short-story-jeevan-prohelikar-asor

জীবন প্রহেলিকার আসর
ফারুক আহমেদ


কর্পোরেট পাড়ায় ঈর্ষণীয় হয়ে ওঠা ম্যানেজিং ডিরেক্টর মাহফুলের ইজ্জত একদিনের ব্যবধানে প্রায় ধুলিতে মিশে গেল। অথচ তার জন্য মাহফুল এতোটুকু দায়ী নয়। যে ঘটনার কারণে সবখানে সে হাসির পাত্রে পরিণত হয়ে উঠলো, তা নিতান্তই ফালতু একটা ঘটনা। একই সঙ্গে অপ্রত্যাশিতও। সন্ধ্যা পেরিয়েছে, জীবন অফিস থেকে বেরিয়ে নানা আসরের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। মাহফুল অফিস শেষ করে সন্ধ্যার দিকে যাচ্ছিল। গাড়ি থেকে নেমেছে সবে। এক অভিজাত রেস্টুরেন্টে ঢোকার আগের মুহূর্ত ছিল সেটা। ডান হাতে চাবির বাটন, বাম হাতে কানে মোবাইল গুজে কথা বলছিল। ২০ থেকে ২৫ সেকেন্ডের ব্যাপার। এর মধ্যে কোত্থেকে একটা লোক এসে মাহফুলের গালে কষে থাপ্পড় বসালো। লোকটা হ্যাংলা, মুখভর্তি দাড়ি। দেখে নেশাখোর-ছিনততাইকারী মনে হবে। থাপ্পড়টা মাহফুলকে একদম কাঁপিয়ে দিল। প্রথমবার দিয়ে সে আবারও দেয়ার জন্য হাত উঠিয়েছিল। ৪০ সেকেন্ডের ভিডিওর প্রথম পর্বে দেখা যাচ্ছে, থাপ্পড়ে মাহফুলের গাল-ঠোঁট বেঁকে গেছে। সে কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। দারোয়ান ছুটে আসছে দেখে লোকটা দ্বিতীয় থাপ্পড়টা ব্যবহার করলো না। মনে হলো, তলোয়ারের মতো থাপ্পড়টা খাপে গুজে মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। এতে দ্বিতীয় থাপ্পড় থেকে মাহফুল বেঁচে যায়। তবে যাওয়ার আগে ‘বাস্টার্ড’ বলে একটি গালি লোকটা দিয়েছে। শব্দটা ফুটেনি, কিন্তু ঠোঁট যেভাবে নড়েছে, শব্দটা ‘বাস্টার্ড’ই। এই হলো ঘটনার প্রথম অংশ। ড্রাইভার সঙ্গে না নিয়ে বের হওয়া সন্ধ্যা ছিল সেটা, সব ছিমছাম, সুন্দর। তেমন ফুরফুরে একটা সন্ধ্যাকে এক থাপ্পড়ে লোকটা ঘনঘোর অন্ধকার বানিয়ে দিল।

দারোয়ান তার দায়িত্বটুকু পালন করে নিজের জায়গায় ফিরে আসে। এদিকে মাহফুল পড়িমড়ি করে রেস্টুরেন্টের ভেতর ঢুকে যায়। ঢুকে অবশ্য কয়েক মিনিটের ব্যবধানে দ্রুত পায়ে ফিরে আসে। তখন দেখা যায় রেস্টুরেন্টের দরজা ঠেলে পেছন পেছন একটা নারীকে বাইরে এসে দাঁড়াতে। নারীটি রেস্টুরেন্টের দরজা ঠেলে বেশিদূর এগোতে পারে না। মাহফুল গাড়ি স্টার্ট দিয়ে পথে নেমে পড়ে। দৃশ্যে নারীর ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল মাহফুলের এই চলে যাওয়াটা তাকে ব্যথিত করেছে।

সব মিলিয়ে মাহফুলের মনে হয়েছে একটি বিশ্রি ঘটনা এই সন্ধ্যায় তার সঙ্গে ঘটেছে। ব্যাপারটা কোন নিয়মের মধ্যে পড়ছে না। লোকটার কোন পরিচয় নাই। ওকে ধরে আনার জন্য যে ন্যুনতম স্ট্যাটাসটুকু থাকা প্রয়োজন, তাও লোকটার নাই। তার ওপর সে ধাপ্পড় দেয়া ছাড়া আর কিছুই করেনি। অন্য কানে গুজে রাখা দামী ফোনটার দিকেও হাত বাড়ায়নি। ফলে অভিযোগ বা শাস্তি দেয়ার তেমন কোন পথ খোলা রইলো না।

মাহফুলের ঢোকা এবং বের হয়ে আসার ৪০ সেকেন্ডের এই ভিডিওটা ভাইরাল হয়ে গেল। ভিউ ১০ লাখ ছাড়িয়েছে। কেউ কেউ কষে চড় দেয়ার সঙ্গে অনন্ত জলিলের ডায়লগ জুড়ে দিয়েছে। এক জায়গায় দেখা গেল, ‘আমাকে তুমি অশেষ করেছো’ এই কয়েকটি শব্দ সুরসহ যুক্ত করেছে কেউ। তাছাড়া থাপ্পড়টা কয়েকবার ফিরে ফিরে এসেছে। আবারও ‘আমাকে তুমি অশেষ করেছো’ গানটা বাজিয়ে ঘটনাটার সমাপ্তি। ফলে নেটভিলেন মাহফুলের জীবনকে এক বিরাট সংকটের ভেতর ফেলে দিল।

ঘটনাটা মাহফুলকে একসঙ্গে অনেকগুলো সংকটে ফেলে দিল। প্রথমত, লোকটা কেন তাকে থাপ্পড় দিতে এলো। দ্বিতীয়ত, ট্রেস করার জন্য যেটুকু সামাজিক অবস্থান লোকটার থাকা দরকার ছিল, তার ন্যুনতমটাও নেই। তৃতীয়ত, ভাইরাল হয়ে যাওয়ায় এটা নানাবিধ সংকটের জন্ম দিয়েছে। চতুর্থত, গাড়িতে ওঠার সময় এক নারীর ব্যাকুলতা। যে নারীটি আবার সদ্য জয়েন করা তার অফিসেরই পাবলিক রিলেশন্স অফিসার। অনেকেই তাকে চিনে ফেলেছে। বাসার মানুষজনও তাকে চিনে ফেলেছে। মাহফুলকে এরকম বহুমুখি সংকটের ভেতর ফেলে দিয়েছে বাজে ঠুনকো একটি ঘটনা।

এ ঘটনার ফলে কোন মিটিংয়ে যাওয়াটাও এখন মাহফুলের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। কিন্তু জরুরি মিটিং তো বাদ দেয়া যাচ্ছে না। কানে ‘থাপ্পড় মাহফুল’ শব্দটা ঢুকে গেলে ঝাঁকুনি দিয়ে ফেলে দিতে হচ্ছে। তবে এটুকু করেই থেমে যাচ্ছে, এমন নয়। অন্যের গাত্রদাহের জন্য বাঙালি যেভাবে হাসে, সেভাবে চারদিকে হাসি ফুটছে। এখানেই শেষ নয়। দেখা গেল, ‘এমওই’ হবে, সেখানে মাহফুলকে থাকতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের বিগবস হিসেবে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর দুই প্রতিষ্ঠানের আগত প্রতিনিধিদের হাততালি পড়লো। হাততালি শেষে অন্য প্রতিষ্ঠানের এমডি বা সিইও মাহফুলের কানের কাছে মুখে এনে ফিসফিস করে, ভাই পাগলটাকে কি ট্রেস করা গেল? প্রশ্নের সঙ্গে ঠোঁটের কোণে যে হাসিটা ঝুলিয়ে রাখে, তা সহ্য করা কঠিন। মাহফুল উত্তরে বিড়বিড় করে, অবৈধ সংগম ছাড়া সুখ/অপরের মুখ ম্লান ক’রে দেওয়া ছাড়া প্রিয় সাধ নেই।’ পড়েছেন, জীবনানন্দ দাশ বলেছে মানুষকে নিয়ে, হাহা। এই হাসি অন্য সবাইকেও পুলকিত করে, ভাবে ফিসফিস করে দুই বস বিশেষ কোন কথা শেয়ার করছে। এই সংকটে জীবনানন্দ দাশের দুটা লাইন সে মুখস্ত করে নিয়েছে।




মাহফুলের মূল সংকট এখন দুটো – ঘর এবং অফিস। ঘরে যতটুকু হবে ভেবেছিল, ততটুকুর মুখোমুখি হতে হয়নি তাকে। বউ দু’দিন গম্ভীর হয়ে ছিল। মাহফুল বাসায় এলে কোন কথা বলে নাই। তৃতীয়দিন রাতে মাহফুল যখন বিছানায় স্ত্রীর হাত ধরতে যাবে, তখন স্ত্রী হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলল, ছি, মাহফুল।

-কেন ছি? মাহফুল উত্তর জানতে চাইলে তার স্ত্রী বিছানা থেকে উঠে বাচ্চাদের রুমে চলে যায়। মাহফুল তখন বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করে। পরদিন ফিরে দেখে তিন বাচ্চা নিয়ে বউ চলে গেছে বাপের বাসায়। তার জন্য একটা চিরকুট রেখে গেছে – অফিসের জুনিয়র কলিগও তোমার কাছে নিরাপদ নয়!

এই মেসেজের মানে বুঝতে পারে না মাহফুল। সংসার, বাচ্চাদের বাদ দিয়ে কেন হঠাৎ অফিসের জুনিয়র কলিগ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়লো তার স্ত্রী। সে কি নারী অধিকার নিয়ে খুব সিরিয়াস হয়ে গেল! প্রতিটি নারীর নিরাপত্তা নিয়ে খুব ভাবছে? যাই হোক, পারিবারিক অশান্তিটা তো হলো না। ছেলেমেয়েরা কয়েকদিন নানা বাসা থেকে ঘুরে আসুক। ম্যানেজিং ডিরেক্টর পদকে বাদ দিয়ে তার স্ত্রী যে একা থাকতে পারবে না, এটা মাহফুল জানে। অনেক পথ তো পেরিয়েছে দুজন। অনেক ঘটনা দু’জন বসে সমাধা করেছে। এমনকী সিঙ্গাপুরে শালার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল যেবার, সেটাও মিটিয়ে ফেলেছিল দুজন একসঙ্গে বসে। কিন্তু ভাইরাল হলে সংকটটা কেমন, এর আগে তো তাকে তার মুখোমুখি হতে হয়নি।

পরিবারের বাইরে বাকি থাকলো অফিস; যে জায়গাটা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। আলোর উৎসটা যদি ঠিক না থাকে, তাহলে ম্যানেজিং ডিরেক্টরে আর শ্রমিকের কন্ট্রাকটরে কোন পার্থক্য থাকে না। সেই জায়গাটাকেই এ মুহূর্তে সব থেকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে মাহফুলকে। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ঘটনা ভাইরাল হওয়ার তৃতীয় দিনে মাহফুলকে তার রুমে ডেকে পাঠালো। বলল, মাহফুল সাহেব, থাপ্পড় তো নিজে খেলেন, সঙ্গে আমার প্রতিষ্ঠানকেও খাওয়ালেন।

মাহফুল খুব সিরিয়াস মুখ করে বলল, স্যার আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না।

-থাপ্পড় আপনি খেলেন, আর কৈয়ফত দিতে হয় আমাকে। মনে হয় আমাদের সিরিয়াস একটা আলোচনায় বসা দরকার।

দু’জন এরপর চুপচাপ কাটালো কিছুক্ষণ। চেয়ারম্যান বললেন, কফি খাবে?

মাহফুল মাথা নাড়িয়ে জানাল, হ্যাঁ। কফি খাওয়া হলো, কিন্তু আর কোন কথা হলো না তাদের।




চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা হওয়ার পরের দিনটা ছুটিতে কাটালো মাহফুল। ঘরে বসে পুরো দিনটা পার করে দিল। এর মধ্যে বিকালে একফাঁকে এসএমএস করলো পিউকে, আজ কোন শিডিউল রেখো না। আমি রাতে আসব, ডিনারের আয়োজন রেখো।

সন্ধ্যা সাতটায় বাসা থেকে নেমে নিজেই গাড়ি নিয়ে পথে নামলো। চেয়ারম্যানের এসএমএসটা যখন এসেছে, সে তখন গন্তব্যের অর্ধেক পেরিয়ে গেছে। ‘মাহফুল পরশু বোর্ড মিটিং আছে। তুমি এ ক’দিন ছুটি কাটাও- কাশেফ, চেয়ারম্যান, কিংকং গ্রুপ।’ পিউয়ের বাসায় যখন পৌঁছে, তখন রাত আটটা দশ। তিনতলায় পিউয়ের বাসাটা ছিমছাপ। বাসার প্রতিটা জায়গাই যত্ন করে সাজানো।

খাবার টেবিলে বসে মাহফুল বলে, দেখ, কী অদ্ভুত একটা ঝামেলায় জড়িয়ে গেলাম। অদ্ভুত এবং বিশ্রি।

-আমিও দেখেছি। তুমি এমন ভড়কে গিয়েছিল। তোমার স্মার্টনেস ওই কয়েক সেকেন্ড একদম উবে গিয়েছিল। তুমি খপ করে কেন ধরে ফেললে না লোকটাকে।

-এসব নেশাখোরের পকেটে ছুরি থাকে, পিস্তল থাকাটাও অসম্ভব নয়। দেখা গেল তলপেটে মেরে দিয়েছে।

-তুমি কি নিশ্চিত সে নেশাখোর?

-দেখে তো তাই মনে হলো।

-তার মানে সে তোমার পূর্ব-পরিচিত নয়।

-কী বল এসব! মাহফুল অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে পিউয়ের দিকে।

এক বয়স্ক বুয়া টেবিলে খাবার এগিয়ে দিতে থাকে। খাবার শেষ হয়ে গেলে ডেজার্ট আসে। মাহফুল বলে, আচ্ছা বল তো এখন আমার এর থেকে বেরিয়ে আসার পথ কী?

-আমিও ভেবেছি ব্যাপারটা নিয়ে। মনে হলো, তুমি এলে আরেকটু বিস্তারিত জেনে নিব। পাবলিক হয়ে যাওয়া একটা বিশ্রি ব্যাপার। তুমি কোন দিকটাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছো প্রথমে?

মাহফুল বলে, আমাকে প্রথম অফিস ঠিক রাখতে হবে।’

খাবার শেষ হলে দু’জন এসে বারান্দায় বসে। গ্রিল ধরে লতানো গাছ ছড়িয়ে পড়ে বারান্দাকে একটা সবুজ আভা দিয়েছে। এর মধ্যে বারান্দায় দু’টা সুন্দর চেয়ার রাখা, মাহফুল আর পিউ তাতে বসে পড়ে।

পিউ বলে, তোমার চেয়ারম্যানের কফি খাওয়ার প্রস্তাবটাই টার্নিং। তোমাকে যে ইঙ্গিত দিয়েছে, তার মানে একটা সুযোগ আছে। ওই মুহূর্তে না হয় কফির কথা বলত না।

মাহফুল প্রবলভাবে মাথা নাড়াতে থাকে, কিন্তু এই এসএমএসের মানে কী! আমি প্রতিষ্ঠানটা নিজের হাতে দাঁড় করিয়েছি। আমার সঙ্গে কোন কথা না বলে এমন একটা মেসেজ উনি দিতে পারলেন!

পিউ নিঃশব্দে হাসে, বলে, প্রতিষ্ঠান তো তোমার নয়। পুঁজির চরিত্রটা তোমাকে মেনে এগোতে হবে।

মাহফুল কোন কথা বলে না। চুপচাপ বসে থাকে।

পিউ আবারও বলতে থাকে, দেখো পুঁজির মালিক তোমারও মালিক, সে কী চাচ্ছে তা তুমি খুঁজে বের করো আগে।

-সে কিছুই চাচ্ছে না। সে চাচ্ছে বোর্ড মিটিং।

পিউ এবার শব্দ করে হেসে ওঠে। গত কিছুদিন, একমাস, দু’মাস বা ছ’মাস স্টাডি করো। দেখো, উনি কী চেয়েছেন, আর তুমি কী দিতে পারোনি। বোর্ড মিটিং তো নিয়মিত একটা ব্যাপার। আর যে তোমাকে থাপ্পড়টা দিল তাকে খুঁজে বের করে জানা দরকার কেন এমন একটা ঘটনা সে ঘটালো। এটা হলে তুমি ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক হতে পারবে।

মাহফুলের কপালে ভাঁজ পড়ে। সে পিউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

-তোমার বাসার কী অবস্থা, সব ঠিক আছে।

-না, বাচ্চাদের নিয়ে ওদের মা চলে গেছে।

-হাহা, তাহলে আমার সঙ্গে থেকে যাও।

-থেকে যাওয়ার জন্যই তো এসেছি। অনেক স্ট্রেস জমা হয়েছে এ ক’দিনে। মনে হলো আজ রাতটা তোমার সঙ্গে থাকলে অনেককিছুই ঠিক হয়ে যাবে। অন্তত স্ট্রেসটা ঝরে যাবে বৃষ্টির মতো।

-আজ রাতটুকুই! পিউ শব্দ করে হাসতে থাকে। তারপর চেয়ার থেকে উঠে দরজার মুখে এসে দাঁড়ায়।

-তুমি এক্ষুণি আমার বাসা থেকে চলে যাও। আমার জরুরি কাজ আছে। আগামীকাল প্রেজেন্টেশন। আমাকে একা থাকতে হবে।

মাহফুল গাড়ি চালাতে চালাতে দেখল, তার মাথাকে একটা অপমান খুব করে চালাচ্ছে। তবে এই ব্যাপারটাকে সে পাত্তা দিল না। বরং পিউ যে বলল, স্টাডি করতে, সেটা এরই মধ্যে করে একটা সমাধান পেয়ে গেছে। তার মনে হলো, বোধহয় এবারের মতো সে বেঁচে গেল।




পরদিন সকালে কাশেফ সাহেবকে ছোট্ট একটা এসএমএস পাঠায় ম্যানেজিং ডিরেক্টর মাহফুল। এসএমএসে একটি নাম (নামটা হালের হার্টথ্রুব এক নায়িকার), সঙ্গে পাঁচ তারকা হোটেলের রুম নাম্বারসহ সন্ধ্যার পর একটা সময় উল্লেখ আছে। এসএমএসটাকে মনে হবে অনেকটা আদেশের মতো, যথাস্থানে যখাসময়ে উপস্থিত থাকার নির্দেশ তাতে স্পষ্ট। কিন্তু তাদের ভেতর এই ভালোবাসার বোঝাপড়াটা আছে বলেই অনেকদিন হলো একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। আর সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ, এটা সফল হওয়া মানুষ মাত্রই জানে।

এই কাজটুকু শেষ করে মাহফুল থানার অফিসার ইনচার্জ আবদুল মালেককে একটা এসএমএস পাঠায়। কিন্তু এসএমএসের কোন উত্তর আসে না। ফলে তার নিজেরই থানায় এসে হাজির হতে হয়। মাহফুলকে দেখে আবদুল মালেক খুব অবাক হওয়ার মতো চেহারা করে জানতে চায়, কী ব্যাপার মাহফুল সাহেব, জরুরি কোন বিষয়?

মাহফুল সঙ্গে সঙ্গে আবদুল মালেকের হাত চেপে ধরে। বলে, আমাকে বাঁচান ওসি সাহেব।

আবদুল মালেক হাসতে হাসতে বলে, আমার তো বাঁচানোর কিছু নাই। পারলে আপনি এই অনুরোধটুকু জাকারবার্গকে করেন।

ওসির এই কথায় মাহফুল কর্ণপাত করে না। বলে, ওই লোকটা, যে থাপ্পড়টা দিল, তাকে আপনার ধরে আনতেই হবে। ব্যাপারটা আমার জানা প্রয়োজন। এর জন্য আপনি যেভাবে বলবেন, সেভাবেই আছি আমি আপনার পাশে। কেন লোকটা এমন করল, তা জানা দরকার।

একটু থামে মাহফুল। তার চোখ কয়েকবার পিটপিট করে। তারপর আবার বলে, ওকে শেষ করে দিতে হবে আপনাকে, প্লিজ এই কাজটুকু আমার হয়ে আপনি করবেন। এই অপমানটা আমি নিতে পারছি না।

উত্তরে ওসি মাথা ঝাঁকায়। তারপর কলিংবেল চাপে।

থানা থেকে মাহফুল বাসায় যাবে। ফ্রেস হয়ে সন্ধ্যায় ছুটতে হবে পাঁচতারকা হোটেলের দিকে। আগামীকাল বোর্ড মিটিং। বোর্ড মিটিংয়ের সিদ্ধান্তটা সে হোটেলে বসেই দিয়ে দিতে চায় কাশেফ সাহেবকে। ওই অনুযায়ী কাশেফ সাহেব আগামীকাল তোতাপাখির মতো অন্য ডিরেক্টরের নির্দেশনা প্রদান করবেন।




দারোগা এসে ওসিকে বলে, স্যার ধরে এনেছি। চেহারা জীর্ণ, কিন্তু শিক্ষিত মানুষ। মার দিতে পারছি না। প্রশ্ন করলে ইংরেজিতে উত্তর দিচ্ছে। আপনাকে একটু আসতে হবে।

দারোগার কথায় আবদুল মালেক প্রথমে রেগে যায়। তারপর মাথা ঠান্ডা করে কাস্টরিতে এসে দেখে গম্ভীর মুখে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে।

দাঁড়িগোফের ভেতর দিয়ে লোকটার যে অবয়ব টের পাওয়া যাচ্ছে, তা দেখে ভদ্রলোক বলেই মনে হয়। আবদুল মালেক এসে বলে, মিলন সাহেব আপনি কথা শুনছেন না কেন?

মানুষটা এর উত্তরে কিছু বলে না। নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে থাকে থানার অফিসার ইনচার্জের দিকে।

-কথা না শুনলে আজকে রাতটাই কিন্তু আপনার শেষ রাত হয়ে যেতে পারে।

এবার মুখ খোলে ভদ্রলোক, পারবেন? খুব তীব্র শোনায় কথাটা।

-মানে? প্রায় চিৎকার দিয়ে ওঠে ওসি। সঙ্গে একটা সংশয়ের মধ্যেও পড়ে যায়।

-পারবেন কী না জানতে চাইছি। আপনার দশ-বারো বছরের একটা মেয়ে আছে শুনেছি, আমার মেয়েটার বয়সও বারো বছর। আমাকেই মেয়ের লালন-পালন করতে হয়। আপনাদের কেউ কেউ পারে, কিন্তু আপনি পারবেন না। আপনার চোখ ততটুকু ক্রুর নয়।

এবার আবদুল মালেকের কপালে ভাঁজ পড়ে। দারোগাকে বলে, তুমি যাও। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মিলনকে দেখতে থাকে।

দারোগা চলে গেলে আবদুল মালেক বলে, মিলন সাহেব ওইদিন সন্ধ্যায় আপনি মাহফুল সাহেবের সঙ্গে এমন কেন করলেন?

মিলন চুপ করে থাকে। আবদুল মালেক বলে, আপনাকে বলতে হবে। আপনি যদি ছাড়া পেতে চান, নিজের প্রাণ বাঁচাতে চান, আপনাকে বলতে হবে। যার অভিযোগে আপনাকে এখানে আনা হয়েছে, সে সহজ মানুষ নয়। বিকাল থেকে অনেকগুলো ফোন এসেছে। একের পর এক আসছে। আপনাকে বাঁচাতে হলে আমার কাছে আপনার পক্ষে যথেষ্ট কারণ থাকতে হবে। আর না হয় সামাল দেয়া কঠিন হবে।

এবার মিলন মাথা তোলে আবদুল মালেকের চোখে চোখ রাখে। বলে, মেয়ের জন্য আমাকে বেঁচে থাকার চেষ্টাটুকু করতে হবে।

-তাহলে বলে ফেলেন।

-মেয়ের দিকে তাকিয়েই আমাকে ওইদিন সন্ধ্যায় মাহফুলকে থাপ্পড়টা দিতে হলো। এর পেছনের গল্প তেমন দীর্ঘ নয়, কিন্তু সময়টা আমার জন্য দীর্ঘ এবং পীড়াদায়ক। মাহফুল এই প্রতিষ্ঠানের আগে ছিল একটা বিজ্ঞাপনী সংস্থার সিইও। আমি সেখানে কপিরাইটার হিসেবে জয়েন করি। বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করেই চাকরিটা পেয়ে যাই। আমার প্রেমিকা রত্না থাকতো খুলনায়। চাকরি পেয়ে আমরা বিয়ে করব এটা ঠিক করা ছিল।

বিয়ের পর রত্না ঢাকায় চলে আসে। ছোট্ট একটা বাসা আমাদের, সঙ্গে আমাদের জমানো কথার বাগান। অদ্ভুত ঘোরলাগা একটা জীবন আমরা পেয়ে যাই। এদিকে বছর ঘুরে আসার সঙ্গে আমি বাবা হয়ে গেলাম। এরপর আমাদের ছোট সংসারে খানিক টানাটানি শুরু হলো। বউ বলতে লাগলো, সে চাকরি করবে। এইচএসসি পাশ করে সে যখন ডিগ্রিতে ভর্তি হয়েছে, ততদিনে আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। অফিসে রিসিপশনের একটা পোস্ট খালি হলে বসকে ম্যানেজ করি। তিনি সিভি চাইলেন, ডাকলেন এবং চাকরিটা হয়ে গেল। আমার বউ চোখ ধাঁধানো রূপবতী ছিল। এক মাসের মধ্যে সে রিসিপশন থেকে ক্লায়েন্ট সার্ভিসে চলে এলো। মাহফুল ভাই বললেন, দূর মিয়া এমন স্মার্ট একটা মেয়েকে কেউ ঘরে বসিয়ে রাখে।

ওর চাকরির সুবাদে প্রথমে আমাদের সংসারের আর্থিক টানাটানি কমতে থাকে। তারপর মাস ঘুরতেই বাসায় নতুন ফ্রিজ চলে আসে, সঙ্গে বড় টেলিভিশন, সোফা। ছোট বাসা থেকে আমরা একটা বড় বাসায় উঠে যাই। এর ভেতর দিয়ে অবশ্য আমাদের কথার বাগান হারিয়ে যায়। রত্নার স্মার্টনেসের কাছে আমি প্রতিনিয়ত ভড়কে যেতে থাকি। তার কাজ দেখে আমার মুখ হা হয়ে যায়। এই হা মুখে সে কয়েকটি শব্দ ঢুকিয়ে দেয়, ক্লায়েন্ট সার্ভিসে আমি খুব ভালো করছি। এসব বোনাস, বেতন নয়। আমাদের বাসা ফার্নিচারে, নানা ইলিকট্রিক প্রডাক্টে ঝকঝকে হয়ে উঠে।

রত্নার সব কিছু বদলে যেতে থাকে। বাসায় ফেরার সময়, পোশাক, মুখের ভঙ্গি। একদিন অনেক রাতে বাসায় ফিরলে আমার চোখ চলে যায় রত্নাার গলায়। ওর গলায় একটা দাঁতের বৃত্ত জ্বলজ্বল করছে। এই বৃত্ত আমাকে বোবা করে দেয়। আমি কয়েকদিন কিছুই বলতে পারি না। একদিন অফিসে ওর ডেস্কে গেলে তার কলিগ জানায়, বসের রুমে গেছে। এই কথা শুনে আমি এক দৌড়ে মাহফুল ভাইয়ের রুমের সামনে চলে আসি। কিন্তু তার পিএ জানায় এখন ঢুকা নিষেধ। আমি ‘ও আচ্ছা’ বলে ফিরে আসতে গিয়ে ফিরতে পারি না। আচমকা দরজা খুলে ঘরে ঢুকে যাই। ঢুকে দেখি অপরূপ এক দৃশ্য। মাহফুল ভাই এক নারীর ঊরুতে আঙুল দিয়ে ছবি আঁকছে। কিন্তু তাতে কোন দাগ পড়ছে না। বস্ত্রহীন সুন্দর ঊরুদ্বয় দেখা যাচ্ছে। এমন একটা প্রেমময় দৃশ্য আমাকে আনন্দের বদলে মর্মাহত করলো। করার কারণটা হলো – সেই নারীটি আমার স্ত্রী রত্না। রত্না মাহফুল ভাইয়ের টেবিলের ওপর বসে আছে, আর মাহফুল ভাই তার কাজটুকু করছে।

এ ঘটনার পর আমার চাকরিটা চলে যায়। আমরা আলাদা থাকতে শুরু করি। তবে আমাদের ডিভোর্সটা হয় না। বোধহয় মনে ক্ষীণ একটা আশা জিইয়ে ছিল। মেয়েকে আমার সঙ্গে রাখি, রত্না তাতে সায় দেয়। তারপর অনেক বছর কেটে যায়। এর মধ্যে মাহফুলের কাছ থেকে রত্না ছিটকে যায়। আমি চাকরি জীবন থেকে সরে এসে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করতে থাকি। সঙ্গে মেয়েকে সময় দিই। কিন্তু মেয়ে তার মাকে ভুলতে পারে না। বলে, মা’কে আমার কাছে এনে দাও। মেয়ের জন্য আমাকে যেতে হয় রত্নার কাছে।

রত্না বলে, সে ফিরবে, যদি আমি মাহফুলকে একটা উচিত শিক্ষা দিতে পারি। মাহফুল তাকে নানাভাবে প্রতারণা করেছে। আমার সম্পর্কে ভুল বুঝিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

অনেক ভেবে মনে হয়, এরকম একটা থাপ্পর মাহফুলের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরাবে। উটকো একটা লোকের এমন ঘটনা সে ঘাটাতেও আসবে না। গোফ-দাঁড়িতে আমাকে মাহফুল চিনতে পারে নাই। তবে এরপর যা ঘটলো, সেখানে আমার হাত ছিল না।

আবদুল মালেক গল্পটা শুনে চুপ হয়ে যায়। বলে, আপনার স্ত্রী ফিরেছে।

-না।

-কেন?

-বলেছে, মাহফুলকে থাপ্পর দিতে তো আমি বলি নাই।

তখনই আবদুল মালেকের ফোনটা বেজে ওঠে। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে মিস্টার মাহফুল, এমডি, কিংকং গ্রুপ।

-আপনি পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যান, আমি দরজাটা খুলে দিচ্ছি। তবে খুব দ্রুতই আপনার সঙ্গে আবার দেখা হবে। মেয়েকে যত্নে রাখবেন।

এই বলে আবদুল মালেক কাস্টরির পেছনের দরজাটা খুলে দরজার মুখে দাঁড়িয়ে থাকে।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *