ইন্দ্রনীল সান্যাল
রাত সাড়ে এগারোটার সময় মৌ দাঁড়িয়ে রয়েছে হট চাইনিজ় রেস্তোরাঁর ঠিক মাঝখানে। পরনে কুচকুচে কালো শিফনের শাড়ি, ব্লাউজ়ের রং টকটকে লাল। ঠোঁটে লাল শেডের লিপস্টিক। শরীরে কোনও গয়না নেই। বাসন্তীর হাত ধরে রয়েছেন দিল্লি পুলিশের মহেশ।
কেন এ রকম হল? ঠিক কী ভাবে সাঁকরাইলের লেবার বস্তির বাসন্তী এখানে এল? সেটা জানার জন্যে এই ছবিটি ফ্রিজ় করে চলে যাওয়া যাক বাইশ বছর আগে। তাহলেই সব বোঝা যাবে।
বাসন্তীদের জগতে আপনাদের স্বাগতম!
বাইশ বছর আগে বাসন্তীর বয়স আট। সে, আগেই বলা হল, সাঁকরাইলের লেবার বস্তির বাসিন্দা। বাবা অজয় জুটমিলের লেবার। মা মিনু শাড়িতে পিকো আর ফল বসানোর কাজ করে। ছোটবেলা থেকেই বাসন্তী জানে, তারা গরিব। সাধ-আহ্লাদ করার সামর্থ নেই।
বাসন্তীর আবার সাধ-আহ্লাদ ছাড়া জীবন পানসে লাগে। তার প্যাশন হল গান। বাড়িতে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড ক্যাসেট প্লেয়ার আছে। অজয়কে অনেক দিন ধরে জপিয়ে কেনা। এর ওর কাছ থেকে ক্যাসেট চেয়ে আনে বাসন্তী। একটাই ক্যাসেট চালিয়ে একবার শোনে, দু’ বার শোনে, তিন বার, পাঁচ বার, দশ, পঁচিশ, পঁচাত্তর বার শোনে… অজয় আর মিনু বিরক্ত হয়ে যায়। বাসন্তী কয়েক বার অজয়ের হাতে মারও খেয়েছে এই কাণ্ডের জন্যে। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। গানটা তোলা হয়ে গেলে ক্যাসেট আর ছুঁয়েও দেখে না। তখন তার গলায় অলকা যাজ্ঞিক বা অনুরাধা পড়োয়াল ভর করেছেন। গানটা নিখুঁত গেয়ে দেয়।
দশ বছর বয়সেই বাসন্তী হয়ে গেল লেবার বস্তির স্টার। বস্তির কোনও ঘরে অতিথি এলে ডাক পড়ে গান গাওয়ার জন্যে। বিনিময়ে টুকটাক টাকাও পায়। স্কুল যাওয়ার সময়ে হাঁটা দেখে মনে হয়, অদৃশ্য স্পটলাইট তাকে অনুসরণ করছে। এই করতে করতে ক্লাস এইট। নাইনে ওঠার পরীক্ষায় বাসন্তী ফেল করল।
ক্লাস ফাইভ ও সিক্স পাস অজয় আর মিনুর মনে হল, মাস্টার রাখলে মেয়ে পড়াশুনো শিখবে। বস্তির এই জীবন থেকে মেয়েকে বার করতে গেলে গ্র্যাজুয়েট বানাতেই হবে। তবে সে অনেক পরের কথা। আগে তো ক্লাস নাইনে উঠুক। ইশকুলের মাস্টাররা পড়ায় না। মেয়ের প্রাইভেট টিউশনি লাগবে।
এই এলাকার ভাল মাস্টার বলতে সাঁকরাইল বিদ্যালয়ের সুরেন স্যার। কিন্তু তাঁর খাঁই খুব। বাধ্য হয়ে মিনু টেলারিং শপে চাকরি নিল। যে ক’টা টাকা আয় হয়, তাই দিয়ে টিউশান ফি হবে। কিছু হয়তো বাঁচবেও।
সুরেন স্যারের কাছে কোচিং শুরু হল। উনি আসেন বিকেল পাঁচটায়। ইশকুল থেকে তার আগেই চলে আসে বাসন্তী। অজয় সেই সময়ে কারখানায়। মিনু টেলারিং শপে।
দিনটা আজও মনে আছে বাসন্তীর। সেটা ছিল সাতই অক্টোবর। সুরেন স্যারের মুখ থেকে হালকা মদের গন্ধ আসছে। বাবার মুখ থেকে এই গন্ধ চিনতে শিখেছে বাসন্তী।
অঙ্ক করানোর সময় বাসন্তীর আঙুলে আঙুল ঠেকে গেল সুরেন স্যারের। বাসন্তী হাত সরিয়ে নিল। ম্যাপ পয়েন্টিং করার সময় আবার একই জিনিস। বাসন্তী হাত সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই সুরেন স্যার ধমকালেন, “পড়াশুনোয় মন নেই কেন?”
ঠিক সেই সময় বাসন্তীর মাথার মধ্যে, নাকি মনের মধ্যে, একজন হেঁটে গেল। কে ও? ভুরু কুঁচকে বাসন্তী ভাবছে তার কোনও রোগবালাই হল নাকি! অন্যমনষ্ক বাসন্তীর কনুই ধরে সুরেন স্যার কড়া গলায় ধমক দিলেন, “এই জন্যে পরীক্ষায় ফেল করেছিস। আমি যা বলব শোন। তা হলে আর ফেল করবি না।” তারপর বাসন্তীর বুকে হাত রাখলেন।
বাবার বয়সী লোকটা বুকে হাত দেবেন এটা বাসন্তী ভাবতে পারেনি। আপত্তি করতে যাওয়ার আগেই খেয়াল করল মাথার মধ্যে অন্য মেয়েটা ঠোঁটে আঙুল রেখে ইশারায় চুপ করতে বলছে। বাসন্তী বুঝল মেয়েটা তার ভাল চাইছে। এখন চুপ করে থাকলে সুরেন স্যার পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দেবেন।
সুরেন স্যারের খাঁই বেশি নয়। বুকে কিছুক্ষণ হাত বুলিয়েই হাঁফিয়ে টাফিয়ে একশা! ঘাম মুছে বললেন, “আজ যা পড়ালাম, রিভাইস করবি। পরশু এসে পড়া ধরব।” তারপরে ঢিল খাওয়া কুত্তার মত পালিয়ে গেলেন।
সুরেন স্যার চলে যাওয়া মাত্র বাসন্তী চোখ বুঁজে বুঝতে চাইল মাথার মধ্যে কে ঘোরাঘুরি করছে। উত্তর এল ভিতর থেকেই। “আমার নাম নিয়তি।”
“নিয়তি? মানে কপাল? মানে ভাগ্য?” আট বছরের বাসন্তী এর বেশি কিছু বলতে পারল না।
নিয়তি নামের মেয়েটি চুপ। আর তাকে অনুভব করতে পারছে না বাসন্তী।
খুব গণ্ডগোলের বিষয়। এই নিয়ে আর মাথা ঘামাল না বাসন্তী। অজয় বা মিনুকেও কিছু বলল না।
সুরেন স্যারের টিউশানির গুণে মাধ্যমিকে পাশ করল বাসন্তী, কিন্তু আর পড়াশুনো হল না। এর কারণ মুড়কিদা।
পরনে সাদা সাফারি আর সাদা কাবলি জুতো, হাতের চৌকো বাক্স পানে ঠাসা, ঠোঁটদুটি খয়েরে রাঙা, মাথায় কদমছাঁট— এই চেহারার লোক সাঁকরাইলে একজনই। মুড়কিদা।
উনি হলেন ট্যালেন্ট স্পটার। যে বছর বাসন্তী মাধ্যমিক পাশ করল, সেই বছর বিজয়া দশমীর রাতে ভাসানের সময় ‘ছাঁইয়া ছাঁইয়া’ গানের সঙ্গে বাসন্তীর নাচ দেখে হিরে চিনেছেন তিনি। পরের দিনই লেবার বস্তির খুপরিতে ঢুকে এক বাক্স সন্দেশ মিনুর হাতে দিয়ে বললেন, “বাড়ির এ কী অবস্থা? কত বছর চুনকাম হয়নি বৌদি?”
“পয়সা নেই ভাই!” সন্দেশের বাক্স ঠাকুরের সামনে রাখল মিনু।
“তোমার মেয়েটা বর্ন ট্যালেন্টেড,” বললেন মুড়কিদা, “কাল আমি ওর ড্যান্স দেখলাম! আসলে কী জানো বৌদি, রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের দেশ তো! কালচার বাঙালির রক্তে। মেয়েটাকে আমার হাতে তুলে দাও। আমি ওকে মাচায় পারফর্ম করাবো। বাংলার মানুষ জানুক, কত বড় ট্যালেন্ট লুকিয়ে আছে সাঁকরাইলে।”
মাচা নিয়ে অজয়ের ঘোরতর আপত্তি। হাওড়া বা মেদিনীপুরের গ্রামে গভীর রাতের মাচায় খুল্লম খুল্লা নাচ সে নিজে দেখেছে। এখন মেয়ের ব্যাপারে সায় দেয় কী করে? তবে মিনুর ব্যাপার আলাদা। একে কালচারের গন্ধ, তার ওপরে টাকার হাতছানি। সে রাজি হয়ে গেল। অজয়কেও রাজি করাল। বাসন্তীকে জিজ্ঞাসা করার কথা কেউই ভাবল না।
সেদিনই বাসন্তীর মাথার মধ্যে নিয়তি এসে হাজির। সে আগের মতো নেই। বাসন্তীর মতো বড় হয়ে গেছে। দেখতেও বাসন্তীর মত হয়েছে। সে বলল, “কী ভাবছিস?”
বাসন্তী বলল, “আমি জানি যে আমার ট্যালেন্ট আছে। কিন্তু আমাকে একবার জিজ্ঞেস করবে না? আমি তো আর বাচ্চা মেয়ে নই!”
“যখন বাচ্চা ছিলি তখন সুরেন স্যার অনুমতি নিয়েছিলেন?” ধমক দিল নিয়তি, “তুই বরং নিজের উইকনেসকে পাওয়ারে বদলে দে। ‘তোমরা চাপ দিচ্ছ বলে আমি রাজি হয়েছি’— এই কাঁদুনি গেয়ে দামি জিন্স আর টিশার্ট আদায় কর।”
সেই সন্ধেবেলা অজয় বাড়ি ফিরল কলকাতার নামকরা শাড়ির দোকানের প্যাকেট নিয়ে। বাসন্তী অবাক হয়ে বলল, “এটা কী?”
“মুড়কিদা দিয়েছে,” অজয় উত্তর দেওয়ার আগেই বলল মিনু, “তিন হাজার টাকা দাম! কাল আমাদের পাড়ায় কালচারাল পোগরাম আছে। সেখানে তুই এইটা পরে গান গাইবি।”
কালো সিল্কের শাড়িতে গোলাপি পাড় আর আঁচল দেখে মুখ ভেটকে বাসন্তী বলল, “কী বাজে কালার কম্বিনেশান! গান তো দূর কী বাত, আমি এটা পরবই না!”
মাথার মধ্যে থেকে নিয়তি বলল, “অ্যাক্টিং চালিয়ে যা। জিন্স আর টিশার্ট বাগিয়ে তবে এই শাড়ি পরবি। ব্লাউজ় এক সাইজ় ছোট বানাস।”
বাসন্তীর আপত্তি শুনে মুড়কিদা দৌড়ে এলেন। সব শুনে বললেন, ‘ট্যানটাম থ্রো না করলে সিল্পি কীসের? তুই আমার সঙ্গে চল। মিনি মার্কেট থেকে জিন্স কিনে দিচ্ছি।”
মুড়কিদার সঙ্গে মিনি মার্কেটে গেল বাসন্তী। ট্রায়াল রুমে নিয়তির পরামর্শ মত লো ওয়েস্ট জিন্স আর ‘আই নো আই অ্যাম হট’ লেখা টিশার্ট কিনে বাড়ি ফিরল। সে যখন জিন্স পরে আয়নার সামনে পোজ় দিতে ব্যস্ত, তখন মুড়কিদা মিনুকে বললেন, “মেয়ের কী একটা ব্যাকডেটেড নাম রেখেছ দিদি! এই নাম আজকালকার দিনে চলে না। ওর নতুন নাম দিলাম টিনা!”
“এ আবার কী রকম নাম?” আপত্তি করল মিনু।
নিয়তি উত্তেজিত হয়ে বাসন্তীর কনুই চেপে বলল, “টিনা খুব ভাল নাম। নিয়ে নে।”
বাসন্তী বলল, “ঠিক আছে। আজ থেকে আমি টিনা।”
পরের দিন মুড়কিদার দেওয়া শাড়ি পরে প্রোগ্রাম করল টিনা। প্রথমে একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইল। তারপরে ‘আর কত রাত একা থাকব’ ধরতেই পুরো মাঠ সিটি আর তালিতে ফেটে পড়ল। মুড়কিদা নাচতে বারণ করেছিলেন। বাধ্য ছাত্রীর মত কথাটা শুনেছে টিনা। শুধু ‘কলকাতার রসগোল্লা’ গাওয়ার সময় নিয়তির পরামর্শমত অল্প কোমর দুলিয়েছে। তাতেই পুরো মাঠ দিওয়ানা।
প্রোগ্রামের পরের দিন বাড়িতে এসে মিনুর হাতে পাঁচশো টাকা তুলে দিয়ে মুড়কিদা বললেন, “বৌদি, বাড়িটা এবার রং করাও।”
মিনু বলল, “পাঁচশো টাকায় বাড়ি রং? তুমি হাসালে ভাই।”
মুড়কিদা বললেন, “তোমরা চাইলে এই মাসে টিনার জন্যে আরও আটটা প্রোগ্রাম ধরে দোব। সামনের মাস থেকে মিনিমাম পনেরোটা কাজ পাবে। সে সব জায়গা সাঁকরাইলের মত কিপ্পুস নয়। পার শো মিনিমাম পাঁচ হাজার। তবে ঝক্কি অনেক। বাড়ি ফিরতে মাঝরাত হবে।”
মিনু বলল, “আমি মেয়ের সঙ্গে যাবো। তবে শোয়ের আগে হাপ টাকা অ্যাডভান্স।”
টিনা দরাদরি শুনছিল। পাশ থেকে নিয়তি বলল, “তোর অনেক সুবিধে হল। এক নম্বর, আজ থেকে কেউ আর পড়াশুনো করতে বলবে না। দু’ নম্বর, গোড়ার কয়েক মাস মুখ বুঁজে সহ্য কর। তারপরে নিজের রোজগার নিজে বুঝে নিবি।”
সেই শুরু। শীতকালে গ্রাম আর মফস্সলের ‘মাচা’-র বড় আকর্ষণ হয়ে গেল টিনা। আজ নুঙ্গি তো কাল বারাসাত, পরশু ঝালদা তো তরশু তমলুক… টিনার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছে।
তবে মাচাতেই আটকে থাকলে চলবে না। টিনা হচ্ছে মুড়কিদার আবিষ্কার। মেয়েটার প্রতি মিনিমাম দায়িত্ব আছে। মুড়কিদাই টিনাকে নিয়ে গেলেন মাস্টারজির আস্তানায়।
বছর পঞ্চাশের মাস্টারজির সঙ্গে টিনার আগে থেকেই আলাপ ছিল। কারণ তিনি মাচার অনুষ্ঠানে গিটার বাজান। তিলজলার ফ্ল্যাটে একা থাকেন। টিনাকে নিয়ে মুড়কিদা যখন ফ্ল্যাটে পৌঁছলেন তখন মাস্টারজি হনুমান চল্লিশা পড়ছেন। পুজো সেরে সোফায় বসে মুড়কিদাকে বললেন, “কী করতে হবে মেয়েটাকে বলে দিয়েছেন?”
“বলেছি যে গান গাইতে হবে।”
“কলকাতার বারে পারফর্ম করতে হবে। কলকাতায় ডান্স বার ইল্লিগাল হওয়া সত্ত্বেও সেখানে কাজ করতে হবে। এটা বলছেন? ও বিলো অ্যাভারেজ সিঙ্গার, এইটা ক্লিয়ারলি বলেছেন? না হলে পরে বলবে, ‘এ আমি কোথায় এলাম?”’ সিগারেট ধরিয়ে হুশ করে রিং ছাড়লেন মাস্টারজি।
সোফায় বসে টিনা ধোঁয়ার রিং দেখছিল। মাথার মধ্যে থেকে নিয়তি বলল, “বিলো অ্যাভারেজ সিঙ্গার— কথাটা শুনে খারাপ লাগল?”
টিনা চুপ।
নিয়তি বলল, “তোর রোজগার আগের থেকে কমেছে না?”
বাধ্য ছাত্রীর মত ঘাড় নাড়ে টিনা।
“রেওয়াজ করে অ্যাবভ অ্যাভারেজ সিঙ্গার হবি না রোজগার বাড়াবি? রেগুলার পার্লারে যাওয়া, দামি ড্রেস পরা, বিদেশি মোবাইল কেনা— এগুলো চালিয়ে যাবি? না ঘরে বসে শিল্প সাধনা করবি?”
টিনা বলল, “তুই যা বলবি।”
“তা হলে মাস্টারজি যা বলছেন শোন।” হুকুম করে নিয়তি।
মাস্টারজি তখন মুড়কিদাকে বলছেন, “সবার আগে ওর নামটা বদলাতে হবে। টিনা টাইপের নাম গ্রামে চলে। কলকাতার বারে চলবে না। ওর নাম আজ থেকে শানায়া। ওকে জিজ্ঞাসা করো, আপত্তি আছে কি না।”
জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন ছিল না। নিয়তি তখন শানায়ার কানে গুনগুন করছে, “তুই টিনা না শানায়া, তাতে কারও কিছু এসে যায় না। টাকাপয়সা নিয়ে কথা বল।”
শানায়া বলল, “রোজ ক’ ঘন্টা ডিউটি? মাইনেপত্তর কী রকম?”
দগ্ধ সিগারেট ছাইদানিতে গুঁজে মাস্টারজি যা বললেন তার মানে হল, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের বার কাম রেস্তোরাঁ ‘হট চাইনিজ়’-এ শানায়াকে সপ্তাহে তিনদিন পারফর্ম করতে হবে। কাস্টমার পছন্দ করলে কাজের দিন বাড়বে। মাইনে, আপাতত, প্রতি রাতে দু’ হাজার টাকা। তবে আসল টাকা আসে কাস্টমারের বকশিশ থেকে। বকশিসের ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ পার্সেন্ট পায় পারফর্মার। ব্যান্ড লিডার পায় বাকিটা। যেটা সে মিউজ়িশিয়ানদের মধ্যে ভাগ করে নেয়।
শানায়া বলল, “সব মিলিয়ে পার নাইট কত পেতে পারি?”
মাস্টারজি বললেন, “দু’ তিন হাজার থেকে বিশ-তিরিশ হাজার। যার ট্যালেন্ট বেশি, সে বেশি রোজগার করবে।”
“আমি তো ‘বিলো অ্যাভারেজ সিঙ্গার।’ আমার রোজগার তা হলে কম হবে।”
“গান গাওয়ার কথা হচ্ছে না, পারফর্ম করার কথা হচ্ছে। গানের সঙ্গে পাছা আর বুক দোলানোর কথা হচ্ছে।” মাস্টারজি বিরক্ত।
নিয়তি বলল, “কথা না বাড়িয়ে কাল থেকে কাজ শুরু কর।”
মাস্টারজির উদ্যোগে তপসিয়ার এক মহিলা পিজিতে জায়গা পেল শানায়া। মঙ্গলবার রাত থেকে রবিবার রাত পর্যন্ত সেখানেই থাকবে। সোমবার সকাল থেকে মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত বাবামায়ের কাছে।
প্রথম দিন কলকাতার নিশি নিলয়ে গান গাওয়ার অভিজ্ঞতা কোনও দিনও ভুলতে পারবে না শানায়া। ‘হট চাইনিজ়’-এর মালকিন পাপড়ি সাহাকে সবাই ‘আন্টি’ বলে ডাকে। তাঁর স্বামী দেবর্ষি সাহাকে বলে ‘আঙ্কল।’ আঙ্কলকে প্রথম দিন দেখতে পায়নি শানায়া।
আন্টির বাগবাজারের বাড়িতে পৌঁছে দিলেন মুড়কিদা। শানায়াকে একটা লাল শিফনের শাড়ি আর গোল্ডেন সিকুইন্ড টিউব টপ দিলেন আন্টি। চড়া মেকআপ করে দিলেন। হাতে ধরালেন গানের লিস্ট। অন্য মেয়েদের বললেন, “ওকে কাজ দেখিয়ে দিস।”
মিস মলি নামের এক পঞ্চাশোর্ধ স্থূলকায়া মহিলা এবং অন্য মেয়েদের সঙ্গে আঙ্কলের এসি গাড়ি চেপে সন্ধে ছ’টার সময় হট চাইনিজ়ে পৌঁছল শানায়া। রেগুলার কাস্টমারদের আসা শুরু হয় সন্ধে সাতটা থেকে। গান শুরু হবে তখন। সাতটা থেকে আটটা পর্যন্ত গান গাওয়ার পরে স্টেজ ছাড়লেন মিস মলি। ভয়ে ভয়ে মঞ্চে উঠছে শানায়া। ব্যান্ড মেম্বারদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছেন মাস্টারজি। সবাই বলেছে প্রাণ খুলে গান গাইতে।
হট চাইনিজ় বার-কাম-রেস্তোরাঁর সদর দরজাটি পালিশ করা সেগুন কাঠের। দামি কাঠের চেয়ার-টেবিল, দামি কাটলারি আর ক্রকারি— সব কিছু নরম হলুদ আলোয় মায়াময় লাগছে। ভেসে আসছে সিগারেট আর মদের গন্ধ। বারে সিগারেট খাওয়া নিষিদ্ধ। কিন্তু নিয়ম তো বইয়ের পাতায়। কলকাতায় ডান্সিং বারও তো নিষিদ্ধ।
মাস্টারজি বলছেন, “এখন গাইতে আসছে নতুন গায়িকা শানায়া!”
খুব হাততালি পড়ছে। শানায়াকে সাহস জোগাতে মঞ্চের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে, এক গাল হেসে নিয়তি তাকাল তার দিকে। হ্যান্ডমাইক মুখের সামনে ধরে শানায়া শুরু করল, “পিয়া তু… অব তু আজা!” তারপরে ‘আ-আ আ জা! আ-আ আ জা’ গাওয়ার সময় হাঁফাতে হাঁফাতে কোমর আর বুক দোলালো।
বারের সমস্ত খদ্দের একসঙ্গে হাততালি দিতে লাগল। সাইকেডেলিক আলো আর স্মোক মেশিনের ম্যাজিকে শানায়াকে ফিল্মস্টার বলে মনে হচ্ছে। কাস্টমাররা তার দিকে একশো টাকার নোট বৃষ্টি করছে, মাস্টারজি সেলাম বাজিয়ে মেঝে থেকে নোট কুড়োচ্ছেন।
একটানা পাঁচটা গান গেয়ে থামল শানায়া। সেই রাতে মাস্টারজির অনুরোধে সাড়ে এগারোটার সময় আবার গাইতে উঠল। বারে তখন গোটা দশেক শ্রোতা। তাদের মধ্যে কালো টিশার্ট, সাদা জিন্স আর সাদা স্নিকার পরা বছর তিরিশের এক শিখ ছোকরা আগাগোড়া শানায়ার দিকে তাকিয়ে রইল। মাঝে মধ্যেই পকেট থেকে বড় পাত্তি বার করে দু’চার পাক ঘুরিয়ে সামনে এগিয়ে দিচ্ছিল।
রাত একটার সময় মাস্টারজির সঙ্গে ট্যাক্সিতে পিজি ফেরার সময় শানায়া জিজ্ঞাসা করল, “আজ আমার রোজগার কত হল?”
মাস্টারজি বললেন, “হাজার দশেক হবে। ভাল পারফর্ম করেছিস। আর একটু ‘ইউজ়ড টু’ হয়ে যা। তারপর তোকে আঙ্কলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব।”
এক মাস পরে আঙ্কলের বাগবাজারের বাড়িতে শানায়াকে নিয়ে গেলেন মাস্টারজি। আঙ্কল ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে মাস্টারজিকে বললেন, “তুমি যাও।” তারপর শানায়াকে বললেন, “মাস্টারজির কাছে সব কিছু শুনেছিস?”
“হ্যাঁ বলে দে।” শানায়ার মাথার মধ্যে থেকে বলল নিয়তি, “সার্ভিস চার্জের ব্যাপারটাও জেনে নে।”
মাস্টারজি বেরিয়ে গেলেন। সেদিকে এক পলক তাকিয়ে শানায়া বলল, “হ্যাঁ।”
আঙ্কল বললেন, “তোকে নিয়ে ক্লায়েন্টদের এখন খুব উৎসাহ। কাজ শুরু করার এটাই আইডিয়াল টাইম। তোর ওপরে কোনও চাপ নেই। প্রথম দিকে পুরনো কাস্টমার ছাড়া দেব না। একটু অভ্যস্ত হয়ে গেলে পিক অ্যান্ড চুজ় করবি। সমস্যা হল পুলিশ। নতুন ওসি এলেই রেড শুরু করে। তখন টাকাপয়সা দিয়ে, মালঝাল খাইয়ে, তোদের পাঠিয়ে ম্যানেজ করতে হয়। ওটা মেনে নিতে হবে। তবে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব…”
“আমার সার্ভিস চার্জ?” নিয়তির কথামত জিজ্ঞাসা করল শানায়া।
“দশ থেকে কুড়ি হাজার পার নাইট। আমি সাজেস্ট করব প্রথম দিকে সপ্তাহে একবার বা দু’বার কাজ করতে। আর একটা কথা। শানায়া টাইপের ফিল্মি নাম বারের জন্যে ঠিক আছে। বিছানায় সবাই ঘরোয়া নাম চায়। মৌ নামটা কেমন?”
“মৌ ইজ় গুড,” বলল নিয়তি। একই কথা বলল মৌ।
“বাই দ্য ওয়ে, তুই কি ভার্জিন?”
মাথা নিচু করে মৌ বলল, “হ্যাঁ।”
সেদিন, তখনই আঙ্কলের সঙ্গে মেলামেশা হল মৌয়ের। পরের দু’ সপ্তাহে আরও কয়েকবার। আঙ্কল খুব কেয়ারিং বলে মৌয়ের অসুবিধে হয়নি। তৃতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হল ক্লায়েন্ট সার্ভিসিং। আর পাঁচটা পেশার মত এই পেশাতেও বেশি কাজ করলে বেশি টাকা। সেই টাকার পরিমাণ অনেকটা বেশি এ কথা যেমন ঠিক, তেমন ঝক্কিও বেশি। গান ও ক্লায়েন্ট সার্ভিসিং এক সঙ্গে সামলাতে গিয়ে শরীর ও মনের ওপরে ধকল পড়ে খুব।
এক ক্লায়েন্টের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠতা হল মৌয়ের। বছর ত্রিশের রাজবিন্দার সিংকে সবাই সিংজি বলে ডাকে। এই ছেলেটিই কালো টিশার্ট, সাদা জিন্স আর সাদা স্নিকার পরে শানায়ার প্রথম পারফরম্যান্সের দিন আগাগোড়া তাকিয়ে ছিল আর বড় পাত্তি উড়িয়েছিল।
সিংজির বাড়ি ভবানীপুরে, ট্রান্সপোর্টের ব্যাবসা। মৌকে তাই বলেছে। হঠাৎ হঠাৎ উধাও হয়ে যায়, ফিরে আসে মাস দেড়েক বাদে। আবার একটানা রোজ হট চাইনিজ়ে রাত দশটা নাগাদ চলে আসে। গাদা গাদা বড় নোট উড়িয়ে, মৌকে নিয়ে চলে যায় গুমঘর লেনের অফিসে। বেশি রাতে তিলজলা ফেরা নিয়ে চিন্তা করতে হয় না মৌকে। বাইকের পিলিয়নে বসিয়ে হাউইয়ের মত উড়ে যায়।
এক বছরের মধ্যে বেহালায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিল মৌ। গৃহপ্রবেশের দিন অজয় আর মিনু এল। ফ্ল্যাট দেখে মিনুর খুবই পছন্দ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তোর বাবার রিটায়ারমেন্টের পরে আমরা এখানে চলে আসব।”
অজয় মেয়ের সাফল্যে সন্দিহান। জিজ্ঞাসা করল, “গান গেয়ে কত টাকা রোজগার হয়?”
“গান গেয়ে কত রোজগার হতে পারে, টিভি দেখে আন্দাজ করতে পারো না?” ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে মিনু।
ঠিক কথা। গানের রিয়ালিটি শো করার পরে বাচ্চাবাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো মাচার স্টার হয়ে যায়। প্রচুর টাকা নিয়ে প্রোগ্রাম করে।
সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল। সমস্যা এল খুব সাধারণ একটা বিষয় থেকে। নিয়তির বারণ সত্ত্বেও মৌ সিংজির প্রেমে পড়ল।
প্রেম! সব গণ্ডগোলের উৎস!
প্রেমের প্রস্তাব পেয়ে সিংজি বলল, “আমার বউ-বাচ্চা আছে। ওরাই মেন ডিশ। তবে সাইড ডিশ হিসেবে তোমার জায়গা কেউ কাড়তে পারবে না।”
সিংজির কথা শুনে নিয়তি মৌকে বলল, “এই হচ্ছে আইডিয়াল সময়। মালকড়ি নিংড়ে নে। ক’দিন বাদেই সিংজির অন্য সাইড ডিশ পছন্দ হবে। তখন খালি প্লেট হিসেবে তোর জায়গা হবে ডাস্টবিনে।”
কথাগুলো আঁতে লাগল মৌয়ের। সে বলল, “আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলার সাহস হয় কোথা থেকে?”
নিয়তি অনেকক্ষণ মৌয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখে আষাঢ়ের মেঘের মত অভিমান জমছে। থেমে থেমে বলল, “একটা বদ লোকের প্রেমে পড়ে নিজেকে জাস্টিফাই করছিস?”
“তুই আমাকে শাসন করার কে? ছোটবেলায় তোকে মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু এখন আমার জীবনে তোর কোনও প্রয়োজন নেই।”
নিয়তি বলল, “সুরেন স্যার যখন মলেস্ট করছিল তখন আমি বলেছিলাম, সিচুয়েশানের ফায়দা ওঠা। তুই আমার কথা শুনেছিলি। যদি সেটা না শুনে বাবামাকে বলে দিতিস সুরেন স্যার তোর সঙ্গে কী করেছে, তা হলে তোর জীবন অন্য খাতে বইত। একই কথা মুড়কিদা, মাস্টারজি, আন্টি বা আঙ্কলের ক্ষেত্রেও সত্যি। আমার কথা শুনে তুই এই জায়গায় পৌঁছেছিস। যে যেখানে যায়, আমার কথা শুনেই যায়। যা বলছি, শোন। সিংজির সঙ্গে প্রেমের অভিনয়টা চালিয়ে যা। ফিউচার গুছিয়ে নে।”
“আমারটা আমাকেই বুঝতে দে।” হাতজোড় করে মৌ। “এখন থেকে তোকে আর আমার হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে না।”
নিয়তি চলে গেল।
এখন মৌ সিংজির প্রেমে পাগল। লোকটা বউবাচ্চা সামলে সত্যিই ভালবাসছে মৌকে। মৌ কখনও সিংজির পারিবারিক বা পেশাদার জীবনে নাক গলায় না। তবে সিংজি নাক গলিয়েছে মৌয়ের কাজে। তার অনুরোধে মৌ ক্লায়েন্ট সার্ভিসিং বন্ধ করেছে। আঙ্কল বলেছেন, “ক্লায়েন্ট সার্ভিসিং না করলে প্রাইম টাইমে তোকে হট চাইনিজ়ে স্টেজ দেব না। আমাকেও নিজের ব্যাবসা দেখতে হবে।” তারপরে তুলসি তলা ও সতী নিয়ে একটি বাংলা প্রবচন আউড়েছেন।
এসব খুচরো সমস্যার মধ্যে বড় বিপদ এসে হাজির। থানায় নতুন বড়বাবু এসে হট চাইনিজ়ে সাদা পোশাকের পুলিশ পাঠিয়ে মৌয়ের নাচের ভিডিও শুট করেছেন। সেটা হাতে পেয়ে আঙ্কলকে ফোনে জানালেন আইনভঙ্গকারীদের তালিকায় আন্টি, আঙ্কল আর মৌ আছে।
দুপুরবেলা লম্বা মিটিং হল বাগবাজারের বাড়িতে। আঙ্কল বললেন, “বড়বাবুর কিছুদিন আগে ডিভোর্স হয়েছে। বাচ্চাকাচ্চা নেই। কোয়ার্টারে একা থাকে। যা বোঝার বুঝে নাও।”
মিস মলি বললেন, “আমাকে দিয়ে যদি কোনও কাজ হলে বলো। মৌ প্রেম করছে। ওকে ঘাঁটিও না।”
আঙ্কল বললেন, “বড়বাবুর স্পেসিফিকালি মৌকেই পছন্দ।”
আঙ্কলের কথা শুনে সবাই মৌয়ের দিকে তাকাল।
সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই রকম সময়ে নিয়তি বরাবর সাহায্য করেছে। আজ সে নেই। তার দরকারও নেই। নিজের রাস্তা নিজেই খুঁজে নিতে পারে মৌ। সে বলল, “আমি রাজি নই।”
আন্টি হিশহিশ করে বললেন, “আমরা আছি বলেই করেকম্মে খাচ্ছিস।”
“তাই বলে আপনারা যা বলবেন তাই শুনতে হবে?”
মৌয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আঙ্কল বললেন, “রাগারাগি করলে শরীর খারাপ হয়। হট চাইনিজ়ে কাজ করতে গেলে তোকে বড়বাবুর কাছে যেতে হবে। যাবি? ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলে উত্তর দে।”
“না। এবং হট চাইনিজ়ে আজই শেষবারের মত পারফর্ম করব।”
আন্টি বললেন, “আমি অনেক আগেই তোকে ছেঁটে ফেলতে চেয়েছিলাম। আঙ্কলের দয়ার প্রাণ বলে এতদিন কাজ করতে পারলি। তবে এটা জেনে রাখ যে আমরা ছেড়ে দিলেও বড়বাবু তোকে ছাড়বে না। আজকের মত কাজ করে বিদেয় নে। পরশু এসে টাকাপয়সা বুঝে নিস।”
“ঠিক আছে।” মিটিং থেকে বেরিয়ে গেল মৌ। গত রাতে সিংজি লুধিয়ানা থেকে ফিরছে। এক্ষুনি ওর সঙ্গে কথা বলতে হবে।
রাত সাড়ে এগারোটার সময় গান গাইছে মৌ। পরনে কুচকুচে কালো শিফনের শাড়ি, ব্লাউজ়ের রং টকটকে লাল। ঠোঁটে লাল শেডের লিপস্টিক। শরীরে কোনও গয়না নেই।
সিংজি এখনও আসেনি। নতুন একটি লোকের নজর পড়েছে মৌয়ের ওপরে। বছর পঞ্চান্নর লোকটা পাত্তি ওড়াচ্ছেন একের পর এক। মাস্টারজি সেগুলো তুলে সেলাম বাজিয়ে ফিরে আসার সময় ঠোঁট নেড়ে মৌকে বলছেন, “ভুল করছিস।”
মৌ মাস্টারজির কথা শুনছে না। সে ‘এক ঘুঁট মুঝে ভি পিলা দে শরাবি, ফির দেখ হোতা হ্যায় কেয়া’ গাইছে আর দরজার দিকে তাকাচ্ছে। সিংজি এখনও আসছে না কেন?
নতুন লোকটি মাস্টারজির কানে কিছু বললেন। মাস্টারজি ঘাড় নাড়ছেন। লোকটা মৌয়ের কাছে এসে নোট ঘুরিয়ে বললেন, “আই অ্যাম মহেশ রোশন ফ্রম মুম্বই। ক্যান উই মিট আফটার দ্য শো?”
মহেশকে পাত্তা না দিয়ে গান গাইতে গাইতে মৌ অন্য শ্রোতার কাছে চলে গেল। তার মাথায় একটা চিন্তাই ঘুরছে। সিংজি কই?
মাতাল মহেশ টুক করে ঢুকে গেলেন হট চাইনিজ়ের বাথরুমে। সাইকেডেলিক আলোর খেলা, টাকার বৃষ্টি, স্ট্রোব লাইটের চোখ মারার মধ্যে মৌ দেখল হট চাইনিজ়ের দরজা খুলে সিংজি ঢুকছে। এগিয়ে আসছে মৌয়ের দিকে। তাকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খাওয়ার অছিলায় ব্রাউন পেপারে মোড়া প্যাকেট ধরিয়ে বলছে, “এটা লুকিয়ে রাখো।” তারপর ফিরে যাচ্ছে দরজার দিকে।
সিংজি কি চলে যাচ্ছে? কালো শিফনের শাড়ির আঁচলের আড়ালে প্যাকেট লুকিয়ে গান গাইছে মৌ। গানটা শেষ করেই বেরতে হবে।
কিন্তু… মৌকে অবাক করে একাধিক ঘটনা ঘটছে। মহেশ বাথরুম থেকে দৌড়ে বেরিয়ে চলে আসছেন মৌয়ের কাছে। হাত বাড়িয়ে বলছেন, “গিভ মি দ্য প্যাকেট!” বিশাল গোঁফওয়ালা একটা লোক সিংজির কলার ধরে হিড়হিড় করে টেনে রেস্তোরাঁর মাঝখানে নিয়ে আসছে।
সিংজির গায়ে হাত দিল! এত বড় সাহস কার? মৌয়ের মাথায় বিপদ ঘন্টি বাজছে ঢংঢং করে। মহেশ প্যাকেটের কথা জানলেন কী করে? কী আছে এর মধ্যে? প্যাকেটটা ওঁর হাতে তুলে দিলে সিংজির বিপদ হবে এটা বুঝে গান থামিয়ে দিল মৌ।
গুঁফো লোকটা সিংজির কলার ধরে হিড়হিড় করে টেনে এনেছে মহেশের কাছে। সিংজি নিচু গলায় মহেশকে বলল, “দিল্লি পুলিশের হয়ে আপনারাই তো আমার সঙ্গে ডিল করলেন। তা হলে?”
মৌ অবাক! মহেশ আর গুঁফো লোকটা দিল্লির পুলিশ? ওঁদের সঙ্গে সিংজির কী ডিল হয়েছে?
মহেশ নিচু গলায় হিন্দিতে বললেন, “পলিটিকাল প্রেশার বস! ডিল ক্যানসেল করছি না, কিন্তু আমার একটা ‘বকরা’ লাগবে। সেটা তুই হবি না অন্য কেউ?”
ঠিক এই সময়! ঠিক এই সময়েই নিয়তিকে আবার দেখতে পেল মৌ। তার মাথা থেকে বেরিয়ে নিয়তি সিংজির পাশে দাঁড়াল। সিংজির কানে কানে কিছু বলল। সেটা মন দিয়ে শুনে, মৌকে চমকে দিয়ে সিংজি চিৎকার করল, “আমি বিবি-বাচ্চাওয়ালা আদমি। আমার পিছনে কেন লাগছেন? মাল আছে এই রেন্ডির কাছে।”
গুঁফো লোকটা সিংজি-র কলার ছেড়ে দিতেই সে হট চাইনিজ়ের দরজার দিকে এগোল। সঙ্গে নিয়তি।
মৌ চিৎকার করে বলল, “নিয়তি, প্লিজ়! ফিরে আয়!”
নিয়তি দাঁড়াল। মৌয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “নিয়তি সবার জন্যে সত্যি। জীবনে যখন বড় কোনও বাঁক আসে, শক্ত কোনও সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তখন আমি সাহায্য করতে আসি। তোর জীবনে আর কোনও নতুন ঘটনা ঘটবে না। তোর বাকি জীবন কাটবে তিহাড় জেলের জেনানা ফাটকে। কিন্তু সিংজির এখন আমাকে দরকার। ড্রাগ কার্টেলের চক্কর থেকে কী ভাবে বেরবে, কী ভাবে বউবাচ্চাদের সামলাবে, কী ভাবে সোনাগাছির নুসরাতকে নতুন ফ্ল্যাট কিনে দেবে— এগুলো ঠিক করার জন্যে আমাকেই সাহায্য করতে হবে।”
মৌয়ের হাত ধরে মহেশ তখন বলছেন, “এক কিলো নার্কোটিক্স রাখার জন্যে আপনাকে গ্রেফতার করা হল মৌ ওরফে শানায়া ওরফে টিনা ওরফে বাসন্তী। আপনার কি আর কোনও নাম আছে?”
বাসন্তী, টিনা, শানায়া কিংবা মৌ বলল, “নিয়তি!”
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
সুন্দর গল্প
Lovely…. khub valo laglo ❤️👍