short-story-neelsagar-express

নীলসাগর এক্সপ্রেস
স্বকৃত নোমান


কমলাপুর স্টেশনে ঠিক ছয়টায় পৌঁছল তৃণা। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম চব্বিশ ঘণ্টার একটা জার্নি করব। এমন জায়গায় যাব, যেখানে আমাদের কেউ চিনবে না। ট্রেনের এমন একটা কেবিন নেব, যেখানে আমাদের কেউ বিরক্ত করবে না। জার্নিতে কী কী হবে আর কী কী হবে না―এ নিয়ে আমরা চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি। যা হওয়ার তা হবে, যা হবে না তা হবে না। আমরা জোর করে কিছু হওয়াতে যাব না, কিংবা হতে চাইলে আমরা আপত্তি করব না।

আমরা বেছে নিলাম নীলসাগর এক্সপ্রেস। দেশের অন্যতম বিলাসবহুল ট্রেন। ঢাকা টু চিলাহাটি, চিলাহাটি টু ঢাকা। পথে কোনো সমস্যা না হলে বরাবর চব্বিশ ঘণ্টার আরামদায়ক ভ্রমণ। আট হাজার টাকায় নিয়েছি এসি বার্থ কেবিন। তৃণা দিয়েছে চার হাজার। পুরোটাই আমি দিতে চেয়েছিলাম। তৃণার আত্মসম্মানবোধ এতই প্রবল যে, সে রাজি হয়নি। শুধু তাই নয়, লাঞ্চ-ডিনারসহ আর যা যা খরচ হবে তার অর্ধেক অর্ধেক দেব দুজন।

ঠিক সাতটায় ছাড়ল ট্রেন। আমি কেবিনের দরজা লক করে দিলাম। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া খুলব না। আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না তৃণা আর আমি একই কেবিনে। যেন তৃণা নয়, অন্য কোনো যাত্রী, যাকে আমি চিনি না। কেননা শুরু থেকেই আমার সংশয় ছিল তৃণা এই জার্নিতে রাজি হবে কিনা। টিকিট কাটার পরও সে বেঁকে বসেছিল। বলেছিল, অন্তরঙ্গ সময় কাটানোর পর নরনারীর কিছু স্মৃতি জমা হয়। সেই স্মৃতি বহন করা অনেকের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। আমি বলেছিলাম, স্মৃতি বহন করার সাধ্য আমার আছে। তৃণারও আছে নিশ্চয়ই। তৃণা বলেছিল, স্মৃতি অনেক সময় আগ্রাসী হয়ে ওঠে। স্মৃতির তাড়নায় দুজন দুজনকে পাওয়ার জন্য উন্মাতাল হয়ে ওঠে। আমি বলেছিলাম, আগ্রাসী আমরা হবো না। কেননা আমরা চাই না চূড়ান্ত প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে আমাদের প্রেমে চিতে পড়ুক। কেননা প্রত্যেক প্রাপ্তিই শেষ পর্যন্ত চিতে পড়ে মলিন হয়ে ওঠে।

তৃণা জানালার পাশে বসা, আমি দরজার পাশে; মাঝখানে ফাঁকা। আমার ইচ্ছে করছে ফাঁকা জায়গাটা ভরাট করে দিতে। কিন্তু আমার ইচ্ছায় তো কাজ হবে না, তৃণারও ইচ্ছা থাকতে হবে। কেননা আমরা জোর করে কোনো কিছু করতে যাব না। বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে তৃণা বলল, ‘এমন ভোর বহু দিন পর দেখছি। আটটার আগে তো কোনোদিন ঘুম ভাঙে না।’ আমি বললাম, ‘আমি কিন্তু রোজ এগারোটায় ঘুমাই আর ছটায় উঠি। মাঝেমধ্যে বের হই। হাঁটাহাটি বা বাজারসদাই করি।’

ভাবি, আমার যা ইচ্ছা করছে তৃণারও কি তা করছে? আমার ইচ্ছার কথা যেমন প্রকাশ করতে পারছি না, তৃণাও কি পারছে না? আমার মনে পড়ে গেল কদিন আগে দেখা এক উর্দু সিনেমার কথা, যাতে একটি সংলাপ ছিল: ‘হক কলন্দর, সব কি আন্দর, এক আন্ধেরা কালা বন্দর। উওহ্ শয়তান।’ আমার ভেতরেও কি তবে এক অন্ধকার বন্দর রয়েছে? সেই বন্দরে অন্ধকার কি এখন প্রবল হয়ে উঠছে? নইলে আমি ফাঁকা জায়গাটা ভরাট করতে চাইছি কেন? কেন আমি পাপকে আহ্বান করছি?

পাপ! তা হবে কেন? তৃণা আমার প্রেমিকা। চার মাস হয়ে গেছে আমাদের প্রেমের বয়স। আমরা বিস্তর সময় কাটিয়েছি মেসেঞ্জারে। ঘুরেছি হাতিরঝিলে, রমনা পার্কে, রবীন্দ্র সরোবরে। খেয়েছি ঢাকা শহরের একাধিক রেস্তোরাঁয়। রিকশায় ঘুরেছি শহরের রাস্তায় রাস্তায়। যদিও হাতে হাত রাখার বেশি আর কিছু করিনি। আমরা যৌথ সম্মতিতে এই জার্নি করছি। প্রেমের বসতি অন্ধকারে নয়, আলোতে। প্রেম শয়তানের কাজ নয়, মানুষের। প্রেমের কারণে আমরা আছি, এই গাছবৃক্ষ নদী সমুদ্র পাহাড় অরণ্য আছে। আছে এই দেশ, এই পৃথিবী, এই মহা বিশ্ব। প্রেম কোনো পাপ নয়, পুণ্য। আর প্রেমের অনিবার্য পরিণতি সেক্স।

তৃণা নাশতা করেনি। একটা ঠোঙায় কিছু কাজু বাদাম এনেছে। কাজু বাদাম আর গ্রিন টি তার সকালের নাশতা। আমি ব্রেড আর কফি খেয়েছি। দুপুর পর্যন্ত কিছু না খেলেও চলবে। খাওয়াটা আজ আমাদের মূখ্য বিষয় নয়। মূখ্য বিষয় একসঙ্গে থাকা, প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করা। খেয়ে কিংবা না খেয়ে। তৃণা ঠোঙাটি আমার দিকে বাড়িয়ে ধরল, ‘খাবে?’ বললাম, ‘হাত ধোয়া নাই, টয়লেট থেকে ধুয়ে আসছি।’ তৃণা হেসে বলল, ‘বাদাম খেতে আবার হাত ধোয়া! এ নাও আমি খাইয়ে দিচ্ছি।’ তৃণা আমার কাছাকাছি এলো। মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটা ভরাট হয়ে গেল। তার হাতটি ধরে বললাম, ‘তোমার হাত কিন্তু খুব সুন্দর।’
‘কেন, মুখ সুন্দর না?’
‘মুখের সৌন্দর্যের কথা কি আর বলতে হয়! আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না এমন সুন্দর মুখের একজন যুবতী আমার প্রেমিকা।’
‘মুখ সুন্দর। ফিগার নিশ্চয়ই খারাপ?’
‘মনেই হয় না বাস্তবের কোনো নারী। মনে হয় শিল্পীর আঁকা কোনো ছবি।’

বাদাম খেতে খেতে আমরা আলাপ করতে থাকি। আলাপ করি রাজনীতি নিয়ে। দেশে একদলীয় শাসন চলছে। চলছে বলেই হরতাল অবরোধ জ্বালাও পোড়াও বন্ধ। বন্ধ বলেই দেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন হচ্ছে, অর্থনীতির বিকাশ ঘটছে। রেমিটেন্স, গার্মেন্টস আর কৃষি সচল রেখেছে অর্থনীতির চাকা। কিন্তু দুর্নীতি লাগামহীন। দুর্নীতি থামাতে পারলে দেশ এতদিনে হয়ে উঠত আবুধাবি-সিঙ্গাপুর। আর মূল্যবোধ ক্রমশ তলানির দিকে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে সহিষ্ণুতা, বাড়ছে সাম্প্রদায়িক সংকট। ধর্মান্ধতা সমাজকে ক্রমশ গ্রাস করছে। ক্ষমতায় টিকে থাকতে ক্ষমতাসীন দল ধর্মান্ধদের সাথে আঁতাতের পর আঁতাত করছে, যার পরিণতিতে দেশ হয়ে উঠতে পারে আফগান-পাকিস্তান।

আমরা আলাপ করি সাহিত্য নিয়ে। ঢাকা হয়ে উঠেছে বাংলা সাহিত্যের রাজধানী। গবেষণামূলক সাহিত্য বা প্রবন্ধে কলকাতা এখনো এগিয়ে। কিন্তু উপন্যাসে? দেবেশ রায়, মুস্তাফা সিরাজ, সুনীলের কাল ফুরিয়ে গেছে। ফুরিয়ে আসছে শীর্ষেন্দু, সমরেশ, শংকর প্রমুখের কাল। কারা ধরবে কলকাতার কথাসাহিত্যের হাল? কলকাতার চেয়ে অনেক ভালো কবিতা লেখা হচ্ছে বাংলাদেশে। উঠে এসেছে একদল শক্তিশালী কথাসাহিত্যিকও। প্রকাশনার ক্ষেত্রেও বহু দূর এগিয়েছে দেশ। বই বিক্রিতে কলকাতার প্রকাশকরা এখন অনেকটা বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশে হয়েছে আন্তর্জাতিক মানের একাধিক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। সাহিত্যের অগ্রসর পাঠকের সংখ্যাও বেড়েছে। এক কালের চটুল জনপ্রিয় সাহিত্যিকদের সাহিত্য থেকে পাঠকরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।

আমরা আলাপ করি সমাজ-সংস্কৃতি নিয়ে। দেশে ডিভোর্সের হার বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে পরকীয়া। এক পুরুষ এক নারীতে কিংবা এক নারী এক পুরুষে তৃপ্ত থাকতে পারছে না। নারীরা এখন আর পুরুষের আধিপত্য মানতে চাইছে না। এর কারণ নারীর ক্ষমতায়ন। নারীরা ঢুকে পড়ছে নানা পেশায়। মোল্লাতন্ত্র যতই চাইছে নারীকে গৃহবন্দি করে রাখতে, পারছে না। সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটছে নীরবে। বাঙালি সংস্কৃতি ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। ধর্মান্ধতা যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে ধর্মহীনতাও।

আমরা আলাপ করি সিগমুন্ড ফ্রয়েড নিয়ে।…একথা স্বীকার করতেই হবে যে, মানবসত্তা পুরুষ ও নারীর যুগলবন্দি শুনতে চায়। তার এক হাতে পৌরুষের উদ্দাম মন্দির, অন্যহাতে নারীত্বের মরমী সেতার। এই দুই নিয়েই বেজে ওঠে জীবনের কনসার্ট। একটি সুন্দরী নারীকে দেখে পুরুষের মনে এবং একটি বলিষ্ঠ স্বাস্থের সুপুরুষ দেখে নারীর মনে আসক্তি ও কামভাব জাগ্রত হবে এটাই তো স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকত্বের মধ্যে যারা অন্যায় ও পাপ অনুসন্ধানে তৎপর হয়, তারা অসুস্থ মস্তিষ্কের।

তৃণা বলল যে তার ঘুম পাচ্ছে। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। কেন হয়নি আমি বুঝতে পারি। যে কারণে আমার হয়নি একই কারণে তারও। রাতভর বিপুল উত্তেজনা আমাদের মাথায় ঘুরে বেড়িয়েছে। উত্তেজনার সঙ্গে ঘুমের শত্রুতা চিরকালীন। বললাম, ‘আমরা কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিতে পারি। আমি কি উপরের সিটে উঠব?’ তৃণা বলল, ‘উপরে ওঠার দরকার নাই, এখানেই শুবো দুজন।’ আমি হেলান দিয়ে বসলাম। বাদামের ঠোঙা, চুলের কাঁটা আর মোবাইলটি ছোট্ট টেবিলটায় রেখে আমার কোলে মাথা রাখল তৃণা। আমি তার মাথায় হাত রাখি। চুলে হাত বুলাই। তৃণা বলে, ‘এভাবে হাত বুলালে কিন্তু ঘুমিয়ে পড়ব।’
‘ঘুমানোর জন্যই তো বুলাচ্ছি।’
‘ঘুমের মধ্যে অন্য কিছু হয়ে যাবে না তো?’
‘হয়ে গেলে যাবে। হওয়া না হওয়া নিয়ে তো আমাদের চিন্তা নাই।’
কোনো এক স্টেশনে থামল ট্রেন। কোন স্টেশনে জানি না। কেননা আমরা এখন পরস্পরকে জানছি। অন্য কিছু জানার প্রয়োজন বোধ করছি না। তৃণা উঠে বসল। কারণ বাইরে থেকে জানালা দিয়ে ভেতরটা দেখা যাচ্ছে। তৃণাকে আমি শুয়ে থাকতে বলি। দেখা গেলে সমস্যা কী? কেউ তো তদন্ত করতে আসবে না আমরা স্বামী-স্ত্রী কিনা। তৃণা শোবে না। ভেতরের সংকোচ তাকে বাধা দিচ্ছে। বাইরে হকারের হাঁক শোনা যাচ্ছে। তৃণা চা খাবে কিনা জানতে চাইলাম। খাবে না। খেলে ঘুম চলে যাবে। একটু না ঘুমালে সে ক্লান্ত হয়ে পড়বে। ক্লান্ত হলে ভ্রমণ উপভোগ্য হবে না।

ট্রেন ছাড়ল। তৃণা আমার কোলে আবার মাথা রাখল। তার চুলের ঘ্রাণ আমার ভেতরের অন্ধকার বন্দরকে জাগিয়ে তুলছে। আমি তার মাথায় হাত বুলাতে থাকি। বুলাতে বুলাতে হাত নেমে এলো কপালে। কপালটা টিপতে থাকি। টিপতে টিপতে হাত নেমে এলো চোখে। দুই আঙুল বুলাতে থাকি দুই চোখের পাতায়। বুলাতে বুলাতে হাত নেমে এলো ঠোঁটে। তৃণা চোখ বন্ধ করে আছে। হাত ক্রমশ আরো নিচে নামতে থাকলেও সে বাধা দেবে না। কেননা কোনো কিছু হওয়া না হওয়ার ব্যাপারে আমরা চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি। ফলে আমার হাত যেখানে যাওয়ার যেতে থাকে। ঠোঁট যেখানে যাওয়ার যেতে থাকে। তৃণা কেঁপে কেঁপে উঠছে। আকাশে ওড়ার সময় মেঘের স্পর্শে প্লেন যেভাবে কেঁপে কেঁপে ওঠে। তার ঘুম উধাও হয়ে গেছে। উত্তাপ বেড়ে গেছে দুজনের শরীরের।

কবি সারওয়ার জাহান একদিন আমাকে বলেছিলেন, শোনো মিয়া, জীবনে সবচেয়ে উত্তম কর্ম কী জানো? সঙ্গম। নরনারীর মিলন। সঙ্গম মানে জীবনকে সজীব রাখা। সঙ্গম মানে দুটি নদী এক মোহনায় মিশে সমুদ্রে লীন হওয়া। সঙ্গম মানে মহাশূন্যে উঠে যাওয়া। সেই মহাশূন্যে দুজন ছাড়া আর কেউ থাকে না। না কোনো মানুষ, না কোনো পশু, না কোনো পাখি। এইসব শিল্প সাহিত্য সিনেমা নাটক বাস ট্রাক ট্রেন প্লেন প্যান্ট শার্ট শাড়ি গয়না জুতা সভ্যতা দ্বিধা সংকোচ লজ্জা ভয় কিচ্ছু থাকে না। সেই মহাশূন্যতায় লা-মাকান। সেখানেই বোধিবৃক্ষ। সেখানেই দ্বারকা-মথুরা-বৃন্দাবন।

আমরা সেই শূন্যতার দিকে যাত্রা শুরু করি। আমাদের পোশাক পড়ে যেতে থাকে সিটের নিচে। আমাদের চারপাশের দৃশ্যগুলো যেতে থাকে মুছে। আমরা জানালার বাইরের কোনো দৃশ্য দেখি না। ভেতরেরও না। দরজা জানালা সিট ফ্যান টেবিল ব্যাগ মোবাইল জুতা কিচ্ছু না। দেখি শুধু পরস্পরের মুখ। দেখি শুধু পরস্পরের চোখ। দেখি শুধু পরস্পরের ঠোঁট। আমরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে ক্রমশ শূন্য থেকে উঠে যেতে থাকি মহাশূন্যে। আমরা ভাসতে থাকি লা-মাকানে। আমাদের মুখে অবিরাম বাজতে থাকে বৃন্দাবনের বাঁশি।

সারওয়ার জাহান বলেছিলেন, সেই মহাশূন্য থেকে ফেরার পর যাকে ভালো লাগবে সেই তোমার প্রেমিকা। আর যাকে ভালো লাগবে না সে গণিকা। আমরা মহাশূন্য থেকে কেবিনে ফিরলাম। পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তৃণাকে আমার ভালো লাগছে। সুতরাং সে আমার প্রেমিকা। তৃণার চোখেও ভাসছে আমার প্রতি ভালো লাগা। সুতরাং আমি তার প্রেমিক। আমরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকি। উঠতে ইচ্ছা করে না। ইচ্ছা না করলে কেন উঠব? ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমরা তো কিছু করব না। নীলসাগর এক্সপ্রেস ছুটে চলছে দূরন্ত গতিতে। চলছে আর দুলছে। দুলুনির তালে তালে আমরাও দুলতে থাকি।

তবু আমাদের উঠতে হলো। কারণ লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে। ট্রেনে কি ভাত পাওয়া যাবে? যাওয়ার কথা। আমি এটেন্ডেন্টকে ডাকার জন্য দরজা খুলতে চাইলাম। তৃণা আমার হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিল। বলল, ‘তুমি কি ভাবছ আমি খাবার আনিনি? এই দেখ।’ তৃণা একটি ব্যাগ থেকে দুটি বক্স বের করল। বাসায় তৈরি মোরগ-পোলাও। খেতে খেতে তৃণা রান্নার কলাকৌশলের বর্ণনা দেয়। সে রান্না করতে ভালোবাসে। রান্না তার কাছে একটা আর্ট। এই আর্টে সম্পূর্ণ মনযোগ না দিলে কাক্সিক্ষত স্বাদ মেলে না।

রান্না থেকে আমাদের আলাপ গড়ায় বাঙালির খাদ্য সংস্কৃতিতে। খাদ্য সংস্কৃতি ক্রমে পাল্টে যাচ্ছে। ভাতের বদলে মানুষ এখন ঝুঁকে পড়ছে ফাস্টফুডে। টিকেট চেকার এসে চেক করে গেল টিকেট। চা-অলা দিয়ে গেল দুই কাপ চা। খেতে খেতে আমরা আলাপ করতে থাকি। আলাপে আলাপে ট্রেন পৌঁছে গেল চিলাহাটি স্টেশনে। বাইরে পদশব্দ, হাঁকডাক। যাত্রীরা নামছে। ব্যাগ গুছিয়ে আমরাও নামি। কিন্তু কোথায় যাব? চিলহাটির কিছুই তো চিনি না। তৃণা বলল, ‘চিনি না বলেই তো আমরা এখানে এসেছি। কোথাও যাওয়ার দরকার নাই, স্টেশনে বসে গল্প করেই কাটিয়ে দেব। মাত্র তো তিন ঘণ্টা, দশটায় ফিরতি ট্রেন।’

আমি বললাম, ‘আমরা কিন্তু রিকশায় ঘুরতে পারি।’ বলতেই রাজি হয়ে গেল সে। একটা রিকশা নিয়ে আমরা ঘুরে দেখলাম চিলাহাটি। আসলেই কি দেখলাম? মনের যোগ ছাড়া চোখ কি দেখার ক্ষমতা রাখে? আমাদের মন তো ঢুকে বসে আছে পরস্পরের মনে। সুতরাং আমরা আসলে কিছুই দেখিনি। চিলাহাটির কোনো দৃশ্যই আমাদের স্মৃতিতে থাকবে না। স্টেশনের কাছে এক হোটেলে ডিনার করে সাড়ে আটটার মধ্যে আবার স্টেশনে চলে এলাম। ট্রেন ছাড়তে আরো দেড় ঘণ্টা। আমাদের বিরক্তি লাগছে না। দেড় ঘণ্টা কেন, দশ ঘণ্টা কাটিয়ে দিতেও আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আমি এক বাদামঅলার সাথে কথা বলি, পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে যে সাতাশ বছর বদলি জেল খেটেছে। তৃণা এক ভিখেরিনীর সাথে কথা বলে, স্বামীর নির্যাতনে যার একটা চোখ নিভে গেছে। স্টেশন এক বিচিত্র জায়গা, যেখানে ঘুরে বেড়ায় বিচিত্র সব মানুষ।

ট্রেন ছাড়ল সাড়ে দশটায়। আধা ঘণ্টা লেট। এবার আমরা অন্য আরেকটি কেবিনে। একই রকম। উপরে-নিচে দুটি সিট। এটেন্ডেন্ট এসে আমাদের দিয়ে গেল কাঁথা-বালিশ। ট্রেন চলছে, চলছে আমাদের কথা। নানা বিষয়ে আমরা কথা বলি। নাটক, সিনেমা, ফেসবুক, ইউটিইউব, সংগীত। দেখার মতো কোনো নাটক-সিনেমা পাই না। কত ভালো ভালো গল্প লেখা হচ্ছে, অথচ নির্মাতারা পড়েই দেখে না। তারা নিজেরাই কাহিনিকার, নিজেরাই চিত্রনাট্যকার, নিজেরাই পরিচালক। পারলে তো নিজেরাও অভিনয় করে। ফেসবুক খুললেই আত্মপ্রচার ও বিষোদগার। ইউটিইউব খুললেই হিরো আলম আর ধর্মজীবীদের ওয়াজের নামে ভাঁড়ামি। ষাট ও সত্তর দশকে যেসব গান লেখা হয়েছিল, এখন কই? রবীন্দ্র-নজরুল-ডিএল রায়কে কবে ছাড়িয়ে যাবে গীতিকাররা?

আমরা কথা বলি বাৎসায়নের কামসূত্র নিয়ে।… আলিঙ্গন স্বীকার করিয়া লইলে, তখন মুখে করিয়া তাম্বুল দান করিবে। যদি তাহা লইতে না স্বীকার করে, তবে স্বান্ত্বনাকর বাক্যে, শপথদ্বারা প্রতিযাচিত দ্বারা কিংবা পাদপতক দ্বারা গ্রহণ করাইবে। লজ্জাযুক্তই হউক, আর অত্যন্ত ক্রোধপরিভুতাই হউক, কামিনী কখনই পাদপতনকে অতিক্রম করিতে পারে না।…ঊরুর উপরে হস্ত বিন্যস্ত করিয়া সম্বাহনক্রিয়ায় সিদ্ধিলাভ করিতে পারিলে ক্রমে ঊরুমূলেও সম্বাহন করিতে প্রবৃত্ত হইবে। সম্বাহন করিতে নিবারন করিলে ‘দোষ কি’ বলিয়া নায়িকাকে পর্যাকূল করিবে। তাহা সরাইয়া লইবে। পরে, তাহা সহ্য হইলে তাহার গুহ্যদেশ স্পর্শ করিবে, রশনা খুলিয়া দিবে, নীবি খুলিয়া দিবে, বসন পরিবর্তন করিয়া দিবে এবং ঊরুমূল সম্বাহন করিবে।

আমি ভেবেছিলাম আমরা আবার মহাশূন্যের দিকে যাত্রা করব। কিন্তু তৃণার খুব ঘুম পাচ্ছে। আমি বললাম, ‘আমরা ঘুমাব না। চব্বিশ ঘণ্টা জেগে থেকে প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করব।’ তৃণা বলল, ‘পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে ঘুমও কিন্তু এক ধরনের উপভোগ।’ বটে। তার কথায় আমি একমত হই। মহাশূন্যে যেতেই হবে এমন তো কোনো শর্ত নেই। আমরা তো আগেই ঠিক করে রেখেছি জোর করে কিছু হওয়াতে যাব না। তাই আগের মতো আমি আবার হেলান দিয়ে বসলাম। আমার কোলে মাথা রাখল তৃণা। নীলসাগর এক্সপ্রেস ছুটছে। নীলসাগর এক্সপ্রেস দুলছে। দুলুনির তালে তালে আমি তৃণার চুলে হাত বুলাই। ট্রেন চলছে। আমি তৃণার বুকে হাত চালাই। ট্রেন দুলছে। আমি তৃণার পেটে হাত বুলাই। ট্রেনের দুলুনির তালে তালে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি।

যখন আমাদের ঘুম ভাঙল নীলসাগর এক্সপ্রেস তখন কমলাপুর স্টেশনে দাঁড়িয়ে। এটেন্ডেন্ট দরজায় টোকা দিচ্ছে। আমি দরজা খুলে তার হাতে বকশিশ তুলে দিলাম। একদল টোকাই কেবিন ঘুরে ঘুরে পানির বোতল কুড়াচ্ছে। এক টোকাই উঁকি মারল আমাদের কেবিনে। ব্যাগ গুছিয়ে আমরা যখন ট্রেন থেকে নামলাম ঘড়িতে তখন ছয়টা সাতাশ মিনিট। তৃণা বলল, ‘মাত্র সাতাশ মিনিট! অথচ আমরা চব্বিশ ঘন্টা একসঙ্গে কাটাতে চেয়েছিলাম।’

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *