short-story-makorsar-jaal

মাকড়সার জাল
মোহিত কামাল

ঘৃণা অর্থ জানো? মম কঠিন ভাষায় জিজ্ঞেস করল নুহাকে।

জানবো না কেন? ঘৃণা পাওয়ার মতো কাজ করেছি। কাজ করে উপহার পাচ্ছি ধিক্কার। উপহার পাচ্ছি বিদ্বেষ আর বিরাগ। এখন যে প্রশ্নটা করেছ, প্রশ্নের মধ্য দিয়েও আমার দিকে নিন্দা ছুড়ে দিয়েছ। তোমার চোখেও দেখতে পাচ্ছি বিষদৃষ্টি। তোমার প্রশ্নের ধরনই বলে দিচ্ছে আমাকে দেখে তোমার পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে, গা ঘিনঘিন করছে। নাক সিটকানো দেখে মনে হচ্ছে, অসহ্য লাগছে আমাকে, বিবমিষা জাগছে। আর কিছুক্ষণ এখানে থাকলে হয়তো গা গুলিয়ে উঠবে তোমার, পেটের ভেতর থেকে বমিটা উগরে দেবে আমার ওপর। দীর্ঘ জবাব দিল নুহা।

মম বলল, অফকোর্স। নিন্দিত, গর্হিত কাজ করে, বিরাগভাজন হয়েছ তুমি। সত্যটা বুঝতে হবে। বুঝেশুনে চলতে হবে ভবিষ্যতে।

বুঝেশুনে চললে কি ঘৃণ্য কাজের দায় থেকে মুক্তি পাব?

না। মুক্তি পাওয়ার আর কোনো পথ খোলা নেই। সারা জীবন আমার ঘৃণার আগুনে পুড়তে হবে তোমাকে।

তোমার তাচ্ছিল্য বরণ করেই বলছি, ঘৃণার আগুন জ্বলছে তোমারই মস্তিষ্কে। ওই আগুন আমাকে, নাকি তোমাকে পোড়াচ্ছে? অন্তরে ঘৃণা পুষে রাখলে ক্ষতি হবে কার মস্তিষ্ক? আমার, না তোমার? আমার দোষে তুমি কেন পুড়বে?

আমার ক্ষতি নিয়ে ভাবতে হবে না তোমাকে। আমার ক্ষতি হলে হোক। তবু সারা জীবন চিৎকার করে বলব, আই হেইট ইউ। তোমাকে ধিক্কার জানাই।

তোমার অন্তরের ধিক্কার তোমারই ভেতরের তুষের আগুন। তবে জেনে রেখো, আমার মনে ক্ষোভ নেই, অপমানবোধ নেই। তোমাকে উপেক্ষা বা তোমার ছায়া না মাড়ানোর ইচ্ছা নেই। তোমার সান্নিধ্য না পেলেও, কাছে থাকার সুযোগ না থাকলেও, তোমার ভালো চাইব আমি। কারণ তোমার দেওয়া অসম্মান, তোমার সন্দেহ, তোমার নাক উঁচু স্বভাবের কারণেই নেহাল বাধ্য হয়েছে তোমাকে ছাড়তে। তোমার দেওয়া কষ্টের বাণ সইতে সইতে, রক্তাক্ত হতে হতে, উপেক্ষিত হতে হতেই আমার দিকে ঝুঁকেছে সে। এজন্য তোমাকে ঘৃণা করব না, ভালোই বাসব। তোমার দুর্ব্যবহারের কারণেই সে এসেছে আমার কাছে। এ কথা মনে রেখো। বলল নুহা।

অন্যের ফিঁয়াসেকে ছিনিয়ে দখল করে, লুণ্ঠনের পক্ষে যুক্তি দেখাচ্ছ? চিৎকার করে প্রশ্ন করল মম।

এটা যুক্তি-তর্কের বিষয় না। যা সত্য তাই বললাম।

আমি ঠেলে দিয়েছি, নাকি তুমি লুট করে নিয়েছ নেহালকে?

যা বলার বলেছি আমি। তোমার অন্তরের বিতৃষ্ণার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, আমার আর কোনো কথা নেই। তোমার যা ইচ্ছা করতে পারো। বলতে পারো।

আবারও চিৎকার করে উঠল মম। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলতে লাগল, আই হ্যাড সেক্স উইথ হিম ফর থ্রি ইয়ার্স।

মমর উত্তেজনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শীতল হতে লাগল নুহার গলা। শীতল স্বরে বলল, আমি জানি। বোথ অব ইউ হ্যাভ এনজয়েড অ্যা লট। হি হ্যাজ বিকাম মোর পারফেক্ট। আই হ্যাভ দ্য অনার অব হিজ পারফরম্যান্স নাও।

ওহ! তোমার সঙ্গেও পারফর্ম করেছে সে! ওর পারফরম্যান্স টের পেয়ে গেছ? মমর ঘৃণার মধ্যে জ্বলে উঠল আগুন। ঘৃণা আর ক্রোধের মিশ্রণে মনের মধ্যে হঠাৎ তৈরি হয়ে গেল ভয়ংকর ঘূর্ণি। ঘূর্ণি সামাল দেওয়ার শক্তি নেই এখন। হাতের মোবাইল ছুড়ে মারল নুহার দিকে। অল্পের জন্য বেঁচে গেল নুহা। সেটা গিয়ে আঘাত হানল ওয়াড্রোবের ওপর রাখা ফ্লাওয়ার-ভাসে। সেখানে ছিল কয়েকটা অর্কিডের স্টিক। কাচের ভাস ভেঙে গেছে; স্টিকগুলো ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু অক্ষত আছে দামি মোবাইলটা।

নুহার শোবার ঘরে বসে কথা বলছিল ওরা। নুহাকে চার্জ করতে ছুটে এসেছিল মম। মমর কাণ্ড দেখে অবাক হলো না নুহা। খাট থেকে উঠে মোবাইলটা হাতে তুলে অর্কিডের স্টিকগুলো গুছিয়ে রাখল ওয়্যারড্রোবের ওপর। ভাঙা কাচের টুকরোগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তুলে নিল হাতে। মমর হাতে মোবাইল তুলে দিতে গিয়ে বলল, বি কনট্রোলড। মাথা না সরালে তো ইনজুরড হয়ে যেতাম। পুলিশ অ্যারেস্ট করত তোমাকে। ব্যাপারটা কি শোভন হতো?

উদ্ধত মেজাজের সামনে নুহার নিয়ন্ত্রিত আচরণ, কথাবার্তা হতবাক করে দিল মমকে। ভাঙচুরের পর মেজাজ ঠান্ডা হতে লাগল। একসময় কেঁদে উঠল। কেঁদেকেটে বলল, জনমের মতো আমার বুক থেকে তুমি কেড়ে নিলে নেহালকে!

আমি জানি তুমি ভালোবাসো নেহালকে। আমি জানি তোমার অধিকৃত সম্পদ মনে করো তাকে। এ কারণেই তাকে সন্দেহ করতে, কোনো মেয়ের সঙ্গে ওকে কথা বলতে দেখলে চিৎকার-চেঁচামেচি করতে। এতে ভালোবাসার বদলে ওর মনে বিতৃষ্ণা জমে গেছে। সে জন্য তোমার কাছ থেকে দূরে সরে এসেছে। জনমের জন্য সরে আসেনি। ইচ্ছা করলে আবার তাকে তোমার বুকে জড়িয়ে রাখতে পারো। আপত্তি করব না আমি।

নুহার কথা শুনে হা-করে তাকিয়ে রইল মম। মুখে কোনো কথা ফুটল না।

নুহা আবার বলল, ওর সব কথা শেয়ার করত আমার সঙ্গে। তোমার প্রতি অটুট ওর ভালোবাসা। তবে তোমার সন্দেহ এখন ওর অন্তরে বিষ ঢেলে দিচ্ছে। বিষের ছোবল থেকে মুক্তি দাও তাকে। তোমারই আছে সে। তোমার কাছেই ফিরে যাবে। ফিরিয়ে দেব আমি।

সন্দেহ ছাড়া কীভাবে থাকব? তার পারফরম্যান্স তোমারও দেখা শেষ! সে তো বিট্রেয়ার। বিট্রে করেছে আমার সঙ্গে।

এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না নুহা। কারণ এক মাস ধরে নেহাল ওর দখলে। পেতে চায়নি প্রিয় বান্ধবীর ফিঁয়াসেকে। কীভাবে যে কী ঘটে গেছে বুঝতে পারেনি। নেহাল তাকে পটায়নি। নুহাও তাকে ইন্ধন জোগায়নি। তবু কী ঘটে যাচ্ছে বুঝতে পারেনি। যা-ই ঘটুক না কেন, ব্যাপারটা বেশ এনজয় করেছে, নেহালের টোটাল পারফরম্যান্সে মুগ্ধ নুহা। আর এ মুগ্ধতা টের পেয়ে গেছে মম। এজন্য ছুটে এসেছে বাসায়। একচোট নিচ্ছে নুহার ওপর। মমর এ প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক ধরে নিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখছে।

‘ঘৃণা অর্থ জানো?’ মমর তীব্র প্রশ্নটির শাব্দিক অর্থ জানা থাকলেও মর্মার্থ মোটেই অনুতাপ জাগায়নি মনে। মোটেই মনে করছে না ঘৃণিত কোনো কাজ করেছে। বরং মনে হচ্ছে নেহালের সঙ্গে যা ঘটেছে, তা হচ্ছে পৃথিবীর শুদ্ধতম শিল্প। শৈল্পিকভাবে রঙিন চিত্র এঁকে দিয়েছে নেহাল; দেহের মধ্য থেকে বের করে দিয়েছে আরেকটা দেহ, দেহের ভাষার মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়েছে আরেকটা ভাষা। অনৈতিক হলেও অচেনা অজানা ভাষাটি হচ্ছে ঐশ্বর্যের, আনন্দের। আনন্দের ভাষা, শিল্পিত ভাষা অশ্লীল হবে কেন? ঘৃণার হবে কেন? বুঝতে পারছে না এ প্রশ্নের জবাব। তবে একসময় বুঝত, নিজেকে রক্ষা করা হচ্ছে নৈতিকতা। কোন ফাঁকে ভেঙে গেছে নৈতিকতার বাঁধ, টের পায়নি। দক্ষ কারিগর নেহাল কি অতি দক্ষতায় তুঙ্গ স্পর্শ করে বদলে দিয়েছে মনোজগৎ, দেহজগৎ? নৈতিক জগৎ উত্তর খোঁজার প্রয়োজন মনে করল না। তবে প্রিয় বান্ধবীর সঙ্গে বিট্রে করতে চায় না। মমর কাছেই ফেরত দিতে চাইবে নেহালকে। যদি নেহাল ফিরে যেতে চায়, বাধা দেবে না, কষ্ট পাবে না, কাঁদবে না। বান্ধবীর জন্য সব শর্ত মানতে রাজি।

নুহা এবার উঠে দাঁড়াল। মমর মাথায় হাত রেখে বলল, আই’ম সরি, মম।

আবারও অবাক হয়ে মম তাকাল নুহার মুখের দিকে।

সত্যিই দুঃখিত তুমি?

হ্যাঁ। সত্যিই সরি। নেহাল যদি তোমার কাছে ফেরত যায়, আপত্তি নেই আমার।

আমাকে কি সস্তা মেয়ে পেয়েছ? ফেরত আসতে চাইলেই জায়গা দেব একটা বিশ্বাসঘাতককে?

নুহা বলল, নেহাল বিশ্বাসঘাতক না। বলতে পারো আমাকেই। আমি তো সরি বললাম। ওকে ক্ষমা করে দাও।

নুহার কথা শুনে আবারও অবাক হলো মম। বুঝল, বান্ধবীর জন্য স্বার্থত্যাগ করতে প্রস্তুত নুহা, কাঁধে তুলে নিচ্ছে নেহালের দোষ। নুহাকে আর ঘৃণা করতে পারছে না। মমর অন্তরের ঘৃণা বদলে যেতে লাগল। বান্ধবীর জন্য মমতার জায়গাটুকু আবার আলোকিত হতে লাগল। নুহার কাছে নিজেকে ছোট মনে হতে লাগল। নিজেকে ভেতরে ভেতরে বিশ্লেষণ করে লজ্জিত হতে লাগল। এত ঘৃণার পর মহত্ত্বের প্রমাণ রেখেছে নুহা। আর সে দেখিয়েছে ক্ষুদ্রতা। ছি! ‘ঘৃণা অর্থ জানো?’ প্রশ্ন করেছিল নুহাকে। প্রশ্নের উত্তর পেয়েছে সে নুহার কাছ থেকে। কেবল উত্তর পায়নি। শিক্ষাও পেয়ে গেছে। নতুন এই শিক্ষার প্রতিদান কী হতে পারে? কতটুকু প্রতিদান দেওয়া উচিত? যে বাঁধন ছিঁড়ে যেতে পারে, তিন বছরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক যে পায়ে ঠেলে দিতে পারে, নিজের শত দোষ থাকলেও, নেহালের পাহাড়সমান দোষ ক্ষমার অযোগ্য। নেহালকে নয়, নুহাকেই ক্ষমা করার ভাবনা জেগে উঠল মনে। নতুন ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘ঘৃণার অর্থ জানো?’ প্রশ্নের উত্তরটা ফিরিয়ে নিলাম। ক্ষমা করে দিলাম তোমাকে। নেহালকে ক্ষমা করতে পারব না। নৈতিকতা বিসর্জন দিয়েছ, নিজেকে বিট্রেয়ার বলছ তুমি। স্বীকার করেছ সব। এজন্য ক্ষমা পেতে পারো তুমি।

আমাকে ক্ষমা করে সমস্যার সমাধান হবে না। সমস্যা আরও বাড়বে। তোমার কাছ থেকে আরও দূরে সরে যাবে নেহাল। আরও বেশি মিস করবে তাকে। সে আরও বেশি ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পাবে আমার। তখন কষ্টও বেড়ে যাবে তোমার। যাতনা বয়ে বেড়াতে হবে তোমাকে। আমার কাছে এলে নেহালকে তখন সরিয়ে রাখতে পারব না দূরে। বিষয়টা কি ভালো হবে? আর একবার ভেবে দেখো। ওকে ক্ষমা করে দাও। নইলে আমাকে আরও দোষ দেবে তুমি। তোমার আমার সম্পর্ক খারাপ হতে থাকবে।

নুহার কথা শুনে উঠে দাঁড়াল মম। বুঝল যা বলেছে, ঠিক বলেছে সে। তাকে ক্ষমা করে লাভ নেই। নেহালকেও ক্ষমা করতে পারবে না মম। ওরা জড়িয়ে গেছে। জড়িয়ে যাক। যা খুশি করুক। নুহা যদি স্বার্থ ত্যাগের কথা বলতে পারে ও কেন পারবে না? নতুন ভাবনায় ভিন্ন অবস্থানে নিজেকে তুলে মম বলল, মনে রেখো, আজ সে আমাকে ছেড়ে তোমার কাছে গেছে। তোমাকে দখল করেছে। জয় করেছে। কাল তোমাকে ছেড়ে আরেকজনের কাছে যেতে মোটেও বুক কাঁপবে না তার। সহজেই বিসর্জন দিতে পারবে তোমার ভালোবাসা। সহজেই ছুড়ে দিতে পারবে নৈতিকতা। যে একবার পেরেছে, বারবারই করতে পারবে এই কাজ।

তুমি ফিরিয়ে দিলে তো নিজেকে ওর কাছ থেকে মুক্ত রাখতে পারব না আমি। তুমিই কি মেনে নিতে পারবে সব?

মম বলল, মেনে নিলাম। বিসর্জন দিলাম। বললামই তো।

এটা তোমার রাগের কথা। জেদের কথা। অন্তরে আর কি কথা লুকিয়ে আছে, এখনো টের পাচ্ছ না। মন শান্ত হলে টের পাবে। নিজের দোষত্রুটি দেখার চোখ খুলে গেলে তখন কষ্ট হবে। প্রতি মুহূর্তে ওর সঙ্গ-সময় মনে পড়বে। তখন কী করবে? দিশেহারা হবে না? স্মৃতি কি দূরে তাড়িয়ে দিতে পারবে?

না। বিশ্বাসঘাতকের জন্য আবার কী কষ্ট!

তোমার ভালোবাসায় খাদ নেই। তুমি শুদ্ধ। তুমি বিট্রে করোনি। চিৎকার-চেঁচামেচি করলেও সব করতে নিজের ভালোবাসার জন্যই। সেখান থেকে বেরোতে পারবে তুমি?

মম বলল, পারব।

নুহা বলল, পারবে না।

মম বলল, সেই বিষয়ে ভাবতে হবে না তোমাকে। ক্ষমা করলেও বিসর্জন দিলাম তোমাকেও। তোমরা দুজন সুখে থেকো।

 

 

বাসা থেকে বেরিয়ে হনহন করে মম এগিয়ে গেল করিডর দিয়ে। একবারও পেছন ফিরে তাকাল না।

নিজের শোবার ঘরে এখন নুহা একাকী বসে পড়ছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা:

হে সুন্দর
       সুন্দরেরও অস্ত্র থাকে, তা অতি নির্মম
       সুন্দরেরও অস্ত্র থাকে, তা অতি নির্মম
       সুন্দরেরও অস্ত্র থাকে, তা অতি নির্মম
       আঃ, থাক না, আর কিছু বলার কী দরকার, থাক!
       হে সুন্দর, এই নাও, আমার সর্বস্ব, এক জীবন…

কবিতাটি পড়ার পর ওর মন হালকা হয়ে গেল। মোটেই মনে হচ্ছে না ঘৃণিত কোনো কাজ করেছে। বরং মনে হচ্ছে, নেহালের সঙ্গে যা ঘটেছে, তা হচ্ছে পৃথিবীর শুদ্ধতম শিল্প। শিল্প অশ্লীল হবে কেন? ঘৃণার হবে কেন? এটা সুন্দরের অস্ত্র। নির্মম হলেও এ অস্ত্রের আঘাত বুক পেতে নিতে চায় ও। সুন্দরের হাতে সঁপে দিতে চায় পুরো জীবন। আর কীই-বা বলতে পারত মমকে। যা বলার বলে দিয়েছে। এখন দেখার পালা নেহালকে। সুন্দরের অস্ত্র কোথায় হানে নেহাল, বোঝার জন্য অধীর হয়ে উঠল নুহা। মনে মনে প্রার্থনা করল নেহালের সঙ্গ। আরাধ্য সঙ্গটা কি নির্মম হয়ে উঠবে?

প্রার্থনা মঞ্জুর হলো না। নেহাল মেসেজ পাঠিয়েছে মুঠোফোনে―তুমি কি সব বলে দিয়েছ মমকে?

নির্মম সত্য হচ্ছে, মমই টের পেয়ে গেছে নেহালের সঙ্গ পাওয়ার খবর। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে সব বুঝে গেছে সে। নিজ থেকে কিছুই বলে দেয়নি, বরং নেহালকে ক্ষমা করার জন্য চাপ দিয়েছে। অথচ মেসেজটায় বোঝাতে চাইছে, সব কথা স্বেচ্ছায় বলে দিয়েছে নুহা।

কী জবাব দেবে?

সত্য জবাব কি মেনে নেবে নেহাল?

মেনে না নেওয়াটা হবে নির্মমতা। এটাই কি তবে নেহালের সুন্দরের অস্ত্র? এই অস্ত্র কি তবে বুকে বসাবে নির্মমতার বাণ?

কী জবাব দেবে, ভাবছে নুহা। এমন সময় আবার মেসেজ এল, ইচ্ছাকৃতভাবে ফাঁস করেছ, আমাদের সম্পর্কের কথা?

মেসেজটা পড়ে উত্তর দেওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলল নুহা। বুঝে গেল নির্মমতা কী। এই সুন্দরের হাতে কি তুলে দেওয়া যায় নিজের সর্বস্ব, এক জীবন?

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে একমত হতে পারছে না নুহা। সে তো চায়নি নেহালকে। ফিরিয়ে দিতে চেয়েছে মমর কাছে। তবু কেন এ প্রশ্ন? দেহকাব্যের ভাষাও খুঁজতে চায়নি। নেহালকে সান্ত্বনা দেওয়ার দুর্বল এক মুহূর্তে নেহালই খুলে দেখেছে তার দেহের পঙ্ক্তিমালা। বাধা দিতে পারেনি। কেন পারেনি ভেবে অবাক হলো। এখন ব্লেম করা হচ্ছে ওকে। সেট বন্ধ করে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। সিএনজি অটোরিকশায় উঠে বলল, মামা, শান্তিনগর চলেন।

মমর উদ্ধত প্রশ্নের সামনে সে ছিল নিয়ন্ত্রিত। এখন নেহালের মেসেজ পেয়ে হয়ে গেছে উত্তেজিত। বিক্ষুব্ধ। একই দেহ, একই মন। অথচ প্রতিক্রিয়া একই ধরনের পরিস্থিতিতে দু রকম। কেন? জানে না নুহা। একবার নিজেকেই প্রশ্ন করল, এত উত্তেজিত হচ্ছি কেন? উত্তর খুঁজে পেলো না। সুনীলের পঙ্ক্তিটি আবার নাড়া দিল― ‘আহ, থাক না, আর কিছু বলার কী দরকার, থাক!’ সুন্দরের ধাওয়া খেয়ে এমন ভাবা ঠিক আছে। ভাবনার পিঠে যে আবেগ ঘনীভূত হয়েছে, তাও ঠিক আছে। এখন পেছনে ধেয়ে আসছে অসুন্দর! অসুন্দর নিয়ে কেন প্রিয় কবি লিখে রাখেননি দুটো পঙ্ক্তি? অসুন্দরের ধাওয়া খেয়ে বলতে ইচ্ছা করছে, অসুন্দরের অস্ত্রটা কেবল নির্মমই নয়, ভয়ংকরও। এ অস্ত্র ছারখার করে দিতে পারে জীবন, জীবনবোধ।

নেহালের বাসার দিকে যতই এগোচ্ছে, ততই মনে হতে লাগল, কী অধিকারে যাবে নেহালের কাছে? নেহাল স্পষ্ট বলেছে, মমকেই ভালোবাসে। তবু খুলে ফেলেছে ওর দেহকাব্য। খোলার জন্য নিজেকে দায়ী ভাবেনি। নুহাকেও দোষ দেয়নি। সত্য বলেছে, ভালোবাসে মমকে। তবে কী অধিকারে যাবে? ভালোবাসা ছাড়া কি অধিকার পাওয়া যায় দেহের?

প্রশ্নের উত্তর নাড়া দিল আবার ভেতর থেকে। দুম করে বলল, ড্রাইভার সাহেব, শান্তিনগর নয়, ইউনিভার্সিটিতে চলুন। ঘুরিয়ে নিন অটো।

চট করে থেমে গেল অটোর গতি। ডান পাশের ডিভাইডার দিয়ে ঘুরে গেল সিএনজি অটো। ঘোরানোর পর ড্রাইভার বলল, ভাড়া বাড়িয়ে দিতে হবে।

ঠিক আছে, বাড়িয়ে দেব।

উত্তর দেওয়ার পরও ড্রাইভারের কথাটা কানে বাজতে লাগল।

‘ভাড়া বাড়িয়ে দিতে হবে’―এটা অবিচার। অবিচার মেনে নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। তবু ভালো। ড্রাইভারের কথা কানে বাজছে। নেহালের মেসেজের নির্মমতা কানে বাজছে না, মনে বাজছে। কান আর মন দুই ধরনের কথা নিয়ে মশুগুল। তাই কোনো কথাই পাত্তা পাচ্ছে না চিন্তায়। যাতনা থেকে রেহাই পেলেও অস্থিরতা থেকে মুক্তি ঘটছে না। প্রশ্ন ঢুকল মনে, কোথায় যাচ্ছে? কার কাছে যাচ্ছে? কী উদ্দেশ্যে যাচ্ছে? কী লাভ গিয়ে? উত্তর জানা না থাকায় প্রশ্নগুলো হতাশা বাড়িয়ে তুলল। মনের ভেতর ফুঁসে ওঠা নেহালের মেসেজের প্রতিক্রিয়াও কমে এল। হঠাৎ মনে পড়ে গেল এখনো বন্ধ আছে মোবাইল। হ্যান্ডব্যাগ থেকে সেট বের করে অন করে অটোর বাইরে তাকাল। রাস্তা বেশ ফাঁকা। ঢাকা শহরের রাস্তা সাধারণত ফাঁকা থাকে না। জরুরি কাজে বের হলে যানজটের ধকল আরও বেড়ে যায়। আজ হাতে জরুরি কোনো কাজ নেই। উদ্দেশ্যবিহীন ঘোরাঘুরির সময় দ্রুত ফুরিয়ে যায় রাস্তা। এখন একই অবস্থা হয়েছে।

অটো এসে হাজির হলো টিএসসি সড়কদ্বীপের সামনে। স্বোপার্জিত স্বাধীনতা ভাস্কর্যের পাশে নেমে দাঁড়াল।

ভাস্কর্যটির মূল বেদিতে চোখ গেল নুহার। শ্যাওলা জমেছে। ময়লার ছোপ বসে গেছে বেদিতে। কোথাও কোথাও উঠে গেছে টাইলস। রাজু ভাস্কর্যেরও একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে দূর থেকে। এবড়োখেবড়ো দাঁত বের করে যেন তাকিয়ে আছে ভাস্কর্যটি।

অতিরিক্ত ভাড়া পঞ্চাশ টাকা দিয়ে ভাস্কর্যের দিকে এগিয়ে গেল নুহা। এ সময় কেন যাচ্ছে ভাস্কর্যের দিকে? উত্তর জানা না থাকলেও ভাবল, ওই ভাঙা বেদিতে বসে কল করবে অদিতিকে। রোকেয়া হলে থাকে অদিতি। কল পেয়ে বাইরে আসতে পারে। কিছুক্ষণ একসঙ্গে কাটালে মনের ঝড়ঝাপটা কমে যেতে পারে ভেবে অদিতিকে কল করল।

কল ধরে অদিতি বলল, মিরাকল! তোমার কথাই আলাপ হচ্ছিল নেহালের সঙ্গে। এ সময় তোমার কল!

নেহালের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছ তুমি! কী আলাপ হচ্ছিল?

তুমি নাকি কষ্ট দিয়েছ নেহালকে?

এই অভিযোগ করল? একই কথা বলেছিল আমাকে মমর ব্যাপারে। মম নাকি তাকে কষ্ট দিত। আমার কাছে কষ্টের কথা রিলিজ করে শান্তি খুঁজেছে সে।

সহজভাবে কথাগুলো বলেছে নুহা। কিন্তু সহজভাবে নিতে পারল না অদিতি। সেও মমর মতো ক্লোজ ফ্রেন্ড। কথার স্বরে পরিবর্তন থাকায় অদিতি পাল্টা প্রশ্ন করল, কী বলছ এসব?

এ বিষয়ে পরে কথা বলব তোমার সঙ্গে। তুমি এখন কোথায়? প্রশ্ন করল নুহা।

টিএসসির ভেতরে আছি। সঙ্গে আছে নেহালও।

ওকে ছেড়ে কি বাইরে আসতে পারবে?

হ্যাঁ। পারব। তুমি কোথায়?

স্বোপার্জিত স্বাধীনতার বেদিতে বসে আছি। খুব জরুরি, বেরিয়ে এসো। না এলে আমার মতো বিপদ হতে পারে তোমারও।

তোমার কি কোনো বিপদ হয়েছে?

হয়েছে নয়। হয়ে গেছে। কমপ্লিকেটেড হয়ে যাচ্ছে বিষয়টা। আমার কথা না শুনলে তুমিও জড়িয়ে যেতে পারো জালে। দ্রুত বেরিয়ে এসো। তোমার সঙ্গে যে কথা বলছে, এখন মনে হচ্ছে, সে একটা বিষাক্ত মাকড়সা। মাকড়সা জাল তৈরি করছে। ওই জালে ধরা খেলে শেষ হয়ে যাবে, ঘোরের মধ্যে ডুবে যাবে। ওই ঘোর থেকে পা তোলার আগেই সর্বনাশ হয়ে যাবে।

নুহাকে ভালোভাবে চেনে অদিতি। নুহার এখনকার স্বরের মধ্যে আছে সত্যিকারের বিপদের আশঙ্কা। এ আশঙ্কা বানোয়াট নয়। চট করে উঠে দাঁড়াল বসা থেকে। নেহালকে বলল, তোমার সঙ্গে পরে কথা হবে। জরুরি কাজে বাইরে যেতে হবে। সরি। কথা শেষ করে দ্রুততার সঙ্গে টিএসসি থেকে বেরিয়ে এল অদিতি। টিএসসি ভবনের বাইরে এসে দূর থেকে দেখতে পেল নুহাকে। সে মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে টিএসসির গেটের দিকে। হাত তুলে অদিতি বুঝিয়ে দিল, দেখেছে নুহাকে। নুহাও হাত তুলে সাড়া দিল। অদিতি কাছাকাছি আসার পর উঠে দাঁড়াল স্বোপার্জিত স্বাধীনতার বেদি থেকে। টিএসসির দিকে না গিয়ে ব্যস্ত রাস্তার মোড় পেরিয়ে ও চলে এল রোকেয়া হলের দিকে। ওকে অনুসরণ করে অদিতিও এগিয়ে এল। হলের গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়াল নুহা। অনেকটা ছুটতে ছুটতে অদিতি ধরতে পারল তাকে।

কী হয়েছে, নুহা? খুলে বলো। এমন লাগছে কেন তোমাকে?

এখানে বলা যাবে না। রিকশায় ওঠো, আমার বাসায় চলো। আজ বাসায় থাকবে তুমি।

হল থেকে মেয়েরা বেরোচ্ছে, ঢুকছে। সামনে রিকশাজট। গায়ে গায়ে ধাক্কা লাগছে। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে কথা বলা যাবে না, বুঝতে পারল অদিতি। হলে গিয়েও নিরিবিলিতে কথা বলা যাবে না। রুমমেটের দুই বোন এসেছে, ভর্তি ফরম তুলতে এসে ওরা রুমে উঠেছে। বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে চট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে অদিতি বলল, চলো।

 

 

রিকশায় উঠে বসেছে ওরা। রিকশা চলতে শুরু করেছে নুহাদের বাসার উদ্দেশ্যে।

চলন্ত রিকশায় বসে শুনল মুঠোফোনের মেসেজ টোনের শব্দ। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল, এটি নেহালের মেসেজ। ভাবছিল, পড়বে না। তারপরও চোখ গেল মনিটরে― ‘মমকে যেভাবে খেপিয়ে দিয়েছ, অদিতিকেও সেভাবে লাগিয়ে দিয়ো না আমার বিরুদ্ধে।’

মেসেজটা পড়ে চকিতে কান গরম হয়ে উঠল। মাথায় জট বেঁধে গেল। মেসেজ-বোমায় আক্রান্ত হয়ে চুরমার হয়ে গেল। নিজের ভাঙচুর ঠেকিয়ে নুহা মুঠোফোনটা শক্ত করে চেপে ধরল ডান হাতের মুঠিতে। নির্বাক তাকিয়ে আছে সামনে। মাথার ভেতর ঘূর্ণির মতো ঘুরছে মেসেজের শব্দগুলো। মমকে খেপিয়ে দিয়েছে ও? এ রকম অপবাদ দিতে পারল! অথচ মমর কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে নেহালকে। সব দোষ নিজের কাঁধে নিয়ে মমর কাছে নত হয়েছে, সরি বলেছে। মমই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জেনে নিয়েছে সব কথা। কত আর মিথ্যা বলা যায়! যার জন্য চুরি করল, সেই বলছে চোর! প্রথমে মনে হয়েছিল ঘৃণিত কোনো কাজ করেনি, মনে হয়েছিল নেহালের সঙ্গে যা কিছু ঘটেছে, সেটা ছিল পৃথিবীর শুদ্ধতম শিল্প। মনে হয়েছিল দেহের মধ্যে আবিষ্কৃত ভাষাটি ঐশ্বর্যের, আনন্দের―অশ্লীল নয়। মনে হয়েছিল, ওই ভাষা হচ্ছে সুন্দরের অস্ত্রের আঘাতে সৃষ্ট নতুন স্বর, সুখের জানালা খুলে দিয়েছিল। উপলব্ধি বদলে গেছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে এখন মন একমত হচ্ছে। সুন্দরের অস্ত্রের আঘাতে নির্মমতার চিহ্ন বসে গেছে জীবনে।

অদিতি বলল, এমন চুপ করে থাকলে চলবে? খুলে বলো কী হয়েছে।

রিকশাওলার দিকে চোখ উঁচিয়ে বুঝিয়ে দিল, এখানে বলা যাবে না সব কথা।

আচ্ছা, সহজ হও। এমন শক্ত হয়ে আছ কেন?

সহজ হওয়ার চেষ্টা করছে নুহা। পারছে না। আরও শক্ত হয়ে মোবাইল অদিতির হাতে দিয়ে বলল, পড়ো।

চট করে পড়ে নিয়ে অদিতি বলল, তোমাকে দুষছে সে। নিশ্চয়ই তুমি মমকে খেপাওনি। নিশ্চয়ই আমাকেও খেপাবে না। নিশ্চয়ই ভুল বুঝেছে নেহাল।

ভুল বোঝেনি। চতুর সে। তার ধূর্ততা ধরা পড়ে যাবে ভেবে ভয় পাচ্ছে। এজন্য ঢালাওভাবে দোষ দিচ্ছে আমাকে। নিজের দোষ ঢাকতে চাচ্ছে।

তুমি তো নিজের কাছে স্বচ্ছ। অন্যে দুষলেই হবে? রিকশাওলার কথা ভুলে গিয়ে অজান্তেই ঢুকে গেল আলাপে।

নুহা বলল, আমি নিজে স্বচ্ছ নেই। আমাকে অস্বচ্ছ করে ফেলেছে সে। আমাকে যেভাবে মোটিভেট করেছে, বদলে নিয়েছে নিজের মতো করে। মনে হচ্ছে, একই উদ্দেশ্যে লেগেছে তোমার পেছনেও।

নুহার জবাব শুনে চুপ হয়ে গেল অদিতি। গত কয়েক দিনের বিভিন্ন ঘটনা ভেসে উঠল চোখের সামনে। তখন ঘটনাগুলো সহজভাবে নিয়েছিল। ফান হিসেবে নিয়েছিল। ফান করতে করতে নেহাল তার ঊরুতে থাপ্পড় দিয়ে বলেছিল, ‘তোমার স্বামী হবে খুবই ভাগ্যবান।’

‘আলাদা এমন কী আছে আমার? স্বামী ভাগ্যবান হবে, ভাবছ কেন?’

‘সেটা বলা যাবে না, গোপন কথা।’ লজ্জা পেয়েই বলেছিল নেহাল।

গোপন কথার মোড়ক উন্মোচন করতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল অদিতি। গোপনীয়তা ফাঁস করেনি নেহাল। নেহালের ওই রহস্যময়তা ভাঙার জন্য বেপরোয়া অদিতি কেবল চাচ্ছিল নেহালের সঙ্গ। বুঝতে পেরেছিল, গোপন রহস্যময়তা তৈরির গুরু নেহাল। এটাই কি গোপন চাল? এই চালে কি জড়িয়ে গেছে! নুহাও কি আটকে গেছে পাতানো মাকড়সার জালে? মমর কথা তো ওপেন সিক্রেট। সবাই জানে, ওদের মধ্যে অ্যাফেয়ার চলছে। যা ইচ্ছে করে, করুক। একটা সম্পর্ক চলার মধ্যে থেকেও কি আরেকজনকে ফাঁদে লটকাতে পারে কোনো ছেলে? বিশ্বাসযোগ্য? মনের মধ্যে প্রশ্ন এলেও নুহাকে দুষতে পারল না। বিশ্বাস করল। বুঝতে চেষ্টা করল অযৌক্তিক কোনো কথা বলবে না সে। ভাবনা নিয়ে নুহার হাত চেপে ধরে বলল, বাসায় গিয়ে সব শুনব। প্লিজ বি ইজি।

সহজ হতে পারছে না নুহা। নিজেকে ঘৃণিত মনে হচ্ছে। নিজের মনেই জাগছে বিরাগ। ধিক্কার দিচ্ছে নিজেকে। এত সহজে গলে গিয়েছিল! এত সহজে পা দিয়েছিল নেহালের জালে! বিবমিষা জাগছে; ঘৃণার তির ছুটে আসছে নিজের দিকে। বুকের গহনের প্রতিধ্বনি ছুটে আসছে বাইরে। আকস্মিক চিৎকার করে নুহা বলল, আমরা সবাই ফ্রেন্ড ছিলাম। ফ্রেন্ড ছাড়া কিছুই ভাবতাম না ওকে। একদিন সবার সামনে কলাভবনের চত্বরে বসে গল্প করার সময় আমার ঊরুতে টোকা দিয়ে বলেছিল, ‘যে তোমাকে পাবে, সে হবে ভাগ্যবান!’

নুহার ঊরুতে নেহালের টোকা দেওয়ার কথা শুনে চকিতে বদলে গেল অদিতি। ভুলে গেল রিকশাওলা শুনছে সব কথা। নুহার কথা ঠেকানোর চেষ্টা থেমে গেল। দুরু দুরু বুকে তাকিয়ে রইল নুহার মুখের দিকে। একই ধরনের কথা নেহাল বলেছিল ওকেও। এভাবে কি তবে ছেলেরা মেয়েদের দেহের গোপন ভাষা জাগিয়ে তোলে? বের করে আনে গোপনধ্বনি? ইচ্ছামতো তখন কি এভাবেই তারা ব্যবহার করে সেই ভাষা! সেই ধ্বনি! অনভিজ্ঞ অদিতির চোখ খুলে গেল। সে বুঝতে পারল নুহাকে ছেড়ে দেয়নি; নুহার ভেতরের শুদ্ধতা বের করে নিজেকে পূর্ণ করে নিয়েছে নেহাল। বুঝতে পারল, প্রতারণার শিকার হয়েছে নুহা। মমর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের মধ্যে থেকেও আড়ালে নেহাল মণি-মুক্তো খুঁজে বেড়িয়েছে অন্যের মাঝে। এটা কী ধরনের বৈশিষ্ট্য? কেন দৃঢ়তা নেই নেহালের? অনেক মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাই কি তার ভেতর থেকে টেনে বের করে দিয়েছে পুরুষসত্তা? সেই সত্তা কি নিয়ন্ত্রণে নেই নেহালের? এজন্য কি নারী-পুরুষের মেলামেশায় নিয়ন্ত্রণের কথা বলে থাকেন অভিভাবকেরা? নতুন প্রশ্নগুলো অন্তর্জগৎ আলোকিত করতে লাগল। নিজের ভরাডুবির আগেই অদিতি দেখতে পেল, নিজের দেহের আড়ালে লুকিয়ে থাকা শত-সহস্র গোপন ঢেউ। বুঝতে পারল থামিয়ে দিতে হবে ওই ঢেউ।

নুহার হাত চেপে ধরে এবার বলল, থামো। আর কথা বোলো না। বাসায় গিয়ে সব শুনব। সব শুনব বললেও শোনার আগ্রহ থেমে গেল। নুহার ঊরুতে নেহালের টোকা দেওয়ার কথা শুনে পূর্ণ হয়ে গেল অচেনা অজানা কৌতূহল। খুলে পড়ে গেল নেহালের তৈরি মাকড়সা-জাল, রহস্যময়তার খোলস।

অদিতির হাতের চাপ খেয়ে এবার থেমে গেল নুহা।

রিকশা ছুটছে সামনে। পৌষের মাঝামাঝি সময়ে দিনের প্রায় মধ্যভাগেও রোদের দেখা নেই। সূর্যকে আড়াল করেছে গাঢ় কুয়াশা। ঢাকায় শীতের প্রভাব দেশের উত্তরাঞ্চলের চেয়ে তীব্র না হলেও দিনভর আবছায়া আর কনকনে হাওয়ার ঝাপটা কিছুটা হলেও বাধাগ্রস্ত করেছে জীবনযাত্রা।

ফাঁকা রাস্তায় প্রায় উড়ন্ত গতিতে ছুটছে রিকশা। চলমান রিকশার গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটতে পারছে না মনের গতি। জীবন-কুজ্ঝটিকায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে মনের আলো। আবছায়া কি দূর হবে? আবার আলোকিত হবে কি জীবন? প্রশ্ন থাকলেও উত্তর জানা নেই নুহার। গাঢ় শূন্যতা বুকে নিয়ে শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে সামনে।

অদিতির ধরা হাত ছাড়তে চায় না নুহা; বন্ধুত্বের শুদ্ধতা নিয়ে আঁকড়ে ধরে বসে থাকতে চায় পরম নির্ভরতায়। ছিঁড়ে ফেলতে চায় বহুমাত্রিক মাকড়সার জাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *