মারীচ
জয়তী রায়

বৃষ্টির বিরাম নেই। সারাদিন সারারাত ঝরছে। ঝরছে আর ঝরছে। অরণ্য ভিজছে। বনাঞ্চল সহনশীল। মায়ের মত ক্ষমাশীল। কোলের আশ্রয়ে আগলে রাখে সন্তান। বর্ষা এলে পুষ্টি পায় মাটি। মহাকায় বৃক্ষ স্নান করে। ছোট ছোট গুল্ম লতাগুলি উছলে ওঠে খুশিতে। বুনো মানুষের কুটির ভিজে জল জমছে উঠোনে। খলবল খেলে শিশু। ধার ঘেঁষে বহমান নদীতে মাছের দল বংশবৃদ্ধি করে। আরো কত কর্মকান্ড চলে। প্রাণের বৃদ্ধি অরণ্যের কাজ। নিঃশব্দে চলছে বুনন। বীজের সঙ্গে ফলের, পতঙ্গের সঙ্গে ফুলের, মানুষের সঙ্গে মানুষীর। মানুষের ঘরে জন্ম নিয়ে শিশু বড় হচ্ছে ফুল, পাতা, পশু – পাখির সঙ্গে। আহা! মধুর দৃশ্য। মিলন হোক, প্রাণ বৃদ্ধি হোক। ক্রোশ জুড়ে বিরাট বিশাল বনজ সভ্যতার মহিমা ধারণ করে থাকা অরণ্য আজ দুখী। আজ বিষন্ন। আজ রাগী।
কেন ভেজা পাতায় পড়ে থাকে রক্তের দাগ?
পোড়া ছাইয়ের স্তুপে হারিয়ে যায় সুন্দরী লতা?
অহঙ্কারী পায়ের আঘাতে কেঁপে ওঠে ভূমি?
দখলকারী নিষ্ঠুর হাতে কেটে ফেলে গাছ। ভূমি দখলের লড়াইয়ে হত্যা করে একের পর এক। অধিকাংশ অঞ্চল নিয়ে গড়ে উঠেছে বিশাল বিশাল আশ্রম। নামেই আশ্রম। আধুনিক সমস্ত সুযোগ সুবিধার অপর্যাপ্ত ব্যবস্থা। রক্ষণা – বেক্ষণের সমস্ত দায়িত্ব রাষ্ট্রের। পরিবার পরিজন এবং মেধাবী ছাত্রদের নিয়ে ত্রুটিহীন ব্যবস্থা। যজ্ঞ, মন্ত্র পাঠ, অগ্নি আহুতি সেইসঙ্গে নতুন নতুন গবেষণা সৃষ্টির কাজে নিমগ্ন গবেষকদের সুবিধার জন্যে প্রয়োজন ছিল নাগরিক কোলাহল থেকে দূরে প্রকৃতির আশ্রয়। সেই কাজে প্রধান বাধা হয়ে উঠেছিল অরণ্যের আদি বাসিন্দা। রাষ্ট্রের শক্তিশালী শাসকের আক্রমণে ছিন্ন – ভিন্ন জনজাতি কোনো রকমে সরে যেতে যেতে পালাতে পালাতে টিঁকে আছে মাত্র।
জঙ্গলের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে গোদাবরী নদীর শাখা জলধারা। ভরা বর্ষায় তার প্রবল স্রোতের টান উপেক্ষা করে কাঠের ডিঙি নিয়ে চলেছে মারীচ। শক্ত করে ধরে আছে দাঁড়। বলিষ্ঠ পেশী আন্দোলিত হচ্ছে জলের ধাক্কায়। গেরুয়া রঙের ভয়ঙ্কর জল স্রোত হেলায় সরিয়ে খাঁড়ির মুখে নৌকা রেখে লাফ দিয়ে ঘাস জমিতে নামে মারীচ। সতর্ক বনবিড়াল দৃষ্টি দিয়ে চারিদিক দেখে। লম্বা লম্বা ঘাসের আড়াল সরিয়ে এগিয়ে যায় দ্রুত পায়ে। কাদা – জলে মাখামাখি অবস্থায় অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে অবিকল শিয়ালের মত ডাক দেয়। পরপর তিনবার। উত্তরে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসতে থাকে তারই মত কালো কালো যুবক – যুবতী। স্বল্প বস্ত্র আর হাতে তির – ধনুক। নাক চোখ মুখ যেন ছাঁচে ফেলা। প্রত্যেকে গম্ভীর। উৎকণ্ঠিত। বিষন্ন। চকিত। বোঝা যায় ছোট গোষ্ঠীটি পরস্পরের প্রতি জোট বেঁধে আছে এবং মারীচ তাদের দলপতি।
তরুণ – তরুণীর দলটি আসন্ন সন্ধ্যার অন্ধকারের কথা চিন্তা করে। আগুন জ্বালাবে? নদীর পাড়ে ভেজা মাটিতে পুঁতে দেবে মশালের লাঠি।
— না।
মারীচ বারণ করে — না। আড়াল থাকুক আঁধারের।
একটি তরুণী, নাম সুবামা, অবুঝ গলায় বলে — শ্বেতজাতিকে আর ভয় পাই না।
গর্জন ওঠে দলটির ভিতর — ভয় পাই না।
লোমশ নামের একটি তরুণ বলে — রাজকুমারী শূর্পনখার সঙ্গে যে কান্ডটা হয়ে গেল, তারপর রক্ত ঠান্ডা রাখা মুশকিল।
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকা একটি তরুণ নাম চতুর সে বলে — তিনি মহান রাজকুমারী। এই অরণ্যে তিনি বাস করতেন একাকী। সদ্য স্বামীহারা, প্রকৃতির আশ্রয়ে আপন গোষ্ঠীর লোকেদের সঙ্গে মিলে মিশে আনন্দে থাকতেন।
— গান গাইতেন।
— ফুলের গয়নায় সেজে থাকতেন অপরূপা।
— সুস্বাদু সুপক্ব মাংস ভোজ দিতেন।
— তিনি উৎসব আনন্দ আর সৌন্দর্যে বিশ্বাসী ছিলেন।
—- সরলা সেই রাজকুমারী যিনি প্রেম কামনা করতেন।
— শ্বেতরাজপুত্রদের নিবেদন করেছিলেন প্রেম।
— বিনিময়ে পেয়েছিলেন উপহাস।
— নাক – কান কেটে ছুঁড়ে ফেলে দেয় অযোধ্যা রাজপুত্র রাম – লক্ষণ।
— এই ভূখন্ড রাজকুমারীর। লঙ্কার রাজা আমাদের রাজা।
চাপা গর্জন ওঠে — লঙ্কার রাজা আমাদের রাজা।
মুঠো হাত, বেঁকে যাওয়া শক্ত শরীর, ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, গাঢ় কালো রঙের গোল মুখের উপর চ্যাপ্টা নাক, জোড়া ঘন ভুরুর তলায় কালো চোখের তারার পাশে সাদাটে জমিতে জলের আভা। পুরু মোটা মোটা ঠোঁটে দুরন্ত অভিমান নিয়ে কুড়িজনের দল স্বাধীনতা চায়। ফিরে পেতে চায় অরণ্যের অধিকার।
কত ছোট থেকে কানে ডেসে আসে অসহায় মানুষের গর্জন। কান্নার মত গর্জন। ঠিক যেন জালে আটকে যাওয়া মাছ অথবা পাখি। একফোঁটা জল অথবা একটুকরো আকাশের জন্যে হাহাকার। জন্মেছে যখন ধরিত্তিরের কাছে পাওনা কিছু থাকে। সেটুকু কেড়ে নেবে শক্তিশালী?
একমুঠি মাটি দেবে না?
এক ছটাক জল দেবে না?
শূদ্রের ছায়া পড়লে অপরাধ?
মেয়েদের ইজ্জত নেবে?
দাস কেন? অচ্ছুত কেন? ভূমি তাদের নয় কেন?
কালো মাথাগুলি নড়ে নড়ে বলে — ইঁদুরের মত পালিয়ে বেড়ানো সম্ভব নয়। হঠাৎ আক্রমণ করতে পারি? পারি না? যেমন তোমার মা মহান যোদ্ধা তাড়কা করতেন? কাপুরুষের মত জীবনযাপন করা ঘেন্নার। ঘেন্নার।
মারীচ হাত তুলে স্থির থাকতে আদেশ করে। তার মাথা ঠান্ডা। লকলক প্রতিশোধ স্পৃহা ভিতরে দমিয়ে রেখেছে আটবছর বয়েস থেকে। মা তাড়কার শহীদ হওয়ার খবর পৌঁছে ছিল রাবণরাজের কাছে। সেইসময় আসে দূত। আদর করে বলে — সময় হলে বিমানে করে নিয়ে যাওয়া হবে লঙ্কারাজ্যে।
পনেরো বছরে পৌঁছলে সময় এল। সেই প্রথম দেখা রাবণের সঙ্গে। সোনার তৈরি প্রাসাদ থেকে ভেসে আসছে সুমধুর সঙ্গীত। নগরীর চারিদিকে ছড়িয়ে আছে সুখ আর ঐশ্বর্য। রাজসভায় আদর হয়েছিল। রাবণের কোলের কাছে এসে অবাক বালক বলেছিল — তোমার কথা বলেছিল মা।
পরম স্নেহে রাবণ বলেছিল — তোমার মায়ের জন্যে আমি গর্বিত।
শুনে কেঁদে ফেলেছিল মারীচ। মায়ের হত্যার নির্মম দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠতে সে আর স্থির থাকতে পারে না।
রাবণ বলেছিলেন — কান্না নয়। শোধ তুলবে অপমানের। কিছুদিন প্রশিক্ষণ চলুক। দেহ – মন ধাপে ধাপে তৈরি হোক। তারপর … ।
মারীচ ফিরে এসেছিল ততদিনে ঘটে গেছে অনেক ঘটনা। তাড়কা হত্যার পরে জঙ্গল দখল করে নিয়েছিল শ্বেতজাত। কিন্তু, দক্ষিণ দিকে তখনো প্রবল প্রতাপে বাস করছে রাবণের দুই সুদক্ষ সেনাপতি খর ও দূষণ। সেখানেই প্রমোদ ভবনে থাকতে এসেছিল রাবণের একমাত্র বোন শূর্পনখা।
রাবণ রাজের অধিকারে ছিল দণ্ডকারন্য ভূখন্ড। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বৃক্ষের সমাহার। গোদাবরী নদীর জলধারায় পুষ্ট শাখা নদী, ওষধি বৃক্ষ, লতা পাতা, পশু – পাখি, মধু সেইসঙ্গে অফুরন্ত জল ভান্ডারে মৎস চাষ — অঞ্চলটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভরপুর। অরণ্যের মধ্যে আছে পঞ্চবটী। । পাঁচটি প্রাচীন বটগাছ ঘেরা জায়গাটা শান্ত সুন্দর। ঋষিদের নজর পড়ে। স্থানটির অধিকার নেওয়া সহজ হয়ে উঠছিল না বনচর জাতির দাপটের জন্যে। প্রবল বাধা দিলেও একসময় পরাজিত হতে বাধ্য হয়ে সরে যেতে থাকে ভিতরের দিকে। দক্ষিণ দিকে। তারপর ঘটল জঘন্য মর্মান্তিক কান্ড! অযোধ্যা থেকে নির্বাসিত হয়ে এসেছিল — আর্য রাজপুত্র রাম – লক্ষণ। শূর্পনখা নিগ্রহ করে — জঙ্গল জুড়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
রাজা রাবণের টনক নড়েছে।
শূর্পনখার অপমানে রেগে আগুন হয়েছেন।
কে রাম কে বা লক্ষণ জানতে চেয়েছেন।
এতদিন পরে তিনি পাশে এসেছেন। বুনো জাতের দুঃখের কথা শুনতে চেয়েছেন।
রাবণ রাজা দেখা করেছেন মারীচের সঙ্গে। সমুদ্রবেষ্টিত দ্বীপ গোকর্ণে। রাবণ বুদ্ধিমান। সাগর পাড়ি দিয়ে যুদ্ধ করা সম্ভব নয়। অপমানের আগুন নেভাবেন অপমান দিয়ে — কেমন হবে সে অপমান?
রাবণ তাকিয়ে থাকেন। দৃষ্টি যেন ডুবুরি। ডুব দিয়ে তুলে আনে অজানা তথ্য — মারীচ, হরবোলা।
মারীচ জানে মায়াবিদ্যা। মারীচ যুব নেতা।
রাবণের দৃষ্টি যেন অজগর সাপ। জড়িয়ে ধরে পাকে পাকে। রাবণ যদি জয়ী হয় বেঁচে যাবে অরণ্য। ফিরে আসবে সুখের দিন। রাবণ মন্ত্রণা দেন। কাজটি শুনে চমকে ওঠে। পছন্দ হয় কি না, ভালো লাগে কি না, অন্য উপায় আছে কি না — প্রশ্ন করার সাহস নেই। সামনে রাবণ। রাবণ গোষ্ঠীপতি। রাবণের আদেশ শিরোধার্য।
দিনকতক অপেক্ষা। তারপর … আসবে সুদিন। রাম – লক্ষণ না থাকলে বুনো জাতের আর ভয় কিসের? রাম শ্বেতজাতির প্রধান নেতা। আগুন অস্ত্র নিয়ে চলে। রেহাই থাকে না। পালানো যায় না। রাম অরণ্যে থাকলে বুনো জাতের মঙ্গল হবে না।
মারীচ ছোট খাটো চেহারার শশককে ডেকে বলে — চব্বিশ ঘন্টা পাহারায় আছে লক্ষণ। সামান্য পাতার আওয়াজ পেলেই লক্ষণ চালিয়ে দেয় বাণ। শশক, তুমি গিরগিটির মত রূপ বদলে ভেজা পাতার উপরে পাতা হয়ে শুয়ে নজর রাখবে প্রতিদিন। প্রতি সন্ধ্যায় আমরা মিলিত হব এই গোপন ডেরায়।
কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে, তারপর … বলব কাজের কথা।
ঘন অন্ধকারে মুখ দেখা যায় না। মারীচ চুপচাপ। বাকিরাও কথা বলছে না। আজ চাঁদ ওঠেনি। অমাবস্যা হলেই গোপন সভা অনুষ্ঠিত হয়। লঙ্কাপুরীর ঐশ্বর্য নিয়ে কোলাহল করছিল অবোধ ছেলে মেয়েগুলো। ধনী দেশে বিষাদ ছড়িয়ে ছিল। শূর্পনখা একলা বসে থাকে। কথা বলে না। শল্যচিকিৎসা করবে না। ছিন্ন নাক আর কান নিয়ে নিজের মহলে বসে থাকে। মহাবিলাসী ছিলেন রাজকুমারী, সাগর ছেঁচে দুর্লভ কালোমুক্তোর গয়নায় সাজতেন, ফিনফিনে রেশমের বস্ত্র নানা রঙের। একশত দাসী নিয়মিত পরিচর্যা করে চলত। দীর্ঘাঙ্গী রূপসী রাজকন্যার অকাল বৈধব্য ভুলিয়ে দিয়ে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়ে ছিলেন ভ্রাতা রাবণ। আজ সে শুকনো ডালের মত পড়ে আছে। রাজকন্যার এই অবস্থার জন্য স্বর্ণলঙ্কা জুড়ে ছমছম করছে বিষাদ আর হতাশা। রাবণ কাঁদেন। সমুদ্রের তীরে একলা বসে বীণা বাজাতে বাজাতে কাঁদেন। সেই রাবণ — তিনভুবন কাঁপে যাঁর দাপটে, সেই রাবণ হাত ধরেছিল মারীচের। তাকিয়ে ছিলেন। অস্ফুটে বলেছিলেন — পারবে?
মারীচ গল্প করে। কুম্ভকর্ণ মহাবীর। মেঘনাদ — মেঘের আড়ালে থেকে যুদ্ধ করে। একদিন ওঁরা আসবে। জয় করবে ভারতভূমি। তখন কেউ রাক্ষস বলবে না। ঘেন্না করবে না। কেউ ছুঁড়ে ফেলে দেবে না সাগরের জলে।
—- কে করেছিল এমন কাজ? দলপতি মারীচ? কে ছুঁড়ে ফেলেছিল তোমায় সাগরের জলে?
ধকধক করে চোখ। পেটে অন্ন নেই। সকাল থেকে খাদ্য সংগ্রহে কেটে যায় অনেকটা সময়। ফল, মধু, মাটির নিচের কন্দ এমনকি পশু মাংসে টান পড়েছে। জ্বালানির কাঠ কমে আসছে। গ্রামে আছে বয়স্ক পুরুষ, বৃদ্ধা, শিশু। খাদ্য জোগাড়ের জন্যে নিজের অরণ্যে লুঠ চালাতে হয়। আশ্রম আক্রমণ করতে হয়। সেই অপরাধে শাস্তি পায়। অনার্য – রাক্ষস সম্বোধন করে গালি দিতে দিতে ঋষি খবর পাঠায় রামচন্দ্রের কাছে। তিনি মারীচের দিকে শান্ত ভাবে তাকিয়ে হুঁশিয়ার করেছিলেন — তুমি মাতৃহারা। প্রাণে মারব না তোমায়। সাগরে চুবিয়ে রাখব কিছুক্ষণ।
সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বলে মারীচ — ওঁরা বোঝে না আমাদের অপমান ঠিক কোথায়? নিজের ভূমি থেকে উপড়ে ফেলা হচ্ছে আর ধর্ম উপদেশ শুনব? ভুলভাল প্রচার চলছে। আমি নাকি রামের অনুগত হয়ে পড়েছি?
করুক ভুল প্রচার। লিখুক ভুল ইতিহাস। আমি প্রতিশোধ নেওয়ার পরে বুঝবে।
তৃষিরা নামের যুবতী বলে — আজ আশ্রমে গিয়েছিলাম গাভী চুরি করতে। শুনে এলাম আলোচনা। আপনি নাকি ঋষির মত হয়ে গেছেন। রাজা রাবণকে ঘৃণা করে শ্বেত – জাতির সঙ্গে থাকতে চান!
সতর্ক হাসে — ভয় পাচ্ছে। আমাদের ভয় পাচ্ছে। তাই অপপ্রচার করছে। দলপতি উপেক্ষা করছে রাবণ রাজাকে — এর চাইতে হাস্যকর আর কি আছে? আচ্ছা, একটা কথা বলো, তোমায় গোপন কাজটি দিলেন কি রাজা রাবণ?
কাজ এমন গোপন কেন?
রাম জব্দ হবে তো?
সুখ আমাদের আসবে তো? ও তাড়কা কুমার, সুখ আমাদের আসবে তো?
২
রামচন্দ্রের উপর ঋষিদের কড়া অনুশাসন আছে। রঘুবংশের প্রথম পুত্রটি গুণ মানে সকলের সেরা এইটি প্রমাণ করার অপেক্ষা রাখেনা। রাম যোগ্যতম। আর্যাবর্তের আগামী নায়ক তিনি এই ব্যাপারে ঋষিদের দ্বিমত নেই। রামচন্দ্রের প্রধান গুণ নিঃশর্ত আনুগত্য। তিনি প্রশ্ন করেন না। যজ্ঞ রক্ষক হিসেবে নির্বিচারে রাক্ষস বধ করতে তাঁর তুলনা নেই। রাক্ষস জাত মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। কিছুতেই সরে যায় না। রামের বাণ কাউকে রেহাই দেয় না। একটা সময়ে কিন্তু কথা শুনল না রাম। মারীচ বধ করতে অনুরোধ করেছিলেন স্বয়ং বিশ্বামিত্র, রামচন্দ্রের মনের ভিতর স্পষ্ট হয়ে উঠল দোলাচল। তিনি শাস্তি দিলেন কিন্তু প্রাণে মারলেন না। ওই ঘটনার চোদ্দবছর পরে রাম এসেছেন বনবাসে, লক্ষণ আছে, সীতা আছে আর সেইসঙ্গে দেখছেন রাক্ষসদের প্রতিপত্তি বেড়ে গেছে। ভয় কমে গেছে। অতর্কিত আক্রমণে ছিনিয়ে নিচ্ছে আশ্রম সম্পদ। দুগ্ধবতী গাভী, তৈজসপত্র। রাম শুনছেন, এঁদের নেতৃত্ব দিচ্ছে মারীচ। ঋষি বিশ্বামিত্র সামান্য অনুযোগের সুরেই বললেন — মারীচ হত্যা প্রয়োজনীয় ছিল বৎস। আতঙ্ক সৃষ্টি করছে ক্রমাগত। রাক্ষস হত্যা করলে না কেন? বুঝলাম না?
রাম চুপ করে রইলেন। কিছু কিছু সময় সহ্য হয় না আনুগত্য। পঞ্চবটী অঞ্চল থেকে বুনো মানুষদের অপসারণের দায়িত্বে ছিলেন ঋষি বিশ্বামিত্র। একটাই নির্দেশ ছিল তাঁর — হত্যা করো। তিনি আবার ডেকে পাঠালেন। আবার আদেশ করা হল মারীচ হত্যার। ভালো লাগেনি রামের। ইচ্ছে করেই হত্যা করেননি।
এখন শুনছেন, সেই ছেলে আরো দামাল হয়েছে। রামচন্দ্র ঠিক করলেন, দেখা করবেন মারীচের সঙ্গে।
আশ্রমের লোক অবাক হয়ে গেল। মারীচ? সে ভয়ঙ্কর রাক্ষস দস্যু। গতকাল গাভী চুরি করল। বস্ত্র, মশলা, চাল … জ্বালিয়ে মারছে। আপনি কেন দেখা করবেন?
রাম উদাস। বর্ষার ঋতু শেষ হয়ে কেটে গেল শরৎ। এখন হেমন্ত। অরণ্য বাসের কেটে গেল অনেকগুলি বছর। রাজপুরী ছেড়ে এলেও চিন্তা ছাড়ছে না। ঝামেলা বন্ধ হচ্ছে না। আশ্রমবাসী শিষ্য বলে উঠল — অমাবস্যা হলেই আক্রমণ করে ওই রাক্ষস। গাল ভরা নাম দিয়েছে নিজেদের দলের। মুক্তিযোদ্ধা! আপনি চরম শাস্তি দিয়ে আমাদের রাক্ষস – মুক্ত জীবন দান করুন হে মহাবীর রাম। আমরা আপনার শরণাগত।
অমাবস্যা? আর তিন দিন পরেই অমাবস্যা। ঠিক আছে, দেখা যাক। শিষ্য কাকুতি মিনতি করছে। ভয় পাচ্ছে। এত ভয় পাওয়ার কারণ কী? রাষ্ট্র থেকে প্রহরার ব্যবস্থা করেছে। অস্ত্র আছে আশ্রমে। রাম রাগত সুরে বললেন — আপনারা কেউ নিরীহ তপস্বী নন। অস্ত্র ধরতে জানেন ভালোই। পাথর দিয়ে কতক্ষণ লড়বে দরিদ্র আদিবাসী?
শিষ্য উত্তেজিত হয়ে বলে — নীচ জাতির রাগ বেশি। হঠাৎ আক্রমণ করছে। টের পাওয়ার আগেই তছনছ করে দিচ্ছে।
রাম বললেন — ওদের দেশ। হাতের তালুর মত চেনে সবকিছু। রাগ? বর্ণ সংকর আজ সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতি ভেদ প্রথার জন্যে ভিতরে জন্মানো ক্ষোভ হয়ত ক্রোধের রূপ নিচ্ছে দিনে দিনে।
শিষ্য একটু থেমে অবাক স্বরে বলে — আপনি বলছেন এই ধরণের কথা? হে রাম, আপনিই ভরসা। উচ্চবর্ণের প্রতিভূ।
রামের হাসিতে বিষন্নতা খেলে — প্রতিভূ অর্থ এই নয় যে নিজের চিন্তা ভাবনা বিসর্জন দিয়ে দেবে?
শিষ্য আবার উত্তেজিত হয়ে বলে — রাক্ষসী শূর্পনখা শাস্তি পেল আপনার হাতে। আজ হঠাৎ বিরোধী পক্ষের হয়ে কথা বলছেন কেন?
মাথা নাড়লেন রাম — রাজা হতে হবে না তোমায় কোনোদিন তাই দোলাচল ব্যাপারটা বুঝবে না।
৩
ভাঁড়ারে টান পড়েছে। আশ্রম আক্রমণ না করলে উপায় নেই। পেটে খিদে থাকলে লড়াই হয় না। রাবণ এখানে এসে যাবেন। গ্রামে খাবার নেই। ভান্ডার ভরা থাকুক। মারীচ নিশ্চিন্ত হয়। আকাশ – মাটি জুড়ে থৈ থৈ অন্ধকার। অসুবিধা নেই। পথ ঘাট চেনা। রাতের বেলা অনায়াসে দেখতে পায়। দুজন সহ যোদ্ধা। ঠিক সময়ে এসে পৌঁছে গেল আশ্রমের পিছন দিকে। ঝুপ করে হাল্কা শব্দ। তিনজনে নেমেছে একসঙ্গে। উল্লাস ঝিকিয়ে উঠছে আঁধারে। আশ্রমের ভাঁড়ার সবসময় পূর্ণ। পরপর ভেসে ওঠে অনাহারী মুখ। অপুষ্টি থেকে আসছে ব্যাধি। কষ্ট করে চালাতে হয়। কৃষিকাজ জানে আর্য। তারা জানে না। তাদের ভরসা ছিল নদীর মাছ আর অরণ্যের পশু। মধু। নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে সে কাজ প্রায় বন্ধের মুখে। কাজেই লুঠ করা ছাড়া উপায় নেই। ভাবনা ছেড়ে সতর্ক হল মারীচ। কেউ দেখছে? কে? ভাবতে ভাবতেই ছুটে এল তির। একসঙ্গে পড়ে গেল দুই সঙ্গী। শব্দটুকু এল না। গাছের পাতা খসার মত পড়ে গেল দুটি তাজা প্রাণ। চকিতে নিজেকে সরিয়ে নিতে গিয়ে কোমরে গোঁজা ধারাল কুঠার বার করতে গিয়ে ব্যর্থ হাত মুচড়ে ধরে কেউ। কঠিন পেষণ থেকে ঝটকা দিয়ে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টায় অপারগ মারীচ দেখে সামনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘকায় পুরুষ। নিকষ আঁধার তবু ভুল হয়না চন্দন সৌরভ — রামচন্দ্র? কি যেন হয় ভিতরটায়, পুড়ে যায় জ্বলে যায় আবার দুলে ওঠে। একসঙ্গে এত ঘৃণা আর এত ভালবাসা কি করে সম্ভব? ঘৃণা করো ঘৃণা করো যতবার বলেছে নিজেকে ততবার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে করুণা ভালবাসা স্নেহে ভরা দুটি শান্ত চোখ। আলোময় হাসি। চরম শত্রুর প্রতি এমন মনোভাব কেন হয় জানে না মারীচ। আজকেও সেই পুরুষ ফিসফিস করে বলে — পালাও। মেরে ফেলবে তোমায়। লক্ষণ আসছে। পালাও।
সক্রোধে মারীচ বলে —- কেন রক্ষা করছেন বারবার আমাকে? কেন?
রাম মাথা নাড়ে — জানি না। হয়ত তুমি আমার সেই রূপ যা আমি হতে চেয়েছি। আমি হয়ত চাইনি অশান্ত রাজনীতি। বর্ণভেদ চাইনি। কিন্তু, তোমার মত প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারিনি। বিস্মিত মারীচ বলে —- আপনি … এমন মহান হয়েও … কেন অনার্য হত্যা করেন? নিঝুম চরাচর। মনে হয় যেন একযুগ পরে উত্তর দেয় রাম — এই আমার নিয়তি।
৪
রাবণ এসেছেন। যাঁর আগমনে কেঁপে ওঠার কথা দশদিক তিনি এসেছেন সঙ্গোপনে। দেখা হয়েছে মারীচের সঙ্গে।
ছোট জনগোষ্ঠীর লোকেরা ঘিরে আছে দশাননকে। রাবণ বলে চলেছেন — শ্বেতজাতির সভ্যতা আমাদের সঙ্গে সদ্ভাব করে থাকবে না। দখলদারি মানব না।
স্লোগান ওঠে — মানব না। মানব না।
— যুদ্ধ হবে।
— যুদ্ধ হোক। যুদ্ধ হোক।
অভুক্ত পেট, অপমানিত চোখ ঝিকঝিক করে। দশানন দশানন। রক্ষা করো দশানন।
অভয় মুদ্রা তুলে রাবণ বলে — তার আগে একটা কাজ। নিতে হবে ভগিনীর অপমানের শোধ। হরণ করব রামের পত্নী। নির্জন চারিদিক। বাতাসের শনশন শব্দ ফালা ফালা করে দিচ্ছে দুপুরের নদীতট। রামের পত্নী হরণ? কেমন ধারা কথা? পরস্ত্রী হরণ? বুনোজাত এমন কাজ করে না। তাদের সোজা সাপটা জীবন। তাদের গাছের মত যাপন। তাদের চতুরতাহীন ভাবনা।
রাবণ রাজা রাবণ রাজা –রাজার কি বা শান! কি বা মান! রাজা যুদ্ধ করুন। স্ত্রী – হরণ? ছিঃ ছিঃ।
মৌন মুখের প্রশ্ন বুঝেই রাবণ বিশদে গেলেন — কি বলো মারীচ? আগেই বলেছিলাম? বলিনি?
বলেছিলেন। আগেই বলেছিলেন। তখন যেটা ঠিক মনে হয়েছিল আজ আশ্চর্য ভাবে পরিবর্তন ঘটেছে ভাবনার গতিপথের, সে কথা বলা যায় না বোধকরি? সীতা হরণ কাজটাকেই সমর্থন করতে পারছে না। সীতা কোনো দোষে দোষী নয়। তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন শূর্পনখা নিগ্রহের সময়। সীতা চুপি চুপি খাবার দেয় বুনো শিশুদের। লক্ষণ কাছে না থাকলে আকারে ইঙ্গিতে কথা বলেন মেয়েদের সঙ্গে। অপরূপা দেবীকে দেখলে মনে হয় তিনি যেন অরণ্যের কন্যা। চোখদুটি মায়ায় ভরা। মারীচ অস্বীকার করবে না পরিবর্তন হয়েছে তাঁর মধ্যে। একটা সভ্যতা আরেকটা সভ্যতাকে গ্রাস করছে। রক্তাক্ত পথ বেয়ে এগিয়ে আসছে আর্য সভ্যতা। রাষ্ট্রের বিকাশ রোধ করতে হলে হোক যুদ্ধ। আদেশ করুন রাজা রাবণ। রাবণের যুদ্ধের ভান্ডার আর্যদের থেকেও উন্নত। আছে আধুনিক মারণাস্ত্র, সুদক্ষ সেনা — ঘিরে ফেলা হোক অরণ্য। উদ্ধার হোক ভূমি। ভূমিপুত্র ফিরে পাক পূর্বপুরুষের অপহৃত ভূখন্ড। অপমানিত শূর্পনখা শান্তি পাবেন যদি শাস্তি পায় রাম লক্ষণ। সীতা কেন? না না না।
রাবণ বুদ্ধিমান। মারীচের অন্তর্জগতের পরিবর্তন দৃষ্টি এড়ায়নি। সাগর অতিক্রম করে যুদ্ধ করার মত উৎসাহ এখুনি নেই রাবণের। আর্য সভ্যতা সংস্কৃতি প্রভাব ফেলতে পারবে না তাঁর দেশে এই ব্যাপারে তিনি নিশ্চিন্ত। শাস্তি নয় ,ক্ষুদ্র মানুষকে তিনি অপমান করতে চান। শাস্তির রকম আছে অনেক। রাজ্য কেড়ে নিয়ে ভিখিরি করে দাও, গলাটা কেটে নাও কুচ করে, জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও। সেগুলো নিতান্ত শাস্তি মাত্র। অপমান নয়। রাবণের পরিবারকে স্পর্শ করার, উপহাস করার সাহস দেখায়। অপমানের আগুনে তাঁর জীবনটাই ছারখার করে না দিলে ঘুম আসবে না। শূর্পনখা বলেছিল — দাদা, সীতা সাধারণ নন। তোমার অন্তঃপুরে কেউ নেই সীতার মত। দাদা গো, তিনি রূপের চেয়েও রূপবতী, গুণের চেয়েও গুণবতী, তিনি স্বয়ং আনন্দময়ী। যদি গ্রহণ করেন তোমায় স্বর্ণলঙ্কা ধন্য হবে। আরো বড় কথা, আর্যাবর্তের মুখে ঝামা ঘসে দেওয়ার এর চেয়ে ভালো উপায় আর কিছু নেই। পরিকল্পনা ঠিকঠাক। এখন মারীচ ন্যায় দেখাচ্ছে? তাঁর মায়ের হত্যাকারীর স্বপক্ষে কথা বলছে? বশীকরণ জানে না কি ভিখিরী রাঘব?
৫
কুটিরের চারিদিকে ঘুরে বেড়ান এক সন্ন্যাসী। সীতা দেখতে পায়। রাম – লক্ষণ দেখেনি। রাম বলে — কেমন দেখতে?
ফল ছাড়িয়ে পদ্মপাতায় রাখতে রাখতে উত্তর দেয় সীতা — গেরুয়া কাপড় দেখলাম যেন। চেহারা? নাহ্। দেখিনি। সে যা হোক, সন্ন্যাসী যখন, ভয়ের কিছু নেই।
রামের কপাল কুঁচকে রইল। সীতা দেখল, স্বামী আর দেবর দুজনেই গম্ভীর। সে তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে ফেলে বলে — চারিদিকের শোভা বড় সুন্দর। আরে, কেমন নিঃসঙ্কোচে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটি হরিণ শিশু। দুপুরের রোদ্দুরে আলো ঝলক দিচ্ছে। যেন সোনার তৈরি।
রাম তাকালেন। হরিণ যেন অপেক্ষায় ছিল। এক পাক নেচে নিয়ে কালো গভীর চোখ দুটি তুলে তাকাল। দৃষ্টি ভীষন চেনা। কোথাও দেখেছেন? কোথায়? রাম স্মৃতি হাতড়ে চলেছেন, হরিণ ওদিকে নানারকম অঙ্গভঙ্গি করছে। কুটকুট চাইছে। সীতা আকুল হয়ে উঠল। হরিণের চোখে অদ্ভুত মায়া। সম্মোহনের দৃষ্টি। সীতা তাকিয়ে রইল। ওই হরিণ চাই।
ও সীতা, কেন চাও? সোনার হরিণ কেন চাও? ও সীতা, ভুলে যাও।
সীতা যেন অন্য সীতা। চোখ দপদপ। মুখ খরখর। জেদে থরথর। রামের মধ্যেও জেগে উঠল একই আকুলতা — চাই ওই হরিণ। লক্ষণ সামাল দেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলছে — দাদা, মায়াবী মারীচ নয়ত? রূপ বদলে করে এসেছে? রাক্ষসী পুত্র ভয়ঙ্কর হিংস্র শুধু নয় জাদু জানে। মাথা ঠান্ডা করে ভাবুন দাদা, হরিণ এইরকম স্বর্ণবর্ণের হয় না।
রাম দেখছেন। কুটির ঘিরে রেণু রেণু সোনালি আলো। মায়াময় শোভায় নেচে বেড়ায় সোনালি হরিণ। বঞ্চিত ভূমিপুত্র মারীচের কত গুণ। বাস্তব থেকে সরিয়ে পৌঁছে দিতে পারে সুন্দর দুনিয়ায়। সরে যায় ছলনা, অসুন্দর দূরে যায়, রাজনীতির কুটিল ছায়া মনে থাকে না। পিতার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করার জন্যে সিংহাসন থেকে নির্বাসিত হওয়ার পিছনে কিচ্ছু যুক্তি ছিল না। কুটিল কঠিন বীভৎস চক্রান্তের শিকার হয়ে তিনি অবাক হয়েছিলেন। এটা কী হল? আচমকা বজ্রঘাতের মত আঘাত সহন করে দেখাতে হয়েছিল হাসিমুখ। মেনে নিতে হয়েছিল ভরতের রাজ্যলাভ। ভরতের করুণা। করুণা বইকি! সিংহাসন পেয়েও নিলাম না দাদা — এটা নয় করুণা? হায় হায় শুনতে শুনতে অযোধ্যার সীমানা ছাড়ছেন — করুণা করছিল প্রজারা।
নাহ্। রাম নন ঈশ্বর। সুখ – দুঃখ – অপমানের জ্বালা সহন করে চলতে চলতে নিজেকেও মনে হয় বঞ্চিত। আজ কিচ্ছু মনে পড়ছে না। উজ্জ্বল সোনালী মায়া তীব্র আকর্ষণ করছে। তিনি যাবেন। ওই মায়ার কাছে আনন্দের কাছে যাবেন। ছুটছেন রাম। অন্ধ আবেগের তাড়নায় ছুটতে ছুটতে পিছন না ফিরেই বললেন — সীতাকে দেখো লক্ষণ।
সীতাকে দেখবে না কি এক অচেনা নারীকে দেখবে? কুটিরের দুয়ারে হেলান দিয়ে মৃদু মৃদু হাসছে। ও কে? দৃষ্টিতে ঘোর, খোলা চুল, পান পাতা মুখখানি অপরূপ সুখে মধুর। সোনার হরিণ আসছে আসছে। ভাবের নদীতে খেলে বেড়াচ্ছে সীতার সচেতন মন। সময়টাকেই মুঠিতে নিয়ে নিয়েছে কেউ। সুতো দুলিয়ে চলেছে আর ওঁরা তালে তালে অনুসরণ করছে। রাগে দুঃখে মাথা ঠুকতে ইচ্ছে করছে লক্ষণের। সীতার পায়ে উপুড় হয়ে বলতে ইচ্ছে করছে — ফিরে আসুন দেবী। বাস্তবে ফিরে আসুন।
ভাবতে ভাবতে শুনতে পেল আর্ত চিৎকার — লক্ষণ। বাঁচাও। লক্ষণ বাঁচাও।
শুনতে পেল কিন্তু শুনল না। ধারণা এইবার পরিনত হয়েছে বিশ্বাসে। মায়া বা জাদু ছাড়া আর কিছু নয়। রাম সাহায্য চাইবে? এমন অসম্ভব ধারণা আর যেই করুক লক্ষণ করবে না। বিপদের গন্ধ পেয়ে সতর্ক চকিত লক্ষণ টানটান উত্তেজনা নিয়ে তৈরি থাকল অস্ত্র নিয়ে। কেউ আছে। কেউ লক্ষ্য করছে। কে সে? লক্ষণ জানে না, এইটুকু জানে যেটা ঘটছে সেটা স্বাভাবিক নয়। ওই যে সীতা উঠে দাঁড়িয়েছে, খর চোখে চাইছে, কর্কশ গলায় আদেশ করছে — যাও। দাদা বিপদে পড়েছে। এখুনি যাও।
লক্ষণ আকুল হয়ে বলছে — দেবী, দাদাকে বিপদে ফেলার ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়নি কেউ। শুনতে পাচ্ছেন? মায়াবী হাসছে? অপেক্ষা করছে কখন আমি যাব। এমন আদেশ করবেন না দেবী। দয়া করুন।
সীতার তীব্র তিরস্কার আছড়ে পড়ল চারিদিকে — চতুর, স্বার্থপর, কুটিল। ভাই নামের অযোগ্য। দাদার প্রাণ চলে যাচ্ছে আর উনি জ্ঞান দিচ্ছেন? তুমি যাবে না? আমি যাচ্ছি। যেতে হবে না তোমায়। সীতা ছুটছে। লক্ষণ লাফ দিয়ে সামনে এসে বলল — যাচ্ছি। আমি যাচ্ছি। শান্ত হয়ে বসুন। একটা কথা দিন, একটাই কথা শুনতে হবে আপনাকে, যে কেউ ডাকুক, দরজা খুলবেন না। আমরাও যদি ডাকি, খুলবেন না। কুটির খোলার কৌশল জানি। অসুবিধা নেই।
সীতা কাঁদেন না। অকারণ ছেলেমানুষী নেই স্বভাবে। অথচ, এখন কাঁদছেন! হতাশ লক্ষণ মাথা নেড়ে কুটিরের বাইরে পা রাখে। আড়ালে কেউ আছে কী? গেরুয়া কাপড় ঢাকা বলশালী হাত? লাভ নেই ভেবে। যেতে তাঁকে হবেই।
৬
যন্ত্রণা ছাপিয়ে মারীচের মুখে ফুটে উঠেছে হাসি। সামনে বসে আছেন রাম। এসে গেছে লক্ষণ। কালান্তক বাণ ফুঁড়ে দিয়েছে হৃদপিন্ড। তিরিশ বছরের যুবক শরীর নিয়ে মৃত্যুর কাছে যেতে যেতে মারীচ হাঁফাতে হাঁফাতে বলে — রাষ্ট্র ব্যবস্থার শিকার আমরা। রাবণ আমাদের গোষ্ঠিপতি। তাঁর আদেশ মেনে শেষ কাজটা করে দিলাম। কিন্তু রাম বা রাবণ বাঁচতে কেউ দেবে না! আপনি কুটিরে ফিরে যান। সর্বনাশ হয়ে গেল।
সীতা হরণের ব্যাপারটা ভূমিকম্পের মত চুরমার করে দিল আর্যসভ্যতার সমস্ত পরিকল্পনা। প্রধান নায়ক রামের ব্যক্তিগত জীবন দাঁড়িয়ে পড়ল প্রশ্নচিহ্নের মুখে। এরপর আর কোনোদিন সংসার সুখ পেলেন না রামচন্দ্র। নদীর জলে আত্মহত্যা করে নিজের জ্বালা জুড়িয়েছিলেন একাকী রাম। শাস্ত্রের বিচারে অস্পৃশ্য শূদ্র আতঙ্কবাদী মারীচের কারণে শুরু হয়ে গেল আগামী মহাযুদ্ধের প্রস্তুতি। সেই যে শুরু হয়ে গেল সোনার হরিণের খোঁজে যুদ্ধ, অবিশ্বাস, পারস্পরিক দোষারোপ আর সবশেষে মৃত্যু — এখনো তার থেকে মুক্ত নই আমরা।