ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়
হেই…হেট্…হেট্…
একপাল ভেড়া নিয়ে এগিয়ে চলেছে টেউ আয়ারশায়ার৷ বয়সে কিশোর, ভেড়া চরানোই তার জীবিকা৷ ছন্নছাড়া অনাথ৷ তিনকূলে কেউ নেই৷ সকালে বিকেলে দু’বার এই ভেড়ার পাল চরিয়ে, তাদের কচি ঘাস খাইয়ে সে ফেরত নিয়ে আসে আসে খামারে৷ সেখানে এসে জন্তুগুলোর মালিক দেখে নেয়, গুনতিতে সব ঠিক আছে কিনা৷ বিনিময়ে দু’বেলা খাওয়া আর সামান্য কিছু টাকা৷
কিন্তু প্রতিবছরই এই সময়টা বড্ড মন খারাপ হয়ে যায় টেডের৷ শীত এগিয়ে আসছে৷ প্রকৃতিতে রুক্ষ, ন্যাড়ান্যাড়া ভাব৷ কচি ঘাস আর কোথায়? ফলে কিছুটা জান হাতে করেই ওকে যেতে হয় গ্রাম ছেড়ে আরও দূরে, পাহাড়ের কাছে৷ সেখানে নেকড়ের উপদ্রব তো আছেই, তাছাড়া…
ভেড়াগুলো নিয়ে যে ও কোনদিকে এগোচ্ছে, ঘন কুয়াশায় ঠাহর করতে পারছে না৷ ওর সঙ্গী অন্য রাখালদের উদ্দেশ্যে ডাক দেয়, এই জিম, টম, হ্যারি…শুনছিস? কোথায় তোরা?
প্রত্যুত্তর ভেসে আসে অনেকটা নীচে থেকে… এই যে এখানে আমরা৷ তুই?
ইতিমধ্যেই রোদ্দুরের দাপটে কুয়াশা খানিকটা পাতলা হয়েছে৷ চোখ সরু করে তাকাতেই টেডের অন্তরাত্মা হিম হয়ে আসে, সর্বনাশ! সঙ্গীরা পাহাড়ের নীচে৷ আর সে পাহাড়ের একেবারে চূড়োয়৷ আর এখানেই তো সেই গর্তগুলো…
হেই..হেট্…হেট্…!
হাতের ছিপটি শূন্যে ‘সাঁ সাঁ’ করতে করতে পাগলের মতো ভেড়াগুলোকে তাড়া লাগায় টেড৷ দরকার নেই কচি ঘাস খাওয়ার৷ গত পরশুই ওর এক সঙ্গীর একটা ভেড়া খেয়েছে এই গর্তগুলো৷ তারপর মনিবের সে কী মার৷
ভেড়াগুলো তড়বড়িয়ে নীচে নামতে থাকে৷ তীক্ষ্ম দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে থাকে টেড, মনে মনে গুণে যাচ্ছে ও ভেড়ার সংখ্যা৷
আরে, আরে… হায় হায়! একটা ভেড়া অদৃশ্য হয়ে গেল!
টেড ছুটে গিয়ে দেখল, উপরে আলগা ঘাসের চাপড়া ভিতরে সেই গর্ত! ঘোর অন্ধকার! ভেড়াটা তার মধ্যেই ডুবে গেছে৷
এখন! এখন কী হবে? ভেড়াটা না নিয়ে ফিরলে ওর পিঠের চামড়া আস্ত থাকবে? আবার অন্যদিকে ওই ভয়াল কালো কালো গর্ত যার মধ্যে নাকি লুকিয়ে থাকে—
টেড উবু হয়ে বসে থাকে গর্তের সামনে৷ শূন্য দৃষ্টি৷ কী করবে, বুঝে উঠতে পারছে না৷ এই ফাঁকে আমরা বরং এই কাহিনীর পটভূমিকা একটু শুনে নিই৷
এই কাহিনীর সময়কাল আজ থেকে ৬০০ বছর আগে৷ সন তারিখ হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে৷ শুধু ঘটনাটা আর তার নায়ক টেড আয়ারশায়ারের নামই থেকে গেছে ।
স্থান…স্কটল্যান্ড৷ ব্রিটিশ যুক্তরাষ্ট্রেরই একটা অঙ্গরাষ্ট্র৷ সেই স্কটল্যান্ডের দক্ষিণে উঁচু মালভূমি ঘেঁষে দু-দুটো পর্বত… নিন্টো আর পেন্টল্যান্ড৷ এই দুই পর্বতশিরার মাঝের উপত্যকায় ছোট্ট এক গ্রাম৷ নাম কাফে৷ উষর, বন্ধুর জমি৷ ফসল প্রায় ফলে না বললেই হয়৷ গ্রামবাসীদের প্রধান জীবিকা মেষপালন৷
ওই গাঁয়ের অনেক কিশোর বাগালগিরি করে নিজের পেট চালায়৷ টেড যে তাদের মধ্যে একজন আগেই জেনেছি৷ কিন্তু সবারই বারণ আছে দূরের ওই পাহাড়ে ওঠার৷ ওখানে যে বাস করে ভয়ঙ্কর ‘দানো’!
হ্যাঁ, ‘কালো দানো’৷ বড় বড় যেসব গর্ত ছড়িয়ে আছে পাহাড়ের ওপরে, সেগুলো গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ৷ গর্তের উপর থেকে নীচের দিকে তাকালে দেখা যায় শুধু জমাট অন্ধকার৷ মাঝে মাঝে ওই গর্তগুলোর মাথায় কালো ধোঁয়াশা জমে, আবার অদৃশ্য হয়ে যায়৷
গ্রামবাসীদের দৃঢ় বিশ্বাস, ওই গর্তগুলোর মধ্যে বাস করে ‘কালো দানো’৷ তারই নিঃশ্বাসে ওরকম ধোঁয়া জমে গর্তের মাথায়৷ পশুপাখি মানুষ একবার ওর মধ্যে ঢুকলেই ‘দানো’ খেয়ে নেয় তাকে৷ তারপর সেই প্রাণীটার আত্মাই হয়ে যায় ‘দানো’-র সহচর… প্রেতাত্মা।
সুতরাং ইতিমধ্যে বেশ কিছু ভেড়া ওই ‘দানো’ খেয়ে ফেললেও কেউই সাহস দেখায়নি ওই গর্তে ঢোকার৷
আজ টেড আয়ারশায়ারের ভেড়াটি হারিয়ে গেলও টেড কিছুক্ষণ নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকে গর্তের বাইরে৷ নাঃ, কেউ তো বেরোল না৷ তাকাল নীচের দিকে৷ বাকি ভেড়ার পাল তড়বড় করতে করতে নেমে গেছে উপত্যকায়৷
কী করবে ও? চলে যাবে এই ভেড়াটার মায়া ছেড়ে? তারপর তো সেই অতীতের পুনরাবৃত্তি…। বেদম পিটুনি আর মজুরি, দানাপানি বন্ধ!
হেই টেড্, হেই…চলে আয়! চলে আয়…!
হইহই করতে করতে ছুটে আসছে টেডের সঙ্গীসথী জিম, টম, হ্যারিরা৷ হাঁপাতে হাঁপাতে তারা টেডের কাছে এসে ওর হাত ধরে টান মারে, এই টেড, চল্! এখানে এই দানোর গর্তের সামনে বসে কী করছিস? চল্ চল্!
নাঃ…! টেড মাথা নাড়ে, আমি যাব না৷
মানে? বন্ধুরা হকচকিয়ে গেল৷
আমি এর ভেতরে ঢুকব৷ দানবের সঙ্গে লড়াই করে ভেড়াটাকে নিয়ে আসব৷ টেড জবাব দেয়৷
বন্ধুরা স্তম্ভিত৷ নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে বলে, ভেড়ার চিন্তায় মাথাটা ওর গেছে! ওকে টেনে নিয়ে যেতে হবে৷
বন্ধুরা ওকে জাপটে ধরে, চল্ টেড চল্! পাগলামি করিস্ নে!
না-আ-আ! চিৎকার করে উঠল টেড আমি দানোর সঙ্গে বোঝাপড়া করে তবেই যাব৷ যা, তোরা চলে যা…!
বলতে বলতে সে এমন ঝটকা মারে, বন্ধুরা সব ছিটকে যায় চতুর্দিকে৷
জিম বিড়বিড় করে বলে ওঠে, ওরে! টেডকে নির্ঘাৎ দানোয় পেয়েছে! আর রক্ষে নেই৷
টেড ততক্ষণে মোটা একটা খুঁটি পুঁতে ফেলেছে গর্তের মুখের কাছে৷ ভেড়া বাঁধার চামড়ার রজ্জু সে বেশ ভালমতন পাকিয়ে নেয় খুঁটির সঙ্গে৷ দড়িটার অন্যপ্রান্ত ধরে টেড এগিয়ে যায় গর্তের দিকে…
অপেক্ষমান সাথীরা রুদ্ধশ্বাস৷
দড়ি ধরে টেড নামছে…আস্তে আস্তে দড়ি ছাড়ছে…আরও নীচে…হ্যাঁ, এই তো পা ঠেকেছে৷
দড়িটা আঁকড়ে কয়েকমুহূর্ত নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে টেড৷ উঃ, কী নিকষকালো অন্ধকার৷ কোথায়, কোথায়…দানো? কোথায় ওর ভেড়া?
ধীরে ধীরে টেডের চোখ সয়ে যাচ্ছে৷ ওই তো উপরের মুখ দিয়ে ক্ষীণ আলোর রেখা এসে ঢুকেছে৷
আবছা আলোয় টেডের চোখে পড়ল গর্তটা বোঝাই কালো কালো একরকম গুঁড়োয়৷ ওই তো…ওই তো! কোণের দিকে কী একটা নড়ছে না?
হামাগুড়ি দিয়ে সেদিকে এগোতে যেতেই টেডের পায়ে একটা কী ঠেকল৷ একটা কঙ্কাল৷ আগের কোনও হতভাগ্য ভেড়ার স্মৃতি৷
দু’হাত দিয়ে এবার টেড জাপটে ধরে ওর হারানিধিকে৷ আঃ! ভেড়াটা এখনও বেঁচে আছে৷
টেডের সারা শরীর বেয়ে আনন্দের বাতাস বয়ে যায়, ও পেরেছে! ও পেরেছে ‘দানো’কে জয় করতে৷
ভেড়াটাকে একহাত দিয়ে বুকে জড়িয়ে অন্যহাতে টেড শক্ত করে ধরে চামড়ার রজ্জুটা, এবার ওপরে ওঠার পালা৷
অমানুষিক কষ্ট! হাঁচড়ে-পাঁচড়ে ঊঠে মুখ বাড়াল টেড৷ চিৎকার করে উঠল, জিম, টম! দ্যাখ দ্যাখ আমি পেয়েছি! এই যে, এই যে আমার ভেড়াটা!
ও কী…ও কী! ওরা ছিটকে আরো দূরে সরে যাচ্ছে কেন?
ভেড়াটাকে বাইরে তুলে দিয়ে শরীরে ঝাঁকুনি মেরে বাইরের খোলা বাতাসে এসে দাঁড়াল টেড! বুকভরে শ্বাস নিল৷
কিন্তু আরে! ওরা যে সব দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে! ওদের চোখে ভয় আর আতঙ্ক৷ তাহলে… পরক্ষণেই টেডের চোখ পড়ে নিজের আর ভেড়াটার দিকে৷ চেনাই যাচ্ছে না ভেড়াটাকে৷ কালো কুচকুচে, শুধু পিটপিট করছে চোখদুটো৷ আর নিজের অবস্থা? সর্বাঙ্গ ঢেকে গেছে কালো গুঁড়োয়! ঠিক যেন আগুনে পোড়া ভূত৷
তাহলে ওকেই নির্ঘাৎ ‘দানো’ ভেবেছে ওরা! তড়িঘড়ি ফের হেঁকে উঠল টেড, ওরে শোন্ শোন্!
আমি টেড, তোদের টেড! পালাস না।
কে শোনে কার কথা! ঊধর্বশ্বাসে ‘দানো দানো’ চিৎকার করতে করতে ছুটে পালাচ্ছে টেডের সহকর্মী বন্ধুরা৷
টেড নিশ্চল হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে৷ তারপর ঝাড়তে শুরু করে কালো গুঁড়োর রাশি৷
খানিকটা সাফসুতরো হয়ে প্রায় ঘণ্টাখানেক পর টেড রওনা দেয় গাঁয়ের দিকে৷ ইতিমধ্যে বেশ খানিকটা ধাতস্থ হয়েছে টেড৷
উপত্যকা বেয়ে গ্রামের কাছাকাছি আসতেই দূর থেকে টেডের হঠাৎ চোখে পড়ে… কী ব্যাপার! রাস্তার মুখেই গাঁয়ের ছেলেবুড়ো মেয়েরা সব ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে৷
আনন্দে নেচে ওঠে টেডের মন ৷ নিশ্চয়ই সবাই ওকে স্বাগত জানাতে এসেছে! ভারিক্কি চলে মেষশাবককে বুকে জড়িয়ে টেড এগিয়ে যায়৷
কয়েক পা এগোতেই হঠাৎ সম্মিলিত চিৎকার ভেসে এল৷ টেডের পা দুটো গেঁথে গেল।
‘টেড, খবরদার তুমি আর এগিও না! ফিরে যাও৷ তোমায় দানোয় পেয়েছে৷ গাঁয়ে তোমার স্থান নেই৷…ফিরে যাও৷…খবরদার৷…’
না-না-না! টেড আর্তনাদ করে ওঠে, দানো-টানো সব বাজে কথা৷ শুধু কালো গুঁড়ো। বিশ্বাস করো, আমি তোমাদেরই টেড৷ এই যে হারানো ভেড়াটা৷
কয়েক মুহূর্তের জন্যে নীরবতা নেমে আসে৷ টেড লক্ষ্য করে, ওদের গাঁয়ের, তুক্তাক্ করা ওঝা মোড়লকে কীসব বলছে৷ তারপরই শোনা যায় মোড়লের গলা, তোমায় বিশ্বাস করি না৷ তুমি চলে যাও৷ ওই ভেড়াটাও নিয়ে যাও৷ এ গাঁয়ে তোমার জায়গা হবে না৷
টেড হতভম্ব হয়ে দেখে, ওঝা চকমকি ঠুকে জড়ো করা ঘাসপাতায় আগুন জ্বালল৷ তারপর ঝোলা থেকে কীসব বের করে আগুনে ফেলতে লাগল আর চেঁচিয়ে বলতে লাগল, হে টেড দানো! তুমি ফিরে যাও তোমার জায়গায়৷ আমরা তোমাকে কোদাল, কুড়ুল, শাবল দিচ্ছি৷ ঘর বানিয়ে তুমি ওখানেই থাকো৷ ভেড়াটা তোমায় উপহার দিলাম৷ রোজ তোমাকে খাবার দিয়ে আসব৷ চলে যাও টেড দানো৷ আমাদের একান্ত মিনতি৷
ওদিক থেকে কোদাল শাবল শূন্যপথে উড়ে আসতে লাগল৷ টেড নিশ্চিত হল, তার গাঁয়ে ফেরার পথ বন্ধ হয়ে গেছে৷
কুড়িয়ে নিল টেড৷ আকাশের দিকে তাকাল৷ দ্রুত দুপুর গড়িয়ে আসছে৷ বিকেল, তারপরেই অন্ধকার রাত্রি৷
টেডের জীবনেও কি অন্ধকার নেমে আসছে? সম্পূর্ণ একা নির্জন পাহাড়ে তাকে বাকি জীবন কাটাতে হবে? সর্বাঙ্গে অসহ্য ক্লান্তি৷ বিপর্যস্ত টেড আবার পাহাড়ের দিকে রওনা হয়।
মাসাধিকাল কেটে গেছে আসছে৷ পাতা ঝরা, রুক্ষ বনেপ্রান্তরে শীতের পদধ্বনি৷
টেড বেঁচে আছে৷ বেঁচে আছে লড়াই করে৷ হ্যাঁ, সে বাঁচবেই, তাকে বাঁচতেই হবে৷ সে প্রমাণ করে দেবে, সব্বার ধারণা কত ভুল৷
কাঠকুটো দিয়ে মাথা গোঁজার ছোট্ট একটা ছাউনি বানিয়ে নিয়েছে টেড৷
দুপুরে খাবার নিয়ে আসে ওঝা৷ আর রোজই তার এক কথা… কি রে, কিছু মন্ত্রতন্ত্র পেলি? আমায় দে৷ দানো কী বলেছে, বল্৷
‘দানো’ যে নেই, তা সে বিশ্বাস করে না৷
এইভাবে চলতে চলতে একদিনে ওঝার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়, তুই ব্যাটা মিথ্যেবাদী৷ ইচ্ছে করে আমায় মন্ত্র দিচ্ছিস না৷ ঠিক আছে, আজ না বললে, কাল থেকে আর ‘দানা’ পাবি না৷
তবে রে বদমাস বুজরুক! টেডের সমস্ত সংযম ভেঙে যায়৷ সহসা হিংস্রভাবে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে৷ চেপে ধরে ওঝার টুঁটি- মন্ত্র চাই! এই নে মন্ত্র৷ নে-নে!
বলতে বলতে সে ‘ক্যাত ক্যাত’ করে ওঝাকে লাথি মারতে থাকে, দিতে হবে না খাবার! শয়তান নরকের কীট! বেরো বেরো!
ওঝা প্রাণভয়ে ছুট দিল।
ওঝা তো পালিয়ে গেল, কিন্ত এবার কীভাবে চলবে? নিজেকেই নিজে ধিক্কার দিল টেড, কেন যে এত তাড়াতাড়ি মাথা গরম হয়ে গেল!
ওঝা খাবার নিয়ে আসত আর সেইসঙ্গে নিয়ে আসত কাঠকুটো৷ এবার তো ওকে এই ঠান্ডাতেই মরতে হবে৷
সন্ধে ঘনিয়ে এল৷ অবশিষ্ট কাঠকুটো দিয়ে আগুন জ্বালল টেড৷ এ কী! আজ এত ঠান্ডা লাগছে কেন?
ছাউনির বাইরে মুখ বাড়াতেই শিউরে উঠল টেড৷ টুপটুপ করে বরফ পড়া শুরু হয়েছে৷ কাঠপাতাও শেষ হয়ে এসেছে৷ নিবু নিবু আগুন৷ উ-হু-হু…কী শীত, অসাড় হয়ে যাচ্ছে হাত পা৷
চকিতে টেডের মনে পড়ল, আচ্ছা, ‘কালো দানো’র গর্তের মধ্যে যখন ও নেমেছিল, বেশ গরম লেগেছিল৷ নামবে একবার?
যেমন ভাবা, তেমন কাজ৷ সেই চামড়ার দড়ি তেমনই ঝোলানো আছে। টেড ঝুলে পড়ল৷
আরে, ভেতরটা সত্যিই দারুণ গরম! টেড গুটি সুঁটি মেরে পড়ে থাকে৷
কিন্তু একটু পরেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে৷ ভেতরে একফোঁটা বাতাস নেই৷
নাহ্, ওকে প্রকৃতিই বাঁচতে দেবে না৷
ফিরে এল আবার ছাউনির ভেতরে৷ বাইরে সমানে তুষারপাত৷ অবর্ণনীয় হাড়হিমঠান্ডা৷ আগুনের দু-একটা ফুলকিই দেখা যাচ্ছে৷ দুচ্ছাই! এটাকেই আগুনে পোড়ানো যাক্৷
কিন্তু গা থেকে জ্যাকেট খুলতে যেতে তার উপরে লেগে থাকা কালো গুঁড়োগুলো আগুনের উপর পড়তে থাকে৷
পরক্ষণেই চমৎকৃত হয় টেড, তাজ্জব ব্যাপার! ওগুলো পড়তেই ফুলকি দিয়ে আগুন জ্বলে উঠল!
তাড়াতাড়ি ট্রাউজার, হাত মুখ ঝাড়তে থাকে টেড৷ আর চোখ বড় বড় করে দেখে, যত ওই কালো গুঁড়ো ঝরে পড়েছে, ততই নিভন্ত আগুন জেগে উঠছে৷ বেশ গরমও হচ্ছে৷
তাহলে? তাহলে ওই দানোর গুঁড়ো আগুন জ্বালতে পারে? আশ্চর্য! চটপট বড় ঝুড়ি আর কোদাল নিয়ে টেড নেমে পড়ল অন্ধকার গর্তটায়৷ কোদাল দিয়ে সে সজোরে কোপ মারতে শুরু করল গর্তের গায়ে। কালো কালো চাঙড় আর ধুলো তুলতে লাগল ঝুড়িতে৷
এবার ঝুড়ি বোঝাই করে হাঁপাতে হাঁপাতে আবার আস্তানায়, আগুনের সামনে৷
প্রথমে খানিক কালো গুঁড়ো ঢালতেই সতেজে জ্বলে উঠল আগুন৷ কী রং আগুনের! লাল টকটকে৷ তারপর ছোট ছোট টুকরোগুলো ফেলতেই। আরিব্বাস! কী ধোঁয়া! তার সঙ্গে দারুণ গরম!
উষ্ণতায় শরীর জুড়িয়ে গেল টেডের৷ ধোঁয়া একটু কমতেই টেডের চক্ষুস্থির৷
কালো কালো টুকরোগুলো এরমধ্যেই আগুনের রং নিয়ে নিয়েছে৷ লাল টকটক করছে৷
আস্তে আস্তে ধোঁয়া একদম কমে গেল৷ কিন্তু আগুনের তেজ কী? গনগন করছে লাল লাল টুকরো! ছাউনির ভেতরটা এখন ফায়ারপ্লেসের চেয়েও অনেক গরম৷
টেড পরম আরামে ঘুমিয়ে পড়ল৷
পরদিন সকালে ওর ঘুম ভাঙল৷ ছাউনির বাইরে কিছু কণ্ঠস্বর, নির্ঘাৎ মরেই গেছে৷ চল্ দেখে আসি৷ যা বরফ পড়েছে কাল৷
তড়াক করে লাফিয়ে উঠল টেড৷ উঁকি মেরে দেখল, গাঁয়ের মোড়ল আর সঙ্গে ওরই সঙ্গীসাথী, কিশোর যুবকরা৷
মরে গেছি? দাঁড়াও, দেখাচ্ছি তোমাদের৷ চট করে চিমটে দিয়ে একখণ্ড জ্বলন্ত কালো টুকরোকে ধরে ছিটকে বাইরে এল টেড, এই যে আমি৷ আর এই দেখো, দানোর কলজে, জ্বালিয়েছি৷ লাল টকটক করছে, জ্বলছে৷
বলতে বলতে সে দৌড়ে গিয়ে মোড়লের হাত ধরে, এসো, এসো, ভয় কী! দেখো ভেতরটা কেমন গরম! পারবে তোমাদের ওই বুজরুক ওঝা এমন গরম করতে? পারবে এমন ধোঁয়াছাড়া লাল আগুন জ্বালাতে?
মোড়ল শুধু নয়, তার দলবলও স্তাম্ভিত।
কয়েক মুহূর্ত পরে মোড়ল টেডের সামনে এসে হাতজোড় করে দাঁড়াল, আমরা অন্যায় করেছি টেড৷ আমাদের ক্ষমা করো৷ আজ থেকে তুমি হবে গাঁয়ের ওঝা৷ আর এ জায়গাটাও তোমাকেই আমরা দিলাম৷ দানোর সবকিছু তোমারই সম্পত্তি৷
টেডের এখন মহা আরামের জীবন৷ কাফে গ্রামেরই সবাই-ই ওকে পালা করে খাওয়ায়, ওর পোশাক পরিচ্ছদের ব্যবস্থা করে৷ টেড আয়ারশায়ারকে আর একটুও পরিশ্রম করতে হয় না৷
বিনিময়ে ও সবার ভালোমন্দ দেখে। ‘দানো’-র টুকরো দান করে৷ ‘দানো’র টুকরো এখন গাঁয়ের অত্যন্ত জরুরি বস্তু! যে কোনও কাজের জন্যে আগুন জ্বালাতে হলে, বিশেষ করে যেখানে খুব তাপ দরকার, তখন টুকরো চাই-ই৷ আগুন থাকেও অনেকক্ষণ৷
টেড টুকরোগুলো এনে দেয় পাহাড় থেকে৷
এদিকে বেচারি ওঝার দশা নিতান্তই করুণ৷ রুটি-রুজি বন্ধ, কেউ তাকে পোঁছেও না৷ এমনসময় একদিন গ্লাসগো থেকে ওঝার লেখাপড়া জানা ভাগ্নে মামার গাঁয়ে বেড়াতে এল৷ নিরুপায় ওঝা সব বলল তাকে৷ দুটো ‘কালো টুকরো’ও দিল৷
ভাগ্নে আর দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে রওনা হল গ্লাসগোয়৷
ঠিক এর মাসখানেক পরে একদল সরকারি উর্দিপরা লোক রাজার ফরমান নিয়ে এসে হাজির হল অখ্যাত অজ্ঞাত কাফে গাঁয়ে, রাজার আদেশ৷ আমরা খবর পেয়েছি এই গাঁয়ের পাশেই মূল্যবান ধাতু ‘কয়লা’র খনি আছে৷ খনির মালিককে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে আমরা সম্পত্তিটা রাজার নামে লিখে নেব৷
সম্পত্তি মূল্য ধার্য হল কয়েক লক্ষ পাউন্ড৷ আর তার মালিক হল, নিঃস্ব ভ্যাগাবন্ড টেড আয়ারশায়ার!
একপাল ভেড়া নিয়ে এগিয়ে চলেছে টেউ আয়ারশায়ার৷ বয়সে কিশোর, ভেড়া চরানোই তার জীবিকা৷ ছন্নছাড়া অনাথ৷ তিনকূলে কেউ নেই৷ সকালে বিকেলে দু’বার এই ভেড়ার পাল চরিয়ে, তাদের কচি ঘাস খাইয়ে সে ফেরত নিয়ে আসে আসে খামারে৷ সেখানে এসে জন্তুগুলোর মালিক দেখে নেয়, গুনতিতে সব ঠিক আছে কিনা৷ বিনিময়ে দু’বেলা খাওয়া আর সামান্য কিছু টাকা৷
কিন্তু প্রতিবছরই এই সময়টা বড্ড মন খারাপ হয়ে যায় টেডের৷ শীত এগিয়ে আসছে৷ প্রকৃতিতে রুক্ষ, ন্যাড়ান্যাড়া ভাব৷ কচি ঘাস আর কোথায়? ফলে কিছুটা জান হাতে করেই ওকে যেতে হয় গ্রাম ছেড়ে আরও দূরে, পাহাড়ের কাছে৷ সেখানে নেকড়ের উপদ্রব তো আছেই, তাছাড়া…
ভেড়াগুলো নিয়ে যে ও কোনদিকে এগোচ্ছে, ঘন কুয়াশায় ঠাহর করতে পারছে না৷ ওর সঙ্গী অন্য রাখালদের উদ্দেশ্যে ডাক দেয়, এই জিম, টম, হ্যারি…শুনছিস? কোথায় তোরা?
প্রত্যুত্তর ভেসে আসে অনেকটা নীচে থেকে… এই যে এখানে আমরা৷ তুই?
ইতিমধ্যেই রোদ্দুরের দাপটে কুয়াশা খানিকটা পাতলা হয়েছে৷ চোখ সরু করে তাকাতেই টেডের অন্তরাত্মা হিম হয়ে আসে, সর্বনাশ! সঙ্গীরা পাহাড়ের নীচে৷ আর সে পাহাড়ের একেবারে চূড়োয়৷ আর এখানেই তো সেই গর্তগুলো…
হেই..হেট্…হেট্…!
হাতের ছিপটি শূন্যে ‘সাঁ সাঁ’ করতে করতে পাগলের মতো ভেড়াগুলোকে তাড়া লাগায় টেড৷ দরকার নেই কচি ঘাস খাওয়ার৷ গত পরশুই ওর এক সঙ্গীর একটা ভেড়া খেয়েছে এই গর্তগুলো৷ তারপর মনিবের সে কী মার৷
ভেড়াগুলো তড়বড়িয়ে নীচে নামতে থাকে৷ তীক্ষ্ম দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে থাকে টেড, মনে মনে গুণে যাচ্ছে ও ভেড়ার সংখ্যা৷
আরে, আরে… হায় হায়! একটা ভেড়া অদৃশ্য হয়ে গেল!
টেড ছুটে গিয়ে দেখল, উপরে আলগা ঘাসের চাপড়া ভিতরে সেই গর্ত! ঘোর অন্ধকার! ভেড়াটা তার মধ্যেই ডুবে গেছে৷
এখন! এখন কী হবে? ভেড়াটা না নিয়ে ফিরলে ওর পিঠের চামড়া আস্ত থাকবে? আবার অন্যদিকে ওই ভয়াল কালো কালো গর্ত যার মধ্যে নাকি লুকিয়ে থাকে—
টেড উবু হয়ে বসে থাকে গর্তের সামনে৷ শূন্য দৃষ্টি৷ কী করবে, বুঝে উঠতে পারছে না৷ এই ফাঁকে আমরা বরং এই কাহিনীর পটভূমিকা একটু শুনে নিই৷
এই কাহিনীর সময়কাল আজ থেকে ৬০০ বছর আগে৷ সন তারিখ হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে৷ শুধু ঘটনাটা আর তার নায়ক টেড আয়ারশায়ারের নামই থেকে গেছে ।
স্থান…স্কটল্যান্ড৷ ব্রিটিশ যুক্তরাষ্ট্রেরই একটা অঙ্গরাষ্ট্র৷ সেই স্কটল্যান্ডের দক্ষিণে উঁচু মালভূমি ঘেঁষে দু-দুটো পর্বত… নিন্টো আর পেন্টল্যান্ড৷ এই দুই পর্বতশিরার মাঝের উপত্যকায় ছোট্ট এক গ্রাম৷ নাম কাফে৷ উষর, বন্ধুর জমি৷ ফসল প্রায় ফলে না বললেই হয়৷ গ্রামবাসীদের প্রধান জীবিকা মেষপালন৷
ওই গাঁয়ের অনেক কিশোর বাগালগিরি করে নিজের পেট চালায়৷ টেড যে তাদের মধ্যে একজন আগেই জেনেছি৷ কিন্তু সবারই বারণ আছে দূরের ওই পাহাড়ে ওঠার৷ ওখানে যে বাস করে ভয়ঙ্কর ‘দানো’!
হ্যাঁ, ‘কালো দানো’৷ বড় বড় যেসব গর্ত ছড়িয়ে আছে পাহাড়ের ওপরে, সেগুলো গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ৷ গর্তের উপর থেকে নীচের দিকে তাকালে দেখা যায় শুধু জমাট অন্ধকার৷ মাঝে মাঝে ওই গর্তগুলোর মাথায় কালো ধোঁয়াশা জমে, আবার অদৃশ্য হয়ে যায়৷
গ্রামবাসীদের দৃঢ় বিশ্বাস, ওই গর্তগুলোর মধ্যে বাস করে ‘কালো দানো’৷ তারই নিঃশ্বাসে ওরকম ধোঁয়া জমে গর্তের মাথায়৷ পশুপাখি মানুষ একবার ওর মধ্যে ঢুকলেই ‘দানো’ খেয়ে নেয় তাকে৷ তারপর সেই প্রাণীটার আত্মাই হয়ে যায় ‘দানো’-র সহচর… প্রেতাত্মা।
সুতরাং ইতিমধ্যে বেশ কিছু ভেড়া ওই ‘দানো’ খেয়ে ফেললেও কেউই সাহস দেখায়নি ওই গর্তে ঢোকার৷
আজ টেড আয়ারশায়ারের ভেড়াটি হারিয়ে গেলও টেড কিছুক্ষণ নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকে গর্তের বাইরে৷ নাঃ, কেউ তো বেরোল না৷ তাকাল নীচের দিকে৷ বাকি ভেড়ার পাল তড়বড় করতে করতে নেমে গেছে উপত্যকায়৷
কী করবে ও? চলে যাবে এই ভেড়াটার মায়া ছেড়ে? তারপর তো সেই অতীতের পুনরাবৃত্তি…। বেদম পিটুনি আর মজুরি, দানাপানি বন্ধ!
হেই টেড্, হেই…চলে আয়! চলে আয়…!
হইহই করতে করতে ছুটে আসছে টেডের সঙ্গীসথী জিম, টম, হ্যারিরা৷ হাঁপাতে হাঁপাতে তারা টেডের কাছে এসে ওর হাত ধরে টান মারে, এই টেড, চল্! এখানে এই দানোর গর্তের সামনে বসে কী করছিস? চল্ চল্!
নাঃ…! টেড মাথা নাড়ে, আমি যাব না৷
মানে? বন্ধুরা হকচকিয়ে গেল৷
আমি এর ভেতরে ঢুকব৷ দানবের সঙ্গে লড়াই করে ভেড়াটাকে নিয়ে আসব৷ টেড জবাব দেয়৷
বন্ধুরা স্তম্ভিত৷ নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে বলে, ভেড়ার চিন্তায় মাথাটা ওর গেছে! ওকে টেনে নিয়ে যেতে হবে৷
বন্ধুরা ওকে জাপটে ধরে, চল্ টেড চল্! পাগলামি করিস্ নে!
না-আ-আ! চিৎকার করে উঠল টেড আমি দানোর সঙ্গে বোঝাপড়া করে তবেই যাব৷ যা, তোরা চলে যা…!
বলতে বলতে সে এমন ঝটকা মারে, বন্ধুরা সব ছিটকে যায় চতুর্দিকে৷
জিম বিড়বিড় করে বলে ওঠে, ওরে! টেডকে নির্ঘাৎ দানোয় পেয়েছে! আর রক্ষে নেই৷
টেড ততক্ষণে মোটা একটা খুঁটি পুঁতে ফেলেছে গর্তের মুখের কাছে৷ ভেড়া বাঁধার চামড়ার রজ্জু সে বেশ ভালমতন পাকিয়ে নেয় খুঁটির সঙ্গে৷ দড়িটার অন্যপ্রান্ত ধরে টেড এগিয়ে যায় গর্তের দিকে…
অপেক্ষমান সাথীরা রুদ্ধশ্বাস৷
দড়ি ধরে টেড নামছে…আস্তে আস্তে দড়ি ছাড়ছে…আরও নীচে…হ্যাঁ, এই তো পা ঠেকেছে৷
দড়িটা আঁকড়ে কয়েকমুহূর্ত নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে টেড৷ উঃ, কী নিকষকালো অন্ধকার৷ কোথায়, কোথায়…দানো? কোথায় ওর ভেড়া?
ধীরে ধীরে টেডের চোখ সয়ে যাচ্ছে৷ ওই তো উপরের মুখ দিয়ে ক্ষীণ আলোর রেখা এসে ঢুকেছে৷
আবছা আলোয় টেডের চোখে পড়ল গর্তটা বোঝাই কালো কালো একরকম গুঁড়োয়৷ ওই তো…ওই তো! কোণের দিকে কী একটা নড়ছে না?
হামাগুড়ি দিয়ে সেদিকে এগোতে যেতেই টেডের পায়ে একটা কী ঠেকল৷ একটা কঙ্কাল৷ আগের কোনও হতভাগ্য ভেড়ার স্মৃতি৷
দু’হাত দিয়ে এবার টেড জাপটে ধরে ওর হারানিধিকে৷ আঃ! ভেড়াটা এখনও বেঁচে আছে৷
টেডের সারা শরীর বেয়ে আনন্দের বাতাস বয়ে যায়, ও পেরেছে! ও পেরেছে ‘দানো’কে জয় করতে৷
ভেড়াটাকে একহাত দিয়ে বুকে জড়িয়ে অন্যহাতে টেড শক্ত করে ধরে চামড়ার রজ্জুটা, এবার ওপরে ওঠার পালা৷
অমানুষিক কষ্ট! হাঁচড়ে-পাঁচড়ে ঊঠে মুখ বাড়াল টেড৷ চিৎকার করে উঠল, জিম, টম! দ্যাখ দ্যাখ আমি পেয়েছি! এই যে, এই যে আমার ভেড়াটা!
ও কী…ও কী! ওরা ছিটকে আরো দূরে সরে যাচ্ছে কেন?
ভেড়াটাকে বাইরে তুলে দিয়ে শরীরে ঝাঁকুনি মেরে বাইরের খোলা বাতাসে এসে দাঁড়াল টেড! বুকভরে শ্বাস নিল৷
কিন্তু আরে! ওরা যে সব দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে! ওদের চোখে ভয় আর আতঙ্ক৷ তাহলে… পরক্ষণেই টেডের চোখ পড়ে নিজের আর ভেড়াটার দিকে৷ চেনাই যাচ্ছে না ভেড়াটাকে৷ কালো কুচকুচে, শুধু পিটপিট করছে চোখদুটো৷ আর নিজের অবস্থা? সর্বাঙ্গ ঢেকে গেছে কালো গুঁড়োয়! ঠিক যেন আগুনে পোড়া ভূত৷
তাহলে ওকেই নির্ঘাৎ ‘দানো’ ভেবেছে ওরা! তড়িঘড়ি ফের হেঁকে উঠল টেড, ওরে শোন্ শোন্!
আমি টেড, তোদের টেড! পালাস না।
কে শোনে কার কথা! ঊধর্বশ্বাসে ‘দানো দানো’ চিৎকার করতে করতে ছুটে পালাচ্ছে টেডের সহকর্মী বন্ধুরা৷
টেড নিশ্চল হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে৷ তারপর ঝাড়তে শুরু করে কালো গুঁড়োর রাশি৷
খানিকটা সাফসুতরো হয়ে প্রায় ঘণ্টাখানেক পর টেড রওনা দেয় গাঁয়ের দিকে৷ ইতিমধ্যে বেশ খানিকটা ধাতস্থ হয়েছে টেড৷
উপত্যকা বেয়ে গ্রামের কাছাকাছি আসতেই দূর থেকে টেডের হঠাৎ চোখে পড়ে… কী ব্যাপার! রাস্তার মুখেই গাঁয়ের ছেলেবুড়ো মেয়েরা সব ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে৷
আনন্দে নেচে ওঠে টেডের মন ৷ নিশ্চয়ই সবাই ওকে স্বাগত জানাতে এসেছে! ভারিক্কি চলে মেষশাবককে বুকে জড়িয়ে টেড এগিয়ে যায়৷
কয়েক পা এগোতেই হঠাৎ সম্মিলিত চিৎকার ভেসে এল৷ টেডের পা দুটো গেঁথে গেল।
‘টেড, খবরদার তুমি আর এগিও না! ফিরে যাও৷ তোমায় দানোয় পেয়েছে৷ গাঁয়ে তোমার স্থান নেই৷…ফিরে যাও৷…খবরদার৷…’
না-না-না! টেড আর্তনাদ করে ওঠে, দানো-টানো সব বাজে কথা৷ শুধু কালো গুঁড়ো। বিশ্বাস করো, আমি তোমাদেরই টেড৷ এই যে হারানো ভেড়াটা৷
কয়েক মুহূর্তের জন্যে নীরবতা নেমে আসে৷ টেড লক্ষ্য করে, ওদের গাঁয়ের, তুক্তাক্ করা ওঝা মোড়লকে কীসব বলছে৷ তারপরই শোনা যায় মোড়লের গলা, তোমায় বিশ্বাস করি না৷ তুমি চলে যাও৷ ওই ভেড়াটাও নিয়ে যাও৷ এ গাঁয়ে তোমার জায়গা হবে না৷
টেড হতভম্ব হয়ে দেখে, ওঝা চকমকি ঠুকে জড়ো করা ঘাসপাতায় আগুন জ্বালল৷ তারপর ঝোলা থেকে কীসব বের করে আগুনে ফেলতে লাগল আর চেঁচিয়ে বলতে লাগল, হে টেড দানো! তুমি ফিরে যাও তোমার জায়গায়৷ আমরা তোমাকে কোদাল, কুড়ুল, শাবল দিচ্ছি৷ ঘর বানিয়ে তুমি ওখানেই থাকো৷ ভেড়াটা তোমায় উপহার দিলাম৷ রোজ তোমাকে খাবার দিয়ে আসব৷ চলে যাও টেড দানো৷ আমাদের একান্ত মিনতি৷
ওদিক থেকে কোদাল শাবল শূন্যপথে উড়ে আসতে লাগল৷ টেড নিশ্চিত হল, তার গাঁয়ে ফেরার পথ বন্ধ হয়ে গেছে৷
কুড়িয়ে নিল টেড৷ আকাশের দিকে তাকাল৷ দ্রুত দুপুর গড়িয়ে আসছে৷ বিকেল, তারপরেই অন্ধকার রাত্রি৷
টেডের জীবনেও কি অন্ধকার নেমে আসছে? সম্পূর্ণ একা নির্জন পাহাড়ে তাকে বাকি জীবন কাটাতে হবে? সর্বাঙ্গে অসহ্য ক্লান্তি৷ বিপর্যস্ত টেড আবার পাহাড়ের দিকে রওনা হয়।
মাসাধিকাল কেটে গেছে আসছে৷ পাতা ঝরা, রুক্ষ বনেপ্রান্তরে শীতের পদধ্বনি৷
টেড বেঁচে আছে৷ বেঁচে আছে লড়াই করে৷ হ্যাঁ, সে বাঁচবেই, তাকে বাঁচতেই হবে৷ সে প্রমাণ করে দেবে, সব্বার ধারণা কত ভুল৷
কাঠকুটো দিয়ে মাথা গোঁজার ছোট্ট একটা ছাউনি বানিয়ে নিয়েছে টেড৷
দুপুরে খাবার নিয়ে আসে ওঝা৷ আর রোজই তার এক কথা… কি রে, কিছু মন্ত্রতন্ত্র পেলি? আমায় দে৷ দানো কী বলেছে, বল্৷
‘দানো’ যে নেই, তা সে বিশ্বাস করে না৷
এইভাবে চলতে চলতে একদিনে ওঝার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়, তুই ব্যাটা মিথ্যেবাদী৷ ইচ্ছে করে আমায় মন্ত্র দিচ্ছিস না৷ ঠিক আছে, আজ না বললে, কাল থেকে আর ‘দানা’ পাবি না৷
তবে রে বদমাস বুজরুক! টেডের সমস্ত সংযম ভেঙে যায়৷ সহসা হিংস্রভাবে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে৷ চেপে ধরে ওঝার টুঁটি- মন্ত্র চাই! এই নে মন্ত্র৷ নে-নে!
বলতে বলতে সে ‘ক্যাত ক্যাত’ করে ওঝাকে লাথি মারতে থাকে, দিতে হবে না খাবার! শয়তান নরকের কীট! বেরো বেরো!
ওঝা প্রাণভয়ে ছুট দিল।
ওঝা তো পালিয়ে গেল, কিন্ত এবার কীভাবে চলবে? নিজেকেই নিজে ধিক্কার দিল টেড, কেন যে এত তাড়াতাড়ি মাথা গরম হয়ে গেল!
ওঝা খাবার নিয়ে আসত আর সেইসঙ্গে নিয়ে আসত কাঠকুটো৷ এবার তো ওকে এই ঠান্ডাতেই মরতে হবে৷
সন্ধে ঘনিয়ে এল৷ অবশিষ্ট কাঠকুটো দিয়ে আগুন জ্বালল টেড৷ এ কী! আজ এত ঠান্ডা লাগছে কেন?
ছাউনির বাইরে মুখ বাড়াতেই শিউরে উঠল টেড৷ টুপটুপ করে বরফ পড়া শুরু হয়েছে৷ কাঠপাতাও শেষ হয়ে এসেছে৷ নিবু নিবু আগুন৷ উ-হু-হু…কী শীত, অসাড় হয়ে যাচ্ছে হাত পা৷
চকিতে টেডের মনে পড়ল, আচ্ছা, ‘কালো দানো’র গর্তের মধ্যে যখন ও নেমেছিল, বেশ গরম লেগেছিল৷ নামবে একবার?
যেমন ভাবা, তেমন কাজ৷ সেই চামড়ার দড়ি তেমনই ঝোলানো আছে। টেড ঝুলে পড়ল৷
আরে, ভেতরটা সত্যিই দারুণ গরম! টেড গুটি সুঁটি মেরে পড়ে থাকে৷
কিন্তু একটু পরেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে৷ ভেতরে একফোঁটা বাতাস নেই৷
নাহ্, ওকে প্রকৃতিই বাঁচতে দেবে না৷
ফিরে এল আবার ছাউনির ভেতরে৷ বাইরে সমানে তুষারপাত৷ অবর্ণনীয় হাড়হিমঠান্ডা৷ আগুনের দু-একটা ফুলকিই দেখা যাচ্ছে৷ দুচ্ছাই! এটাকেই আগুনে পোড়ানো যাক্৷
কিন্তু গা থেকে জ্যাকেট খুলতে যেতে তার উপরে লেগে থাকা কালো গুঁড়োগুলো আগুনের উপর পড়তে থাকে৷
পরক্ষণেই চমৎকৃত হয় টেড, তাজ্জব ব্যাপার! ওগুলো পড়তেই ফুলকি দিয়ে আগুন জ্বলে উঠল!
তাড়াতাড়ি ট্রাউজার, হাত মুখ ঝাড়তে থাকে টেড৷ আর চোখ বড় বড় করে দেখে, যত ওই কালো গুঁড়ো ঝরে পড়েছে, ততই নিভন্ত আগুন জেগে উঠছে৷ বেশ গরমও হচ্ছে৷
তাহলে? তাহলে ওই দানোর গুঁড়ো আগুন জ্বালতে পারে? আশ্চর্য! চটপট বড় ঝুড়ি আর কোদাল নিয়ে টেড নেমে পড়ল অন্ধকার গর্তটায়৷ কোদাল দিয়ে সে সজোরে কোপ মারতে শুরু করল গর্তের গায়ে। কালো কালো চাঙড় আর ধুলো তুলতে লাগল ঝুড়িতে৷
এবার ঝুড়ি বোঝাই করে হাঁপাতে হাঁপাতে আবার আস্তানায়, আগুনের সামনে৷
প্রথমে খানিক কালো গুঁড়ো ঢালতেই সতেজে জ্বলে উঠল আগুন৷ কী রং আগুনের! লাল টকটকে৷ তারপর ছোট ছোট টুকরোগুলো ফেলতেই। আরিব্বাস! কী ধোঁয়া! তার সঙ্গে দারুণ গরম!
উষ্ণতায় শরীর জুড়িয়ে গেল টেডের৷ ধোঁয়া একটু কমতেই টেডের চক্ষুস্থির৷
কালো কালো টুকরোগুলো এরমধ্যেই আগুনের রং নিয়ে নিয়েছে৷ লাল টকটক করছে৷
আস্তে আস্তে ধোঁয়া একদম কমে গেল৷ কিন্তু আগুনের তেজ কী? গনগন করছে লাল লাল টুকরো! ছাউনির ভেতরটা এখন ফায়ারপ্লেসের চেয়েও অনেক গরম৷
টেড পরম আরামে ঘুমিয়ে পড়ল৷
পরদিন সকালে ওর ঘুম ভাঙল৷ ছাউনির বাইরে কিছু কণ্ঠস্বর, নির্ঘাৎ মরেই গেছে৷ চল্ দেখে আসি৷ যা বরফ পড়েছে কাল৷
তড়াক করে লাফিয়ে উঠল টেড৷ উঁকি মেরে দেখল, গাঁয়ের মোড়ল আর সঙ্গে ওরই সঙ্গীসাথী, কিশোর যুবকরা৷
মরে গেছি? দাঁড়াও, দেখাচ্ছি তোমাদের৷ চট করে চিমটে দিয়ে একখণ্ড জ্বলন্ত কালো টুকরোকে ধরে ছিটকে বাইরে এল টেড, এই যে আমি৷ আর এই দেখো, দানোর কলজে, জ্বালিয়েছি৷ লাল টকটক করছে, জ্বলছে৷
বলতে বলতে সে দৌড়ে গিয়ে মোড়লের হাত ধরে, এসো, এসো, ভয় কী! দেখো ভেতরটা কেমন গরম! পারবে তোমাদের ওই বুজরুক ওঝা এমন গরম করতে? পারবে এমন ধোঁয়াছাড়া লাল আগুন জ্বালাতে?
মোড়ল শুধু নয়, তার দলবলও স্তাম্ভিত।
কয়েক মুহূর্ত পরে মোড়ল টেডের সামনে এসে হাতজোড় করে দাঁড়াল, আমরা অন্যায় করেছি টেড৷ আমাদের ক্ষমা করো৷ আজ থেকে তুমি হবে গাঁয়ের ওঝা৷ আর এ জায়গাটাও তোমাকেই আমরা দিলাম৷ দানোর সবকিছু তোমারই সম্পত্তি৷
টেডের এখন মহা আরামের জীবন৷ কাফে গ্রামেরই সবাই-ই ওকে পালা করে খাওয়ায়, ওর পোশাক পরিচ্ছদের ব্যবস্থা করে৷ টেড আয়ারশায়ারকে আর একটুও পরিশ্রম করতে হয় না৷
বিনিময়ে ও সবার ভালোমন্দ দেখে। ‘দানো’-র টুকরো দান করে৷ ‘দানো’র টুকরো এখন গাঁয়ের অত্যন্ত জরুরি বস্তু! যে কোনও কাজের জন্যে আগুন জ্বালাতে হলে, বিশেষ করে যেখানে খুব তাপ দরকার, তখন টুকরো চাই-ই৷ আগুন থাকেও অনেকক্ষণ৷
টেড টুকরোগুলো এনে দেয় পাহাড় থেকে৷
এদিকে বেচারি ওঝার দশা নিতান্তই করুণ৷ রুটি-রুজি বন্ধ, কেউ তাকে পোঁছেও না৷ এমনসময় একদিন গ্লাসগো থেকে ওঝার লেখাপড়া জানা ভাগ্নে মামার গাঁয়ে বেড়াতে এল৷ নিরুপায় ওঝা সব বলল তাকে৷ দুটো ‘কালো টুকরো’ও দিল৷
ভাগ্নে আর দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে রওনা হল গ্লাসগোয়৷
ঠিক এর মাসখানেক পরে একদল সরকারি উর্দিপরা লোক রাজার ফরমান নিয়ে এসে হাজির হল অখ্যাত অজ্ঞাত কাফে গাঁয়ে, রাজার আদেশ৷ আমরা খবর পেয়েছি এই গাঁয়ের পাশেই মূল্যবান ধাতু ‘কয়লা’র খনি আছে৷ খনির মালিককে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে আমরা সম্পত্তিটা রাজার নামে লিখে নেব৷
সম্পত্তি মূল্য ধার্য হল কয়েক লক্ষ পাউন্ড৷ আর তার মালিক হল, নিঃস্ব ভ্যাগাবন্ড টেড আয়ারশায়ার!
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
সুন্দর গল্প। টান টান লেখা। রূপকথার জাকজমজ নেই, অথচ রূপকথার মত। অনবদ্য।
দুর্দান্ত।
খুবই সুন্দর