দীপেন ভট্টাচার্য
আমার এক বন্ধু ছিল, নাম ছিল রেবা। তো রেবা একদিন প্রজাপতি হয়ে উড়ে গিয়েছিল। উড়ে যাওয়াটা আমি দেখিনি, দেখেছিল অভীক। তবে প্রজাপতি হবার আগে রেবা ওদের বাসার দেয়ালের ভেতরে বাস করছিল, মানুষ থেকে প্রজাপতি হবার যে সমস্ত পর্যায়গুলো পার হতে হয় সেগুলো পার হচ্ছিল। এটার সাক্ষী আমি, কারণ রেবাকে যখন পাওয়া যাচ্ছিল না অভীক আমাকে ওদের বাসায় যেতে বলে, ও নাকি দেখেছিল রেবাকে দেয়ালে ঢুকে যেতে। রেবাকে আমি দেয়ালের এপাশ থেকে ডেকেছিলাম, ও প্রথমে সাড়া দিলেও পরে চুপ হয়ে গিয়েছিল।
রেবা আর অভীকের একটি সন্তান ছিল। আট বছরের শান্তনু স্কুলে যেতে গিয়ে বাস-স্ট্যান্ডে বাসের নিচে চাপা পড়েছিল। অভীক শান্তনুকে স্কুল-বাসে তুলে দিতে গিয়েছিল, কিন্তু ওই সময়টিতে ছেলেকে একা রেখে স্ট্যান্ডের পেছনে চায়ের দোকানে চা খেতে যায়। রেবা মনে হয় অভীককে আর ক্ষমা করেনি, তাই শেষে প্রজাপতি হয়ে গিয়েছিল। প্রজাপতি হয়ে উড়ে যাবার আগে অভীক নাকি রেবাকে বলেছিল ওকে সাথে নিয়ে যেতে। কিন্তু যে একবার প্রজাপতি হয়ে যায় সে কি আর মানুষের ভাষা বোঝে?
রেবা চলে যাবার পরে বহু প্রজাপতিকে দেখতাম আমার তিনতলার ফ্ল্যাটে খোলা জানালা দিয়ে আসতে। প্রথমে ভাবতাম বাইরের ছোট বারান্দায় যে গোলাপ লাগিয়েছিলাম সে জন্য আসে। পরে ভাবলাম এদের মধ্যে যে রেবা সে আমার সাথে দেখা করতে আসে। কিন্তু প্রজাপতির জীবন তো খুব ছোট, এতদিন তো আর রেবার বেঁচে থাকবার কথা নয়।
না, বেঁচে থাকবার কথা নয়, রেবা তো আর বাঁচতে চায়নি।
সারা দিন বৃষ্টি হচ্ছিল, গরম কমে এল। বিকেলে বৃষ্টিটা ধরে এলে অফিস থেকে বের হলাম। রাস্তায় প্রচুর মানুষ, বাড়ি ফিরতে উৎসুক। ভাঙা ফুটপাথের পাশে খানাখন্দ, তাতে জল জমেছে। শাড়ি পরে সেগুলো পার হয়ে রিক্সা বা সিএনজি ধরা কঠিন হবে। এই অফিসের কোনো নিজস্ব গাড়ি নেই যে আমাকে পৌঁছে দিতে পারে। আমার একটা বাঁধা সিএনজি আছে, কিন্তু ড্রাইভার আগে থেকে বলে দিয়েছে দু-দিন আসতে পারবে না, আজ না আসার প্রথম দিন। ইদানিং ফোন দিয়ে ভাড়া গাড়ি ডাকা যায়, কিন্তু আমি তাতে সেরকম সড়গড় নই। একটা বাস আমার বাড়ির কাছ দিয়ে যায় জানি, সেটা এখান থেকেই পাওয়া যাবে, কিন্তু তাতে কোনওদিন উঠিনি। অফিস ফেরৎ সিএনজিতে ওঠার সময় বাসটা অনেকবার দেখেছি, কিন্তু তাতে ওঠার পদ্ধতিটা ভাল করে লক্ষ করিনি। করলে হয়তো আজ কাজটা সহজ হত। কিন্তু আসলেই কি তাই? এই শহরটা আমাকে শান্তি দেয় না, প্রতিটি পদক্ষেপের পেছনে যেন একটা অস্বস্তি কাজ করে। কাজ থেকে বাসায় ফিরতে চাই – এটা খুব বড় চাওয়া নয়, কিন্তু সেটুকু করাই মনে হয় যেন এক অসাধ্য সাধন।
আকাশে কালো মেঘ, সন্ধ্যা আর রাত্রির সন্ধিক্ষণে আঁধারটা ঘন হয়ে নামল। একটা বাস জল ছিটোতে ছিটোতে এল, হেল্পার চিৎকার করে গন্তব্যস্থান ঘোষণা করছে, না করলেও হয়, কারণ যাত্রীর অভাব নেই। মনে হল শ’খানেক লোক সমুদ্রপৃষ্ঠের বিশাল দোলুনির মত বাসটার একটা দিকে আছড়ে পড়ল। আমি এর মধ্যে গেলে সমুদ্রের অতল গহ্বরে চলে যেতাম। এরকম তিনটে বাস ছেড়ে দেবার পরে দেখি আমাদের অফিসেরই আর একজন আমার পাশে। ওর নামটা কিছুতেই মনে থাকে না আমার, অফিসে ওকে অদ্রি বলে ডাকে, পরে জেনেছিলাম ওর ভাল নাম আদ্রিকা। আমার থেকে বয়সে অনেক ছোট, অফিসে একটা বড় ঘরে অনেকের সাথে বসে। অদ্রির সঙ্গে রেবার অনেক মিল আমি খুঁজে পাই, কিন্তু জীবনের ব্যস্ততায় ওর সঙ্গে আমার সেরকম সখ্যতা গড়ে ওঠেনি। ওর তরুণ উজ্জ্বল মুখটি সেই দমবন্ধ-করা অবরোহী অন্ধকারকে একটু হালকা করে দিল। সে বলল, ‘উঠতে তো পারছেন না, আসুন উঠিয়ে দিই।’ আমার ডান হাতটি কোনো দ্বিধা ছাড়াই ধরে সে আমাকে খানখন্দের জল এড়িয়ে ভিড়ের মধ্যে নিয়ে গেল। তার কালো চুল সারা পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে ছিল বৃষ্টিভেজা একটি লাল জামার ওপর। আদ্রিকা মানুষের সমুদ্রে একটা বিরাট পথ মুহুর্তে করে নিল, কিন্তু তাতে ঢোকা মাত্র চারদিক থেকে সমুদ্র আমাকে ঢেকে দিল, ওর হাতটাও আমার হাত থেকে ছুটে গেল। আদ্রিকাকে হারিয়ে ফেললাম।
আমার ভাগ্য ভাল যে জনসমুদ্রে তলিয়ে গেলাম না, তাহলে মাটিতে পড়ে মৃত্যু হত আমার। সমুদ্রের ঢেউ আমাকে বাসের দরজার দিকে নিয়ে যেতে থাকে, কিন্তু সেই ঢেউয়ের যেন সহস্র হাত ছিল, কিন্তু সেগুলো পরিষ্কার ছিল না, নোংরা হাতগুলি আমার শরীরে নিজেদের ঘষে পরিষ্কার করে নিচ্ছিল। এরকম ব্যাপার, কিন্তু একসাথে শাড়ি সামলানো, হাতের ব্যাগটিকে যক্ষের ধনের মত আগলে রাখা, আর মাটিতে পড়ে না যাবার আপ্রাণ চেষ্টা অন্য কিছু ভাবার সময় দিল না। মৃত্যুচিন্তা হল, কিন্তু মৃত্যু হলো না, বরং সহস্র হাতের স্রোত আমাকে সরু থেকে সরুতর একটি দরজা পেরিয়ে বাসের ঠিক মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দিল। আদ্রিকাকে কোথাও দেখতে পেলাম না।
পৃথিবীটা বদলে যায়, বাইরের আলো অসংখ্য শরীরে শোষিত হয়ে বাসের ভেতরটাকে কৃষ্ণ গহ্বরে পরিণত করে। চারদিকে কিছু শরীর, সামনে সিটে বসা এক জোড়া কাঁধ, তার ওপর একটা মাথা, কালো ঘন চুল, সেখান থেকে একটা গা-গুলানো গন্ধ উঠে আসছে। এই বাসটিই কি আমার? সেটা কাউকে জিজ্ঞেস করতে হবে, কিন্তু তার আগে বাসটি ঝটকা দিয়ে সামনে এগোয়। টাল সামলানো যায় না, বাঁ হাতে ব্যাগটা সামলে ওপরের রডটা ধরে কোনওরকমে দাঁড়িয়ে থাকি, কিন্তু আমার ওপর একজন এসে পড়ে। সে ‘দুঃখিত’ বা ‘সরি’ বলে না, বরং তার একটি হাত আমার বুক ও পিঠের মধ্যের জায়গাটা খামচে ধরে। সেই অসহায় ‘কী করব’ অবস্থায় সামনের সিটে বসা গন্ধময় ঘনচুল তরুণটি আমার দিকে চেয়ে বলে, ‘ম্যাডাম, এইখানে বসুন।’ আমি তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বসতে যাই, কিন্তু তার সঙ্গে জায়গা বদল করতে গিয়ে মনে হল সেও আমার শরীরের আঘ্রাণ পেতে চায়। সে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। আমি ব্যাগ খুলে টিকিটের পয়সা আর ফোনটা বের করতে চাই, কিন্তু এর মধ্যেই পেছনের সিট থেকে কেউ হাত বাড়িয়ে আমাকে স্পর্শ করে, আমি ব্যাগের ভেতরে ফোনটা হাতে চেপে বসে থাকি আতঙ্কে। নড়ে বসি, কিন্তু হাতটা থামে না, শাড়ির ভেতর দিয়েই আমার পেট স্পর্শ করে। অন্যদিকে, দাঁড়ানো তরুণটির শরীরের মধ্যস্থল আমার ডান বাহুর ওপর চেপে বসতে থাকে। আমি বাঁ পাশে বসা পুরুষটির দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকাই, সে নিশ্চয় বুঝছে কী ঘটছে। কিন্তু সে হাসে, তার পান-খাওয়া লাল দাঁতগুলো বীভৎস হয়ে তাকে মানুষখেকো রাক্ষসের রূপ দেয়। সে আমার বাঁ উরুতে হাত রেখে বলে, ‘চিন্তা করবেন না, আপনাকে পৌঁছে দেব।’ এর মধ্যে পেছনের হাতটি আমার পেটের ডানদিক ঘেঁষে জংঘার দিকে এগোয়, আর দাঁড়ানো তরুণটির স্ফীতকায় মধ্যদেশ আমার বাহু ঘষতে থাকে। আমার চোখ দিয়ে জল গড়ায়, গলা ধরে আসে, চিৎকার করতে চাই, পারি না।
রেবা এখানে থাকলে কী করত? রেবাকে এরা কিছু করতেই সাহস পেত না। আর যদি কিছু করত তাহলে রেবা এখনই চিৎকার করে ভাল মানুষগুলোকে জড়ো করে ফেলত। বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স শেষ করার সাথে সাথে বাড়ি থেকে আমাকে এক বিদেশবাসী ছাত্রর সঙ্গে বিয়ে করিয়ে দেয়া হয়েছিল। রেবা বলেছিল, ‘তুই এটা কেন করছিস? ওদের না বলে দে।’ আমি না করতে পারিনি, হয়তো বিদেশ যাবার লোভ ছিল, কিন্তু বিয়ের পরে দু’মাসও টিঁকতে পারলাম না ওদের নির্যাতনে। পালিয়ে এলাম, কিন্তু আমার বাড়িতে পালানোটা গ্রহণযোগ্য হলো না। রেবা একটা চাকরি জোগাড় করে দিয়েছিল, তারপরে ষোলোটা বছর কেটে গেল একা। এই দীর্ঘ সময়ে অর্থও হলো না, সামাজিক প্রতিষ্ঠাও হলো না, কিন্তু যুদ্ধ হলো। সেই যুদ্ধে জয়ী হলাম না, আপস করে বাঁচলাম। আপস করতে করতে পিঠ ঠেকে যেত, আত্মহত্যার কথা ভাবতাম। রেবা বলত, ‘আত্মহত্যা করবি কেন? যতদিন আছে পৃথিবীটাকে দেখে যা, আকাশ দেখ, পাহাড়ে যা, আর পাহাড়ে যেতে না পারিস নদীর ধারে যা। মরলে পরে তো পাথর হয়ে যাবি, তো আগে পাথর হয়ে লাভ কী?’ রেবার ওপর আমার অনেক রাগ, ও বলেছিল এই শহরটাকে আমার জন্য বাসযোগ্য করে দেবে, বলত, ‘দিলু, অপেক্ষা কর, আমি তোর জন্য সব ঠিক করে দেব, একদিন প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারবি, রাতে ঘুমাতে পারবি, সকালে উঠে মন খারাপ করবে না আর।’ সেই রেবা কি শেষে আত্মহত্যা করল? না রেবা কখনও আপস করেনি, সে প্রজাপতি হয়ে গিয়েছিল।
আর আমি রেবা নই, তাই অপমানে ও লজ্জায় চোখ দিয়ে জল গড়াতে থাকে। থরথর করে কাঁপতে থাকে শরীর, নড়তে পারি না, মুখ দিয়ে শব্দ বের হয় না। হাতে ফোনটা আছে, কাউকে কি ফোন করা যায় যে আমাকে এখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে? এই শহরে এখন আমার কাউকে ফোন করার নেই।
আমার বাঁ পাশের লোকটি, যার হাত আমার উরু স্পর্শ করে আছে, তার বাঁদিকে একজন তরুণী বসেছিল। আমি নিশ্চিত ছিলাম যা ঘটছে তা তার দৃষ্টি এড়ায়নি, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে কিছু বলতে যাব এসময়ে দেখলাম পুরুষটির বাঁ হাতে সেই নারী একটা রুমাল গুঁজে দিল। আর গুঁজে দেবার প্রক্রিয়াটির সময় সেই নারীর মুখ বদলে এক কিম্ভূতকিমাকার রূপ নিতে থাকে, তার হাতটি সরু লিকলিকে হয়ে যায়। আমি আতঙ্কে চিৎকার করতে পারি না, খাবি খাই, পুরুষটির হাত আমার উরুতে আরো গেঁথে যেতে থাকে। সে বলে, ‘শরীর খারাপ নাকি? এই রুমালটা নেন।’ এই বলে সে মুহুর্তে তার অন্য হাত দিয়ে সেই রুমালটি আমার মুখের কাছে নিয়ে আসে, আমি কিছু বলার আগেই সেটি নাকের ওপর চেপে ধরে। জ্ঞান হারানোর আগে মনে হল পেটের ওপর পেছনের মানুষটির হাতটি খড়খড়ে লোমশ হয়ে উঠছে।
জ্ঞান যখন ফিরল তখন বাসটি ছুটছে উন্মত্তবেগে শহরের এক অজানা অংশে। আমার শরীরের দিকে তাকাতে ভয় পেলাম, রক্তের এক ঠাণ্ডা স্রোতধারা তাতে কোথাও বইছে। সতেজ রক্ত কি ঠাণ্ডা হতে পারে? আমি আগের জায়গাতেই আছি, কিন্তু বসা নয়, শোয়া। রক্তাক্ত বিবস্ত্র আমি সামনের সিটটা ধরে উঠে বসি, মনে হল শরীরটা এখনই ভেঙে খান খান হয়ে যাবে, মাথাটা ঘোরে। আমার ব্যাগটিকে দেখি না। বাসে আর কোনো যাত্রীই নেই। চোখ জ্বলে, সেই জ্বলা চোখ দিয়ে বাঁদিকের জানালার একটু অংশ চোখে পড়ে। সেখান দিয়ে আলো এসে পড়ে, বাসের বাইরে একটি দোকান। কোনো যন্ত্রাংশ বিক্রির, নাকি সাধারণ মুদির দোকান? কিন্তু সেখানে মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল না, কয়েকটি হিংস্র নেকড়ের মত জীব পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে জিনিস কিনছিল, আর কাউন্টারের পেছনে দোকানদারটির মুখাবয়ব ছিল একটি অজানা জন্তুর মতো। বাস পার হয়ে যায় উঁচু ফ্ল্যাটবাড়ির দালান, এমন দালান আমি আগে দেখিনি। আধো-অন্ধকারে দেখি সেই বাড়িগুলোর বারান্দায় জটলা, কিন্তু তারা মানুষ নয়। তাদের মুখমণ্ডল হিংস্র নেকড়ে ও পুরাণের পিশাচের এক অদ্ভূত মিশ্রণ। একি সম্ভব? আমার আহত মাথা নানাবিধ কল্পনা করছে নিশ্চয়! অনেক দোকান পার হয়ে যাই – ক্রেতা বিক্রেতার ভিড়, তাদের শরীর কুমিরের, মুখ গোসাপের। ধীরে ধীরে এক তীক্ষ্ম আতঙ্ক আমাকে অথর্ব করে দেয়। বহু বছর আগে এরকম স্বপ্ন দেখেছিলাম, রাতের আঁধারে শহরটা বদলে যায়, সব মানুষ অদ্ভূত জন্তুতে পরিণত হয়।
এর মধ্যে বুঝলাম বাসে আমি ছাড়া আরো তিনটে মানুষ আছে। বাস চালক, যার মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না, এবং তার পাশে আমার দিকে মুখ করে একটা সিটে বসেছিল দুজন। তাদেরকে চিনলাম, আমার ডান পাশে দাঁড়ানো তরুণটি, আর বাঁ পাশের লোকটি যে আমার মুখে রুমাল চেপে ধরেছিল। আমার জেগে ওঠার খবর তারা চিৎকার করে চালককে বলল। চালক বাস চালাতে চালাতেই আমার দিকে পেছন ফিরে চাইল, মনে হল তার শরীর আঁশে ভর্তি, মুখমণ্ডলও আঁশে ঢাকা, শুধু চোখদুটি খোলা, সেগুলো জ্বলছে অঙ্গারের মতো। পরে বুঝলাম সেটি আমার দৃষ্টিভ্রম। এই তিনজনের মুখেই এক বীভৎস হাসি জেগে ওঠে, তারা যেন পিশাচ হয়ে যায়। বাসটি একটি নির্জন পেট্রোল স্টেশনে ঢুকে দালানের পেছন দিকে চলে যায়। স্টেশনের বাতির আলো কিছুটা বিচ্ছুরিত হয়ে বাসের মেঝে আর সিটে জানালাগুলোর খোপ খোপ ছায়া তৈরি করে। এর মধ্যেই একটি প্রজাপতি বাসের জানালা দিয়ে ঢোকে, রাতে কি প্রজাপতি ওড়ে? মৃত্যুর আগে কেন এই তথ্যটি মনে গেঁথে গেল জানি না। পিশাচ দুটো উঠে আমার দিকে আসতে থাকে, তাদের হাতে চাপাতি, পেছনে ‘আঁশযুক্ত’ বাসের চালক। জীবনের শেষ মুহূর্তে মানুষ হয়তো মনে করে এগুলো সবই স্বপ্ন, অথবা সে সমস্ত আশা পরিত্যাগ করে ঈশ্বরকে ডাকে অথবা নির্বাণের পথ খোঁজে। কিন্তু ততক্ষণে আমি হয়ে গিয়েছিলাম এক নির্জীব মাংসপিণ্ড। দুটো চাপাতি একসাথে শূন্যে ওঠে।
হঠাৎ পেছন থেকে একটা হিসহিসে গলা শোনা যায়, ‘থামো।’ চাপাতিদুটো শূন্যে স্তব্ধ হয়ে ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসে, তবে আমার গলায় নয়। আমার পেছনের অস্তিত্বটি সম্পর্কে সচেতন হই। ঘাড় ঘোরাতে যন্ত্রণা হচ্ছিল, তবু পেছনে তাকাতে পারলাম। দুটো সিট পরে, মধ্যের সরু পথটার ওপারে দাঁড়িয়ে আছে এক নারী, তার মাথার চুলের বদলে অজস্র সাপ জটলা পাকিয়ে আছে, কিন্তু তার মুখমণ্ডল ছিল যেন ভাস্করের বাটালি দিয়ে যত্নে গড়া। সুগঠিত গলার নিচে স্তনদ্বয় ছিল উন্মুক্ত, আর নাভির নিচে ছিল না পা, ছিল সেখানে সরীসৃপের আঁশযুক্ত দেহ। সেটুকু প্রথমে মৎসকুমারীর আকর্ষণীয় অংশ বলে মনে হতে পারে, কিন্তু দ্বিতীয় দৃষ্টিতে বুঝলাম সেটি আসলে সর্পদেহই বটে। বিড়বিড় করে বলি, ‘মেডুসা।’ মেডুসা হাসে, অট্টহাস্য নয়, এক শীতল জমাট বরফের হাসি। কেন জানি শত বীভৎসতার মধ্যেও তার যত্নে গড়া মুখাবয়ব আমাকে একটা পরিচিতির আবহে নিয়ে যায়।
মেডুসা আমার কাছাকাছি আসে, মাটিতে তার দেহের নিচের অংশের ছ্যাঁচড়ানোর শব্দ শোনা যায়। আমার পাশে এলে তার মাথার অসংখ্য সাপের চলন আমাকে এক ভীতিকর সম্মোহনে নিক্ষেপ করে। সে বলে, ‘মানুষদের আমি বুঝি না।’ তার মাথার ওপর সেই প্রজাপতিটি ওড়ে, তার ডানা নীল রঙের। মেডুসার মাথার সাপগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মত প্রজাপতিটাকে দেখে। মেডুসাকে দেখে মানুষরূপী পিশাচ তিনটি অস্ফূট চিৎকার করে ওঠে, ওদের মুখমণ্ডল ভয়ে আরো কিম্ভূত হয়ে যায়, ওরা পিছনে দিকে সরতে থাকে। মেডুসা এক হাত দিয়ে আমাকে সিট থেকে তুলে তার দেহের পেছনে আমাকে আড়াল করে। এই প্রথম বুঝলাম তার হাত আছে, আর মাথার পেছনেও দুটি চোখ ও মুখ আছে। পেছনের মুখটি বলে, ‘বাসের পেছনের দরজা খোলা আছে, তুমি নেমে যাও, আমি এদের দেখছি।’ মেডুসার গলার স্বর পরিচিত মনে হয়।
আমি দৌড়াতে চাই, কিন্তু সারা শরীরে ক্ষত। খালি পা বাসের অমসৃণ মেঝেতে পড়ে আরো বিক্ষত হয়। আস্তে আস্তে পা ফেলে এগোই, মেডুসা চিৎকার করে, ‘তাড়াতাড়ি করো।’ বাসের দরজা দিয়ে নামতে নামতে মানুষগুলোর আর্তনাদ শুনি, তারপর মেডুসার তীক্ষ্ম চিৎকার। কিন্তু আমি আর পেছনে তাকাই না, কী করে স্টেশনের সামনে দিকে এলাম তা আর মনে নেই, একটি পেট্রোল দেবার স্ট্যান্ডের সামনে মাটিতে পড়ে যাই। আবার জ্ঞান হারাই।
জ্ঞান ফিরে এলো কিছু মানুষের কথাবার্তায়, তাদের কন্ঠস্বর তরুণ, শুয়ে অস্পষ্টভাবে দূর থেকে তাদের পাগুলো দেখি। কাছে এসে তারা উবু হয়ে বসে, শুধুমাত্র তখনই বুঝি এরা দেখতে সেই দোকানগুলোর কুমির-গোসাপ সঙ্করের মতো। এই দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি নেই। কিন্তু ওদের একজন বলল, ‘স্টেশন থেকে একটা কাপড় নিয়ে আয়, ওনাকে ঢাকতে হবে।’ আর একজন বলল, ‘আমি একটা গাড়ি নিয়ে আসছি, এখনই হাসপাতালে না নিলে বাঁচবে না।’ আমি চেষ্টা করি কিছু বলতে, কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বের হয় না। কাপড় নিয়ে এসে আমাকে ঢেকে ওরা আমার মুখে জল দেয়। ওদের মুখের দিকে তাকানো যায় না, সেখানে দ্বিখণ্ডিত জিভ। ওদের একজন বলে, ‘আপনি কোন শহরে থেকে এসেছেন?’ আমার নির্জীব কন্ঠস্বর শুনতে ওরা মাথা কাছে নিয়ে আসে। আমি বলি ‘ঢাকা।’ ঢাকা শুনে ওরা একে অপরের দিকে চায়, এমন যেন ঢাকা নামে কোনো শহর তারা চেনে না, অথবা ঢাকা থেকে আসা মানুষদের বিপর্যয় তারা আগে দেখেছে। মনে হল এই কুমির-গোসাপদের আমাকে হাসপাতালে নিতে ভয় নেই, এরা পুলিশের জিজ্ঞসাবাদকে ভয় করে না। আমি শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে কয়েকটা কথা বলতে পারি, ‘স্টেশনের পেছনে একটা বাস আছে, সেখানে একজন আমাকে বাঁচিয়েছেন, সে আপনাদেরই মতন, তাকে বাঁচান।’ ওদের মধ্যে কয়েকজন আমাকে ছেড়ে সেদিকে যেতে থাকে। আমি বিড়বিড় করে বলি, ‘ওর নাম আদ্রিকা, সে একজন অপ্সরা।’
আবার জ্ঞান হারাবার আগে দেখি সেই নীল প্রজাপতিটি মাটি ঘেঁষে উড়ছে। ওদের কথাগুলো ভেসে আসে, ‘এতো রাতে আগে তো কখনো প্রজাপতি দেখিনি। ঢাকা থেকে এসেছে মনে হয়।’
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
অসাধারণ গল্প। লেখায় জাদু আছে।
গ্রিক পুরাণের সর্পকেশা দেবী মেডুসাকে কখনো এতো আপনজন মনে হয়নি। এই কৃতিত্ব প্রজাপতি আর মানুষের ভাষার মধ্যে সেতুবন্ধনের। কারিগরকে নতমস্তক অভিনন্দন !
দারুণ এই গল্প! এতো সহজ ভাষায় একটি আখ্যান চিন্তায় এতো বাঁক নিয়ে একটি একটি করে কতো অসংখ্য চিত্রকল্প দেখিয়ে গেল! গল্পের বিষয় বাস-নারী এবং শহর, কিন্তু গল্পের শরীর সেখান থেকে নেমে গেল যে জগতে, সেখানে আমরা থমকে দাঁড়াই। সরীসৃপ পুরুষের থেকে নিজেকে আলাদা করতে ক’জন পুরুষ পারে? প্রশ্ন আসছে, উত্তর কেবলই ঝাপসা অথবা প্রজাপতির জীবনের মতো সংক্ষিপ্ত!
দীপেন ভট্টচার্য’র লেখা আরো একখানা অপূর্ব গল্প। আশা জাগানিয়া ও শক্তিশালী। আশা নিয়ে আসুক রেবার মত সব প্রজাপতি, নিরাপত্তা দিক আদ্রিকারা। শক্তিমান এই লেখকের জাদুবাস্তব কল্পনা আজকের হতাশাকে ছাড়িয়ে বাস্তব হোক। হোক নিরাপত্তাহীন জীবনের সবটুকু যাপন নিরাপদ। জাগতিক হতাশা দূর করে দিতে দিলুদেরকে শক্তি জোগাতে মেডুসা ও তাঁর অসংখ্য সর্পিল চুল শুভ শক্তির বিচ্ছুরণ ঘটাক। চরিত্রটি সত্যি হোক। ওয়ার্মহোলের সুড়ঙ্গপথে সত্যি হোক গল্পের সেই ঢাকাই একটি অভয়স্থান, আদ্রিকার মত নাগরিক-প্রাণী যেখানে মানুষকে বাঁচাতে পুলিশের ভয় পাবে না। হাসপাতালে নিয়ে যেতে দু’বার ভাববে না। দরকার হলে হোক তা সমান্তরাল এক মহাবিশ্বের কোন এক নিরাপদ উদ্যান, হোক কল্পনা, হোক তা স্বপ্ন। সুন্দর স্বপ্ন দেখলে হয়ত বা একদিন তা বাস্তব হবে। হয়ত ঘুমের স্বপ্নে আমরা খাঁটি মানুষের মত হই, বিচরণ করি সুস্থ কোন সুন্দর সমান্তরালে, কে জানে? আমার মত সাধারণ পাঠককে দীপেন ভট্টচার্য মেডুসা গল্পের চরিত্রগুলোকে দিয়েই গল্পে জড়িয়েছে আষ্টেপৃষ্ঠে, অনায়াসে, যেখানে লেখক নিজে কিছুই জোর করে করেনি। একেই বলে লেখার জাদু। দুর্দান্ত।
লেখকের সামাজিক দায়িত্ব পালন করেছেন অপূর্ব সুন্দর এক শিল্পকর্মের মাধমে। নমষ্কার ও কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন।
বাহ, দীপেন দা। অনেক দিন বাদে আপনার নিজস্ব ভঙ্গীতে একটু অন্য রকম লেখা। ভাল লাগল।
কী অসাধারণ লেখা , এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। কী সুনিপুণ চিত্রকল্প, পড়তে পড়তে কখন যে নিজেই দিলু হয়ে উঠলাম আর তার যন্ত্রণাগুলি নিজের হয়ে উঠলো , বুঝতেই পারিনি। প্রথম অংশে রেবার গভীর দুঃখ, অভীকের অসহায়ত্ব কী গভীর ভাবেই না বুকে বাজলো, আর সেটাই হয়তো আমাকে “দিলু” হয়ে উঠতে সাহায্য করলো। দীপেন দা , কী অসম্ভব যাদুবাস্তবতায় না গ্রীক আখ্যানের মেডুসাকে এই বাঙালি দিলুর জীবনের কঠিনতম সময়ে মিলিয়ে দিলেন ! ঢাকা শহরে বড় হওয়া মেয়ে হিসেবে জানি আমরা মনে মনে সবাই তো মেডুসার প্রতীক্ষাতেই থাকি। আবার নিজেরাই আদ্রিকা হয়ে দিলুদের পাশে দাঁড়াই, আবার ভিড়ে হারিয়েও যাই। আমরা যারা দিলুর মতো পরিণতি এড়াতে পারি, তারা রেবার মতো প্রজাপতি হয়ে বেঁচে যেতে চাই ।
আহা এমন গল্প পড়লে দীর্ঘক্ষণ এর রেশ মনে থেকে যায় কেননা পড়তে পড়তে পাঠক থেকে আমি নিজেই যে গল্পের চরিত্র, গল্পের অংশ হয়ে উঠি। দীপেন দা আপনি অনন্য ।