“ওমা কী হবে গো? মাসিমা শুনেছেন?”
“কী শুনব বল তো?”
“সব্বাই বলাবলি করছে তাই ভাবলাম আপনিও শুনেছেন!”
“কী শুনেছি একটু বলবি মমতা?”
“ভিখিরি মেয়ের গলায় রাজপুত্তুরের মালা!”
“সে আবার কী? ভিখিরিটা কে?”
“কে আবার? আমাদের ঝালিয়া আবার কে?”
“ওই গান গাওয়া মেয়েটা?”
“হ্যাঁ গো হ্যাঁ। ওই মেয়ের পেটে যে এত কিছু ছিল কেউ জানত?”
“কী ছিল বল তো? ভাল গান করে বলে জানতাম।”
“ওই গান দিয়েই তো জাদু করছে সবাইকে।”
“কাকে জাদু করল?”
“এ মেয়ে মন্তর জানে গো। গান তো নয় নেশা! নেশা ধরিয়ে দেয় সবাইকে। তলে তলে একটা প্রেমও করে ফেলেছে।”
“প্রেমও মানেটা কী?”
“ভালবাসা বাসি গো।”
“সেটা বুঝেছি। আর কী করেছে?”
“ও মা! গৌরদার বাড়িতে থাকত তো।”
“তাতে কী হয়েছে রে মমতা? গৌরকিশোর ওকে আশ্রয় দিয়েছিল।”
“এমনি এমনি কেউ আশ্রয় দেয় মাসিমা?”
“তোদের মনগুলোই নর্দমা হয়ে গেছে। ছিঃ মমতা।”
“অমন বোলো না। শুনেছি বলেই বলেছি।”
“কে বলে তোকে এসব কথা?”
“দুলালদা বলল। নিজে চোখে দেখেছে।”
“কী দেখেছে বল তো?”
“ওসব বলা যায়?”
“না না তুই বল। কী দেখেছে শুনি? মেয়েটাকে আশ্রয় দিয়ে ক্লাসিক্যাল মিউজিকে তালিম দিল। কত ভাল গায় এখন। ফাংশনও করে। কী দেখেছে দুলাল? নিজে তো দু’পাত্তর চড়িয়ে রোগা বৌটাকে পেটায়।”
“ও মা! সোয়ামি স্ত্রীর ঝগড়া তো হবেই মাসিমা। দুলালদা’র কী স্বার্থ আছে বলুন? মাছ দিতে গিয়ে নাকি ডাকাডাকি করে কাউকে পায়নি। পাশ দিয়ে ঘুরে গিয়ে জানলার পর্দা সরাতেই দেখে এই সব কাণ্ড!”
“দুলাল এখন লোকের বাড়িতে উঁকি দিচ্ছে?”
“না গো মাসিমা। রোজই তো মাছ দেয় গৌরদাকে। দরজা খুলছিল না বলে জানলা দিয়ে উঁকি দিয়েছে।”
“গোরকিশোরের বৌ আছে। ছোট্ট একটা মেয়ে আছে। যা মুখে আসবে তাই বলবি মমতা?”
“বৌদি তো বাপের বাড়ি গেছল গো। মেয়ের বয়সী তো কী হয়েছে! মেয়ে তো নয়। যা দিনকাল পড়েছে! কাগজে তো দেখি বুড়ো বুড়ো লোকেরা পাঁচ-দশ বছরের বাচ্চা মেয়েদেরও ছাড়ে না।”
“আমি জানি না তুই কাদের কথা বলছিস! গৌরকিশোরকে আমি চিনি। পাশের বাড়ির পাপিয়াকেও গান শিখিয়েছে। গান-পাগল মানুষ। গান নিয়েই তো আছে।”
“এ সব দোষ শিল্পীদেরই বেশি হয় গো দিদি।”
“কই ঝালিয়া কিছু বলেনি তো কাউকে?”
“ও আবার কী বলবে! পায়ের তলার মাটিটুকু সরে যাবে না?”
“তাহলে ওর সম্মতি ছিল!”
“মেনে তো নিতেই হবে। আশ্রয়দাতা বলে কতা!”
“মেয়েটা তো বলছিস প্রেমও করত! এসব সম্পর্ক লুকিয়ে কেউ প্রেম করে?”
“সেটাই তো বলছিলাম। ব্যবসায়ীর ছেলে তুলেছে। ঝালিয়ার কপালে শিকে ছিঁড়েছে। মা-বাপের তো ঠিক নেই। রাস্তায় থাকত। এবার ব্যবসায়ী বাড়ির বৌ হবে। ওর গান শুনেই নাকি প্রেমে পড়ে গেছে। সামনের মাসে বিয়ে।”
“এ তো দারুণ খবর রে মমতা!”
“ছাই খবর! ছলা-কলায় ভুলিয়ে সবাইকে জাদু করছে। দু’দিন বাদে স্বরূপ ধরবে! গৌরদা’র সঙ্গে লটর পটরের কথা জানতে পারলে কী হবে বলো তো?”
“খবরদার ওসব খবর ছড়াবি না। দুলালটা এক নম্বর বজ্জাত। ওর পচা মাছ নিয়ে কেউ কিছু বললেই ও তার বদনাম করে। ওকে আমার চেনা আছে।”
“না গো মাসিমা। যা রটে তার কিছুটা তো ঘটে।”
কোত্থেকে একটা মেয়ে এসেছে বেতালপুরায়। মোড়ের মাথায় বসে গান গায়। মেয়েটা গান গাইলে রাস্তার কুকুরও নাকি চুপ করে শোনে। কোথায় থাকে? কে খেতে দেয়? কে ওকে গান শিখিয়েছে? এই সব প্রশ্নের উত্তর কারুর কাছে নেই। মেয়েটা নিজেও জানে না ও কোত্থেকে এল। ঘর-বাড়ি বাবা-মা ব্যাপারগুলো ওর মাথায় নেই। অনেকে বলে, ওর মাথায় ছিট আছে। বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে ভুলেই গেছে বাড়ি কোথায়। বারো তেরো বছরের একটা মেয়ে যখন চোখ বুজে গান করে আশেপাশে ভিড় জমাটা স্বাভাবিক। ছেঁড়া ফ্রক পরা মেয়েটাকে ভিখিরি মনেই হতে পারত। কিন্তু হয় না। সুর-তালের একটা অন্তর্নিহিত আভিজাত্য আছে। গণিতের অসীমের মতো। যেন কেউ ছুঁতে পারে না কিন্তু খুব কাছাকাছি যেতে পারে। তবু কাছে গেলেই তাকে আরও দূরে মনে হয়। এই মেয়েটাও তেমনি। ধুলো ওড়া রাস্তার ঠিক ধারে লক্ষীনারায়ণ ভাণ্ডারের দালানে বসে শ্রেয়া ঘোষালের ‘ইয়ে ইশ্ক হায়’ গান গাওয়া মেয়েটা যেন ভিখিরি হয়েও ঠিক ভিখিরি নয়। পয়সা ছুড়তে গিয়েও সবাই ঠিক ছুড়তে পারে না। কাছে গিয়ে বলে, “নাম কী রে তোর? কী করে শিখলি রে? কিছু খেয়েছিস?”
ঝালিয়া দু’দিকে ঘাড় নেড়ে বলে, “না”
“কিছু খাবি?”
মেয়েটা বলে, “সন্ধ্যেবেলায় খেতে পাবো।”
ঠিকই বলে মেয়েটা। সন্ধ্যেবেলায় ওখানেই তো তেলেভাজার দোকান দেয় মানিক আর মানিকের বৌ। লক্ষীনারায়ণ ভাণ্ডারের এক ঠোঙা মুড়িতে দুটো আলুর চপ মিশিয়ে ওকে খেতে দেয়। মানিকের বৌ শান্তা ওকে ঝালিয়া নামে ডাকে। ঝালিয়া মুদি দোকানের দালানেই শুতো। শান্তা এখন দয়া করে ওদের ঝুপড়িতে নিয়ে যায়। কেউ বলে ওদের ছেলেমেয়ে নেই তাই। কেউ বলে ওরা সেয়ানা। রাতে একটু ভাত খেতে দিয়ে ঝালিয়াকে দিয়ে দোকানের বাসন মাজায়। ঝালিয়া সারা সন্ধ্যে মানিকের চপের দোকানে বসে গান গেয়ে যায়। কখনও ধরছে লতা মঙ্গেশকারের ‘বাঁহো মে চলে আও’, কখনও আশা ভোঁসলের, ‘ইন আঁখো কি মস্তি কে’। ভিড় উপচে পড়ে। আর তেমনি ওড়ে আলুর চপ, বেগুনি। নিত্যানন্দ সুইটসের সিঙ্গাড়া নাকি আর বিক্রি হচ্ছে না। সবাই ঝালিয়ার সুর আর তেলেভাজায় ডুবে গেছে। গৌরকিশোর কিন্তু সন্ধ্যেবেলায় ব্যস্ত থাকে। তিনচারটে গানের টিউশন থাকে। শুক্কুরবার আবার বাড়িতেই একটা ক্লাস খুলে ফেলেছে। রিয়ালিটি শো’র বাজার চলছে। ছাত্র ছাত্রী কম হয় না। কয়েকটা স্টুডেন্ট তো বেশ প্রমিসিং। সারেগামায় চান্স পেতে পারে। তাহলে আর গৌরকিশোরকে পায় কে? একটা পার্মানেন্ট কোচিং সেন্টার খুলে ফেলবে। আর একটু নাম ডাক হলে একটা রেকর্ডিং ষ্টুডিও। আগে গৌরকিশোর অনেক ফাংশন করত। রাগপ্রধান, কালোয়াতি, শ্যামাসঙ্গীত, বৈঠকি , টপ্পা, পুরাতনী- সব রকমের স্টক ছিল। এখন আর সময়ই হয় না। লোকে গুজব রটায়, আসল কথা নাকি পপ-র্যাপের যুগে গৌরকিশোর স্টেজ পাচ্ছে না। তাতে গৌরকিশোরের কিছু এসে যায় না। শ্রোতার বদলে ছাত্র জুটলে মন্দ কী? সেদিন মল্লিকাদের বাড়ি যাওয়া হলো না। সাইকেলটা বিগড়ে গেল। হেঁটে অনেকটা পথ। স্ট্যান্ডে আবার রিক্সাও নেই। রাত প্রায় নটা। মাটিপাড়ার গানের ক্লাসটা শেষ করে মল্লিকাদের বাড়িতে যায় গৌরকিশোর। চপের দোকানে বেশ ভিড়। কে একটা গান করছে শুনে কানটা খাড়া হয়ে গেল। শ্রেয়া ঘোষালের, ‘তেরি ঔর’ শুনে ওদিকেই কৌতূহলবশত হেঁটে গেল। ঝালিয়ার সঙ্গে অনেকে আবার গলা মেলানোর চেষ্টা করছে। গানের শিক্ষক গৌরকিশোরকে অনেকেই চেনে। একটু সম্ভ্রমের সঙ্গে জায়গা ছেড়ে দিল কয়েক জন। একজন আবার বলল, “কী গান করে গো গৌরদা! তোমার হাতে পড়লে কী হবে ভাবো?”
তেরি ঔর শেষ হতেই গৌরকিশোর বলল, “বাংলা গান জানিস?”
ঝালিয়া এক পলক তাকিয়ে হাতের বেগুনিতে কামড় বসালো, ‘আজ আর গাইবনি।’
গৌরকিশোর পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করে বললেন, “একটা বাংলা গান গা দেখি।”
শান্তা ফুলুরির হাতা নাড়িয়ে মুখ ঝামটে বলে উঠল, “গা না ঝালি, গৌরদাকে একটা গান শুনিয়ে দে। মস্ত বড় গানের টিচার রে!”
ঝালিয়া ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে গৌরকিশোরকে দেখল। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে গেয়ে উঠল, “ওওও ওও ও, দীপ জ্বেলে ওই তারা/ একী কথা বলে যায়?/দূর হতে দূরে কেন আকাশ চলে যায়/কেন যে? ওরা আমাকে?/ডাকে শুধু ডাকে।” দুটো অটো হর্ন বাজিয়ে চলে গেল। একটা বাসও এসে দাঁড়িয়েছিল। কয়েকটা প্যাসেঞ্জার নামিয়ে চলে চলে গেল। কেউ খেয়ালও করেনি। ঝালিয়া যেন আবার হারিয়ে গেছে। বহু দূর থেকে একটা সুর শুধু ভেসে আসছে। কখন যে গান শেষ হয়েছে গৌরকিশোর খেয়ালই করেনি। সবাই গান শুনে হাততালি দিয়ে চলে গেছে। শান্তা বাসন গুছোচ্ছে। মানিক উনোনে জল ঢালছে। গৌরকিশোর দাঁড়িয়ে আছে। হাতে মানি ব্যাগ। শান্তা তক্কে তক্কে আছে। নোট দিলে ওই নেবে। ঝালিয়ার জন্য তেলেভাজাও বিক্রি হচ্ছে আবার একটু আধটু টাকাও আসছে। নিজে থেকেই লোকে পাঁচ দশ টাকার নোট ঝালিয়ার হাতে গুঁজে দেয়। গৌরকিশোর মানি ব্যাগ ঢুকিয়ে ফেলল। মানিকও দেখছিল। একটু হতাশই হলো।
হয়ত তাড়ানোর জন্যই বলে উঠল, “শেষ খোলের বেগুনিগুলো নিয়ে যান গৌরদা। আজ ডাল-ভাত আর শান্তার বেগুনি খেয়ে দেখুন!”
গৌরকিশোর শুধু বলল, “ওর নাম কী?”
“ঝালিয়া গৌরদা! জানতাম আপনার ভাল লাগবে। আপনি গুণীজন। ঠিক চিনবেন ওকে। বেগুনিগুলো প্যাক করে দি?”
গৌরকিশোর শুধু বলল, “ওকে আমি নিয়ে যাবো।”
শান্তা’র হাত থেকে বেসনমাখা ডেকচিটা পড়ে গেল, “তা হয় না গৌরদা। ও আমাদের মেয়ের মতো।”
গৌরকিশোর শুধু শান্ত গলায় বলল, “তোর বৌদির সঙ্গে কথা বলি। কাল এসে নিয়ে যাব ওকে। ও আমাদের বাড়িতে থাকবে।”
“গৌরদা বুঝতে পারছেন ও আমাদের জান…।”
“সব বুঝতে পারছি। আমি যা পারি ক্ষতিপূরণ দেবো। মেয়েটার ক্ষতি কোরো না তোমরা।”
“আপনি দিনের বেলা শেখান না গৌরদা?”
“না ও আমার কাছে থাকবে। ওকে অনেক কিছু শিখতে হবে।”, বলে হন হন করে চলে গিয়েছিল গৌরকিশোর।
মানিক আর শান্তা সে রাত জেগে কাটিয়েছে। শেষ পর্যন্ত মানিকই বুঝিয়েছে,
“দেখ গুণ্ডা দিয়ে ভয় দেখালে গৌরদা ঝামেলা করবে না। কিন্তু পুলিশ জানলে?”
শান্তা চোখ পাকিয়ে বলে, “থানা পুলিশ কে করছে?”
“কেউ নালিশ করতেই পারে।”
“পুলিশ আসলি মা-বাপকে খুঁজে বার করুকগে!”
“আর যদি খুঁজে পায়? আমরা যে হাজতে যাব।”
“আমরা আশ্রয় দিচ্ছি, তার বেলা?”
“আশ্রয় না ছাই! বিনি পয়সায় খাটাচ্ছিস! সব কি ঘাসে মুখ দে চলে নাকি রে মাগি!”
“তুই একটা ডরপোক। দিয়ে দে আমার ঝালিকে।”
“ও কত বড় ট্যালেন্ট জানিস! যদি ফিলিমে গান গায় আমাদের দেখবে না?”
“তুই ওই আশায় থাক। একবার চানস পেলে আমাদের আর চিনবে সে?”
“তা বলে কি চিরকাল চপের কীর্তন করাবি?”
“দুটো খদ্দের হচ্ছে! ব্যাটাচ্ছেলের সইবে কেন?”
“ওই সুর ঝুপড়িতে মানায় না। ও ষ্টার হবে। ছেড়ে দে ওকে।”
বছর পাঁচেক কেটে গেছে। গান-পাগল গৌরকিশোর পূর্ণিমাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঝালিয়াকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে। পূর্ণিমা খুব ঠাণ্ডা স্বভাবের। ওদের বিয়ে একটু দেরিতেই হয়েছিল। গৌরকিশোরের কাছে গান শিখতে গিয়ে প্রেম। বয়সে অনেকটাই ছোট পূর্ণিমা। এখনও মাঝে মাঝে গৌরদা বলে ফেলে। তবু রাস্তার একটা মেয়েকে ঘরে এনে তোলার কথা বলতেই সে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিল।
“ছেলেমেয়ে না থাকলে এক কথা ছিল। সাত বছরের একটা মেয়ে আছে তোমার! সারাটা দিন তো গান নিয়ে থাকো। মেয়েটাকেই একটু সময় দিতে পারো না।”
“মেয়েটার দারুণ ট্যালেন্ট পূর্ণিমা। ও ভাল ঘরে জন্মালে আজ প্লে- ব্যাক সিঙ্গার হয়ে যেত।”
“আর তোমার মেয়েটা?”
“অন্তরা তো রেওয়াজই করে না। তাছাড়া…”
“ওর ট্যালেন্ট নেই, তাই তো?”
“সবার গলা একরকম নয়, পূর্ণিমা।”
“ছাড়ো, তুমি রাস্তা থেকে মেয়ে ধরে ধরে প্লে-ব্যাক সিঙ্গার বানাও। অন্তরা আর গান গাইবে না।”
“আহা, আমি কি তাই বলেছি? ঘরের কাজেও তো সাহায্য করবে। সারাক্ষণ কি আর রেওয়াজ করবে?”
“ওসব মেয়েকে একবার প্রশ্রয় দিলে দেখো কী হয়! ঘরে এলেই সাপের পাঁচ পা দেখবে।”
“একটা মেয়েকে যদি শিখিয়ে ষ্টার বানাতে পারি আমারও তো নাম হবে। পয়সাও আসতে পারে। শ্রেয়া ঘোষাল একটা শো’তে যা পয়সা চায় তা আমি তো সারা জীবনেও রোজগার করতে পারব না।”
“শ্রেয়া ঘোষাল তোমার ঘরের কাজ করবে?”
“আহা একদিনে তো আর সিঙ্গার হচ্ছে না! পড়াশোনা করে টাকা ধ্বংস করবে না। একটু গান করবে আর ঘরের কাজ করবে।”
“চুরি চামারি করলে কিন্তু আমি লাথি মেরে তাড়াব।”
“ও সব নিয়ে ভেবোই না। চুরি করলে পুলিশে দেবো।”
ঝালিয়া সহজেই ঘরের কাজ শিখে গেল। সত্যি কথা বলতে কী পূর্ণিমার এখন ভালই লাগে মেয়েটাকে। কিন্তু সমস্যাটা হয়ে গেল গান নিয়ে। খোলা আকাশের নিচে বাস-অটোরিক্সার ক্ল্যারিওনেট আর ঝংকারের সঙ্গেই যেন ওর গলাটা মানায়। ঘরে বসে হারমোনিয়াম নিয়ে রেওয়াজ করতে গিয়ে ওর হাঁফ ধরে গেল। হিন্দুস্তানি রাগ শিখতে গিয়ে আর আধুনিক গান গাওয়া হয় না। গানের স্কেল বুঝতে গিয়ে চোখে জল চলে আসে। তবু গৌরকিশোরের কথা শুনে কাকভোরে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে। পূর্ণিমা ঘুম থেকে ওঠার আগেই ওর গলা সাধা হয়ে যায়। চট জলদি দু’কাপ চাও বানিয়ে ফেলে। গৌরকিশোর প্রথম প্রথম আপত্তি করত। পূর্ণিমা মানিয়ে নিয়েছে। এটুকু সেবা নিতে ওর ভালই লাগে। মাঝে মাঝে দয়া হলে বলে,
“হ্যাঁ রে মা-বাবাকে মনে পড়ে?”
“না বৌদি।”
“ভাই-বোন কেউ ছিল?”
“জানি না।”
“গান শিখলি কী করে?”
“কত টিভি চলে চারিদিকে। শুনে নিই। একটা ছেলে মোবাইলে শোনাতো। সারেগামা দেখেছি।”
“শুনে শুনে এত ভাল গান গাস?”
“ভাল মন্দ জানি নে। গাইতে ভাল্লাগে।”
গৌরকিশোর এসব সহ্য করতে পারে না। বলে, “আড্ডা না মেরে প্র্যাকটিস কর। ক্লাসিক্যাল ট্রেনিং ছাড়া কিচ্ছু করতে পারবি না। আজকে দাদরাটা তুলবি। আমি এসে শুনব।”
গৌরকিশোর কর্পোরেশনে সামান্য একটা চাকরি করে। বেরিয়ে গেলেই ঝালিয়া একটু ফুরসত পায়। পূর্ণিমাও সিরিয়াল দেখে। মাঝে মাঝে ঝালিয়া হঠাৎ বেরিয়ে পড়ে। মোড়ের মাথায় গিয়ে লক্ষীনারায়ণ ভাণ্ডারের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মানিক আর শান্তার উনোনের ছাই পড়ে থাকে। ওদের নাকি একটু পুঁজি হয়েছে। মানিক আজকাল সবজি নিয়ে বসে। তবে সন্ধ্যেবেলা দুজনে মিলে তেলেভাজার দোকানটা চালায়। বেআইনি দোকান কতদিন চলবে কে জানে। ঝালিয়া অত বোঝে না। গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে দুটো বাদাম কিনে খায়। গৌরকিশোর মাঝে মাঝে দু’পয়সা দেয়। ওই ঘুরতে যাওয়াই কাল হলো। হঠাৎ একদিন একটা ছেলে এসে জোর করে গান গাইয়ে মোবাইলে রেকর্ড করে নিয়ে গেল। বেশ দেখতে ছেলেটা। গলায় সোনার চেন। হাতে বালা। ঝকঝকে গাড়ি থেকে নেমে ওকে গান গাইতে বলল। ঝালিয়া ‘না’ বলতে পারেনি। দেওয়ালেরও কান আছে। রাস্তা-ঘাট তো কানাঘুষোর স্বর্গ। কথাটা একদিন গৌরকিশোরের কানেও পৌঁছল।
“তোকে বলেছিলাম যে রাস্তাঘাটে আর গান করবি না?”
“অমন করে বলল, তাই….।”
“টাকা দিয়েছে? তোর খুব লোভ, না? তোকে ওই আস্তাকুঁড়েতেই মানায়।”
“টাকা দেয় নি তো! মোবাইলে তুলেছে।”
“ভিডিও?”
“জানিনে।”
গৌরকিশোর রেগে পূর্ণিমাকে বলল, “বাইরে গেলে ঝালির খাওয়া দাওয়া বন্ধ। বাথরুমে বন্ধ করে রেখে দেবে। ভেবেছেটা কী? ভিডিও তুলে ছড়ালেই ও সিঙ্গার হবে?”
ঝালিয়া কিছুই বোঝে না। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে না খেয়ে শুয়ে পড়ল। কাজের মেয়েটা কয়েকদিন আসছে না। কাল সকালে উঠে আগে বাসন মাজা তারপর গান।
তবু ঝালিয়া ছাদে উঠে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই মোবাইলের ছেলেটা বাইক নিয়ে সামনে দিয়ে যায়। ওটাই সিগন্যাল। ঝালিয়া জানে বাইক নিয়ে এদিক ওদিক করবে। চোখ চোখ পড়লে কিসি ছুড়ে দেবে। লোকেও তো বলে, সেই আগের ঝালিয়া আর নেই। ছেঁড়া ফ্রক পড়া কালিঝুলি মাখা ঝালিয়ার এখন বেশ চকচকে একটা চেহারা হয়েছে। পূর্ণিমা ওকে সাবধান করে দিয়েছে, “ডাগরডোগর হয়েছিস! সামলে চলিস!” মাঝে মাঝে দোকান থেকে জিনিস আনতে গেলে ছেলেটার সঙ্গে দেখা হয়। কাছে ধারেই নাকি থাকে। ব্যবসায়ীর ছেলে। তবে গৌরকিশোরের ভয়টা মিথ্যে হয়ে গেছে। ভিডিও ছড়ায়নি। ঝালিয়ার পাশ দিয়ে বাইক নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ছেলেটা বলে, “রোজ শুনি। আর একটা ভিডিও চাই জান।”
ঝালিয়া ভয়ে কিছু বলে না। ছেলেটা কত কী বলে যায়। বিয়ে করতে চায়। বিয়ের পর মুম্বই নিয়ে যাবে। কোলকাতার ষ্টুডিওতে কথা বলেছে। একদিন রেকর্ডিং রুমে সিটিং দিতে হবে।
গৌরকিশোর কানাঘুষোয় শুনেছে কিন্তু কাল ব্যাপারটা নিজে চোখে দেখেছে। পূর্ণিমা অন্তরাকে নিয়ে বাপের বাড়ি গেছে। ঝালিয়া হয়তো রান্না করতে গিয়ে আদা রসুন কিনতে মোড়ের মাথায় এসেছিল। ঝালিয়ার পাশে পাশে বাইক নিয়ে আস্তে আস্তে চলেছে ছেলেটা। ঠিক পেছনেই সাইকেল নিয়ে গৌরকিশোর। ও ইচ্ছে করেই সিগারেট খেয়ে একটু পেছিয়ে পড়েছে। বাড়ি ঢুকেও ঝালিয়াকে কিছু বলেনি। ঝালিয়ার রান্না করা ডিমের ঝোল পড়েই ছিল। খিদে নেই বলে কিছু না খেয়ে শুয়ে পড়েছে। ঝালিয়াও খায়নি। সকালে পড়ার ঘরটায় ঝালিয়া রেওয়াজ করে। অন্যদিনও অন্তরা ঘুম থেকে ওঠার আগেই ওর গলা সাধা হয়ে যায়। ইলেট্রনিক তানপুরাটা তখনও বাজছে। ওটা নতুন কিনে দিয়েছে গৌরকিশোর। ঘরে ঢুকে চুলের মুঠি ধরে মাদুর থেকে টেনে তুলল ঝালিয়াকে। ঠাস ঠাস করে ক’টা চড় মেরেছিল নিজেও জানে না। ঝালিয়ার ব্যথা লাগেনি। চোখ দিয়ে জলও পড়েনি। ভেঙে পড়া একটা লতার মতো গৌরদার পায়ে পড়তে গিয়েছিল। গৌরকিশোরই ওকে টেনে তুলল,
“কতদিন ধরে এসব চলছে? হ্যাঁ? পূর্ণিমাই ঠিক বলেছিল। তোকে ওই মানিকের ঝুপড়িতেই মানায়।”
ঝালিয়া নির্বাক দাঁড়িয়ে। ওই ছেলেটাকে তো ভাল করে দেখেইনি। তবু কেন ভাল লাগে ওর? তবে ওর মুখটাও মনে পড়ছে না। গৌরদার মতো একটা লোককে আবছা মনে পড়ছে। একজন মহিলা ওকে মেরে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। আর লোকটা ফ্যালফ্যাল করে দেখছে। ওর মা নয়। মা তো মারা গেছে। তবে ওই লোকটাই কি ওর বাবা ছিল? ওকে কোনও দিন মারেনি লোকটা। ওই মহিলাই শুধু মারত। গৌরদা তো ওর বাবার মতোই। এত মারছে কেন গৌরদা? একটু আগেই গাইছিল, মুঝে নেহি যানা বাবুল কো ছোড়কে। রাগ মাড়োয়ায় বাঁধা। এখনও বুকের ভেতর বাজছে। বাবাকে কখনও জড়িয়ে ধরেছিল ঝালিয়া? মনে পড়ে না! গৌরদাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল সে। এবার দু’চোখে বান আসল। গৌরদা’র লোমশ বুক ভিজে যাচ্ছে।
“আমাকে ছেড়ে দাও গৌরদা। আমি আর শিখব নি।”
গৌরকিশোরের মাথায় খুন চেপেছে। ছুড়ে ফেলল ঝালিয়াকে। ঝালিয়ার শরীরটা গিয়ে পড়ল ছোট্ট খাটটার ওপর। মাথাটা দেয়ালে ঠুকে গেছে। গৌরকিশোরের হুঁশ নেই। নিচু হয়ে ঝালিয়ার শরীরটাকে ঝাঁকিয়ে বলে চলেছে,
“তোকে কোথায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম জানিস? থাক তুই আস্তাকুঁড়েতে। বড়লোকের ছেলে দু’দিন ফষ্টিনষ্টি করবি। তারপর ওই আস্তাকুঁড়েতেই তোকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে।”
আর ঠিক তখনই “মাছ নেবে গৌরদা? ও গৌরদা?” বলে চেঁচিয়ে হদ্দ হয়ে গেছিল দুলাল মাছওয়ালা। গৌরকিশোর শুনতেই পায়নি। সে না শুনলে কী হবে? সারা বেতালপুরা শুনে গেল। রসাল গল্পে আঠা থাকে বটে কিন্তু জলের মতো তা ছড়িয়েও পড়ে। কাজের মেয়ে মমতার কানেও পৌঁছে গেল কথাটা। এমনকি মিঠাপুরে পূর্ণিমার বাপের বাড়িতেও। এর পর ব্যবসায়ী অঘোরচাঁদের ছেলে গোপী যখন রেনোঁ গাড়ি থেকে নেমে গৌরকিশোরকে প্রণাম করে ঝালিয়াকে বিয়ে করতে চাইল, গৌরকিশোরের মনে হলো – আপদ বিদেয় হোক। লাভ গোপীরই হলো। ভেবেছিল গুণ্ডা নিয়ে এসে ঝালিয়াকে তুলে নিয়ে বিয়ে করবে। ব্যাপারটা যে এত সহজ হবে ভাবতেই পারেনি। তবে গোপী কিন্তু কথা রাখতে পারেনি। ওদের জামা-কাপড়ের ব্যবসা। নতুন একটা দোকান ওকে সামলাতে হচ্ছে। ঝালিয়ার গানের রেকর্ডিংও হয়নি ভিডিওও ছড়ায়নি। ওদের একটা মেয়ে হয়েছে। ঝালিয়াই নাম রেখেছে গৌরী। একটু বড় হোক না! কোনও ওস্তাদের কাছে পাঠিয়ে দেবে। ক্লাসিকালটা শেখাতে হবে। ঝালিয়াও মাঝে মাঝে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে। মাড়োয়ায় মুচড়ে ওঠে গলা – মুঝে নেহি যানা বাবুল কো ছোড়কে। টিউশনে যেতে যেতে গৌরকিশোরের কানে যেন ভেসে আসে – দীপ জ্বেলে ওই তারা/ একী কথা বলে যায়?/দূর হতে দূরে কেন আকাশ চলে যায়/কেন যে? ওরা আমাকে?/ডাকে শুধু ডাকে। ভুলও হতে পারে। বাস আর অটোরিক্সার আওয়াজে আবার গান শোনা যায় নাকি? সেদিন গৌরকিশোরের এক ছাত্ৰী বলল, “গৌরদা একজন ভিখিরিকে মুম্বই নিয়ে গেছে। পুরো লতা’র গলা বসানো। সে এখন টিভিতে গাইছে।”
ও কথায় কান না দিয়ে গৌরকিশোর যেন আপন মনেই বলল, “সহজে সুর লাগে না বেতালপুরায়। লাগলেও তাকে ধরে রাখা শক্ত। মিল যায়ে তো পাকড়কে রাখো। ছোড়না নেহি। মুখড়াটা আবার গাও।”
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে এখানে ক্লিক করুন