short-story-monimalar-jonmodin

মণিমালার জন্মদিন
অনীশ মুখোপাধ্যায়

আজ মণিমালার জন্মদিন। যত জায়গায় তাঁকে নিজের আবির্ভাব-দিবসের উল্লেখ করতে হয়, সর্বত্র আজকের তারিখটিই লেখা। সে অন্য কেউই লিখে রাখুন অথবা উনি নিজে। আর এই ব্যাপারে তিলমাত্র মিথ্যে নেই।আজ বারোই আগস্ট। আজই মণিমালা পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন। 

 সকালে রোজের মতোই নিমাইয়ের মা কাজ করে চলে গেছে। টেবিলে খাবার ঢাকা দেওয়া আছে, যেমন অন্যদিনেও থাকে। দুপুরে মণিমালা নিজেই খাবারগুলো গরম করে  নেবেন।আবার সন্ধেবেলায় এসে রান্নাসহ বাকি কাজ করে যাবে নিমাইয়ের মা। এই আড়াই কামরার ফ্ল্যাট কিছুদিন ধরে যেন নিয়তই মণিমালাকে গিলে খেতে আসে। চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন দু’বছর হল। ভেবেছিলেন, বাকি জীবনটা গান, সামান্য কিছু পড়া-লেখা, দু-চারজন বন্ধুর সাহচর্যে কাটিয়ে দিতে পারবেন। ঘুরে বেড়াবেন ইচ্ছেমতো। কিন্তু সে-সব আর হল কই! কোনও কিছুতেই মন বসে না আর।           

 আজ আকাশ মেঘলা। হয়তো বৃষ্টি নামবে। মণিমালা বিছানায় আধশোয়া হয়ে জানালার বাইরে তাকালেন। যতদূর চোখ যায়, কয়েকটি বাড়ির মাথা ডিঙিয়ে দূরে সবুজের সামান্য দেখা মেলে। দেখতে দেখতে মেঘের আস্তরণ যেন চারিদিক ঢেকে ফেলছে। কিন্তু তাহলেও মণিমালাকে একবার বেরোতে হবে। দু’টো ওষুধ ফুরিয়ে গেছে।যতদিন নভোনীল ছিলেন, তিনি একটি পর্যায় অবধি এ-সবের খেয়াল রাখতেন। নভোনীলের সঙ্গে তাঁর বিবাহিত জীবন ঠিক দু’বছর আগে শেষ হল। নভোনীল এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন।    

  মণিমালা ধীরে ধীরে খাট থেকে উঠে দাঁড়ালেন। এক-ফালি ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াবার পরে উত্তাল সমুদ্রের সামনে দাঁড়ালে যেমন হাওয়ার ঝাপটা অনুভূত হয়, তেমনই যেন জোলো হাওয়া ধাক্কা মারতে শুরু করল তাঁর চোখে-মুখে। চাইলেই ঘরে ফিরে যেতে পারতেন। কী ভেবে,কিছুটা সময় ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন উনি। নভোনীল চলে যাওয়ার পরে জন্মদিনটা আরওই যেন বেদনাদায়ক হয়ে উঠেছে। এমনিতেও কবে তাঁর জন্মদিন, সেই খবর হাতে গোনা যে ক’জন রাখতেন তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই আজ পরপারে! দু-তিনজনের মেসেজ বা ফোন এখনও আসে। কিন্তু ওই অবধিই। নভোনীল একবার ওঁকে বলেছিলেন, যেদিন থাকব না, বুঝবে তুমি! কেউ খবর রাখবে না তোমার। মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখো না। নিয়মিত সম্পর্ক না রাখলে দু’দিন বাদে এমনিতেই লোকে ভুলে যায়। একা-একা থাকতে কেমন লাগবে, দেখো!

নভোনীলের তখন ক্যানসার-স্টেজ-থ্রি!   

 

 

বৃষ্টি নামার আগে বেরিয়ে পড়লেন মণিমালা। সকালে উঠেই থাইরয়েডের ওষুধ খেতে হয়। অন্য ওষুধটা মাথা যন্ত্রণার জন্য কাজে লাগে। দু’টোই ফুরিয়েছে। ভানুদেব মেডিকো’জ-এ বলে দিলে হয়তো বাড়িতে দিয়ে যেত। কিন্তু জরুরি দরকারে ওষুধ চেয়ে পাননি—এমনও একাধিকবার ঘটেছে। তারপর থেকে নিজেই দোকানে যান। একান্তই না পারলে নিমাইয়ের মাকে বলেন। নিমাই ওষুধ এনে দেয়। একটা ফোন এসেছে। চলতে চলতে রাস্তার একপাশে সরে এলেন। তাঁর কলেজ জীবনের বন্ধু রাজন্যা ফোন করছেন। আগে রাজন্যা কলকাতাতেই থাকতেন। বছর দশেক আগে জামশেদপুরে চলে গেলেও যোগাযোগ আছে।

শুভ জন্মদিন, ডিয়ার মণি। তু জিয়ে…   

রাজন্যা বাকিটা বলতে গিয়েও থমকে যাওয়ার আগে হেসে ফেললেন।     

গালিটা দিলি না? মণিমালাও পাল্টা হাসেন।  

তোকে হাজারো না হোক শ’ও সাল বললে তুই বলবি গালি দিচ্ছি। শাপ দিচ্ছি। আর আমি প্রতিবারেই সেটা ভুলে যাওয়ার মুখে মনে পড়ে। যাইহোক,ঠিক আছিস তো? বাইরে আছিস বলে মনে হচ্ছে!    

ওষুধ ফুরিয়ে গেছে।তাই কিনতে বেরিয়েছি।    

বেশ করেছিস। এবারে বল দেখি, আমার এখানে কবে আসবি?   

মণিমালা সহসা উত্তর দিতে পারলেন না। রাজন্যা অনেকবারই তাঁকে জামশেদপুরে যেতে বলেছেন। নভোনীল চলে যাওয়ার পরে তো একরকম জোর করেই দিন পনেরো নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে রেখেছিলেন। মণিমালা ফেরার আগে কথা আদায় করে নিয়েছিলেন রাজন্যা—আবার যেন তাঁর কাছে মণিমালা বেড়াতে যান। কিন্তু যাওয়া হয়নি। কারও বাড়িতে গিয়ে থাকার কথা ভাবলে বড়ই সঙ্কুচিত হয়ে যান মণিমালা।  

কই রে! চুপ করে গেলি কেন?   

বেশ যেন জোর করেই মণিমালা বলে ওঠেন, আরে যাব!

কিন্তু কবে? কত গল্প জমে আছে বল দেখি! সব কি আর ফোনে বলা যায়?   

এই…এই তো সামনের মাসেই আসছি। তোকে তার আগে জানাব।

ঠিক তো?

একদম।   

ফোন রাখার পরে রাজন্যার কথা ভাবলেন উনি। স্বামী আর একমাত্র কন্যাকে নিয়ে ভালই আছেন রাজন্যা। ওঁর স্বামী দীপসুন্দরবাবু জামশেদপুর স্টিল-প্ল্যান্টে বড় চাকরি করেন। নভোনীলের সঙ্গে দীপসুন্দরবাবুর যথেষ্ট সখ্য ছিল। নভোনীল চলে যাওয়ার পরে মণিমালা যখন মানসিকভাবে পুরোপুরি বিধ্বস্ত, দীপসুন্দরবাবু-রাজন্যা একেবারে যাকে বলে আগলে রেখেছিলেন তাঁকে। এই ঘটনা যে ঘটবে সে তো জানাই ছিল। প্রশ্ন ছিল একটাই—কবে? নভোনীল কতদিন লড়তে পারবেন? রোগটা ধরা পড়ার এক বছরের মাথায় অনেকেই চলে যায়। নভোনীল চার বছর লড়েছেন।হয়তো আরও কিছুদিন থাকতে পারতেন। যদি না রোগটা ফিরে আসত! মণিমালা ধীর পায়ে ওষুধের দোকানে এসে দাঁড়ালেন। জনাকয়েক কাস্টমারের প্রয়োজন মেটাতে কাউন্টারের অপর-প্রান্তে দু’জন খুবই ব্যস্ত। ফলে তাঁর দিকে নজরটা পড়তে খানিক দেরিই হল। নিরঞ্জন নামের ছেলেটি হেসে বলল, বৌদি, আমাকে একবার ফোন করে দিতেন! পরের মাস থেকে আমিই বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসব। ওদিক দিয়েই তো রোজ ফিরি।     

মণিমালা প্রত্যুত্তরে স্মিত হেসে হাত বাড়িয়ে টাকা এগিয়ে দিলেন। নিরঞ্জন প্যাকেটে ভরে দিয়েছে দু’টি ওষুধ। মণিমালা সেটা ছোট হ্যান্ডব্যাগে ঢুকিয়ে ফিরে চললেন। হাওয়ার গতিটা আরও বাড়ছে। বৃষ্টি নামার আগে ঘরে ফিরতে পারলে ভাল হয়। নভোনীল থাকলে ফোন করে ফেলতেন এতক্ষণে—ভিজো না যেন! ছাতাটা খুলে নিও।

 

 

 

আজকাল আর গান নিয়ে বসতে ইচ্ছে করে না মণিমালার। কত বছর আগে শখ করে কিছুদিন গল্প লেখার চেষ্টা করেছিলেন। কবে যেন সে-সবও বন্ধ হয়ে গেল। অনেক দিন কোনও গল্পের আইডিয়াও মাথায় ঘোরে না।শেষ যখন লেখার চিন্তা মাথায় এসেছিল তখন নভোনীল কিছুটা সুস্থ হয়েছেন। লিখতে বসে মণিমালা আবিষ্কার করেন শব্দেরা নিয়মিতভাবে তাঁর সঙ্গে ব্যবধান বাড়িয়ে ফেলেছে। ওয়ার্ড পেজ খুলে ভাষাহীন দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থাকতেন দিনের পর দিন।তারপরে এক সময়ে হাল ছেড়ে দেন। অথচ যখন প্রথম লেখার উৎসাহ এসেছিল, তখন এমন পরিস্থিতিতে বেশ কিছু সময় বসে থাকার পরে চিন্তাসূত্র জুড়ে জুড়ে ঠিক একটি-দু’টি বাক্য মাথায় এসে যেত। সেখান থেকে লেখাটা নিয়ে এগোতে পারতেন। এখন আর তেমন কিছুই মাথায় আসে না। প্রাইভেট ফার্মে চাকরির ফাঁকে খুচরো লেখালেখির অভ্যাস বিয়ের কত বছর পরে শুরু হয়েছিল যেন? দশ তো বটেই।প্রথম গল্প বেরোবার পরে নভোনীল তাঁকে অত্যন্ত দামি একটি কলম উপহার দিয়ে বলেছিলেন, এবার থেকে এটা দিয়েই লিখো।    

আজও আছে কলমটি। তখনও অবধি খাতা-কলমে লিখতেন মণিমালা। তার কিছু বছর বাদে কম্পিউটারে টাইপ করা শিখলেন।

  মণিমালা ঘরে ফেরার মুহূর্তে বৃষ্টিটা নামল। দ্রুত লিফটে উঠে ঘরের দরজা খুলে ঢুকলেন। মনে হল, এক কাপ চা খেলে ভাল হয়। চায়ের জল গরম করতে করতে ফোন বাজার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন। পাশের ঘরের টেবিলে ফোনটা রেখে এসেছেন। এবারে এগিয়ে গিয়ে দেখলেন সুবিমল ফোন করছে। সুবিমল সামন্ত। বাগড়াকোটে বাড়ি। আজ তার ফোন করার কথা বটে! বাগড়াকোটে একটি প্রাইভেট লাইব্রেরির উদ্বোধন হবে। সুবিমল ‘দিন-রাতের কথা’ নামে স্থানীয় পত্রিকার সম্পাদক। তাঁকে দিয়ে লাইব্রেরির উদ্বোধন করাতে চায়। এহেন প্রস্তাবে মণিমালা প্রথমে ভারি অবাক হয়েছিলেন। তাঁকে এরা চিনল কীভাবে? সর্ব অর্থে বিস্মৃতপ্রায় মফসসলের অতি সাধারণ কলমচি তিনি। একটি মাত্র বই বেরিয়েছিল সেই কোন্ যুগে!আজকাল আর পাওয়া যায় না শুনেছেন। পাওয়ার কথাও নয়। প্রকাশনা সংস্থাই নাকি উঠে গেছে। সেখানে সুবিমল তাঁকে দিয়ে…! বরুণেশের কাছে তাঁর কথা শুনে সুবিমল যোগাযোগ করেছেন। বরুণেশ অনেক বছর আগে তাঁর সঙ্গে একই কোম্পানিতে চাকরি করতেন। পরে কোম্পানি পাল্টে চলে যান। তবে অনিয়মিতভাবে হলেও যোগাযোগটা থেকে গেছে। বরুণেশের কন্যা সিডনিতে থাকে। তাঁর স্ত্রী নেই, প্রায় পনেরো বছর হল!      

  দিদি, টিকিট পাঠিয়েছি হোয়াটসঅ্যাপে। রাত এগারোটায় ট্রেন। আর সকালে ষ্টেশনে গাড়ি থাকবে। আপনি ট্রেনে উঠে একবার আমাকে জানিয়ে দেবেন প্লিজ!

মণিমালার মনে হল বহুদূর থেকে কেউ তাঁকে ডাকছে। ডাক আসলে এসেই ছিল। কিন্তু উনি ভুলে গিয়েছিলেন। আজকাল মাথাটা কি একেবারেই কাজ করে না? এই আমন্ত্রণ তো এক মাস আগেই…! অথচ গত দশদিনে একবারও মনে পড়ল না কেন? আজই যে তাঁর যাওয়ার কথা সেটা বেমালুম…                            

কোনও মতে উনি বললেন, হ্যাঁ ভাই। আমি আপনাকে নিশ্চয়ই জানাব। আর ফেরার টিকিটের ব্যাপারে কী স্থির করলেন সেটা একবার বলবেন, কেমন? আমি দিন দুয়েকের জন্য যাওয়ার কথা বলেছিলাম।

বলব দিদি! আপনি আগে আসুন প্লিজ।    

 

 

 

নিমাইয়ের মা আজ ডাল, আলু পোস্ত আর ছানার তরকারি রেঁধেছে। খেতে বসে অনেক দিন বাদে মণিমালার চোখ দু’টো জলে ভ’রে উঠল। নভোনীলের কথা ভেবে? নাকি বাবা-মায়ের কথা মনে করে? দু’বছর ধরে জন্মদিন এলে ভাবেন পরের জন্মদিনটা যেন আর দেখতে না হয়। এই একার যাপন সর্বার্থে মূল্যহীন, অর্থহীন হয়ে উঠেছে তাঁর কাছে। আত্মীয়কুলে তেমন প্রায় কেউই নেই যাদের সঙ্গে ওঁর নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবে হলেও যোগাযোগ আছে। বন্ধু বলতে রাজন্যা, হৈমন্তি, শর্বাণী, মানস আর মাঝে-মধ্যে বরুণেশ। মণিমালা চলে গেলে এরা সত্যিই দুঃখ পাবেন। কিন্তু তার চেয়ে বেশি কিছু হবে কি? নাহ!

হৈমন্তী একবার বলেছিলেন, তুই এভাবে থাকতে পারবি না। বিয়ে কর। তোরই মতো কত মানুষ একা দিন কাটাচ্ছেন, খবর রাখিস? তুই রাজি থাকলে আমি খোঁজটা…   

বিয়ে! চমকে উঠেছিলেন মণিমালা।   

হ্যাঁ। বয়সটা কোনও ফ্যাক্টরই নয় আজকাল। সেটা তো নিজেও বুঝিস!   

হেসে ফেলেছিলেন মণিমালা। শোয়ার ঘরে আজও নভোনীল এবং তাঁর ছবিটা বিছানার পাশে রাখা আছে। সেখানে অন্য একজনের ছবি থাকবে, ভাবতেই পারেন না। এক রাতের কথা মনে এল। তখন নভোনীল প্রথম রাউণ্ডের কেমোথেরাপি সেরে খানিকটা সুস্থ হয়ে উঠেছেন। প্রায়ান্ধকার ঘরে তাঁকে কাছে টেনে বলেছিলেন, একটা কথা বলব। রাখবে?   

নভোনীলের বলার ভঙ্গিমায় কেমন যেন রহস্য ছিল। খানিক আকুতিও। বেশ যেন অদ্ভুত ঠেকেছিল তাঁর কাছে।    

কী কথা?

আগে বলো, রাখবে!

আগে শুনি। রাখতে পারলে রাখব না কেন?

নভোনীল ফিসফিসিয়ে বলেছিলেন, হাতে আর কতদিন সময় আছে জানি না। হয়তো আরও কিছুদিন আছি। অথবা দুম করে না-ও থাকতে পারি।

আবার ও-সব কথা! বলেছি যে আমাকে বলবে না!

বলব! কারণ মিথ্যে তো আর বলছি না!

মণিমালা চুপ করে থাকেন। নভোনীল বলতে শুরু করেন, তুমি দুঃখ পাবে জানি। তা-ও বলি, আমি চলে যাওয়ার পরে…একা থেকো না মণি।  

তার মানে!

বিয়ে কোরো। একা থাকতে পারবে না। আমি তো তোমায় জানি! ভীষণ অসুবিধা হবে। এই ফ্ল্যাটে একা থাকা…আমি যে মরেও শান্তি পাব না। একা থেকো না, প্লিজ।    

ছিটকে উঠে গিয়েছিলেন মণিমালা। সে-রাতে আর বিছানায় শুতে আসেননি। ভোরবেলায় সোফার ওপরে ঝিমিয়ে গিয়েছিলেন। নিমাইয়ের মা কলিং-বেল টেপার শব্দে যখন ওঠেন, সাতটা বেজে গেছে। হৈমন্তীর কথায় সে-রাতের স্মৃতি ফের ধাক্কা মারতে এসেছিল। আর আজ? খেতে বসে বারংবার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল এই বিজন ঘরে। নভোনীল বিয়ের কথা কেন বলেছিলেন?   

 

    

 

নিমাইয়ের মা সন্ধ্যায় এসে চা আর রাতের খাবার বানিয়ে দিয়ে গেছে। মণিমালা ধীর পায়ে এ-ঘর থেকে ও-ঘর করতে করতে গোছগাছ সেরে নিলেন। দু’দিনের তো ব্যাপার! কত আর জামাকাপড় লাগবে! ট্রেনে উঠে সুবিমলকে মেসেজ পাঠিয়ে শুয়ে পড়লেন। ঘুম পাচ্ছে আজ। ঘুম আসার আগে মনে হচ্ছিল, জীবন থেকে আরেকটি বছর টুপ করে খসে পড়ল। নিজেকে বলতে চেষ্টা করলেন, এবারে ওপরে উঠে গেলে ভাল হয়। ক্লান্ত লাগছে। বড় নিঃসঙ্গ আর অসহায় হয়ে পড়েছেন। নভোনীল চলে যাওয়ার পরের কিছু মুহূর্ত তাকে জড়িয়ে ধরে একা ঘরে হাউ-হাউ করে কেঁদেছিলেন। সেই কান্নার কোনও সাক্ষী ছিল না। চোখ থেকে অবিরাম ধারায় জল নেমে এসেছিল সে-রাতে। তারপরে নভোনীলের আসা প্রথম জন্মদিনটাতেও একইভাবে…। এতদিন বাদে আজ দুপুরে আবারও…। ঘুরে-ফিরে নভোনীল, বাবা-মাকে মনে পড়ল দিনভর। রাজন্যার ফোন, হৈমন্তীর মেসেজে যদিও স্বাভাবিক ছিলেন। আরেকটা মেসেজ আগামীকাল আসবে। সকালে বা বেলায়…বরুণেশ মেসেজ করবেন উনি। জন্মদিনের শেষ মেসেজ।      

  ঘুম ভাঙল সাতটা নাগাদ। ট্রেন শিলিগুড়ির দিকে এগিয়ে চলেছে। বাগড়াকোটে ঢুকতে ঢুকতে দশটা বাজবে। মোবাইল ডেটা অন করলেন আরও আধঘন্টা বাদে। আর তারপরেই দেখলেন, রাত্রি বারোটা বাজার দশ মিনিট আগে বরুণেশের মেসেজ ঢুকেছে—শুভ জন্মদিন, মালা। এক আকাশ শুভকামনা জানাই। দেখা হবে।   

বড় অবাক হলেন মণিমালা। এই মেসেজ তো আজ সকালে আসার কথা! বরুনেশ জানেন, আজই তাঁর জন্মদিন। তাহলে…   

ট্রেন থেকে নেমে বাইরে এসে দেখলেন সুবিমল নিজেই তাঁকে রিসিভ করতে এসেছে।

এক গাল হেসে তাঁকে প্রণাম করে বলল, আসুন দিদি। আপনার থাকার ব্যবস্থা ‘আলাপ-হোম স্টে’তে করা আছে। গাড়িতে দশ মিনিটও লাগবে না। 

মণিমালা গাড়িতে উঠে পড়লেন। স্টেশন থেকে গাড়ি পিচ-ঢালা পথের বুক চিরে কিছুক্ষণের মধ্যেই এনে ফেলল নির্দিষ্ট হোম-স্টে’তে। গাড়ি থেকে নেমে সুবিমলের সঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করে চমকে উঠলেন মণিমালা।রিসেপশনের সামনে হাসিমুখে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত বরুণেশ। ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবিতে ভারি চমৎকার দেখাচ্ছে তাঁকে।মণিমালা সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তিনি জানতেন আগামীকাল বিকেলের অনুষ্ঠানে বরুণেশ আসবেন। সুবিমল সেটাই বলেছিল। এটা কীরকম ব্যাপার হল?

তুমি? এখানে?

বরুনেশ হাসছেন। বললেন, চলে এলাম ম্যাডাম!

সুবিমল বলল, আপনারা গল্প করুন দিদি। আমি চা-ব্রেকফাস্টের কথাটা বলে আসছি। 

মণিমালা বরুণেশের সঙ্গে তাঁর জন্য রাখা ঘরে এসে বসলেন। তার ঠিক উলটোদিকে চেয়ারে বসেছেন বরুণেশ। তাঁর মুখে মিটিমিটি হাসি খেলা করছে। থাকতে না পেরে মণিমালা ফোনটা দেখিয়ে বললেন, মেসেজটা কাল রাতে এসেছে দেখলাম! এবারে অ্যাডভান্স…?    

বরুণেশ হেসে বললেন, তোমার কপালে বকুনি অপেক্ষা করছে!

আমার অপরাধ?

এত বছর ধরে আমাকে ভুল তারিখ জানাবার ফল! বারোই আগস্ট বলতে কী এমন অসুবিধা ছিল এবারে শুনি!

মণিমালার মুখ যুগপৎ মলিন ও বেদনার্ত হয়ে উঠল। সেটা খেয়াল করে বরুনেশ জিজ্ঞেস করলেন, কী হল? ভুল কিছু বললাম?

মণিমালা মাথা নিচু করে বললেন, আমি সত্যিই দুঃখিত। এমন মিথ্যে আমার বলা উচিত হয়নি। কিন্তু না বলেই বা…  

বরুণেশের মুখে উদ্বেগ। সামান্য অধীরতাও যেন পরের প্রশ্নটায় প্রকাশ পেল—কিন্তু কেন? কী সেই অসুবিধা? বলা যায় না?  

মণিমালা সামান্য কুন্ঠিত স্বরে জানালেন, যে নিজের প্রথম জন্মদিনে বাবাকে হারায় তার জন্মদিন…কী করে শুভ হতে পারে, বলবে প্লিজ? আর দ্যাখো…আশ্চর্য কপাল আমার! নভোনীলকেও একই দিনে চলে যেতে হয়েছিল! এবারে…        

চমকে উঠলেন বরুণেশ। মণিমালার দিকে তাকাতে পারছেন না যেন। বেশ কিছুক্ষণ বাদে বললেন, অনুষ্ঠানে একটা বুক-লেট বেরোবে। সেখানে তোমার পরিচিতির জন্য…। বইতে জন্মদিনটা লেখা নেই দেখে ফোন করেছিল সুবিমল। যেটা জানি সেটাই বললাম। তারপরে কাল হঠাৎ ফ্রেন্ডবুকে দেখি তোমার কোনও বন্ধু শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। ভাবলাম, আমিই কি তবে ভুল জেনে এসেছি? তাই অত রাতে…

মণিমালার বিস্ময় উত্তরোত্তর বাড়ছে। তিনি শেষ কবে ফ্রেণ্ডবুকে ঢুকেছেন, মনে নেই। এই কাজটা আবার কে করতে পারে! দেখতে হবে তো!   

বরুণেশ উঠে এসে তাঁর হাতটা চেপে ধরে বললেন, এবার থেকে জন্মদিনে আর একা থাকার সুযোগ দেব না। অন্তত যে ক’টা দিন আমি বেঁচে আছি। 

মণিমালা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। নাকি অলক্ষ্যে নভোনীলই থামিয়ে দিলেন!    

বরুণেশ পরম যত্নে তাঁর হাত ধরে পাশের সোফার দিকে এগোতে এগোতে বললেন, একটু বসি চলো। সুবিমল খানিক বাদেই হয়তো এসে পড়বে।    

  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *