short-story-keranigonjer-kerani

কেরানীগঞ্জের কেরানী ও মুক্তি যুদ্ধ
হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত


টিফিনটাইম শেষ হবার পরে সোহেল তার কম্পিউটার নিয়ে কাজে বসতে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময় পাশের ঘর থেকে কোম্পানির এ অফিসের নতুন বস ফোন দিলেন – ‘সোহেল ভাই, একবার আমার চেম্বারে আসেন তো।’

বসের ডাকে ‘আসছি’ বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল সোহেল। সে অনুমান করল হামিদ সাহেব এই অফিস সম্পর্কে সম্ভবত কোন তথ্য সংগ্রহ করবেন সোহেলের কাছ থেকে। এই সওদাগরী অফিসের পার্মানেন্ট বস মামুন স্যার তাঁর মেয়ের শাদীর জন্য এক মাসের ছুটিতে রাজশাহীতে গেছেন। তাঁর জায়গাতেই কোম্পানি ডেপুটেশনে পাঠিয়েছে হামিদ স্যারকে। মাত্র কয়েকদিন হল তিনি তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, এ অফিস সম্পর্কে তাঁর বিশেষ কিছু জানা নেই। তাই, কিছু জানার প্রয়োজন হলেই ডাক পড়ছে এ অফিসের চিফ একাউন্টেন্ট সোহেলের। এ অফিসের অন্যরা পদমর্যাদায় তার নীচে। সোহেল, হামিদ সাহেবের চেম্বারে প্রবেশ করতেই তিনি তাকে চোখের ইশারায় বসতে বললেন, তাঁর সামনে খোলা আছে অফিসের এটেনডেন্স রেজিস্টারটা। সোহেল টেবিলের এ পাশে তাঁর মুখোমুখি বস্ল। এ অফিসটা খুব বড় নয়, সোহেলকে নিয়ে বড় সাহেবের অধীনস্ত কর্মচারীর সংখ্যা সাত জন। তার মধ্যে দু-জন পিওনও আছে। হামিদ স্যার রেজিস্টার খাতাটায় আঙুল বোলাতে বোলাতে এক জায়গায় তর্জনী থামিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘এই আব্দুল তরফদার নামে লোকটার কী কাজ বলুন তো?’

সোহেল জবাব দিল আব্দুল ভাই টাইপিস্ট। তবে টাইপ রাইটারের কাজ তো এখন উঠেই গেছে, সবই তো এখন কম্পিউটারে টাইপ হয়…’

‘তাহলে লোকটার কাজ কী?’ সোহেলের কথা শেষ হবার আগেই আবারও প্রশ্ন করে উঠলেন নব নিযুক্ত অস্থায়ী বড়কর্তা।

সোহেল জবাব দিল, ‘মামুন স্যার কোন প্রয়োজন হলে তখন হয়তো কোন লেখালেখি বা কপি করার কাজ দেন ওঁকে।’

সোহেলের জবাব শুনে হামিদ স্যার বললেন, ‘আর যখন তার সে কাজ না থাকে তখন লোকটা কী করে, গল্প?’

নতুন সাহেবের এ কথা শুনে সোহেল বুঝতে পারল ইতিমধ্যে কেউ এ খবরটা লাগিয়েছে তাঁর কানে। হয়তো বা পিয়ন রাকিব হবে। তার এসব স্বভাব আছে। আব্দুল ভাইয়ের এ ব্যাপারে সত্যিই সুনাম বা দুর্নাম আছে। একটু সুযোগ পেলেই লোকটা অফিসের অন্য লোকদের গল্প শোনাতে বসে। মুক্তিযুদ্ধর গল্প। কাজের সময় গল্প করার জন্য মামুন স্যার মাঝে মাঝে তিরস্কারও করেন তাকে। কিন্তু ব্যাস ওই পর্যন্তই। কারণ আব্দুল ভাই লোকটা এ অফিসের বর্তমানে সব থেকে পুরানো কর্মচারী আর সৎ লোক। লোকটা সত্যিই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।

হামিদ স্যারের প্রশ্ন শুনে সোহেল মৃদু হেসে বলল, ‘আব্দুল ভাইয়ের বাসা একসময় ছিল ওপারের কেরানীগঞ্জে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই কেরানীগঞ্জ থেকেই খান সেনাদের বিরুদ্ধে ঢাকাতে গেরিলা আক্রমণ পরিচালিত হত। শৈশবে আব্দুলভাই সে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। উনি মুক্তিযোদ্ধা। মাঝে মাঝে উনি সে সব গল্পই শোনান। তবে লোকটা আমাদের পুরানো কর্মচারী। অসম্ভব বিশ্বাসী এবং সৎ।’ – একথা বলে আব্দুল ভাইয়ের সম্পর্কে ওঠা অভিযোগটা হালকা করার চেষ্টা করল সোহেল।

কিন্তু কথাটা শুনে হামিদ সাহেবের কোন ভাবান্তর হল না। বরং তিনি কিছুটা উত্তেজিত ভাবে বললেন, ‘কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাবার জন্য তো কোম্পানি তাঁকে বেতন দেয়না। আমি এ কথাও জেনেছি যে সে অন্যদের গল্প শুনিয়ে তাদের কাজ নষ্ট করে।’

একথা বলার পর তিনি বললেন, ‘দেখিন আমি যে কয়দিন এ অফিসের দায়িত্বে আছি সে কয়দিন আমার নিয়মে অফিস চলবে। কোম্পানির কাজের ক্ষতি আমি বরদাস্ত করব না। কেউ আমার নির্দেশ অমান্য করলে আমি কোম্পানির কাছে তাকে অবসর দেবার সুপারিশ করব। জানেন তো কোম্পানি আজকাল আর বাড়তি লোক রাখার পক্ষপাতি নয়। ওই আব্দুল নামের লোকটাকে কাজ দিন। যাতে তাকে কাজ করতে হয়, আর সে গল্প করে অন্য কারো কাজ নষ্ট না করতে পারে।’

হামিদ স্যার অস্থায়ী বস হলেও বর্তমানে এই অফিসের বস। তিনি কোন অভিযোগ জানালে সত্যিই আব্দুল ভাইয়ের কর্মজীবনের শেষ প্রান্তে বিপত্তি ঘটতে পারে। আরমাত্র কয়েক বছর চাকরী আছে তার। বসের কথা শুনে সোহেল মৃদু ইতস্তত করে জানতে চাইল, ‘তাঁকে কী কাজ দেব স্যার। তাঁকে দেবার মতো আমার তো কোন কাজ নেই। কারণ উনি টাইপ ছাড়া ক্যালকুলেশনের কাজ তিনি পারেন না।’

হামিদ সাহেব কিন্তু এ কথা শুনেও তাঁর বক্তব্য থেকে পিছু হঠলেন না। তিনি বললেন, ‘আমি যে কয়দিন আছি সে কয়দিন মুক্তিযুদ্ধর গল্প শুনিয়ে আর সে বেতন নিতে পারবে না।’ – এ কথা বলার পর একটু ভেবে নিয়ে তিনি বললেন, ‘একটা কাজ করুন। কম্পিউটার থেকে এ অফিসের গত তিনবছরের দৈনিক ব্যালেন্স শিটের প্রিন্ট আউট বার করুন। আর সেটা টাইপ করতে বলুন লোকটাকে। আর হ্যাঁ, তাকে বড় ঘর থেকে উঠিয়ে এনে আমাদের করিডোরে ফাঁকা ঘরটাতে বসিয়ে দিন। যাতে সে টাইপ করতে করতেও অন্য কারো সঙ্গে গল্প না করতে পারে, সে যেন বড় ঘরে তার পুরানো জায়গায় না বসে আর আমরাও তার টাইপ রাইটারের খটরখট্‌ শব্দ শুনে বুঝতে পারি সে কাজ করছে।’

এ কথা বলে হামিদ স্যার তাঁর ঘাড় নেড়ে বুঝিয়ে দিলেন যে তাঁর যা বক্তব্য ছিল তা বলা শেষ হয়ে গেছে। সোহেল বলল, ‘ঠিক আছে স্যার তাই করছি। কাল থেকে তাকে আমাদের সামনের ঘরে বসিয়ে দিচ্ছি।’ – এ কথা বলে সোহেল তার কর্তব্য পালনের জন্য বসের চেম্বার ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এল।




বসের এ নির্দেশ পালন মানে যে আব্দুল ভাইয়ের ওপর কার্যত অত্যাচার নামিয়ে আনা তা সোহেলের বুঝতে অসুবিধা হল না। লোকটা গল্পকরা ছাড়া আর লোকজনের মাঝে ছাড়া কিছুতেই থাকতে পারে না। বলা ভাল লোকটা মুক্তিযুদ্ধর কথা না বলে একদিনও থাকতে পারে না। হয়তো বা পরিজনহীন লোকটার সেটাই একমাত্র বেঁচে থাকার সম্বল, আনন্দ। মামুন সাহেব ছুটিতে গেলে কোম্পানি তাঁর জায়গায় অন্য অফিস থেকে ডেপুটেশনে যে সব লোক পাঠায় তাঁরা অনেকেই এ অফিসে এসে তাঁদের কর্তৃত্ব, দক্ষতা জাহির করার চেষ্টা করেন তা ইতিপূর্বেও দেখেছে সোহেল। তবে হামিদ স্যারের মধ্যে এ ব্যাপারটা বেশী মাত্রাতেই রয়েছে বলে সোহেলের মনে হল। নইলে যে কাজ করে অফিসের কোন লাভ হবে না তা জেনেও তা করাবার নির্দেশ দিতেন না তিনি। কিন্তু তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদ করলে আব্দুল ভাইয়ের ক্ষতি হবার সম্ভাবনা আছে বুঝতে পেরে তাঁর নির্দেশ পালন করারই সিদ্ধান্ত নিল সোহেল। করিডোরের শেষ প্রান্তে কর্মচারীদের বসার ঘর। বসের ঘর ছেড়ে সোহেল সেদিকে এগোলো।

দরজার পাল্লাদুটো ভেজানো অবস্থায় ছিল। নিঃশব্দে দরজাটা খুলে দাঁড়াল সোহেল। টিফিন পিরিয়ড শেষ হয়ে গেছে, কর্মীরা যে যার টেবিলে কম্পিউটার বা ফাইলপত্র সামনে বসে আছেন ঠিকই। কিন্তু তাঁরা কেউ কাজ শুরু করেননি এখনও। তাঁদের দৃষ্টি ঘরের কোণে একটা টেবিলের উপর নিবদ্ধ। সেই টেবিলে একটা টাইপ রাইটার রাখা। তার ওপর দু হাত রেখে এক পালিত কেশ চশমা ওয়ালা প্রৌঢ় বলে চলেছেন, ‘খান সেনারা তখন কেরানী গঞ্জের আমাদের পাশের গ্রাম কোনাখোলা জ্বালিয়ে দিয়েছে, বহু মানুষকে খুন করেছে তারা। তাদের কাছে রাইফেল, মেশিনগান। আর আমাদের সম্বল বলতে এখন কয়েকটা গাদা বন্দুক আর ঘরের বঁটি, কাটারি। কিন্তু আমাদের সব থেকে বড় অস্ত্র এখন বঙ্গবন্ধুর সেই বক্তব্য, ‘সাত কোটি মানুষকে আর দাবায়ে রাখতে পারবা না। বাঙালি মরতে শিখেছে…।’ একদিন সূর্য ডোবার আগে আমরা দেখতে পেলাম খান সেনা ভর্তি একটা লঞ্চ বুড়ি গঙ্গা বেয়ে আমাদের দিকে আগায় আসতাছে!’ – এ পর্যন্ত বলেই হঠাৎ দরজার দিকে চোখ পড়তেই সোহেলকে দেখে থেমে গেলেন অফিসের কেরানী টাইপিস্ট আব্দুল তরফদার। অন্যরা অবশ্য সোহেলের উপস্থিতি খেয়াল করেননি। তাঁদের অনেকেই তন্ময় হয়ে শুনছিলেন মুক্তি যোদ্ধার গল্প। আব্দুল ভাই গল্প থামাতেই তাঁদের একজন বলে উঠলেন, ‘তারপর? তারপর?’

মুক্তিযোদ্ধার কষ্ট নিঃসৃত কাহিনী যে টুকু সোহেলের কানে গেছে, মুহূর্তের জন্য হয়তো সোহেলও তার মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল। এ কথা অস্বীকার করে লাভ নেই যে, ‘মুক্তি যুদ্ধ’ শব্দটা বললেই এদেশের অনেকের মতো সোহেলের শরীরেও একটা রোমাঞ্চ কাজ করে। কিন্তু আব্দুল ভাই কথা থামিয়ে তার দিকে তাকাতেই সম্বিত ফিরে পেল সোহেল। এটা একটা অফিস, গল্প শোনাবার বা শোনার জায়গা নয়। তাই যে লোকটা প্রশ্ন দিলেন, ‘তারপর?’ – তাঁর কথার জবাবে সোহেল বলে উঠল, ‘তারপর আর কিছু নেই। গল্প এখানেই শেষ।’

হঠাৎ সোহেলের কন্ঠস্বর শুনে মৃদু চম্‌কে উঠে সে ঘরের লোকগুলো তাকাল তার দিকে। আব্দুল ভাইয়ের থেকেতো বটেই এ ঘরের অন্য লোকদের তুলনায় বয়েসে সোহেল অনেক ছোট হলেও পদমর্যাদায় সোহেল এ অফিসের দ্বিতীয় ব্যক্তি বলে তাকে দেখে সবাই এরপর উঠে দাঁড়াল। সোহেল এরপর ঘরের সবার ওপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, ‘টিফিন টাইমতো পেরিয়ে গেছে তাই না?’ সোহেলের কথার অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে পেরে মাথা নীচু করল কয়েকজন আর আব্দুল ভাইয়ের মুখমণ্ডলেও একটা লজ্জার ভাব ফুটে উঠল। তবে সোহেল আর সেখানে দাঁড়িয়ে কাউকে ভৎর্সনা করল না। অন্য কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে সে বলল, ‘যে যার কাজ শুরু করুন।’

এ কথা বলে সে কেরানীগঞ্জের আব্দুল তরফদারকে বলল, ‘আব্দুল ভাই আপনি আমার রুমে আসুন, দরকার আছে।’

সে জায়গা থেকে ফিরে সোহেল তার নিজের রুমে ঢুকে বসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পায়জামা- পাঞ্জাবী পরা শীর্ণ চেহারার প্রৌঢ় আব্দুল ভাই এসে দাঁড়ালেন সে ঘরে। তিনি মনে হয় মৃদু হাসতে যাচ্ছিলেন সোহেলের দিকে তাকিয়ে, ঠিক যেমন তিনি সোহেলের সামনে এসে দাঁড়াবার পর হাসেন। যে হাসিতে সৌজন্য, সম্ভ্রম, স্নেহ মিশে থাকে তাঁর পুত্রসম ওপরওয়ালার জন্য। কিন্তু আব্দুল ভাই সম্ভবত সোহেলের মুখের ভাব দেখে অনুমান করলেন কিছু একটা গম্ভীর ব্যাপার ঘটেছে। তাই তিনি যেন হাসতে গিয়েও নিজেকে সম্বরণ করে নিলেন। সোহেল গম্ভীরভাবে কয়েক মুহূর্ত তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকার পর গম্ভীরভাবে তাঁকে বলল, ‘ কোম্পানির এ অফিসের গত তিন বছরের দৈনিক হিসাবপত্র দেওয়া হবে আপনাকে। কাল থেকে সেগুলো টাইপ করার কাজ করবেন আপনি। যত দ্রুত সম্ভব কাজটা করতে হবে আপনাকে।’

আয়-ব্যয় বা হিসাব সংক্রান্ত কাজ যে বেশ কিছু বছর ধরে কম্পিউটারের মাধ্যমেই ছাপা হয় তা জানেন আব্দুল। তাই কথাটা শুনে যেন মৃদু বিস্মিত হলেন তিনি। তবে ব্যাপারটার কারণ সম্পর্কে তিনি কোন প্রশ্ন করলেন না। কারণ, তাঁর কাজই তো টাইপ করা। আব্দুল ভাই একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, ‘আচ্ছা স্যার করব।’

সোহেল বলল, ‘ হ্যাঁ। ফারুক ভাই আপনাকে কম্পিউটার থেকে প্রিন্ট আউট বার করে দেবেন। সেগুলো দেখে আপনি টাইপ করবেন।’

এ কথা বলার পর সোহেল বলল, ‘তবে আপনি কাজটা করবেন করিডোরে আমাদের ঘরের উল্টোদিকের ঘরে বসে। সবার সঙ্গে বসে আপনার নিজের টেবিলে নয়। আমি সাকিব ভাইকে বলব আপনার টাইপরাইটার, কাগজপত্র সে ঘর থেকে ও ঘরে পৌঁছে দিতে।’

সোহেলের এ কথা শুনে এবার যেন মৃদু আঁতকে উঠলেন আব্দুল। তিনি বললেন, ‘না, না। আমার জন্য আলাদা ঘরের দরকার নেই। আমি সবার মধ্যে বসে কাজ করছি সেটাই বেশ। ওখানে বসে কাজ করতে আমার কোন অসুবিধা হবে না।’

আব্দুল ভাইয়ের কথার জবাবে সোহেল বলল, ‘এটা আপনার সুবিধা-অসুবিধার ব্যাপার নয়। হামিদ স্যার সামনের ঘরে বসে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর সেটাই আপনাকে জানালাম।’

সোহেলের এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই স্পষ্ট বিস্ময় ফুটে উঠল কেরানীগঞ্জের আব্দুল ভাইয়ের মুখমণ্ডলে। তিনি বলে উঠলেন, ‘স্যার এমন নির্দেশ দিলেন কেন?’

সোহেল একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘এর আগেই আপনাকে অনেকবার বলা হয়েছে অফিস আওয়ার্সে অন্যদের সঙ্গে গল্প না করতে। সবাইতো আর মাসুদ স্যার বা আমি নই। কথাটা হামিদ স্যারের কানে গেছে। আপনি গল্প বলিয়ে অন্যদের কাজ নষ্ট করেন। তাই এই ব্যবস্থা।’

আব্দুল ভাইয়ের মুখটা একথা শুনে কেমন যেন পাংশু হয়ে গেল। তিনি বললেন, ‘এ হুকুমের কি কোন পরিবর্তন হবে না? আপনি দয়া করে একটু বলে দেখুন না স্যারকে। আপনার বা বড় স্যারের চিন্তার কোন কারণ নেই। যা কাজ বলবেন তা আমি নিজের জায়গাতে বসেই করে দেব। কিন্তু আমাকে অন্য ঘরে বসাবেন না। একলা বসলে আমার দম আটকে আসবে।’

আব্দুল ভাইয়ের মনের অবস্থা বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হল না সোহেলের। লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে না পারলে তাদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাতে না পারলে হয়তো সত্যিই দমবন্ধ হবার উপক্রম হবে এই মুক্তিযোদ্ধার। কিন্তু এর পাশাপাশি সোহেল এটাও বুঝতে পারল যে ব্যাপারটা নিয়ে হামিদ স্যারকে অনুরোধ জানালে হিতে বিপরীত হবার সম্ভাবনা। তিনি যদি সত্যিই আব্দুল ভাইয়ের সম্পর্কে কোম্পানির কাছে অভিযোগ জানান তবে এই শেষ বয়সে এসে আব্দুল ভাইয়ের ক্ষতি হতে পারে। মাত্র একমাসের তো ব্যাপার। এ কটা দিন আব্দুল ভাই হয়তো কষ্ট পাবেন ঠিকই, কিন্তু মাসুদ স্যার ফিরে এলেই আব্দুল ভাইকে আবার সবার সঙ্গে তার নিজের চেয়ারে বসানো যাবে। এখন যা পরিস্থিতি তাতে হামিদ স্যারের নির্দেশ পালনই আব্দুল ভাইয়ের পক্ষে ভালো হবে। একথা ভেবে নিয়ে সোহেল তার কণ্ঠস্বরে কাঠিন্য ফুটিয়ে বলল, ‘আমার অনুরোধে তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবেন না। এটা অফিস, বাড়ি নয়। ওপরওলার নির্দেশ সিদ্ধান্ত আমাকে মেনে চলতে হয় আর আপনাকেও মেনে চলতে হবে। তিনি যেখানে বসে কাজ করতে বলেছেন সেখানে বসেই আপনাকে কাজ করতে হবে। পুরানো ঘরে আর আপনি ঢুকবেন না। হামিদ স্যার যদি আপনার সম্পর্কে ওপরতলায় অভিযোগ জানায় তবে কিন্তু আমার কিছু করার থাকবে না। উনিই কিন্তু এই অফিসে আগামী একমাস আমাদের দণ্ডমুন্ডের কর্তা।’

সোহেলের কথা শুনে শীর্ণ প্রায় বৃদ্ধ লোকটা যেন স্বগোতক্তির স্বরে বললেন, ‘হামিদ স্যার কি জানেন যে আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম?’

সোহেল এবার তার কণ্ঠস্বরে আরও কাঠিন্য ফুটিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ তিনি জানেন, তবে তিনি মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলে অফিস চলেনা। আর কোম্পানি আপনাকে কাজ করার জন্য বেতন দেয়, মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাবার জন্য নয়।’ – একথা বলতে সোহেলের খারাপ লাগলেও পরিস্থিতির বিচারে সোহেলকে কথাগুলো বলতে হল তাঁকে।

সোহেলের মুখ থেকে এমন কঠিন বাক্য প্রয়োগ ইতিপূর্বে শোনেননি আব্দুল ভাই। কয়েক মুহূর্ত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর ‘আচ্ছা স্যার’ বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। সোহেল এরপর একাউস্টেন্স ফারুক ভাই আর পিয়ন রাকিবকে ডেকে পাঠিয়ে আব্দুল ভাইয়ের জন্য তাদের কী কাজ করতে হবে তা বুঝিয়ে দিল।




সোহেল পরদিন অফিস শুরু হবার পর তার চেম্বারে বসে শুনতে পেল তার ঘরের উল্টোদিক থেকে ভেসে আসা টাইপরাইটারের খটাখট শব্দ। অর্থাৎ নির্দেশ মেনে কাজ শুরু করেছেন কেরানীগঞ্জের কেরানী টাইপিস্ট আব্দুল তরফদার। সে শব্দ শুনে লোকটাকে একা করে দেবার জন্য সোহেলের খারাপ লাগল ঠিকই কিন্তু হামিদ সাহেবের ক্ষমতা প্রদর্শনের হাত থেকে লোকটাকে রক্ষা করার জন্য তাঁর নির্দেশ পালনের দরকার ছিল।

অন্যদিনের মতোই এদিনও সোহেলের ডাক পড়লে হামিদ স্যারের ঘরে। সে ঘরে যাবার জন্য সোহেল করিডোরে পা রেখে তাকাল সামনের ঘরটার দিকে। দরজাটা খোলা। সোহেল দেখল ঘরের মাঝখানে টেবিল চেয়ার নিয়ে দরজার দিকে পিঠ দিয়ে বসে একমনে টাইপ করে চলেছেন আব্দুল ভাই। তাঁর টাইপ রাইটারের শব্দ অন্য ঘরটার মধ্যে গুঞ্জন তুলে ছিটকে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসছে। সে-ঘরের সামনে মুহূর্তখানেক দাঁড়িয়ে থেকে সোহেল এরপর প্রবেশ করল হামিদ স্যারের ঘরে। টাইপ রাইটারের শব্দটা এ ঘরেও ঢুকছে। এদিন সোহেলকে অফিস সংক্রান্ত অন্য বিষয়ে কথা বলার জন্য ডেকেছিলেন হামিদ স্যার। তা নিয়েই কথা হল দুজনের মধ্যে। আব্দুল ভাইয়ের কাজ নিয়ে তিনি কোন কথা না বললেও সোহেলের মনে হল করিডোর হয়ে ভেসে আসা টাইপরাইটারের শব্দটা যেন বেশ উপভোগ করছেন তিনি। কারণ হামিদ স্যার সোহেলের সঙ্গে কথা বলার সময় টাইপরাইটারের শব্দের তালে তালে তাঁর হাতের পেনসিলটা বেশ কয়েকবার টেবিলে ঠুকলেন। ওভাবে তাল ঠুকে তিনি যেন বুঝিয়ে দিতেন যে অস্থায়ীভাবে হলেও তিনি এ অফিসে আছেন যে কয়দিন, এ অফিসে তাঁরই অভ্রান্ত কর্তৃত্ব বর্তমান। তিনিই এ অফিসের দণ্ডমুণ্ডের একমাত্র কর্তা, তাঁর হুকুমেই এ অফিসের সব কিছু পরিচালিত হবে। কথা শেষ করে এরপর নিজের ঘরে ফিরে এল সোহেল। কাজ করতে করতে সোহেল শুনতে পেল বাইরে থেকে ভেসে আসা টাইপরাইটারের শব্দ। এমন কী টিফিনের সময়ও যে শব্দের বিরাম ঘটলনা। দিন কেটে গেল এক সময়।

শুধু সে দিনটা নয়, অফিসে ঢুকে টাইপরাইটারের শব্দ শুনেই একটা করে দিন কাটতে লাগল সোহেলের। বাইরে বেরিয়ে সামনের ঘরের দিকে তাকালেই সোহেল দেখে, কোন দিকে না তাকিয়ে এক মনে পাশে রাখা কাগজ দেখে টাইপ করে চলেছেন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল। না, তিনি এখন মুক্তি যোদ্ধা নন, এ অফিসের টাইপিস্ট কেরানী আব্দুল। অফিসের অন্য কর্মচারীদের মুখ থেকে সোহেল জানতে পারল আব্দুল আর তাদের ঘরে প্রবেশ করেন না। দেখা হলেও নাকি বিশেষ কথা বলেন না তাদের সঙ্গে। ঠিক দশটায় অফিসে এসে নিজের ঘরে ঢুকে টাইপ করতে বসে যান। কাজ থেকে ওঠেন পাঁচটা বাজলে। সবার শেষে অফিস ছাড়েন তিনি। দুটোদিন কেটে যাবার পরই সোহেল বুঝতে পারল ভেসে আসা টাইপরাইটারের শব্দ যেন চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে মিলে মিশে গেছে। কয়েক মুহূর্তর জন্য সে শব্দ কানে না এলে সোহেলের কলমও যেন থেমে যায়। মনে হয় যেন কোথাও কোন ছন্দ পতন হল! আর টাইপের শব্দগুলোকেও যেন আলাদা আলাদা ভাবে চিনতে পারে সোহেল। কখনও তা বাজতে থাকে ধীর ছন্দবদ্ধ লয়ে, আবার কখনও বা সেই শব্দ অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বাজে। যেন বুলেট ছিটকে বেরোচ্ছে টাইপরাইটার থেকে!

সোহেলদের অফিসে সপ্তাহর প্রথম কাজের দিন হল শনিবার। বৃহস্পতিবার অর্ধ দিবস হয়ে অফিস ছুটি হয়ে যায়। শুক্রবার সাপ্তাহিক পূর্ণ দিবস ছুটি। আব্দুল ভাইকে কাজে বসানো হয়েছিল রবিবার থেকে। দেখতে দেখতে মাঝের আরও তিনটে দিন অতিক্রান্ত হয়ে বৃহস্পতিবার এসে গেল। এদিন অর্ধ দিবসের পর ছুটি হয়ে যাবে। অফিসে ঢুকে নিজের চেয়ারে বসে কাজ শুরু করতেই সোহেল রোজকার মতো শুনতে পেল টাইপরাইটারের শব্দ। আজ যেন তা ঝড় তুলতে শুরু করেছে। সোহেলের যেন মনে হতে লাগল কোন তীব্র প্রতিবাদ ধ্বনিত হচ্ছে সেই শব্দে। কেমন যেন একটা অস্বস্তি বোধ হতে লাগল সোহেলের। সে ভাবল আজ একবার আব্দুল ভাইকে ডেকে সে কথা বলবে।

টাইপরাইটারের ঝড় তোলা সেই শব্দ শুনতে শুনতেই এক সময় বেলা দুটো বাজল। অফিস ছুটি হয়ে গেল। তখনও কিন্তু বেজে চলেছে টাইপরাইটার। অফিস ছেড়ে বেরোবার আগে সোহেল তার ভাবনা মতো পিয়নকে দিয়ে ডেকে পাঠালেন আব্দুল ভাইকে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরে প্রবেশ করলেন আব্দুল ভাই। একটা ক্লান্তির ছাপ যেন ফুটে আছে তাঁর মুখে। সোহেল লক্ষ্য করল তাঁর দু-হাতের আঙুলগুলো নড়ছে। যেন তখনও টাইপ করে চলেছে তাঁর আঙুলগুলো!

সোহেল তাঁকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার কাজ কতদূর হলো?’

কেরানী টাইপিস্ট আব্দুল ভাই জবাব দিল, ‘হামিদ স্যার চাইলে দিয়ে দিলেই হবে।’

সোহেল কথাটা শুনে বেশ আশ্চর্য হল। তার হিসাব মতো কাজ শেষ হতে আব্দুল ভাইয়ের অন্তত দিন দশবারো সময় লাগার কথা। কিন্তু চার দিনের মধ্যেই কাজটা করে ফেললেন আব্দুল ভাই! বেশ তাজ্জব ব্যাপার। অবশ্য সোহেল কথাটা শুনে খুশিও হল এই ভেবে যে হামিদ সাহেব বুঝতে পারবেন আব্দুল ভাইয়ের সম্পর্কে গল্প করার অভিযোগ থাকলেও তাঁকে কাজ দিলে তিনি তা করতে পারেন, লোকটা আসলে স্বভাবগত ভাবে ফাঁকিবাজ নন, কাজ থাকেনা বলে তিনি অন্য লোককে মুক্তিযুদ্ধর গল্প শোনান।

সোহেল এরপর আব্দুল ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলল, ‘ঠিক আছে শনিবার এসে আপনার কাজ দেখব খন। আপনি শনিবার অফিস বসার পর আপনার কাজ নিয়ে আসবেন।’

আব্দুল ভাই সংক্ষিপ্ত জবাব দিল, ‘জ্বী’ বলে। এরপর তিনি সোহেলকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। সোহেলও কিছুক্ষণের মধ্যে রওনা হল নিজের বাসায় ফেরার জন্য।




মাঝে শুক্রবার ছুটির দিনটা কেটে গেল। শনিবার সপ্তাহর প্রথম দিন। তবে বাইরে অফিসেরই একটা কাজ সেরে আসায় এদিন অফিসে আসতে এক ঘণ্টা দেরী হল সোহেলের। অফিসে এসে নিজের চেয়ারে বসেই সোহেলের মনে হল কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে তার। কী যেন একটা নেই! কয়েকমুহূর্তের মধ্যেই অবশ্য সোহেল ব্যাপারটা ধরতে পারল। টাইপ রাইটারের শব্দটা আর শোনা যাচ্ছে না। যে শব্দ চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে এমন ভাবে মিশে থাকে যে তার অনুপস্থিতির কারণে ফাঁকা লাগছে সোহেলের। তার মনে পড়ল আজ তার আব্দুল ভাইয়ের কাজ বুঝে নেবার কথা। এ কথা ভেবে সে বেল বাজাতে যাচ্ছিল পিয়নকে ডেকে আব্দুল ভাইকে তার ঘরে আসার জন্য। ঠিক সেই সময় সোহেলের ঘরে প্রবেশ করলেন অফিসের আর এক কেরানী তৌসিফ ভাই। তাঁর মুখমণ্ডলে লেগে আছে থমথমে ভাব। তিনি এসে দাঁড়ালেন সোহেলের টেবিলের সামনে।

সোহেল তাঁকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার বলুন?”

প্রশ্নর জবাবে তৌসিফ একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘পরশু রাতে আমাদের আব্দুলভাইয়ের এন্তেকাল হয়েছে। মারা গেছেন তিনি।’

কথাটা শুনেই সোহেল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বিস্মিত ভাবে বলল, ‘আব্দুলভাই মারা গেছেন! কীভাবে?’

তৌসিফ ভাই বললেন, ‘এপারে বাংলামোটরে ওঁর বাসার কাছেই তো আমার বাসা। তাই লোক মুখে আজ সকালে খবরটা জানতে পারলাম। হার্ট অ্যাটাক। আব্দুল ভাইতো গল্পবাজ লোক ছিলেন। কিন্তু কদিন ধরে নাকি বাসাবাড়ির অন্যদের সঙ্গেও গল্পবলা গন্ধ করে দিয়েছিলেন তিনি। নিজের লোক বলতে তো তাঁর অন্য কেউ ছিল না। বাসা বাড়িতে অন্য যারা ভাড়া থাকেন তারাই তাঁকে নিয়ে গিয়ে বুড়িগঙ্গার ওপাড়ে কেরানীগঞ্জে গতকাল দফন করে এসেছেন।’

এ কথাগুলো একটানা বলে থামলেন তৌসিফ।

আকস্মিক এই সংবাদ পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সোহেল।

তৌসিফ এরপর বিমর্ষ ভাবে বললেন, ‘আপনাকে কথাটা জানিয়ে গেলাম। বড় সাহেব হামিদ স্যারকে কথাটা জানিয়ে দেবেন।’ – এ কথা বলে ঘর ছাড়লেন শোকগ্রস্থ লোকটা। এই অপ্রত্যাশিত দুঃসংবাদটা জানার পর তার প্রাথমিক অভিঘাত কাটতে সোহেলের বেশ কয়েক মিনিট সময় লাগল, তারপর তার মনে হল ঘটনাটা তার এখনই হামিদ স্যারকে জানানো দরকার। টেবিলা রাখা কাচের গ্লাসের পানিটা এক চুমুকে শেষ করে সোহেল তার ঘর থেকে বেরোল হামিদ স্যারকে খবরটা দেবার জন্য।

হামিদ স্যারের ঘরে ঢোকার আগেই তার চোখ গেল সামনের ঘরটার দিকে। যে ঘরে বসে কাজ করছিলেন আব্দুল ভাই। খোলা দরজা দিয়ে সে ঘরে তাঁর টেবিল চেয়ার, টাইপরাইটার টাইপ করা কাগজপত্র সব দেখা যাচ্ছে। শুধু লোকটাই নেই। যে আর ওই টাইপরাইটারের সামনে কেরানীগিরি করতে বসবে না কোন দিন। সোহেলের মনটা সেই ঘরের দিকে তাকিয়ে বিষন্নতায় ভরে উঠল। সোহেল এরপর যেন কোন কিছুর অদৃশ্যটানে হামিদ সাহেবের ঘরে যাবার আগে পায়ে পায়ে প্রবেশ করল সামনের ঘরটাতে।

সে গিয়ে দাঁড়াল আব্দুল ভাইয়ের টেবিলের সামনে। টাইপরাইটারের এক পাশে যত্ন করে রাখা আছে আব্দুল ভাইয়ের দিস্তে দিস্তে টাইপ করা কাগজ। সোহেলের ইচ্ছা হল কাগজগুলো স্পর্শ করার। আব্দুল ভাইয়ের স্মৃতি তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে শুরু করেছে। সোহেল তুলে নিল আব্দুল ভাইয়ের স্পর্শ মাখা এক তাড়া কাগজ।

আর এরপর কাগজগুলো নাড়াচাড়া করতে গিয়েই আশ্চর্য হয়ে গেল সে! প্রথম কয়েকটা পাতায় হামিদ সাহেবের নির্দেশ মতো আব্দুলভাই অফিসের হিসাব টাইপ করেছেন ঠিকই। কিন্তু সে মাত্র কয়েকটা পাতা। বাকি পাতাগুলোতে তিনি লিখে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের গল্প! যে গল্প তিনি নিরন্তর ভাবে শুনিয়ে চলেন সবাইকে বছরের পর বছর ধরে। তিনি যাতে অন্য কাউকে গল্প বলে কাজের সময় নষ্ট না করেন সে জন্য তাঁকে একলা বসানো হয়েছিল এ ঘরে। কিন্তু পাতার পর পাতা জুড়ে টাইপরাইটারের শব্দে তিনি বলে গেছেন সেই গল্প, মুক্তিযুদ্ধর গল্প। ব্যাপারটা কেউ বুঝতে পারেনি।

দিস্তা দিস্তা মুক্তিযুদ্ধর কাহিনী টাইপ করা কাগজগুলোর শেষ পাতাটা হাতে তুলে নিল সোহেল। যে পাতাটা শেষ হয়েছে বঙ্গবন্ধুর বিখ্যাত বক্তব্য দিয়ে ‘…কেউ দাবায় রাখতে পারবা না।’

কাগজটা হাতে নিয়ে নিশ্চুপভাবে দাঁড়িয়ে রইল সোহেল। তার মনে হল সত্যিইতো যার রক্তে মিশেছিল মুক্তিযুদ্ধ, খান সেনারা যাকে দাবায় রাখতে পারেনি সেই কেরানীগঞ্জের কেরানী মুক্তিযোদ্ধাকে কি কোন অফিসের পক্ষে, নিয়মের পক্ষে হামিদ স্যারের মতো মানুষরা কোন দিন বেঁধে রাখতে পারেন? না পারেন না। মুক্তিযোদ্ধাদের দাবায় রাখা যায় না।

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *