জীবনানন্দের খোঁজে
(জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত)
এক
বনপথের প্রান্তে যার সঙ্গে দেখা সে যদি আবারও চলে যায় ঐ বনপথের গভীরেই, কারো কিছুর বলার থাকে না। আমারও ছিল না। শুধু ভাবনা, বরং বলা যাক, সামান্য অস্বস্তি – বনপথে দিশা হারাবেন না তো তিনি ?
এই সেই বনপথ নয়, বনদেবী এখানে পথ দেখায় না, খেলাও করে না। দেখা যাবে না বনমাঝে কোন কুমারী তাপসী, বনলতা যার সখী। অ্যাশফল্ট-কংক্রিটের চার লেনের রাস্তা – রাজ্য সড়ক ৪৯ থেকে বেরিয়ে গেছে – রাজ্যসড়ক ৮৪। সোজা প্রবেশ তার সংরক্ষিত জাতীয় অরণ্যে। চলে গেছে যেন অন্তহীন, পশ্চিমে। অরণ্যের শেষে ভিন্ন জনপদ, ভিন্ন রাজ্য পেরিয়ে আবার-ও হারিয়ে যায় সে ভিন্ন জাতীয় অরণ্যের মধ্যেই। এই প্রান্তেও জনপদ আর সেখানে কেউ নেমে গেলে চিরকালের জন্যে হারিয়ে যাবে, এমন নয়।
আমার কর্মস্থল থেকে একশো মাইল আসবার পরে মিসিসিপি নদী। সেটি পার হলে ভিক্স্বার্গ শহর, তার-ও সত্তর মাইল পরে মিসিসিপি রাজ্যের রাজধানী জ্যাক্সন। সেখানে পৌঁছে আন্তরাজ্য সড়ক ২০ থেকে নেমে সত্তর মাইল গেলে ছোট শহর হ্যাটিস্বার্গ। হ্যাটিস্বার্গের শুরুতেই ঐ বনপথ, রাজ্যসড়ক ৮৪, ওইখানেই তাকে নামিয়েছিলাম।
বনপথে কোন অত্যাচারী প্রাণীর চিহ্ন কখনো দেখা যায় না। সারি সারি ওক কি পাইন রাস্তার দু’পাশ থেকে এসে রাত্রির চাঁদোয়া তৈরি করে। পাতার সামান্য ফাঁক দিয়ে পথে গড়িয়ে পড়ে সহস্র রূপালী জ্যোৎস্নাচূর্ণ পূর্ণিমার। সেই পথ পার হয়ে দৃশ্যে বর্ণময় এক শহরে ফুটে থাকে “অ্যাজালিয়া।” সারা শহরেই। ঐ শহরেই বাস আমার। তাই এই অরণ্যপথে যাতায়াত আমার প্রতি সপ্তাহশেষে। শেষ রৌদ্রের কালে যাত্রা শুরু দুই প্রান্তের গন্তব্য থেকেই। অরণ্যের অন্ধকার কি ম্লান চন্দ্রালোক ঘরে ফেরার আগ্রহে কি নিরানন্দ কর্মস্থলে ফেরার বিষন্নতায় চোখে পড়ে না, পড়েছিল সেই রাত্রিতে।
দুই
হ্যাটিসবার্গ শহরে ঢোকবার মুখে ঐ বনপথ চলে গেছে পশ্চিমে, মন্টিচেলো –ব্রুকহ্যাভেন শহরের দিকে। হোমোচিটো জাতীয় অরণ্যের প্রান্তবর্তী শহর। হ্যাটিসবার্গে একটি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, আছে দোকানপাট , স্কুলকলেজ, খেলার স্টেডিয়াম – সব-ই। তাই চার ঘন্টা রাস্তা পার হবার পরে ‘আর মাত্র দু’ঘন্টা’- এই স্বস্তিচিন্তায় পথের পাশে এই কফির দোকানে বসি আমি। এক কাপ গরম কফি, কিছু আহার্য, মূলত বিশ্রাম। আর ঐ বিশ্রামকালেই আমি তাঁকে দেখেছিলাম। গাত্রবর্ণ, চেহারায় স্বজন বলে চিনতে মোটে ভুল হয় না। বিস্মিত হই কিছু – এই ঘন অরণ্যের রাজ্যে, অজানা শহরে, নিজভূমের মানুষ ! কে তিনি ?
আমিই যাই তাঁর কাছে উঠে। নিজ নাম বলি। জিজ্ঞাসা করি তিনি কি আমারই মতন। পরম আগ্রহে আমার হাত ধরেন তিনি। সানন্দে সম্মতি জানান আমার কথায়। এই সময়ে, এইখানে আমার মতো কারো সঙ্গে দেখা হওয়ায় তিনি নিজেও অভিভূত স্পষ্ট বুঝি। আমার গন্তব্য শহরের কথা বলি তাঁকে, বলি প্রতি সপ্তাহান্তে কেন এই পথে আমার যাতায়াত। তাঁর কথাও শুনি – দক্ষিণ অঞ্চলের নানা শহরে ঘুরে বিশেষ কোনো পণ্যের প্রচারই তাঁর কাজ। আজ এই শহরে, কাল ভিন্ন কোথাও। এই শহরেই একটি ঠিকানা আছে। যদিও স্থায়ী বাসস্থান সেটিকে বলা যায় না।
নানা কথায় সময় কাটে। একাকী বিদেশী – তার কথা বুঝবে কে ? তারই মতন কেউ ছাড়া ? নিজ ঠিকানা দিই, বলি, আমার শহরে গেলে নিশ্চয়ই যেন ওঠেন আমার ঘরে। নিজ স্ত্রী-কন্যার কথাও বলি। প্রতি সপ্তাহান্তে সাড়ে ছ’শো মাইল গাড়ি চালানো ক্লান্তিকর, নিঃসন্দেহে, তবু-ও শুক্রবার রাত্রি থেকে রবিবার দুপুরতক ঘরেই থাকি আমি।
আনন্দের সঙ্গেই বলেন তিনি আমাকে। প্রায় শুক্রবার সন্ধ্যায় এখানে এসে বসেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের একজন ছাত্র আছে। সপ্তাহান্তে সে এই দোকানেই কাজ করে। তার কাছেই কখনো এসে ওঠেন তিনি। সেটিই তাঁর ঠিকানা।
তিন
মিলনায়তনের সামনের দিকেই বসি, মঞ্চের কাছেই। যদি মঞ্চে উঠতে হয় এমন চিন্তা মনে ছিল না, তবুও।
ক্রমে মঞ্চে এসে তাঁরা বসেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নানা কর্মকর্তা, বিভাগীয় প্রধান প্রমুখ। এই কিছুক্ষণ আগে যাঁর সঙ্গে বিভাগীয় দপ্তরে দেখা হয়েছিল, বিভাগীয় প্রধান, তিনিও এসে বসেন মঞ্চে। অন্তত একটি পরিচিত মুখ তো আছে , ভাবি। আজ সকালেই তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখা হলেও টেলিফোনে কথা হয়েছে কয়েকবারই। কয়েক পর্বের সাক্ষাৎকার – টেলিফোনেই; বিভাগীয় প্রধান ও ডীনের সঙ্গে। ভেবেছিলাম, বিশ্ববিধ্যালয়ের ভাইস প্রেসিডেন্টের সঙ্গেও বুঝি কথা বলতে হবে – কিন্তু তার দরকার পড়েনি। তামামী ডিগ্রীর জন্যে থিসিস জমা না দেয়া সত্ত্বেও যে তাঁরা আমাকে অধ্যাপনার কাজটি দিয়েছেন সে কেবল যে বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে ডিগ্রী দেবে তার সুনামের জন্যেই।
শিক্ষাবর্ষ শুরুর প্রথম সভা – নতুন পুরনো সমস্ত শিক্ষকেরই সেখানে উপস্থিত থাকা চাই। এইজন্যেই এতো বড়ো মিলনায়তনের ব্যবস্থা। এই সভার শেষে প্রতিটি বিভাগের নিজস্ব জমায়েত আছে। তারপরে কোন এক সময়ে ডীন বা ভাইস-প্রেসিডেন্টের সঙ্গেও দেখা করে আসা। কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয়েছিলাম কর্মসূচি দেখে। নেহায়েৎ অস্থায়ী সহকারী অধ্যাপকের চাকরীই তো ! তবু-ও বুঝি এই সময়ে, তায় বিদেশী, এমন কাজ পাওয়া বড় সহজ নয়।
নিজ নিজ আসন থেকে দাঁড়িয়ে প্রধানেরা যাঁর যাঁর বিভাগের নতুন শিক্ষকদের পরিচয় করিয়ে দেন। আমাকেও পরিচয় করিয়ে দিলেন বিভাগীয় প্রধান, গর্বের সঙ্গেই, যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করার মুখে আমি সেটির নাম বলে। উঠে দাঁড়াই আমি। সামান্য মাথা নুইয়ে পরিচয় স্বীকার করে নেই। সামান্য গর্ববোধ হয় বৈকি !
বিভাগীয় সভাতেও যাই। পরিচয়, সম্ভাষণ ইত্যাদির শেষে যার যার ক্লাসের সময়সূচি নিয়ে নিতে বলেন বিভাগীয় সহকারীর কাছে থেকে। নিয়মমাফিক দু’একটি ফর্মেও সই করা প্রয়োজন বলে তিনি বেরিয়ে যান। ভিন্ন রাজ্য, ভিন্ন শহর থেকে অনেক পথ পাড়ি দিয়ে এই অচেনা শহরে,অচেনা প্রতিষ্ঠানে আসা। ভেবেছিলাম, তিনি হয়তো আমার খোঁজখবর নিতে চাইবেন, টেলিফোনে অবশ্য তেমন কোন আভাস ছিল না। আন্তঃরাজ্য সড়ক ২০-থেকে বেরিয়ে শহরে ঢোকার মুখে যে সব মোটেল আছে তার-ই একটি বেছে নিতে বলেছিলেন।
কাগজপত্রে সই করে ক্লাসের সময়সূচি হাতে নিয়ে দেখি আমার নামের বানানটি ঠিকমতো লেখা নেই। দরখাস্ত, নিয়োগপ্রাপ্তির চিঠি সবকিছুতেই ঠিক বানানই তো লিখেছিলাম মনে পড়ে। ভাবি, এ এমন কী – নামের বানানই তো !
ক্লাস শুরুর এখনো দু’দিন বাকি। এই দু’দিন দেয়া হয় শিক্ষকদের প্রস্তুত হবার জন্য। আমি ভাবি প্রস্তুতি তো ঘরে বসেও নেয়া যায় ! উঠবো কি সাড়েছ’শো মাইলের রাস্তায় ! পরে ভাবি, মোটেলের ঘরে সপ্তাহভর থাকা যাবে না। বাসস্থান একটি চাই। বাধ্য হয়েই অচেনা শহরের সস্তা মোটেলের ঘরে ফিরে যাই।
বিভাগীয় প্রধান বলেছিলেন ক্যাম্পাসের আশেপাশেই আছে বিস্তর থাকবার জায়গা। খোঁজ নিয়ে দেখি, সব বাসস্থানই ছাত্রদের জন্যে। আমায় যেতে হবে পাশের ছোট শহরটিতে। পাঁচমাইল দূরে। সেখানেও একটি বিশ্ববিদ্যালয় আছে – মূলত কারিগরি শেখানোর জন্যে। নতুন আরও দু’জন শিক্ষকের সঙ্গে পরিচয় হলে সকলে মিলে একটি বাড়ি ভাড়া নেই। সপ্তাহান্তে সাড়ে ছ’শো মাইলের সঙ্গে আর-ও পঞ্চাশ মাইল যোগ হয়।
চার
বনপথের ওপারেও গেছি আমি একবার। সোজা পশ্চিমে। এই অরণ্য পার হয়ে, মন্টিচেলো-ব্রুকহ্যাভেন শহর পার হয়ে, অন্য অরণ্যের বুক বেয়ে, দৃশ্যময় ন্যাচেস ট্রেস পার্কওয়ে ধরে খানিক ওপরে উঠে পোর্ট গিবসন –এর কাছে লরম্যান-এ। লরম্যান অতি ছোট শহর। প্রায় মিসিসিপির ওপরেই।একটি ছোট বিশ্ববিদ্যালয়-ও আছে সেখানে। নানা বাঁকে, নানা খাতে বয়ে যাওয়া মিসিসিপি, ওপারে লুইজিয়ানা রাজ্য। জলজঙ্গলের শতমাইলব্যাপী বনভূমি। অনেক দূরে আলেকজান্দ্রিয়া শহর। ন্যাচেস পার্কওয়ে ধরে আর-ও উত্তরে গেলে পড়বে ভিক্স্বার্গ – পূর্ব দিক থেকে আসা আন্তরাজ্য সড়ক ২০, যে পথ আমাকে নিয়ে যায় কর্মস্থলে।
জলজঙ্গলের ছোট শহর লরম্যান-এ ইউনিভার্সিটি কেন এমন প্রশ্ন মনে আসে। হোক সেটি কৃষি কি কারিগরি বিদ্যা শেখানোর জন্যেই। বিশেষ প্রয়োজনে, বিশেষ জনগোষ্ঠীর জন্যেই এই স্থাপনা, আগেই শুনেছিলাম। লরম্যান-এ গিয়ে আরো ভালো বুঝি। পূর্ব-পরিচিত যার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া, সে এই শহরে আছে অনেক কাল। একসময়ে ছাত্র হয়েই আসা তার এখানে। ছাত্রত্ব একরকম কাটলেও কোথায় যাওয়া জানে না বলে সামান্য দু’একটি কোর্স পড়ানোর কাজ নিয়ে এখনো রয়ে গেছে সেখানেই। ছাত্রাবাসের যে ঘরটিতে থাকে সে সেই ঘরেই অন্য একটি বিছানায় রাত কাটাই। দোকান থেকে খাবার কিনে আনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাপর্ব শেষের ছুটি। ছাত্র-শিক্ষক কাউকেই দেখা যায় না। ছাত্রাবাসটিও জীর্ণ। জনশূন্য হওয়ায় সেটি কেবল বিষণ্ণই নয়, পরিত্যক্ত মনে হয় যেন। তিন দিকে প্রায় একশো মাইল গাড়ি চালিয়ে পরিচিতজনকে দেখতে না আসাই ভালো ছিল মনে হয়।
লরম্যান যাওয়ার পথে হোমোচিটো জাতীয় অরণ্যে পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম সেরাতে। মূল বনপথ থেকে বেরিয়ে ছোট ছোট রাস্তা এদিক সেদিকে যায়। রাস্তার নম্বর কি নির্দেশ কি নিশানা সর্বদা স্পষ্ট নয়, আর অন্ধকারে ভালো দেখাও যায়নি। এজন্যেই পথ হারানো। ঘুরে ফিরে মন্টিচেলো শহরে পৌঁছলে এক কৃষ্ণাঙ্গ পুলিশ অফিসার আমার সামনে গাড়ি চালিয়ে পথ দেখিয়ে আবার মূল রাস্তায় তুলে দিয়ে আসেন।
লরম্যান যাওয়া কেবল পরিচিতজনের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়াই। ছয় ঘন্টা গাড়ি চালানোর পথে কিছুটা বিশ্রামও উদ্দেশ্য ছিল। পিঠের ব্যথাটা ইদানিং বড় কষ্ট দিচ্ছিল। কাজে যোগ দেয়ার পরে প্রথম ঘরে ফিরলে এক রাত্রিতে বড় অস্থির হয়েছিল শরীর। প্রায় অবশ। হয়তো ঐ বন পার হয়ে জল-জঙ্গলের শেষে অপরিচিত শহরে ফিরে যেতে প্রতিবাদই করেছিল শরীর, মন না-জানলেও। ডাক্তার, হাসপাতাল, অর্থলোভী চিকিৎসকের প্রায় বিনা কারণে মেরুদন্ডের নানা পরীক্ষা অবশেষে শয্যাশায়ী করেছিল মাসাধিককাল। কিন্তু ওরই মধ্যে কাজে ফিরে যেতে হয়েছিল। গাড়ি চালাবার মতো অবস্থা ছিলো না বলে প্লেনে করেই, তারপরে ট্যাক্সিতে তিরিশ মাইল। নতুন চাকরি, কোন ছুটিই তখনো পাওনা ছিল না।
পাঁচ
বেলা বারোটার ক্লাসটি নেবার পরে স্বচ্ছন্দে পথে নেমে যেতে পারি আমি। প্রায় সাড়ে তিনশ’ মাইল রাস্তা। সাতঘন্টাও নেয় কখনো কখনো যদি পথে একবারও থামা যায়। কিন্তু পারা যায় না। প্রথম দিকে কয়েকবার উঠেছিলাম পথে একটার মধ্যেই, পরে একদিন বিজ্ঞপ্তি দেখেছিলাম আমার জন্যে নির্দিষ্ট করা চিঠিপত্রের বাক্সে। তিনটের সময় বিভাগীয় সভা, এবং তারপরে প্রতি শুক্রবারেই।
ফলে একশ’ মাইল দক্ষিণে নেমে আমি যখন মিসিসিপি নদী পারাপারের সেই ব্রিজে উঠি, তখন প্রায় সন্ধ্যা। ওপারেই ঐতিহাসিক নগরীর ডাইনে দূরে জ্বলে-নেভে তাপবিদ্যুত উৎপাদন চুল্লির চিমনিতে আলো। সেতুর নিচে অথৈ ঘূর্ণির কালো জল আমার চোখে পড়তো না, কেবল সামনে আসে চলে যায় সেতুর অতিকায় কড়ি-বরগা। রেলিং বরাবর আলোর মালা। বাঁয়ে তাকালে দেখি পাহাড়সম খাতের শীর্ষে নদীর বাঁকে জ্বলে উঠেছে শহরের বাতি। পাশ দিয়ে দ্রুতগামী যান কিছু চলে গেলে খেয়ালও করি না, গাড়ির বেগ আপনি থেকেই কমে আসে। মনের কোণে যা ভার জমেছে, তা উঠে এসে ছড়িয়ে পড়ে সারা বুকে। এখনও আড়াইশ’ মাইল, পাঁচ ঘন্টা, অন্তত মধ্য রাত তো হবেই, কখন চলে যাবে বিছানায় শিশুকন্যাটি। তার মা, একাকী এ-ঘর ও-ঘর করবে নানা কাজে। উৎকর্ণ সর্বদা, এই বুঝি শোনা গেল গাড়িবারান্দায় ইঞ্জিনের শব্দ।
সব ছেড়ে চলে আসার কথা মনে হয়েছে অনেকবারই। কিন্তু চুক্তিভঙ্গের খেসারত দেয়ার ক্ষমতা থাকলে তো চুক্তিপত্রে সইই করতাম না। আর এই সময়ে, এই দেশে, মূলত ভিন্নভাষী বিদেশীর জন্যে অধ্যাপনার চাকরী মেলা সহজ নয়। এক বছরে শতাধিক আবেদনপত্রই তার প্রমাণ। চাকরী মিলেছিল ঠিকই। কিন্তু এমন সব দিনরাত্রি কাটাতে হবে ভাবিনি।
কয়েকদিন আগে বিভাগীয় প্রধান ডেকেছিলেন। জিজ্ঞাসা করেছিলেন, নিয়মিত সুগন্ধি ব্যবহার করি কিনা। ব্যক্তিগত চেহারা, পোশাক-পরিচ্ছদ সম্পর্কে অতিসচেতন আমি অপমানে নির্বাক হয়ে গেছিলাম।
নানা বিজ্ঞপ্তিতে আমার নামের বানানটি ভুল লেখা হতো, সেই প্রথম দিনই লক্ষ্য করেছিলাম। কয়েকবার ইতস্তত করে বিভাগীয় সহকারীর কাছে ব্যাপারটির উল্লেখও করেছিলাম।
এরকম হওয়ার কথা নয়। আবেদনপত্রে, নিয়োগপত্রে তো নামের বানান ঠিকই লেখা আছে ! বিভাগীয় প্রধানকেও বলেছিলাম। এক সহকর্মী পরে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। পড়তে দিয়েছিলেন ভিন্ন এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের তিক্ত অভিজ্ঞতার কাহিনী। এই রকমই ঘটে। তুমি যে কিছু নও,প্রমাণ করার এই হচ্ছে প্রথম ধাপ। সুগন্ধি ব্যবহারের ব্যাপারটিও। পার তো প্রতিবাদ কর। চাকরিটি তো চাই ! নাকি ?
বনপথের প্রান্তে সেই কফির দোকানে আসি। দেখি তিনি বসে আছেন এই এতো রাত্রিতেও। শুক্রবার বলেই সম্ভবত। কফির পেয়ালা হাতে নিয়ে তাঁর টেবিলে গিয়ে বসি। দু’এক কথার পথে তিনি বলেন যদি খুব অসুবিধে না হয়, তাহলে তিনি আমার সঙ্গে যেতে চান। রবিবার সন্ধ্যায় ফেরার পথে এখানে নামিয়ে দিলেই চলবে। তাঁর গাড়িটি এই দোকানের পার্কিং লটেই থাকবে। কোনো অসুবিধে হবে না।
সামান্য বিস্ময় কাটিয়ে নিয়ে সহাস্য মুখেই বলি, “এতো খুব-ই আনন্দের কথা ! দাঁড়ান ঘরে বলে দিই।” পাবলিক ফোনে খুচরো পয়সা ঢালি। সঙ্গে অতিথি আসছেন একজন, স্ত্রীকে জানাই। গভীর অরণ্যের প্রান্তে, বনপথের শেষে পরিচয় হওয়া অজানা স্বদেশীর কথা তাকে আমি আগেই বলেছিলাম।
ছয়
বাড়িটি ছোট আমাদের ঠিকই। কিন্তু পুরো বাড়িই। সামনে পেছনে পাশে অনেক জায়গা। পেছনে সবজিবাগানও করা যায়। করেও ছিল আমার স্ত্রী এই গেল মৌসুমেই। আমার স্ত্রীর এই শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির সুবাদেই বাড়িটি পাওয়া। প্রকৃতপক্ষে তার চাকরিটিই প্রথমে হয়েছিল বলে এই শহরে আসা। তারপর দূরের শহরে আমার।
বাড়িটি দেখে খুব খুশী হন তিনি। বার বার সে কথা বলেন। বুঝি, অনাত্মীয় ছাত্রটির ঘরের মেঝেতে কি সস্তা মোটেলের ঘরে রাত কাটানোর পরে ছোট হলেও বাড়িটি তাঁর ভালো লাগারই কথা। ইউনিভার্সিটির বিবাহিত ছাত্রদের জন্যে নির্দিষ্ট বাসস্থান ছেড়ে এসে আমাদেরও লেগেছিল।
নানা কথায় নানা আলাপে বলেন, তাঁর কাজটি এমন কিছু বাঁধাধরা নয়। তেমন অর্থকরীও নয়। দেশে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা আছে। তাদের ভরণপোষণ তো করতে হয়ই ! কখনো বিনাশ্রয়ে যদি গাড়ির পেছনে শুয়েই রাত কাটাতে হয়, তাতেও কোন ক্লেশ হয় না তাঁর।
খাবার টেবিলে বসবার মুখে তিনি সঙ্গে আনা বড় ব্যাগটি থেকে একটি বড় প্লাস্টিকের ঢাকনা দেয়া পাত্র বের করে আমার স্ত্রীর হাতে দেন। সে খুবই আপত্তি করে বলে, “কেন এসব এনেছেন, বলু্ন তো!” বলেই সে পাত্রটির ঢাকনা খোলে। সবিস্ময়ে দেখি আমরা, পাত্রটি ভরা খোসাশুদ্ধু ডিম।
“না, না এ আর কী”- বিব্রত বোধ করেই বলেন তিনি, “কেবলই তো ডিম। কিন্তু সব সেদ্ধ করা।”
“কিন্তু এতো ডিম !” বিস্ময়ে বলি।
বুঝি লজ্জা বোধহয় এবারে তাঁর, “সেদ্ধ ডিম খুব সহজে নষ্ট হয় না। কখন কোথায় থাকি ঠিক নেই তো !”
“তাহলে এগুলি বরং আপনার ব্যাগেই থাকুক।” নিতান্ত কুন্ঠিত আমার স্ত্রী।
“না না না ”, প্রচন্ড আপত্তি করেন তিনি।
আমাদের কোনো কথাই খাটে না। স্থির করি রবিবারে তাঁর যাওয়ার সময়ে আবার না হয় নতুন করে দু’ডজন ডিম সেদ্ধ করে তাঁর পাত্র ভরে দেব।
শনিবার সারা দিন আনন্দেই কাটে। তাঁকে নিয়ে শহরের এখানে-সেখানে যাই। যাই মনোহরা পার্কটিতে। সারা শহরে ছড়ানো অ্যাজালিয়ার সারি সারি ঝোপ দেখাই। এখনো কিছু কিছু ফুল রয়ে গেছে। ভরা মরসুমে “অ্যাজালিয়ার রঙ” শতগুণে ফুটে উঠবে।
আমাদের কন্যাটিকে কোলে নিয়ে বসে থাকেন ঘরছাড়া দূরবাসী জন। সন্তানদের কথা বলেন বারবার। তাদের মায়ের কথাও। কিন্তু কখন, কীভাবে , কেন এই জলজঙ্গলের ভূমিতে, নানা কানে শোনা নানা কথার দক্ষিণ অঞ্চলে আসা তাঁর, পরিষ্কার হয় না। বেশি জিজ্ঞাসাও করি না আমরা। পাছে কিছু মনে করেন।
রবিবারে বৈকালিক চা পর্বের পরে পথে উঠি আবার। হয়তো পৌঁছতে বেশি রাতই হবে। কিন্তু একাকী ঘরের কথা ভাবলে সেটি গ্রাহ্য করি না। আর সঙ্গীজন যে আদৌ ঐ রাত্রিতে এমন কি মাটিতেও বিছানা পাততে পারবেন এমন নিশ্চয়তাও তো নেই ! কে জানে পুরনো গাড়ির পেছনেই রাত কাটবে তাঁর।
অন্ধকার ঘন হওয়ার আগেই বনপথের প্রান্তে কফিশপের সামনে তাঁকে নামিয়ে দিই।
সাত
আন্তরাজ্য সড়কে ওঠবার ঠিক মুখে থামি একবার। চারপাশ ভালো করে দেখে নিই। ওই সেই প্রথম দুই রাত্রি কাটানো মোটেল, ঐ সেই বার্গার কিং-এর দোকান। পেছনে ফেলে আসা রাস্তা দেখি, গাছের ডালপালায় ঢাকা পড়েছে তিন গৃহসতীর্থের একত্র বাসের পুরনো বাড়িটি। সামনে এগুলে ঠিকই পাওয়া যায় শহরের সবচেয়ে বড় শপিং মলটি। আন্তরাজ্য সড়কে ডাইনে গেলে শ্রীভপোর্ট লুইজিয়ানা রাজ্যে, বাঁয়ে মিসিসিপি নদী।
চোখবন্ধ করি। হাইওয়ে র্যাম্পে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না তাই চোখ বন্ধ করে, দ্রুত অস্ফুট স্বরে বলি, “আর কখনো কোনোদিন এই পথে ফিরবো না।”
গাড়িটি নানা বাক্সপোঁটলায় বোঝাই। গাড়ির ট্রাংকটিতে আছে ভারি কিছু বাক্সই। কয়েকদিন আগেও ভেবেছিলাম, এক বছর পরে যদি ফিরে আসি, কিছু ব্যবহার্য না হয় রেখেই যাই কোথাও। মনের সায় ছিল না তবুও বিভাগীয় প্রধানকে একটা চিঠি লিখেছিলাম এক বছর ছুটি চাই। পিএইচডির অভিসন্দর্ভ শেষ করার জন্যে। অস্থায়ী, বাৎসরিক চুক্তিভিত্তিক পদ। ফিরে আসবো কিনা জানাতেই হবে। নিঃশব্দে চলে যাওয়া যায় না। তাছাড়া ভাত ছড়ালে কাকের অভাব কী, এই চিরকালীন আপ্তবাক্য তো মনে ছিলই।
বিভাগীয় প্রধান চিঠিটি ভাইস-প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠিয়ে দেন। আমাকে বলেন, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। একবার ভাবি, নাই বা গেলাম আর কারো কাছে কিন্তু ওই যে ছড়ানো ভাত আর কাকের কথা মনে পড়ে ! আলিশান টেবিলের ওপারে বসা ক্ষমতাধর আমাকে জানিয়ে দেন তাঁদের প্রয়োজনের ওপরে নির্ভর করবে আমার ফেরা-না-ফেরা, আমার প্রয়োজনের ওপরে নয়।
পেছনে কি ডাইনে-বাঁয়ে আর তাকাই না। রাস্তায় উঠে যাই। পার হয়ে যাই ছোট্ট শহরটি, ত্রিশ মাইল দূরের মাঝারি শহর, বিমানবন্দর, সেতুর নিচে দেখি তেমনি কালো জল, পাহাড়ের মাথায় সেই তাপবিদ্যুত উৎপাদনের আলো – আর কখনো যেন না দেখি এসব !
দক্ষিণ অঞ্চলের গ্রীষ্ম – প্রথম কাল হলেও অপরাহ্ন এখনও তাপ ছড়ায়। গাড়িতে ঠান্ডা বাতাসের যন্ত্র চালালে শীতল হাওয়ার ধারা বুকের বাঁ পাশে একরকম যন্ত্রণার সৃষ্টি করে যেন। গাড়ির রেডিওতে আবহাওয়ার খবর শুনি না, সংবাদ নয়, কোনো গানও নয়।
ভেবেছিলাম আজ আর থামবো না। যদিও ঘন্টা চারেকের মাথায় গাড়ির বিশ্রাম দরকার – তবুও।
বনপথের সেই প্রান্তে এলে আপনি থেকেই যেন গাড়ির বেগ কমে যায়। গাড়ি রাখবার জায়গায় থামি, নামবো কিনা ভাবতে গিয়ে দেখি সেই পুরোনো গাড়িটি দাঁড়ানো একটু দূরে। জানি গাড়ির পেছনে কেউ শুয়ে নেই তবুও কাছে যাই। দেখি জনশূন্য গাড়িটিতে নানা মালামাল।
কাচের দেয়াল দিয়ে ঘেরা দোকানটি – স্বচ্ছন্দেই ভেতরের উজ্জ্বল আলোয় টেবিলে বসা সকলকেই দেখা যায়। দেয়ালের দিকে দু’পা এগোলেই দেখি সেই কোণের টেবিলটিতে বসে আছেন তিনি। জানি, দেয়ালের এপারে সন্ধ্যার নিরালোকে চিনবে না কেউ আমাকে। মুহূর্তে সরে আসি। গাড়িতে উঠে ইঞ্জিন চালিয়ে পথে উঠে যাই।
আট
ঘরে পৌঁছনোর আগে পথটি শূন্য মাঠ ও জলাভূমির মাঝখান দিয়ে চলে গেছে। আকাশের সীমায় দেখি আমার শহরের আলো। পাইন গাছের সারি, পথের দু’পাশে ঝোপঝাড় – জলাভূমি।
অমন করে চলে আসা কেন আমার ? দায়তো আমার কিছুই ছিল না, তবে ? বনপথের প্রান্তে যাকে দেখেছিলাম সে যদি রয়ে যায় ওই বনপথের প্রান্তেই তাতে আমার কী ? কী বলবো তাঁকে, কী শুনবো, এই কি ছিল ভয় ?
গাড়ীটি থামাই। দরজা খুলে পথের পাশে নামলে দেখি অসময়ের বর্ষণে জলাভূমি কানায় কানায় পূর্ণ। হাওয়া দ্রুত বয়ে যাওয়ায় পাইনের শীর্ষ দুলতে থাকে। ওই রাত্রিতে চাঁদ ওঠবার কথা নয়, ওঠেও না। তবুও অস্বচ্ছ আলোর আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি, যেন কোথাও যাওয়ার নেই। স্থির।