেন।অষ্টম শতাব্দীর ভারতীয় বংশোদ্ভূত
    চীনা জ্যোতির্বিদ গৌতম সিদ্ধ, যিনি চীনদেশে ভারতীয় শূন্যের ব্যবহার চালু করেছিলেন। রেনেসাঁ সময়ের জার্মান জ্যোতির্বিদ জোহানেস কেপলার কে এক গল্পে হাজির করে কী দারুণ সাবলীল লেখায় অন্য এক আলোর দ্যূতিতে পাঠকে হাজার বছরের সংস্কৃতিতে বিচরণ ঘটালেন!
    দ্বিমাত্রিকতা থেকে ত্রিমাত্রিকতায় প্রিয় নায়িকার দৃশ্যায়ন,ফেসবুক বা আন্তর্জাল নিয়ে গভীর চিন্তাশীল এবং পরিশীলিত লেখা!
    ইসাবেল সিমোনে দু’জন ফরাসী অভিনেত্রীর নামের সম্মিলন-এলসার আর এক নাম ইসাবেল!ভাইরাসের তাণ্ডবের দীর্ঘ স্বেচ্ছা নির্বাসনের সময় বাইরের বস্তুজগতে বিচরণ – সবই অসাধারণ! বারবার পড়বার ইচ্ছে জাগে! প্রণতি জানাই লেখকের প্রতি 🙏💐🙏

  5. কি চমৎকার গল্প! এক নিশ্বাসে সব কাজ ফেলে পড়লাম । খুব সুন্দর লেখা। গল্পটা অপূর্ব।

  6. আরো পাঠ করতে হতো। করব না কারণ, গল্প দীর্ঘ। যেখানে বুঝিনি সেখানে যেতে যেতে পুনরাবৃত্তির চাপ সহ্য করতে হবে। তাছাড়া, আলো, মাত্রা সম্পর্কে কোনো জ্ঞান না থাকায় ওই জায়গাগুলো আবার না বুঝতে পারি। সব মিলিয়ে জটিল। আসলে শ্রদ্ধেয় দীপেন ভট্টাচার্য বহুদিন গল্পকে পার্থিব-অপার্থিব কল্পনার যোগসূত্রে জুড়ে দেবার স্টাইলে সিদ্ধহস্ত এখন। এটি এখন একটি পরিচিত স্টাইল যা কিনা দীপেন স্টাইল। স্টাইলটি যেন একটি পাথরখণ্ডকে কল্পনায় আলোর গতির থেকে বেশি জোরে মহাশূন্যে নিক্ষেপ করে আবার তারচেয়ে একটু বেশি গতিতে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা। প্রক্রিয়াটি দীপেন, আর পাথরটি গল্প।

  7. অনেকদিন পর আপনার লেখা পড়ার সময় পেলাম।আসলে এখন খুব কম ফেবুতে ডুকি আর ডুক্লে বিভিন্ন গ্রুপের গল্প পড়ি।কিন্তু আপনার লেখা সব সময় আমাকে আমার কল্পনায় ঘুরিয়ে নিয়ে আসে কারণ অই জগৎ টা আমার ভিশন প্রিয়। ধন্যবাদ ভাইয়া।আরো লিখে যেতে থাকুন।ভালো থাকুন।

  8. অদ্ভুত সুন্দর একটা গল্প। লেখকের মুন্সীয়ানা প্রতিটী অক্ষরে প্রস্ফুটিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *