শফিক হাসান
দুয়ার থেকে দুয়ারে ঘুরতে ঘুরতে সম্ভাবনার শেষ আলোটুকুও নিভে গেছে বলে অনুধাবন করে কুদ্দুস। হতাশায় নুয়ে না পড়ে উপায় থাকে না। পাঁচ বছর যাবত কোমল কুদ্দুস নামে কবিতা লিখেছে এন্তার, অথচ বই প্রকাশ করতে পারেনি এখনো। অন্যদিকে ফেসবুকে মাত্র চার মাস লেখালেখি করেও অনেকের কবিতা-গল্পের বই বেরিয়েছে। সেসবের আবার ভালো পত্রিকায় রিভিউও হয়। নামী লোকেরা সমালোচনার নামে প্রশংসাবাক্য দেন।
স্পাইরাল করা পান্ডুলিপি নিয়ে অনেক প্রকাশকের দোরগোড়াতেই ধর্না দিয়েছে সে। সবারই এক জবান কবিতার বই চলে না। চলে না মানে বিক্রি হয় না। প্রকাশকরা বিনিয়োগ করবেন না। কুদ্দুস খরচ বহন করলে ছেপে দেবেন। তাও সেটা সাহিত্যসেবার স্বীকৃতি দিতেই। খরচের অঙ্কটা ওঠানামা করেছে ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ হাজারে। কুদ্দুস কোত্থেকে এত টাকা জোগাড় করবে! অনার্স সেকেন্ড ইয়ার থেকে থার্ড ইয়ারে ওঠাই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সে দুইটা টিউশনি করে। বাড়ির আশপাশের জমিজিরাত দেখাশোনা করেন মা। সেও মাকে সাহায্য করে। বাবা বিদেশে গিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। বিয়ের পর পরিবারের খোঁজখবর নেননি আর। যৎকিঞ্চিত জমিজিরাত আর সেলাই ফোঁড়াইয়ের বিদ্যাটুকুর ওপর ভর করে মা এতদূর টেনে এনেছেন ভগ্ন সংসার। কুদ্দুসের দাদা শহীদ হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি। বেওয়ারিশ হয়ে সেটা খাল-নদীজলে ভেসে গেছে, অথবা শেয়াল-শকুনে খেয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা পরিবার হিসেবে কেউ কেউ তাদের আলাদা দৃষ্টিতে দেখে; আবার ঠোঁট বাঁকানোর লোকেরও কমতি নেই। যুদ্ধের সময়ই কুদ্দুসের একমাত্র ফুপু আছিয়া পাক বাহিনীর হাতে ধর্ষিতা হন। গ্রামের মোড়ল জুলফিকার হোসেন নাম লিখিয়েছেন রাজাকারে। তার কাজ ছিল কোন বাড়ির ছেলে মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিয়েছে খবরটি যথাস্থানে পৌঁছানো। পাশাপাশি যুবতী ও খুবসুরত নারীর খোঁজ দেওয়াও বড় দায়িত্ব। পবিত্র মাটির দ্বীনদার ভাইদের খেদমত করাকে ঈমানি দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছেন জুলফিকার রাজাকার। বুভুক্ষ পাকসেনাদের চাহিদার জোগান দিতে ইজ্জত হারিয়েছে অনেকে। সিরিয়ালে একদিন আসে কিশোরী আছিয়ার নাম। তার চিৎকার-চেঁচামেচিতে জেগে উঠেছিল পুরো গ্রাম। অশ্রু মুছতে মুছতে কেউ কেউ অভিশাপ দিয়েছিল আল্লাহর গজব পড়ব তোগো উপরে। একদিন জুলফিকার রাজাকারের ভিটায় কুত্তাও মুততে যাবে না। গ্রামবাসীর শাপ-শাপান্তের ভেতরেই পরদিন সকালে একটি গাছে আছিয়ার ওড়না পেঁচানো লাশ দেখা যায়। আলুথালু কালো চুলে ঢেকে গেছে মুখ। কলঙ্ক মুছতে হয়ত এর চেয়ে ভালো কোনো পথ পায়নি অভাগিনী। দাদার নিরুদ্দেশ, ফুপুর মর্মান্তিক পরিণতির কথা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছে কুদ্দুস। শুনতে শুনতে ভেতরে জন্ম নিয়েছে একধরনের ক্ষোভ। ক্ষোভানলের বহিঃপ্রকাশ প্রথমবার ঘটাল স্কুলের দেয়ালিকায়। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান হয় স্কুলে। সেটারই অংশ হিসেবে দেয়ালিকা প্রকাশ পায়। সেখানে শহীদ স্মরণে ছড়া এবং বীরাঙ্গনাদের নিয়ে স্মৃতিগদ্য লেখে সে। দুটোই নির্বাচিত হয়। তারপর থেকে ধীরে ধীরে কবিতায় আসক্ত হয়ে পড়ে। পত্রিকায়ও মাঝে-মধ্যে কবিতা ছাপা হয়। টাকা জোগাড় করে গঞ্জ থেকে কিনে আনে কবিতার বই। বইয়ের সামনের-পেছনের প্রচ্ছদ, ভেতরে লেখকের ছবিতে পরম যত্নে হাত বোলায়। আর ভাবে, নিজেরও বই হবে, লোকজন কবি হিসেবে চিনবে। সুদৃশ্য প্রচ্ছদে নিজের নাম কল্পনা করে সুখবোধ করে। কয়েকবার ঢাকায় যাতায়াতে ব্যর্থ হলে মা সান্তনা দেন, ‘এসব এখন থাক বাজান। কবিতা বড়লোকের জিনিস।’
কুদ্দুস পাল্টা যুক্তি দেখায়, ‘জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কি বড়লোক আছিলেন! আমিও তার মতো হব। বিদ্রোহী রণক্লান্ত। রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ চাই।’
স্নেহ-মমতা ঝরে পড়ে জননীর কণ্ঠে ‘আইচ্ছা বাবা, নজরুল হইস। পড়ালেখা শেষ কর। ভালা একখান চাকরি পাইলে ট্যাকার অভাব অইব না। তখন তোর বাপরে নিয়াও একখান কবিতা বান্ধিস।’
অপেক্ষায় চলবে না কুদ্দুসের। তাকে হতে হবে সময়ের কবি। খ্যাতনামা, জ্ঞানী মহাজন। যদিও ইতোমধ্যেই এলাকায়, হাট-বাজারে নাম ছড়িয়েছে। কেউ সম্মান করে, কেউ অবজ্ঞা। কবি বলে টিটকারি মারার লোকও বিস্তর।
এক বিকালে টিউশনি শেষে বাড়ি ফিরছে কুদ্দুস। টং দোকান থেকে ডাক দিলেন সোলেমান কাকা ‘ওই কবি, চা খাইয়া যাও’।
কুদ্দুস এসে কাঠের বেঞ্চিতে বসে। চায়ের তেষ্টা পেয়েছে আরো আগেই। কিন্তু পকেটের কথা চিন্তা করে কোথাও থামেনি। কাকার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে ‘একটা বিস্কুট নিমু?’
‘কবি মানুষ, তুমি বিস্কুট ক্যান দোকানসুদ্ধা খাইয়া ফালাও, সমস্যা কী!’ চায়ের অর্ডার পড়লে কুদ্দুস বয়ামের ভেতর থেকে বিস্কুট বের করে। কামড় বসায় কনডেন্সড মিল্কে তৈরি চায়ে চুবিয়ে। কাকা বেঞ্চির উপর রাখা দৈনিক পত্রিকাটা খোলেন ‘আইজ তোমার কবিতা পড়লাম। জব্বর লেখছ।’ কুদ্দুস আগ্রহভরে কাগজে চোখ বোলায়। তাই তো! কাকা না বললে জানাই হত না। অথচ সে যেদিন পত্রিকা কেনে, সেদিন পেপারের লোকেরা কবিতা দেয় না। এরকমই হয় বেশিরভাগ সময়ে।
পেপারটা চেয়ে নেয় কুদ্দুস। বলে, ‘আপনারে নিয়া একটা কবিতা বানামু।’
দোকানে নিয়মিত বিড়িখোর অলস সময় যাপনকারী জেঠাত ভাই সম্পর্কের একজন ইয়ার্কির সুরে বলে, ‘আমগোরে কবিতা বানাবি না! কী দোষ করলাম রে?’
সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই কুদ্দুসের। আক্ষেপ করে বলে, ‘বুঝলেন কাকা, দেশে প্রতিভার মূল্য নাই। জ্ঞানীর কদর নাই। একখান কবিতার বইও ছাপাইতে পারলাম না। সবাই শুধু নগদ ট্যাকা চায়।
বই বিক্রি কইরা পরিশোধ করমু কইলেও হোনে না।’
সোলেমান কাকা সোৎসাহে বলেন, ‘ট্যাকার জন্য তোমার কাব্যগ্রন্থ ছাপা অইব না এইটা কেমনে অয়!’
তিনদিন পর তিনি সুখবর দিলেন। জানালেন, টাকা জোগাড় হবে। বইও বের হবে। কুদ্দুসকে কিছুই করতে হবে না। পান্ডুলিপিটা দেবে আর কয়েকজন প্রকাশকের ঠিকানা। বাকি কাজ সোলেমান আলীর। বইটা একজন সম্মানীত ব্যক্তিকে উৎসর্গ করা হবে। খরচের টাকাটা তিনিই দেবেন। কথা পাকাপাকি। দিল-দরিয়া মানুষ তিনি। প্রস্তাব শুনে ‘না’ করতে পারেন নাই।
পরের দুই সপ্তাহ সোলেমান কাকা দৌড়ঝাঁপ করলেন গ্রাম থেকে ঢাকায়, ঢাকা থেকে গ্রামে। গ্রামে মেকআপ করা পান্ডুলিপি আনলে কুদ্দুস ছুঁয়ে দেখে বারবার। প্রয়োজনীয় সংশোধনী দেয়। কাটা-ছেঁড়া বাড়ে কেবল। বই ছাপিয়ে একসময়ে নিয়েও আসেন কাকা। ভ্যানভর্তি কাব্যগ্রন্থ যখন গ্রামে ঢোকে আশপাশের সবাই জিজ্ঞেস করে, কীসের বই?
কবিতার বই এই গ্রামে এমন পদ্ধতিতে আগে কখনো আসেনি। প্রাইমারি স্কুলের বই আসে, সেদিকে লোকজনের অতটা মনোযোগ থাকে না। ওইসব বাচ্চাকাচ্চার জিনিস, তারা দেখে আনন্দে লাফাবে। উদ্বেল হবে নতুন বই প্রাপ্তির আনন্দে।
সুদৃশ্য কাগজে ছাপা বই হাতে পেয়ে নবীন কবি কোমল কুদ্দুসের আনন্দ আর ধরে না। বারবার উল্টে দেখে বইয়ের শেষ প্রচ্ছদে নিজের ছবি। এ কী কান্ড, কীভাবে হল, কেমন যেন স্বপ্নের মতো লাগে। কয়েকটি বই হাতে নিয়ে আনন্দের আতিশয্যে মাকে ডাকে চেঁচিয়ে। মা আসার আগে পৃষ্ঠা ওল্টায় আবার। উৎসর্গ পাতায় গিয়ে থমকে যায়
উৎসর্গ
মুক্তিযোদ্ধা জুলফিকার হোসেন
যাঁর অমলিন আদর্শ আমাকে মুগ্ধ করে…
পাশে দাঁড়ানো উপকারী কাকার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকায় সে ‘এইটা কী হইল সোলেমান কাকা?’
‘উৎসর্গ? সব তো তোমারে কইয়াই করছি।’
এটা ঠিক, কথা তিনি আগেই পাকাপাকি করেছেন। কিন্তু কাকে উৎসর্গ করা হবে, নাম খুলে বলেননি। এমনকি পৃষ্ঠা বিন্যাস করা পান্ডুলিপিতেও নামটি বসাননি। বলেছেন, একেবারে শেষ ধাপে বসাবেন। কৌতূহল থাকলেও এটা নিয়ে জোরজবরদস্তি করেনি কুদ্দুস। বই প্রকাশ হবে এই আনন্দেই মাতোয়ারা। শেষপর্যন্ত এমন সর্বনাশ! কাঁদো কাঁদো গলায় সে পাল্টা যুক্তি দেখায় কইছেন। তাই বইলা একজন রাজাকারের নাম ঢুকাইয়া দিবেন আমার বইয়ে? তারে আবার মুক্তিযোদ্ধাও বানাইলেন!’
‘মুখ সামলাইয়া কতা কও মিয়া। কারে তুমি রাজাকার কও? তিনি সমাজের সম্মানী লোক। ওই সব গ-গোলের কতা ভুইলা যাও। বেঈমানের দলে নাম লেখাইও না। একাত্তরে তিনি গেরামের সুবিধা-অসুবিধা দেখছেন; এখনো আমাগো মুক্তির জন্য কাম করতাছেন। শিক্ষিত মানুষরা যেইটারে কয় অর্থনৈতিক মুক্তি, সাংস্কৃতিক মুক্তি। তিনি তো সবটাতেই আছেন।’
ততক্ষণে সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন কুদ্দুসের মা আলেয়া বেগম। কাহিনী-সূত্র কিছুটা আঁচ করতে পেরে বলেন, ‘আমার ননদী আছিয়া গলায় দড়ি দিছিল ক্যান? কে তারে মারছে! আমার শ্বশুরের জীবন কে খাইছে?’
কথায় কথা বাড়ে। একসময় সোলেমান কাকা চলে যান। মা বলেন কুদ্দুসকে লক্ষ করে ‘খবরদার, তুই ওই রাজাকারের নিশানা আমার ঘরে তুলবি না।’
‘তুলুম না, মা। তুমি আমারে একটা ম্যাচ দাও।’
তালিবপুর গ্রামে প্রথমবারের মতো আরেকটা ঘটনা কিংবা দুর্ঘটনা সূচিত হয়। বিকালে বই পোড়ানোর মতো ঘটনা ঘটে। যে বইকে ছেলে-বুড়ো সবাই পবিত্র জ্ঞান করে, সেই বইয়ের এমন দশায় মর্মাহত হয় অনেকেই। এই অঞ্চলের জ্বালানির খুব অভাব। আর কিছু না হোক, জ্বালানি হিসেবেও তো ব্যবহার করা যেত। আহা রে, কী কামডা করল! আফসোস বাড়ে অনেকের।
খবর পৌঁছে যায় সোলেমান আলীর কানেও। টগবগিয়ে তিনি জুলফিকার হোসেনের দুই ছেলেসহ আসেন। ততক্ষণের মাগরিবের আজান পড়েছে। অন্ধকার নেমে আসছে চারদিকে। শুধু কোমল কুদ্দুসের প্রথম কাব্যগ্রন্থের আগুনসমাধির ছাই ভেদ করে থেকে থেকে উঁকি দিচ্ছে আগুনের ফুলকি। দমকা বাতাস ফুলকিকে উসকানি দিচ্ছে।
কী এক অসহ্য ব্যথায় হু হু করে কেঁদে চলেছে কুদ্দুস। এমন অবস্থায় তার উপর চড়াও হয় সোলেমান গং। কুদ্দুসকে উপর্যুপরি কিল-ঘুষি লাথি দিতে থাকে তারা। জুলফিকার আলীর বড় ছেলে মিশুক এখন সরকারি দল করে। আওয়ামী লীগের বড় নেতাদের সঙ্গেও হাত আছে। সে কলার চেপে ধরে কুদ্দুসের ‘শালা, আর কত চেতনা মারাবি? তোর নাফরমান মুক্তি বাপগোর কতা হুইনাও শিক্ষা অয় নাই? তিরিশ লাখ শহীদ শুধু মুখস্থই করবি, সংখ্যা গুইনা দেখবি না!’
আলেয়া বেগমের গগনবিদারি চিৎকারে জড়ো হয় আরো লোকজন। সম্মিলিত শোরগোলে অন্ধকার যেন দিশেহারা হয়ে ওঠে। মারধরে রক্তাক্ত কুদ্দুস পড়ে থাকে উপুড় হয়ে। ডান হাতের মুঠোতে ধরা ধানক্ষেতের মাটির চাক। মায়ের বিক্ষুব্ধ প্রতিবাদ, চেঁচামেচি ও আল্লাহ-রাসুলকে সাক্ষী মেনে বিচার চাওয়ার পরও কুদ্দুসের ব্যথা কমে না।
বিবরণ শুনে গণ্যমান্য ব্যক্তিরা রায় দেন, আগামীকাল সকালে কুদ্দুস গিয়ে জুলফিকার সাহেবের কাছে ক্ষমা চাইবে। হাজার হলেও তিনি বয়োজ্যেষ্ঠ সম্মানী লোক। এই গ্রামের মানুষের জন্য অনেক কিছুই করেছেন। তিনি না থাকলে কী কী সর্বনাশ ঘটতে পারত বয়ানের তালিকা দীর্ঘ হয়। সেই রাতেই ফুপুর মতো সম্মানের জীবন বেছে নেয় কুদ্দুস। প্রকৃত কবি কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে না। যে মুখে স্বাধীনতার কবিতা আবৃত্তি করে, সেই মুখেই রাজাকারকে তোয়াজ করবে কীভাবে। রাত গভীর হলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। বেছে নেয় রাস্তার পাশের বড় গাছটির মগডাল। ফুপু আব্রু রক্ষা করেছেন এই গাছেই।
তরুণ কবি কোমল কুদ্দুস আত্মহত্যা করেছে ভোরে খবরটি ছড়িয়ে পড়লে লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় গাছতলা। কখন যেন খসে পড়েছে কুদ্দুসের পরিহিত লুঙ্গিটি। বাতাসে ঈষৎ নড়ে ওঠে তার জননেন্দ্রিয়। সেদিকে তাকিয়ে প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার নূর আলম বোঝার চেষ্টা করেন দেশটা আসলে কোন দিকে মোড় নিচ্ছে।
স্পাইরাল করা পান্ডুলিপি নিয়ে অনেক প্রকাশকের দোরগোড়াতেই ধর্না দিয়েছে সে। সবারই এক জবান কবিতার বই চলে না। চলে না মানে বিক্রি হয় না। প্রকাশকরা বিনিয়োগ করবেন না। কুদ্দুস খরচ বহন করলে ছেপে দেবেন। তাও সেটা সাহিত্যসেবার স্বীকৃতি দিতেই। খরচের অঙ্কটা ওঠানামা করেছে ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ হাজারে। কুদ্দুস কোত্থেকে এত টাকা জোগাড় করবে! অনার্স সেকেন্ড ইয়ার থেকে থার্ড ইয়ারে ওঠাই কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সে দুইটা টিউশনি করে। বাড়ির আশপাশের জমিজিরাত দেখাশোনা করেন মা। সেও মাকে সাহায্য করে। বাবা বিদেশে গিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। বিয়ের পর পরিবারের খোঁজখবর নেননি আর। যৎকিঞ্চিত জমিজিরাত আর সেলাই ফোঁড়াইয়ের বিদ্যাটুকুর ওপর ভর করে মা এতদূর টেনে এনেছেন ভগ্ন সংসার। কুদ্দুসের দাদা শহীদ হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি। বেওয়ারিশ হয়ে সেটা খাল-নদীজলে ভেসে গেছে, অথবা শেয়াল-শকুনে খেয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা পরিবার হিসেবে কেউ কেউ তাদের আলাদা দৃষ্টিতে দেখে; আবার ঠোঁট বাঁকানোর লোকেরও কমতি নেই। যুদ্ধের সময়ই কুদ্দুসের একমাত্র ফুপু আছিয়া পাক বাহিনীর হাতে ধর্ষিতা হন। গ্রামের মোড়ল জুলফিকার হোসেন নাম লিখিয়েছেন রাজাকারে। তার কাজ ছিল কোন বাড়ির ছেলে মুক্তি বাহিনীতে যোগ দিয়েছে খবরটি যথাস্থানে পৌঁছানো। পাশাপাশি যুবতী ও খুবসুরত নারীর খোঁজ দেওয়াও বড় দায়িত্ব। পবিত্র মাটির দ্বীনদার ভাইদের খেদমত করাকে ঈমানি দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছেন জুলফিকার রাজাকার। বুভুক্ষ পাকসেনাদের চাহিদার জোগান দিতে ইজ্জত হারিয়েছে অনেকে। সিরিয়ালে একদিন আসে কিশোরী আছিয়ার নাম। তার চিৎকার-চেঁচামেচিতে জেগে উঠেছিল পুরো গ্রাম। অশ্রু মুছতে মুছতে কেউ কেউ অভিশাপ দিয়েছিল আল্লাহর গজব পড়ব তোগো উপরে। একদিন জুলফিকার রাজাকারের ভিটায় কুত্তাও মুততে যাবে না। গ্রামবাসীর শাপ-শাপান্তের ভেতরেই পরদিন সকালে একটি গাছে আছিয়ার ওড়না পেঁচানো লাশ দেখা যায়। আলুথালু কালো চুলে ঢেকে গেছে মুখ। কলঙ্ক মুছতে হয়ত এর চেয়ে ভালো কোনো পথ পায়নি অভাগিনী। দাদার নিরুদ্দেশ, ফুপুর মর্মান্তিক পরিণতির কথা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছে কুদ্দুস। শুনতে শুনতে ভেতরে জন্ম নিয়েছে একধরনের ক্ষোভ। ক্ষোভানলের বহিঃপ্রকাশ প্রথমবার ঘটাল স্কুলের দেয়ালিকায়। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান হয় স্কুলে। সেটারই অংশ হিসেবে দেয়ালিকা প্রকাশ পায়। সেখানে শহীদ স্মরণে ছড়া এবং বীরাঙ্গনাদের নিয়ে স্মৃতিগদ্য লেখে সে। দুটোই নির্বাচিত হয়। তারপর থেকে ধীরে ধীরে কবিতায় আসক্ত হয়ে পড়ে। পত্রিকায়ও মাঝে-মধ্যে কবিতা ছাপা হয়। টাকা জোগাড় করে গঞ্জ থেকে কিনে আনে কবিতার বই। বইয়ের সামনের-পেছনের প্রচ্ছদ, ভেতরে লেখকের ছবিতে পরম যত্নে হাত বোলায়। আর ভাবে, নিজেরও বই হবে, লোকজন কবি হিসেবে চিনবে। সুদৃশ্য প্রচ্ছদে নিজের নাম কল্পনা করে সুখবোধ করে। কয়েকবার ঢাকায় যাতায়াতে ব্যর্থ হলে মা সান্তনা দেন, ‘এসব এখন থাক বাজান। কবিতা বড়লোকের জিনিস।’
কুদ্দুস পাল্টা যুক্তি দেখায়, ‘জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কি বড়লোক আছিলেন! আমিও তার মতো হব। বিদ্রোহী রণক্লান্ত। রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ চাই।’
স্নেহ-মমতা ঝরে পড়ে জননীর কণ্ঠে ‘আইচ্ছা বাবা, নজরুল হইস। পড়ালেখা শেষ কর। ভালা একখান চাকরি পাইলে ট্যাকার অভাব অইব না। তখন তোর বাপরে নিয়াও একখান কবিতা বান্ধিস।’
অপেক্ষায় চলবে না কুদ্দুসের। তাকে হতে হবে সময়ের কবি। খ্যাতনামা, জ্ঞানী মহাজন। যদিও ইতোমধ্যেই এলাকায়, হাট-বাজারে নাম ছড়িয়েছে। কেউ সম্মান করে, কেউ অবজ্ঞা। কবি বলে টিটকারি মারার লোকও বিস্তর।
এক বিকালে টিউশনি শেষে বাড়ি ফিরছে কুদ্দুস। টং দোকান থেকে ডাক দিলেন সোলেমান কাকা ‘ওই কবি, চা খাইয়া যাও’।
কুদ্দুস এসে কাঠের বেঞ্চিতে বসে। চায়ের তেষ্টা পেয়েছে আরো আগেই। কিন্তু পকেটের কথা চিন্তা করে কোথাও থামেনি। কাকার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে ‘একটা বিস্কুট নিমু?’
‘কবি মানুষ, তুমি বিস্কুট ক্যান দোকানসুদ্ধা খাইয়া ফালাও, সমস্যা কী!’ চায়ের অর্ডার পড়লে কুদ্দুস বয়ামের ভেতর থেকে বিস্কুট বের করে। কামড় বসায় কনডেন্সড মিল্কে তৈরি চায়ে চুবিয়ে। কাকা বেঞ্চির উপর রাখা দৈনিক পত্রিকাটা খোলেন ‘আইজ তোমার কবিতা পড়লাম। জব্বর লেখছ।’ কুদ্দুস আগ্রহভরে কাগজে চোখ বোলায়। তাই তো! কাকা না বললে জানাই হত না। অথচ সে যেদিন পত্রিকা কেনে, সেদিন পেপারের লোকেরা কবিতা দেয় না। এরকমই হয় বেশিরভাগ সময়ে।
পেপারটা চেয়ে নেয় কুদ্দুস। বলে, ‘আপনারে নিয়া একটা কবিতা বানামু।’
দোকানে নিয়মিত বিড়িখোর অলস সময় যাপনকারী জেঠাত ভাই সম্পর্কের একজন ইয়ার্কির সুরে বলে, ‘আমগোরে কবিতা বানাবি না! কী দোষ করলাম রে?’
সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই কুদ্দুসের। আক্ষেপ করে বলে, ‘বুঝলেন কাকা, দেশে প্রতিভার মূল্য নাই। জ্ঞানীর কদর নাই। একখান কবিতার বইও ছাপাইতে পারলাম না। সবাই শুধু নগদ ট্যাকা চায়।
বই বিক্রি কইরা পরিশোধ করমু কইলেও হোনে না।’
সোলেমান কাকা সোৎসাহে বলেন, ‘ট্যাকার জন্য তোমার কাব্যগ্রন্থ ছাপা অইব না এইটা কেমনে অয়!’
তিনদিন পর তিনি সুখবর দিলেন। জানালেন, টাকা জোগাড় হবে। বইও বের হবে। কুদ্দুসকে কিছুই করতে হবে না। পান্ডুলিপিটা দেবে আর কয়েকজন প্রকাশকের ঠিকানা। বাকি কাজ সোলেমান আলীর। বইটা একজন সম্মানীত ব্যক্তিকে উৎসর্গ করা হবে। খরচের টাকাটা তিনিই দেবেন। কথা পাকাপাকি। দিল-দরিয়া মানুষ তিনি। প্রস্তাব শুনে ‘না’ করতে পারেন নাই।
পরের দুই সপ্তাহ সোলেমান কাকা দৌড়ঝাঁপ করলেন গ্রাম থেকে ঢাকায়, ঢাকা থেকে গ্রামে। গ্রামে মেকআপ করা পান্ডুলিপি আনলে কুদ্দুস ছুঁয়ে দেখে বারবার। প্রয়োজনীয় সংশোধনী দেয়। কাটা-ছেঁড়া বাড়ে কেবল। বই ছাপিয়ে একসময়ে নিয়েও আসেন কাকা। ভ্যানভর্তি কাব্যগ্রন্থ যখন গ্রামে ঢোকে আশপাশের সবাই জিজ্ঞেস করে, কীসের বই?
কবিতার বই এই গ্রামে এমন পদ্ধতিতে আগে কখনো আসেনি। প্রাইমারি স্কুলের বই আসে, সেদিকে লোকজনের অতটা মনোযোগ থাকে না। ওইসব বাচ্চাকাচ্চার জিনিস, তারা দেখে আনন্দে লাফাবে। উদ্বেল হবে নতুন বই প্রাপ্তির আনন্দে।
সুদৃশ্য কাগজে ছাপা বই হাতে পেয়ে নবীন কবি কোমল কুদ্দুসের আনন্দ আর ধরে না। বারবার উল্টে দেখে বইয়ের শেষ প্রচ্ছদে নিজের ছবি। এ কী কান্ড, কীভাবে হল, কেমন যেন স্বপ্নের মতো লাগে। কয়েকটি বই হাতে নিয়ে আনন্দের আতিশয্যে মাকে ডাকে চেঁচিয়ে। মা আসার আগে পৃষ্ঠা ওল্টায় আবার। উৎসর্গ পাতায় গিয়ে থমকে যায়
উৎসর্গ
মুক্তিযোদ্ধা জুলফিকার হোসেন
যাঁর অমলিন আদর্শ আমাকে মুগ্ধ করে…
পাশে দাঁড়ানো উপকারী কাকার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকায় সে ‘এইটা কী হইল সোলেমান কাকা?’
‘উৎসর্গ? সব তো তোমারে কইয়াই করছি।’
এটা ঠিক, কথা তিনি আগেই পাকাপাকি করেছেন। কিন্তু কাকে উৎসর্গ করা হবে, নাম খুলে বলেননি। এমনকি পৃষ্ঠা বিন্যাস করা পান্ডুলিপিতেও নামটি বসাননি। বলেছেন, একেবারে শেষ ধাপে বসাবেন। কৌতূহল থাকলেও এটা নিয়ে জোরজবরদস্তি করেনি কুদ্দুস। বই প্রকাশ হবে এই আনন্দেই মাতোয়ারা। শেষপর্যন্ত এমন সর্বনাশ! কাঁদো কাঁদো গলায় সে পাল্টা যুক্তি দেখায় কইছেন। তাই বইলা একজন রাজাকারের নাম ঢুকাইয়া দিবেন আমার বইয়ে? তারে আবার মুক্তিযোদ্ধাও বানাইলেন!’
‘মুখ সামলাইয়া কতা কও মিয়া। কারে তুমি রাজাকার কও? তিনি সমাজের সম্মানী লোক। ওই সব গ-গোলের কতা ভুইলা যাও। বেঈমানের দলে নাম লেখাইও না। একাত্তরে তিনি গেরামের সুবিধা-অসুবিধা দেখছেন; এখনো আমাগো মুক্তির জন্য কাম করতাছেন। শিক্ষিত মানুষরা যেইটারে কয় অর্থনৈতিক মুক্তি, সাংস্কৃতিক মুক্তি। তিনি তো সবটাতেই আছেন।’
ততক্ষণে সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন কুদ্দুসের মা আলেয়া বেগম। কাহিনী-সূত্র কিছুটা আঁচ করতে পেরে বলেন, ‘আমার ননদী আছিয়া গলায় দড়ি দিছিল ক্যান? কে তারে মারছে! আমার শ্বশুরের জীবন কে খাইছে?’
কথায় কথা বাড়ে। একসময় সোলেমান কাকা চলে যান। মা বলেন কুদ্দুসকে লক্ষ করে ‘খবরদার, তুই ওই রাজাকারের নিশানা আমার ঘরে তুলবি না।’
‘তুলুম না, মা। তুমি আমারে একটা ম্যাচ দাও।’
তালিবপুর গ্রামে প্রথমবারের মতো আরেকটা ঘটনা কিংবা দুর্ঘটনা সূচিত হয়। বিকালে বই পোড়ানোর মতো ঘটনা ঘটে। যে বইকে ছেলে-বুড়ো সবাই পবিত্র জ্ঞান করে, সেই বইয়ের এমন দশায় মর্মাহত হয় অনেকেই। এই অঞ্চলের জ্বালানির খুব অভাব। আর কিছু না হোক, জ্বালানি হিসেবেও তো ব্যবহার করা যেত। আহা রে, কী কামডা করল! আফসোস বাড়ে অনেকের।
খবর পৌঁছে যায় সোলেমান আলীর কানেও। টগবগিয়ে তিনি জুলফিকার হোসেনের দুই ছেলেসহ আসেন। ততক্ষণের মাগরিবের আজান পড়েছে। অন্ধকার নেমে আসছে চারদিকে। শুধু কোমল কুদ্দুসের প্রথম কাব্যগ্রন্থের আগুনসমাধির ছাই ভেদ করে থেকে থেকে উঁকি দিচ্ছে আগুনের ফুলকি। দমকা বাতাস ফুলকিকে উসকানি দিচ্ছে।
কী এক অসহ্য ব্যথায় হু হু করে কেঁদে চলেছে কুদ্দুস। এমন অবস্থায় তার উপর চড়াও হয় সোলেমান গং। কুদ্দুসকে উপর্যুপরি কিল-ঘুষি লাথি দিতে থাকে তারা। জুলফিকার আলীর বড় ছেলে মিশুক এখন সরকারি দল করে। আওয়ামী লীগের বড় নেতাদের সঙ্গেও হাত আছে। সে কলার চেপে ধরে কুদ্দুসের ‘শালা, আর কত চেতনা মারাবি? তোর নাফরমান মুক্তি বাপগোর কতা হুইনাও শিক্ষা অয় নাই? তিরিশ লাখ শহীদ শুধু মুখস্থই করবি, সংখ্যা গুইনা দেখবি না!’
আলেয়া বেগমের গগনবিদারি চিৎকারে জড়ো হয় আরো লোকজন। সম্মিলিত শোরগোলে অন্ধকার যেন দিশেহারা হয়ে ওঠে। মারধরে রক্তাক্ত কুদ্দুস পড়ে থাকে উপুড় হয়ে। ডান হাতের মুঠোতে ধরা ধানক্ষেতের মাটির চাক। মায়ের বিক্ষুব্ধ প্রতিবাদ, চেঁচামেচি ও আল্লাহ-রাসুলকে সাক্ষী মেনে বিচার চাওয়ার পরও কুদ্দুসের ব্যথা কমে না।
বিবরণ শুনে গণ্যমান্য ব্যক্তিরা রায় দেন, আগামীকাল সকালে কুদ্দুস গিয়ে জুলফিকার সাহেবের কাছে ক্ষমা চাইবে। হাজার হলেও তিনি বয়োজ্যেষ্ঠ সম্মানী লোক। এই গ্রামের মানুষের জন্য অনেক কিছুই করেছেন। তিনি না থাকলে কী কী সর্বনাশ ঘটতে পারত বয়ানের তালিকা দীর্ঘ হয়। সেই রাতেই ফুপুর মতো সম্মানের জীবন বেছে নেয় কুদ্দুস। প্রকৃত কবি কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে না। যে মুখে স্বাধীনতার কবিতা আবৃত্তি করে, সেই মুখেই রাজাকারকে তোয়াজ করবে কীভাবে। রাত গভীর হলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। বেছে নেয় রাস্তার পাশের বড় গাছটির মগডাল। ফুপু আব্রু রক্ষা করেছেন এই গাছেই।
তরুণ কবি কোমল কুদ্দুস আত্মহত্যা করেছে ভোরে খবরটি ছড়িয়ে পড়লে লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় গাছতলা। কখন যেন খসে পড়েছে কুদ্দুসের পরিহিত লুঙ্গিটি। বাতাসে ঈষৎ নড়ে ওঠে তার জননেন্দ্রিয়। সেদিকে তাকিয়ে প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার নূর আলম বোঝার চেষ্টা করেন দেশটা আসলে কোন দিকে মোড় নিচ্ছে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
অপূর্ব।