short-story-mithye-dhulobali

মিথ্যে ধুলোবালি
রতনতনু ঘাটী

 

 ‘দুন্দুভি, বাজতেও জানে, বাজাতেও জানে!’ অলকেশ আমাকে বলল ক্লাস-অফ পিরিয়ডে।

   ‘কথাটা তুই কি ভাল অর্থে বললি, নাকি খারাপ অর্থে?’ আমার কথা শুনে মনে হয় রাগ হয়ে গেল অলকেশের। রাগে গরগর করতে করতে উধাও!     

   ‘বাজাতেও জানে—কথাটার মানে কী?’ মনে হয় কথাটা আমাকে ঠেস দিয়ে বলল! এখনও সিনেমা মোড়ের কলেজ কাফেতে গেলে হয়তো অলকেশকে পেয়ে যাব! হনহন করে নয়, প্রায় ছুটতে-ছুটতে গেলামও সেখানে। না, অলকেশ ভোঁ-কাট্টা!

   আমি মুখ ভার করে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম। দোকানদার গৌতমদাকে বললাম, ‘গৌতমদা, একটা চা দাও! মাথাটা খুব ধরেছে!’

   ‘কেন, কারুর সঙ্গে ফের ঝগড়া করে এলি নাকি? তুই তো ঝগড়া না করে থাকতে পারিস না!’ গৌতমদার কথার উত্তর দেওয়ার ইচ্ছেই হল না আমার।

    একটু পরে বললাম, ‘না না। তুমি অত কথা বোলো না তো গৌতমদা! ঝগড়া করে এলেই মাথা ধরে? আমি ঝগড়া না করলেও আমার মাথা ধরে। এই যেমন, এখন দেখছ না?’

   চায়ের কাপটা রেখে যাওয়ার সময় একবার চোখাচোখি হল বটে গৌতমদার সঙ্গে। আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম।

   দুন্দুভিকে নিয়ে কেউ কিছু বললে আমার বড় বেশি গায়ে লাগে। দুন্দুভির সঙ্গে আমার পরিচয় ক’ মাসের মাত্র। ফার্স্ট ইয়ারে লাইব্রেরিতে বই ইসু করতে গিয়ে। তখনই দুন্দুভির সঙ্গে ঝগড়া হতেই যাচ্ছিল আমার। আমি বৈষ্ণব পদাবলীর যে বইটা ইসু করব বলে বেছে লাইব্রেরিয়ানের টেবিলের একধারে রেখে দিয়েছিলাম, একটু পরে দেখি অমন একটা বই নিয়ে বিদ্যাবাসিনী ভঙ্গিতে লাইব্রেরিতে ঘুরছে দুন্দুভি। আমার অমনি রাগ হয়ে গেল! আমি দুন্দুভিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি বৈষ্ণবপদাবলীর ওই বইটা ইসু করলে?’

   মেয়েদের বই বাঁ দিকে বুকে আগলে রাখার দৃশ্যকে আমরা ছেলেরা মেয়েদের আড়ালে বলতাম—‘বিদ্যাবাসিনী’!  দুন্দুভি অমন বিদ্যাবাসিনী ভঙ্গিতে শাড়ির আঁচলটা কোমরে পেঁচিয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ‘না। এখনও ইসু করিনি। তবে এই বইটা ক’দিন ধরে খুঁজছিলাম! আজ পেয়ে গেলাম।’

   আমার তখনই বলা উচিত ছিল, ‘আমি এই বইটা নেব বলে লাইব্রেরিয়ানের টেবিলে বাঁ দিকে রেখে এসেছিলাম।’ কিন্তু বলতে পারলাম না! আমি এরকম কোনও মেয়েকেই মুখের উপর কিছু বলতে পারি না! যে কথাটা বলা উচিত নয়, তাও যেমন বলতে পারি না, তেমনিই যে কথা বলা উচিত, তাও তো পারিই না! মেয়েদের কাছে আমি একটা হেরো গোছের ছেলে! আর কেন যে দুন্দুভিকে ‘তুমি’ সম্বোধনে কথা বলতে শুরু করেছি নিজের অজান্তে, সে আমি নিজেই জানি না। ক্লাসের সকলেই মেয়েদের সঙ্গে ‘তুই’ সম্বোধন করে কথা বলে। আমিও সব মেয়েকে ‘তুই’ সম্বোধনই করি, শুধু দুন্দুভিকে ছাড়া। আমার কেন যেন দুন্দুভির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ‘তুই’ সম্বোধন করতে কণ্ঠ জড়িয়ে যায়! ‘তুমি’ বলে ফেলি!  

   অলকেশেরও তো বান্ধবী আছে, প্রিয়তমা! প্রিয়তমা বোস! অলকেশ তো প্রিয়তমাকে ‘তুই’ বলে দিব্যি কথা চালিয়ে যায়, শুনেছি! তবে আমি অবশ্য প্রিয়তমাকে ঠেস দিয়ে কখনও কোনও কথা বলিনি? ক্লাসের কতজনের মুখে-মুখে সেই ছড়াটাও তো ঘোরে–‘প্রিয়তমা দাসসেন / কান্টিনে আসলেন!’ প্রিয়তমা অলকেশের বান্ধবী। সেটা জানি বলেই আমি প্রিয়তমাকে নিয়ে ঠেস দিয়ে কোনও কথা বলি না!  

   যেমন দেবদত্ত বসুরায়! কই কেউ তার বান্ধবী নন্দিনী সেনকে নিয়ে একবার কিছু একটা বলুক তো! তার মুখের বাঁ দিকের ভূগোলটাকে ডান দিক করে দিতে দেবদত্তর কয়েক সেকেন্ড সময় লাগবে!

   দুন্দুভি আর আমি বাংলা অনার্স! অলকেশ এবং প্রিয়তমা সংস্কৃত অনার্স। আর রাগী দু’জনই পড়ে ফিলজফি অনার্সে, দেবদত্ত বসুরায় এবং নন্দিনী সেন!

   আমি কলেজ কাফে থেকে বেরিয়ে এলাম। ঝুপ করে এক্ষুনি বিকেলের অন্ধকার নেমে পড়বে! এখনই অলকেশকে সামনে পেলে একটা সমুচিত জবাব দিতাম, ঠোঁটের কাছটায় এসে ফুটবলের ভুল পোনাল্টি বলের মতো সঠিক কথাটা আটকে গেল! অলকেশকে সামনে পেলে স্ট্রং দু’ কথা শুনিয়ে ছাড়তাম!

   কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে সকলেই জেনে গিয়েছি কার সঙ্গে কার বন্ধুত্ব। কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের বারীনদা সেদিন গায়ে পড়ে এসে কথা বলতে শুরু করল, ‘প্রেম করছ করো! প্রেম করছ কি করছ না, এ কথা জানতে-জানতেই তো ফার্স্ট ইয়ারটা হুস! বাকি থাকল দুটো বছর! সেকেন্ড ইয়ারে জানাজানি কমপ্লিট হতে-না-হতেই ওয়ানস আ ফাইন মর্নিং, তুমি দেখলে, সিদ্ধান্ত নিতে-নিতেই তুমি সেকেন্ড ইয়ারের হার্ডলসগুলো ঠিকঠাক পেরোতে পারোনি! আর থার্ড ইয়ারটা সিনেমার ফার্স্ট-ফরোয়ার্ড রিলের মতো! এই নায়িকা নাচছে তো এই বিয়ে করে হানিমুনে সিমলায়। দেখবে আর মিলিয়ে নেবে আমার কথাটা ঠিক কিনা! ধরো, আজ কলেজে এসেই শুনলে যে, দেবদূত মালবিকার সঙ্গে নাকি রেজিস্ট্রি ম্যারেজটা সেরে ফেলেছে গত কালই। তুমি তাজ্জব গলায় রথীনকে জিজ্ঞেস করলে, ‘হ্যাঁ রে রথীন, মালবিকাদের কথাটা যা শুনছি, সে কি সত্যি?’ রথীন বলল, ‘হুঁ-হুঁ ব্বাবা, জানতি পারোনি! তার পর দিনই শুনলে সমর কবে-কবে দেবলীনাকে ভালবাসত! মানে সে যে ডুবে-ডুবে জল খেত আর কী, আমরা কেউ খোঁজই রাখিনি! শুনলে, আজই একটু পরে ওরা ম্যারেজকোর্টে যাচ্ছে সাক্ষীটাক্ষি নিয়ে। তখন তুমি তোমার পিছন দিকটায় তাকিয়ে দেখলে তোমার মনের গভীরে গচ্ছিত করে রাখা শ্যামলিম তরুছায়ার সবটাই ধু-ধু মরুভূমি!’ বারীনদা কথা থামিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, তোমার বান্ধবীর নামটা যেন কী?’

   আমি থতমত খেয়ে বলেই ফেললাম মন্ত্রচালিতের মতো, ‘ওই, মানে দুন্দুভি দে!’

   ‘হ্যাঁ, দুন্দুভি!’ বারীনদা খেই ধরল ঝপাস করে। বলল, ‘থার্ড ইয়ারটার শেষের মুখে তুমি একদিন কলেজ-ফেরতা মোড়ের মাথায় দেখতে পেলে একটা বি এম ডব্লিউ ফুল দিয়ে সাজানো। কী মনে হল, ভাল করে নজর করতেই দেখতে পেলে গাড়ির ভিতরে নববধূর সাজে বসে আছে দুন্দুভি! কিছুটা মোহাবিষ্টের মতো বি এম ডব্লিউর পাশে-পাশে হাঁটতে হাঁটতে দেখলে, হ্যাঁ, তুমি ঠিকই দেখেছ! ততক্ষণে দুন্দুভির গাড়িটা ট্রাফিকের জট ছাড়িয়ে খানিকটা এগিয়ে গেছে। তুমি দৌড়লেও আর গাড়িটার কাছে পৌঁছতে পারবে না!’

   বারীনদা থামলেন। আমি তখন দুন্দুভির কাছ থেকে, বি এম ডব্লিউর কাছ থেকে, বারীনদার কাছ থেকে, থার্ড ইয়ার বাংলা অনার্সের কাছ থেকে ছুটতে-ছুটতে যে দিকে দু’ চোখ যায়, পালাচ্ছি! এভাবে কি অনেক দূর পালানো যায়? কত দূর? একটা জীবন? আমি জানি না!

 

 

   দুন্দুভি কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার সময়, আমি তক্কেতক্কে থাকতাম ‘রকমারি’ দোকানটার আড়ালে। ফট করে বেরিয়ে পড়তাম ধূমকেতুর মতো। একটু চমকে উঠত বলে মনে হত দুন্দুভিকে। আমি কী কথার পিঠে কী বলব, ভেবে কূল পেতাম না। অথই দরিয়ায় কূল খুঁজতাম। শেষে কথা জুড়ে দিতাম, ‘তুমি কোন ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করবে ভেবেছ?’

   ততক্ষণে আমার থেকে দশ স্টেপ এগিয়ে গেছে দুন্দুভি। পিছন ফিরে বলত, ‘আমি ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্সটা করব। ওখানে ছাড়া আমার আর ভাললাগা ইউনিভার্সিটি নেই।’

   এটা ওর একটা স্বপ্ন ছিল! আমি আমার স্বপ্ন দুন্দুভির সঙ্গে কখনও শেয়ার করব ভাবিনি। করিওনি। আসলে আমার তেমন কোনও স্বপ্নই তো ছিল না। স্বপ্ন দেখার শুরুতে দুন্দুভির সঙ্গে দেখা হল। আমি স্কুল থেকে পাশ করে কলেজে পড়তে গিয়ে মেয়েদের সঙ্গে মিশতে পারতাম না। মানে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কথা হারিয়ে ফেলতাম! দুন্দুভির সঙ্গেও কথা হারিয়ে ফেলতাম প্রতিদিনই। আমরা অতটা কাছাকাছি হতে পারলাম কই, যে একটু বেশি-বেশি কথা বলব?

   আমি বারীনদার কথা মতো পটাপট তিনটে বছর কেমন করে যে পেরিয়ে এলাম! দুন্দুভির সঙ্গে চটপট সেই ফার্স্ট ইয়ারে যে ‘তুমি’ সম্বোধনে পৌঁছে গিয়েছিলাম, তার থেকে আর এক পাও এগোতে পারিনি দু’ বছরে! বার কয়েক অনার্সের বই দেওয়া-নেওয়া, অনার্সের নোট বিনিময় ছাড়া আর কী কী ঘটেছে আমার আর দুন্দুভির মধ্যে, মনে করতে লাগলাম।

   একদিন রাজবাড়ির বাইরের পরিখার চারপাশে ঘুরে বেড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিলাম, ‘দুন্দুভি, চলো, রাজবাড়িটা কত বড়, একবার মেপে দেখি!’

   ‘ও মা! রাজবাড়ি মেপে দেখতে যাব কেন? আমি কি রাজবাড়িটা কিনব নাকি?’

   ‘না না! মানে, রাজপরিখার বাইরে দিয়ে হেঁটে-হেঁটে গেলে বুঝতে পারব রাজবাড়িটা কতখানি। চলো, দু’জনে হেঁটে দেখি!’

   আমার কথা শুনে খিকখিক করে মুখের চাপা হাসিটা চেপে রেখে দুন্দিভি বলল, ‘যাচ্চলে! কবে বলতে কবে না বলে বসো, চলো হলদি নদীটা তো বিশেষ বড় নয়। এক ছুটির দিন হলদি নদীতে ঢুব দিয়ে দেখে আসি চলো, হলদি নদীটা কতখানি গভীর!’

   আমার কিছু একটা বলা উচিত, যখন ভাবছি, দুন্দুভি বলে বসল, ‘তবে আমি কিন্তু হলদি নদীর গভীরতা মাপতে কখনও যেতে পারব না—এই আমি আগেভাগেই বলে রাখছি, কখনও অমন কথা আমাকে বলতে এসো না!’

   আবারও কয়েক পা এগিয়ে গেল দুন্দুভি। আমি অল্প একটু দৌড়নোর চেষ্টা করে ওর কাছে গিয়ে বললাম, ‘চলো, বরং রাজপরিখার চারপাশটাই না হয় বেড়াতে যাই?’

   সেদিন আমি কেমন যেন মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম। কলেজের কত ছেলেই তো মেয়ের হাত ধরে ঘুরতে যায়, আমি না হয় দুন্দুভির হাতটা ধরতে পারব না ঠিকই, কিন্তু একসঙ্গে ঘুরতে তো যেতে পারি?

   শেষমেশ রাজি হল দুন্দুভি। আমরা মোরাম বিছানো পরিখার ধারের রাস্তায় যথেষ্ট দূরত্ব রেখে হাঁটতে লাগলাম। অনেক চেষ্টা করে তেমন কোনও কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। শেষমেশ দুন্দুভিকে বলে বসলাম, ‘তুমি রান্না করতে পারো?’

   ব্যস, দুন্দুভি আর যায় কোথায়? আমাকে রাগত চোখে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি যে আমাকে বিয়ের কনে দেখার মতো করে প্রশ্ন করছ, তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে নাকি?’

   আমি বড় ফাঁপরে পড়ে গেলাম। বললাম, ‘আরে, না না! এমনিই বললাম আর কী!’

   প্রায় মুখঝামটা দেওয়ার মতো করে দুন্দুভি বলল, ‘কোনও কলেজে-পড়া মেয়েকে অমন প্রশ্ন করা যায় নাকি?’

   আমি দুন্দুভির কথাটাকে মুখঝামটা বললাম বটে, তবে আমি কখনও কোনও মেয়ের মুখ থেকে অমন ধরনের কথা শুনিনি কিনা! যাক গে, মুখঝামটা ব্যাপারটার সঙ্গে এই প্রথম পরিচিত হলাম!

   দুন্দুভির গলায় এখনও আগের সেই ঝাঁজ লেগে আছে।  বলল, ‘এর পর জিজ্ঞেস কোরো না যেন, শুক্তো রান্না করতে কী কী মশলা দিতে হয়? আমি কিন্তু ওসব কথার উত্তর দিতে পারব না!’ বলে দুন্দুভি জলথইথই পরিখার জলে জলপিপির ছুটে বেড়ানো দেখতে লাগল এক মনে!

   রাজবাড়ির পরিখার পশ্চিম পাড়টা ঘুরে বেড়ানো হয়েছে কি হয়নি, আমি থমকে গিয়ে চুপ করে গেলাম। আমি আর দুন্দুভি হাঁটছিলাম। বেশ লাগছিল। আমি মনে-মনে একটুও পুলক বোধ করিনি যে তা নয়। কখনও কোনও মেয়ের সঙ্গে এমন করে হাঁটিনি তো! পশ্চিম দিক থেকে এক ঝলক দমকা বাতাস বয়ে এল। ওই বাতাসটাকেই দখিনা পবন বলে ভ্রম হল আমার। প্রেমে পড়লে বুঝি মানুষের এমনই হয়।

   তখন বিকেল হয়নি। দুপুরবেলার রোদই আকাশে তখনও গনগন করছে। দুন্দুভি বলল, ‘চলো, মৈনাক, বিকেল ফুরিয়ে আসছে। বাড়ি ফিরতে হবে!’  

   রাজবাড়ির পরিখার ওপারে একটা ত্রিভঙ্গমুরারী কৃষ্ণচূড়ার গাছ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম দুন্দুভিকে, ‘ওটা কী গাছ বলো তো?’ আসলে কথা ঘোরাতে চাইছিলাম আর কী!

   আমার এই অকারণ কথার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না দুন্দুভি! চুপ করে থাকল। আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম, আচ্ছা, অলকেশ আর প্রিয়তমা! ওরা যে সারাক্ষণ গায়ে-গা লাগিয়ে বকর-বকর করতে করতে হেঁটে বেড়ায়। কী কথা হয় ওদের মধ্যে? একদিন লুকিয়ে শুনতে পারতাম যদি, ভাল হত! কী এমন কথা জমে থাকে ওদের মধ্যে? তা হলে আমার আর দুন্দুভির মধ্যে কথা ফুরিয়ে যায় কেন?

   আমরা সেদিন ফিরে এসেছিলাম কলেজমোড়ে। ও, মনে পড়েছে। আর একদিন শাক্তপদাবলীর বইটা ফেরত দিতে গিয়ে দুন্দুভির আঙুলের সঙ্গে আমার আঙুলটা ছুঁয়ে গেল। বিশ্বাস করুন, সেদিন মোটেও ইচ্ছে করে ওর আঙুলে আঙুল ছোঁয়াইনি আমি। অত সাহস আমার ছিল না। উত্তরে আমি বললাম, ‘সরি!’

   কটমট চোখে আমার মুখের দিকে তাকাল দুন্দুভি। কেমন সে চোখের চাউনি, আমি বলতে পারব না। হায়েনা তার কব্জায় পাওয়া শিকারের দিকে যেমন করে তাকায়, ওরকম একটা চাউনি ছিল দুন্দুভির স্থির চোখে।

   আর হ্যাঁ, মনে পড়েছে! আর একবার দুন্দুভির পথের পাঁচালির নোট খাতার ভিতরে দোল পূর্ণিমার আগে-আগে ‘শুভ দোলযাত্রা’ লিখে একটা দোলের কার্ড দিয়ে খাতাটা দুন্দুভিকে দিয়েছিলাম। পরদিন ক্লাসে ঢোকার মুখে আমাকে একটা খামে ভরে সেই দোলযাত্রার কার্ডটা ফেরত দিয়েছিল। মুখে কিচ্ছুটি বলেনি!

   দুন্দুভির সঙ্গে আমার এটুকুই নৈকট্য হয়েছিল! এটুকু দিয়ে একটা মেয়ের সঙ্গে প্রণয় হতে পারে, আমি জানতাম না। পরে জেনেছি, এটুকু দিয়ে প্রণয় বৈতরণী পেরনো যায় না। সংসার সমুদ্রে সাঁতার কাটা তো নয়ই।

   তারপর দুন্দুভির সঙ্গে দূরত্বের সেতু তৈরি হতে লাগল। সামনাসামনি দেখা হলে ও না-চেনার মতো ভঙ্গিতে রাস্তা পেরিয়ে যেত। নয়তো চোখাচোখি হয়ে গেলে শাড়ির আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখের কোনায় উড়ে এসে পড়া মিথ্যে ধুলোবালি খুঁজতে লাগত।

   কখনও ক্লাসে বা কমনরুমে ওর কোনও বান্ধবী যখন ওকে জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যাঁরে দুন্দুভি, সেকেন্ড ইয়ারে আমাদের অনার্সে যে ছেলেটা সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে, ওর নামটা কী রে?’

   দুন্দুভি আকাশ থেকে পড়ল। বলল, ‘ওর নাম জানি না তো! ওর সঙ্গে কখনও আলাপই হয়নি।’ অন্তরার মুখে যেদিন ওদের কমনরুমের এই কথাটা শুনলাম, সেদিন আমি একটা দূরত্বের সেতুকে অনেক দূর থেকে চোখে দেখতে পেলাম!

    প্রথম দিকে সে দূরত্বের সেতুটাকে চিনতেই পারিনি! কেননা, কখনও দূরত্বের সেতুকে আমি চোখেই দেখিনি। সেই দূরত্বের সেতুর রঙ লাল না সবুজ, সে সেতু পেরোতে কতক্ষণ লাগে? একদিন, নাকি একটা গোটা জীবন?

 

 

   থার্ড ইয়ারের রেজাল্ট বেরোল। আমি আর দুন্দুভি পাশ  পাশ করেছি। রাসমঞ্চের সামনে দুন্দুভির সঙ্গে প্রায় মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল! সেই পুরনো দূরত্বের সেতুটা টপকাতে পারলাম না। একটু পরেই অলকেশ আর প্রিয়তমাকে দেখলাম, সিনেমা মোড়ের দিকে যাচ্ছে। আমি ওদের ডাকলাম, ‘অলকেশ-প্রিয়তমা, তোরা দু’জনেই অনার্স পেয়েছিস! সেকেন্ড ক্লাস! চল, খাওয়াবি তো?’

   প্রিয়তমা বলল, ‘তার আগে তুই তো আমাদের খাওয়াবি? তুই তো ফার্স্টক্লাস!’

   আমি প্রিয়তমাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুই জানলি কী করে?’

   প্রিয়তমা বলল, ‘এসব কথা রাষ্ট্র হতে কি আর সময় লাগে, রে? যার ফার্স্টক্লাস পাওয়ার কথা ছিল, সে-ই তো বলে বেড়াচ্ছে।’

   আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কার কথা বলছিস?’

   ‘কেন? দুন্দুভির কথা! শুনছি, তারই নাকি ফার্স্টক্লাস পাওয়ার কথা ছিল। কৃষ্ণাম্যাডামও বলে বেড়াচ্ছেন!’

   আমি থতমত খেয়ে জানতে চাইলাম, ‘যিনি ফার্স্টক্লাস পাননি, তিনি কী বললেন?’

   ‘কেন, তোর সঙ্গে তার কথা হয়নি?’

   ‘তুই কার কথা বলছিস?’

   ‘তোর দুন্দুভির কথা?’

   ‘না। দেখা হয়েছিল বটে! তবে কথা বলার সুযোগই পাইনি!’

   অলকেশ বলল, ‘মানে ব্রেকআপ! মৈনাক, এখন আমি আর প্রিয়তমা আমরা মুভি দেখতে যাচ্ছি! তিনটের শো। ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘেঢাকা তারা’। রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে!  এবার ক’টা দিন মুভিটুভি দেখে কাটাই? হলের একদম ধারের সিট পেলে কথাই নেই! প্রিয়তমার পাড়ার এক কাকু হলের টিকিট বুকিংয়ে বসে। প্রিয়তমা কাউন্টারের সামনে দাঁড়ালেই উনি হলের সবচেয়ে অন্ধকার সিট দুটো আমাদের দেবেই দেবে! ওই একটু চুমুটুমু…! জানিস তো, হলের ভিতর অনেকক্ষণ ধরে চুমু খাওয়ার বাধা নেই? তারপর প্রিয়তমা কোথায় গিয়ে ভর্তি হবে, আর হয়তো দেখাও হবে না কোনও দিন! যেটুকু পারি উসুল করে নিই, কী বলিস? এটাই তো কলেজ লাইফ, হা-হা! কাল বিকেলে কলেজ ক্যাফেতে চলে আয়। চুটিয়ে আড্ডা হবে!’ অলকেশের এসব কথা শুনলে দুন্দুভি জনারণ্যে মূর্ছা যেত!

   ওরা কলকল করতে করতে চলে গেল। আমার মাথার ভিতর আয়লার মতো ঘুরপাক খেতে লাগল অলকেশের কথাগুলো। চুমুটুমু…কলেজ লাইফ… অন্ধকার দুটো সিট…আমি ভাবতেই পারছিলাম না! আমি এগিয়ে যেতে গিয়েও পিছন ফিরে তাকালাম। কেউ দেখতে পায়নি, অথচ যার চোখে উড়ে এসে ধুলোবালি পড়েছিল, সেই মিথ্যে ধুলোবালির কী হল?

   দুন্দুভি গার্লস কমনরুমে সত্যিই বলেছিল, আমাকে চেনে না, কখনও আলাপই হয়নি? অতখানি মিথ্যে না বললে চলত না? ফার্স্টক্লাস না-পাওয়ার সঙ্গে অতখানি মিথ্যে বলতে পারল দুন্দুভি? হঠাৎ পশ্চিম আকাশের দিক থেকে এক দঙ্গল মনখারাপের মেঘ উড়ে এল আমার চারপাশে। আমি তাদের কাউকে কাউকে ধরতে চাইলাম। কাউকে ধরতেই পারলাম না। মনখারাপের মেঘের সঙ্গে আগে ক’বার আমার দেখা হয়েছিল দুন্দুভির সান্নিধ্যে। ওগুলো যে মনখারাপের মেঘ, আমার চিনতে বেশ দেরি হয়েছিল।

   আমি খুব ধীর গতিতে আপনজন সুইটস পেরিয়ে এগিয়ে চললাম। অমন সময় দেখলাম, দেবদত্ত আর নন্দিনী সেনকে। দু’জনেই তাদের চারপাশে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না যেন! একবার থার্ড ইয়ারের শেষাশেষি একটা কানাঘুষো ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা কলেজে। আমিও শুনেছিলাম। তারপর সেটা কলেজ ক্যান্টিনে, কলেজের পিছনের বকুল মঞ্জরীতে, আর তারও পিছনের মরা নদীর সোঁতা হয়ে বেঁচে থাকা ক্ষীণস্রোতা ক্যানালের ঘুমিয়ে-পড়া ঢেউগুলোতে। কথাটা আমাদের বলতে মুখে বাধছিল। অনেকেই শুনল, কবে নাকি দেবদত্ত নন্দিনীকে নিয়ে কাটিয়ে এসেছে ইছামতির তীরের ‘ছুটি-ছুটি’ হোটেলে একটা গোটা দুপুর।

   এসব কথা পাঁচকান হতে-হতে পঁচিশকান হতে বেশি সময় লাগল না। কলেজে সে কী হইহই। কলেজের ছোট্ট মাঠটায় সব ইয়ারের ছেলেমেয়েদের ছোট-বড় বারো-তেরোখানা জটলা সকাল-বিকেল ডাল-ভাঙা মৌচাকের মতো। সারাটাদিন ধরে কখনও সবক’টা মৌমাছি ভাঙা ডাল থেকে উড়ে গেছে, এমন হয়নি! কোথায় যেন পড়েছিলাম শরৎচন্দ্রের লেখায় নাকি… মনে পড়ছে না! নিন্দের কথা পল্লবিত হতে বেশি সময় লাগে না!

   তারপর যা হয়, কোনও কোনও ডাকাবুকো মেয়ে নন্দিনীকে সরাসরি জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যাঁরে, তারপর বল সেদিন কেমন কাটল?’

   ওরকম একজন কলেজের সেরা ডাকাবুকো মেয়ে হল বিনতা। কলেজ ক্যান্টিনের সামনে দাঁড়িয়ে ছেলেদের সঙ্গে সিগারেট খায়! ছেলেদের জড়িয়ে ধরাটরা কোনও ব্যাপারই নয় বিনতার কাছে। আমি একদিন দেখলাম, ক্যান্টিনে ফট করে তপোজয়ের কোলে বসে পড়ল বিনতা। আমার দেখে বেশ খারাপই লেগেছিল। কথাটা দেবায়নকে বলতে যেতে সে বলল, ‘আরে, ও কিছু না। বিনতা কার সঙ্গে যেন বাজি ধরেছিল, তপোজয়ের কোলে বসতে পারে কিনা!’

   যদি ধরেই নিই যে বাজি ধরে বিনতা তপোজয়ের কোলে বসেছিল, কিন্তু আমার মতামত হল, ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।

   নন্দিনী এমনিতে খুব সাহসী মেয়ে। বিনতার প্রশ্নের উত্তরে জানতে চাইল, ‘কোন দিনের কথা বলছিস?’

   ‘ওই যে ইছামতীর পারের হোটেল নাকি রিসর্ট, কোথায় যেন তুই আর দেবদত্ত একটা দিন কাটিয়ে এলি?’

   নন্দিনী ঠোঁট উলটে বলল, ‘দিন আর রাত মিলিয়ে তবে একটা দিন হয়, বুঝলি? আমরা একবেলাই তো ওখানে ছিলাম! ওটাকে তোরা নিন্দুকেরা বাড়িয়েবুড়িয়ে একটা দিন করে দিলি? তা বল, কী জানতে চাইছিস? রুমে একটাই ডবল বেড ছিল। ওই একটুআধটু শোওয়া-টোওয়া নিয়ে আমি কিছু মনে করি না! সে দেবদত্তর সঙ্গে পরে আমার বিয়ে হোক বা না-ই হোক! আমার অত ছুঁতমার্গ নেই, ভাই। একটু সতর্ক থাকলে ভয়ের কিছু থাকেও না! আর মিশলে তো খোলা মনেই মিশব, বল? অত রাখোঢাকোর কী আছে?’

   নন্দিনীর এসব কথা দুন্দুভিকে বলা সমীচীন হবে না, যেমন সমীচীন হবে না প্রিয়তমার কথাও! আমি বলতেও পারব না কোনও দিন দুন্দুভিকে! বরং সেই ভাল, ‘মিথ্যে ধুলোবালি’ আমার আর দুন্দুভির মধ্যে অনন্তকাল জেগে থাকুক!

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *