ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
কঙ্কাবতী নিজের জীবনটা নিজের মত করেই গড়ে নিয়েছে। অসম্ভব ভালো গানের গলা তার। আপাতত সেটিকে মূলধন করেই এগিয়ে চলতে চেয়েছিল সে। খুব প্রয়োজন ছিল অর্থের। নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে তাকে। সন্ধান পেয়েছিল হোটেলে নিয়মিত গান গাইবার ।
ফিরে দেখা-
পছন্দের বিয়েতে আপত্তি ছিল না মা বাবার। কিন্তু বছর চারেক কুন্দনলালের সঙ্গে ঘর করেই সে বুঝতে পেরেছিল এ জীবন তার সুখের হবে না। বাঙালী মেয়ের অবাঙালী ঘরের ছেলের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া খুব শক্ত ব্যাপার। কোএড কলেজে কঙ্কাবতীর সহপাঠী ছিল কুন্দন, ধনী ব্যাবসায়ী পরিবারের একমাত্র ছেলে। কঙ্কাবতী তখন কলেজের ফ্যাশন শোয়ে অংশ নেয়। বেশ মডেল মডেল চেহারা, চালচলন তার। সেই সঙ্গে গানের অপূর্ব গলা। কলেজ ফেষ্টে মাতিয়ে দেয়। টুকটাক প্রোগ্রামও করে বাইরে। টেলিভিশনেও দু একবার মুখ দেখিয়েছে গানের অনুষ্ঠানে। মধ্যবিত্ত বাঙালী পরিবারের গ্লিটসি কঙ্কাবতী তখন অল্পবয়সী কলেজ পড়ুয়াদের একাধারে ফ্যাশন আইকন অন্যদিকে সঙ্গীতশিল্পী। আধুনিক, ফিল্মী গান তার জনার।
কুন্দনদের ব্যাবসার বিষয়ে মাথা ঘামাতো না কঙ্কাবতী কোনোদিনো। তবে কুন্দন চাইত তার সুন্দরী বৌ বিয়ের পর সব ক্লায়েন্ট পার্টির মিটিং গুলিতে যাক। তাদের মনোরঞ্জন করুক। কঙ্কাবতীর সেসবে আগ্রহ ছিল না। পছন্দও করত না সে। বাড়ির বৌ হয়ে সে কেন যাবে অপরিচিত মানুষ বাড়িতে এলে। চা, ড্রিংকস, জলযোগ সার্ভ করার জন্য কাজের লোকের অভাব নেই বাড়িতে। তবুও তার ডাক পড়ত কেউ এলে। কুন্দন নাছোড়। আর যেমন তেমন করে নয়। বেশ সাজগোজ করে তাকে যেতে হবে অচেনা পরিবেশে। এই নিয়ে সংঘাত উত্তরোত্তর বাড়তে থাকল। মিঠি তখন পেটে এসেছে সবে তার। না, না। মেয়ের নাম মিঠি দেবে ভেবেছিল কঙ্কাবতী। তবে সে সাধ আর পূর্ণ হয়নি তার। মিঠির স্বপ্ন দেখেছিল সে। মিঠিকে গান শেখাবে। নিজের হাতে পোষাক বানিয়ে পরাবে। সাজাবে। ইংরেজীমাধ্যম স্কুলে পড়াবে। তার নিজের মত স্মার্ট করে তুলবে। কিন্তু তার সব স্বপ্নে জল ঢেলে দিয়েছিল কুন্দন। বাচ্ছা পেটে আসায় কুন্দন ভেবেছিল কঙ্কাবতীকে আর বুঝি নিজের কাজে লাগানো যাবে না। ফিগার নষ্ট হল বৌয়ের। তলপেটে একগাদা স্ট্রেচমার্কস নিয়ে বৌকে লেহেঙ্গা পরিয়ে তার বিজনেস পার্টিতেও নিয়ে যাওয়া যাবে না। কঙ্কাবতীর এই ফিগার আর স্মার্টনেস কে কাজে লাগাবে বলেই তাকে একদিন প্রোপোজ করেছিল কুন্দন। অথচ বৌটার মধ্যবিত্ত বাঙালীর মানসিকতা তার অসহ্য লাগত। বৌ কিনা বিয়ের পর থেকেই বাচ্ছার জন্য মরিয়া। কোথায় লেটনাইট পার্টি করবে। মদ খাবে। লাস্যময়তায় মাতিয়ে রাখবে অভ্যাগতদের। তা না সেই মিডলক্লাস বাঙালী মেয়েদের মত বাচ্ছাকে ব্রেস্টফিড করাবে। আবারো নিজের ফিগারের দফা গয়া করবে। এমনিতেই কঙ্কাবতী মারোয়াড়ী ঘরের বৌ হয়েও নিজেকে পুরোটা বদলায়নি বলে কুন্দনের বেশ রাগ তার ওপরে।
পাঁচবছরেও আমাদের বাড়িতে নিজেকে ঠিকমত গ্রুম করতে পারলে না? কঙ্কাবতী বলে, না পারলাম না। মাছ খাই না তো। বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পেয়েছে, হয়েছে? আরে, ইয়ার। আপনা ঘর যা কে তো মছলি খাতে রহ। তা খাব না বুঝি? বলেই তো নিয়েছিলাম বিয়ের আগে। সেই বুঝে বিয়ে কর। তোমাদের কৃষ্ণের দোহাই দিয়ে আমি ননভেজ ছাড়তে পারব না কিন্তু। নিজেরা মদের ফোয়ারা ছোটাবে প্রতি উইকএন্ডে আর আমি একটা ডিমসেদ্ধ করে খেলেই আগুন জ্বলে যাবে বাড়িতে। অগত্যা বাপের বাড়িই সম্বল তার। বিয়ের আগে কিন্তু অন্যকথা বুঝিয়েছিল কুন্দন। বলেছিল ছাদের ঘরে তুমি ইন্ডাকশনে ডিম বানিয়ে নিজের মত করে খেও। শুধু সেদ্ধ কেন, ভাজা, অমলেট, যা খুশি। কেউ বারণ করবে না তোমায়। শুধু মাছটা ভেজো না। গন্ধ পেলে মা রাগ করবে। কঙ্কাবতী কথা বাড়ায় নি।
সেই কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে একদিন বাঙালী বন্ধুদের ননভেজ ভার্সেস ভেজ যুদ্ধে কুন্দন বলেছিল ওহ্! ফিশ্! এই ওহ্! ফিশ্ তার মুদ্রাদোষ। সেদিন বুঝেছিল কঙ্কাবতী। ছুতোয়নাতায় সে বাঙালীর মত্স্যপ্রীতিকে ঘা দেয়। তবুও তার সঙ্গেই সব হল। বরাত এল জরির পাগড়ি বেঁধে, শেরওয়ানি পরে, ঘোড়ায় চেপে, ঝমঝমিয়ে। কঙ্কাবতীদের বাড়ির দোরগোড়ায়। সেদিন রাতেই বিয়ে করে নিয়ে গেল শ্বশুরবাড়িতে। হাতের কনুই অবধি খয়ের দেওয়া মেহেন্দীতে টুকটুকে হয়ে বসেছিল বিয়ের সাজে কঙ্কাবতী। কি অপূর্ব দেখাচ্ছিল তাকে। মায়ের দেওয়া সোনার চুড়ির ফাঁকে ফাঁকে শ্বশুরবাড়ির কাঁচের চুড়ি আর মীনাকারী। কত গয়না পেয়েছে সে। হীরের নাকছবি, আংটি, কানের দুল। শ্বশুরবাড়ি পৌঁছেই তার বাবার বাড়ির সব গয়না তুলে রেখে দিতে বলেছিল কুন্দনদের আত্মীয়ারা। মনে মনে খুব দুঃখ পেয়েছিল সে এই ঘটনায়। যেন তার বাবা যেগুলো দিল সব সাব স্ট্যাণ্ডার্ড। পাতে দেওয়া যায় না এ বাড়িতে। মা যত্ন করে ফুলশয্যার তত্ত্ব পাঠিয়েছিলেন। সেসব শাড়ি পরলে নাকি শ্বশুরবাড়ির নিন্দে হবে। তাদের দেওয়া মিষ্টিগুলিও নাকি অপাঙ্ক্তেয়। শাদীবাড়িতে ক্ষীরের মিষ্টি, ঘিউ কি মিঠাই, রাবড়ি, কেশরভোগের কদর বেশী। কঙ্কাবতী বুঝতে পারেনি কি করা উচিত তার সেই মূহুর্তে। তার বাবা, মা যথেষ্ট ভালো দোকান থেকে সব কিনে কেটে পাঠিয়েছেন নিজেদের সাধ্যমত। এ বাড়িতে সবেতেই যেন নাক উঁচু ভাব। আর সবেতেই কঙ্কাবতীর মনে হত সে বাঙালী বলেই বুঝি এমন ডিস্ক্রিমিনেশন। সেই মনোভাব বাড়তে বাড়তে এতদূর এগিয়েছে।
বন্ধ হয়েছে চিরতরে কঙ্কাবতীর বাবা মায়ের সেই বাড়িতে হঠাৎ আগমন। তার মধ্যবিত্ত বাপ-মা নিজেদের বাড়িতে নতুন কুটুমকে আপ্যায়ন করতে চেয়েও বারেবারে ব্যর্থ হয়েছেন। যুক্তি স্বরূপ তারা বলেছেন, বড্ড মাছের গন্ধ বেরোয় বাঙ্গালী বাড়িতে। তারপর একসময় সকলেই বুঝেছেন তাঁরা এদের সমগোত্রীয় নন বলেই এমন বিরূপ মনোভাব তাদের। এরমধ্যেই মিঠি হঠাৎ করেই পেটে এসে গেছিল। শুরুতেই কুন্দন বলেছিল রাখতে হবেনা। নষ্ট করে ফেল। কঙ্কাবতী বলেছিল না। প্রথম সন্তান ফেলে দিলে আর পরে আসতে নাও পরে। কুন্দন আবারো দোষ দিয়ে বলেছিল মিডলক্লাস বেঙ্গলির মেন্টালিটি বলে। রোজ রোজ এমন সব নিতে পারত না কঙ্কাবতী। আর প্রতিমূহুর্তেই বাঙালীদের ছোট করা। সেদিন রাগের মাথায় বলেই ফেলেছিল সে। এতই যখন বাঙালীদের ছোট চোখে দেখ, আমায় বিয়ে করে আনলে কেন? মারোয়াড়ি মেয়েই তো আনলে পারতে। কুন্দন বলেছিল, তুমি বুঝি জোর করে এসেছ আমাদের বাড়িতে? যেদিন কলেজে প্রোপোজ করেছিলাম হাতে তো চাঁদ পেয়েছিলে তুমি? গলি মে চাঁদ নিকলা। তোমাদের মত অরডিনারি বাড়িতে কেউ আমার মত জামাই স্বপ্নেও ভাবতে পেরেছে কখনো?
কঙ্কাবতী বলেছিল, বুঝতে ভুল করেছিলাম। তুমি শুধুই সুন্দরের প্রেমে পড়েছিলে। আমি মানুষটার প্রেমে পড়নি।
কুন্দন সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল, পেটি বাঙালী মেয়ে। বোকা বাঙালী।
কঙ্কাবতী আর থাকতে না পেরে বলেছিল, তা এতই যদি বাঙালীজাতটার ওপর ঘেন্না তোমার, নিজেদের দেশ ছেড়ে এই বাঙালীর দেশেই ব্যাওসাপাতি করতে আসা কেন বাপু? খুব ঘা লেগেছিল কুন্দনের।
বলেছিল এনাফ ইজ এনাফ। স্টপ ইট।
কঙ্কাবতী বলেছিল, আমি জানতাম বাঙ্গালীরা রেগে গেলে ইংলিশ বলে। এখন দেখছি অবাঙ্গালীরাও বলে।
আরও রেগে গেছিল কুন্দন। বলেছিল, ঐ পেটের মেয়েটাকে আমি রাখব না কিন্তু। ওটাকে ফেলেই ছাড়ব।
কঙ্কাবতী বলেছিল, দেখি কার সাধ্য আমার মেয়েকে আমার থেকে কে আলাদা করে?
ঝগড়ায় ইতি টানতেই হয়েছিল আচমকা এক দুঃসংবাদে। কঙ্কাবতীর বাবার ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকের খবরে সব ওলটপালট হয়ে গেছিল বাবাকে সে যাত্রায় বাঁচানো যায়নি। আর তার কিছুদিনের মধ্যেই মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়ে সব যেন কেমন হয়ে গেল। মায়ের কাছেই ছিল সে। আসা যাওয়া করত। তবে কুন্দনের সঙ্গে সম্পর্কটা তিক্ত থেকে তিক্ততম হতেই পাকাপাকিভাবে কঙ্কাবতী চলে আসবে ঠিক করল মায়ের কাছে। ডিভোর্স নয়। আলাদাই থাকবে সে। তবে রাজী হল না কুন্দনের পরিবার। এদিকে সে সন্তানসম্ভবা তায় আবার ছোটাছুটি। একদিকে মায়ের সংসারে নিদারুণ অর্থাভাব আর অন্যদিকে পেটের শিশুর কলে কলে বেড়ে ওঠা। মায়ের ক্যানসারে হু হু করে খরচা হয়ে যাচ্ছে। মা, মেয়ে দুজনের চিন্তায় ঘুম আসেনা। প্রতিমাসেই দৌড়তে হয় নার্সিংহোম। সুরাহা হয় না। কোষ থেকে কোষান্তরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে সেই মারণ রোগ। ডাক্তার আশার আলো দেন না। অবশেষে সমাধান হল একটা। মায়ের একমাত্র জামাই কুন্দনলাল জানাল সে চিকিত্সার সব ভার নেবে তবে একটা শর্তে। কঙ্কাবতীকে তার কাছে থাকতে হবে নয়ত এই টানাপোড়েনে পেটের বাচ্ছাটির আশা ত্যাগ করতে হবে। কঙ্কাবতীর উভয়সঙ্কট। মা রাখে না সন্তান রাখে? মা বললেন, আমাকে যেতে দে। এ রোগ ভাল হবার নয়। যে আসছে তার যত্ন কর। কঙ্কাবতী চায় দুজনকেই। মা-শিশু দুজনেই তার বড্ড আপন। দোটানায় পড়ে অবশেষে নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়ল সে। প্রবল মানসিক এবং শারীরিক চাপ তার। মায়ের দায়িত্ত্ব নিয়েছে কুন্দন। কেমো শুরু করে মা অনেকটা ভাল আছে। এক একটি কেমোর আকাশছোঁয়া দাম। সব করছে কুন্দন তার শাশুড়ি মায়ের জন্যে। কুন্দনের কথা শুনতেই হবে এখন। নয়ত মা আর সেরে উঠবে না। মিঠির জন্যে মা সেরে উঠে নকশীকাঁথা বানাবে। উলের পোষাক বানাবে বলেছিল। সে আর কোথা থেকে পারত এই রাজ রোগের খরচ জোগাতে? কিন্তু কঙ্কাবতী এখন নার্সিংহোমে ভর্তি। ডেলিভারি বহুদূরে। তার প্রি এক্লেম্পশিয়া। চরম মানসিক টানাপোড়েনে গর্ভাবস্থায় শিশুটির ওপর খুব চাপ পড়েছে। প্রিম্যাচিওর ডেলিভারি করে দিতে হবে, ডাক্তারবাবু জানালেন। জ্ঞান নেই কঙ্কাবতীর অথচ তার মা এখন বেশ সুস্থ হচ্ছেন ধীরে ধীরে। নিজেদের সুবিধার্থেই একই নার্সিংহোমে আছেন তারা। কুন্দনলাল ঢালাও আয়োজন করেছে। দুজনের চিকিত্সার কোনো ত্রুটি রাখেনি সে। একদিকে গাইনি ওয়ার্ডে মেয়ে আর একটু দূরে সেই হাসপাতালের অঙ্কোলজি ডিপার্টমেন্টে তার মা চিকিৎসাধীন। কেমো নিতে নিতে মায়ের কেশশূন্যতা এলেও মা আগের চেয়ে অনেকটা ভাল। আর কঙ্কাবতী? তার অবস্থা বেশ সংকটজনক।
আগেভাগেই ডেলিভারি করে দিলেন ডাক্তার। সন্তানকে বাঁচানোর চেয়ে কঙ্কাবতীকে বাঁচানোই বেশী জরুরী ছিল সেই মূহুর্তে। সিজারিয়ান সেকশান করেই বেবিকে ইনকিউবেশনে মায়ের থেকে আলাদা রাখা হয়েছিল। জ্ঞান ফিরতেই কঙ্কাবতী জেনেছিল তার মিঠি বাঁচেনি। শুধু নার্স বলেছিল, কি সুন্দর মেয়ে হয়েছিল দিদি! তবে ডান গালটা জুড়ে বিশাল কালো জড়ুল ছিল। ভালই হয়েছে জানেন দিদি? মেয়ে সন্তানের ডান দিকে জড়ুল অপয়া, অশুভ। ব্যথায়, যন্ত্রণায় কাবু কঙ্কাবতী আরো ভেঙে পড়েছিল। বলেছিল থামবে তোমরা?
হাতের মুঠোয় ফোনে তারিখটা দেখে ভাবল, আরো তিনমাস পর মিঠির জন্মানোর কথা ছিল। মা বলেছিল সাধ খাওয়াবে। কোনোকিছুই পূর্ণ হলনা। এখন শুধু একটাই সুখবর। তার মা আগের থেকে অনেক ভাল। তিনি বাড়ি ফিরেছেন। মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা হল তার। মা বললেন, দুঃখ করিস নি। তুই বেঁচে থাকলে আবারো একটা মিঠি আসবে তোর পেটে। কঙ্কাবতী বলেছিল, এইজন্যেই বলে বাচ্ছা জন্মানোর আগে তার নাম করে কিছুই বানিয়ে রাখতে নেই। কেন হাত দিলে তুমি উল কাঁটায়? মেঝেতে কাঁথা পাতলে কেন মা? জানতে না এসব?
মা বলল, আর তুই যে নাম দিয়ে ডাকতে শুরু করে দিলি?
অনেকদিন বাদে কুন্দন এসেছিল কঙ্কাবতীর কাছে। নার্সিংহোম থেকে ডিসচার্জ হবে এবার। তার মাথায় কুন্দন আলতো করে হাত রাখতেই কঙ্কাবতী বলেছিল, খুব খুশি তো এবার তুমি? কুন্দন বলেছিল, দেখ বাচ্ছাটাকে না বের করে দিলে তুমি মারা যেতে। আর অসুস্থ বাচ্ছা থাকার চেয়ে … এনি ওয়ে, তোমার মাও তো সে রাত্তিরে বণ্ডে সই দিলেন, শুধু তোমার কথা ভেবে। কঙ্কাবতী বলল, ফিরে গিয়েই কিন্তু আমায় আবার মিঠি এনে দিতে হবে।
কুন্দন বলল, ডক্টর বলেছেন তুমি আর কোনোদিনও মা হতে পারবে না। তোমার পলিসিস্টিক ওভারি ছিল। আর পেটের বাচ্ছার সঙ্গেই বড় হচ্ছিল বিশাল একটা টিউমার। সব বাদ দিয়ে দিয়েছেন ডক্টর। কঙ্কাবতী আকাশ থেকে পড়ল। মানে আমি আর কোনোদিনও মা হতে পারব না? কুন্দন বলল, না। আমরা অ্যাডপ্ট করব সুইটহার্ট। চিন্তা মাত কর।
কিন্তু আমার তো কোনও প্রব্লেম ছিল না। ডক্টর বলেছিলেন মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে প্রেগনেন্সি খুব ভাল । আমার সব রিপোর্ট নরম্যাল ছিল। তিরিশের পরে নাকি সব কমপ্লিকেশন অ্যারাইজ করে।
আরে ছোড়ো না ইয়ার। আভি জিও জি ভরকে।
ভেঙে পড়েছিল কঙ্কাবতী আবার। এবার পাকাপাকিভাবে ফিরে গেছিল মায়ের কাছে। আর নয় কুন্দনের সঙ্গে। কে জানে হয়ত সন্তান শোক, আর মা হতে না পারার দুঃখ ভুলছিল হোটেলে গান গাইবার চাকরীটা পেয়ে। মা বলেছিল, দেখিস বাপু ওসব হোটেলে সব খারাপ মেয়েরা গান গায়। কঙ্কাবতী বলেছিল আমি কি আর মিস্ শেফালি, মিস পাপিয়া হতে চাইছি মা? শুধু সপ্তাহে দুদিন একঘন্টা গান গাইব আর চলে আসব। মনোরঞ্জন করার অন্য মেয়েরা আসে আরো গভীর রাতে। আমার পারফর্মেন্স সন্ধ্যেবেলায়। তুমি চিন্তা কোরো না মা। আমায় ভুলে থাকতে দাও। গানটাই পারি আমি। কুন্দনের কাছে ফিরে যায় নি সে। মনে কর না বিয়ের আগে যেমন টেলিভিশন চ্যানেলে সন্ধ্যেবেলায় গান গাইতে যেতাম তেমনি যাচ্ছি। মা রোজ যাওয়ার সময় বলতেন, দুগ্গা, দুগ্গা। এভাবেই প্রায় রোজ সন্ধ্যেবেলায় গান গাইবার ডাক পড়ত কঙ্কাবতীর। একটা থেকে দুটো থেকে তিনটে। মা ভাবতেন ভালই পয়সা আসছে ঘরে। জামাইয়ের কাছে হাত পাততে হচ্ছে না। মা, মেয়ের দিব্য চলে যাচ্ছে। কঙ্কাবতী ভুলে গেছিল তার অতীত। কুন্দন তার জীবনে এক অভিশাপ।
বেশ কিছু বছর পরে-
মা আর বেঁচে নেই। কঙ্কাবতীর বয়স তখন চল্লিশ ছুঁয়েছে সবে। দেখে মনে হবে না মোটেও। টানটান চেহারা তার। ফিগার মেনটেইন করতে জানে মেয়েটা। চিরকাল তার চেহারা মডেলদের মত। এখন সে কন্ট্যাক্ট লেন্স পরে গান গাইতে যায়। সভ্য পরিশীলিত তার সাজগোজ। হোটেলের সঙ্গে কেজো সম্পর্ক এত বছরের। গান গেয়েই পেমেন্ট নিয়ে চলে আসে। সন্ধ্যের শুরুর স্লটেই গান গায় সে। নতুন প্রজন্মের মদের হুল্লোড়, লাগামছাড়া বেলেল্লাপনা শুরু হয় রাত বাড়লে। কঙ্কাবতীর এসব নাপসন্দ।
এখনকার কলেজ পড়ুয়াদের সঙ্গে তাদের যুগ কে সে মেলাতে পারেনা। এখন কলেজে ঢুকেই তারা নাইটক্লাব শিখে যায়। তন্ত্রে যায়। সারারাত পড়ে থাকে। পাব শিখে ফেলে। মদ, হুক্কা বার সবেতেই দড়ো তারা। এই হোটেলের ডায়াসটা খুব নীচু। যারা খেতে এসেছে তাদের চোখে চোখ রাখা যায় গান গাইতে গিয়ে। আর অন্ধকার তো নয় হোটেল। বেশ জমজমে আলোর মাঝেই গাইতে হয় তাকে। সেদিন সামনেই বসেছে চারকোণা টেবিলে তিনজন ছেলেমেয়ে। একটি মেয়ে, দুটি ছেলে। মন দিয়ে তারা শুনছে কঙ্কাবতীর গলায় গীতা দত্তের পুরোনো হিন্দী গান। চোখ কেবলই চলে যাচ্ছে তাদের দিকে। তারাও তারিফ করছে ওর গানের, বুঝতে পারছে কঙ্কাবতী। পড়তে পারছে ওদের চোখের ভাষা। সহপাঠীই হবে তারা। এদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালে এরা মোবাইলে সেলফি তোলে। ফেসবুকে সেই ছবি পোস্ট করলে আরও গানের অফার আসে। নিজের সম্মান বাড়ে। তার মাঝেও মনে পড়ে যায় নিজের কলেজ জীবনে কুন্দনলালের সঙ্গে রেস্তোঁরায় যাবার কথা।
প্রোগ্রাম শেষে কঙ্কাবতী নিজেই নেমে আসে ওদের কাছে। হাত মেলাতে। শিল্পীর কদর করেছে এরা। তার প্রতিদান স্বরূপ একটা ধন্যবাদ তো দেওয়া শিল্পীর কর্তব্য। মেয়েটি উঠে দাঁড়ায়। খুব চেনা লাগছে আপনাকে। কি সুন্দর গাইলেন আপনি।
তোমার নাম কি?
মেয়েটি বলে মিঠু। কঙ্কাবতী নিজের মিঠির কথা মনে পড়ে যায় সেই শুনে। এমনি হত এদ্দিনে, আজ বেঁচে থাকলে।
আপনি যাবেন কোনদিকে? আমার গাড়িতে যেতে পারেন। কঙ্কাবতী বলে না, থ্যাংক্স। মিঠু বলে, গেলে খুশি হতাম কিন্তু। অনুরোধ ফেলতে পারেনা কঙ্কাবতী। মিঠুর দুই বন্ধু বাই, সি ইউ বলে বেরিয়ে পড়ে। অ্যাপ ক্যাব এসে থামে হোটেলের বাইরে। কঙ্কাবতী আর মিঠু গাড়ির পেছনে উঠে বসে। মহানগরীর কোলাহলকে ছাপিয়ে যায় ওদের গল্পপথ।
মিঠু জানায় সে এক পালিতা কন্যা। তার জন্মের পরে নাকি তাকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল বাইপাসের ধারে। পাড়ার লোকজন সব জানিয়ে দিয়েছে মিঠুকে। ওর এখনকার পালিকা বাবা, মা কুড়িয়ে এনে মানুষ করছে তাকে। এসব জানার পর মিঠুর আর ভালো লাগেনা সেখানে থাকতে।
কঙ্কাবতী বলে, তোমার বয়স কত? মিঠু বলে, সুইট সিক্সটিন জাস্ট কমপ্লিট । তাই তো কলেজে উঠেই রেস্তোঁরা, পাবে যাবার পাসপোর্ট পেয়েছি। ড্যাডিরা ব্যস্ত তাদের লাইফস্টাইল নিয়ে। আমাকে দেবার মত সময় নেই তাদের। শুধু আমায় অনেক অনেক পকেট মানি দেয়। আমার ভাল লাগেনা। আন্টি হোয়াটস্যাপে আছেন? বিনিময় হয় দুজনের নাম্বার।
কঙ্কাবতী ভাবে তার মিঠি বেঁচে থাকলে ষোলো বছরেরই হত এদ্দিনে। ট্যাক্সি থেকে নামার সময় আলো আঁধারিতে খেয়াল হল এবার তার। কঙ্কাবতী চমকে ওঠে। ধুবলা পাতলা মেয়েটি, তণ্বী, শিখরা, সুন্দরী। কিন্তু তার গালের অর্ধেক জুড়ে একটা কালচে জড়ুল। ও মা! এ কেমন করে সম্ভব!
বাড়ি পৌঁছানোর বাকী পথটুকুনি পেরুতে সেদিন বড্ড বেশী সময় লাগল কঙ্কাবতীর । দুয়ে দুয়ে চার হয়ে জীবনের অংকটা মিলল শেষমেশ।
ফিরে দেখা-
পছন্দের বিয়েতে আপত্তি ছিল না মা বাবার। কিন্তু বছর চারেক কুন্দনলালের সঙ্গে ঘর করেই সে বুঝতে পেরেছিল এ জীবন তার সুখের হবে না। বাঙালী মেয়ের অবাঙালী ঘরের ছেলের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া খুব শক্ত ব্যাপার। কোএড কলেজে কঙ্কাবতীর সহপাঠী ছিল কুন্দন, ধনী ব্যাবসায়ী পরিবারের একমাত্র ছেলে। কঙ্কাবতী তখন কলেজের ফ্যাশন শোয়ে অংশ নেয়। বেশ মডেল মডেল চেহারা, চালচলন তার। সেই সঙ্গে গানের অপূর্ব গলা। কলেজ ফেষ্টে মাতিয়ে দেয়। টুকটাক প্রোগ্রামও করে বাইরে। টেলিভিশনেও দু একবার মুখ দেখিয়েছে গানের অনুষ্ঠানে। মধ্যবিত্ত বাঙালী পরিবারের গ্লিটসি কঙ্কাবতী তখন অল্পবয়সী কলেজ পড়ুয়াদের একাধারে ফ্যাশন আইকন অন্যদিকে সঙ্গীতশিল্পী। আধুনিক, ফিল্মী গান তার জনার।
কুন্দনদের ব্যাবসার বিষয়ে মাথা ঘামাতো না কঙ্কাবতী কোনোদিনো। তবে কুন্দন চাইত তার সুন্দরী বৌ বিয়ের পর সব ক্লায়েন্ট পার্টির মিটিং গুলিতে যাক। তাদের মনোরঞ্জন করুক। কঙ্কাবতীর সেসবে আগ্রহ ছিল না। পছন্দও করত না সে। বাড়ির বৌ হয়ে সে কেন যাবে অপরিচিত মানুষ বাড়িতে এলে। চা, ড্রিংকস, জলযোগ সার্ভ করার জন্য কাজের লোকের অভাব নেই বাড়িতে। তবুও তার ডাক পড়ত কেউ এলে। কুন্দন নাছোড়। আর যেমন তেমন করে নয়। বেশ সাজগোজ করে তাকে যেতে হবে অচেনা পরিবেশে। এই নিয়ে সংঘাত উত্তরোত্তর বাড়তে থাকল। মিঠি তখন পেটে এসেছে সবে তার। না, না। মেয়ের নাম মিঠি দেবে ভেবেছিল কঙ্কাবতী। তবে সে সাধ আর পূর্ণ হয়নি তার। মিঠির স্বপ্ন দেখেছিল সে। মিঠিকে গান শেখাবে। নিজের হাতে পোষাক বানিয়ে পরাবে। সাজাবে। ইংরেজীমাধ্যম স্কুলে পড়াবে। তার নিজের মত স্মার্ট করে তুলবে। কিন্তু তার সব স্বপ্নে জল ঢেলে দিয়েছিল কুন্দন। বাচ্ছা পেটে আসায় কুন্দন ভেবেছিল কঙ্কাবতীকে আর বুঝি নিজের কাজে লাগানো যাবে না। ফিগার নষ্ট হল বৌয়ের। তলপেটে একগাদা স্ট্রেচমার্কস নিয়ে বৌকে লেহেঙ্গা পরিয়ে তার বিজনেস পার্টিতেও নিয়ে যাওয়া যাবে না। কঙ্কাবতীর এই ফিগার আর স্মার্টনেস কে কাজে লাগাবে বলেই তাকে একদিন প্রোপোজ করেছিল কুন্দন। অথচ বৌটার মধ্যবিত্ত বাঙালীর মানসিকতা তার অসহ্য লাগত। বৌ কিনা বিয়ের পর থেকেই বাচ্ছার জন্য মরিয়া। কোথায় লেটনাইট পার্টি করবে। মদ খাবে। লাস্যময়তায় মাতিয়ে রাখবে অভ্যাগতদের। তা না সেই মিডলক্লাস বাঙালী মেয়েদের মত বাচ্ছাকে ব্রেস্টফিড করাবে। আবারো নিজের ফিগারের দফা গয়া করবে। এমনিতেই কঙ্কাবতী মারোয়াড়ী ঘরের বৌ হয়েও নিজেকে পুরোটা বদলায়নি বলে কুন্দনের বেশ রাগ তার ওপরে।
পাঁচবছরেও আমাদের বাড়িতে নিজেকে ঠিকমত গ্রুম করতে পারলে না? কঙ্কাবতী বলে, না পারলাম না। মাছ খাই না তো। বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পেয়েছে, হয়েছে? আরে, ইয়ার। আপনা ঘর যা কে তো মছলি খাতে রহ। তা খাব না বুঝি? বলেই তো নিয়েছিলাম বিয়ের আগে। সেই বুঝে বিয়ে কর। তোমাদের কৃষ্ণের দোহাই দিয়ে আমি ননভেজ ছাড়তে পারব না কিন্তু। নিজেরা মদের ফোয়ারা ছোটাবে প্রতি উইকএন্ডে আর আমি একটা ডিমসেদ্ধ করে খেলেই আগুন জ্বলে যাবে বাড়িতে। অগত্যা বাপের বাড়িই সম্বল তার। বিয়ের আগে কিন্তু অন্যকথা বুঝিয়েছিল কুন্দন। বলেছিল ছাদের ঘরে তুমি ইন্ডাকশনে ডিম বানিয়ে নিজের মত করে খেও। শুধু সেদ্ধ কেন, ভাজা, অমলেট, যা খুশি। কেউ বারণ করবে না তোমায়। শুধু মাছটা ভেজো না। গন্ধ পেলে মা রাগ করবে। কঙ্কাবতী কথা বাড়ায় নি।
সেই কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে একদিন বাঙালী বন্ধুদের ননভেজ ভার্সেস ভেজ যুদ্ধে কুন্দন বলেছিল ওহ্! ফিশ্! এই ওহ্! ফিশ্ তার মুদ্রাদোষ। সেদিন বুঝেছিল কঙ্কাবতী। ছুতোয়নাতায় সে বাঙালীর মত্স্যপ্রীতিকে ঘা দেয়। তবুও তার সঙ্গেই সব হল। বরাত এল জরির পাগড়ি বেঁধে, শেরওয়ানি পরে, ঘোড়ায় চেপে, ঝমঝমিয়ে। কঙ্কাবতীদের বাড়ির দোরগোড়ায়। সেদিন রাতেই বিয়ে করে নিয়ে গেল শ্বশুরবাড়িতে। হাতের কনুই অবধি খয়ের দেওয়া মেহেন্দীতে টুকটুকে হয়ে বসেছিল বিয়ের সাজে কঙ্কাবতী। কি অপূর্ব দেখাচ্ছিল তাকে। মায়ের দেওয়া সোনার চুড়ির ফাঁকে ফাঁকে শ্বশুরবাড়ির কাঁচের চুড়ি আর মীনাকারী। কত গয়না পেয়েছে সে। হীরের নাকছবি, আংটি, কানের দুল। শ্বশুরবাড়ি পৌঁছেই তার বাবার বাড়ির সব গয়না তুলে রেখে দিতে বলেছিল কুন্দনদের আত্মীয়ারা। মনে মনে খুব দুঃখ পেয়েছিল সে এই ঘটনায়। যেন তার বাবা যেগুলো দিল সব সাব স্ট্যাণ্ডার্ড। পাতে দেওয়া যায় না এ বাড়িতে। মা যত্ন করে ফুলশয্যার তত্ত্ব পাঠিয়েছিলেন। সেসব শাড়ি পরলে নাকি শ্বশুরবাড়ির নিন্দে হবে। তাদের দেওয়া মিষ্টিগুলিও নাকি অপাঙ্ক্তেয়। শাদীবাড়িতে ক্ষীরের মিষ্টি, ঘিউ কি মিঠাই, রাবড়ি, কেশরভোগের কদর বেশী। কঙ্কাবতী বুঝতে পারেনি কি করা উচিত তার সেই মূহুর্তে। তার বাবা, মা যথেষ্ট ভালো দোকান থেকে সব কিনে কেটে পাঠিয়েছেন নিজেদের সাধ্যমত। এ বাড়িতে সবেতেই যেন নাক উঁচু ভাব। আর সবেতেই কঙ্কাবতীর মনে হত সে বাঙালী বলেই বুঝি এমন ডিস্ক্রিমিনেশন। সেই মনোভাব বাড়তে বাড়তে এতদূর এগিয়েছে।
বন্ধ হয়েছে চিরতরে কঙ্কাবতীর বাবা মায়ের সেই বাড়িতে হঠাৎ আগমন। তার মধ্যবিত্ত বাপ-মা নিজেদের বাড়িতে নতুন কুটুমকে আপ্যায়ন করতে চেয়েও বারেবারে ব্যর্থ হয়েছেন। যুক্তি স্বরূপ তারা বলেছেন, বড্ড মাছের গন্ধ বেরোয় বাঙ্গালী বাড়িতে। তারপর একসময় সকলেই বুঝেছেন তাঁরা এদের সমগোত্রীয় নন বলেই এমন বিরূপ মনোভাব তাদের। এরমধ্যেই মিঠি হঠাৎ করেই পেটে এসে গেছিল। শুরুতেই কুন্দন বলেছিল রাখতে হবেনা। নষ্ট করে ফেল। কঙ্কাবতী বলেছিল না। প্রথম সন্তান ফেলে দিলে আর পরে আসতে নাও পরে। কুন্দন আবারো দোষ দিয়ে বলেছিল মিডলক্লাস বেঙ্গলির মেন্টালিটি বলে। রোজ রোজ এমন সব নিতে পারত না কঙ্কাবতী। আর প্রতিমূহুর্তেই বাঙালীদের ছোট করা। সেদিন রাগের মাথায় বলেই ফেলেছিল সে। এতই যখন বাঙালীদের ছোট চোখে দেখ, আমায় বিয়ে করে আনলে কেন? মারোয়াড়ি মেয়েই তো আনলে পারতে। কুন্দন বলেছিল, তুমি বুঝি জোর করে এসেছ আমাদের বাড়িতে? যেদিন কলেজে প্রোপোজ করেছিলাম হাতে তো চাঁদ পেয়েছিলে তুমি? গলি মে চাঁদ নিকলা। তোমাদের মত অরডিনারি বাড়িতে কেউ আমার মত জামাই স্বপ্নেও ভাবতে পেরেছে কখনো?
কঙ্কাবতী বলেছিল, বুঝতে ভুল করেছিলাম। তুমি শুধুই সুন্দরের প্রেমে পড়েছিলে। আমি মানুষটার প্রেমে পড়নি।
কুন্দন সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল, পেটি বাঙালী মেয়ে। বোকা বাঙালী।
কঙ্কাবতী আর থাকতে না পেরে বলেছিল, তা এতই যদি বাঙালীজাতটার ওপর ঘেন্না তোমার, নিজেদের দেশ ছেড়ে এই বাঙালীর দেশেই ব্যাওসাপাতি করতে আসা কেন বাপু? খুব ঘা লেগেছিল কুন্দনের।
বলেছিল এনাফ ইজ এনাফ। স্টপ ইট।
কঙ্কাবতী বলেছিল, আমি জানতাম বাঙ্গালীরা রেগে গেলে ইংলিশ বলে। এখন দেখছি অবাঙ্গালীরাও বলে।
আরও রেগে গেছিল কুন্দন। বলেছিল, ঐ পেটের মেয়েটাকে আমি রাখব না কিন্তু। ওটাকে ফেলেই ছাড়ব।
কঙ্কাবতী বলেছিল, দেখি কার সাধ্য আমার মেয়েকে আমার থেকে কে আলাদা করে?
ঝগড়ায় ইতি টানতেই হয়েছিল আচমকা এক দুঃসংবাদে। কঙ্কাবতীর বাবার ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকের খবরে সব ওলটপালট হয়ে গেছিল বাবাকে সে যাত্রায় বাঁচানো যায়নি। আর তার কিছুদিনের মধ্যেই মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়ে সব যেন কেমন হয়ে গেল। মায়ের কাছেই ছিল সে। আসা যাওয়া করত। তবে কুন্দনের সঙ্গে সম্পর্কটা তিক্ত থেকে তিক্ততম হতেই পাকাপাকিভাবে কঙ্কাবতী চলে আসবে ঠিক করল মায়ের কাছে। ডিভোর্স নয়। আলাদাই থাকবে সে। তবে রাজী হল না কুন্দনের পরিবার। এদিকে সে সন্তানসম্ভবা তায় আবার ছোটাছুটি। একদিকে মায়ের সংসারে নিদারুণ অর্থাভাব আর অন্যদিকে পেটের শিশুর কলে কলে বেড়ে ওঠা। মায়ের ক্যানসারে হু হু করে খরচা হয়ে যাচ্ছে। মা, মেয়ে দুজনের চিন্তায় ঘুম আসেনা। প্রতিমাসেই দৌড়তে হয় নার্সিংহোম। সুরাহা হয় না। কোষ থেকে কোষান্তরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে সেই মারণ রোগ। ডাক্তার আশার আলো দেন না। অবশেষে সমাধান হল একটা। মায়ের একমাত্র জামাই কুন্দনলাল জানাল সে চিকিত্সার সব ভার নেবে তবে একটা শর্তে। কঙ্কাবতীকে তার কাছে থাকতে হবে নয়ত এই টানাপোড়েনে পেটের বাচ্ছাটির আশা ত্যাগ করতে হবে। কঙ্কাবতীর উভয়সঙ্কট। মা রাখে না সন্তান রাখে? মা বললেন, আমাকে যেতে দে। এ রোগ ভাল হবার নয়। যে আসছে তার যত্ন কর। কঙ্কাবতী চায় দুজনকেই। মা-শিশু দুজনেই তার বড্ড আপন। দোটানায় পড়ে অবশেষে নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়ল সে। প্রবল মানসিক এবং শারীরিক চাপ তার। মায়ের দায়িত্ত্ব নিয়েছে কুন্দন। কেমো শুরু করে মা অনেকটা ভাল আছে। এক একটি কেমোর আকাশছোঁয়া দাম। সব করছে কুন্দন তার শাশুড়ি মায়ের জন্যে। কুন্দনের কথা শুনতেই হবে এখন। নয়ত মা আর সেরে উঠবে না। মিঠির জন্যে মা সেরে উঠে নকশীকাঁথা বানাবে। উলের পোষাক বানাবে বলেছিল। সে আর কোথা থেকে পারত এই রাজ রোগের খরচ জোগাতে? কিন্তু কঙ্কাবতী এখন নার্সিংহোমে ভর্তি। ডেলিভারি বহুদূরে। তার প্রি এক্লেম্পশিয়া। চরম মানসিক টানাপোড়েনে গর্ভাবস্থায় শিশুটির ওপর খুব চাপ পড়েছে। প্রিম্যাচিওর ডেলিভারি করে দিতে হবে, ডাক্তারবাবু জানালেন। জ্ঞান নেই কঙ্কাবতীর অথচ তার মা এখন বেশ সুস্থ হচ্ছেন ধীরে ধীরে। নিজেদের সুবিধার্থেই একই নার্সিংহোমে আছেন তারা। কুন্দনলাল ঢালাও আয়োজন করেছে। দুজনের চিকিত্সার কোনো ত্রুটি রাখেনি সে। একদিকে গাইনি ওয়ার্ডে মেয়ে আর একটু দূরে সেই হাসপাতালের অঙ্কোলজি ডিপার্টমেন্টে তার মা চিকিৎসাধীন। কেমো নিতে নিতে মায়ের কেশশূন্যতা এলেও মা আগের চেয়ে অনেকটা ভাল। আর কঙ্কাবতী? তার অবস্থা বেশ সংকটজনক।
আগেভাগেই ডেলিভারি করে দিলেন ডাক্তার। সন্তানকে বাঁচানোর চেয়ে কঙ্কাবতীকে বাঁচানোই বেশী জরুরী ছিল সেই মূহুর্তে। সিজারিয়ান সেকশান করেই বেবিকে ইনকিউবেশনে মায়ের থেকে আলাদা রাখা হয়েছিল। জ্ঞান ফিরতেই কঙ্কাবতী জেনেছিল তার মিঠি বাঁচেনি। শুধু নার্স বলেছিল, কি সুন্দর মেয়ে হয়েছিল দিদি! তবে ডান গালটা জুড়ে বিশাল কালো জড়ুল ছিল। ভালই হয়েছে জানেন দিদি? মেয়ে সন্তানের ডান দিকে জড়ুল অপয়া, অশুভ। ব্যথায়, যন্ত্রণায় কাবু কঙ্কাবতী আরো ভেঙে পড়েছিল। বলেছিল থামবে তোমরা?
হাতের মুঠোয় ফোনে তারিখটা দেখে ভাবল, আরো তিনমাস পর মিঠির জন্মানোর কথা ছিল। মা বলেছিল সাধ খাওয়াবে। কোনোকিছুই পূর্ণ হলনা। এখন শুধু একটাই সুখবর। তার মা আগের থেকে অনেক ভাল। তিনি বাড়ি ফিরেছেন। মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা হল তার। মা বললেন, দুঃখ করিস নি। তুই বেঁচে থাকলে আবারো একটা মিঠি আসবে তোর পেটে। কঙ্কাবতী বলেছিল, এইজন্যেই বলে বাচ্ছা জন্মানোর আগে তার নাম করে কিছুই বানিয়ে রাখতে নেই। কেন হাত দিলে তুমি উল কাঁটায়? মেঝেতে কাঁথা পাতলে কেন মা? জানতে না এসব?
মা বলল, আর তুই যে নাম দিয়ে ডাকতে শুরু করে দিলি?
অনেকদিন বাদে কুন্দন এসেছিল কঙ্কাবতীর কাছে। নার্সিংহোম থেকে ডিসচার্জ হবে এবার। তার মাথায় কুন্দন আলতো করে হাত রাখতেই কঙ্কাবতী বলেছিল, খুব খুশি তো এবার তুমি? কুন্দন বলেছিল, দেখ বাচ্ছাটাকে না বের করে দিলে তুমি মারা যেতে। আর অসুস্থ বাচ্ছা থাকার চেয়ে … এনি ওয়ে, তোমার মাও তো সে রাত্তিরে বণ্ডে সই দিলেন, শুধু তোমার কথা ভেবে। কঙ্কাবতী বলল, ফিরে গিয়েই কিন্তু আমায় আবার মিঠি এনে দিতে হবে।
কুন্দন বলল, ডক্টর বলেছেন তুমি আর কোনোদিনও মা হতে পারবে না। তোমার পলিসিস্টিক ওভারি ছিল। আর পেটের বাচ্ছার সঙ্গেই বড় হচ্ছিল বিশাল একটা টিউমার। সব বাদ দিয়ে দিয়েছেন ডক্টর। কঙ্কাবতী আকাশ থেকে পড়ল। মানে আমি আর কোনোদিনও মা হতে পারব না? কুন্দন বলল, না। আমরা অ্যাডপ্ট করব সুইটহার্ট। চিন্তা মাত কর।
কিন্তু আমার তো কোনও প্রব্লেম ছিল না। ডক্টর বলেছিলেন মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে প্রেগনেন্সি খুব ভাল । আমার সব রিপোর্ট নরম্যাল ছিল। তিরিশের পরে নাকি সব কমপ্লিকেশন অ্যারাইজ করে।
আরে ছোড়ো না ইয়ার। আভি জিও জি ভরকে।
ভেঙে পড়েছিল কঙ্কাবতী আবার। এবার পাকাপাকিভাবে ফিরে গেছিল মায়ের কাছে। আর নয় কুন্দনের সঙ্গে। কে জানে হয়ত সন্তান শোক, আর মা হতে না পারার দুঃখ ভুলছিল হোটেলে গান গাইবার চাকরীটা পেয়ে। মা বলেছিল, দেখিস বাপু ওসব হোটেলে সব খারাপ মেয়েরা গান গায়। কঙ্কাবতী বলেছিল আমি কি আর মিস্ শেফালি, মিস পাপিয়া হতে চাইছি মা? শুধু সপ্তাহে দুদিন একঘন্টা গান গাইব আর চলে আসব। মনোরঞ্জন করার অন্য মেয়েরা আসে আরো গভীর রাতে। আমার পারফর্মেন্স সন্ধ্যেবেলায়। তুমি চিন্তা কোরো না মা। আমায় ভুলে থাকতে দাও। গানটাই পারি আমি। কুন্দনের কাছে ফিরে যায় নি সে। মনে কর না বিয়ের আগে যেমন টেলিভিশন চ্যানেলে সন্ধ্যেবেলায় গান গাইতে যেতাম তেমনি যাচ্ছি। মা রোজ যাওয়ার সময় বলতেন, দুগ্গা, দুগ্গা। এভাবেই প্রায় রোজ সন্ধ্যেবেলায় গান গাইবার ডাক পড়ত কঙ্কাবতীর। একটা থেকে দুটো থেকে তিনটে। মা ভাবতেন ভালই পয়সা আসছে ঘরে। জামাইয়ের কাছে হাত পাততে হচ্ছে না। মা, মেয়ের দিব্য চলে যাচ্ছে। কঙ্কাবতী ভুলে গেছিল তার অতীত। কুন্দন তার জীবনে এক অভিশাপ।
বেশ কিছু বছর পরে-
মা আর বেঁচে নেই। কঙ্কাবতীর বয়স তখন চল্লিশ ছুঁয়েছে সবে। দেখে মনে হবে না মোটেও। টানটান চেহারা তার। ফিগার মেনটেইন করতে জানে মেয়েটা। চিরকাল তার চেহারা মডেলদের মত। এখন সে কন্ট্যাক্ট লেন্স পরে গান গাইতে যায়। সভ্য পরিশীলিত তার সাজগোজ। হোটেলের সঙ্গে কেজো সম্পর্ক এত বছরের। গান গেয়েই পেমেন্ট নিয়ে চলে আসে। সন্ধ্যের শুরুর স্লটেই গান গায় সে। নতুন প্রজন্মের মদের হুল্লোড়, লাগামছাড়া বেলেল্লাপনা শুরু হয় রাত বাড়লে। কঙ্কাবতীর এসব নাপসন্দ।
এখনকার কলেজ পড়ুয়াদের সঙ্গে তাদের যুগ কে সে মেলাতে পারেনা। এখন কলেজে ঢুকেই তারা নাইটক্লাব শিখে যায়। তন্ত্রে যায়। সারারাত পড়ে থাকে। পাব শিখে ফেলে। মদ, হুক্কা বার সবেতেই দড়ো তারা। এই হোটেলের ডায়াসটা খুব নীচু। যারা খেতে এসেছে তাদের চোখে চোখ রাখা যায় গান গাইতে গিয়ে। আর অন্ধকার তো নয় হোটেল। বেশ জমজমে আলোর মাঝেই গাইতে হয় তাকে। সেদিন সামনেই বসেছে চারকোণা টেবিলে তিনজন ছেলেমেয়ে। একটি মেয়ে, দুটি ছেলে। মন দিয়ে তারা শুনছে কঙ্কাবতীর গলায় গীতা দত্তের পুরোনো হিন্দী গান। চোখ কেবলই চলে যাচ্ছে তাদের দিকে। তারাও তারিফ করছে ওর গানের, বুঝতে পারছে কঙ্কাবতী। পড়তে পারছে ওদের চোখের ভাষা। সহপাঠীই হবে তারা। এদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালে এরা মোবাইলে সেলফি তোলে। ফেসবুকে সেই ছবি পোস্ট করলে আরও গানের অফার আসে। নিজের সম্মান বাড়ে। তার মাঝেও মনে পড়ে যায় নিজের কলেজ জীবনে কুন্দনলালের সঙ্গে রেস্তোঁরায় যাবার কথা।
প্রোগ্রাম শেষে কঙ্কাবতী নিজেই নেমে আসে ওদের কাছে। হাত মেলাতে। শিল্পীর কদর করেছে এরা। তার প্রতিদান স্বরূপ একটা ধন্যবাদ তো দেওয়া শিল্পীর কর্তব্য। মেয়েটি উঠে দাঁড়ায়। খুব চেনা লাগছে আপনাকে। কি সুন্দর গাইলেন আপনি।
তোমার নাম কি?
মেয়েটি বলে মিঠু। কঙ্কাবতী নিজের মিঠির কথা মনে পড়ে যায় সেই শুনে। এমনি হত এদ্দিনে, আজ বেঁচে থাকলে।
আপনি যাবেন কোনদিকে? আমার গাড়িতে যেতে পারেন। কঙ্কাবতী বলে না, থ্যাংক্স। মিঠু বলে, গেলে খুশি হতাম কিন্তু। অনুরোধ ফেলতে পারেনা কঙ্কাবতী। মিঠুর দুই বন্ধু বাই, সি ইউ বলে বেরিয়ে পড়ে। অ্যাপ ক্যাব এসে থামে হোটেলের বাইরে। কঙ্কাবতী আর মিঠু গাড়ির পেছনে উঠে বসে। মহানগরীর কোলাহলকে ছাপিয়ে যায় ওদের গল্পপথ।
মিঠু জানায় সে এক পালিতা কন্যা। তার জন্মের পরে নাকি তাকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল বাইপাসের ধারে। পাড়ার লোকজন সব জানিয়ে দিয়েছে মিঠুকে। ওর এখনকার পালিকা বাবা, মা কুড়িয়ে এনে মানুষ করছে তাকে। এসব জানার পর মিঠুর আর ভালো লাগেনা সেখানে থাকতে।
কঙ্কাবতী বলে, তোমার বয়স কত? মিঠু বলে, সুইট সিক্সটিন জাস্ট কমপ্লিট । তাই তো কলেজে উঠেই রেস্তোঁরা, পাবে যাবার পাসপোর্ট পেয়েছি। ড্যাডিরা ব্যস্ত তাদের লাইফস্টাইল নিয়ে। আমাকে দেবার মত সময় নেই তাদের। শুধু আমায় অনেক অনেক পকেট মানি দেয়। আমার ভাল লাগেনা। আন্টি হোয়াটস্যাপে আছেন? বিনিময় হয় দুজনের নাম্বার।
কঙ্কাবতী ভাবে তার মিঠি বেঁচে থাকলে ষোলো বছরেরই হত এদ্দিনে। ট্যাক্সি থেকে নামার সময় আলো আঁধারিতে খেয়াল হল এবার তার। কঙ্কাবতী চমকে ওঠে। ধুবলা পাতলা মেয়েটি, তণ্বী, শিখরা, সুন্দরী। কিন্তু তার গালের অর্ধেক জুড়ে একটা কালচে জড়ুল। ও মা! এ কেমন করে সম্ভব!
বাড়ি পৌঁছানোর বাকী পথটুকুনি পেরুতে সেদিন বড্ড বেশী সময় লাগল কঙ্কাবতীর । দুয়ে দুয়ে চার হয়ে জীবনের অংকটা মিলল শেষমেশ।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন