সৌরভ চক্রবর্তী
লকেট বাড়িতে আসার পর ববি কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়েছে। ববির হাজবেন্ড কৃশানু ইউএসে কর্মরত। ববি কলকাতায় মায়া কাটিয়ে উঠতে পারেনি। যদিও মোটা বেতনের কর্পোরেট চাকরি একটা কারণ, আরছোটবেলায় কাটানো বালিগঞ্জের ঢাউস বাংলো অন্যটা। বাড়িতে এতদিন রান্নাবান্নার লোক আর একজন মাসী রেখেই চলে যেত। কিন্তু রিসেন্টলি ছোট ছেলে হবার পর থেকেই লকেটের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিল ববি। এমনিতেই অর্চি বড় হচ্ছে, ছ’বছর বয়স। তার উপর এখন ঋষি এলো। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে গেলে এবং মাসিক খরচ কমাতে গেলে লকেটের বিকল্প কিছুই ছিলনা। কোম্পানি থেকেও বলেছিল,
– বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানো থেকে শুরু করে রান্না করা বাসন মাজা, আপনাকে তৈরি করা সবকিছু করতে পারে আমাদের রোবোমম।
– দুধ খাওয়ানো?
ববির প্রশ্নে মহিলা হেসে বলেছিলেন,
– বটল ফিডিং।
কৃশানু বলেছিল,
– দেখো ইউএসে এসব এসেছে বহুবছর। ২০৫০ দাঁড়িয়ে এখন রান্না করা, ঘর পরিস্কার এটসেট্রার আলাদা আলাদা লোক রাখা মানেই পয়সা নষ্ট। আমার আপত্তি নেই। তুমি দেখে নাও।
হলুদ সুতী শাড়ি পড়া, সুশ্রী মুখের রোবোমমকে দেখেই পছন্দ হয়েছিল ববির। তারপর ডাউনপেমেন্ট করে দেয় ববি। ইএমআইয়ে ঘরে চলে আসে ফুলটাইম রোবোমম।
কোম্পানি শুধু বলেছিল,
– ব্যাটারি ফুল এমপ্টি যেন না হয় লক্ষ রাখবেন। অবিশ্যি রোবোমম নিজেই নিজেকে চার্জ দেয়, তবুও।আর বাজ পড়লে এই মেশিন অনেক সময় ভুল কমান্ড নেয়। আপডেট চলে এলে আমরাই অটো আপডেট করে দেবো। এছাড়া আর কোনও সমস্যা নেই।
লকেট নামটা ববিই রেখেছে। যার পেছনে একটা সকেট আছে এবং গলার পেছনে ইলেকট্রনিক তার পেঁচানো, সেই রোবোটের নাম লকেট রাখাই যাই। লকেট গৃহকর্মে নিপুণা, চটপটে, অফিস আওয়ার্সে একইসঙ্গে ববিকে প্রয়োজনীয় জিনিস এগিয়ে দেওয়া, অর্চিকে স্কুলের জন্য তৈরি করা এবং ঋষিকে সামলানো – এ মানুষের কম্ম নয়।
তবে ববি অবসর সময়ে লক্ষ্য করেছে, লকেটের মধ্যে সত্যজিতবাবুর অনুকূলের কোনও গুণাবলী নেই।অনুভূতিহীন একটা যন্ত্র এই লকেট। শুধু কাজ করতে জানে এবং অবসরে নিজেকে নিজেই চার্জ দেয়।কাজের কথার বাইরে একটা শব্দ খরচ করেনা সে।
ববি বৃষ্টির মরসুম আসার পর তক্কে তক্কে আছে। লকেটকে নানাভাবে পরীক্ষা করছে। কিন্তু কোম্পানির মেয়েটির কথাকে সম্পূর্ণভাবে মিথ্যে প্রমাণ করেছে লকেট। যত বৃষ্টিই হোক, যত বাজই পড়ুক লকেট আদেশ পালনে কোনও ভুল করেনা। একসময়ে ববি প্রায় নিশ্চিন্ত হয়ে পড়ে।
সেদিন সন্ধ্যে থেকে খুব বৃষ্টি। অর্চি স্কুল থেকে ফিরেছে অনেকক্ষণ। এখন বসে বসে বৃষ্টি দেখছে। আজ নাইট শিফট আছে ববির। ঋষি এখনো ঘুমে কাদা।
– লকেট?
– হ্যাঁ, বলুন।
– আমি কাল সকালে ফিরবো। ফ্রিজে আস্ত চিকেন রাখা আছে, অর্চি রোস্ট খাবে বলেছিল। করে দিও।
ব্যাগ গোছাতে গোছাতেই ইন্সট্রাক্ট করছিল ববি,
– আর অর্চিকে হোমওয়ার্কে হেল্প করে দিও। ঋষির ঘুম ভাঙলে তাকে খাইয়ে দিও। ব্রেস্টমিল্ক পাম্প করে রেখে গেছি ফ্রিজে। বুঝেছো?
– হ্যাঁ, বুঝে গেছি।
মিষ্টি হেসে প্রথাগত যন্ত্রমানবীর মত উত্তর দিয়েছিও। লকেট।
ফোন আসে, রিসিভ করে ববি,
– হ্যাঁ, কৃশানু, আমি বেরোচ্ছি। তুমি মেইলটা আমায় পাঠিয়ে…
আর শোনা যায়না। ফোন কানে দিয়ে ববি বেরিয়ে যায়।
লকেট ইনস্ট্রাকশান অনুসারে কাজ করতে থাকে। রান্নাঘরে গিয়ে ফ্রিজ থেকে চিকেন বের করে আনে, ছাল ছাড়ানো ধুয়ে রাখা সাদা আস্ত মুরগী। বরফ ঝরার জন্য বাইরে রেখে ম্যারিনেট করার বন্দোবস্ত করতে থাকে সে। বাইরে বৃষ্টি বাড়ছে।
– লকেট, লকেট?
অর্চি ডাকছে, মশলা বানানো মাঝপথে থামিয়ে হাত ধুয়ে লকেট অন্য ঘরে যায়।
– হোমওয়ার্ক…
লকেট বই এবং খাতা নিয়ে বসে পড়ে অর্চির সঙ্গে। বাইরে বৃষ্টির ছাট বাড়ছে, বাজ পড়া শুরু হয়ে গেছে।ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে জানলার শার্সি।
তিনমাসের ঋষির কান্নার শব্দ শোনা যায়।
মাঝপথে হোমওয়ার্ক থামিয়ে ঋষির ঘরে ছোটে লকেট। ডায়পার চেঞ্জ করিয়ে ফ্রিজ থেকে বের করে আনে ব্রেস্টমিল্ক। খাইয়ে দেয় ঋষিকে। ঋষির তন্দ্রা কাটেনি, আবার ঘুমিয়ে পড়ে সে।
– লকেট আমার দেরি হচ্ছে। আজ অনেক হোমওয়ার্ক। প্লিজ কাম ফাস্ট।
ঋষিকে ঘুম পাড়িয়ে আবার অর্চির ঘরে দৌড়ায় লকেট। তখুনি একটা বীভৎস শব্দে দালান কাঁপানো বাজ পড়ে। মুহুর্তের জন্য থেমে যায় লকেট। চার্জ কমে আসছে, বিপ বিপ শব্দ শোনা যাচ্ছে। এখন চার্জ দেবার সময় নেই, ব্যাটারির পাওয়ার ব্যাকআপ বাড়িয়ে দেয় সে। ইমারজেন্সি থেকে চার্জ তুলে নেয় লকেট। কিছু এপ্লিকেশান অফ হয়ে যায়।
একঘন্টা কাটে, কাঁচের জানালা দিয়ে দেখা যায় কালো আকাশে ইন্দ্রের বজ্রের মত বিদ্যুৎ শলাকা ফুটে উঠছে বারে বারে। এরই মধ্যে হোমওয়ার্ক শেষ করেছে লকেট। মাঝে দু‘বার ছুটতে হয়েছে কিচেনে এবং ঋষির ঘরে।
– অর্চি তুমি অপেক্ষা করো। আমি তোমার চিকেনটা রোস্টের জন্য মাইক্রোওয়েভে বসিয়ে আসছি।
– ফেরার পথে দুধ এনো, খাবো। আর ঋষির ঘরে জানালা বন্ধ আছে কিনা দেখে নিও। আর শোনো, তোমার বিপ বিপ শব্দ আবার শুরু হয়েছে। ব্যাটারি নেই বোধহয়। চার্জ দাও।
অর্চি এত ইন্সট্রাকশান একসঙ্গে দিল যে প্রায় ব্যাটারি নিঃশেষিত লকেট কোনোক্রমে সবগুলো আলাদাভাবে বুঝতে পারলো।
ধীরে ধীরে সে এগিয়ে গেলো রান্নাঘরে। মাঝে ফিরে এলো ঋষির কাছে। আবার রান্নাঘর, আবার ঋষি।
রোস্টের জন্য মুরগীটা মাইক্রোওয়েভে রাখলো। জানালা বন্ধ করে, ঋষিকে আরেকটু খাইয়ে নিপাট ভাঁজ করা চাইল্ডবেডে শুইয়ে চাদরে ঢেকে দিল।
– আজ ইচ্ছে করছে না। রোস্ট খাবোনা। আমি শুয়ে পড়ছি।
অর্চির গলা, লকেট বুঝলো কাজ শেষ হয়েছে তার। রোস্টেড চিকেনটা বের করে টেবিলের উপর রেখে ঢেকে দিল সে।
নিজেকে নিয়ে চার্জে বসিয়ে দিন শেষ হল তার।
***
ক্যাব থেকে নেমে ফোন কানে দিয়ে ঘরে ঢুকছে ববি। রোবোমম কোম্পানির ফোন। তা থেকে স্বয়ংক্রিয় ভয়েসে কথা শোনা যাচ্ছে। কাজের সুবিধার্থে লাউডস্পিকারে রাখলো ববি।
লকেট দরজা খুলে দিয়েছে।
– গুডমর্নিং ম্যাম।
– গুডমর্নিং। অর্চির কী খবর। ঋষি রাতে ক‘বার উঠেছে?
– অর্চি রাতে খায়নি। হোমওয়ার্ক শেষ করে শুয়ে পড়েছে।
– সেকী? আর ঋষি?
– সে একবার উঠেছিল। খাইয়ে শুইয়ে দেবার পর আর ওঠেনি।
– মানে? এতটুকু বাচ্চা ওঠেনি!
বলেই ব্যাগ রেখে ববি ছুটলো ঋষিকে যে ঘরে রাখা হয় সেখানে। মেঝেতে চারদিকে ছোটখাটো খেলনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, ববি এক দু‘টোকে মাড়িয়ে চলে গেল যেন। আর গিয়ে যা দেখলো তাতে বাকশক্তিরহিত হয়ে গেল।
চাইল্ডবেডে চাদর গায় দিয়ে শুয়ে আছে, পালক ছাড়ানো সাদা ধবধবে একটা আস্ত মুরগী। গায়ে ম্যারিনেশানের মশলা লেগে আছে।
বিছানা ধরে বসে পড়ে ববি। ফোনের লাউডস্পিকারে এখনও শোনা যাচ্ছে রোবোমম কোম্পানির কথা।
– প্রিয় গ্রাহক, আমরা রোবোমমকে আপডেট করে ফেলেছি। বৃষ্টির দিনে বাজ পড়লে সে আর আগের মত ভুল করবে না। শুধুমাত্র ব্যাটারি কম থাকাকালীন একসঙ্গে অনেক অর্ডার এলে সে গুলিয়ে ফেলতে পারে, তাও শুধুমাত্র বজ্রপাতসহ বৃষ্টির দিনেই। একটু খেয়াল রাখবেন প্রিয় গ্রাহক। ধন্যবাদ।
রান্নাঘরে গিয়ে টেবিলে রাখা রোস্টেড চিকেনের ঢাকনা খোলার সাহস দেখাতে পারল না আর ববি।