short-story-missing-diary

মিসিং ডায়েরি হিমাদ্রি
কিশোর দাশগুপ্ত


প্রশান্ত নিয়োগী থানার ডিউটি অফিসারের মুখোমুখি বসার পর অফিসার বললেন, “বলুন আপনাকে কী সাহায্য করতে পারি? তার আগে আপনার নাম পরিচয়টা জানাবেন।” প্রৌঢ় প্রশান্ত নিয়োগী নিজের টাকে একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে বললেন, “আমি প্রশান্ত নিয়োগী, বাঁশদ্রোনির বাসিন্দা। আপনি হয়তো বিশ্বকর্মা রোডওয়ের নাম শুনেও থাকতে পারেন। কনস্ট্রাকশন কম্পানি। আমি সেই কোম্পানির চিফ এক্সিকিউটিভ।”

বিশ্বকর্মা রোডওয়ে নামটার সঙ্গে অনেকেই পরিচিত। এই কোম্পানি দেশের বড় বড় রাস্তা হাইওয়ে ব্রিজ নির্মাণ করে। অফিসারও কোম্পানির নামের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। এই লোকটা সেই কোম্পানির শীর্ষকর্তা! নিশ্চিত ওই আগন্তুকের সঙ্গে সমাজের ওপর মহলের পরিচয় আছে। নেতা মন্ত্রী আমলাদের সঙ্গেও পরিচিতি আছে। তাই প্রশান্তর পরিচয় জানার পর পুলিশ অফিসার একটু সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বলুন স্যার। কেন এসেছেন? কনস্ট্রাকশন সাইটে কোন তোলাবাজির ঘটনা! নাকি সাইট থেকে মেশিনপত্র খোয়া গেছে। লেবার প্রবলেম?” প্রশান্ত বললেন, “না ওসব কিছু নয়। আমি একটা মিসিং ডায়েরি করতে এসেছি।”

“কে মিসিং?” সোজা হয়ে বসে জানতে চাইলেন অফিসার।

প্রশান্ত একটু চুপ করে থেকে জবাব দিলেন, “আমার সহোদর।”

“কী নাম তার? কবে থেকে মিসিং? বয়স কত?”

প্রশান্ত বললেন, “নাম পুলু নিয়োগী। বয়স ওই ধরুন আঠারো” এই কথা বলে একটু চুপ করে থেকে তিনি বললেন গত তিনদিন ধরে সে বাড়িতে নেই, মানে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশ অফিসার জানতে চাইলেন, “মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলেন? সুইচ অফ বলছে নাকি?” প্রশান্ত উত্তর দিলেন, “না সে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে না।” আজকালকার ছেলেমেয়েরা ছোটবেলা থেকেই মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। যে নিখোঁজ হয়েছে সে মোবাইল ব্যবহার করে না জেনে অফিসার মৃদু বিস্মিত হয়ে বললেন, “মোবাইল ফোন ব্যবহার করত না? ফোন নম্বর থাকলে ট্র্যাক করে তাকে খোঁজার সুবিধা হত। আপনার কি ধারণা ওটা কোন কিডন্যাপিং-এর ব্যাপার?”

একটু চুপ করে থেকে প্রশান্ত বললেন, “মনে হয় না। তাকে কিডন্যাপ করে লোকের কি লাভ তার তো টাকা-পয়সা ছিল না এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতো সাঁতার কাটতো ঘুড়ি ওড়াতো ফুটবল খেলত, মাঝে মাঝে স্টেডিয়ামে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের খেলা দেখতে যেত। ওসব নিয়ে ভালোই কাটছিল তার।”

অফিসার বললেন, “আপনি বড় চাকরি করেন যে। বড় বাড়ির ছেলে তার কাছে পয়সা না থাকলেও আপনার কাছে তো আছে, সেই জন্য কেউ তাকে কিডন্যাপ করতে পারে!”

“তেমন হলে তো আমার কাছে মুক্তিপণ চেয়ে ফোন বা চিঠি আসতো। তেমন তো কিছু আসেনি” জবাব দিলেন প্রশান্ত।

অফিসার কথাটা শুনে একটু ভেবে নিয়ে বললেন, “তা বটে। তবে কি আপনার মনে হয় যে স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে? আজকাল এইসব ছেলেদের মতিগতি বোঝা ভার। আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবের বাড়ি খোঁজ নিয়ে দেখেছেন? আপনার বাড়ির অন্যরা কিছু অনুমান করতে পারছেন!”

প্রশান্ত বললেন, “আত্মীয়-স্বজন বন্ধু বান্ধবের বাড়িতে সে নেই। আর বাড়িতে তো বাবা-মা মারা যাবার পর আমি আর সেই থাকতাম।”

“সে কি রাজনীতি টাজনীতি করত?”

“না ওইসব পলিটিক্স ইত্যাদিতে সে জড়ায়নি। ওই যে বললাম মাছ ধরা, ঘুড়ি ওড়ানো, খেলাধুলা ওসব নিয়েই সে থাকতো” এই কথা জানাবার পর অনেকটা স্বগতোক্তির স্বরে প্রশান্ত বললেন, “আমার উপর কোম্পানির বড় দায়িত্ব, অনেক চাপ আজ দিল্লি তো কাল চেন্নাই কখনোবা দেশের বাইরে ছুটতে হয় তার উপর আমি নজর রাখতে পারিনি। কখন কিভাবে যে হারিয়ে গেল বুঝে উঠতে পারলাম না।”

পুলিশ অফিসার জানতে চাইলেন, “ওর কোনো ছবি আছে?”

নিখোঁজ ভাইয়ের একই ছবির বেশ কয়েকটা প্রিন্ট সঙ্গে করে এনেছিলেন প্রশান্ত। পকেট থেকে ছবির খামটা বের করে তার মধ্যে থেকে একটা ছবি তিনি এগিয়ে দিলেন অফিসারের দিকে। ছবিটা ভালো করে দেখলেন অফিসার। ওই ১৭-১৮ বছরের এক তরুণের ছবি। মাথায় এক ঝাঁক কোঁকড়া চুল আর বয়সের দিকটা বাদ দিলে ছেলেটার সঙ্গে মিল আছে অফিসারের সামনের মানুষটার। সহোদর যখন তখন মিলটা থাকা স্বাভাবিক এই কথা ভাবলেন অফিসার।

তার অন্য কাজ আছে তাই তিনি মিসিং ডায়েরি লিখতে বসলেন, দ্বিতীয়বার তথ্যগুলো মিলিয়ে নিলেন। একই সময় প্রশান্তর কাছ থেকে একটা বয়ান লিখিয়ে রাখলেন। এসব কাজ মেটার পর পুলিশ অফিসার বললেন, “আমি সব কাগজপত্র লাল বাজারে মিসিং পার্সন স্কোয়াডে পাঠিয়ে দিচ্ছি আশেপাশের থানাগুলোতেও মেসেজ পাঠিয়ে রাখছি। এই ছবি সমেত সন্ধান চাই বলে বিজ্ঞাপন করা হবে। ওকে খোঁজার জন্য চেষ্টা ত্রুটি রাখবো না আর একটা কথা সে যদি নিজে থেকে ফিরে আসে অথবা আপনি যদি তার কোন খোঁজ পান তবে থানায় এসে অবশ্যই জানিয়ে যাবেন, স্যার।” পুলিশ অফিসারের কথার জবাবে বিষন্নভাবে ‘জানাবো’ বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন প্রশান্ত। তারপর নমস্কার বিনিময় করে থানা থেকে বেরিয়ে পড়লেন।




থানার বাইরের রাস্তার গায়ে তার ক্যাডিলা গাড়িটা পার করে রেখেছিলেন প্রশান্ত। মহার্ঘ গাড়ি কলকাতা শহরের কিছু উচ্চবিত্ত মানুষ ছাড়া কারোর কাছে ও ওই কোম্পানির ওই মডেলের গাড়ি নেই। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু সিভিক পুলিশ বিস্ময়ের দৃষ্টিতে গাড়িটাকে দেখে কি যেন আলোচনা করছে নিজেদের মধ্যে। সম্ভবত গাড়িটার সম্পর্কেই, তাদের পাশ কাটিয়ে কম্পাউন্ড ছেড়ে বেরিয়ে গাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালেন প্রশান্ত। মনে মনে ভাবলেন কোথায় যাবেন তিনি গত তিন দিন বাড়ির বাইরে বেরোননি। যার খোঁজে তিনি থানায় এসেছিলেন তার হারিয়ে যাওয়া অন্তর্ধানের কারণে এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা গ্রাস করে রেখেছে তাকে। কোম্পানি তাকে পদোন্নতির চিঠি দিয়েছে। এম.ডি হিসাবে নিয়োগ করার প্রস্তাব দিয়েছে। সিনিয়র একজন এম.ডি কলকাতাতেই থাকেন। তার সঙ্গে তাকে সাক্ষাৎ করতে বলা হয়েছে, কারণ তার কাছেই নিয়োগ পত্র রাখা। যেটা গ্রহণ করে প্রশান্তর হেড অফিস যাওয়ার কথা। কী করবেন? তার সঙ্গেই কি দেখা করতে যাবেন? নাকি বাড়ি ফিরে যাবেন? যে হারিয়ে গেছে তার জন্য থানায় আসা, খোঁজ করা, মন খারাপ করা বেশি হচ্ছে প্রশান্তর জীবনে। আরও বড় হওয়া প্রতিষ্ঠিত হওয়া এখন পৃথিবীর লক্ষ্য। আরও উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত হও এটাই তো এখন সমাজ জীবনের আদর্শ, তার জন্য যদি অন্য কাউকে ত্যাগ করতে হয়, তাও ভালো।

অবশ্য অনেকেই প্রশান্তকে খানিকটা ক্ষ্যাপাটে স্বভাবের বলে সে যদি আরও বাস্তববাদী হত তবে আরো উন্নতি করতে পারত, কোম্পানির অংশীদার হতে পারত। গাড়ির চাবি হাতে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলেন কোথায় যাবেন। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল একটা জায়গার কথা। কলকাতা থেকে ঘন্টা তিনে দূরত্বে একটা রাস্তা নির্মাণের কথা তার কোম্পানির। সেখানে একটা বড় পুকুর আছে। রাস্তার পাশে মাঠ আছে। সত্যি কথা বলতে কি ওসব দেখেই তার মনে পড়ে গেছিল নিরুদ্দেশের কথা আর বাড়ি ফিরে এসে তিনি দেখলেন সে নেই। কোথায় যাবেন ভাবতে ভাবতে প্রশান্তর হঠাৎ মনে হল সেই জায়গাতেই একবার ঘুরে আসা যেতে পারে! হয়তোবা ওটাও তার মনের পাগলামি। রিস্ট ওয়াচ দেখলেন প্রশান্ত। বেলা দশটা বাজে, জায়গাটাতে গিয়ে বিকালের মধ্যেই ফিরে আসতে পারবেন তিনি, গাড়িতে উঠে সেই জায়গার উদ্দেশ্যেই রওনা হয়ে গেলেন। কিছুটা চলার পরই কোম্পানির বড়কর্তার ফোন এল। তিনি জানতে চাইলেন তিনদিন ধরে তার কোন খবর নেই কেন, অফিস অ্যাটেন্ড করছেন না কেন, নতুন পদে জয়েন করার চিঠি নিতে এম.ডির সঙ্গে যোগাযোগ করছেন না কেন! প্রশান্ত সংক্ষিপ্ত জবাব দিলেন, “সব ঠিক আছে কলকাতার বাইরে নতুন প্রোজেক্টের জায়গাটা একবার দেখে আসতে যাচ্ছি।” তারপর তার কর্তব্যপরায়ণতায় খুশি হয়ে বড়কর্তা বললেন, “ঠিক আছে যান। আপনাকে তারিফ করতে হয়, অন্য কেউ হলে পদোন্নতির খবর পাবার পর আর ওখানে যেত না। যে আপনার জায়গায় আসবেন তার ওসব দেখার দায়িত্ব। কাল আপনি আমাকে ফোন করবেন” কথা না বাড়িয়ে “আচ্ছা” বলে ফোন রেখে দিলেন প্রশান্ত। যে নিখোঁজ তার কথা ভাবতে ভাবতে গাড়ি চালিয়ে এগোলেন তিনি। এক সময় কলকাতা শহরের বাইরে বেরিয়ে পড়লেন। রাস্তার দুপাশে নগর সভ্যতা ঘরবাড়ি ক্রমশ অদৃশ্য হতে লাগল। ফাঁকা জমি মাঠ পুকুর চোখে পড়তে লাগল তার। একসময় তার বাড়ির চারিপাশও এমনই ছিল। একসময় চা পানের জন্য গাড়ি থামালেন তারপর আবার তিন ঘন্টার রাস্তা পেরিয়ে পৌঁছে গেলেন নির্দিষ্ট স্থানে। মেঠো রাস্তা চলে গেছে দিকচক্রবালের দিকে। যে রাস্তা পাকা সড়কে রূপান্তরিত করার দায়িত্ব পেয়েছে তার কোম্পানি। রাস্তার এক পাশে গাছের ছায়া ঘেরা একটা পুকুর। জমি ঢালু হয়ে নেমেছে পুকুরে। তার পাশেই একটা ফুটবল মাঠ। বাঁশ দিয়ে বানানো গোলপোস্ট দুটো মাঠের দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে। প্রশান্ত দেখলেন একটা লোক পুকুর পাড়ে মাথায় ছাতা নিয়ে ছিপ ঠেলে বসে আছে পুকুরের কাছাকাছি রাস্তার পাশে একটা ছোট ঘর। সেটাকে চায়ের দোকান ভেবে তার সামনে গিয়ে রাস্তার এক পাশে গাড়িটা দাঁড় করালেন। গাড়ি থেকে নেমে এগোলেন দোকানটার দিকে, নির্জন দুপুর। যে লোকটা মাছ ধরছে, সে ছাড়া আর কোন লোকজন দেখা যাচ্ছে না চারিপাশে।




দোকানটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন প্রশান্ত একজন বুড়ো লোক দোকানের ভিতর বসে ঝিমুচ্ছিলেন। সে প্রশান্তকে দেখে সোজা হয়ে বসল। তবে দোকানটা চায়ের দোকান নয়। মাছ ধরার সামগ্রীর দোকান। ছিপ হুইল, সুতো, মাছের চার বা খাবার সবই রাখা আছে দোকানে, একটা গন্ধ আসছে দোকানের ভিতর থেকে। প্রশান্তর নাকে অনেকদিন পর সেই চেনা গন্ধ এসে লাগল। ওটা পিঁপড়ের ডিমের গন্ধ। মাছের চার বা টোপ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। প্রশান্তর পরনে শহুরে পোশাক। টিশার্ট, জিন্স, পায়ে স্নিকার্স। তাকে দেখে দোকানদার একটু ইতস্তত করে বলল, “বাবু কি মাছ ধরতে এসেছেন নাকি? আমার কাছে রেডি ছিপ ভাড়া পাওয়া যায়। খাবারও আছে। পুকুরটা আমিই দেখাশোনা করি। অনেক বড় বড় মাছ আছে পুকুরে।”

লোকটার কথা শুনে প্রশান্ত চুপ করে রইলেন। দোকানের ভিতর সাজিয়ে রাখা জিনিসগুলো দেখতে থাকলেন। অমন ছিপ একসময় তার বাড়িতেও ছিল। লোকটা তারপর বলল, “মাছ ধরার জন্য ৫০ টাকা টিকিট। আপনি যতক্ষণ খুশি বসে থাকুন না কেন, যত বড় মাছ ধরুন না কেন আর এক পয়সাও দিতে হবে না। শহর থেকে অনেক বাবুরাই এসে বড় বড় মাছ ধরে নিয়ে যান। ছিপ ভাড়া মাছের চার আর টিকিটের সব মিলিয়ে একশ টাকাতেই হয়ে যাবে।”

দোকানদারের কথাটা যেন প্রশান্তর মধ্যে অনেকদিন পর ঘুমিয়ে থাকা অন্য প্রশান্তর উদ্দেশ্যে হাঁক দিল। নিজের অজান্তেই তিনি দেয়ালের গায়ে দাঁড় করানো একটা ছিপের দিকে হাত বাড়ালেন। আর এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ছিপ, চার ইত্যাদি মাছ ধরার সামগ্রী নিয়ে পুকুরের ধারে এক জায়গায় গিয়ে বসলেন যে জায়গায় মাথার উপর গাছের ছায়া আছে। ছিপ ফেললেন জলে। নির্জন পুকুরপাড়। ফড়িংয়ের দল ওড়াউড়ি করছে জলের ওপর — সব জল ফড়িং। চারিপাশে কোন শব্দ নেই। কিছুক্ষণ বসে থাকার পরই প্রশান্তর ছিপের ফাতনা নড়ে উঠলো। বড়শিতে ঠোকর দিচ্ছে মাছ। বার কয়েক অমন হবার পর মাছ খাবার গিলছে অনুমান করে তিনি হ্যাচকা টানে ছিপটা ওঠালেন। ছিপের আগায় দুপুর রোদের আলোতে লাফাচ্ছে। বড়শিতে আটকে একটা ছোট মৃগেল মাছ। তাকে বড়শি থেকে ছাড়িয়ে পাশে রাখতে রাখতে প্রশান্ত ভাবলেন মাছ টানার কৌশল তিনি ভোলেননি এখনো। গত তিন দিনের বিষণ্ণতার পর এই প্রথম যেন একটা ভালো লাগার অনুভূতি সৃষ্টি হল মনে। আবার জলে ছিপ ফেললেন তিনি। ফাতনার দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে যেতে লাগলো পুরনো স্মৃতি। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা বড় আকারের তেলাপিয়া উঠে এল তার ছিপে। এবার উত্তেজনার আনন্দে চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু নিস্তব্ধতা ভঙ্গ হলে কিছুটা দূরে যে লোকটা মাছ ধরছে তার বিরক্তি হতে পারে তাই প্রশান্ত নিজেকে সংযত করলেন। মাছটা ছিপ থেকে খুলে নিয়ে আবার ছিপটা ফেললেন জলে। সময় এগিয়ে চলল আর ধীরে ধীরে প্রশান্তর মনের বিষন্নতা কেটে যেতে শুরু করল। তার যেন মনেই পড়তে চাইল না আজ সকালে তিনি একজনকে খোঁজার জন্য থানাতে গিয়ে নিখোঁজ ডায়েরি করে এসেছেন। মাছ ধরতে বসলে সময় কিভাবে কেটে যায় তা বোঝা যায় না। প্রশান্তর ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হলো না সেই ঘটনার। চিন্তা ছিন্ন হল তার। একদল ছেলে ফুটবল মাঠের দিকে আসছে বল নিয়ে, বিকাল হয়ে গেছে, ইতিমধ্যে আরো বেশ কয়েকটা মাছ ধরে ফেলেছেন তিনি প্রায় কেজি খানেক মাছ হবে ছোট বড় সব মিলিয়ে। প্রশান্তর মনে হল এবার তাকে ফিরতে হবে। যে প্লাস্টিকের প্যাকেটে দোকানদার মাছের চার দিয়েছিলেন তাতে মাছগুলো নিয়ে ছিপ তুলে উঠে পড়লেন তিনি। দোকানের কাছে ফিরে ঠিক ফেরত দেবার পর মনে হল এই মাছগুলো নিয়ে কি করবেন তিনি! ফ্রিজ ভর্তি খাবার আছে। তাছাড়া ইদানিং মাছ-মাংস খেতে আর ভালো লাগে না। ছেলের দল মাঠের ধারে পৌঁছে গেছে। প্রশান্তর মনে হল মাছগুলো ছেলেরা যদি নেয়। তিনি এগোলেন মাঠের দিকে। খেলা এখনো শুরু হয়নি। মাঠের ধারে খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল ছেলেগুলো। চোদ্দ পনেরো বছর বয়সী আশপাশের গ্রামের ছেলে। দু একজনের বয়স কম বেশি আছে। প্রশান্ত তাদের সামনে হাজির হতে বিস্মিত ভাবে তারা তাকালো। তাদের কাছে ডেকে মাছগুলো দেখিয়ে বলল, “তোমরা এগুলো কেউ নেবে? পয়সা দিতে হবে না। একটু আগেই পুকুর থেকে ধরেছি” মাছগুলো দেখে আর প্রশান্তর কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন বলে উঠলো, “হ্যাঁ হ্যাঁ নেব।” সরল মনের বালক সব। তাদের মনে এখনো তেমন কোনো সন্দেহ বা আত্মসম্মানবোধ তৈরি হয়নি। মাছের থলেটা একজনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে প্রশান্ত পিছু ফিরে তার গাড়ির দিকে এগোতে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময় একটা ছেলে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বলে উঠল, “তুমি আমাদের সঙ্গে খেলবে?” কথাটা কানে যেতেই মৃদু চমকে উঠে ছেলেগুলোর দিকে ফিরে দাঁড়ালেন তিনি। ছেলেগুলো তাকিয়ে আছে। একটা ছেলে বলল, “আসো, খেলো আমাদের সঙ্গে” তারপর আরো একজন বলল, “আমাদের সঙ্গে খেললে ভালো লাগবে তোমার।” সরলমতি ছেলেদের আহ্বান। কিন্তু প্রশান্তর মনে হল যে, আহ্বান যেন ভেসে আসছে তার অতীত থেকে। যখন এমন বয়স ছিল তার, তখন তাদের বাড়ির কাছে মাঠ ছিল। কলকাতা শহর আর ফ্ল্যাটবাড়ি গ্রাস করে নেয়নি সব মাঠকে। সবচাইতে বড় কথা প্রশান্ত তখন অফিসের কোম্পানির কাজ সর্বস্ব একজন মানুষে রূপান্তরিত হয়নি। এই আহ্বান যেন ভেসে আসছে সেই অতীত থেকে। যে ডাককে তিনি অস্বীকার করতে পারলেন না। বলে উঠলেন, “হ্যাঁ খেলব”। তারপর ছেলেগুলোর সঙ্গে ফুটবল নিয়ে মাঠে নেমে পড়লেন আধবুড়ো প্রশান্ত নিয়োগী। বয়সজনিত কারণে প্রথমে তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে দমের ঘাটতি হচ্ছিল ঠিকই কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই খেলার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিলেন। ঘটনাচক্রে একটা গোলও দিয়ে ফেললেন তিনি। ছেলেদের উল্লসিত চিৎকারে মাঠ ভরে উঠল। সন্ধ্যা নামার একটু আগে পর্যন্ত যতক্ষণ খেলা চলল ততক্ষণ খেলে গেলেন তিনি। খেলা শেষ হবার পর ছেলেগুলো খুশি হয়ে বলল “আবার খেলতে এসো তুমি।” প্রশান্তর বুকে একটু কষ্ট হলেও মনের মধ্যে একরাশ তাজা অক্সিজেন নিয়ে ছেলেগুলোকে আবার আসবেন বলে গাড়ির দিকে এগোলেন।




পরদিন সকালবেলা একটু দেরি করেই ঘুম ভাঙলো প্রশান্তর। গতরাতে বাড়িতে ফেরার পর থেকে যতক্ষণ তিনি জেগে ছিলেন ততক্ষণ ও তারপর ঘুমের মধ্যেও তার সেই পুকুরপাড়, ফুটবল মাঠের কথা ভেবেছেন আর মগ্ন থেকেছেন। ঘুম ভাঙার পর মনে হল মনের সব বিষণ্ণতা কেটে গেছে। অফিসের কাজের চাপ পদোন্নতির ব্যাপার কোন কিছুই মাথায় এলো না তার। জানালার বাইরে সূর্যের আলোতে আলোকিত আকাশটা বহুদিন পর সুন্দর দেখাচ্ছে। ধীরেসুস্থেই বিছানা ছাড়লেন তিনি। আজ যেন কোন কাজের তারা নেই। কিছুক্ষণ পর সাহেবের ফোন এলো। তিনি জানতে চাইলেন প্রশান্ত কখন এম.ডির থেকে চিঠিটা নিতে যাবেন। সাইট কেমন দেখে এলেন ইত্যাদী। প্রশান্ত জবাব দিলেন, “চিঠির আর প্রয়োজন নেই। কোম্পানি কে শুধু চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেব আমি আর চাকরি করব না। আমার চাকরি করতে ভালো লাগছে না।” কথাটা শুনে বড় সাহেব আঁতকে উঠে বললেন, “আপনি কী বলছেন? এত ভালো চাকরি এত ভালো প্যাকেজ…” কিন্তু প্রশান্তর কানে কিছু গেলো না। উত্তর না পেয়ে বড় সাহেব ফোন কেটে দিলেন। তারপর প্রশান্ত তার টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা ছবি বার করলেন। যার একটা কপি তিনি আগের দিন থানায় জমা দিয়ে এসেছিলেন। কিছুক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলেন তার ক্ষ্যাপামিটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। তিনি থানায় গিয়ে জানিয়ে দেবেন পুলু গতকাল রাত্রে ফিরে এসেছে। তারপর তিনি আজও আবার রওনা দেবেন সেই নির্জন পুকুরের উদ্দেশ্যে, আকাশের নিচে উন্মুক্ত মাঠে। যেখানে তিনি খুঁজে পেয়েছেন পুলুকে। এ নাম যে তারই হারিয়ে যাওয়া পুরনো নাম। আর এই হাতে ধরা ছবিটা তারই ছবি।



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *