ওয়াসি আহমেদ
একে বৃষ্টি, তারওপর জায়গাটা ঘরের বাইরে, মাথার ওপর পলিথিনের ছাউনি থাকলেও বৃষ্টির ব্যাঁকাত্যাড়া ছাঁট আসছে। মিরাজ আশ্চর্য না হয়ে পারল না বৃষ্টির কয়েকটা ফোঁটা গায়ের টানটান চাদরে পড়ামাত্র একটা ঠান্ডা শিউরানি টের পেল। খাটিয়াটাকে খোলা উঠানে না পেতে ঘরের দাওয়ায় রাখলে ছাউনি টানানোর দরকার পড়ত না, যাদের দেখার তারা দাওয়ায় না উঠে নিচে থেকে আলগোছে চাদর সরিয়ে মুখটা দেখে নিতে পারত।
বৃষ্টি অবশ্য হালকা, তবে হাওয়ার কারণে ফিনফিনে তেরচা ছাঁট কিছু সময় পর পর এপাশ-ওপাশ থেকে জ্বালাতন করছে। বুদ্ধিটা তবারকের, সে-ই তোড়জোড় করে উঠানে চারটা বাঁশ পুঁতে নীল পলিথিনের টুকরাটা টানিয়েছে, তার পর মন্নাফকে সঙ্গে নিয়ে ঘর থেকে খাটিয়া বয়ে এনে মাঝউঠানে নামিয়ে তাজ্জব কথা বলেছে, এইখানে ভাইজান আলো-বাতাস পাইব। ওর গাধামি গেল না। আলো-বাতাস কী রে গাধা, বৃষ্টি আছে চোখে পড়ছে না!
বাড়িতে আসার পর কম করে হলেও এগারো-বারো ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। মিরাজের ধারণা ছিল দাফনের কাজ অল্প সময়েই হয়ে যাবে। বৃষ্টির মধ্যে আশপাশের কিছু পড়শি আসবে, আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে একমাত্র ছোট বোন সিতারা ও তার বর মন্নাফ তাদের দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে ছুটে আসবে, আর আসার মধ্যে জগলু ও মাহতাব মাস্টার, এই তো। বাড়িতে থাকার মধ্যে বউ রাবিয়া, ষোলো বছরের ছেলে মনির আর গাধা তবারক।
তবারক ছোটাছুটি করছে, অনেক দিন পর একটা কাজের মতো জুটেছে। বেকার হয়ে ভাইয়ের ঘাড়ে বসে এত দিন খাওয়ার শোধ দিতেই যেন তার ব্যস্ততার কমতি নাই। ব্যস্ততা বা ছোটাছুটি নামেই, কোন আক্কেলে যে উঠানে বৃষ্টির মধ্যে খাটিয়া পাতল, বোনজামাই মন্নাফও তার কথায় সায় দিয়ে ঘর থেকে খাটিয়া বয়ে আনল! এসবের মধ্যে হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে কিছুক্ষণ আগে একটা আছাড় খেয়েছে। কবরে পাতার জন্য বাঁশ কাটা হচ্ছিল উঠানের এক কোণে, যারা কবর খুঁড়বে – তরিবত, মজিদ, আক্কাস – মাপ মতো কেটে, চেঁছে আঁটি বাঁধবে বলে তৈরি, এ সময় তবারক ওদের কিছু বলবে বলে খামোখাই ছুটতে গিয়ে কাদা-পানিতে চিৎ হয়ে পড়ে কোমরে হাত চেপে ঘাড় ঘুরিয়ে ডানে-বাঁয়ে তাকাল- কেউ হাসাহাসি করছে কি না দেখাটাই যেন জরুরি। একটা ধমক দিতে মিরাজের গলাটা জ্বলছে। আহম্মকটাকে তার হয়ে অন্য কেউ একটা ধমক দিলে পারে।
হালকা একটা টোকা- এতেই যা হওয়ার হয়ে গেল, লাট্টু পাকিয়ে পড়ল তো পড়ল গিয়ে দশ ফুট নিচে খাদে! দোষ তারই, জেলাসদর থেকে গত সন্ধ্যায় ফেরার সময় মিনিবাসের হেলপারকে বলেছিল রাজাখালি মোড়ের কিছুটা আগে তাকে নামিয়ে দিতে। হেলপার চাইছিল মোড়ে গিয়ে যেন নামে, ওখানে নামার আরও লোক ছিল। মোড় পর্যন্ত গেলে খানিকটা পিছিয়ে বাড়ির পথ ধরতে হয়। হাঁটার খাটনি বাঁচাতে হেলপারের কাঁধে-পিঠে হাত বুলিয়ে রাজি করাতে ড্রাইভার দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে জোরে ব্রেক চেপেছিল। গাড়িটা থামছে, ধীরেসুস্থে নামলেই পারত। কী যে হয়েছিল, পাদানি থেকে লাফিয়ে নামতে গিয়ে পেছন থেকে আসা একটা পলকা ইজিবাইকের ধাক্কায় – ঠিক ধাক্কা বলা যাবে না, এখনো টোকা-ই মনে হচ্ছে – গোল্লা পাকিয়ে গিয়ে পড়েছিল পাশের খাদে। অল্প সময়েই বুঝতে বাকি থাকেনি যা হওয়ার হয়ে গেছে। ঘাড়টা পড়েছিল নিচে, পাটকাঠি ভাঙার মতো একটা মট্ আওয়াজ পেয়েছিল, আর কিছু না।
গতকাল শহরে যাওয়ার কথা ছিল না। ইউরিয়া ও ট্রিপল সুপার ফস্ফেটের ডিলারশীপ পেয়েছে বছর দুয়েক। রাজাখালি বাজারে যে দোকানটা নিয়েছে, সেটা ছোট, সময়মতো সব মাল ওঠাতে পারে না। বোরো মৌসুমে সারের চাহিদা বাড়লে দোকানে জায়গার অভাবে সারের বেশ কিছু বস্তা বাড়িতে রাখার ব্যবস্থা করেছিল। গতকাল শহরে যাওয়ার দরকার না থাকলেও ভেবেছিল যদি নতুন চালানের খবর পায়, ফিরে এসে বাড়ির বস্তাগুলো গোছগাছ করে জায়গা বের করে রাখবে। গিয়ে শুনেছিল সার পেতে সময় লাগবে, শুধু ইউরিয়া পাবে এবার। আগে খবর পেয়েছিল সরকার নাকি সারে ভর্তুকি বাড়াবে, বাড়ায়নি, বাড়ালেও তার কমিশনে হেরফের হতো না।
ঘরের ভিতর থেকে মেয়ে গলায় কান্নার আওয়াজ আসছে, গলাটা সিতারার। ভাইয়ের জন্য বোন কাঁদবে এ খুবই স্বাভাবিক। মিরাজের বাপ বলত, বিয়ের পর ভাইয়ের জন্য বোনের মায়া বাড়ে, শ্বশুরবাড়িতে বোন পথ চেয়ে থাকে ভাই কবে আসবে। সেসব আগের দিনের কথা, মিরাজের মনে পড়ে তার বাপ বছরে অন্তত একবার তার দুই ফুপুর বাড়ি যেত, আয়োজন করেই যেত- আম-কাঁঠালের মৌসুমে বা রোজার সময়। আবার তাদের নাইওরও আনাত। আজকাল এসব কে করে! মিরাজ একবারই সিতারার শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল, তাও তার বিয়ের পরপর। কাঁদছে যে সিতারা, অন্তর থেকে, যাকে বলে দিলেজানে কাঁদছে। তবে রাবিয়া আর মনিরের সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। রাবিয়া হয়তো ভাবছে এ সুযোগে তার বেকার ভাই মোসলেমকে এ বাড়িতে ঢোকাবে। মোসলেম বেকার হলেও তবারকের মতো গাধা না, দুই বেকার এক সাথে কিছু দিন মিলেমিশে থাকবে, তার পর মোসলেমের আসল চেহারা ফুটবে, সে তবারককে বাড়িছাড়া করে মিরাজের সারের কারবার, সয়সম্পত্তি দখল করবে। এমন সুযোগ কে ছাড়ে! ভাইকে সাহায্য করতে রাবিয়া সায় দেবে। তবারক বোঝার আগেই যা হওয়ার হয়ে যাবে। অনেক দিন ধরে রাবিয়া মোসলেমকে এখানে আনতে নানা কায়দাকানুন করে যাচ্ছে- মোসলেম বেকার হলেও মাথায় বুদ্ধি রাখে, মমতাজে যদি তাকে সঙ্গে রাখে, সারের কারবার চালাতে তার অনেক সাহায্য হবে, শহর থেকে মাল আনা, দোকানে তোলা, বেচা-বিক্রি, স্টকের হিসাব রাখা, আবার মওকা বুঝে লুকিয়ে-চুরিয়ে সরকারের বাঁধা দরের বেশিতে বেচে দেওয়া- কত হাঙ্গামা। তবারককে দিয়ে তো কাজের কাজ কিছু হয় না। এখন মিরাজ নাই, ভাইকে আনতে রাবিয়ার বাধা কিসে! বলা যায় না, আগামিকালই হয়তো বোনের দুঃখে সামিল হতে টুপি মাথায় মোসলেম এসে হাজির হবে। বাড়িতে পা দেওয়ার আগে দুলাভাইয়ের কবর জিয়ারত করে পাকসাফ হয়ে তমিজের সাথে ঢুকবে।
মোসলেমের কথা ভেবে তবারকের জন্য খারাপ লাগছে। আছাড় খেয়ে ভালোই ব্যথা পেয়েছে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। আগামীতে কপালে কী আছে ভাবার শক্তি তার নাই, ভাইকে কবরচাপা দিয়ে একা একা এদিকে ওদিকে ঘুরবে। সিতারা যখন আছে, ছোট ভাইকে ধরে মন খুলে নিশ্চয় অনেক কাঁদবে, তবারককেও কাঁদাবে। কিন্তু মনির কোথায়? বাড়িতে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। বয়স ষোলো পার হতেই বেয়াড়া হয়ে গেছে। ক্লাস নাইনে দুইবার ফেল মেরে মাথায় পড়ালেখার চিন্তা নাই, বাইক কিনে দিতে মাকে দিয়ে তদবিরে কাজ না হওয়ায় কিছু দিন হলো বাপের সামনে আসা ছেড়ে দিয়েছে। এখন কী, আর তো সামনে আসার দরকার পড়বে না, তবে কবরে নামার আগে ছেলেটাকে সামনে পেলে, সে না দেখুক, মিরাজ তো তাকে দেখতে পারত। নিজেরই তো রক্ত, বাপ না থাকা কী জিনিস দুই দিনেই বুঝবে।
একটা ধাঁধা অনেকক্ষণ ধরে মাথায় ঘুরছে, এখন তো সবই দেখছে, শুনছে, কবরে মাটিচাপার পরও কি অবস্থা এ রকম থাকবে, না-কি …
কান্নার আওয়াজ ছাপিয়ে সুর করে কোরান তেলাওতের গলা পাওয়া যাচ্ছে, তাও একজনের না, কম করে হলেও তিন-চারজনের। মাদ্রাসা থেকে এদের কে ধরে আনল? তবারক কাজটা কোন ফাঁকে করল খেয়াল করেনি তো।
রাতটা মহাহুলুস্থুলে গেছে। নিজেরই এলাকা, চারদিকে চেনা-জানা লোকজন। বাড়িতে খবর পৌঁছতে দেরি হয়নি। মিনিবাসটা অবস্থা বেগতিক দেখে দাঁড়ায়নি, এদিকে ইজিবাইকওয়ালার কপাল খারাপ, বেশি দূর যেতে পারেনি, পাকড়াও করে মার আর মার, ভেঙেচুরে তার গাড়িটারও দফারফা। মিরাজ যদি চেঁচিয়ে উঠে লোকজনকে থামাতে পারত! সে উপায় ছিল না, ততক্ষণে তার নতুন নাম দেওয়া সারা- লাশ। কেউ বলছিল লাশটা বাড়িতে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে, কেউ আবার উপজেলা হাসপাতালে। হাসপাতাল কেন, লাশ যে এতে কোনো সন্দেহ নাই, হাসপাতালে লাশ নিয়ে কী হবে? কিন্তু নেওয়াই নাকি নিয়ম, ডাক্তারের সার্টিফিকেট ছাড়া দাফন করা বেআইনি। অনেক হুজ্জতে রাতটা গেছে। হাসপাতাল থেকে বাড়িতে আনতে রাত এগারোটা পার হয়ে গিয়েছিল। কান্নাকাটির ফিরিস্তি লম্বা, যত ঘোরপ্যাঁচের মেয়েমানুষ হোক, রাবিয়া তো তার বউ-ই, আছাড়িপিছাড়ি করে কাঁদছিল। মনির কী করবে বুঝতে পারছিল না। আর তবারকের কথা না বলাই ভালো, হাউমাউ করে চিৎকার করছিল। রাতের কাহিনি থাক। মিরাজের হাঁসফাঁস লাগছিল, মরে গিয়ে লাশ হয়ে সে যে শুধু হাঁসফাঁসের যন্ত্রণায় ভুগবে, এ বড় আশ্চর্যের। আরো আশ্চর্যের, তার যেন রাতারাতি অনেকগুলো চোখ-কান গজিয়ে গিয়েছিল। কে কী বলছে সব শুনতে পাচ্ছিল, দেখতে পাচ্ছিল। মরার পর বাড়তি এতগুলো চোখ-কান গজাবে কারো কাছে শোনেনি। শুনবে কী করে, মরার পর কেউ তো ফিরে এসে নিজের অভিজ্ঞতা বলতে যায় না।
এখন বেলা এগারোটার কম হবে না। বাদজোহর কবর দেওয়ার কথা বলাবলি হচ্ছে। তার মানে আরো অন্তত তিন-চার ঘণ্টা। উঠানের এদিকে ওদিকে লোকজন বাড়ছে। সে যেমন ভেবেছিল তার চেয়ে অনেক বেশি। মেয়ে-পুরুষ মিলে জনা তিরিশেক বা বেশিও হতে পারে। এত মানুষ তার উঠানে কোনো দিন জড়ো হয়নি। জগলু তার ছোটবেলার বন্ধু, মুখ থেকে চাদর সরিয়ে কম করে হলেও চার-পাঁচবার দেখে গেছে। তার সঙ্গে মাহতাব মাষ্টার, সেও বার দুই দেখেছে। জগলু যে এতবার দেখেছে এর কারণ পরিষ্কার, সে অস্থিরতায় আছে- মিরাজকে দেওয়া ধারের টাকার কী গতি হবে? কম তো না, প্রায় লাখ খানেকের মতো। দেব দেব করে মিরাজই ওকে ঘোরাচ্ছিল। গত মৌসুমে টাকার টান পড়ায় এক কথায়ই জগলু টাকাটা দিয়ে দিয়েছিল। টাকা পেয়ে মিরাজ অবাক হয়েছিল, এত সহজে কেউ কাউকে টাকা দেয়! জগলু নিশ্চয় ভাবেনি এত দিনে শোধ হবে না, আর মিরাজের আয়-রোজগার যে মন্দ না এ খবর তার অজানা ছিল না। টাকাটা মেরে দেওয়ার ইচ্ছা তার ছিল কি না বলতে পারছে না। মানুষের মন বোঝা দায়, নিজের মন হলেও। জগলু নরম মানুষ, দু-একবার বলেছে টাকার কথা, তবে বারবার তাগদা দিয়ে বা জোর খাটিয়ে টাকা আদায়ের চেষ্টা সে করত না। এখন কী হবে? টাকাটা তো গেল। মন খারাপ করে ও কি লোকজনকে বলে বেড়াবে? মিরাজ এদিক থেকে মুক্ত, বেঁচে থাকলে টাকা দিত কি না সে আলাদা কথা, কিন্তু এখন যখন সে আর মিরাজ না, উঠানে ডোরাকাটা চাদরমোড়া লাশ, টাকার কথা উঠবে কেন?
ব্যাপারটা বেশ আশ্চর্যের। মরার পরও টাকার মায়া রয়ে গেছে। জগলুকে না দিয়ে, মানে ফাঁকি দিয়ে মরায় কী সুখ সে ঠিক বুঝতে পারছে না। এখন টাকা তার কী কাজে লাগবে? একটা খটকার মতো লাগছে। এদিকে ব্যাংকে লাখ তিনেকের মতো আছে। এ টাকার কথা ভেবেও চিন্তা হচ্ছে। তবে ভরসার কথা, রাবিয়া সহজে টাকায় হাত দিতে পারবে না। সাকসেশন সার্টিফেকেট বের করতে হবে, সময় লাগবে, বিয়ের কাবিননামা দিয়ে প্রমাণ করতে হবে মৃত মিরাজ মন্ডল তার স্বামী ছিল, এছাড়াও আরো কাগজপত্রের দরকার পড়বে। তারপরও ব্যাংক ইচ্ছা করলে ঝামেলা করতে পারে। ভাইকে নিয়ে রাবিয়া টাকাটা কবজা করতে উঠেপড়ে লাগবে সন্দেহ নাই। এতদূর ভেবে মিরাজ অবাক হলো তার হঠাৎ ফুরফুরে লাগছে। কল্পনায় দেখতে পেল ঠোঁটের কোণে একটা আবছা হাসির রেখা উঁকি দিচ্ছে। বিয়ের কাবিননামা রাবিয়া কোথায় পাবে? তার সঙ্গে বিয়ের আগে রাবিয়ার আরেকটা বিয়ে ছিল। বছর বিশ-বাইশ আগে মিরাজ ম্যানেজারি করত সিরাজগঞ্জে রাবিয়ার আগের স্বামী সোবহান মোল্লার হার্ডওয়ারের দোকানে। ওই সময় কারণে-অকারণে রাবিয়া তাকে ডাকত, স্বামী বাড়িতে না থাকলে খাতির করে ঘরে এনে এটা ওটা খেতে দিত, আর আকারে-ইঙ্গিতে আধবুড়ো মোল্লা যে তার দুই চোখের বিষ বোঝাতে বাকি রাখত না। রাবিয়ার রূপ-যৌবন যে তাকে টানত না, তা না। তবে কর্মচারী হয়ে মালিকের বউয়ের দিকে হাত বাড়াতে সাহসে কুলাত না। সাহস রাবিয়াই জুগিয়েছিল, বুদ্ধি দিয়েছিল ভাগার, সঙ্গে ভরসা বলতে তার গয়নাগাটি আর মোল্লার টাকাকড়ি যতটা হাতানো সম্ভব। পরিকল্পনামাফিক কাজ হয়েছিল। বউ ভেগে যাওয়ায় সোবহান মোল্লা তেমন গরজ দেখায়নি, না হলে পুলিশ লাগিয়ে খুঁজে বের করে দুজনকে ইচ্ছামতো প্যাঁদানি দিয়ে জেলের ভাত খাওয়ানো কঠিন কাজ ছিল না। ঝোঁকের মাথায় কাজটা করে ফেলে মিরাজ অনেক দিন ভয়ে ভয়ে কাটিয়েছে। মোল্লা হয়তো রেহাই পেয়েছিল বউ ভেগে যাওয়ায়। কিন্তু ভেগে তো আর বিয়ে ছাড়া বউ নিয়ে বাড়িতে ঢোকা যায় না। কিন্তু তালাক না হওয়া মেয়েমানুষের আবার বিয়ে হয় কী করে! এত কিছু ভাবাভাবিতে না গিয়ে মিরাজের মনে হয়েছিল রাবিয়াকে একটা বুঝ দিলেই চলবে। বুঝটা দিয়েছিল বাড়ি আসার পথে এক নকল কাজিকে দিয়ে বিয়ে পড়িয়ে। কাজি যদি আসলও হতো, বিয়ে বলে তো ঘটনাটা টিকত না। এমন যখন অবস্থা, দেখা যাক রাবিয়া আর তার ভাই মিলে কত দূর যেতে পারে।
একটা পাতিকাক খাটিয়ার চারপাশে অনেকক্ষণ ওড়াওড়ি করছে। কেউ মনোযোগ দিচ্ছে না এ ক্ষোভেই সম্ভবত যে-ইতরামিটা ওর জাতভায়েরা মওকা পেলেই করে, সেও তা-ই করল। ছাউনির একটা বাঁশের মাথায় বসার সুবিধা না পেয়েও কোনোমতে পা আঁকড়ে বসেই পুচুৎ করে ঝেড়ে দিল। নিশানা হয়তো করেছিল কারো মাথা বা ছাতা, পড়ল গিয়ে বৃষ্টিজমাট ছাউনিতে। ছাউনির পানিতে কালো কাকের সাদা টুথপেস্ট রঙের গু মিলেমিশে বিপজ্জনকভাবে টলতে থাকলে তবারক ছুটে এসে একটা কঞ্চি দিয়ে নিচ থেকে জোরে খোঁচা দিয়ে সর্বনাশের যা বাকি ছিল ঘটিয়ে ফেলল। কাকের গু মেশানো পানি অনেকটাই বাইরে পড়ল, তবে কঞ্চির খোঁচায় পলিথিন ছ্যাঁদা হয়ে কয়েক ফোঁটা মিরাজের গায়ের চাদর হয়ে নাভিতে, তলপেটে গিয়ে ঠেকল। আশ্চর্য, মিরাজের এমন বেআক্কেলির জন্য কেউ তাকে বকাঝকা করল না। লাশের ভাই বলে হয়তো রেয়াত পেল। ঘর থেকে কারা যেন দৌড়ে একটা পরিস্কার চাদর এনে বেশ কায়দা করে ধরে নিচের চাদরটা টেনে সরিয়ে নিল। যদিও কেউ জানে না ফোঁটায় ফোঁটায় গু মেশানো পানি ততক্ষনে তার অ-কোষের গোড়ায় পৌঁছে চটচট করছে।
জগলু মনমরা হয়ে উঠানে ঘুরছে। শিকভাঙা ছাতা একটা মাথায় থাকলেও গায়ে যে বৃষ্টির ছাঁট লেগে পরনের পাঞ্জাবির পুরোটাই ভিজে গেছে, সেদিকে খেয়াল নাই। যতবার জগলুর দিকে নজর পড়ছে, ওর মনের অবস্থাটা মিরাজ টের পাচ্ছে। জগলুকে দেখে সবাই ভাববে বন্ধু মারা যাওয়ায় সে এতই ভেঙে পড়েছে, ছাতাটা পর্যন্ত ঠিকমতো মাথায় রাখতে পারছে না। তবে মিরাজ জানে জগলু তাকে শেষ দেখা দেখতে এলেও মনে মনে সে তার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করতে বাকি রাখছে না। বলা যায় না, বারবার কাপড় সরিয়ে মুখ দেখতে গিয়ে ঠোঁট যে নাড়ছে, তাতে মুর্দার রুহের মাগফেরাতের বদলে গালাগালই করছে। কবরে মাটি ফেলার সময় দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে ছোট ছোট মাটির ডেলা ছুড়ে দেওয়া নিয়ম। জগলু কি তখন লোকদেখানো ঠোঁট নাড়বে, আর মিরাজের যাতে বেশি বেশি গোরআজাব হয়, দোজখের আগুনে হাজার বছর পোড়ে, এমন বদদোয়ার ফুঁ-তে মনের ঝাল মেটাবে?
মরার পর এখন অনেক কথাই নতুন করে মাথায় নড়েচড়ে উঠছে। রাবিয়ার সঙ্গে তার বিয়েটা যে ভাঁওতা এত বছর সে ভুলেই ছিল। ঠিক ভুলে ছিল বলা যাবে না, বিষয়টা নিয়ে সে ভাবাভাবিতে যায়নি। কাজটা খারাপ না ভালো সেটা বড় কথা না, সে যে এত বছর ঘটনাটাকে চাপা দিয়ে রাখতে পেরেছে, এমনকি রাবিয়ার মনেও এ নিয়ে খটকা দেখা দেয়নি- এ কি সোজা কথা! জামাই-বউ সেজে সুন্দর এত বছর পার করেছে। কজন পারে? রাবিয়ার অবশ্য কিছু ক্ষতি হয়েছে। বাপ-মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না। বাপ-মা মরার খবর পর্যন্ত সময়মতো পায়নি। ইদানীং মোসলেমের সঙ্গে কীভাবে যেন তার যোগাযোগ গড়ে উঠেছে। মোসলেম বোনকে দেখতে এ বাড়িতে দুই-তিনবার এসেছে। এখন হয়তো পাকাপাকি আসবে। কিন্তু মিরাজ যে একটু আগে ভাবল মোসলেম তার সারের কারবার দখল করবে, কীভাবে? ডিলারশীপ তার নামে, কাগজপত্রে সাফ লেখা ছিল হস্তান্তরযোগ্য নহে, তাহলে? আবার একটা ফুরফুরে হাওয়া টের পাচ্ছে। ডিলারশীপ মোসলেম কবজা করতে পারবে না। আর সম্পত্তি বলতে কিছু ধানি জমি আর এই ভিটা। দখল করবে বললেই হলো! ভাবামাত্র সে অবাক হলো, বলছে না তো কেউ, সে-ই উল্টাপাল্টা ভাবছে।
চটচটে অ-কোষ নিয়ে উঠানে টানটান শুয়ে এসব ভাবতে পারছে বলে তার মন্দ লাগছে না। মানুষ কত আজগুবি কিসসা-কাহিনি বানায়। দুনিয়াদারি আর আখিরাত নিয়ে হুজুরদের কত ওয়াজ-নসিয়ত! দুই দিনের দুনিয়া, মরার সময় সব ফেলেথুয়ে যেতে হবে, সঙ্গে কিছু যাবে না। দুই দিনের দুনিয়া কথার কথা, আটান্ন বছর দুনিয়াদারি করল, কম তো না। আরো দশ-পনেরো বছর বাঁচলে খারাপ হতো না, তবে ঝামেলাও হয়তো বাড়ত। বলা যায় না, লম্বা সময় বাঁচার খেসারত দিতে গিয়ে তার আর রাবিয়ার দুই নম্বরি বিয়ের খবরটা যদি ফাঁস হয়ে যেত। মরে গিয়ে তেমন খারাপ কিছু হয়নি। আর মরল তো মরল এমন কায়দায়, একটা দুবলা পাটকাঠি ভাঙার আওয়াজ ছাড়া কিছু টের পেল না। এদিকে এখন যা কিছু নিয়ে ভাবছে সবই তো দুনিয়াদারি। কোনো টানই তাকে ছেড়ে যায়নি। আগে যেমন ছিল তেমনই আছে।
হঠাৎ একটা শোরগোলের আওয়াজ পেতে তার নজরে পড়ল এলাকার মাতব্বর গোছের কয়েকজন এক সাথে পা ফেলে উঠানে এসে দাঁড়িয়েছে। বৃষ্টি থেমে গেছে বলে তারা মোটামুটি হালকা চালে হাঁটতে পারছে। আশ্চর্য, এদের মধ্যে আমজাদ চেয়ারম্যানকেও দেখা যাচ্ছে। লোকটার এখন চেয়ারম্যানগিরি নাই, তবে একবার নামের সঙ্গে ছাপ্পাটা লেগে গেলে মরা পর্যন্তই না, মরার পরেও লেপ্টে থাকে। গোরস্তানে যেমন লেখা থাকে- মরহুম চেয়ারম্যান অমুক, মেম্বার তমুক, মুহুরি হমুক। আমজাদ চেয়ারম্যান তার বাড়ি আসবে – হোক লাশ দেখতে – এ কোনো হিসাবেই পড়ে না। মিরাজ ভেবে পাচ্ছে না ও কী মতলবে এল? এখনি সে ও তার চেলাচামুন্ডারা এক এক করে চাদর সরিয়ে তার মুখ দেখবে, ঠোঁট নাড়বে- নিয়ম যা। লাশ নিয়ে এই এক সুবিধা, যার যা মন চায় করো, মুখ দেখবে দেখো, খালি মুখ কেন, মন চাইলে চাদর টেনে নামাও, বুক-পেট দেখতে চাও দেখো, ন্যাংটো করে গোসল করাবে করাও। মুর্দা মেয়েলোক হলে কথা আলাদা। জ্যান্ত অবস্থায় মিরাজ পারত এভাবে চিৎ হয়ে বারো-চৌদ্দ ঘণ্টা শুয়ে থাকতে! আর এত মানুষ নতুন বউয়ের মুখ দেখার মতো বিনা নজরানায় মুখ দেখবে, এ তো ভাবাই যায় না।
আজব কথা বলল আমজাদ চেয়ারম্যান। মিরাজ নাকি গেল সপ্তায় তার সাথে দেখা করে সামনের ইলেকশনে তাকে দাঁড়াতে কাঁকুতি-মিনতি করে গেছে। এও নাকি বলেছে জান দিয়ে খাটবে। শালা এত বড় মিথ্যাটা বলতে পারল! সামনে তো লোক কম না, সবাই মিথ্যাটা শুনল। অন্য কথাও বলল- মিরাজ মানুষটা ভালো ছিল, গ্রামের পাঁচজনের উন্নতি নিয়ে তার সাথে অনেক কথা বলত, খোদা যেন বেহেশত নসিব করেন। দুই দুইটা মিথ্যার সঙ্গে বেহেশত নসিব করতে যে বলল এর মানে কী? মন থেকে বলেছে, হতেই পারে না, তবু কেন যেন তার মনে হলো মন থেকে না বললেও বলেছে যখন এ জন্য মিথ্যুক শালাকে ধন্যবাদ।
মাস দুয়েক আগে আমজাদের কাছে মিরাজ গিয়েছিল, তবে ইলেকশনে তাকে দাঁড়াতে বলবে এমন বেয়াকুফ সে না। গিয়েছিল একটা পরামর্শ করতে, বাজারে তার সারের দোকানটা ছোট, পাশে এক টুকরা খালি জমির মালিকানায় ভেজাল আছে, জমির দলিলে নওশের আলী নামে এক লোকের নাম থাকলেও নামজারি হয়নি। লোকটা মারা গেছে, ছেলে একটা আছে, ইয়াবা-ফিয়াবা খায়। জমিটার অন্য পাশে আমজাদ চেয়ারম্যানের সো মিল। একা মিরাজ সামলাতে পারবে না, তবে চেয়ারম্যান সঙ্গে থাকলে এক রাতেই জায়গাটা তারকাঁটার ঘের দিয়ে নিজের সীমানায় ঢোকাতে পারবে। আমজাদের সাহায্য চাওয়া মানে মিরাজ অর্র্ধেকটা জমি তাকে ছেড়ে দেবে, সো মিলের জন্য তারও বাড়তি জায়গা দরকার। আমজাদ জাত ঘুঘু, তার প্রস্তাবে তখন সাড়া দেয়নি, মনে মনে নিশ্চয় আফসোস করেছে বুদ্ধিটা তার মাথায় অনেক আগেই গজানো উচিত ছিল। মিরাজকে সে হ্যাঁ না কিছু বলেনি, তবে দিনকয়েক বাদে মিরাজ যেমন তারকাঁটার ঘেরের কথা বলেছিল, সে তা-ই করেছিল। শুধু ঘের দিয়েই থামেনি, কাঠের বড় বড় গুঁড়ি, চেরাই-আধচেরাই কাঠ ফেলে জায়গাটা যে তার মৌরুসি পাট্টা এমন ধারণা পোক্ত করতে সবই করেছে। মিরাজের হাঁ হয়ে দেখা ছাড়া গতি ছিল না। হারামিটা জায়গা না হয় দখলে নিল, মূল পরিকল্পনা যে মিরাজের এর হাদিয়া বাবদ কিছু নগদ ধরালে তো পারত। ঘের দেওয়ার বুদ্ধি যেদিন থেকে মিরাজের মাথায়, সে ধরে নিয়েছিল অর্ধেকটা জায়গা তার হয়ে গেছে। পাঁচ ইঞ্চি ইটের গাঁথনি দিয়ে ছোটখাটো গুদামের মতো করে ফেললে দেড়-দুই শ বস্তা সার হেলাফেলায় রাখতে পারবে, বাড়িতে একটা ঘরও এতে খালি হবে। কল্পনাও করেনি আমজাদ এমন নাফরমানি করবে। জায়গাটার টান ছাড়া মুশকিল, এখন এই হারামিকে দেখার পর টান আরো বাড়ছে। এত সাধের গুদামের জায়গায় লাকড়ির জঞ্জাল। এই টান তাকে ভোগাবে বুঝতে পারছে। আবার ভালোও লাগছে এই ভেবে বেঁচে থাকতে টাকাকড়ি, বিষয়-সম্পত্তির যে টান ছিল, মরে যাওয়ার পরও তাকে ছেড়ে যায়নি। এ যে একটা গুপ্ত কথা, যারা বেঁচে আছে তারা জানে না। তাই তো তারা ভাবে যা করার বেঁচে থাকতে করে ফেলো। এই কয়েক ঘণ্টায় সে পরিষ্কার টের পাচ্ছে কিছুই ফেলে যাচ্ছে না।
কিন্তু এ কে? বেশ কিছুক্ষণ হলো দাওয়ার খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েমানুষ, মুখটা ঘোমটায় ঢাকা পড়ায় ছোটখাটো গড়নটাই নজরে পড়ছে। কারো সাথে কথাবার্তা বলছে না, সঙ্গে কেউ রয়েছে কি না কে জানে। তাকে কেউ চেনে বলেও মনে হচ্ছে না। কে হতে পারে? মিরাজের মনোযোগে এখন এই ঘোমটামোড়া মেয়েলোকের ওপর। জামকাঠের খুঁটিতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাশ ফিরে, দূর থেকে মুখ দেখা যাচ্ছে না। ভাবতে ভাবতে মিরাজ নিজের অবস্থা যাচাই করল, সে তো চাইলে কাছে গিয়ে দেখে নিতে পারে। নিজের বর্তমান অবস্থা নিয়ে এখনো তার ধারণা পোক্ত হতে বাকি- মানে কতটা তার ক্ষমতা। এগোবে কি না ভাবছে, এমন সময় মেয়েলোকটা ঘাড় ঘুরিয়ে উঠানে ঠিক যেখানে খাটিয়া পাতা সেদিকে নজর করতে মিরাজের মনে হলো কে যেন মাথায় জোরে চাটি মারল। না, চাটি-ফাটি না, মাথাটা যেন চক্কর দিল। ফরিদা না? কী আশ্চর্য, ফরিদাই তো। ওর তো খবর পাওয়ার কথা না, এলই-বা কার সাথে? সেই কোন কালে মিরাজ জায়গির মাস্টার হয়ে থাকত ফরিদাদের বাড়ি, জায়গাটা এ গ্রাম থেকে মাইল দশেক দূরে। ফরিদার বাপ কালাম ব্যাপারির ছিল পেঁয়াজের আড়ত। মেট্রিক সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করলেও মিরাজের অঙ্কের মাথা ছিল ভালো। মেট্রিক-পাশ বিদ্যা দিয়েই সে ক্লাস নাইনের ফরিদাকে অঙ্ক শেখাত, মাঝেমধ্যে সাধ্যমতো পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন নিয়েও বসত। একটু বয়স করে পড়েছে বলে ফরিদার তখন পনেরো-ষোলোর কম না। দেখতে ভালো ছিল না, বাম গালে একটা কালো আঁচিল ছিল, তবে সবে বাড়ন্ত একটা মেয়ে বই-খাতা নিয়ে সামনে বসবে আর সে তার আঁচিলওয়ালা গালে না তাকালেও শরীরের অন্য কোথাও চোখ পড়বে না কী করে হয়! ফরিদা তাকে বলত, আপনে কলেজে পড়লে অনেক উন্নতি করবেন। শুনে মিরাজ বড় করে নিঃশ্বাস ফেলত যার মানে সেই পুরনো কাহন- সাধ আছে, সাধ্য কই! কীভাবে যেন এই নিঃশ্বাস ফেলার ঘটনাটা বেপারির কানে চলে গিয়েছিল। সে কাউকে না বলে দিনকতক চিন্তা করেছিল, পরে ফরিদার মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে সাব্যস্ত করেছিল জায়গির মাষ্টারের কলেজ পড়ার খরচ সে দেবে, আইএ-বিএ যা পড়তে চায়, তার নিজের তো ছেলে নাই, তবে এর বদলে যে কিছু দরকার। সেটা নতুন কিছু না, গরীব মেয়েজামাইকে পড়ার খরচ দিয়ে সাহায্য করা কোনো ব্যাপার না। এমন ঘটনা আকছার ঘটছে। ব্যস, মিরাজের কলেজে পড়ায় সাধ আর সাধ্যের গরমিল মিটে গিয়েছিল। এর পর পাক্কা দুই-অড়াই বছর ফরিদাদের বাড়িতে তার মাগনা থাকা-খাওয়া। জায়গির মাষ্টার নামটা টিকে থাকলেও সেটা তখন জরুরি ছিল না, কারণ মেট্রিক ফেল করে ফরিদার লেখাপড়ার পাট চুকে গিয়েছিল। বেপারি চেয়েছিল মেয়ের যখন লেখাপড়া শেষ, বিয়েটা হয়ে গেলে কী ক্ষতি! এদিকে মিরাজও জানত তার জন্য ফরিদা বসে আছে। ফলে সময়-সুযোগমতো ফরিদাকে ভোগ করার সব ধান্দাই সে কাজে লাগাত। ফরিদার আপত্তির কারণ ছিল না, দুই দিন পর যখন সব ডাল-ভাত হয়ে যাবে। লাভ যা হয়েছিল মিরাজের, ফাও লাভ। কলেজে ভর্তি হয়েই বুঝতে পেরেছিল লেখাপড়া তার কাজ না। দুই বছর ফরিদার বাপের টাকা উড়িয়ে সে ভাবছিল একটা দাও মেরে কেটে পড়বে, হবু বউ হিসাবে ফরিদাকে কোনো দিনই সে মাথায় আনেনি। দাও মারার বুদ্ধি একটা মাথায় এসেছিল, ব্যবসা করতে টাকা চাইবে, কিন্তু কপাল খারাপ, কালাম ব্যাপারি হঠাৎ মারা যাওয়ায় সেটা আর হয়নি। তবে একটা লাভ হয়েছিল, সে ফাঁকতালে সটকে পড়েছিল। কয়েক বছর নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি শেষে সিরাজগঞ্জে সোবহান মোল্লার হার্ডওয়ারের দোকানে কাজ নিয়ে মোটামুটি আরামে ছিল। রাবিয়ার নজর তার ওপর পড়তে আরামটা আরো বেড়েছিল।
ফরিদাকে তার এত বছর পর চেনার কথা না। চিনল কী করে? দূর-দূর থেকে খবর পেয়েছিল ফরিদার বিয়ে হয়নি, গালের আঁচিলটাই সম্ভবত কারণ, আর বেপারি মরার পর ওদের অবস্থাও পড়ে গিয়েছিল। এখানে কী চায় ফরিদা? এত বছর যার সাথে কোনো যোগাযোগই ছিল না, সে আজ কী হাসিল করতে এল? ব্যাপারটা ধাঁধার মতো ঠেকছে। না-কি ফরিদা না জেনেই এসেছে, এসে দেখছে সে লাশ হয়ে উঠানে।
সেই যে ফরিদা উঠান বরাবর খাটিয়ার দিকে তাকিয়েছে, তাকিয়েই আছে। মাথার ঘোমটা কপাল ছেড়ে কিছুটা পেছনে সরে যেতে এখন পুরো মুখটা দেখা যাচ্ছে। আঁচিলটা আগে বাম গালে ইঞ্চি দুয়েক জায়গা জুড়ে ছিল, এখন একে আঁচিল কে বলবে? গোটা গাল দখল করে ফেলায় মুখটাকে মনে হচ্ছে এসিড-পোড়া। এ অবস্থায় ওকে চেনার কথা না মিরাজের, কিন্তু এক নজর তাকিয়েই যে চিনল, এ কী করে সম্ভব! আর এখন ফরিদাকে দেখতে গিয়ে হঠাৎই একটা স্মৃতি মাথায় টনটন করে উঠল। ফরিদার বাম বুক ছিল জোড়ের অন্যটার চেয়ে আঁটো বাঁধুনির, খয়েরি বোঁটার পাশে বড়সড়ো তেলতেলে তিল খোলা চোখে চেয়ে থাকত। তিলটার কথা মনে পড়তে সে অবাক না হয়ে পারল না- শরীরে সাড় পাচ্ছে!
এরা দেরি করছে কেন? জোহরের আজান হতে এত সময় লাগার কথা না। কবর নিশ্চয় এত সময়ে তৈরি, সাড়ে তিন হাত মাটি খুঁড়তে কতক্ষণ লাগার কথা! এদিকে তবারক বা মন্নাফকে আশেপাশে দেখতে পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ আগে যারা খাটিয়া ঘিরে দাঁড়িয়েছিল, তারা খানিকটা দূরে সরে গিয়ে জটলা পাকাচ্ছে। এটা বেশ আশ্চর্যের। এক ফাঁকে সে জটলার মধ্যে জগলুকে দেখল, আরো কারা যেন আশেপাশে, চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু ঠিক ধরতে পারছে না। আর এটা কী দেখছে, জামকাঠের খুঁটি ছেড়ে দাওয়া থেকে নেমে ঘোমটায় বাম গাল ঢেকে ফরিদাও জটলার দিকে হাঁটছে। তাজ্জব ব্যাপার। সে অনেক চেষ্টা করল ওদের মতিগতি বুঝতে, পারল না। গতরাত থেকে যে ক্ষমতাটা তার ওপর ভর করেছিল সেটার শক্তি-সামর্থ্য কি ক্ষয়ে যেতে শুরু করেছে? এখন আর আগের মতো মানুষের কথাবার্তা বুঝতে পারছে না। শুধু দেখতে পাচ্ছে, আর যা দেখছে তাতে ভিতরে একটা কুডাক টের পাচ্ছে- এরা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। ফরিদা যে ফরিদা, জীবনে এ বাড়িতে আসেনি, হয়তো এ গ্রামেও পা দেয়নি, সেও যখন জটলায় গিয়ে শরিক হচ্ছে, ঘটনা তাহলে সেরকমই।
এসব যে দেখতে হচ্ছে এটাই এখন বড় যন্ত্রণা। মরেই যখন গেছে, অল্প সময়ে কবরে ঢুকবে, দেখাদেখির এ কেরামতির কী দরকার ছিল! জ্যান্ত থাকতে একটা সুবিধা ছিল, দেখতে না চাইলে চোখ বন্ধ করলেই হলো, এখন সে উপায় নাই। চোখই নাই, খোলা বা বন্ধ করার প্রশ্ন ওঠে না; কিন্তু চোখ ছাড়াই যে দেখছে, মাত্র দুই জোড়া না, দুই জোড়ার বেশি অদৃশ্য চোখ দিয়ে ছেনে ছেনে দেখছে। মিরাজ দেখে যাচ্ছে, দেখে যাওয়া ছাড়া যেন উপায় নাই। যত দেখছে একটা অঘটনের আলামত টের পাচ্ছে। কিন্তু এর পরও যে দেখার বাকি ছিল সে কী করে আন্দাজ করবে! তার কি কল্পনায়ও ছিল উঠানের জটলায় রাবিয়ার আসল স্বামী সোবহান মোল্লাকেও দেখবে! এত বছর বাদে তাকেও তার চেনার কথা না, লোকটার আগে দাড়ি ছিল না, এখন মেন্দিতে লালে লাল হালাল দাড়িতেও ঠিক চিনতে পারল।
কী হচ্ছে! মিরাজের মনে হচ্ছে সব তার মনের ভুল। কোথায় সিরাজগঞ্জ আর কোথায় মনোহরদি! এত দূর থেকে এই বুড়ো-হাবড়া কী করে এত জলদি চলে আসবে! আসবেই যদি, বিশ বছর আগে পুলিশ নিয়ে আসলে বলার কিছু ছিল না- মিরাজের কপালে তখন যত খারাবিই থাকুক। কিন্তু লোকটা যে এক হাতে লুঙ্গি গুটিয়ে কাদা-পানি বাঁচিয়ে জটলায় গিয়ে মিশল, এ কি দেখার ভুল? তার মন বলল, ভুল। ভুল দেখছে মিরাজ। স্বপ্নে যেমন হয়। সোবহান মোল্লা ভুল, ফরিদা ভুল, জগলুও কি ভুল? জটলা-ফটলা কিছু না, ভুল। জীবনভর যা যা করেছে, সেসবই এখন মওকা পেয়ে ছাড়াছাড়াভাবে স্বপ্নে উঁকি দিচ্ছে। সময় যত যাবে, আরো বেশি বেশি করে শুধু উঁকিই না, ভীড় করবে।
কাকটা আবার ফিরে এসে উড়াউড়ি করছে, এটা সেটাই। ওর কায়দাকানুনে পরিষ্কার, ঠিক একই ভাবে খাটিয়ার চারপাশ ঘিরে চক্কর কাটছে। কাকটাও কি ভুল? এ কী করে হয়! ভেজা অন্ডকোষ সাক্ষী। কাকটাকে দেখামাত্র চটচটে অস্বস্তিটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। তবে এবার আর ছাউনির খুঁটিতে না বসে কাকটা যেন ঠিক করেছে কারো মাথাকে নিশানা করবে। মিরাজ দেখল উড়ে গিয়ে জটলার ওপরে হালকা চালে ডানা মেলে সে যেন সিদ্ধান্ত নিতে সময় নিচ্ছে- কোন মাথাটাকে তাক করবে।
এতক্ষণে মিরাজের মাথায় অন্যরকম একটা চিন্তা খোঁচা দিল। সে যে মরে গেছে এর প্রমাণ কি শুধু উঠানে খাটিয়ায় শোয়ানো লাশ-ছ্যাঁদা পলিথিনের ছাউনির নিচে টানটান চাদরমোড়া?
খুব চটচট করছে, চুলকাচ্ছেও। ইচ্ছা করছে জায়গাটা ভালোমতো চুলকে নেয়। মন বলছে চাইলে পারবে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
অসাধারন। গল্পের আঁটসাঁট বুনট মুগ্ধ করল।