হামীম কামরুল হক
ছোটবেলায় ঠিক কী হতে চাইত জানতে পারেনি, নিজেকেও বলতে পারেনি, অন্যদের শিখিয়ে দেওয়া বা পাঠ্যপুস্তকে পড়া কি পরীক্ষার খাতায় লেখা ‘জীবনের লক্ষ্য’ বা ‘এইম ইন লাইফ’ লিখে যা যা বলেছিল, তার কোনোটারই ধারে কাছে কাসেদ যায়নি। এই যে এমএসসি পাস করে কী করবে তাও ঠিক করতে পারছে না, যদিও সে বোঝে যে, স্রেফ ভালোলাগার ওপরে ছেড়ে দিয়ে জীবন চলে না। তদুপরি অপ্রয়োজনীয় যা যা সব ছেঁটে দিয়ে নিজের জন্য যা করা দরকার তাও সে এখন অব্দি ঠিক করতে পারেনি; হ্যাঁ, তবে একটা বিষয় নিজের মনে সে গোপনে আশা করেছিল, সারা জের মতো কাউকে, আর রুহির চাহুনি যে অবিকল সারা জের মতো সেটাও অনেক পরে ধরতে পেরেছিল, রুহির একটি স্টিল ফটো দেখে। আসলে সময়মতো কিছু ধরতে পারে না কাসেদ। হাতের কাছে, এমন কি হাতে মুঠায় চলে এলেও ছুটে যাওয়ার পর কখনো কখনো টের পায় কী এসেছিল। তবে রুহিকে পাওয়ার পরে, আসলে কি পাওয়া, রুহি নিজে থেকে তাকে নিয়েছে, রুহি চেয়েছিল বলেই সে রুহির, নিজের কোনো বাছাই ছিল না, পছন্দও ছিল না, যাকে বলে ‘চয়েস’ ছিল না। হাতের ওপর হাতের কোনো স্পর্শ সে পেয়েছিল যা অনেক ভালোবাসার। এটা রুহির আগে সে বুঝতে পারেনি, তবে ভালোবাসারও কিনা কে জানে, কারণ এখন দুজনের প্রতি দুজনের প্রবল শরীরের টান, এটা চলে গেলেই আসলে বোঝা যাবে কতটা ভালোবাসা একে অন্যের মনের ভেতরে রাখা। ভালোবাসা মানে তো হাতের মুঠায় পাওয়া কিছু নয়, আবার হাতের মুঠার বাইরেরও কিছু নয়। রুহিকে পেয়ে মনে হয়েছে দু’হাত তার ভরে উঠেছে। যেখানে হাত রাখছে সেখানে পূর্ণ ও ভরাট রুহি। তার মতো হ্যাংলা ঢ্যাংগা টিংটিংয়ে লোকের জন্য এমন হৃষ্টপুষ্ট রুহি, তাদের মনে হয় মানায়নি মোটেও। অন্তত লোকে দেখে তাই বলবার কথা। রুহি একে তো স্বাস্থ্যবতী, তায় দেহবতী, প্রচণ্ড খাঁই ভেতরে। গায়ের রঙ প্রায় বিদেশিনি বিদেশিনি, বলতে গেলে শ্বেতাঙ্গদের কাছাকাছি, চুলের রঙ প্রায় সোনালি, আসলে কটা। রুহিকে একটু বেশিই পাওয়া হয়ে গিয়েছিল, তবে রুহি বলে, কাসেদই তার মনের মতো। তাকে ভরিয়ে দিয়েছে কাসেদ। অবশ্য কাসেদ কোনোদিন ভাবেনি সে কারো মনের মতো হতে পারে কিনা, বা অন্য কেউ বা কোনো কিছু তার মনের মতো হতে পারে কি না। মনের মতো কিছু না পেলে কোনো কিছুর মতো মন করে নিতে হয়, এটাও তার জানা ছিল। কিন্তু তেমন কোনো কিছুতে যে সেঁটে যেতে পারেনি। যেখানে সেঁটে যেতে পারলে বোঝা যেত সে কোনো কিছুর মন হয় উঠেছে, কাসেদের কেবল মনে হয় সে তো নিজের মনের মতোই হয়ে উঠতে পারেনি। শুধু তাই নয়, আসলে সে কী ও কেন তাই তো তার কোনোদিন টের পাওয়া হয়নি, এই হওয়া না-হওয়ার খেলাও তার ভেতরে সারাদিন চলে না, কিছু একটা সে করতে চায়, কিন্তু সে-ই কিছু একটা কী তা জানে না। কলেজের বন্ধু বলেছিল, কলেজ পাস করে দুহাতে আঠা নিমু। যেখানে লাগে সেটাই করতে শুরু করমু; সে এখন ডাক্তার, কিন্তু আসলে ডাক্তারই যে হয়ে উঠবে, তা সে জানেনি আগে কোনোদিন। মানে হতে চায়নি। সুযোগ পেয়েছে হয়েছে। বন্ধুটির বাপ ছিল উকিল, সে আঠা বলতে তার হাতে যে সুযোগ মিলেছে। সে মতো সে সেই সুযোগের জগতে ঢুকে পড়েছে। কাসেদের হাতে কিছু নেই, সে এমন কোনো কিছু পারে না যে তাই ধরে নিজের পথটা করে নেবে। পথ করে নেওয়া না কি পথ পেয়ে যাওয়া, তাও তার জানা নেই। দুহাতে কোনো কিছু ধরে রাখতে পারেনি, তাও তো নয়। ধরতেই তো পারেনি ধরার মতো কিছু, তারওপর ক’দিন ধরে একটা নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝেই চমকে উঠছিল কাসেদ। কারণ হাত দুটো বার বার গলে যাচ্ছে, গলে গিয়ে ফের আগের মতো হয়ে উঠছে। প্রথমবার দৃশ্যটা বার বার দেখে তার সারা শরীর ছম ছম করে উঠছিল। চোখের ভুলেই দেখছে নাকি! কী দেখতে কী সব দেখছে, এই তো সেদিন অনেক রাতে বাসায় ফেরার পথে, বরাবরের মতো এই সময় রাস্তায় কেউ থাকে না, সেদিনও ছিল না। কিন্তু মোড় ফিরতেই সামনের মোড়ে একটা আলখাল্লা পরা লোকের উদয় হলো। তাও মাথাটা ঢাকা, মুখটা নিচু করে লোকটা খুব আস্তেই হাঁটছিল। শীতের রাত নয়, গরমে সকাল থেকে সারা দিন প্রাণ আইঢাই করে, এর ভেতরে আলখাল্লা পরে কে, এসব প্রশ্নও মনে কানে বেজে ওঠেনি। সে একটু তাড়াতাড়িই হাঁটছিল। আলখাল্লা পরা লোকটা কাছাকাছি হতেই হঠাৎ ওর মুখোমুখি চলে আসে, মাথার ওপরের ঢাকনিটা ফেলে দিয়ে, পারলে ওর মুখের সঙ্গে মুখ মিলিয়ে দাঁড়ায়। কাসেদ এমন চমকে ওঠে, কারণ লোকটার চেহারা হুবহু তার মতো, মানে সেই তার মুখোমুখি। শিরদাঁড়া বেয়ে পাছার জোড়া পর্যন্ত একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। যেমন এসেছিল, তেমন করে দুম করে মাথায় ফের ঢাকনিটা দিয়ে সরে যায়। এবার আর আস্তে নয়, হন হন করে হাঁটা দেয়। লোকটা রাস্তার বাঁকে বা মোড়ে মিলিয়ে না যাওয়া অব্দি তাকিয়ে থাকে। ঠিক তখন ফোনটা বেজে ওঠে। দেরি দেখে এর আগেও রুহি ফোন করেছে কয়েকবার। বাসার সবাই শুয়ে পড়েছে সেই কখন, রাতের খাবার নিয়ে সে বসে আছে, রুহিকে হাজারবার বলা আছে, সে যেন দেরি দেখলে খেয়ে নেয়; ইস, একেবারে যেন বিয়ে করা বউ; বলে, আজব, বউই তো, বিয়ে তো কিছুই না যদি বউ আগে না হয় কেউ কারো মনে মনে। কাসেদের রাগও লাগে, হাসিও পায়, মায়াও জাগে, আবার ভালোবাসাও। রুহির সঙ্গে তার কি ভালোবাসার সম্পর্ক এই প্রশ্নটা মাঝেমাঝেই হানা দিয়ে যায়; ওই বাসার তিনটা ঘরে তারা তিনটা জুটি থাকে, আইয়াজ ও তানহা দুজনেই চাকরি করে। এদের ঘরটা অ্যাটাচড বাথ। আর নিহাদ ও আনিতা, চাকরি না পেলেও টিউশনি করে ভালোই আয় আছে ওদের, তারা থাকে আরেকটা ঘরে। ব্যবহার করে কমন যে বাথরুম, তাদের আর কাসেদদের; মানে রুহি আর কাসেদ যেটা ব্যবহার করে। মানে অন্য দুই জুটির আলাদা আলাদা ঘর রয়েছে, কারণ তারা ভাড়াও বেশি দেয়, ছেলে-মেয়ে দুজনেই আয় করে। রুহি বলেছে স্রেফ ঘরের বউ হিসেবেই থাকবে। এদিকে কাসেদ ফ্রিল্যান্স এটা ওটা করে প্রায়ই কুলাতে পারে না, ফলে তাদের কোনো নিয়মিত আয় নেই। তারা বাসাটার সদর দরজা দিয়ে ঢোকার মুখেই যে ঘরটা, তাতে থাকে। আসলে এ বাসায় বসার ও খাবারঘর মানে ড্রইং-ডাইনিং স্পেসটাই তাদের থাকার জায়গা। আর তার একদিকে রান্নাঘর, অন্যদিকে সেই বাথরুমটা। একটা পর্দা দিয়ে আড়াল করা তাদের থাকার জায়গাটা। তাও সেটুকু যেটুকুতে একটা ছোট বিছানা পাতা যায়, খাট তো নেই। একটা ছোট চৌকিতে গাদাগাদি করে থাকা। রুহি কেবলই গা ঘেঁষে থাকতে পছন্দ করে। রুহির একটাই কথা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছো, এমএসসি পাশ করেছো, একটা না একটা কাজ তো হবেই। আর কাসেদ ইমরান সত্যিই একদিন দেখিয়ে দেবে, আলী ইমরানের পোলা বলে কথা; আলী ইমরান পোলার তেমন খোঁজ রাখেন না। এলাকার জমিজায়গা, রাজনীতি আর ফসল নিয়ে তার দিন কাটে। পোলাকে তিনি ঢাকা পাঠাতেই রাজি ছিলেন না। এখন তার বাপের কথা তার ভবিষ্যৎ সে নিজে বুঝে নিক। ছেলেকে টাকা পাঠাবেন না বলেননি, কিন্তু কাসেদ নিজেই আর বাপের কাছ থেকে টাকা নেয় না। এছাড়াও বছরের পর বছর পার হয়ে যায় বাড়ি যায় না, রুহির সঙ্গে সম্পর্কটা রেখেছে। বিয়ে করবে ভালো কোনো ব্যবস্থা করতে পারলে, কিন্তু তার আগে থেকেই একসঙ্গে থাকতে রাজি। আনিতা আর তানহার জন্যই রুহি সাহসটা পেল। এভাবে একসঙ্গে থাকার মূল আয়োজক আসলে তানহা আর আইয়াজই। পরে নিহাদ আর আনিতাকে পাওয়া যায়। রুহি আর কাসেদ রাজি হওয়ার পর, নিহাদ ও আনিতা বিয়ে করবে করবে করেও এখনও করেনি। টিউশুনি করছে আর বিসিএস দিয়ে যাচ্ছে। নিহাদের এক বিসিএসের লিখিততে চলে এসেছে তো আরেকটার ভাইভার জন্য অপেক্ষায়। আনিতার বলে হয়েই যাবে এবার, দুজনের প্রথম পছন্দ ‘ফরেন ক্যাডার’। হলেই এ বাসাটা ছেড়ে দিতে হবে, তখন কী হবে নিয়ে মাঝে মাঝে চিন্তা করে আইয়াজ। নতুন কোনো জুটিকে পাওয়া কঠিন কিছু না, মুশকিল বনিবনা নিয়ে। এখানে রাতে একজনের বড়ি শেষ হলে অন্য জনের কাছে কনডম চেয়ে নিতে কোনো সমস্যা হয় না। সবাই সমবয়সি, একই সঙ্গে পাশ করেছে, একই ব্যাচের; প্রথম প্রথম খুব একসঙ্গে মজা হতো, বেড়াতে যাওয়া হতো। দিনে দিনে সেটা কমে এসেছে, বিশেষ করে আইয়াজ আর তানহার চাকরি হওয়ার পর। দুজনেই দুটো এনজিওতে কাজ করে, একজনের অফিস ধামরাই, অন্যজনের সাভার। তানহার চাকরিটা পোক্তই বলা যায়, তানহা বলে মোটা অঙ্কের বেতনও পায়। এখন বলে টাকা জমাচ্ছে। আইয়াজের লাইন ভালো, আসলে ওরা তালে আছে একটা মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানির চাকরি জোগাড় করার। সব সময় বলে, আই ওয়ান্ট অ্যা বিগ লাইফ, পারহ্যাপস দ্যা বিগেস্ট ওয়ান। শালার নায়াগ্রা ফল না দেখে, গ্র্যান্ড ক্যানিয়ান না দেখে মরে যাবো এ হয় নাকি বল; কেবল তাই নয়, কথা বললেই বিরাট কিছু করার কথা বলে। নিহাদও কী করবে না করবে আগে বলত, এখন চুপ মেরেছে। সেখানে কাসেদ একদমই বলে না সে কী করবে। টুঁ শব্দটিও করে না। আর সারা দিন কেবল চিন্তায় থাকে টাকার। রাতে ফিরলে রুহির সঙ্গে উদ্দাম প্রেম। কাসেদ বলে, তুমি আমাকে একটু কম ভালোবাসতে পারো না, তাহলে আমার কিছু করার যোগ্যতা হতো, এত প্রেমে থাকলে কিছু করা যায় না জানো; রুহি বলে, একদম ঠিক না, বরং ভালোবাসাটাই আসল দরকার, ভালোবাসা থাকলে সব হবে। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতাটা পুরো মুখস্থ রুহির। সে ওটা ফের আবৃত্তি করে শোনাবে, শুনতে শুনতে কাসেদেরও মুখস্থ হয়ে গেছে। সুযোগ পেলেই বলে ‘তুমি দেখে নিয়ো’, লিখেছেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী:
‘‘একে একে বানিয়ে তুলব সব, তুমি দেখে নিয়ো।
বাড়িঘর, খেতখামার,
উঠোনে লাউয়ের মাচা, জানলার পাশে
লতানে জুঁইয়ের ঝাড় –
একে একে সমস্ত বানাবো, তুমি
দেখে নিয়ো
দক্ষিণে পুকুর থাকলে ভাল হয়, তুমি বলেছিলে।
অবশ্য থাকবে।
পুকুরে হাঁসের স্নান দেখতে চাও, সে আর এমন
কী বেশী কথা,
সাদা ও বাদামী হাঁস ছেড়ে দেব।
যা চাও সমস্ত হবে,
একই সঙ্গে হয়ত হবে না, কিন্তু
একে-একে হবে।
ভালবাসা থাকলে সব হয়।
দেখো, সব হবে।
যা-কিছু বানানো যায়, আমি সব
দুই হাতে দিনে-দিনে বানিয়ে তুলব, তুমি দেখে নিয়ো।’’
শেষ করে রুহি বলে, জানো, এই স্বপ্নটা আমি কখনো হারাতে চাই না, কাসেদের বার বার মনে জেগে উঠে ফের হারিয়ে যায় কথাটা। একই সঙ্গে হয়ত হবে না, কিন্তু একে-একে হবে। কাসেদ রুহিকে শোনায় ওর বন্ধু নাহাজ হাবিবের কবিতার একটা লাইন, ‘আমি তোমাকে করে তুলব আমার আরোগ্যহীন বেদনার সমান’। রুহি মজা করে বলে, বেদনা না বলে বলো অসুখ, তোমার আরোগ্যহীন অসুখ। কাসেদ বারবার বলে, অনেক আদর করে বলে রু, আমার রুহ, আমাকে এত ভালোবেসো না জান, আমার রুহ, আমার রু। কাসেদের রু কখনো রুহ। এত্ত ভালো লাগে রুহির। কাসেদ বলে, ভালোবাসা বেশি বেসো না, জীবনকে একেবারে বারোটা বাজিয়ে দেয়। রুহি হি হি করে হাসে। সুযোগ পেলেই তাদের ভালোবাসা চলে দিনে রাতে সারাদিন। অন্য দুই জুটি কেবল রাতে ফেরে। নিজের ঘরে রাখা টেবিলে, যেটা পড়ালেখার জন্য কাজে লাগে, খাবারের জন্যও কাজে লাগে। তাতে বসে খেয়ে নিয়ে যে যার মতো দরজা বন্ধ করে দেয়। রুহি ও কাসেদের তো কোনো দরজা নেই। অন্য দুই জুটির দরজা সারা রাতই বন্ধ থাকে। কেবল নিজেদের অ্যাটাচড বাথ নেই বলে রাতে দরকার হলে আনিতা ও নিহাদ দরজা খোলে কমন যে বাথরুমটা আছে সেটা ব্যবহারের জন্য। প্রায় সকালে দুজনে একসঙ্গে গোসল করে নেয়। এতে সময়, পানি কম সব বাঁচে, আর প্রেমটাও বলে জমজমাট থাকে। তাদের দেখাদেখি আইয়াজ আর তানহা কয়েকদিন করে বাদ দিয়েছে। তারা বলে অতটা রোমান্স পায়নি। রুহি অবশ্য সুযোগে থাকে কাসেদকে নিয়ে একসঙ্গে গোসল করার। সময়টা ভীষণ জান্তব উন্মত্ত ও উদ্দাম হয়ে ওঠে, যেটা পর্দাটানানো চৌকিতে পাওয়া বাকি থাকে, তার পুরোটুকু উসুল করা হয় গোসলখানায়। সবসময় সুযোগ মেলে না, কারণ অনেকসময় দেখা গেল ওই চারজনের কেউ না কেউ বাসায় থাকছে। বিশেষ করে নিহাদ ও আনিতা, তাদের যেকোনো একজন প্রায় বাসায় থাকে। টিউশনির রুটিন পাল্টালে, বাসায় বিসিএসের প্রস্তুতি নেয়। সেটা হয় আইয়াজ, তানহা, নিহাদ ও আনিতাদের সবাই যখন বাইরে। দুই জুটিই বেরুনোর সময় নিজেদের ঘরগুলি তালা মেরে দেয়। প্রথম দিকে খোলাই থাকত, কিন্তু আইয়াজের ল্যাপটপ চুরির পর থেকে দুই জুটির কেউই আর ঘর খোলা রেখে বেরোয় না। কাসেদ টের পায়, ভার্সিটিতে পড়ার সময় এই ছয় জনের কোনো ভেদ না থাকলেও এখন একটু একটু করে আলাদা হতে শুরু করেছে সবাই। রুহি এজন্য একটু দুঃখ করে, তাই হাতে টাকা এলেই সে সবাইকে দাওয়াত করে পোলাও রোস্ট ইলিশ খাসির রেজালা সঙ্গে সালাদ মিষ্টি দিয়ে ছোটখাটো ভোজের আয়োজন করে প্রায়ই। প্রথম প্রথম তাতে অন্য দুই জুটির আগ্রহ থাকলেও, আর খাওয়ার সময় হৈ চৈ করে মজা করে খাওয়ার মেজাজটা থাকলেও পরে কেটে গেছে। তারা যে খুব হিসেবি কখনো মনে হয় না, হিসেবে চললে টাকা থাকে, টাকা আসে। আর ভালোবাসায় চললে টাকা এলেও চলে যায়, থাকে না রুহিই বলে। কিন্তু তারপরও আমি ভালোবাসায়ই চলতে চাই, হিসেবে নয়। বাকিদের কথা মনে হলে, ক’টি কথা নিজেদের দিকেই ফিরে আসে রুহির বলতে ইচ্ছা করে, ‘ঘনিষ্ঠ আকাশ যেন যেন কোন্ বিকীর্ণ জীবন/ অধিকার করে আছে ইহাদের মন’। বাসায় তার কাছে ‘জীবনানন্দ দাশের কাব্যসমগ্র’ আর ‘সুজিত সরকার নির্বাচিত ১০০’ ‘দেওয়াল তুললেই ঘর/ ভেঙে ফেললেই পৃথিবী,’ কাসেদ শুনে বলে, ভেঙে ফেলাটাই কঠিন। দেওয়াল তোলাটাই বরং সহজ, নাকি ভুল বললাম; বলেই কাসেদ নিজের হাতের দিতে তাকায়। ভয়ে ভয়ে নিজের হাতটা দেখে, গলে গলে যাচ্ছে না তো? কথাটা রুহিকেও বলতে পারেনি, বললে হয়ত চিন্তায় পড়ে যাবে। রুহিকে কোনো সমস্যার কথা, বিশেষ করে নিজের শারীরিক সামান্য সমস্যার কথা বললে রুহি অস্থির হয়ে ওঠে। আজ সব বন্ধ, আজ ডাক্তারের কাছে চলো। কীভাবে রুহিকে বলে, এমনিতে হাতে টাকা থাকে না, কিন্তু তখন কোথা থেকে যে রুহির টাকা বের হয়। আজকাল যখনই সে তার হাতের দিকে তাকায়, দেখে হাতটা কব্জি থেকে বার বার গলে যাচ্ছে, এসময় কোনো ব্যথা হয় না। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে পাশের কোনো লোককে বলতে, দেখেন তো ভাই আমার হাতটা ঠিকমতো আছে কিনা। এটা বললে লোকে আবার তাকে না জানি কী ভেবে বসে। রুহিকে তো বলাই যায় না, সে আছে স্বপ্নের ভেতর, আগামীর আনন্দে ডুবে। রুহিকে বাঁচিয়ে দিয়েছে তার আপন বড় ভাই রাফসানের প্রশ্রয়। রুহি বলে, ভাইয়াই তো লাই দিয়ে আমার মাথাটা খারাপ করেছে। নিজে আর্কিটেক্ট, টাকাপয়সা আয়ের কোন সীমা পরিসীমা নেই। তার ওপর আছে কবি মন। রাফসান বলে, আর্কিটেক্ট মানে তো শিল্পীই, তাই নারে। তারা একেবারে পাথর নয়। জানিস, আজব ইচ্ছা ছিল, এ দুনিয়ার প্রত্যেকটি দেশে যাবো। এজন্য তোর মতো জিওগ্রাফিতে পড়ারই ইচ্ছা ছিলো। আছেই তো দুটো জিনিস। একদিকে আমি, অন্যদিকে দুনিয়া, দুনিয়া মানে ভূগোল। রুহি বলে, তোমার কোনো সন্দেহ আছে ভাইয়া? কাসেদ জানে রুহির প্রধান গুণ ও দোষ হলো মানুষের ওপর বিশ্বাস। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে, একদিন সব হবে, এটা তার অসুখের মতো হয়ে গেছে। সংসার, রান্নাবাড়া, আর ভালোবাসা। নিজের শরীর নিয়ে রাজ্যের ফ্যান্টাসি, বিছানায়ও এজন্য ধেনুক সবচেয়ে পছন্দের। এতে রাজ্যের ফ্যান্টাসি ভিড় করাতে পারে সে। কাসেদকেও সম্পূর্ণভাবে পায়, পুরোটা নেওয়া যায় ভেতরে, বা চলে যায়। প্রথম দিকে কাসেদের এতে অতি উত্তেজনা চলে আসত, পরে সহ্য করে নিয়েছে। অনেকক্ষণ নিজেকে সে ধরে রাখতে পারে। দমাদম নিরবচ্ছিন্ন চালিয়ে নিতে পারে, আই লাভ ইয়োর স্ট্যামিনা, রুহি বার বার বলে। দেখেছে শুরু থেকেই নিজেকে অনেকক্ষণ ধরে রাখতে পারে কাসেদ। কিন্তু তার প্রিয় ধেনুকে এলেই নাজুক হয়ে যায়। পরে ধেনুকেও অভ্যস্ত হয়েছে, আসলে করিয়েছে। টানা একুশ দিন পিসিমাসলের ব্যায়াম করিয়ে করিয়ে। তবু মনে হয় সবমিলিয়ে রুহির সঙ্গে সে পেরে ওঠে না। পুরুষের তুলনায় নারীর আহার দ্বিগুণ, বুদ্ধি চারগুণ, কাজের উদ্দীপনা ছয়গুণ, আর কামশক্তি আটগুণ বেশি। রুহি এর সার্থক নমুনা, রাত্রিভোর সাঁতারিয়েও পার হওয়ার উপায় নেই কোনো। রুহি যেন এক অন্তহীন সমুদ্রের মতো, যার তীর আছে পার নেই। আসলে তো সব সমুদ্রেরই পার আছে, আবার কোনোটারই কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই। রুহি বলে, আমরা নিজে শরীরের জিওগ্রাফিও জানি না, জগতেরও জিওগ্রাফিও জানি না। কাসেদ শরীরের কথা শুনলে ভয় পায়, তার হাতের কথা মনে হয়। হাতটার কী হলো, রুহি জানে না, স্বাস্থ্যে আর সুস্থতায় ঝলমল করছে দিনরাত। আর শরীরের ব্যাপার জেগে উঠলে রুহি আর মানুষ থাকে না। হয় একটা ইন্দ্রলোকের কেউ বা একটা আস্ত জানোয়ার হয়ে ওঠে। দাঁতে নখে কী পাগলপারা রূপান্তর হয় তার। আমি তোমার একান্ত বিশ্বস্ত রুহি, তুমি আর যাই করো, আমাকে কোনোদিন ঠকিও না। রুহি কাসেদকে বহুবার বলেছে এ কথা, কাসেদ জানে, যে কাজের দিকে সে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে, তার কপালে নাটক সিনেমা আর বিজ্ঞাপন তৈরির মানুষ হয়ে ওঠারই সম্ভবনা। আর তা হয়ে ওঠা মানে রাজ্যের মানুষ আর হরদম মেয়েমানুষ ঘাঁটাঘাঁটি করা। পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে পাস করা জাদিদুল আমিন তাকে বলেছিল, আমি তো কবিতা থেকেই ফিল্মে গেছিলাম। ফিল্মকে কবিতার তুলনায় এত ফাঁপা মনে হয়, যখন এমন সব লোকজনের সঙ্গে কথা বলা লাগে, দেনদরবার করা লাগে, অভিনয় জানে না, কেবল বিখ্যাত হওয়ার শখ। শরীর ভাড়া দেওয়ার রাস্তা খোঁজা নারীরা, আর টাকায় ধান্দায় থাকা দালালেরা, রিড্ডিকুলাস, এদেশে কিছু হবে না। বাঙালিদের দিয়ে আর কিছুই হবে না, না ফিল্ম না ফুটবল, সিনেমা কিংবা স্যানিটেশান। চিন্তা করেছো স্যানিটেশানের কী অবস্থা, আরে যে বাঙালি মুসলমানেরা এখন পর্যন্ত হাগা শেখেনি, তারা বানাবে সিনেমা, ফুঃ। কাসেদের মনে হয়েছে, লোকটার নাকউঁচু দশার জন্য আসলে কিছু হলো না। বুনুয়েল বার্গম্যান ফেলিনি কুরোসাওয়া তারকোভস্কি সত্যজিৎ ঋত্বিক মৃণাল বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের নিচে ফিল্মকে ভাবতেই পারে না। বলে, সিনেমা ইজ ডেড, সিনেমা আর হবে না, শেষ, সব শেষ। এখন যা হচ্ছে তা সিনেমার নামে সিনেমা। কাসেদ তাকে বলতে চেয়েছিল, আগের তুলনায় পরে কিছু কেন হবে? কাসেদকে কি তার বাপকে দিয়ে বিচার করা যাবে, রুহিকে কি তার মাকে দিয়ে? একদিন দেখা হয়েছিল রুহির বাবা-মায়ের সঙ্গে, কাসেদের অস্বস্তি লেগেছে। রীতিমতো হিজাবপরা মা আর রীতিমতো স্যুটেডবুটেড কিন্তু মাথায় জিন্নাটুপি পরা রুহির বাপকে তার ভালো লাগেনি। অনেক ভাই-বোন বিধায় রুহি কী করছে, সেটা আলাদা করে ভাবেন না বাপ-মা। চার ভাই চার বোনের পরিবার। রুহি পড়ছে বড় ভাই রাফসানের আওতায়, পরিবারের সবার ছোট বলে। বড় আর ছোট বোন রাফসানের দায়িত্বে, (বড় বোনের বিয়েও হয়ে গেছে)। বাকি দুজনের দায়িত্ব আলাদা আলাদা করে পরের দুই ভাইয়ের। ছোট ভাই কেবল চাকরিতে ঢুকছে। মফস্বল শহরে থাকা ওদের পরিবারের গ্রামেও জমিজায়গা কম ছিল না। তার একটা অংশ বিক্রি করে সেজ ভাইয়াকে দক্ষিণ কোরিয়ায় পাঠানো হয়েছে। রুহি মাঝে মাঝে কাসেদকে বুকে নিয়ে বা নিজে কাসেদের বুকের ওপর শুয়ে এসব গল্প বলে। কাসেদ কোনো গল্প বলে না, কী করেছে সারা দিন তাও বলে না, চুপচাপ থাকে। আগেও চুপচাপই ছিল, এখন আরো। সেদিন রাতে আলখাল্লাওয়ালা নিজের সঙ্গে দেখা হওয়ার অনেক রাতে বাসা ফিরে, গেটের চাবি তো সব সময় থাকে তার কাছে, তাও মাঝে মাঝে ভয় হয় নতুন তালা লাগিয়ে দিয়েছে কিনা। সেদিন তালা খুলতে গিয়ে থর থর করে কেঁপে ওঠে, দেখে হাত দুটো গলে যাচ্ছে, তার হাত থেকে চাবি পড়ে যায়। সেদিন যেটা হলো মোমের মতো টপ টপ করে গলে মাংসের দলা বাড়ি ঢোকার মুখে বাঁধানো চত্বরের পড়ছিল। আরেকটু হলে সে চিৎকারই করে উঠত। ঠিক তখন আবার গলাটা থেমে যায়। নতুন তালা লাগানো হলে গার্ডচাচাকে ডেকে তুলতেই হবে, নইলে রুহিকে ফোন করতে হবে, সে আরেক বিরক্তিকর ব্যাপার। কাউকে এতটুকু বিরক্ত করবে না এমন একটা প্রতিজ্ঞাই বোধহয় তোমার আছে, রুহির এ কথায় মৃদু হেসেছিল। সেদিন গভীর রাতে ভাত খেতে খেতে, রুহি তাকে ভালোবাসে বলেই হয়ত বুঝতে পারে। কাউকে বুঝলে ভালোবাসা যায় হয়ত, কিন্তু ভালোবাসলেই সত্যিকারভাবে বোঝা যায় এটা রুহি ফের প্রমাণ করল। রুহি কখনো বলেনি, কিন্তু কাসেদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, আইয়াজ ও তানহা আর নিহাদ ও আনিতার ভেতরে ভালোবাসার বদলে আছে কেবল হিসাব আর শরীর। বিয়ে যে অর্থে একটি অর্থনৈতিক ও জৈবিকক্ষুধা নিশ্চিতকরণ চুক্তি, সেদিক থেকে অন্য দুই জোড়া একসঙ্গে থাকছে এবং রুহি ও কাসেদের দিক থেকে তারা, বা কাসেদ ও রুহি তাদের দিক থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। কারণ হুটহাট করে কোন কিছু তারা দুজনের কেউ পেতে আগ্রহী নয়। ফলে সেদিন রাতে ফিরে রুহির কাছে যখন শোনে আইয়াজ ও তানহা আর এখানে থাকবে না, নিহাদ ও আনিতাও চলে যাবে, শুনে মোটেও অবাক হয়নি। কোনোরকম আবেগের বলকও ওঠেনি শরীরে বা মনের কোথাও। এত দিন একসঙ্গে থাকল, এত স্মৃতি আনন্দ হাসি গান, প্রায় সাত আট বছরের বন্ধুত্ব। বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি ছিল তাদের মেলামেশা একসময়। কাসেদ বলে, তাহলে তো আমাদেরও এখানে থাকা চলে না, এবার তাহলে কাজির কাছে যেতেই হয়। কারণ ঢাকা শহরে কে আমাদের ঘর ভাড়া দেবে, চিন্তা করে দেখতে হবে। আমাদের নিজেদের মতো থাকা তাহলে শুরু হলো, এটা কঠিন। কিন্তু এই কঠিনটাই সামনের অনেক কিছু সহজ করে দেবে। এরপর তেমন কিছু ঘটে না, কেবল কাসেদ দেখে তার নিজের হাতদুটোর দিকে তাকালে আর ভয় লাগে না। গলে গলে ফের স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ার লীলা থামিয়ে দিয়েছে হাতদুটো।
‘‘একে একে বানিয়ে তুলব সব, তুমি দেখে নিয়ো।
বাড়িঘর, খেতখামার,
উঠোনে লাউয়ের মাচা, জানলার পাশে
লতানে জুঁইয়ের ঝাড় –
একে একে সমস্ত বানাবো, তুমি
দেখে নিয়ো
দক্ষিণে পুকুর থাকলে ভাল হয়, তুমি বলেছিলে।
অবশ্য থাকবে।
পুকুরে হাঁসের স্নান দেখতে চাও, সে আর এমন
কী বেশী কথা,
সাদা ও বাদামী হাঁস ছেড়ে দেব।
যা চাও সমস্ত হবে,
একই সঙ্গে হয়ত হবে না, কিন্তু
একে-একে হবে।
ভালবাসা থাকলে সব হয়।
দেখো, সব হবে।
যা-কিছু বানানো যায়, আমি সব
দুই হাতে দিনে-দিনে বানিয়ে তুলব, তুমি দেখে নিয়ো।’’
শেষ করে রুহি বলে, জানো, এই স্বপ্নটা আমি কখনো হারাতে চাই না, কাসেদের বার বার মনে জেগে উঠে ফের হারিয়ে যায় কথাটা। একই সঙ্গে হয়ত হবে না, কিন্তু একে-একে হবে। কাসেদ রুহিকে শোনায় ওর বন্ধু নাহাজ হাবিবের কবিতার একটা লাইন, ‘আমি তোমাকে করে তুলব আমার আরোগ্যহীন বেদনার সমান’। রুহি মজা করে বলে, বেদনা না বলে বলো অসুখ, তোমার আরোগ্যহীন অসুখ। কাসেদ বারবার বলে, অনেক আদর করে বলে রু, আমার রুহ, আমাকে এত ভালোবেসো না জান, আমার রুহ, আমার রু। কাসেদের রু কখনো রুহ। এত্ত ভালো লাগে রুহির। কাসেদ বলে, ভালোবাসা বেশি বেসো না, জীবনকে একেবারে বারোটা বাজিয়ে দেয়। রুহি হি হি করে হাসে। সুযোগ পেলেই তাদের ভালোবাসা চলে দিনে রাতে সারাদিন। অন্য দুই জুটি কেবল রাতে ফেরে। নিজের ঘরে রাখা টেবিলে, যেটা পড়ালেখার জন্য কাজে লাগে, খাবারের জন্যও কাজে লাগে। তাতে বসে খেয়ে নিয়ে যে যার মতো দরজা বন্ধ করে দেয়। রুহি ও কাসেদের তো কোনো দরজা নেই। অন্য দুই জুটির দরজা সারা রাতই বন্ধ থাকে। কেবল নিজেদের অ্যাটাচড বাথ নেই বলে রাতে দরকার হলে আনিতা ও নিহাদ দরজা খোলে কমন যে বাথরুমটা আছে সেটা ব্যবহারের জন্য। প্রায় সকালে দুজনে একসঙ্গে গোসল করে নেয়। এতে সময়, পানি কম সব বাঁচে, আর প্রেমটাও বলে জমজমাট থাকে। তাদের দেখাদেখি আইয়াজ আর তানহা কয়েকদিন করে বাদ দিয়েছে। তারা বলে অতটা রোমান্স পায়নি। রুহি অবশ্য সুযোগে থাকে কাসেদকে নিয়ে একসঙ্গে গোসল করার। সময়টা ভীষণ জান্তব উন্মত্ত ও উদ্দাম হয়ে ওঠে, যেটা পর্দাটানানো চৌকিতে পাওয়া বাকি থাকে, তার পুরোটুকু উসুল করা হয় গোসলখানায়। সবসময় সুযোগ মেলে না, কারণ অনেকসময় দেখা গেল ওই চারজনের কেউ না কেউ বাসায় থাকছে। বিশেষ করে নিহাদ ও আনিতা, তাদের যেকোনো একজন প্রায় বাসায় থাকে। টিউশনির রুটিন পাল্টালে, বাসায় বিসিএসের প্রস্তুতি নেয়। সেটা হয় আইয়াজ, তানহা, নিহাদ ও আনিতাদের সবাই যখন বাইরে। দুই জুটিই বেরুনোর সময় নিজেদের ঘরগুলি তালা মেরে দেয়। প্রথম দিকে খোলাই থাকত, কিন্তু আইয়াজের ল্যাপটপ চুরির পর থেকে দুই জুটির কেউই আর ঘর খোলা রেখে বেরোয় না। কাসেদ টের পায়, ভার্সিটিতে পড়ার সময় এই ছয় জনের কোনো ভেদ না থাকলেও এখন একটু একটু করে আলাদা হতে শুরু করেছে সবাই। রুহি এজন্য একটু দুঃখ করে, তাই হাতে টাকা এলেই সে সবাইকে দাওয়াত করে পোলাও রোস্ট ইলিশ খাসির রেজালা সঙ্গে সালাদ মিষ্টি দিয়ে ছোটখাটো ভোজের আয়োজন করে প্রায়ই। প্রথম প্রথম তাতে অন্য দুই জুটির আগ্রহ থাকলেও, আর খাওয়ার সময় হৈ চৈ করে মজা করে খাওয়ার মেজাজটা থাকলেও পরে কেটে গেছে। তারা যে খুব হিসেবি কখনো মনে হয় না, হিসেবে চললে টাকা থাকে, টাকা আসে। আর ভালোবাসায় চললে টাকা এলেও চলে যায়, থাকে না রুহিই বলে। কিন্তু তারপরও আমি ভালোবাসায়ই চলতে চাই, হিসেবে নয়। বাকিদের কথা মনে হলে, ক’টি কথা নিজেদের দিকেই ফিরে আসে রুহির বলতে ইচ্ছা করে, ‘ঘনিষ্ঠ আকাশ যেন যেন কোন্ বিকীর্ণ জীবন/ অধিকার করে আছে ইহাদের মন’। বাসায় তার কাছে ‘জীবনানন্দ দাশের কাব্যসমগ্র’ আর ‘সুজিত সরকার নির্বাচিত ১০০’ ‘দেওয়াল তুললেই ঘর/ ভেঙে ফেললেই পৃথিবী,’ কাসেদ শুনে বলে, ভেঙে ফেলাটাই কঠিন। দেওয়াল তোলাটাই বরং সহজ, নাকি ভুল বললাম; বলেই কাসেদ নিজের হাতের দিতে তাকায়। ভয়ে ভয়ে নিজের হাতটা দেখে, গলে গলে যাচ্ছে না তো? কথাটা রুহিকেও বলতে পারেনি, বললে হয়ত চিন্তায় পড়ে যাবে। রুহিকে কোনো সমস্যার কথা, বিশেষ করে নিজের শারীরিক সামান্য সমস্যার কথা বললে রুহি অস্থির হয়ে ওঠে। আজ সব বন্ধ, আজ ডাক্তারের কাছে চলো। কীভাবে রুহিকে বলে, এমনিতে হাতে টাকা থাকে না, কিন্তু তখন কোথা থেকে যে রুহির টাকা বের হয়। আজকাল যখনই সে তার হাতের দিকে তাকায়, দেখে হাতটা কব্জি থেকে বার বার গলে যাচ্ছে, এসময় কোনো ব্যথা হয় না। মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে পাশের কোনো লোককে বলতে, দেখেন তো ভাই আমার হাতটা ঠিকমতো আছে কিনা। এটা বললে লোকে আবার তাকে না জানি কী ভেবে বসে। রুহিকে তো বলাই যায় না, সে আছে স্বপ্নের ভেতর, আগামীর আনন্দে ডুবে। রুহিকে বাঁচিয়ে দিয়েছে তার আপন বড় ভাই রাফসানের প্রশ্রয়। রুহি বলে, ভাইয়াই তো লাই দিয়ে আমার মাথাটা খারাপ করেছে। নিজে আর্কিটেক্ট, টাকাপয়সা আয়ের কোন সীমা পরিসীমা নেই। তার ওপর আছে কবি মন। রাফসান বলে, আর্কিটেক্ট মানে তো শিল্পীই, তাই নারে। তারা একেবারে পাথর নয়। জানিস, আজব ইচ্ছা ছিল, এ দুনিয়ার প্রত্যেকটি দেশে যাবো। এজন্য তোর মতো জিওগ্রাফিতে পড়ারই ইচ্ছা ছিলো। আছেই তো দুটো জিনিস। একদিকে আমি, অন্যদিকে দুনিয়া, দুনিয়া মানে ভূগোল। রুহি বলে, তোমার কোনো সন্দেহ আছে ভাইয়া? কাসেদ জানে রুহির প্রধান গুণ ও দোষ হলো মানুষের ওপর বিশ্বাস। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে, একদিন সব হবে, এটা তার অসুখের মতো হয়ে গেছে। সংসার, রান্নাবাড়া, আর ভালোবাসা। নিজের শরীর নিয়ে রাজ্যের ফ্যান্টাসি, বিছানায়ও এজন্য ধেনুক সবচেয়ে পছন্দের। এতে রাজ্যের ফ্যান্টাসি ভিড় করাতে পারে সে। কাসেদকেও সম্পূর্ণভাবে পায়, পুরোটা নেওয়া যায় ভেতরে, বা চলে যায়। প্রথম দিকে কাসেদের এতে অতি উত্তেজনা চলে আসত, পরে সহ্য করে নিয়েছে। অনেকক্ষণ নিজেকে সে ধরে রাখতে পারে। দমাদম নিরবচ্ছিন্ন চালিয়ে নিতে পারে, আই লাভ ইয়োর স্ট্যামিনা, রুহি বার বার বলে। দেখেছে শুরু থেকেই নিজেকে অনেকক্ষণ ধরে রাখতে পারে কাসেদ। কিন্তু তার প্রিয় ধেনুকে এলেই নাজুক হয়ে যায়। পরে ধেনুকেও অভ্যস্ত হয়েছে, আসলে করিয়েছে। টানা একুশ দিন পিসিমাসলের ব্যায়াম করিয়ে করিয়ে। তবু মনে হয় সবমিলিয়ে রুহির সঙ্গে সে পেরে ওঠে না। পুরুষের তুলনায় নারীর আহার দ্বিগুণ, বুদ্ধি চারগুণ, কাজের উদ্দীপনা ছয়গুণ, আর কামশক্তি আটগুণ বেশি। রুহি এর সার্থক নমুনা, রাত্রিভোর সাঁতারিয়েও পার হওয়ার উপায় নেই কোনো। রুহি যেন এক অন্তহীন সমুদ্রের মতো, যার তীর আছে পার নেই। আসলে তো সব সমুদ্রেরই পার আছে, আবার কোনোটারই কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই। রুহি বলে, আমরা নিজে শরীরের জিওগ্রাফিও জানি না, জগতেরও জিওগ্রাফিও জানি না। কাসেদ শরীরের কথা শুনলে ভয় পায়, তার হাতের কথা মনে হয়। হাতটার কী হলো, রুহি জানে না, স্বাস্থ্যে আর সুস্থতায় ঝলমল করছে দিনরাত। আর শরীরের ব্যাপার জেগে উঠলে রুহি আর মানুষ থাকে না। হয় একটা ইন্দ্রলোকের কেউ বা একটা আস্ত জানোয়ার হয়ে ওঠে। দাঁতে নখে কী পাগলপারা রূপান্তর হয় তার। আমি তোমার একান্ত বিশ্বস্ত রুহি, তুমি আর যাই করো, আমাকে কোনোদিন ঠকিও না। রুহি কাসেদকে বহুবার বলেছে এ কথা, কাসেদ জানে, যে কাজের দিকে সে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে, তার কপালে নাটক সিনেমা আর বিজ্ঞাপন তৈরির মানুষ হয়ে ওঠারই সম্ভবনা। আর তা হয়ে ওঠা মানে রাজ্যের মানুষ আর হরদম মেয়েমানুষ ঘাঁটাঘাঁটি করা। পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে পাস করা জাদিদুল আমিন তাকে বলেছিল, আমি তো কবিতা থেকেই ফিল্মে গেছিলাম। ফিল্মকে কবিতার তুলনায় এত ফাঁপা মনে হয়, যখন এমন সব লোকজনের সঙ্গে কথা বলা লাগে, দেনদরবার করা লাগে, অভিনয় জানে না, কেবল বিখ্যাত হওয়ার শখ। শরীর ভাড়া দেওয়ার রাস্তা খোঁজা নারীরা, আর টাকায় ধান্দায় থাকা দালালেরা, রিড্ডিকুলাস, এদেশে কিছু হবে না। বাঙালিদের দিয়ে আর কিছুই হবে না, না ফিল্ম না ফুটবল, সিনেমা কিংবা স্যানিটেশান। চিন্তা করেছো স্যানিটেশানের কী অবস্থা, আরে যে বাঙালি মুসলমানেরা এখন পর্যন্ত হাগা শেখেনি, তারা বানাবে সিনেমা, ফুঃ। কাসেদের মনে হয়েছে, লোকটার নাকউঁচু দশার জন্য আসলে কিছু হলো না। বুনুয়েল বার্গম্যান ফেলিনি কুরোসাওয়া তারকোভস্কি সত্যজিৎ ঋত্বিক মৃণাল বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের নিচে ফিল্মকে ভাবতেই পারে না। বলে, সিনেমা ইজ ডেড, সিনেমা আর হবে না, শেষ, সব শেষ। এখন যা হচ্ছে তা সিনেমার নামে সিনেমা। কাসেদ তাকে বলতে চেয়েছিল, আগের তুলনায় পরে কিছু কেন হবে? কাসেদকে কি তার বাপকে দিয়ে বিচার করা যাবে, রুহিকে কি তার মাকে দিয়ে? একদিন দেখা হয়েছিল রুহির বাবা-মায়ের সঙ্গে, কাসেদের অস্বস্তি লেগেছে। রীতিমতো হিজাবপরা মা আর রীতিমতো স্যুটেডবুটেড কিন্তু মাথায় জিন্নাটুপি পরা রুহির বাপকে তার ভালো লাগেনি। অনেক ভাই-বোন বিধায় রুহি কী করছে, সেটা আলাদা করে ভাবেন না বাপ-মা। চার ভাই চার বোনের পরিবার। রুহি পড়ছে বড় ভাই রাফসানের আওতায়, পরিবারের সবার ছোট বলে। বড় আর ছোট বোন রাফসানের দায়িত্বে, (বড় বোনের বিয়েও হয়ে গেছে)। বাকি দুজনের দায়িত্ব আলাদা আলাদা করে পরের দুই ভাইয়ের। ছোট ভাই কেবল চাকরিতে ঢুকছে। মফস্বল শহরে থাকা ওদের পরিবারের গ্রামেও জমিজায়গা কম ছিল না। তার একটা অংশ বিক্রি করে সেজ ভাইয়াকে দক্ষিণ কোরিয়ায় পাঠানো হয়েছে। রুহি মাঝে মাঝে কাসেদকে বুকে নিয়ে বা নিজে কাসেদের বুকের ওপর শুয়ে এসব গল্প বলে। কাসেদ কোনো গল্প বলে না, কী করেছে সারা দিন তাও বলে না, চুপচাপ থাকে। আগেও চুপচাপই ছিল, এখন আরো। সেদিন রাতে আলখাল্লাওয়ালা নিজের সঙ্গে দেখা হওয়ার অনেক রাতে বাসা ফিরে, গেটের চাবি তো সব সময় থাকে তার কাছে, তাও মাঝে মাঝে ভয় হয় নতুন তালা লাগিয়ে দিয়েছে কিনা। সেদিন তালা খুলতে গিয়ে থর থর করে কেঁপে ওঠে, দেখে হাত দুটো গলে যাচ্ছে, তার হাত থেকে চাবি পড়ে যায়। সেদিন যেটা হলো মোমের মতো টপ টপ করে গলে মাংসের দলা বাড়ি ঢোকার মুখে বাঁধানো চত্বরের পড়ছিল। আরেকটু হলে সে চিৎকারই করে উঠত। ঠিক তখন আবার গলাটা থেমে যায়। নতুন তালা লাগানো হলে গার্ডচাচাকে ডেকে তুলতেই হবে, নইলে রুহিকে ফোন করতে হবে, সে আরেক বিরক্তিকর ব্যাপার। কাউকে এতটুকু বিরক্ত করবে না এমন একটা প্রতিজ্ঞাই বোধহয় তোমার আছে, রুহির এ কথায় মৃদু হেসেছিল। সেদিন গভীর রাতে ভাত খেতে খেতে, রুহি তাকে ভালোবাসে বলেই হয়ত বুঝতে পারে। কাউকে বুঝলে ভালোবাসা যায় হয়ত, কিন্তু ভালোবাসলেই সত্যিকারভাবে বোঝা যায় এটা রুহি ফের প্রমাণ করল। রুহি কখনো বলেনি, কিন্তু কাসেদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, আইয়াজ ও তানহা আর নিহাদ ও আনিতার ভেতরে ভালোবাসার বদলে আছে কেবল হিসাব আর শরীর। বিয়ে যে অর্থে একটি অর্থনৈতিক ও জৈবিকক্ষুধা নিশ্চিতকরণ চুক্তি, সেদিক থেকে অন্য দুই জোড়া একসঙ্গে থাকছে এবং রুহি ও কাসেদের দিক থেকে তারা, বা কাসেদ ও রুহি তাদের দিক থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। কারণ হুটহাট করে কোন কিছু তারা দুজনের কেউ পেতে আগ্রহী নয়। ফলে সেদিন রাতে ফিরে রুহির কাছে যখন শোনে আইয়াজ ও তানহা আর এখানে থাকবে না, নিহাদ ও আনিতাও চলে যাবে, শুনে মোটেও অবাক হয়নি। কোনোরকম আবেগের বলকও ওঠেনি শরীরে বা মনের কোথাও। এত দিন একসঙ্গে থাকল, এত স্মৃতি আনন্দ হাসি গান, প্রায় সাত আট বছরের বন্ধুত্ব। বন্ধুত্বের চেয়ে বেশি ছিল তাদের মেলামেশা একসময়। কাসেদ বলে, তাহলে তো আমাদেরও এখানে থাকা চলে না, এবার তাহলে কাজির কাছে যেতেই হয়। কারণ ঢাকা শহরে কে আমাদের ঘর ভাড়া দেবে, চিন্তা করে দেখতে হবে। আমাদের নিজেদের মতো থাকা তাহলে শুরু হলো, এটা কঠিন। কিন্তু এই কঠিনটাই সামনের অনেক কিছু সহজ করে দেবে। এরপর তেমন কিছু ঘটে না, কেবল কাসেদ দেখে তার নিজের হাতদুটোর দিকে তাকালে আর ভয় লাগে না। গলে গলে ফের স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ার লীলা থামিয়ে দিয়েছে হাতদুটো।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন