ঈশ্বর আছেন, ঈশ্বর নেই
হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

১
বর্ষাঋতুর তিনমাস পথ পরিক্রম করেন না অমিতাভ ও তাঁর সহচর ভিক্ষুরা। তার কারণ এই নয় যে বর্ষাকালে পরিক্রমা করলে আকাশ থেকে নেমে আসা ধারাপাতে শরীর সিক্ত হয়ে ক্লেশ উৎপন্ন হবে তার জন্য। ভিক্ষাপাত্র হাতে পথ চলার সময় কত ক্লেশই তো সহ্য করতে হয় মহাজ্ঞানীকে। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহ, আকস্মিক প্রবল বর্ষণ, কিম্বা প্রবল শৈত্যপ্রবাহ অগ্রাহ্য করেও তো মহাজ্ঞানী কত পথ হেঁটেছেন, আজও হেঁটে চলেন। কিন্তু বর্ষাঋতুর এই তিনমাস তাঁর পথ চলা স্থগিত রাখার পিছনে বিশেষ কারণ আছে। এ সময় ঘাস জন্মায়, মাটি ফুঁড়ে বাইরে বেরিয়ে সূর্যের আলো দেখে বৃক্ষ সন্তানরা, প্রায় নিষ্প্রাণ হয়ে যাওয়া লতাগুল্ম আবার সজীব হয়ে ওঠে। মহাজ্ঞানী চান না তাঁর ও ভিক্ষুকুলের পদচালনা কালে তারা কেউ পদদলিত হোক। কারণ, তাদেরও তো প্রাণ আছে, এ পৃথিবীতে মানুষের মতো তাদেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে। এ পৃথিবীর সব জীবের প্রতিই অসীম মমত্ববোধ আছে প্রেমময় শান্তার। তবে এ সময়ও বহু মানুষ মহাজ্ঞানীর সাথে সাক্ষাৎ করতে আসে তাঁর দর্শন লাভ, আশীর্বাদ গ্রহণ করার জন্য। বুদ্ধ তাদের কাছে তাঁর ‘ধম্ম’র কথা ব্যক্ত করেন, নির্বাণ লাভের জন্য পথের সন্ধান দেন। এমনকী কখনও বা কারো মনের মধ্যে জমে থাকা অমীমাংসিত প্রশ্নেরও উত্তর দেন মহাজ্ঞানী।
বর্ষাঋতুর তিনমাস সাধারণত দুটি স্থানে অতিবাহিত করেন অমিতাভ। প্রথম স্থানটি হল মগধ সম্রাট বিম্বিসারের উপহার দেওয়া জলাশয় সমৃদ্ধ একটি বাঁশবন, যা বেণুবন নামে পরিচিত। যে স্থান রাজগৃহর নিকটবর্তী। এবং যে স্থানে অশ্বত্থ বৃক্ষ তলে তিনি সিদ্ধার্থ থেকে বুদ্ধ হয়েছিলেন, যে স্থান থেকেও বেণুবনের দুরত্ব পদব্রজে মাত্র একদিনের পথ।
আর তথাগতর বর্ষাবাসের দ্বিতীয় স্থানটি হল, কোশল রাজ্যের অন্তর্গত বৈশালীর ‘জেত বন’। সরোবর ও আম্রকুঞ্জ সমৃদ্ধ ওই জেত বনেই বর্তমানে বেশ কয়েকটি বর্ষাঋতু অতিবাহিত করছেন মহাজ্ঞানী। এ স্থানে অমিতাভর বর্ষাবাস রচনার পিছনে একটি কাহিনী আছে। এ বনের বা উদ্যানের নাম কোশলরাজ প্রসেনজিৎ-এর পুত্র ‘জেত’ এর নামানুসারে। এ স্থানটি একসময় তাঁর সম্পত্তি ও প্রিয় স্থান ছিল। বুদ্ধ অনুরাগী শ্রেষ্ঠী অনাথপিন্ডক প্রথমে এ স্থানটি নির্বাচন করেন মহাজ্ঞানীর বর্ষাবাসের স্থান হিসাবে। এই ইচ্ছা প্রকাশ করে তিনি যুবরাজ জেতের কাছে এই শ্যামলিমাময় স্থানটি ক্রয় করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু প্রাথমিক অবস্থায় যুবরাজ জেত তাঁর অতিপ্রিয় এই উদ্যানটি বিক্রয় করতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু সরাসরি অনাথপিণ্ডকের প্রস্তাব প্রত্যাখান করতে না পেরে তিনি এক কৌশলের আশ্রয় নেন। তিনি অনাথপিণ্ডককে জানান যে রাজপ্রাসাদের সামনের বিশাল প্রাঙ্গণ যদি তিনি স্বর্ণখণ্ড দিয়ে আবৃত করে দিতে পারেন তবে তিনি উদ্যানটি অনাথপিণ্ডককে দেবেন। বুদ্ধর সান্নিধ্য লাভ করার জন্য সে কাজই করেন দুঃখী-আতুরের সেবায় নিয়োজিত বুদ্ধ অনুরাগী অনাথপিণ্ডক। তিনি তাঁর সব ধনসম্পদ স্বর্ণে রূপান্তরিত করতে থাকেন। গরুর গাড়িতে চাপিয়ে এনে সেই স্বর্ণ ঢেলে দিতে থাকেন প্রাসাদ প্রাঙ্গণে। তথাগতর প্রতি অনাথপিণ্ডকের এই শ্রদ্ধা দেখে বিস্মিত হন রাজপুত্র জেত। তিনি অনাথপিণ্ডকের হাতে জেত বন তুলে দেন তথাগতর বর্ষাবাসের স্থান হিসাবে, নির্মাণ করান এক সুদৃশ্য তোরণ, ভিক্ষুদের জন্য সংঘগৃহ, অতিথি-দর্শনার্থীদের জন্য আবাসস্থল। মনস্কামনা পূর্ণ হয় বুদ্ধ ভক্ত অনাথপিণ্ডকের। যে তিনমাস মহাজ্ঞানী জেতবনে অবস্থান করেন সে তিনমাস অনাথপিণ্ডক প্রত্যহ শান্তার সাথে সাক্ষাত করতে আসেন। তাঁর বাণী শুনে, তাঁর পাদস্পর্শ করে, সান্নিধ্য লাভ করে তৃপ্ত হন। বর্তমানে বেণুবন অপেক্ষা জেত বনেই বর্ষাঋতু অতিবাহিত করতে বেশী পছন্দ করছেন মহাজ্ঞানী। কারণ, এ স্থানে তাঁর দর্শনার্থীদের আগমন বেশী হয়। তাদের মাধ্যমে মহাজ্ঞানী তাঁর ধর্ম কথা অধিক সংখ্যক মানুষের মধ্যে প্রচার করতে পারেন। এ বৎসরও বর্ষাঋতু জেত বনেই কাটাচ্ছেন অমিতাভ। তবে আর কিছুদিনের মধ্যেই বর্ষাঋতু শেষ হয়ে যাবে। তার ইঙ্গিত মিলছে। মাঝে মাঝেই সূর্য মেঘ সরিয়ে আত্মপ্রকাশ করছে। আকাশে মেঘের আনাগোনা, চঞ্চলতা কমে আসছে। আর বর্ষাঋতু শেষ হলেই মহাজ্ঞানী তাঁর সঙ্গী ভিক্ষুদের নিয়ে যাত্রা করবেন ষোড়শ মহাজনপদের ধূলি মাখা পথে। মানবমুক্তির বার্তা পৌঁছে দেবার জন্য পথচলাই তো তাঁর জীবন।
২
এদিন প্রভাতে সরোবরে অবগাহন করে জেতবনের এক আম্রবৃক্ষতলে প্রতিদিনের মতোই উপবেশন করলেন মহাজ্ঞানী। সাথে তাঁর ছায়াসঙ্গী শিষ্য ভিক্ষু আনন্দ। পাখির কূজন ধ্বনিত হচ্ছে চারপাশে। গতরাতে খানিক বৃষ্টি হয়েছে। ধৌত আম্র পল্লবগুলি আরও নবীন আরও সবুজ হয়ে উঠেছে। বৃক্ষশাখার ফাঁক গলে প্রভাতি সূর্যকিরণ এসে পড়েছে বৃক্ষবলে প্রস্তর আসনে উপবিষ্ট অমিতাভর শরীরে। দেখে মনে হচ্ছে এক স্নিগ্ধ মনোরম আলোকজ্যোতি বিচ্ছুরিত মহাজ্ঞানীর শরীর থেকে।
অনাথপিণ্ডক প্রতিদিন যেমন আসেন এদিনও তেমনই এলেন। হাতের পদ্মফুলটি মহাজ্ঞানীকে নিবেদন করে তাঁর চরণতলে বসলেন। বুদ্ধ উজ্জ্বল সূর্যকিরণের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী আলোকময় প্রভাত। আর কয়েকদিনের মধ্যেই শরৎ-এর আগমন ঘটবে। আনন্দ তুমি যাত্রারম্ভের জন্য প্রস্তুতি শুরু কর। আমি বারাণসীর পথে রওনা হব।
শান্তার বিদায়কাল সমাগত হলেই শ্রেষ্ঠী অনাথপিণ্ডকের মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। বৃদ্ধ অদর্শনে ব্যাথিত হয়ে ওঠে তাঁর মন। তথাগত ভিক্ষু আনন্দকে তাঁর যাত্রারম্ভের ব্যবস্থা করতে বলার পর অনাথপিণ্ডক বললেন, ‘মহাজ্ঞানীর কাছে আমার একটি নিবেদন আছে।’
‘কী নিবেদন?’ জানতে চাইলেন শান্তা।
শ্রেষ্ঠী অনাথপিণ্ডক বললেন, ‘আপনার অনুপস্থিতি, আপনার অদর্শন আমাকে বড় কাতর করে তোলে। আমি আপনার একটি মূর্তি নির্মাণ করাতে চাই যেমন দেবমূর্তি রচনা করা হয় তেমনই। এ স্থলে আপনার অনুপস্থিতিতে ওই মূর্তি দর্শন করলে আমার এবং আমার মতো আরও অনেকেই মনে হবে আপনি এ স্থলেই আছেন, ঈশ্বর বা দেবতার সান্নিধ্য লাভ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি না আমরা। আপনি আমাদের মূর্তি নির্মাণের অনুমতি দিন।’
বুদ্ধ ভক্ত অনাথপিণ্ডকের অনুরোধ শুনে করুণাময় হেসে বললেন, ‘এ অনুমতি আমি তোমাকে দিতে পারি না। ইতিপূর্বে কাউকে দেইনি। আর ভবিষ্যতে আমার জীবনকালে কাউকে দেব না। কারণ আমি ঈশ্বর বা দেবতা কোনটাই নই। আমি রক্ত-মাংসের একজন মানুষ যে মানবমুক্তির জন্য, নির্বাণ লাভের জন্য জ্ঞান আহরণ করেছে ও তা সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করছে। আমি একজন পথ প্রদর্শক মাত্র। তার চাইতে বড় কেউ নই। তুমি যেমন মানব সেবায় নিয়োজিত আছ তেমনই থাকো। দেখবে আমার উপস্থিতি সবসময় তোমার সাথেই আছে।
কিছু সময় পর এক ব্যক্তি এসে উপস্থিত হলেন মহাজ্ঞানীর কাছে। মহাজ্ঞানীকে প্রণাম জানিয়ে তাঁর সামনে হাঁটু মুড়ে বসে সে বলল, ‘আপনার কাছে আমার একটি জিজ্ঞাস্য আছে। আপনি বুদ্ধ, মহাজ্ঞানী। তাই নিশ্চয়ই আপনি আমার কৌতূহলের অবসান ঘটাতে পারবেন।’
প্রেমময় বললেন, ‘কী প্রশ্ন?’
সেই ব্যক্তি বলল, ‘ঈশ্বর কি আছেন?’
প্রশ্নর উত্তর দেবার আগে করুণাময় হেসে জানতে চাইলেন, ‘এ ব্যাপারে উত্তর দেবার আগে আমি ঈশ্বরের উপস্থিতি সম্পর্কে তোমার মতামত জানতে চাই।’
সেই ব্যক্তি বলল, ‘আমারতো মনে হয় ঈশ্বর নিশ্চয়ই আছেন। তিনিই এই জগৎ সংসার পরিচালনা করেন। আমি ঠিক বললাম কিনা?’
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে তাকে অবাক করে দিয়ে মহাজ্ঞানী হেসে জবাব দিলেন, ‘না। ঈশ্বর বলে কেউ নেই। ঈশ্বরের ধারণা ভ্রান্ত।’
প্রশ্নকর্তা একজন সাধারণ মানুষ, সে ঈশ্বর বিশ্বাসী। কিন্তু মহাজ্ঞানী যখন বলছেন যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই তখন আর এ ব্যাপার নিয়ে তর্কে গেল না। তাঁর নিজের এতদিনের ভাবনা আর মহাজ্ঞানীর বলা কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সে স্থান ত্যাগ করল।
তথাগতর কথা শুনে অনাথপিণ্ডকের মনে হল, মহাজ্ঞানী ঈশ্বর বিশ্বাসী নন বলেই, ঈশ্বরের মূর্তির মতো নিজের মূর্তি নির্মাণের ক্ষেত্রে তিনি সম্মত নন।
সময় এগিয়ে চলল। আরও কয়েকজন ব্যক্তি সাক্ষাৎ করতে এল তথাগতর সাথে। বুদ্ধ তাদের কাউকে তাঁর ধর্মতত্ত্ব বিবৃত করলেন, কারো তাঁর চলার পথ কেমন হবে তার দিক নির্দেশ করলেন।
সূর্য যখন ঠিক মাথার উপর ঠিক তখন এক ব্যক্তি উপস্থিত হল তথাগতর সামনে। সে তাঁকে প্রণাম জানিয়ে বলল, ‘হে তাপস। আমি এক কৌতূহলের নিরসন করার জন্য এসেছি আপনার কাছে। লোকে বলে আপনি মহাজ্ঞানী। তাই দয়া করে আমার কৌতূহলের নিরসন করুন।’
আলোকময় জানতে চাইলেন, ‘কী কৌতূহল?’
লোকটি প্রশ্ন করল, ‘ঈশ্বর আছে কি নেই?’
বুদ্ধ ওই একই প্রশ্ন করা প্রথম ব্যক্তিকে যেমন জিজ্ঞেস করেছিলেন তেমনই এই ব্যক্তিকেও বললেন, ‘আগে এ বিষয় সম্পর্কে তোমার মতামত শুনি, তারপর তোমার প্রশ্নের জবাব দেব।’
এ কথা শুনে সেই ব্যক্তি বেশ দৃঢ় ভাবে জবাব দিল, ‘আমি বহু দেবালয় পরিক্রমা করেছি, বহু যাগযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু কোথাও ঈশ্বরের দেখা পাইনি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ঈশ্বর বলে কেউ নেই। সবটাই মানুষের অলীক কল্পনা।
বুদ্ধ কথার জবাব দিলেন, ‘ঈশ্বর অবশ্যই আছেন। এ পৃথিবীতে তিনিই তো প্রধান সত্য। তুমি তাঁকে খোঁজার চেষ্টা করো।’ তাঁর কথা শুনে শুধু লোকটিই নয়, তার চাইতে বেশি অবাক হলেন বুদ্ধভক্ত অনাথপিণ্ডক আর আনন্দ। কারণ, সকালবেলাইতো মহাজ্ঞানী এক ব্যক্তিকে বললেন, ‘ঈশ্বর নেই!’
দ্বিতীয় প্রশ্নকর্তা আর মহাজ্ঞানীকে কোনো প্রশ্ন করল না। তার নিজের এত দিনের বিশ্বাসের সাথে মহাজ্ঞানীর কথা মিলছে না কেন ভাবতে ভাবতে জেতবন ত্যাগ করল সে।
বুদ্ধ তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে এরপর বৃক্ষতল ত্যাগ করে সংঘগৃহতে প্রবেশ করে তণ্ডুল গ্রহণ করে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে যখন আবার সেই বৃক্ষতলে উপবিষ্ট হলেন তখন বিকাল হয়ে এসেছে। আনন্দ, রবি, অনাথপিণ্ডকের সাথে তিনি ধর্ম আলোচনা শুরু করলেন। বিকাল হল একসময়। তারপর একসময় অরণ্যের আড়ালে সূর্য ডুবতে শুরু করল। পাখির দল ঘরে ফিরে আসতে লাগল। দিনান্তের শেষ আভা ছড়িয়ে পড়ল তথাগতর শরীরে। প্রদীপ জ্বালাবার প্রস্তুতি শুরু হল অনতিদূরে সংঘগৃহে। ঠিক এমন সময় আবারও এক ব্যক্তি এসে উপস্থিত হল মহাজ্ঞানীর সামনে। নতমস্তকে তথাগতকে প্রণাম জানিয়ে সে বলল, ‘মহাজ্ঞানী আপনার কাছে আমি এক প্রশ্ন নিয়ে এসেছি। বহুদিন ধরে সে প্রশ্নর উত্তর না পেয়ে আমি বড় বিচলিত হয়ে আছি। সে প্রশ্ন হল, ঈশ্বর আছেন? নাকি তিনি নেই? আমি তাঁকে খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু তাঁকে পাচ্ছি না। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না ঈশ্বর আছেন? নাকি নেই? মহাজ্ঞানী আমার কৌতূহলের নিরসন করুন।’
বুদ্ধ কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলে সেই ব্যক্তির দিকে। তারপর কোন জবাব না দিয়ে ধীরে ধীরে চোখের পাতা মুদলেন। সূর্য ডুবে গেল। সংঘগৃহ থেকে ভেসে আসতে লাগল প্রার্থনা সঙ্গীত। ধ্যানস্থ হলেন বুদ্ধ। প্রশ্নর জবাব না পেয়ে ফিরে গেল সেই ব্যক্তি। সারাদিন তথাগতর সাথে সময় অতিবাহিত করার পর অনাথ পিণ্ডক নিজের গৃহে ফিরে যান। এ সন্ধ্যায় তিনি কিন্তু ফিরলেন না। তিনি প্রতীক্ষা করতে লাগলেন তথাগতর ধ্যান ভঙ্গ হবার জন্য।
৩
মহাজ্ঞানীর যখন ধ্যানভঙ্গ হল তখন আম্রকুঞ্জর মাথার উপর চাঁদ উঠে গেছে। ঝোপেঝাড়ে থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলছে। ইতিমধ্যে ভিক্ষু আনন্দ একটি মৃৎপ্রদীপ জ্বালিয়েছেন। তার আলোকরশ্মি গিয়ে পড়েছে মহাজ্ঞানীর মুখমণ্ডলে। স্নিগ্ধ শান্ত মুখমণ্ডল থেকে জ্ঞানের জ্যোতি যেন বিচ্ছুরিত হচ্ছে। করুণাঘন আঁখিপল্লব উন্মোচিত করে তিনি তাকালেন অনাথপিণ্ডক আর আনন্দর দিকে। অনাথপিণ্ডককে দেখে তিনি অনুমান করলেন নিশ্চয়ই তাঁকে কিছু বলার আছে তাঁর। মহাজ্ঞানী তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও?’
অনাথপিণ্ডক করজোড়ে বললেন, “হ্যাঁ মহাজ্ঞানী। ঈশ্বর আছেন কি নেই, এব্যাপারে আপনার পরস্পর বিরোধী বক্তব্য আমি বুঝতে পারছি না। আপনি এক ব্যক্তিকে বললেন ঈশ্বর নেই, অপর ব্যক্তিকে বললেন তিনি আছেন। দয়া করে এই বিপরীত ধর্মী বক্তব্যের কারণ, আমাকে বুঝিয়ে দিন।”
মহাজ্ঞানী হাসলেন বুদ্ধভক্ত অনাথপিণ্ডকের কথা শুনে। তারপর বলতে শুরু করলেন, “প্রথম যে ব্যক্তি আমাকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন করেছি, সে ওই বিশ্বাস নিয়েই আমার কাছে এসেছিল যে ঈশ্বর আছেন। আমি যদি তাঁকে বলতাম যে ঈশ্বর আছেন তবে সে খুশি হত ঠিকই, কিন্তু সে আর ঈশ্বরকে অন্বেষণ করত না। ঈশ্বরকে অন্বেষণ করা মানে তো, নিজের অন্তরকে, চারপাশের সব কিছুকে অন্বেষণ করা। ঈশ্বরকে মানা ও জানার মধ্যে পার্থক্য আছে। কোন কিছুকে নিঃশর্ত ভাবে মেনে নেওয়ার অর্থ হল মানসিক স্থবিরতার সৃষ্টি হওয়া। সে ব্যক্তি আর তখন কিছু খোঁজে না। তাঁর জ্ঞানের বিস্তার ঘটে না। আমি ওই ব্যক্তির মধ্যে জ্ঞান আহরণের প্রদীপকে নির্বাপিত হতে দিতে চাইনি। যাতে সে ঈশ্বরকে শুধুমাত্র না মেনে তাঁকে জানার চেষ্টা করে। তাই আমি তাঁকে বলেছি ‘ঈশ্বর নেই। আমি চেয়েছি সে যেন অন্বেষণের মাধ্যমে সত্যর কাছে পৌছাতে পারে।
দ্বিতীয় যে ব্যক্তি আমাকে মধ্যাহ্নে একই প্রশ্ন করেছিল তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস যেহেতু সে ঈশ্বরের দর্শন পায়নি। তাই ঈশ্বর নেই। আমি যদি তার কথা সমর্থন করতাম তবে সে আর ঈশ্বরের অন্বেষণ করত না। এটাও একটা বিপরীত ধর্মী স্থবিরতা। এ স্থবিরতাও আত্ম অনুসন্ধান জ্ঞান আহরণের পথকে স্তব্ধ করে দেয়। তার বিশ্বাস ঈশ্বর নেই। তার এ বিশ্বাসের উপর আঘাত এলে তার মনের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হবে। সে ভাবতে শুরু করবে কার বক্তব্য সঠিক? তার না আমার। আর তার এই ভাবনা থেকেই তার অন্বেষণের কাজ শুরু হবে, জ্ঞান আহরণ করে সে সত্যর কাছে পৌঁছবার চেষ্টা করবে। ওই ব্যক্তির মনের মধ্যে জ্ঞানের দীপশিখা জ্বালাবার চেষ্টা করেছি আমি। তাই আমি তাকে বলেছি ঈশ্বর আছেন।”
ভিক্ষু আনন্দ বললেন, ‘হে মহাজাতক, প্রথম দুজন ব্যক্তিকে আপনি কেন বিপরীত ধর্মী উত্তর দিয়েছেন আমরা তা বুঝতে পারলাম। কিন্তু তৃতীয় ব্যক্তির প্রশ্নে আপনি নিরুত্তর রইলেন কেন?’
শান্তা বললেন, “তৃতীয় যে বক্তি আমার কাছে এসেছিল সে দ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছে ঈশ্বরের উপস্থিতির ব্যাপারে। অর্থাৎ সে ঈশ্বরের অনুসন্ধানের জন্য যাত্রা শুরু করেছে। আমি যদি তাকে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ এমন কোন একটা উত্তর দিতাম তবে সে হয়ত কোনো একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে আর ঈশ্বরকে খোঁজার চেষ্টা করত না। তার জ্ঞান আগ্রহর পথ স্তব্ধ হয়ে যেত। সত্যর কাছে পৌঁছান সম্ভব হত না। আমার কাজ পথপ্রদর্শকের মতো। আমি চেষ্টা করি মানুষের অন্বেষণের ইচ্ছা, জ্ঞান আহরণের ইচ্ছা অর্থাৎ সত্যর কাছাকাছি পৌঁছবার প্রচেষ্টা যেন স্তব্ধ না হয়। তাই আমি ‘ঈশ্বর আছেন, নাকি নেই’ তা নিয়ে তৃতীয় ব্যক্তির প্রশ্নর জবাবে নিরুত্তর থেকেছি।’
এরপর একটু থেমে মহাজ্ঞানী হেসে বললেন, ‘ঈশ্বরকে মানা সহজ, কিন্তু জানা কঠিন। তাঁকে চোখে দেখা যায় না। যদি কেউ ঈশ্বর বলে নিজেকে দাবী করেন, তাঁকে যদি চন্দ্র সূর্যর মতো চোখে দেখা যায় তবে তিনি ঈশ্বর নন। তাঁকে দেখা যায় না, তাঁকে অনুভব করতে হয়। ক্রমাগত পথ চলার মাধ্যমে, জ্ঞান আহরণের মাধ্যমে সত্যর কাছে পৌছাতে হয়। তবেই তাঁকে অনুভব করা যায়।’ – এই বলে মহাজ্ঞানী বুদ্ধ আবার চক্ষুমুদে ধ্যানস্থ হলেন।
কয়েকদিনের মধ্যে বর্ষাঋতু শেষ হল। মহাজ্ঞানী আবার তাঁর শিষ্য ভিক্ষুদের নিয়ে পথে নামলেন সত্য অনুসন্ধানের জন্য। অনাথপিণ্ডক বৈশালী নগরীতেই বুদ্ধর নির্দেশ মতো রয়ে গেলেন মানবসেবার জন্য। ব্যক্তি পুজোর বিরোধী মহাজ্ঞানী চাইতেন না কেউ তাঁর মূর্তি বানিয়ে তাঁকে দেবতা রূপে পুজো করুক। তিনি চাইতেন তিনি যে জ্ঞান আহরণ করেছেন, যে সত্যকে উপলব্ধি করেছেন মানুষ তা তাঁর কাছ থেকে গ্রহণ করুক। মহাজ্ঞানী তাই শ্রেষ্ঠী অনাথপিণ্ডককে তাঁর মূর্তি স্থাপনের অনুমতি দেননি। কিন্তু ভিক্ষু আনন্দর পরামর্শ মতো বুদ্ধ অনুরাগী অনাথপিণ্ডক, যে বৃক্ষ তলে বুদ্ধ বোধি লাভ করেছিলেন সেই বোধি বৃক্ষর একটি চারা এনে বুদ্ধর প্রতীক অর্থাৎ জ্ঞানের প্রতীক হিসাবে রোপণ করেছিলেন জেতবনে। তাঁর দিকে চেয়ে অনাথপিণ্ডক স্মরণ করতেন বুদ্ধবাণী। প্রতীক্ষা করে থাকতেন আবারও একটি বর্ষাঋতুর আগমনের জন্য।