short-story-kodombo-tole

কদম্ব তলে
সাগরিকা রায়


আজও রুটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে বিরক্তি প্রকাশ করেঅনুভব। দিদি মায়া ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নীচু করে থাকে। পিছনে একটু আগে নিভিয়ে রাখা উনুনে ছাই জমছে। নতুন করে রুটি করে দেওয়ার সময় নেই। অনুভব প্রত্যেকদিন খেতে বসে বিরক্তি দেখাচ্ছে ইদানিং। অথচ মাস দুই আগেও পরিস্থিতিটা এত খারাপ ছিল না।

মায়ার মা একবার ছেলের দিকে,একবার মেয়ের দিকে ক্রমান্বয়ে তাকিয়ে চলেছে। মেয়ের দিকে খানিকটা বিরক্তি নিয়ে মা-ও তাকাচ্ছে। ভাবটা, একটু ভালো করে কেন কাজ করছে না মায়া! যখন ভাইয়ের ঘাড়েই উঠেছে এসে!

অনুভব দুমদাম করে উঠে গেল। রুটিগুলো ছিঁড়ে ফালা ফালা করে রেখে গেছে। বাটির ডাল,বেগুন ভর্তা,ফুলকপির ডালনার লংকাটা একই রকম ভাবে রয়েছে। স্পর্শই করেনি অনুভব।

একসময় মা-ও উঠে গেলে মায়া চুপ করে রান্নাঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে। আধ অন্ধকার ঘরের মধ্যে রান্নাবান্নার গন্ধ আটকে আছে। মায়ার মা একবার উঁকি দিয়ে দেখে গেল পরিস্থিতি। মুখে পান। ঠোঁট সামান্য উঁচু করে পানের রস সামলে নিতে নিতে বলল, “মন পড়ে আছে বরের কাছে। কাজে মন থাকে কী করে? ভাইয়ের দিকটাও দেখতে হবে, মায়া। সেও বউ ছেড়ে আছে। তোর বর নিজের বোনের দিকটা তো দেখছে না! সে একটু সামাল দিলে তোর সংসার টিকে থাকতো।”

মায়া মায়ের তোম্বা মুখের দিকে তাকিয়ে শ্বাস ফেলে। সে কোনও কাজের নয়। রাজায় রাজায় যুদ্ধ বাঁধে,উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। মায়ার ননদ চুনীর সঙ্গে মায়ার ভাই অনুভবের বিয়েটা কে দিয়েছিল? মায়া? সে সত্যিই কি চেয়েছিল পালটাপালটির এই বিয়ে? চায়নি মায়া। সম্পর্কের মধ্যে অতি ভালবাসার ফল ভাল হয় না বলে জানে মায়া। বিশেষ করে ওর মায়ের মধ্যে হঠাৎ ভালবাসার হড়পা বানের খবর ও আগেও দেখেছে। প্রথম প্রথম তীব্র ভাব-ভালবাসা চলে, ছোট মাছের চচ্চড়ির বাটির দেওয়া নেওয়া চলে।তারপরেই শুরু হতে থাকে নিন্দাচর্চা। নেক্সট পর্যায়ে মুখ দেখাদেখি বন্ধ। এই কারণেই চুনীকে অনুভবের “ভীষণ পছন্দ” কথাটা শুনে ভয় পেয়েছিল মায়া। আপত্তি জানিয়েছে সবে, চুনী পুকুরের ধারের পেয়ারাতলায় দাঁড়িয়ে লাল লাল মুখ করে বউদিকে জড়িয়ে ধরেছিল, “এটাই ভাল হল,তাই না, বউদি? তোমার ইচ্ছে হলেই চলে যাবে,আমার ইচ্ছে হলেই চলে আসবো। দুজনে দুটো বাড়ি সামলে নেবো।বলো?”

মায়া চুনীর লাজরক্তিম সুখী মুখের দিকে তাকিয়ে একটিও শব্দ উচ্চারণ করতে পারেনি। নিজের ছোট ঘরে ঢুকে একা একা গান গাইছিল চুনী, “প্রাণসখী রে/ ওই শোন কদম্ব তলে বংশী বাজায় কে!”

কষ্ট হয়েছিল চুনীর জন্য।সাদাসিদে ভাল মানুষ ননদটিকে ভালবাসে মায়া। সে ভাইয়ের বউ হবে,এতে আপত্তি করার কিছু নেই। তবু ভেবেছে মায়া। এই যেরুটি, শুরুটাও রুটি দিয়েই হয়েছিল। মায়ার মা বিয়ের ঠিক দু’মাসের মাথায় আবিষ্কার করে ফেলল,চুনী রুটি বড্ড খারাপ বানায়।“বিচ্ছিরি! শক্ত,বেঁকাতেড়া।” মায়ের মুখের হাসি দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল ও। রামায়ণের তাড়কা রাক্ষসীর মুখের ছবিটা এই রকমই ছিল না?

সেই দিন মায়ার বুক কেঁপে উঠেছে। ও বুঝেছে, মা রণদামামায় একটা আঘাত করে যুদ্ধের হুমকি দিয়ে ফেলল। এবারে এই ছোট শান্তির,ভালবাসার বাড়ি কুরুক্ষেত্রের মাঠ হয়ে দাঁড়াতে সময় নেবে না।

চুনী বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। মায়া চুপ করে চুনীর কাছে গিয়ে দাঁড়াল, “ভয় নেই চুনী। মা এই রকমই। একটু মানিয়ে নে।”

কত ভাবে আর মানিয়ে নেওয়া যায়! আস্তে আস্তে অনুভবও চুনীর দোষ দেখতে পাচ্ছিল। মায়ের কথার চাদরে অনুভবও মুখ ঢেকেছে ততদিনে। চুনী ঠিক তরুণদার স্ত্রী মল্লিকা বউদির মত নয়। যেভাবে মল্লিকা বউদি রঙ্গরসিকতা করতে জানে, চুনী তার ধারে কাছে ঘেঁষতে জানে? যেভাবে মল্লিকা…সেভাবে চুনী…?

লিস্ট বাড়ছিল অনুভবের কাছে,লিস্ট বেড়ে যাচ্ছে অনুভবের মায়ের। ইদানিং চুনী মুখ খুলছে। এ কি সহ্য করার? দুজনে একসময় যুক্তি করেছে।কিছুদিন চুনীকে বাপের বাড়িতে রেখে এলে ঠিক হয়।

এক সকালে অনুভব বাড়িতে রেখে এল সেই বাড়ির মেয়েকে। চুনীর দাদা উজ্জ্বল অপেক্ষা করল না। নিজের স্ত্রী যখন অনুভবের দিদি,সে বা শ্বশুরালয়ে থাকে কেন? অনুভবের বোন আর উজ্জ্বলের বোন হল দাবার গুটি। দান ফেলতে শুরু করেছে অনুভব,তার মা। ওদিকে দান ফেলেছে উজ্জ্বল। মায়া সবে বড়ির জন্য ডাল ভিজিয়েছে,পুরনো শাড়ি বের করে নরম সুখী কাঁথা বানাতে শুরু করেছে,তখন উজ্জ্বল এসে বলল, “চলো গো। অনুভবের মাথায় একটু বাড়ি মেরে আসি। ও ভেবেছে আমি বোকা?”

সব ফেলে মায়া চলল যুদ্ধক্ষেত্রে। চুনী এসে পৌঁছল,মায়াও গিয়ে পৌঁছল। কারও মুখে হাসি নেই।বাপের বাড়ি এসে হইহই করে সোনার চুড়ি বাজিয়ে শ্বশুরবাড়ির সুখের গল্প নেই।চারপাশে দাঁড়কাকের ডাক কেবল শুনতে পাচ্ছিল দুই নারী। ঘরছাড়া, ঘরহারা দুই নারী নির্বোধের মত এসে দাঁড়িয়েছে ভাইয়ের সংসারে। যেখানে একটি পদক্ষেপও নিজের নয়। দিন দুপুরে ঝা ঝা ঘরে, রাত দুপুরে ঝা ঝা ঘরে সারাক্ষণ একটি প্রেতিনী ডাকাডাকি করে, “আয়! পুকুরে ডুবতে বড্ড মজা! আয় না!” এগিয়ে যেতে গিয়েও ভয়ে থমকে দাঁড়ায় মায়া। ছেলেটা আছে তার বাবার কাছে। ডুবে যাওয়ার আগে একবার দেখা হবে না!

এলোচুল হাতে জড়িয়ে খোঁপা বেঁধে নেয় মায়া। চুনীর খোঁজ নেই। কেমন আছে মেয়েটা কে জানে! উজ্জ্বলও আসে না। খোঁজ নেয় না। রোজ ফোন করে করে হতাশ হয়ে পড়েছে মায়া। উজ্জ্বল ফোন তোলে না। ইদানিং বোধহয় সিম পালটে ফেলেছে। যোগাযোগের পথ নেই আর! চুনীর ফোন আসে। অনুভব ফোন কেটে দেয়। বোঝে মায়া। নিশ্চয় অনুভবও সিম পালটে নেবে! বুদ্ধিটা দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু দেয় না। চুনী চেষ্টা করে যাক। কে জানে,একদিন হয়তো অনুভব ফোন রিসিভ করবে! চুনী চেষ্টা করুক। আর কেউ তো নেই মায়ার কাছে চেষ্টা করার মতো। উজ্জ্বলের মধ্যে পৌরুষটাই বেশি হল! যেন মায়াকে নিয়ে যেতে হলে অনুভবের কাছে ছোট হয়ে যাবে! কেন,বোনকে নিয়ে চলে আসতে পারে না? এসে বলতে পারে না, “মাসিমা, বোনকে রেখে গেলাম। আমার বউটিকে ছেড়ে থাকতে পারছি না। সংসার দেখে কে? ওরই তো সব!”

সকালের দিকে কাজের চাপ ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। মায়ার মা দোক্তাপাতা কুটতে কুটতে বলে, “অনু আর কত করবে? তুই দুটো টিউশনি করে নিজের খরচ তুলতে চেষ্টা করলেও পারিস।”

মায়া টিউশনির খোঁজে দোলনদের বাড়িতে গেল বেলা তিনটের দিকে। দোলনের মা সবে মনসামঙ্গল নিয়ে বসতে যাচ্ছে,মায়া গিয়ে হাজির, “মামী, দোলন কোথায়?”

দোলন আদর করে চা খাওয়ায়। মায়া অনেকদিন পরে আদর পেয়ে চোখের জল গিলে ফেলে, “দোলন,আমাকে দুটো টিউশনি দিবি?”

মায়ার চোখের শুকনো দৃষ্টি, ছাপা শাড়ির অচেনা ফুলের দলের নেতিয়ে পড়া দেখতে দেখতে ফুল্লরার কথা মনে হয় দোলনের। মায়া ত্রিশংকু রাজার মত আলাদা জগতে ঝুলে আছে। না স্বর্গে,না মর্ত্যে! কোথায় আছে মায়া! একেই কি নো ম্যানস ল্যান্ড বলে?

রাতে ঠেসে ঠেসে আটা মাখে মায়া। হাতের জোড়া খুলে যাওয়ার উপক্রম হয়।তবু মেখে চলে। আজ অনুভব কিছুতেই বলতে পারবে না রুটি শক্ত। রুটি বেঁকাতেড়া!

বলল অনুভব। অন্যরকম ভাবে, “খেয়ে এসেছি। জয়লক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে রাতের রুটি করছিল,বারো টাকার রুটি আর চিকেন খেলাম। বাড়িতে খাওয়াদাওয়া তুলে দেব ভাবছি।” অনুভব শব্দ করে জলের গেলাস রাখে। শব্দের দাপটে চমকে ওঠে মায়া।

মায়ার মা অদ্ভুত হাসে, “সেই ভাল। এই মেয়ে দিয়ে কাজটা কী হল? পারল ননদকে শিক্ষা দিতে!”

মায়া অবাক হয়ে গেল। কী ভাবে চুনীকে শিক্ষা দেবে মায়া? চুনীকে এবাড়িতে এন্ট্রি দেবেই না মা। মায়া কী করে নিজের সংসারে ফিরে যাবে? উজ্জ্বল মায়াকে গ্রহণ তখনই করবে,যখন চুনীকে অনুভব ফিরিয়ে আনবে। অনুভব মায়ের কথার বাইরে যাবে না। চুনীও ফিরবে না। আর মায়াও!

তখনও রোদ ওঠেনি। ভোরের আলো অল্প অল্প জানান দিচ্ছে দিন শুরুর। মায়া দেখল অনুভব বারান্দায় চুপ করে বসে আছে। দু’দিন ধরে জ্বর ভাইটির। এই সময় চুনী কাছে থাকলে কতো ভাল হতো! মায়ার কষ্ট হয়। মনে হয়,ভাইয়ের কষ্টের কথা ও ছাড়া আর কেউ বুঝবে না! একবার গিয়ে বসবে অনুভবের পাশে?

মায়ার উপস্থিতি টের পেয়েও মুখ ঘুরিয়ে তাকাল না অনুভব। একবারও বলল না, “কেমন আছিস? দোলনের টিউশনিগুলো ছেড়ে দে। আমি তো আছি।” বলল না, “তুই ফিরে যাস দিদি। আমিও চুনীকে নিয়ে আসব। ভাবিস না। দুটো বছর গড়িয়ে গেল, আর নয়। “কিন্তু, কিচ্ছু বলাবলি হল না। অনুভব খানিক পরে ঘাড় না ঘুরিয়েইবলল, “খবর শুনেছিস?”

খবর! কী খবর? কোন খবর? ত্রাসে পাথর হয়ে যায় মায়া। ঠোঁট নড়ে না। জিভ আলগা হয় না। শরীর আড়ষ্ট । কোন খবর দিতে চায় অনুভব? উজ্জ্বল ভাল আছে? ছেলেটা? চুনী!

“চুনী! তোর ননদ চুনী! উজ্জ্বলের…, ছোটলোক উজ্জ্বলের লুজ ক্যারেক্টার বোনটা পালিয়েছে পাড়ার কোন যুবকের সঙ্গে! ছি ছি! মুখ দেখাবো কী করে!”

অনেকটা সময় পরে মায়া নিজের মধ্য থেকে আসল মায়াকে খুঁজে বের করে আনে। চুনী চলে গিয়েছে সংসার তৈরি করতে? এক সংসারের সং হয়ে দুটো বছর অনেক হেনস্থা,অবহেলা পার করে অবশেষে ত্রিশংকু নিজের জায়গা খুঁজে পেয়েছে তাহলে? চুনী লড়াই জিতিয়ে দিল? নিজের মুখ উঁচু করে চলে যেতে পেরেছে?

মায়ার মা খবর শুনে হাঁ হয়ে গেল। এ কি বিশ্বাস করা যায়? নোংরা মেয়েছেলেটা ভাগ্যিস এই বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল! নইলে…!

মায়া দেখেছে নীল মেঘে বৃষ্টি হয়েছে আজ সকালে। পুজোর বুঝি দেরিনেই। গুন গুন করে মায়া। এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে, আশ্চর্যভাললাগায় অনেকদিন পরে মায়ার গলায় গান এসেছে, “প্রাণসখী রে,ওই শোন কদম্ব তলে বংশী বাজায় কে…!” একজন কেউ আছে, যে বুকের ভিতরথেকে বেরিয়ে এসে নতুন করে বাঁচতে শেখায়। অবলাকে উঠে দাঁড়াতে শেখায়। সে হল নিজের ভিতরের সাহসটুকু। চুনী যাকে চিনেছে।

মায়া আজ দুপুরেই ব্যাগ গুছিয়েছে। কাল বাসে উঠে চলে যাবে রানিডাঙ্গায়। নিজের ঘরে গিয়ে হাজির হবে উজ্জ্বলকে তোয়াক্কা না করে। কে হে তুমি! বাঘের ছাল গায়ে দিয়ে মিথ্যে গর্জন করো কেন?

সন্ধের দিকে আটা মাখতে বসেছে মায়া। ঠেসে আটা মেখে নরম তুলতুলে রুটি বানিয়েছে। কিন্তু আজ কেউ রুটি খেতে পারল না। গোল গোল নরম রুটিগুলো আস্তে আস্তে ঘুমিয়েই পড়ল। কেউ স্পর্শটুকু করল না ওদের। অথচ দুঃখ নয়। মায়ার হাসি পাচ্ছিল।



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *