short-story-masud-mintu-joynal

মাসুদ, মিন্টু, জয়নাল ও অন্যান্য
কামরুল হাসান বাদল


‘আমারে অহনও ভাত দিতাছস না ক্যান? রাইত কত হইছে তোগো খেয়াল নাই। ফাজিলের ফাজিল দিনরাইত খালি মোবাইল চালাস।’

দুলালী বুঝতে পারে মাসুদ কাকে ইঙ্গিত করে কথাটা বলেছে। দুলালী মোবাইলে রিল দেখছিল। মাসুদের কথায় মোবাইল থেকে মাথা তুলে বলে, ‘এ্যাই মাসুইদ্দা বেশি কথা কস ক্যান? তোর বাপের ট্যাহা দিয়া মোবাইল চালাইতেছি নাকি, রে? চুপ কইরা পইড়া থাক।’

বাপের ট্যাহা অইবো ক্যান? আমার ট্যাহা দিয়া তোগো খাওন-পরন হয়। মোবাইলও চালাইতাছস আমার ট্যাহায়।’ মাসুদও কম যায় না।

‘বেশি কথা কইলে শালার পুত এক ফোঁঢা পানিও খাইতে দিমু না।’
দুলালীর গলা আরও উঁচুতে উঠে যায়। মোবাইলটা বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে, ‘আমি বাইরে গেলাম আইজ রাইতে তোরে ভাত কেডা দেয় আমি দেখুম।’

দুলালী বেরিয়ে যায়। ঘরে একা পড়ে থাকে মাসুদ। একটা আধপাকা ঘরের পাকা ফ্লোরে মাদুরের ওপর শুয়ে আছে মাসুদ। ঘরে অল্প পাওয়ারের একটা বাতি জ্বলছে। মাথার ওপর একটা ফ্যান ঘুরছে বটে তবে আওয়াজের তুলনায় বাতাস একেবারেই কম। জানালা একটা থাকলেও খোলা যায় না। তার পাল্লা খোলার জায়গা নেই, পাশে এমন ঘেঁষাঘেঁষি করে আরেকটা ঘর।

মাসুদকে সারাদিন শুয়েই কাটাতে হয়। শুয়ে থাকাটাই তার কাজ। তার জীবন। নিজে নিজে উঠতে-বসতে পারে না কারো সাহায্য ছাড়া। সে জানে, দুলালী যদি তাকে খেতে না দেয় তো তার পক্ষে খাওয়া সম্ভব না। মনটা খারাপ হয়ে যায় মাসুদের। কেন সে ওই কথাটি বলতে গেল তা ভেবে পস্তাচ্ছে এখন। তার তো আসলে রাগ করে কিছু বলা শোভা পায় না। সে বেঁচেই আছে মানুষের কৃপায়। অথর্ব, অনড়। তাঁর মনে পড়ে জোনাকির কথা। ডাক দেয়, জোনাকি, জোনাকি। কিন্তু জোনাকির সাড়া নেই। তবে বাইরে বেশ কথাবার্তার শব্দ শোনা যাচ্ছে। নারী-পুরুষ মিলে অনেকে হয়ত কথা বলছে। কিন্তু সেখানে দুলালী বা জোনাকির কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে না।

দুলালী মাসুদের মালিক। প্রায় সাত বছর আগে দেড় লাখ টাকায় হাজি বক্করের কাছ থেকে মাসুদকে কিনে নিয়েছিল দুলালী। সেই থেকে সে দুলালীর অধীনে আছে। হাজী বক্কর তাকে কিনেছিল ১ লাখ টাকায় জব্বরের কাছ থেকে। ওই জব্বরই মাসুদের প্রতিপালক। জব্বর ছাড়া তেমন কারো স্মৃতি মনে নেই মাসুদের। তবে দুটি মুখ চকিতে এসে আবার মিলিয়ে যায়। ঠিক একটি অবয়ব দাঁড় করাতে পারে না সে।

এই শহরে জব্বর সাহেবের বড় দাপট। তার মতো এমন কয়েক শ’ মাসুদকে পালেন তিনি। চট্টগ্রামসহ কয়েক জেলায় তার একটা বড় নেটওয়ার্ক আছে। ল্যাংড়া, খোড়া, অন্ধ, বধির ভিক্ষুকদের সোজা কথায় মালিক তিনি। হারিয়ে যাওয়া শিশু, পথভোলা মানুষদের নানা কৌশলে তার ডেরায় এনে তাদের অঙ্গহানী করে ভিক্ষার কাজে লাগায় জব্বর। এভাবে গড়ে তুলেছেন তার সাম্রাজ্য। একজন বিত্তবান মানুষ হিসেবে তিনি পরিচিত এই শহরে। অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত তিনি। নিজের টাকায় মসজিদ, মাদ্রাসা করেছেন এলাকায়। কেউ বুঝতে পারে না ভদ্র চেহারার এই লোকটি কী ভয়ংকর ও অমানবিক কাজের গডফাদার।

এই সময় জোনাকি ঘরে ঢোকে। তাকে দেখে বলে, ‘কই ছিলি রে, জোনাকি? মিন্টু, জয়নাল অহনও আইতাছে না ক্যান?’

‘মিন্টু, জয়নাল ক্যান আইতাছে না তা আমি জানুম ক্যামনে। আইলে তো দেখবা, তখন তাগো জিগাইবা।’ ঝাঁঝানো গলায় বলে জোনাকি।

জোনাকির বয়স কত হবে? ৯ বা ১০ বছর। কিন্তু বয়সের চেয়ে অনেক বেশি পাকনা সে। আসলে জীবনের বাস্তবতার ঘোরপ্যাঁচে জোনাকিদের মতো শিশুদের বড় হয়ে ওঠার আগে বড় হতে হয়। তথাকথিত ভদ্রলোকদের ৯/১০ বছরের মেয়েদের এখনো হয়ত ভাত মুখে তুলে খাওয়াতে হয়। আর জোনাকিদের এই বয়সেই নিজের ভাত নিজেকে জোগাড় করে নিতে হয়। শুধু তাই নয়, তার শরীরটাও যে অনেকের কাছে লোভনীয় খাবার তা-ও বোঝার ক্ষমতা অর্জন করেছে সে। কাজেই শরীরটা রক্ষার কলাকৌশলও তাকে শিখতে হয়, জানতে হয়। জোনাকি আসলে মাসুদের কেয়ারটেকার অর্থাৎ ওদের ভাষায় মাসুদ হলো জোনাকির মাল। জোনাকির তত্ত্বাবধানেই মাসুদকে থাকতে হয়।

মাসুদ হাঁটতে-চলতে পারে না। দুই পা একেবারেই ছোট। আর একটি হাতে কনুই পর্যন্ত কাটা। কোনো কাজ তো সে পারেই না এমন কি নিজে নিজের কোনো কাজও করতে পারে না । কাজে যেতে তাকে সাহায্য করার লোক আছে। তবে রাস্তায় দিনভর পাহাড়া দিয়ে রাখে জোনাকি।

সকালে তাকে প্রথমে টেক্সিতে তারপর কাছাকাছি গিয়ে কাঠের চাকার একটা ঠেলাগাড়িতে করে তার জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা জায়গায় নিয়ে গিয়ে রেখে আসা হয়। আবার রাতে তুলে আনা হয়। শহরের নানা জায়গায় তাকে থাকতে হয়। মুরাদপুর ফুটওভার ব্রিজ, আগ্রাবাদ, হালিশহর এমন সব জায়গায়। এখন তার জায়গা জামালখানের শিকদার হোটেলের সামনে। মাসুদের মতো আরও দুজন মিন্টু ও জয়নালও দুলালীর মাল। যারা সারাদিন ভিক্ষা করে আয় করে মহাজন দুলালীর জন্য। সে টাকার কানাকড়িও এরা পায় না; বিনিময়ে খাইয়ে-দাইয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে দুলালী।

এদের আয়ে চলে দুলালী ও তার কর্মচারীদের জীবন। মাসুদসহ তিনজন ওরা। প্রতিদিন একেকজন প্রায় ১ হাজার টাকার ওপর আয় করে। তবে সবসময় একই আয় হয় না। জায়গা বুঝে ভিক্ষা বাড়ে-কমে। ভিক্ষার জন্য সবচেয়ে দামি জায়গা হলো মাজার ও কোর্টবিল্ডিং। আর শুক্রবার জুমার নামাজের সময় কোনো মসজিদের সামনে। বর্ষার সময় খুব কম আয় হয়। বেশি হয় রমজান মাসে।

গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত বারো মাসই মাসুদকে কাজ করে খেতে হয়। কাজ মানে ফুটপাত বা কোনো দোকানের সামনে উপুর হয়ে শুয়ে থাকতে হয়। পাশে থাকে ভিক্ষার থালা। মানুষ আসতে যেতে থালায় ভিক্ষা দিয়ে যায়। জোনাকির কাজ হলো দূরত্বে থেকে তার ওপর নজর রাখা আর থালায় টাকা-পয়সা জমে গেলে তা তুলে ফেলা। জোনাকিকে পাহাড়া দিতে একজন থাকে। সে জোনাকির কাছ থেকে টাকা-পয়সা বুঝে নেয় কয়েক ঘণ্টা পরপর। সকালে বের হওয়ার সময় একবার খেয়ে-দেয়ে বের হয়। সারাদিন পানি ছাড়া বেশি কিছু খাওয়ার দেওয়া হয় না তাকে পাছে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। কয়েক বছর থেকে তাকে একটি ডায়াপারের মতো কিছু একটা পরিয়ে দেওয়া হয় হাফপ্যান্টের নিচে যাতে জলবিয়োগের কাজটির জন্য ঝামেলা পোহাতে না হয়।

এরই মধ্যে মিন্টু ও জয়নালও এসে পড়ে। আজ গরম পড়েছিল বেশি। দুজনের চেহারায় চরম ক্লান্তির ছাপ। মনে হয় সারাদিন রোদেই পড়েছিল দুজন। এরা আসার খানিক পরে দুলালীও ঘরে ঢোকে। মাসুদের মতো ওদের দুজনের সঙ্গেও থাকে দুজন। তবে স্থায়ী নয়। দৈনিক বেতনে কাজ করে। এদের রেখে চলে যায়। সকালে হাজিরা দিয়ে কাজে যায়।
ভিক্ষার সময়ে এরা যে শুধু সঙ্গে থাকে তা না। এরা প্রয়োজনে ওদের সন্তান হিসেবেও পরিচয় দেয় লোকের কাছে।

মাসুদের সবসময় ফুটপাতে শুয়ে ভিক্ষা করতে হয় না। মাঝেমধ্যে কাঠের তৈরি এক ধরনের হুইল চেয়ারে বসিয়েও ভিক্ষা করানো হয়। তখন জোনাকিদের মতো শিশুরা গাড়ি ঠেলে ঠেলে ভিক্ষা চায়। এটা বেশি হয় রমজান মাসে বিশেষ করে ঈদের আগে জাকাত দেওয়ার সময়ে। মানুষ এমনিতেই এ ধরনের পঙ্গু ভিক্ষুকদের ভিক্ষা বেশি দেয়। আর রমজানে এ কারণে জাকাতের টাকাসহ কাপড়চোপড়ও বেশি পায় তারা।

মিন্টু, জয়নাল আসার পর সবাইকে ভাত দেওয়া হয়। মাসুদ, মিন্টু, জয়নাল এবং জোনাকিকে একসাথেই খেতে দেওয়া হয়। খেতে খেতে তাদের মধ্যে নানা বিষয়ে আলাপ হয়। সারাদিনের কত গল্প জমে থাকে তাদের। এদের চোখের সামনে কতকিছু ঘটে যায় কিন্তু মানুষ হলেও সেখানে দর্শক হওয়া ছাড়া তাদের কিছু করার থাকে না।

এ সময় তাদের কেউ কেউ ছোটবেলার গল্প বলে। কোনো সুখস্মৃতি নিয়ে আলোচনা করে। অনেক সময় নিজেদের যাপিত জীবন নিয়ে গল্প করে। কিন্তু কেউ ভুলেও তাদের পঙ্গু হওয়ার স্মৃতি নিয়ে কিছু বলে না।

এরা থাকে মতিঝর্ণায় পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা বস্তিতে। এখানে অনেক পরিবার বাস করে। মাঝেমধ্যে বিশেষ করে বর্ষার সময়ে বৃষ্টি বেশি হলে এখানে সরকারি লোকেরা উচ্ছেদ অভিযান চালায়। সে সময়টা ওদের জন্য ভীষণ কষ্টের। তাদের এখান থেকে সরিয়ে অন্যকোনো বস্তিতে নিয়ে রাখা হয়। দু-চার-পাঁচদিন পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার ফিরিয়ে আনা হয় এখানে। এসব ঝামেলা দুলালী একাই মোকাবেলা করে।

মাঝবয়েসী দুলালী বেটেখাটো তবে শক্তসামর্থ্য। শরীর এখনো টানটান। বিয়ে হয়েছিল কিনা এদের তিনজনের কেউ জানে না তা। তবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পুরুষ আসে। রাত কাটিয়ে চলে যায়। এরপর কয়েকদিন বদ মেজাজি দুলালীকে খোশমেজাজে দেখা যায়। অনেকে বলে হাজি বক্করের সঙ্গে বিশেষ একটা সম্পর্ক ছিল দুলালীর। বক্কর বেঁচে থাকতে দুলালীর বেশ দাপটও ছিল বস্তিতে।
দুলালীকে দেখে মাঝেমধ্যে শরীর জেগে ওঠে মাসুদের। কিন্তু দুলালীর দিকে তাকিয়ে ভয়ে চুপসে যায় সে। মাসুদ কোনোদিন নারী শরীর দেখেনি। মাঝেমধ্যে খুব ইচ্ছা হয় কিন্তু সে সৌভাগ্য তার কখনো হয়নি।

আজ খুব বেশি আলাপ জমল না। মিন্টু ও জয়নালের শরীর ভালো লাগছে না বলে খেয়েই শুয়ে পড়ল। ফলে মাসুদের কিছু করার থাকে না। সেও শুয়ে পড়ে।

বেশিরভাগ রাতে শোয়ার পরই ঘুমিয়ে পড়ে সে কিন্তু আজ দুচোখের পাতা এক হচ্ছে না। ফ্লোরে পাশাপাশি শুয়েছে তিনজন। পাশের চৌকিতে জোনাকি একা শোয়। জোনাকির বাড়ি কোথায়, সে কীভাবে এদের সঙ্গে জুটেছে তার কিছুই জানে না মাসুদ। প্রশ্ন করলে কৌশলে এড়িয়ে যায় সে।
রুমটা এত ছোট একটা চৌকির পর যতটুকু জায়গা থাকে সেখানে তিনজনের পক্ষে শোয়া বেশ কষ্টকর। তবুও বছরের পর বছর এভাবেই জীবন কাটছে তাদের।

মাসুদের যেদিন ঘুম আসে না সেদিন তন্ময় অবস্থায় একটি মুখ খুব জীবন্ত হয়ে আসে তার কাছে। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বলে, বা’জান ঘুম আসে না? আমি মাথায় হাত বুলায় দিতাছি। ঘুমাও বাবা। তখন সে তার ছোটবেলায় ফিরে যায়। দেখে একটা নীল রঙের শাড়ি পরা মহিলা। একটা মোড়ার ওপর বসে আছে মাসুদ। তার মুখে ভাত তুলে দিতে দিতে বলছে, ‘সারাদিন এত দৌড়াদৌড়ি কর ক্যান বাবা। দেখছো রোদে থাইকতে থাইকতে তোমার রংটা কেমুন কালা হয়া গেছে। বা’জানের রাজপুতের মতো রং ছিল। যাও বা’জান। খাইয়া কিন্তু এখন ঘুমাইত যাবা। তোমার বাবা খেত থ্যাইকা আইসা যদি দেখে তুমি রোদের মইধ্যে খেলতাছো তখন খুব গোস্বা করবে বা’জান।’

ভাত খেতে ভেতে মাসুদ বাইরে তাকায়। বাইরে রোদে যেন পুড়ে যাচ্ছে সব। বাড়ির হাঁস-মুরগিগুলা লাউয়ের মাচানের নিচে ছায়ায় বসে হাঁফাচ্ছে। লাউয়ের কচি ডগাগুলো রোদে নুইয়ে পড়েছে।

যতবার মায়ের কথা মনে করার চেষ্টা করে তখনই এই দৃশ্যটাই শুধু মনে পড়ে তার।
মাসুদের খুব তেষ্টা পায়। সবাই ঘুমিয়ে। নিজে নিজে পানি ঢেলে খাবে সে উপায় নাই তার। অন্যদিন একটা প্লাস্টিকের বোতলে পানি রাখা হয় বিছানার পাশে। আজ সেটাও নেই। দু’জনের মধ্যে একজন ভীষণ নাক ডাকছে। তাতে আরও বিরক্ত লাগে মাসুদের। এ সময় পাশের রুম থেকে ফিসফিসিয়ে কথা বলার শব্দ পায় সে। রুমটা দুলালীর। তার হাসির শব্দও ভেসে আসছে। এমন শব্দ সে আগেও পেয়েছে বহুবার। এটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার ধরে নিয়ে মাসুদ পাশ ফিরে আবার ঘুমাবার চেষ্টা করে। কিন্তু ঘুম আসে না। আরেকটি দৃশ্য এসে ভেসে ওঠে চোখের ওপর। সেদিনের পর জীবনটাই পাল্টে গেল তার।

সেদিন ছিল হাটবার। বাবার সঙ্গে হাটে যাওয়ার বায়না ধরেছিল মাসুদ। তার জেদ আর মায়ের জোরাজুরিতে শেষ পর্যন্ত বাবার হাত ধরে হাটে যাওয়ার সুযোগ হলো তার। এত এত দোকান আর প্রচুর মানুষের ভিড় দেখে ভয় ও আনন্দে মাসুদের এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল সেদিন। হাওয়াই মিঠাই দেখে তা খাওয়ার আবদার করে সে। বাবা তাকে হাওয়াই মিঠাইয়ের লাঠিটি ধরিয়ে দিয়ে মিঠাইওয়ালাকে পয়সা দিতে গেল। আর হাওয়াই মিঠাই নিয়ে আনন্দে নাচতে নাচতে একসময় মাসুদ তার বাবাকে হারিয়ে ফেলে। বাবা, বাবা বলে কেঁদে কেঁদে সারা হাট খুঁজেও বাবাকে পেল না মাসুদ। সন্ধ্যার দিকে ক্লান্ত-শ্রান্ত মাসুদের মাথায় হাত রেখে এক ব্যক্তি বলল, ‘বাবারে হারাই ফেলছো? কুনো অসুবিধা নাই। আমার লগে আসো। তোমার বাবার কাছে নিয়া যাব।’

কয়েক বছর পর মাসুদ জানল লোকটার নাম জব্বর। তার ডেরায় এমন অনেক হারিয়ে যাওয়া ছেলেমেয়ে আছে। মাসুদের বাবা, মায়ের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে লোকটি তাকে নিয়ে এসেছিল শহরে। পথে অনেক কান্নাকাটি করেছিল। লোকটি বারবার তাকে বলছিল, ‘বেশি কাঁদলে মা-বাবারে খুইজাঁ পাবা না।’ লোকটার ডেবায় এসে অনেকের ভিড়ে কান্না ভুলে যেতে থাকে। এমন কি বাবা-মার কথা, বাড়ির কথাও ভুলে যায় সে।

মাসখানেক পর শুরু হয় মাসুদের কাজ। সকালে এক থালা ভাত দেওয়া হতো। তারপর একটা লোক এসে তার মতো ছেলেমেয়েদের একটা ইনজেকশন দিতো। দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা মরার মতো ঘুমিয়ে পড়ত। তখন তাদের নিয়ে শহরের কোনো ফুটপাতে শুইয়ে রেখে একটা সাদা থান কাপড় দিয়ে ঢেকে দিত শরীর। আর তার পাশে ‘পোলাটা মইরে গেছে দাফনের টাকা দ্যান’ বলে কান্না করতো কোনো মহিলা। জব্বরের কাছ থেকে দিনে তিন/ চার শ’ টাকা দিয়ে তাদের ভাড়া করতো কিছু মহিলা। মাঝেমধ্যে ঘুম ভেঙে নড়েচড়ে উঠলে তাকে নিয়ে দ্রুত সটকে পড়ত মহিলারা।

এভাবে বছর দুয়েক চলার পর বন্ধ হয়ে গেল সে ধান্ধা। এরপরের জীবনটা মাসুদের জন্য দোজকের মতো ভীতিকর ও যন্ত্রণাময়। দোজক কাকে বলে তখনো জানত না মাসুদ। বড় হয়ে যখন দোজকের বর্ণনা শুনতো তখন মাসুদ ভাবতো দোজকে কি এর চেয়েও বেশি শাস্তি দেওয়া হয়?

একদিন তাকে এবং তার বয়সী আরও কয়েকজনকে ধরে পা দুটো বাঁকা করে দড়ি দিয়ে বেঁকে দেওয়া হয়। এভাবে বছরখানেক ফেলে রাখার পর যখন দড়ি খুলে দেওয়া হলো তখন মাসুদ টের পেলো সে আর হাঁটতে পারে না। পা দুটো অকেজো হয়ে গেছে। এরপর শুরু হয় তার অন্য জীবন। রাস্তায় উপুড় হয়ে পড়ে থেকে ভিক্ষা চাওয়া। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার উপরের অংশ বড় হলেও পা দুটো রয়ে যায় সেই শিশু বয়সের মতো। সরু ও ছোট।

তার জীবনের দুঃখের কাল তখনো শেষ হয় না। বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা। এখনো স্পষ্ট মনে আছে মাসুদের। নিউ মার্কেটের পাশে ছিল সেদিন সে। শহরের তখন বেশি বেশি আন্দোলন চলছির। একটা বড়সড় মিছিল তার পাশ দিয়ে চলে গেল নিউমার্কেটের দিকে। এরপর শুনতে পেলো গুলির শব্দ। আর তারপরই শুরু হয় হুলস্থল দৌড়াদৌড়ি। মানুষ পালাচ্ছে দিগ্বিদিক। সঙ্গে রিকশা, টেক্সি, টেম্পু, মোটর সাইকেল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার বাম হাতের ওপর দিয়ে চলে গেল গাড়ির একটা চাকা। তারপর আর কিছুই মনে নেই তার। যখন হুঁশ ফিরে এলো তখন দেখল একটি বিছানায় শুয়ে আছে সে। হাতে তীব্র ব্যথা। নাড়তে গিয়ে দেখল কব্জি পর্যন্ত কেটে ফেলা হয়েছে হাতটা।

মাসুদ টের পায় তার গলা শুকিয়ে আসছে। একটু পানি খাওয়া দরকার। ঘরে বাতি না জ্বললেও দরজা ও টিনের বেড়ার ফাঁক দিয়ে আসা বাইরের আলোয় ঘরের সবকিছু মোটামুটি আন্দাজ করা যায়। সে ডাকল, ‘জোনাকি, জোনাকি।’ কয়েকবার ডাকার পর সাড়া দিল মেয়েটি। বলল, ‘পানি দস নাই আইজক্যা। একটা বোতল দিয়া যা।’

চরম বিরক্তি নিয়ে মেয়েটি ওঠে। একটা বোতল তার পাশে রেখে আবার শুয়ে পড়ে।

ঢকঢক করে বোতলের অর্ধেক পানি শেষ করে মাসুদ। ঢেকুর ফেলে বলে আলহামদুলিল্লাহ। আবার শুয়ে পড়ে ভাবে এবার তার ঘুমানো দরকার। সে সময় দূরের মসজিদ থেকে মাইকে ফজরের আজানের শব্দ কানে এসে লাগে। মাসুদ ঘুমানোর চেষ্টা করে। সিলিং ফ্যানের বাতাস নাই। ঘেমে একপ্রকার ভিজে গেছে।

ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়া কিছুটা ফাঁকফোকর দিয়ে ঘরেও প্রবেশ করে। সে হিমেল পরশে মাসুদের চোখে ঘুম নেমে আসে। আর তখনই মা এসে হাজির হয়। তাকে ঘুম থেকে ডেকে দিয়ে বলে, ‘যাও বা’জান মাঠে খেলতে যাও। সবাই দেখো আইস্যা পড়ছে। মায়ের ডাকে সেও উঠে মাঠের দিকে যায়। দেখে প্রকাণ্ড এক মাঠ। সেখানে অজস্র শিশু খেলা করছে। মাসুদ মাঠে এসে দেখে সেই ছোটবেলায় হারিয়ে যাওয়া হাটের মতো কত-শত লোক মাঠের বাইরে। আর মাঠ জুড়ে শুধু তার বয়েসী শিশুরা। কারো হাতে রঙিন ঘুড়ি, কারো হাতে বেলুন, কারো হাতে হাওয়াই মিঠাই। ওর হাতেও কেউ একজন এসে একটি হাওয়াই মিঠাইয়ের কাঠি ধরিয়ে দেয়। দিগন্ত লাল করে পশ্চিমে সূর্য ডুবতে বসেছে। তার আভায় রঙিন হয়ে আছে চারপাশ। সে অনেকবার শুনেছে বেহেস্তে শিশুরা এমন খোলা ময়দানে খেলবে আর তাদের মা – বাবাকে খুঁজবে। মাসুদের মনে হয় সে দোজক থেকে বেহেস্তে এসেছে। সে এদিক-ওদিক চোখ ঘুরিয়ে খুঁজতে থাকে যদি তার মাকে দেখতে পাওয়া যায়। হঠাৎ দেখে ভিড় ঠেলে দুটি শিশু মাসুদ, মাসুদ বলে এগিয়ে আসছে। কাছে আসার পর মাসুদ তাদের চিনতে পারে মিন্টু আর জয়নাল। মিন্টু তার কাছে এসে ডাকে মাসুদ, মাসুদ বলে। মাসুদের সেদিকে খেয়াল নাই। সে অস্তমিত সূর্যের চারধারে রঙিন হয়ে ওঠা আকাশটা দেখে। সে সময় তাকে ধাক্কা দিতে দিতে মিন্টু বলে মাসুদ, ওই মাসুদ।

মাসুদ চোখ খুলে দেখে তার মুখের ওপর ঝুঁকে আছে মিন্টু। চোখ খুলেছে দেখে বলে, ওঠ ব্যাটা, আইজ কাজে যাবি না?



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *