অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী
এখন এখানে ভালোই ঠাণ্ডা পড়েছে। শীতের জাদুকরী ছোঁয়ায় লোকজন যেন উধাও হয়ে গেছে স্টেশন চত্বর, আশেপাশের রাস্তা থেকে। প্ল্যাটফর্ম ঘন কুয়াশার আড়ালে হারিয়ে গেছে। এই স্টেশনে দূরপাল্লার ট্রেন দাঁড়ায় না। শেষ লোকাল ট্রেন চলে গেছে খানিকক্ষণ আগে। সেই ট্রেন থেকে একজন লোক এসে নেমেছিল এই স্টেশনে। তারপরে প্ল্যাটফর্মের এক কোণে থাকা ভাঙ্গা বেঞ্চিতে এসে বসেছিল লোকটা। বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে। লোকটা যতই এই নাম না জানা স্টেশনের আধো-অন্ধকারে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করুক না কেন, লোকটার ভাবভঙ্গিতে এমন কিছু আছে, যা বলে দেয় এরকম অনুজ্বল জায়গার জন্য যেন সে বেমানান।
স্টেশনের বাইরে একটা ছোট চায়ের দোকানে আলো জ্বলছিল। লোকটা এগিয়ে গেল সেদিকে। দ্বিধাগ্রস্ত পায়ে। লোকটার পায়ে একটা দামী জুতো। পরনে দামী বিদেশী ব্র্যান্ডের প্যান্ট ও শার্ট। একটা পশমিনা শালে গা-মাথা ঢাকা। তবু এই ঠাণ্ডায় যেন কাঁপছে। মনে হয় লোকটা আন্দাজ করতে পারেনি এখানে এতো ঠাণ্ডা পড়তে পারে।
লোকটা দোকানটার কাছে গিয়ে একটু অবাক হল দোকানী ছেলেটাকে দেখে। বছর বারোর ছেলে এতো রাতে একা চায়ের দোকানে কী করছে! বলে উঠল “চা হবে?”
“হ্যাঁ। লেবু চা, না দুধ চা?”
“দুধ চা-ই দে। তা তুই এত রাতে একা? এটা তোর দোকান?”
“আমার বাবার ছিল। এখন আমি বসি।”
“এত রাত অব্দি এখানে তুই একা?”
“অনেক সময় এখানে দু-এক জন চলে আসে অনেক রাতেও। তাই বসে থাকি।”
“বাড়ীতে কেউ নেই?”
“মা আছে।”
“তাহলে? এটা পড়াশোনার বয়স, তা না করে দোকানে বসে আছিস?”
ছেলেটা একটু উদাসী হয়ে পড়ল। তারপরে বলে উঠল – “এই তো কোভিড অসুখের জন্য আমার স্কুল বন্ধ হয়ে গেলো। আর খুলল না। বাবাও মারা গেলো। এখন শুধু মা আছে। সংসার চালাতে হবে তো?”
“ও বুঝেছি।”
দোকানের দেওয়ালে একটা ছবি রাখা আছে। সে ছবি দেখে লোকটা বুঝতে পারল এই হয়ত ছেলেটার বাবা।
“বাবা কীসে মারা গেলো? কোভিডে?”
“না” ছেলেটা আবার উদাস হয়ে গেল। তারপরে দূরে স্টেশনের লাইনের দিকে আঙুল তুলে বলে উঠল “ট্রেনে কাটা পড়েছিল।”
“সে কী? কী করে?”
“জানি না।” বলে থেমে রইল ছেলেটা। খানিকক্ষণ নীরবতার পরে ফের বলে উঠল “সবাই বলে সুইসাইড।”
যেন থমকে গেলো লোকটা। কী বলে সান্ত্বনা দেবে ছেলেটাকে?
“হঠাৎ করে? কী হয়েছিল?”
“জানি না। মা বলেছিল চারদিকে অনেক ধারদেনা হয়ে গিয়েছিল বাবার।”
“কী করে?”
“বাবা সবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে ‘স্বপ্ন’ না কী একটা সংস্থায় টাকা দিত। কিন্তু সে সংস্থা বন্ধ হয়ে যায়। বাবা আর সে টাকা ফেরত পায়নি। পাওনাদারেরা বাবার পিছনে পিছনে সবসময় ঘুরত। আমাদের বাড়ীতে গিয়ে হানা দিত। ঝামেলা করত। বাবারও সব পুঁজি ওতে চলে গিয়েছিল। সব জমা টাকা। সে জন্যই হয়ত।”
হাতটা কেঁপে গেলো লোকটার। চা ছলকে উঠে জামার হাতায় লাগল। কোনওরকমে দোকানের সামনের কাঠের পাটাতনের কোণটা ধরে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
এই ‘স্বপ্ন’ চিটফান্ডের জন্য গত পাঁচ বছর ও জেলে ছিল। এর জন্যেই একসময় সারা ভারত ওকে চিনত। সবাই জানত এই ফান্ডে টাকা রাখলে সে টাকা খুব তাড়াতাড়ি বেড়ে যায়। কিন্তু সে টাকা বাড়ানোর আড়ালের আসল রহস্যটা কেউ জানত না। শুরুর দিকে অনেকে তাদের টাকা ফেরত পেয়েছিল। কথামতো দু’বছরে দ্বিগুণ। কিন্তু সেরকম তো আর চিরকাল চলতে পারে না। যখন আসল রহস্য সামনে এলো, তখন সবাই টাকা ফেরত চাইল। সংস্থা এর কয়েক মাস পরেই বন্ধ হয়ে যায়।
জেলে যেতে হল। কিন্তু ভারতে ভাল ল’ইয়ারের পিছনে টাকা খরচ করতে পারলে বেশীদিন জেলে থাকতে হয় না। সেজন্য পাঁচ বছরের মধ্যে ছাড়া পেয়েছে। কিন্তু এ পাঁচ বছরে অনেক কিছুই পাল্টে গেছে। লোকেও ওর কৃতকর্ম ভুলে গেছে। তবে ওর সেই ‘স্বপ্ন’ সাম্রাজ্য হারিয়ে গেছে। যারা ওকে ঈশ্বরের চোখে দেখত, তারাই এখন ওকে সামনে পেলে ছেড়ে দেবে না। অনেকে নিঃস্ব হয়ে গেছে। অনেকের জীবনের সব সম্বল হারিয়েছে এই চিটফান্ডে। তবু টাকার জন্য নয়, এই হারিয়ে যাওয়ার শূন্যতা, অপরাধবোধ যেন গ্রাস করেছে ওকে। সে জন্য পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে গত কয়েকদিন। কিন্তু তারপরেও যেন ছেলেটার কাছে ধরা পরে গেছে ও। এ ছেলেটার এ অবস্থার জন্য ওই দায়ী! দোকানের এক পাশে পড়ে থাকা অঙ্কের বইটা মনে করিয়ে দিচ্ছে ছেলেটা কী হতে পারত! এরকম আরও কতজনের কাছে ও এখনও ধরা পরে যাবে! আদালতে জাজকে বলে বোঝানো যায়, কিন্তু নিজের কাছে যে বিচার হয়, সেখানে নিজেকে নিরপরাধ বলে প্রমাণ করবে কী করে!
লোকটার মাথা যেন ফের ঘুরে গেলো। শক্ত করে দোকানের কাঠ ধরে নিজেকে সামলালো।
চায়ের দোকানের ছেলেটা উদ্বিগ্ন স্বরে বলে উঠল “শরীর কী খারাপ লাগছে? আজ রাতে কোথায় যাবে?”
এ প্রশ্নের উত্তর সত্যি জানা নেই। ভারত জুড়ে অগুনতি বাড়ী আছে লোকটার। নানান নামে। কিন্তু সেখানে কোথাও আর যাওয়ার ইচ্ছে নেই। আজ যেন মনে হচ্ছে সত্যি আশ্রয়হীন।
ছেলেটা লোকটার হাত ধরে নিয়ে এসে স্টেশনের বেঞ্চিতে বসাল। তারপরে বলে উঠল “আমাদের বাড়ী থাকলে তোমাকে ওখানে নিয়ে যেতাম। এখন মা একটা লোকের বাড়ী কাজ করে। আমি ওখানে গিয়েই রাতে থাকি। আমাদের নিজের বাড়ী বিক্রি করে দিতে হয়েছে।”
মৃন্ময়বাবু এতটা লিখে থামলেন। পেনটা খাতার উপরে রেখে চারদিকে তাকালেন। যেন এক ঘোরের মধ্যে ছিলেন। বীনা কোথায় গেল! পড়ার টেবিলের পাশে চায়ের কাপটা এতক্ষণ পড়ে আছে। তারপরেই খেয়াল হল বীনা আসবে না। বীনা, ওঁর স্ত্রী মারা গেছেন এক মাস আগে। দীর্ঘ আটচল্লিশ বছরের দাম্পত্য জীবনের সব রুটিন যেন থেমে গেছে হঠাৎ করে। সব যেন তারপর থেকে অন্যরকম লাগছে। যেন কোনও কিছুই ভালো লাগছে না।
চারদিকের জগৎ থেকে সরিয়ে নিয়েছেন আরও। ফ্ল্যাটের সঙ্গে এক চিলতে ছোট বারান্দা। সেখানে গিয়ে দাঁড়ালেন কিছুক্ষণ। পাশের বাড়ীর ছাদের কারনিশে একটা বেড়াল চুপ করে বসে আছে। মাথার উপরে বর্ণহীন ঘোলাটে মনখারাপের আকাশ যেন ওঁর নিজের মতোই থমকে দাঁড়িয়ে আছে।
রান্নাঘরে গিয়ে চা করলেন। তারপর অশক্ত অনভ্যস্ত হাতে আনমনে রান্নার জায়গাটা একটু মুছে নিলেন। চুপ করে তাকিয়ে রইলেন রান্নাঘরের জানলা দিয়ে বাইরের দিকে। বহু বছর কাটিয়েছেন এ ভাড়ার ফ্ল্যাটে। নিজের ফ্ল্যাট হয়নি এরকমই একটা চিটফান্ডের খপ্পরে পড়ে। কিন্তু এ ফ্ল্যাটও এখন ওঁকে ছেড়ে দিতে হবে। কে খেয়াল রাখবে এখানে ওঁর উপরে! বয়স হয়েছে। তাছাড়া বাড়ীওয়ালাও চাইছে ভাড়া বাড়াতে। এসব ভেবে উনি ফ্ল্যাট ছেড়ে দুদিন বাদে চলে যাবেন বৃদ্ধাশ্রমে।
পড়ার ঘরে এসে বই এর আলমারির দিকে সস্নেহে তাকালেন। এসব বই – এর মধ্যে থেকে কিছু বই নিয়ে যাবেন। আলমারির উপরে বহুবছর আগে ওঁর জীবনে পাওয়া এক মাত্র সাহিত্যপুরস্কার। সেটা না নিলেও হবে। ফ্ল্যাটের চারদিকে এখনও বীনার স্মৃতি।
আবার পড়ার টেবিলে এসে বসলেন। বসে খাতা, পেন তুলে নিলেন।
প্ল্যাটফর্মে এখনও ঘন কুয়াশা। ছেলেটা বেঞ্চিতে ওই লোকটার পাশে এসে বসেছে। লোকটাকে ওর স্কুলের গল্প বলছে। ওর বন্ধুদের গল্প। লোকটা মন দিয়ে সে গল্প শুনছে। ছেলেটা আর কোনওদিন স্কুলে যাবে না।
ওরা দুজনেও মৃন্ময়বাবু মতোই একা।
ওরাও মৃন্ময়বাবুর মতো অসহায়, আশ্রয় খুঁজছে এক অনিশ্চিত কুয়াশাঘন রাতের মধ্যে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন