short-story-rohosyo-voyanak

রহস্য ভয়ানক
সাগরিকা রায়

 

        বৃদ্ধ লোকটি পিছন ফিরে বসেছিল। সন্ধ্যার ছায়ায় তাঁর পিঠ দেখা যাচ্ছে। বিরলকেশ মাথাটি চোখের সামনেই। এখন সন্ধে ছ’টা। ছ’টা পনেরোতে এই ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। সময় লাগবে আবাসন থেকে বেরিয়ে যেতে। তারপর এলাকা থেকে বেরিয়ে যেতেও সময় লাগবে কোনও ঝুট ঝামেলা না হলেও। বিশেষ করে লোকের চোখে ধুলো দিয়ে পালাতে হবে। সেই কারণে হাতে সময় চাই। প্রত্যেক বার কাজে হাত দিয়ে পুরো কাজের আগাপাস্তলা চেক করে নেয় প্রিয়ম। ঘড়ি ধরে কাজ ওর।   

দরজা দিয়ে ঢুকে সাবধানে পা ফেলে দাঁড়ায় প্রিয়ম। প্রাত্যহিক রুটিন অনুযায়ী এই সময়ে প্রৌঢ় লোকটি বিজনেসের বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলেন ছেলের সঙ্গে। কিন্তু আজ ছেলে বাড়িতে থাকছে না। সে দিল্লিতে গিয়েছে বিজনেসের ব্যাপারে। প্রৌঢ় এই সময়ে ফাঁকা থাকবেন, এমনটা জানে প্রিয়ম। ওকে এমনটাই ইনফর্ম করা আছে।  

  সিঁড়ি দিয়ে থার্ড ফ্লোরে উঠে বেল বাজানোর কথা নয়। কারণ বাড়ির কিচেনে টাইলস চেঞ্জ এবং পুরো কিচেন রঙ করা হচ্ছে। মিস্ত্রিরা এইসময় বেরিয়ে যাবে বলে দরজা লক করা থাকবে না এখন। মিস্ত্রিদের বেরিয়ে যাওয়ার সময়েই প্রিয়ম এসেছে। ওরা বেরিয়ে যাবে, প্রিয়ম ঢুকে পড়বে। মিস্ত্রিরা বেরিয়ে গেলে পরে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়।  

   ঠিক তাই হল। এখন রঙ মিস্ত্রিরা চলে গেল, আর আড়াল থেকে প্রিয়ম এসে ফ্ল্যাটের ভিতরে ঢুকে পড়ল। ওদের বেরিয়ে আসা আর প্রিয়মের ঢুকে পড়ার মধ্যে অতি সামান্য সময়ের দরকার ছিল। মিস্ত্রিদের একজন ডানদিক ঘেঁষে বের হবে। প্রিয়ম ওর বাঁ হাত ঘেঁষেই ঢুকে পড়বে।

ঢুকেই হালকা অন্ধকার ঘরের মধ্যে চোখ চালালো প্রিয়ম। একটা স্বপ্নীল আলো ঘুমের জড়তা নিয়ে ফ্লোরের কাছের ওয়ালের গায়ে জ্বলছে বলেই লিভিং রুমে চাঁদনী জমেছে যেন।

 দরজা লক করে দিতে কেউ তো আসবে। কিন্তু এখনও কেউ এল না কেন? ফ্ল্যাটে প্রৌঢ়ের স্ত্রী লীলাবতী, কন্যা রায়া থাকবে। তারা কোথায়? নিশ্চয় আশেপাশেই আছে। দরজা খোলা সেটা তারা জানে। নাকি ফ্ল্যাটে দামি জিনিস কিছু নেই? নেই বলেই সে বিষয়ে ভয় নেই। চুরির ভয় এরা করে না? কিন্তু প্রিয়ম শুনেছিল এরা নাকি ভয়ংকর টাইপের ধনী! কিন্তু, টাকাপয়সা রাখে কোথায়? একজন ওকে কাজের ভার দিয়েছে মানে প্রিয়ম নিজের স্বার্থে অন্যদিকটাও দেখে নেবে না, তা হয় না। বুড়োটা বসে থাকে যেখানে, প্রথমে সেখানেই যেতে হবে। সুপারিকিলার প্রিয়ম পার্টির কাজটা আগে করবে। সেটাই নিয়ম এই প্রফেশনের।  

    প্রিয়ম একমুহূর্ত অপেক্ষা করে। কোমরে গুঁজে রাখা বস্তুটিকে একবার স্পর্শ করে নেয়। তারপর, গলা বাড়িয়ে দেখে নেয় ঘরের ভিতরটা। বাইরে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা ঠিক নয়। পিছন থেকে কেউ এসে পড়লেই হল! ধরা পড়ে যেতে সময় লাগে না।

 টুক করে ঢুকে পড়েছে প্রিয়ম। ফ্ল্যাটের ভিতরটা অদ্ভুত নিঝুম। এসি চলছে কোনো ঘরে। লুজ কানেকশনের জন্য একটা শব্দ হচ্ছে। লিভিং রুমে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কেউ নেই যদি, তাহলে ফাঁকা ফ্ল্যাটে এসি চলছে কেন? আর, মিস্ত্রিরা নিশ্চয় ফাঁকা ফ্ল্যাটে কাজ করেনি! মাত্র দুজন মিস্ত্রি ছিল। তারা কিচেনে টাইলস চেঞ্জ করছিল। তাহলে কিচেনেই কেউ আছে? ওহ প্রিয়মকে বলা হয়েছিল ফ্ল্যাটে দুজন মহিলা থাকবে। শব্দ না করে বৃদ্ধের ঘরে ঢুকে কাজ কমপ্লিট করে ফেলতে হবে। এখন মহিলাদের সাড়া না পেলে গতিক ঠিক দিকে যাচ্ছে কিনা, বুঝবে কী করে প্রিয়ম?

 বৃদ্ধ এই সময় নিজের বেডরুমে পিছন ফিরে বসে থাকেন খোলা জানলার সামনে। মুখ থাকে বাইরের দিকে। কাজটা এই সময়েই করে ফেলা উচিত। সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকবে না। উনি নিজেও আততায়ীকে দেখতে পাবেন না। সুতরাং সময়টা গুরুত্বপূর্ণ অবশ্যই। মহিলারা যেখানে খুশি থাকুক, প্রিয়ম কাজ করে বেরিয়ে যাবে।  

    প্রিয়ম এই আবাসনে আগে দুবার এসেছে। পরপর দুবার নয়। পনেরো দিনের তফাতে দুবার এসে দেখে গিয়েছে ঢোকা এবং বের হওয়ার পথ, লিফটের অবস্থান, সিসি ক্যামেরার অবস্থান। অসুবিধে নেই। যেহেতু নিয়ম মেনে এখন মাস্ক অপরিহার্য, সেহেতু মুখ চেনার সুবিধেও নেই।

বৃদ্ধ কি নড়ে উঠলেন? প্রিয়ম নির্নিমেষে বৃদ্ধের অবয়বের দিকে তাকিয়ে আছে। বৃদ্ধ সামান্য নড়ে ফের শান্ত হয়ে বসেছেন। প্রিয়ম সময় নষ্ট করল না। রিভলবারটা বের করলো শার্টের ভিতর হাত ঢুকিয়ে।

 রিভলবারে একটা ছোট্ট শব্দ হল। এই শব্দ বাইরে যাবে না। কিন্তু বৃদ্ধ চেয়ার থেকে উলটে পড়ে গেলেন মেঝেতে। শব্দটা হল তখন। দমাস শব্দটা এই নির্জন ঘরে এতো তীব্র হয়ে উঠবে, সোমু ভাবেনি। কেউ কি চলে আসবে এখন?

বাইরে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। কেউ আসছে এ ঘরে। প্রিয়ম দরজার আড়ালে যাবে? যে আসছে সে কে?

অপেক্ষা করার মতো সময় নেই। প্রিয়ম প্রথমে ঘরে ঢুকেই যে দরজার আড়ালে লুকিয়ে ছিল, সেখানেই ঢুকে গেল। মুখের মাস্ক এঁটে নিয়ে চোখে নাইট গ্লাস পরে নিল। মাথায় ব্যান্ডানা থাকা সত্ত্বেও টুপি পরে এসেছিল। বারান্দা টুপি কপাল ঢেকে রেখেছে। রিভলবার হাতেই রয়েছে। ঘরের ভিতরে একটা পরিচিত গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে।

   প্রিয়ম নাক টানলো। রক্তের গন্ধ। বুড়ো মরেছে তো? নাকি বেঁচে যাবে? মোটা টাকার বরাত পেয়েছে প্রিয়ম। বুড়োকে বাঁচতে দেওয়া যাবেই না।  

  দ্রত পায়ে কে ঘরে ঢুকে পড়ল। মুখে অস্পষ্ট কথা, “বাপু, আরে বাবুজি, পড়ে গেলেন কেন? কী হল বাবুজি?” বলতে বলতে যে বৃদ্ধের দিকে দৌড়ে যাচ্ছে, তার শাড়ি থেকে মিষ্টি গন্ধ ভাসছে রক্তের গন্ধ ঢেকে দিয়ে।

   প্রিয়ম অন্ধকারের ভিতরে নিঃশব্দে দরজার আড়াল থেকে বের হয়ে লিভিং রুমে চলে গেল। দরজা পর্যন্ত যেতে হবে।এর মধ্যে ঘরের আলো কেউ জ্বেলে দিলে ধরা পড়া যাবে ও। দ্রুত বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে যেতে গিয়ে প্রিয়ম দরজা খুলে ফেলে ঢুকেই বুঝল অন্য ঘরে ঢুকে পড়েছে। এটা বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার দরজা নয়।

পুরো ফ্ল্যাট জুড়ে আলো জ্বালেনি কেন কেউ? অবশ্য এতে ওর ভালো হল। এখন এই ঘর থেকে টুক করে বের হয়ে বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার দরজার দিকে যেতে হবে।   

   প্রিয়ম ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল। ফের লিভিং রুমে এসে পড়েছে। এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছে ও, সেখান থেকে বৃদ্ধের ঘর সোজাসুজি। কিন্তু যখন ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়ে ছিল, তখনও বৃদ্ধের ঘর সোজাসুজিই ছিল দরজা থেকে! পাশাপাশি দরজা আছে কি?

 প্রিয়ম দেওয়াল হাতড়ে দরজা খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে থাকে। এবং খানিকটা নার্ভাস হয়ে পড়ে। মহিলা আলো না জ্বেলেই “বাবুজি, বাবুজি,” করে চলেছেন। যে কোনও মুহূর্তে মহিলার মেয়ে চলে আসবে। 

    প্রিয়ম ডানদিকের দেওয়ালে হাত রাখে। এদিকেই কি বাইরে যাওয়ার দরজা ছিল? হাতড়াতে গিয়ে একটা শরীরের আভাস্ পেল প্রিয়ম। চমকে উঠেছে আর ঠিক সেই মুহূর্তে ধাক্কা খেল। আচমকা ধাক্কা খেয়ে উলটে গিয়ে যেদিকে পড়ল, হাতের ছোঁয়ায় চিনে ফেলল এটাই বাইরে যাওয়ার রাস্তা।

   প্রিয়ম দরজার লক ঘুরিয়ে বাইরের আলোয় বেরিয়ে এল। এক সেকেন্ড অপেক্ষা না করে সিঁড়ির দিকে ছুটল। টকাটক সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে যখন গ্রাউন্ডে নেমে এল, সিকিউরিটি গার্ড টেবিলের ওপরে ঢাউস খাতায় কিছু লিখছে। ওকে দেখেছে কিনা, বোঝা গেল না।

   প্রিয়ম দ্রুত বাইরে বের হয়ে এসে মেইন গেটের দিকে যাচ্ছে, তখন গেটের দিক থেকে কানে ফোন চেপে হেসে হেসে কথা বলতে বলতে যে আসছিল, প্রিয়ম তাকে চেনে। নওলকিশোরের নাতনি রায়া। সে ফোনে মগ্ন বলে প্রিয়মকে খেয়ালই করলো না। প্রিয়ম সুট করে সরে পড়লো। একটা চিন্তা মাথায় কাকের মতো করে ঠোক্কর দিচ্ছে।

আচ্ছা, রায়া তাহলে ফ্ল্যটে ছিলই না? যে ছিল, সে রায়ার মা? বাবুজি বাবুজি করছিল…। প্রিয়ম রায়ার পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। এই ম্যাডাম ফ্ল্যাটে ঢুকে কী দেখবে এখন!

    রাস্তায় নেমে একটা অটো ধরে নিল প্রিয়ম। নেক্সট স্টপেজে নেমে পড়ে জগদীশের ঠেক থেকে বাইক বের করে নিয়ে হাওয়া হয়ে যাবে। অটোর একেবারে সাইডে বসে স্বস্তির শ্বাস ফেলল ও। প্রত্যেকটা কেসএর পরে টেনশনে ভোগে। যতক্ষণ না নিরাপদে নিজের আস্তানায় ফিরতে পারছে, ততক্ষণ স্বস্তি হয় না।

নেক্সট স্টপেজে নেমে জগদীশের ঠেকের পিছনের খুপড়ি ঘরে ওর বাইক রাখা আছে। বাইক নিয়ে বেরিয়ে বেলেঘাটার উদ্দেশ্যে রওনা হতে হতে প্রিয়মের চোখের সামনে নওলকিশোরের ফ্ল্যাটটা ভেসে এল। বাপ রে! বুড়ো শব্দ না করেই উলটে পড়ে গেল। মৃত্যু খুব সহজ! এই আছে, এই নেই! আজ খুব বিপদ ছিল। দরজাটা খুঁজেই পাচ্ছিল না প্রিয়ম।                                                          

রাস্তার ধারে বাইক থামিয়ে স্থির হয়ে রইল ও। রায়া ছিল না ফ্ল্যাটে। তাহলে অন্ধকারে ওকে ধাক্কা দিল কে? কে ছিল অন্ধকারে দাঁড়িয়ে?

আরেকটা কোশ্চেন। ও যখন ফ্ল্যাটে ঢুকে ছিল, একটা ড্রিমি লাইট ছিল লিভিং রুমে। সেই আলো নেভালো কে? যে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছিল?

সে দেখেছে বৃদ্ধের খুন হয়ে যাওয়াটা? কিন্তু চেঁচামেচি করে লোকজন ডাকেনি? সে-ই কি খুনি?   প্রিয়মের সঙ্গে ডিল করেছে সে?

  প্রিয়ম ডিকি থেকে জলের বোতল বের করে জল খেল। একটা কেস কমপ্লিট করেছে ঠিকই, সঙ্গে কিন্তু একটা ঝামেলা ভর্তি রহস্য নিয়ে এসেছে। ও যখন বৃদ্ধের ফ্ল্যাটে ঢোকে, ঘরে ড্রিমি লাইট ছিল। খুন করে ফের সেই ঘরে ঢুকে দরজা পর্যন্ত যেতে পারছিল না কারণ ঘর অন্ধকার ছিল। আলো নিভিয়ে দিয়েছিল কে? কেন? সোমুকে যেন কেউ না দেখে ফেলে সেই জন্যই কি আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছিল? ধাক্কাটা কি দরজা দেখিয়ে দিতেই? 

   প্রিয়মের চুল হাওয়ায় উড়ছে। এই কাজের জন্য ভালো টাকা পেয়েছে। বেশ কিছুদিন আরামে কাটানো যাবে। প্রিয়ম ভাবলো একবার তিথিদের বাড়িতে যাবে। তিথির বাবার করোনা হয়েছিল। এখন সুস্থ হলেও প্রোটিন, ওষুধপত্র দরকার। অথচ তিথিরা অভাবী। কিছু টাকা তিথির মায়ের হাতে দিয়ে আসবে।

 অটো বাঁক নিতেই প্রিয়ম জলা জমির দিকে দেখল। ওদিকে একটা পাম্পঘর আছে। সেখানেই মদনকে খুন করেছিল প্রিয়ম। বছর দুই আগে।এদিকে আসা হয় না বলে মনেই ছিল না। মদনকে কেন খুন করেছিল? ধুস, মনেই নেই। প্রয়োজন তো ওর নয়। ওর শুধু টাকার সঙ্গে সম্পর্ক। মদন বারবার বলছিল, ওকে ছেড়ে দিতে। প্রিয়ম ছাড়ে কী করে?

অটো শিমূলতলায় পৌঁছতেই প্রিয়ম নেমে পড়লো। নওলকিশোরকে কেন খুন করলো প্রিয়ম, এটা ওকে জানতে হবে। প্রিয়ম খুনি। কিন্তু ও কি চিরকাল অন্যের হাতের পুতুল হয়ে থাকবে? ওর জানার অধিকার আছে ও কেন মানুষটিকে খুন করলো। এখন তিথির মাকে টাকা দিয়ে প্রিয়ম ফের যাবে সেই আবাসনে। ওকে জানতে হবে নওলকিশোরকে মেরে ফেলার জন্য সুপারি কে দিয়েছিল ওকে?

    তিথি প্রিয়মকে দেখে খুশি হলেও প্রকাশ করলো না। বরং বিরক্তির ভাবটাই প্রকাশ করলো, “তুমি কোথায় ছিলে? বলে গেলে আসবে, তারপর আর দেখা নেই। কী করো সারাদিন?”   

    প্রিয়ম জবাব না দিয়ে সামনের ঘরে ঢুকে পড়লো। তিথির বাবা শুয়ে আছে্ন। বিছানা বলতে চৌকির ওপরে একটা সস্তা বেডশিট পেতে রাখা। ওকে দেখে চোখে আলো জ্বলে উঠলো যেন, “এলে? তোমার কথাই ভাবছিলাম। শরীর জুতের নেই। দোকানটা বন্ধ। মেয়েটা কী করে যে সংসার চালাচ্ছে, কে জানে! টিউশনি করে গোটা চারেক। অনলাইনে। টাকা পয়সা পায়ই না বলতে গেলে। চেহারাটাও ভেঙে গিয়েছে। করোনা যুগ কবে শেষ হবে বলো তো?”

  প্রিয়ম কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কথা শোনে। বয়স্ক মানুষ।কথা বলার লোক না পেয়ে মুষড়ে থাকেন। ওর কাছে সুখ দুঃখের ঝাঁপি ঢেলে স্বস্তি পেলেন। প্রিয়ম তিথির মায়ের খোঁজ করলো। তিথি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভেজা চুল আঁচড়াচ্ছিল। তিথির মা একগাদা জামাকাপড় নিয়ে কাচাকুচি করছে। রোগা চেহারায় অভাবের ছাপ স্পষ্ট। প্রিয়ম কাছে গিয়ে দাঁড়ালো, “কাকিমা, কিছু টাকা রাখো।”

   বলতে বলতে পকেট থেকে একগাদা নোট বের করে তিথির মায়ের হাতে দিলো। তিথি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলো। বারণ করার ইচ্ছে থাকলেও সংসারের দিকে তাকিয়ে বারণ করতে পারে না তিথি। এটা বোঝে সোমু। নওলকিশোরের জন্য পাওয়া সুপারির টাকার খানিকটা উদ্ধার হলো পুণ্য কাজে।

তিথিকে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে আসতে আসতে প্রিয়মের হাসি পেল। নওলকিশোর এখন কী করছে? গিয়ে দেখাই যাক।

 

 

   আবাসনের কাছাকাছি এসে একটি পান দোকানের সামনে দাঁড়াল প্রিয়ম। পরিস্থিতি বুঝে এগিয়ে যাবে ও। খুনটা কি সবাই জানতে পেরে গিয়েছে? নওলকিশোরের পুত্রবধু যেভাবে “বাবুজি বাবুজি” করে ডাকাডাকি করছিল, তাতে তো ইতিমধ্যেই আশেপাশের লোকজন ঘটনা জেনে ফেলেছে।

   প্রিয়ম একটা সিগারেট নিল। আগুন ধরাতে ধরাতে পানদোকানির দিকে তাকালো। লোকটা নির্বিকার মুখে পান সাজছে। এখান থেকে আবাসনটা বেশি দূরে নয়। যদি খুনের খবর জেনেই থাকে লোকটি, তাহলে এমন নির্বিকার থাকতে পারবে?

কে জানে ! ইদানিং ক্রাইম নিয়ে মানুষ বেশি মাথা ঘামায় না। দিনে দুপুরে খুন হচ্ছে মানুষ। পরিবারের মধ্যে খুনোখুনি চলছে। মানুষ বোধহয় ধাতস্থ হয়ে পড়েছে এই পরিস্থিতিতে।  প্রিয়ম সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল। দু চারজন যারা আসছে,পান,সিগারেট নিয়ে চলে যাচ্ছে। কারও মধ্যে হেলদোল নেই। তাহলে কি এখনও কিছু টের পায়নি এলাকার লোক ? নাকি বুড়ো মরেনি?

সে কী করে হবে? বুড়ো না মরলে প্রিয়ম ঝামেলায় পড়ে যাবে যে! ওকে ডিল-এর টাকা ফেরত দিতে হবে। সে টাকার অনেকটা তিথিদের বাড়িতে আছে এখন।

    প্রিয়ম চঞ্চল হয়ে পড়লো। একবার তো আবাসনে যেতেই হবে। অনেক প্রশ্নের জবাব পেতে হবে। যদিও সুপারি নেওয়ার পরে কাজটা কমপ্লিট করাই একমাত্র উদ্দেশ্য। তার আগে পরে কিছু জানার অধিকার নেই। নেই ঠিকই। কিন্তু প্রিয়ম নিজের কাছে জবাব দিতে চায়। কেন নওলকিশোরের পুত্রবধু শ্বশুরের মৃত্যুর সম্ভাবনার কথা বুঝেও চেঁচামেচি করেনি? একচুয়ালি খুনের জন্য প্রিয়মকে ভাড়া করেছে কে? রায়া না তার মা? শ্বশুর মরে গেলে লাভ বেশি রায়ার? না ওর মায়ের?

  পানের দোকানের সামনে থেকে আস্তে আস্তে সরে আবাসনের দিকে এগিয়ে গেল প্রিয়ম। আবাসনের সামনে লোকজন নেই। বিরাট গেটের বাইরে থেকে উঁকি দিল ও। সিকিউরিটি গার্ড টেবিলের সামনে বসে আছে। পেন দিয়ে কী আঁকিবুঁকি কাটছে।

অর্থাৎ, হয় নওলকিশোর মরেছে। বা মরেনি। তবুও প্রশ্ন আছে। গুলি চলেছে। নিহত না হলেও আহত হয়েছে অবশ্যই। প্রিয়মের হাত কাঁচা হাত নয়। তো, এই আবাসনের একজন আহত হয়েছে। তবুও কারও ভ্রুকুঞ্চন নেই কেন? পুলিশ আসেনি! অদ্ভুত লাগলো প্রিয়মের। রায়া, ওর মা পুলিশ ডাকেনি!

লিফটের দরজা খুলে যেতেই দূর থেকেই রায়াকে লিফট থেকে বের হতে দেখল প্রিয়ম। রায়া শপিং ব্যাগ নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছিল। লিফটে ঢুকে পড়লো প্রিয়ম। আশঙ্কা ছিল, ওকে রায়া দেখে ফেলে কিনা। কিন্তু রায়াকে দেখে মনে হলো রায়ার নজর কোনদিকেই নেই। ও দ্রুত বেরিয়ে গেল। তাড়াহুড়ো করছে বেশ।

 লিফটের ভিতরে এখন কেউ নেই। লিফট সেকেন্ড ফ্লোরে পৌঁছতেই বেরিয়ে এল প্রিয়ম লিফট থেকে। থার্ড ফ্লোরে যেতে সিঁড়ি ইউজ করলো। নওলকিশোরের ফ্ল্যাটের সামনে গিয়ে ইতস্তত করলো। বেল বাজলে কে দরজা খুলবে? কেন এসেছে প্রিয়ম? রঙ মিস্ত্রির লোক বলবে নিজেকে। ভাবতে ভাবতে ডোর বেলএ আঙুল ছুঁয়েছে। ভিতরে বেল বাজছে। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না কেন? পুত্রবধুও কি শপিং এ গিয়েছে? নাকি বডিটা লুকোতে ব্যস্ত? এসব কেসএ এরকমই হয়। ঘরের লোক আপনজনকে মেরে দিয়ে বডি নিয়ে ঝামেলায় পড়ে যায়। কম কেস তো দেখলো না প্রিয়ম। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তো বেশি টাকা নিয়ে ওকেই বডি হাপিস করতে হয়েছে। এখানেও টাকা দিলে বুড়োর বডি ব্যাগে ঢুকিয়ে হাপিস করে দিতো। ব্যাস।

  প্রিয়ম দরজায় হাত দিয়ে সামান্য ঠেলে দেখলো। আগের বার যখন এসেছিল, দরজা খোলা ছিল। কিন্তু এবারে কি খোলা থাকবে? জোরে চাপ দিয়ে বুঝতে পারলো দরজাটা বন্ধ। এখন কী করা উচিত?

   প্রিয়ম নিজের নিয়ম মেনে দরজার লক খুলে ভিতরে ঢুকে পড়লো। ওর একটা কথা মনে পড়েছে। ও বুড়োকে গুলি করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় রায়াকে শপিং করে ফিরতে দেখেছিল। এইটুকু সময়ের মধ্যে রায়া ফের শপিংয়ে যাচ্ছে? ঘন্টা খানেকের মধ্যেই? কেন? রায়া প্রথমবার ফ্ল্যাটে ঢুকেই কি বুড়োর বডি দেখেনি? দেখেও চুপচাপ থেকেছে? নাকি দেখেনি?

দেখেছে। রায়া সেকেন্ড টাইম শপিং করতে যায়নি। ও বডি রাখার জন্য বড় ব্যাগ কিনতে গিয়েছে কি? হতে পারে। শুধু রায়াই নয়। সঙ্গে রায়ার মা আছে? বুড়োর বডি কোথায় লুকিয়ে রাখলো এরা? আছে নিশ্চয় খাটের নীচে কাপড়ে মুড়ে রাখা অবস্থায়। কী করবে প্রিয়ম এখন? ওর তো এসব দেখার কথা নয়। টাকা পেয়েছে। ব্যস।

 অনেক খুন করেছেও। কিন্তু এমন রহস্য অন্য কেসগুলোতে পায়নি। যাবে ফ্ল্যাটের ভিতরে ।

অন্ধকার ফ্ল্যাটের ভিতরে সাবধানে ঢুকে পড়লো প্রিয়ম। নওলকিশোরের ঘর এখান থেকে সোজাসুজি। প্রিয়ম এগিয়ে গেল। বুড়োর বডি পড়ে আছে মেঝেতে। জানলা থেকে অল্প আলো আসছিল। সেই আলোতে বুড়োকে পড়ে থাকতে দেখল প্রিয়ম। খুব আশ্চর্য হলো ও। বডি এভাবেই পড়ে আছে? ঘরে কেউ নেই! পুত্রবধু কোথায়? প্রিয়ম কি ঝামেলায় পড়ে গেল? ফের আবাসনের ভিতরে ঢুকেছে সিকিউরিটির চোখ এড়িয়ে। অসুবিধে নেই। ও রঙ মিস্ত্রি। যাবে থার্ড ফ্লোরে। সিকিউরিটি জানে ওই ফ্ল্যাটে রঙের কাজ হচ্ছে।

কেউ প্রশ্ন করেনি। প্রিয়ম এখনই চুপচাপ বেরিয়ে যাবে।

বের হয়েই যাচ্ছিল প্রিয়ম। বুড়োর বডির পাশে ঝাপসা আলোতে বড় একটা কিছু রাখা আছে দেখে দাঁড়ালো। ওটা কী? প্রিয়ম নীচু হলো। তারপরেই…!

সমস্ত শরীরে ভয় থিরথির করছিল ওর। নওলকিশোরের পুত্রবধুর বডি পড়ে আছে । রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে।

দু দুটো বডি! কে মেরেছে পুত্রবধুকে? রায়া? রায়া ছাড়া ফ্ল্যাটে অন্য কেউ ছিল না। রায়া পুলিশকে না ডেকে শপিং এ গেল? অদ্ভুত! ও পালিয়েছে!  প্রিয়ম এখনই বেরিয়ে যাবে এখান থেকে। কে চলে আসবে, কে জানে!

ডোর বেল বাজছে। কে এসেছে? রায়া মিনিট পাঁচেক হলো শপিং এ গিয়েছে। সে এখনই ফিরবে না। তাহলে?

ফের বেল বাজলো। যে এসেছে সে জানে না ফ্ল্যাটে প্রিয়ম আছে। প্রিয়ম স্থির হয়ে গেল। স্বাভাবিক মুখে দরজা খুলে নিজেকে রাজমিস্ত্রি বলে পরিচয় দিয়ে বেরিয়ে যাবে। একবার বেরিয়ে গেলে প্রিয়মকে আর খুঁজে পায় কে? 

প্রিয়ম দরজা খুলে দিল। রায়া দাঁড়িয়ে আছে। পিছনেই পুলিশ। রায়া সরাসরি আঙুল তুললো, “এই লোকটি আমার দাদু নওলকিশোর চৌধুরীকে গুলি করে মেরেছে।”

 রায়া পুলিশ ডেকে এনেছে? পুরো ব্যাপারটা প্রিয়মকে ফাঁদে ফেলার জন্য করেছে রায়া? ও জানতো ওকে বেরিয়ে যেতে দেখলেই ফ্ল্যাটে ঢুকবে প্রিয়ম?  

 প্রিয়ম আর্তনাদ করে, “মিথ্যে বলছে স্যার। এই মহিলা আর ওর মা মিলে বুড়োকে মেরেছে। তারপর এই মহিলাটি নিজের মাকে খুন করে বাইরে চলে গিয়ে আপনাদের ডেকে এনেছে। আমাকে ফাঁসানো হয়েছে স্যার।”

“আমাকে কেউ মারেনি অফিসার। এই লোকটি আমার শ্বশুরকে মেরেছে।”

 প্রিয়ম বিস্ময়ে কথা বলতে ভুলে গেল। পুত্রবধুটি সারা গায়ে লাল রঙে মেখে এসে দাঁড়িয়েছে। এ মারা যায়নি? প্রিয়মকে হাতকড়া পরিয়ে দিয়েছে কখন প্রিয়ম জানতেই পারেনি। ও স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছে। এসব কেন হচ্ছে?

অফিসার প্রিয়মের দিকে তাকালেন, “নওলকিশোর চৌধুরীকে কেন খুন করলে? তুমি সুপারি কিলার। বহুদিন ধরে তোমাকে খোঁজা হচ্ছিল।”

ঘটনার তল খুঁজতে না পেরে হাত কাঁপছে সোমুর। তবু বুদ্ধি হারায়নি। মোবাইল থেকে রেকর্ড করা ডিল শোনালো, “শুনুন স্যার, একদিন ফোনে আমাকে সুপারি দেওয়া হয়। অনেক টাকার অফার ছিল। সব খুঁটিয়ে বলা আছে। নওলকিশোর কটার সময় কোথায় বসে থাকবেন। সেই সময় ফ্ল্যাটে কী ভাবে ঢুকবো…। সব। শুনুন। এই কন্ঠস্বর কার আমি জানি না।”

রেকর্ড করা কথা শুনতে শুনতে অফিসার একটা শব্দ শুনে পিছন ফিরে তাকালেন। কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে দরজার মুখে।

“কে?” অফিসার জানতে চান।

“আমি নওলকিশোর চৌধুরী। আমিই সুপারি দিয়েছিলাম প্রিয়ম দানাদারকে। ও দানা ভরে দেয় কপালে। আমাকে খুন করার সুপারি দিয়েছিলাম।”

“কেন? কেন এ কাজ করলেন? আমি আপনাকে গুলি করেছি। আপনি বেঁচে গেলেন কী করে?” প্রিয়ম চেঁচিয়ে ওঠে।

“ওটা আমি নই যাকে তুমি চেয়ারে বসে থাকতে দেখে গুলি করেছ। ওটা একটা বড় পুতুল। তোমাকে আমার ফ্ল্যাটে আনা খুব দরকার ছিল। খুব কষ্ট করে পুলিশের সঙ্গে মিলে তোমার ফোনের নাম্বার জোগাড় করি। কারণ, আমার ভাইপো সুহাস চৌধুরী তিনমাস আগে খুন হয়। তাকে কে খুন করেছিল আমরা জানি না। কেবল এ কথা জানা গিয়েছে যে সুপারি কিলার ওকে খুন করে। সিসি ক্যামেরায় প্রিয়মকে দেখেছি আমি। একমাত্র প্রিয়ম বলতে পারবে যে, কে সুহাসকে মারার জন্য সুপারি দিয়েছিল। তাই ওকে ফাঁদে ফেলে আমার ফ্ল্যাটে আনি। বাকিটা থানা জানে সব।”

 প্রিয়ম বলল, “ফোনে ডিল হয়েছিল। আমি তাঁকে দেখিনি। যেমন আপনাকে আমি দেখিনি।”

“কিন্তু তুমি ফোন রেকর্ড করে রাখো। এটা সতর্কতা তোমার। আমরা সেই রেকর্ড ওপেন করেছি। শুনুন।” পুলিশ অফিসার রেকর্ড অন করলেন।

রেকর্ড অন হয়েছে। প্রথমে অস্পষ্ট, পরে স্পষ্ট শোনা গেল দুজনের কন্ঠস্বর। একজন প্রিয়ম। অন্যজনের গলা শুনে আর্তনাদ করে ওঠেন নওলকিশোর, “এ তো আমার মুন্না। আমার ছেলে আদিত্য। ও নিজের কাকার ছেলেকে খুন করার জন্য সুপারি দিয়েছিল? সব সম্পত্তির জন্য? ওর অনুপস্থিতিতে সব সম্পত্তি পাবে আদিত্য? এই জন্য এতো পাপ?”

গর্ত খুঁড়ে সত্য বের করতে গিয়ে বিষের ধোঁয়ায় চোখ পুড়ে যাচ্ছে যেন নওলকিশোরের। আদিত্যর স্ত্রী, মেয়ে রায়া দু হাতে মুখ ঢেকে আছে।

একটি অপরাধীকে ধরতে গিয়ে পুরো পরিবার জান লড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু এতো বড় প্ল্যানের বিষয়ে আদিত্য জানতে পারলো না কেন?

“ও কেদারনাথ গিয়েছে সুহাসের নামে পুজো দিতে। ও চলে যাওয়ার পরে আমরা এই তিনজন মিলে প্ল্যান করে খুনিকে ধরার চেষ্টা করেছি। ভেবেছি, আদিত্য ফিরে এলে ওকে চমকে দেব।” আদিত্য কেদারনাথে যায়নি। দিল্লিতে ছিল। পুলিশি তৎপরতায় ওকে এরেস্ট করা সম্ভব হয়। প্রিয়মের নামে একাধিক খুনের কেস আছে। কতদিন জেলের বাইরে আসবে সে নিজেও জানে না। জানে, চোখের সামনে একটা কালো দেওয়াল নিজের হাতে বানিয়েছে ও। সেই দেওয়াল ভেঙে ফেলার ক্ষমতা ওর নেই।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *