short-story-maaa

মা
স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়


আজও সায়ন অফিস থেকে ফেরার পথে পাড়ার মোড়ে মোটরবাইকটা দাঁড় করিয়ে এগিয়ে গেল।

রোজকার মতোই বুড়ি ডাবউলি সায়নকে দেখে ফোকলা মুখে এক গাল হেসে বলল, — এয়েছিস, বাপ! তোর জন্য একটা কচি ডাব আলাদা করে লুকিয়ে রেখেছি। বলতে বলতে নিজের পেছন থেকে একটা চকচকে গোল মুখ ডাব বার করে এনে ডাবের মুখ কেটে যত্ন করে তার মধ্যে স্ট্র ঢুকিয়ে ডাবটা সায়নের হাতে তুলে দিল।

সায়ন ডাবের জল পান করে ডাবটা একপাশে ফেলে পকেট থেকে নোট বার করে এগিয়ে দিতেই ডাবউলি বুড়ি ফোকলা হেসে বলল, — আবার তুই আমায় নোট দেখাচ্ছিস! ওরে মা কি বেটাকে খেতে দিয়ে ট্যাকা নেয়?

— কিন্তু…

— না বাপ। ওটাকা, তুই তোর কাছেই রাখ।

সায়ন কি করবে ভেবে পায় না। তবে এই কদিনে সে বুঝেছে বুড়ি কে জানে কি কারণে কিছুতেই ডাবের দাম নেবে না। কিন্তু বুড়ি গরিব মানুষ। এভাবে কি প্রতিদিন বিনা পয়সায় ডাব খাওয়া উচিত! কথাটা বুড়িকে বলতে বুড়ি এমন ছলছল চোখে তাকিয়েছে যে তারপর আর সায়ন কিছু বলতে পারেনি।




আসলে কান্ডটা ঘটিয়েছে সায়নই। সে এই শহরতলীর এক মেসে দুই বন্ধুর সঙ্গে থাকে। তার দেশের বাড়ি মালদা। সেখানে তার বাবা আর ছোট বোন থাকে। মা মারা গেছেন গত বছর। তারপরই দেশের বাড়ির প্রতি আকর্ষণ হারিয়েছে সায়ন। একটা চাকরির অফার পেয়ে চলে এসেছে এখানে। সে এক বছর পঁচিশের যুবক।

ঘটনাটা ঘটলো মাসখানেক আগে। সায়ন বরাবরই নিজস্ব মোটরবাইকে কর্মস্থলে যাতায়াত করত। ডাবের জল ছিল তার খুব প্রিয়। বিশেষ করে গরমের সময়ে।

পাড়ার মোড়ে ফুটপাথের ধারে বসে ডাব বিক্রি করে এক বুড়ি। মাথায় রুক্ষ চুল। পরনে শতছিন্ন শাড়ি। সায়ন রোজই অফিস ফেরত সেই ফুটপাথের ধারে তার মোটরবাইক দাঁড় করিয়ে ডাবের জল খেত। কিন্তু সেদিন কি যে হল পড়ন্ত রোদের আলোটুকু এসে পড়েছিল ডাবউলির মুখে। বুড়ি ডাবউলির ওই ক্লান্ত মলিন মুখটা দেখে হঠাৎ কেমন যেন ঘোর লেগে গিয়েছিল সায়নের। সারাদিন পথের ধারে ধুলো ময়লার মধ্যে বসে ডাব বিক্রির খাটাখাটনির মধ্যেও চোখদুটো হয়ে উঠেছিল মায়াময়। হঠাৎ যেন সায়নের মনে পড়ে গিয়েছিল নিজের মায়ের কথা। সায়নের মা একা হাতে সংসারের সব কাজ সেরেও বাবার মন পেত না। বাবার ছিল উগ্র মেজাজ। মায়ের জন্য কোনদিন কিছু করতে বা দিতে দেখেনি সায়ন। এই জন্য মায়ের কোন অভিযোগ ছিল না। তবে কখনো কখনো আড়ালে মাকে চোখের জল ফেলতে দেখেছে সে। কিন্তু এত সব দেখে শুনেও প্রতিবাদের সাহস ছিল না তার। তখন যে তার পায়ের তলার মাটি ছিল না। দুবেলা অন্নের জন্যে বাবার উপরে নির্ভরশীল ছিল তবু কখনো কিছু বলতে গেলে বাবা বলতেন — এ সংসারে আমার কথাই শেষ কথা। না পোষালে নিজের রাস্তা দেখে নাও। মা তখন ছেলেকে সামলাতেন। বলতেন — তুই কিছু মনে করিসনি। জানিস তো বাবা মানুষটা রাগী। মা যখন এ কথা বলতেন মায়ের চোখেও এমনই মায়া দেখেছে সায়ন।

মা মারা গেলেন মাত্র তিন দিনের জ্বরে। ভীষণ কষ্ট পেয়েছিল সায়ন। ওবাড়িতে আর থাকতে পারেনি। ঠিক সেই সময় চাকরিটাও জুটে গিয়েছিল। হয়তো পরলোকগত মায়ের আশীর্বাদেই।

এইসব ভাবতে ভাবতেই সেদিন ডাবউলি যখন তার হাতের কাটারিটা দিয়ে সায়নের জন্য একটা ডাব কাটছিল, হঠাৎ সায়নের কন্ঠ থেকে কথাটা বেরিয়ে এল, — তুমি ঠিক আমার মায়ের মতো।

কথাটা শুনেই সেদিন থমকে গিয়েছিল বুড়ি। কিছুক্ষণ অবাক চোখে সায়নের দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপর তার ফোকলা মুখে ফুটে উঠেছিল এক আশ্চর্য হাসি। ফিসফিস করে বলেছিল — তুই আমায় মা ডাকলি বাপ!

— হ্যাঁ গো, এবার সায়ন স্বাভাবিকভাবেই বলার চেষ্টা করেছে। আমার মা নেই। মারা গেছে। কিন্তু আমার মায়ের চোখদুটো ঠিক তোমার মতই ছিল।

উত্তরে বুড়ি কিছু বলেনি। কিন্তু সেদিন থেকে সেই বুড়ি ডাবউলি সায়নের কাছ থেকে কিছুতেই ডাবের দাম নেয় না। সায়ন যতবার দিতে চায় বুড়ি বলে, — একি কথা বাপ! মা কি ছেলেকে খাইয়ে ট্যাকা নেয়?

তবুও সায়নও যেন প্রতিদিন সেই ডাবউলির হাতে ডাব না খেয়ে তৃপ্তি পায় না।




এভাবেই চলছিল দিনের পর দিন। তারপর ঘটনাটা ঘটল সেদিন। ঘটনা নয় দুর্ঘটনা। সেদিন বোধহয় কোন কারণে অফিস ফেরত কিছুটা অন্যমনস্ক ছিল সায়ন। মোটর বাইকটা নিয়ে অন্যদিনের মতোই রাস্তার ধারে ডাবউলির কাছাকাছি দাঁড় করিয়েছিল। বাইক থেকে নেমে সবেমাত্র হেলমেটটা খুলতে যাচ্ছে আচমকা একটা মোটর ভ্যান পেছন থেকে এসে ওকে সজোরে ধাক্কা মেরে চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে ফুটপাতের ধারে পড়ল। সায়নের মাথা ফেটে দরদর করে রক্ত ঝরতে লাগল। রাস্তায় একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। কিন্তু সবচেয়ে আগে দৌড়ে এল সেই ডাবউলি। সায়নের কাছে এসে সে বুকফাটা কান্নায় আশপাশ কাঁপিয়ে তুলল।

ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন তাকে জিজ্ঞেস করল — এই বুড়ি, ওকে চিনিস?
— ও যে আমার ব্যাটা গো? ওকে আগে তোমরা ডাক্তারখানায় নিয়ে চলো বাবুরা।

ওর কথা শুনে ভিড় করে আসা সকলের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হল। কিন্তু কেউ এগিয়ে এলো না। পুলিশ এসে গেল ডাবউলি তখন তার জীর্ণ কাপড়ের পার ছিড়ে সায়নের কপালের রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করছে। সায়ন পড়ে আছে বেহুঁশ হয়ে।

পুলিশ এসে প্রথমে জনতার কাছে দুর্ঘটনার বিবরণ শুনল। কিন্তু দুর্ঘটনাকারী ভ্যানের হদিস কেউ দিতে পারল না। সায়নের ঠিকানাও কেউ জানাতে পারল না। আসলে সে তো এলাকার ছেলে নয়। তার মুখটা অপরিচিত না হলেও ঠিকানা কেউ জানে না। পুলিশ তখন সেই ডাবউলি বুড়িকে জিজ্ঞেস করল — এই বুড়ি তুই চিনিস একে?

বুড়ি বলল — তোমরা আগে আমার বেটাকে ইলাজের জন্য নিয়ে চলো। আর দেরি করো না বাবুরা।

পুলিশ দুর্ঘটনাগ্রস্থ মোটরবাইক এবং সায়নের পকেট সার্চ করে ওর কোন ঠিকানা বা মোবাইল ফোন পেল না। সম্ভবত সেটা রাস্তায় ছিটকে পড়েছে। এবং সুযোগ বুঝে কেউ সেটা চুরি করে নিয়ে সরে পড়েছে। অগত্যা রক্তাক্ত সায়ন আর সেই ডাবউলি বুড়িকে একই গাড়িতে তুলে পুলিশ সরকারি হাসপাতালের এমার্জেন্সিতে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দিল।




এমারজেন্সিতে ডাক্তার এসে পেশেন্ট দেখে বুড়িকে জিজ্ঞেস করলেন — এর নাম ঠিকানা কী?

বুড়ি বলল — জানি না ডাক্তারবাবু। তবে এ আমার বেটা।

ডাক্তার বুড়ির আগাপাশতলায় চোখ বুলিয়ে বিস্মিতভাবে বললেন — এ তোমার বেটা? কী নাম?

বুড়ি একটু চিন্তা করে বলল — সুলেমান।

আরো অবাক হলেন ডাক্তার। বললেন — তোমার নাম কী?

— নাজনীন বালু, ডাক্তার সাব। কিন্তু আর দেরি করবেন না, ডাক্তার সাব। ওর ইলাজ করুন, বুড়ি অনুনয় করে বলল।

ঠিকই। এমারজেন্সি কেস। ডাক্তার আর দেরি করলেন না। ওকে বেডে দিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেন। সেদিন সারারাত ডাবউলি বুড়ি নাজনীন বালু সেই সরকারি হাসপাতালের সামনে ফুটপাতে শুয়ে রইল। সকাল হলে হাসপাতালে ঢুকল। সেখানে গিয়ে জানল তার বেটার জ্ঞান ফিরেছে। ডাক্তারদের কাছে সে নিজের নাম ঠিকানা বলেছে।

বুড়ি যখন সায়নের বেডের সামনে গিয়ে দাঁড়াল, দেখল, সায়নের মাথায় ব্যান্ডেজ জড়ানো। তাকে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। সায়ন বুড়িকে দেখে বলল — আমি সব শুনেছি। তোমার জন্যই আমি এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম। ডাবউলি বুড়ি ওর মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল — ও কথা বলিসনি বাপ। সায়ন হাসল। বলল — বেশ তবে আমার একটা কথার জবাব দেবে?

— কী বাপ?

— হাসপাতালে রেজিস্টারে আমার সুলেমান নামটা কেন লিখিয়েছিলে? একটা নাম দিতে হয়েছে তাই?

— না রে, বাপ!

ডাবউলি বুড়ি একটু সময় চুপ করে রইল। এই প্রথম ওর মুখটা বিষন্ন হয়ে উঠতে দেখল সায়ন। একটু বাদে ধীরে ধীরে বলল, সুলেমান ছিল আমার একমাত্র বেটা।

— ছিল কেন বলছ?

— ও আর নেই রে, বাপ। গত বছর মারা গেছে, বলতে বলতে ডাবউলি বুড়ি নাজনীন বালুর দু’চোখ থেকে জলের ধারা নামল।

সায়ন কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল তার অশ্রুসিক্ত মুখের দিকে। তারপর একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে ধরে ধীরে ধীরে বলল, — মা, আজ থেকে আমিই তোমার সুলেমান।



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *