স্বপ্নময় চক্রবর্তী
শুনশান রাস্তাঘাট, লকডাউন চলছে। করোনাকাল। কয়েকটা কুকুরের ভৌ ভৌ শুনছিল ঘরবন্দী মানুষ। আসলে তো কুকুরগুলো নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিল। ওদের কথোপকথন এরকম।
১ম। আমার তো সাতবছর বয়স হয়ে গেল কাকু, এমন দেখিনি গো।
২য়। আরে, তোর তো সাতবছর মাত্র, আমার তোর ডবল। তোর বাবাকে জন্মাতে দেখিছি, পেরমায়ু শেষ হতে চলল আমার, আমিও কি বাপের জন্মে এমন দেখেছি নাকি! হোটেলগুলো সব বন্ধ, রাস্তার ঘুগনিওলাটা পর্য্যন্ত বসছে না, কেউ একটা থার্মোকলের বাটিও ফেলছে না – একটু চাটতাম। বাসি রুটিও ফেলছে না কেউ।
১ম। সেই মোটা দিদিমণিটাও আর আসছে না কাকু, যে রোজ এক প্যাকেট বিস্কুট এনে আয় আয় ছু ছু করতো। আমরা লেজ নাড়তেও ভুলে যাচ্ছি কাকু।
৩য়। লেজ নাড়া ভুলে গেলে আমাদের আর রইল কী! একেবারে – যাকে বলে সাংস্কৃতিক সংকট। তাছাড়া, তাছাড়া এটা আমাদের একটা বড় ব্যায়ামও বটে। পুচ্ছায়াম, মানে পুচ্ছ প্রাণায়াম। খুশির কিছু সংবাদ না পেলেও আমাদের এটা নাড়িয়ে যেতে হবে।
৪র্থ। এই শুঢঢাটা জ্ঞান দেবার ইস্কোপ পেলেই জ্ঞান দিতে থাকে। আমি মরছি পেটের জ্বালায় মাতালগুলো গেল কোথায়? রাস্তায় কেউ বমিও করেনা মাইরি? মানুষই নেই।
২য়। একটা কিছু বড় অঘটন ঘটেছে, বুঝলে। মানুষজাতি বড় কোনও বিপদে পড়েছে। একটা বড় কিছু। নইলে এমন হয়?
৪র্থ। আমারও তাই মনে হয় ব্রাদার। মানুষেরই বিপদ হয়েছে। আমাদের তবে কী করা উচিত। বাপ পিতোমোর কাছে শুনে এসেছি আমরা হলাম খুব প্রভুভক্ত জাতি। আর মানুষই তো আমাদের প্রভু। আমাদেরও তো কিছু কর্তব্য আছে, নাকি!
ওদের এইসব কথাবার্তা শুনি বারান্দায় বসে। আমারও হালকা করে মনে হয় আমরাও তো প্রভুভক্ত। আমাদেরও তো কর্তব্য ছিল। হ্যাঁ, পাঠিয়েছি তো, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন পাঠিয়ে দিয়েছি আমেরিকায়। আমাদের দু’হাজার ওদের আশিহাজার মানুষের হয়ে গেছে। খুব বিপদে পড়েছিল ওরা যে।
যমুনা, হাত ধরো, স্বর্গে যাবো। লাঠিটা খুঁজছো? কেন খোঁজো? আমি তো আছি। দুপুড়ে ঝড় হয়ে গেল, বৈশাখী ঝড়। আম পড়েছে কত সমস্ত বাগানে। কত ঝড় বয়ে গেছে, ফিরেও দেখিনি। এবারে দেশবাড়িতে এসে আটকে পড়েছি, নইলে এতদিন থাকতাম বুঝি? এখন আকাশের নীল বুঝি, পাতার শিরশির। যমুনা, হাত ধরো, চলো বাল্যবেলায় যাই। করোনা পেরিয়ে আগামী বৈশাখে কি থাকবো দুজনেই! চলো, হাত ধরো। বাগানে যাই। আম কুড়োবো। আমবাগানটাও কি থাকবে আগামী বছরে আর! দেখেছি, ক’মাস আগে ভীষণ মাপজোক হয়ে গেছে আমবাগানে। ছেলেমেয়েরা তিনজনই ছিল তো তখন হাত ধরাধরি। লাঠিটা আমিই নিচ্ছি যমুনা, তুমি হাত ধরো।
সূর্যটা আজ আকাশকে ততটা না রাঙিয়েই নিঃশব্দে বিদায় নিল। আকাশ থেকে ধীরে ধীরে একটা ধোঁয়াটে নীল পর্দা ঝুলে পড়ল শোকনগরে। এখন করোনা কাল। ইঁটপাথর কংক্রিট নৈঃশব্দ বমি করে চলেছে। বন্ধ দোকানপাট সদর দরজা। কুন্ডলি পাকানো কুকুর এলিয়ে অযত্নে পড়ে থাকা সদ্যমুন্ডিত মস্তকের চিরুনি খানির মত। সেই বাসায় একা একা একটি রিকসা। সাদা রঙ সিটে বসে আছে একটি শূন্যতা শুধু। রিকসাটি চলছে – গলি থেকে রাজপথ, রাজপথ থেকে গলি। একটি মানুষ নিমগ্ন প্যাডেলে।
যে চালাচ্ছে তাকে আপনারা চেনেন পাঠক।
ও তো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই মদন তাঁতি। যে আকালের দিনে শূন্য মাকু চালিয়েছে ঠকঠক… ঠকঠক।
লোকটার মাথাটা উঁচোনো।
একা হাঁটছে, আনমনা।
গাছ দেখলে গাছের তলায় দাঁড়িয়ে পড়ছে।
কিছু যেন জরিপ করছে।
লোকটার দৃষ্টি উঁচুতে।
লোকটা একা, হাঁটছে, একা।
গাছের পাশে দাঁড়াচ্ছে কিছুক্ষণ, কিছু যেন হিসেব করছে।
লোকটাকে চেনা লাগে। চেনা চেনা লাগে,
কিন্তু নামটা মনে পড়েনা।
ফুটপাথে বৌদির দোকানে বাসন মাজতো?
গাড়ি ধুতো?
চাট বেচতো দেশি মদের ঠেকে?
নাকি ট্রেনের হকার?
একটা নিমগাছের তলায় দাঁড়িয়ে, উপরে, তাকিয়ে যেন ঈশ্বরকেই কৃতজ্ঞতায় বলল, “এই ডালটা কিন্তু শক্ত আছে বেশ, ঝুলে পড়লে ভাঙবেনা।”
একটি সরকারি কর্মচারীদের কো-অপারেটিভ আবাসনের নাম ‘আমরা সবাই’। প্রথম প্রথম সবার মধ্যেই বেশ একটা আমরা সবাই ভাব ছিল। একসঙ্গে পিকনিক, কারোর সন্তানের জন্মদিনে গণতালিতে হ্যাপি বার্থডে। এসব এখন অতীত। চুয়াল্লিশটা ফ্ল্যাটের পুরোটাই ঝগড়া। তেরোটা দল, চোদ্দটা উপদল। কালিপুজোর রাতে কোনও বোমাপ্রেমী চকলেট বোমা ফাটিয়েছিল, পরিবেশপ্রেমীরা আপত্তি করেছিল, তা থেকে ঝগড়া, হাতাহাতি। কেউ একজন বাড়িতে হিজড়ে এনেছিল এই বিশ্বাসে – ওরা কোলে তুলে আশীর্বাদ করলে নবজাতক দীর্ঘায়ু হয়। তা নিয়ে কুসংস্কার বিরোধীদের প্রতিবাদ ট্রান্সজেন্ডার কমিশন – মানবাধিকার হয়ে থানাপুলিশ পর্যন্ত যায়। লকডাউনের আগে ডাক্তার নার্স স্বাস্থ্যকর্মীদের থালা-ঘণ্টা-কাঁসর বাজিয়ে অভিনন্দনের পরদিন ঝগড়াঝাঁটি হয়। বাড়িতে অসুস্থ কেন এত থালা বাজানো নিয়ে ঝগড়া শুরু হয় দুই পরিবারের পরে দেশভক্ত বনাম দেশদ্রোহী পর্য্যায়ে চলে যায়।
সমস্ত বিরোধ মিটে গেল গতকাল। থালা বাজানোর তিনসপ্তাহ পর। সবাই একমত এই ব্যাপারটায়। মতের এমন মিল অনেকদিন হয়নি। ঘোষদস্তিদার সাহেব ছেলের কাছে ব্যাঙ্গালোরেই থাকেন। নিজের ফ্ল্যাটটা ভাড়া দিয়ে দিয়েছেন একটি বেসরকারী হাসপাতালকে। তিন জন নার্সও ফ্ল্যাটে থাকেন।
সবাই একমত ওদের ঢুকতে দেয়া হবে না।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন