short-story-rong-milanti

রঙমিলান্তি
পাভেল আল ইমরান




হারিকেনডা মুইচ্ছাও রাহে না মাগিডায়। বাতিডাত ইট্টুও হর নাই। ভীত মস্তিষ্কে বিড়বিড় লাফিয়ে দিয়ে মইজুদ্দিন ঘরের কড়িকাঠ পার হয়। কিচকিচ্চা আন্ধার। আত নায়াইলে আত দ্যাহা যায় না। তারউরপে হেই হাঁঝেত্তেন মেঘ অইতোই আচে। মছিবতের মেঘ কমতোই য়াচেনা। উঠানের মাটি ক্ষয়ে গেছে বৃষ্টির উপদ্রবে। মাডিগুলা সব ওই রাকখইস্যা ঝিলের পেডে জাইবো। বলে সে ঝিলের দিকে নজর দেয়। বিসর্পিত বৃদ্ধ ঝিলের চিবুক গাল বাহু ফেটে দীর্ণতা ঢুকিয়ে দিচ্ছে পেটে। পারজীর্ণ শিকড় ত্যাঁদড় ছেলেপেলের খিলখিল দাঁত সাজিয়ে হাসে। মস্ত পেট আরো ঘন কালো জলে থিকথিক। কালো জলের মাছেরাও কালো পিঠ দেখাতে উঠে আসে প্রায়শই জলের উপরে। পারে ঝোপঝাড়ের প্রতিযোগ— কে কত অধিক পাতাভরা হতে পারে। ঢেঁকিশাক, চোচরাপাতা গাছ, হাইরার লতা, মোস্তাগ গাছ একে অন্যেকে ঠেলে দখলদারি বাড়িয়ে নিচ্ছে। নানাপদি সাপের মুখ উঁকিঝুঁকি মারে। অন্যগ্রামের লোকজন ঝিলটিকে আদর করে ঝিলডানা কেউ সাগরডানা নামে ডাকলেও ঝিলপাড়ে বাসকারী মইজুদ্দিনের পরিবার রাকখুশেমুক সাব্যস্তে রেখেছে। চারপাশে প্রাচীন আমলের অন্ধকার ধরে গাছগুলি পাতায় পাতায় দিনের আলোকেও নিমিষে গিলে ফেলতে পারে। সন্তত সুপারির সার অনাথ ছোকরার মাথায় দুহাত রেখে বেভুল দাঁড়িয়ে আছে। গাব, আম, কড়ই গাছে বুড়ো কৃষকের পায়ে ওঠা গেঁজ ভারি স্রাব ঝরায়।

আকাশস্পর্শী লেচু গাছটির নিচ হতে ভূরিফাটানো গাবগাছোব্ধি শুয়ে আছে পাখনাজোড়া। গাছের পাতা ধীরেসুস্থে জলের ফোটা ফেলছে পাখনার স্ফূর্তিমান আবরণে। দুইপাশে বসে বসে ন্যাওটা ছেলে কয়টা বৃষ্টি মাথায় করে প্রহরা দিচ্ছে। স্ফীত বাতাসে জলের ঝাপটা যেয়ে পড়তে অনুরণন হাসিতে ঝলকে উঠলো পাখনার ফর। মইজুদ্দিনের নজর আকস্মিক পড়তেই সে পিছলে পড়লো উন্নার তলে। ওরে বাভারে, মাইরা হালাইছে রে। আর্তনাদ উঠে দৌড়ে উত্তরের বাগান ফেরিয়ে, দক্ষিণে চৌহদ্দিতে বড় ঘাটলায় ছোঁয়াছুঁয়ি খেলে, রাস্তায় ভাঁটফুল ঝিন্টিফুল বেনাঝোপ ধরে আসলামের চরে চোখ বড়বড় করেও কাউকে যদি না-দেখে, ফিরে এসে তথাস্তু মইজুদ্দিনের স্ত্রীর কানেই ঢুকে পড়ে। স্ত্রী হইহইরইরই আওয়াজে প্রথমেই মইজুদ্দিনের প্রতি, পরে ছ্যাঁচড়া বৃষ্টির প্রতি এবং পরিশেষ রাকখুশে ঝিলের প্রতি বকাবাদ্য বাজিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে আসে। দেখে মইজুদ্দিনের কালো শরীর জলকাদায় ভেটকানো, পরনের লুঙিখানা ছিঁড়ে পাছা বেরিয়ে পড়েছে, হারিকেন অদূরে পেয়ারা গাছের শিকড়ে উল্টিয়ে জ্বলছে। স্ত্রী তাকে উদ্ধারের জন্য বাইরে পা ফেলার আগে মইজুদ্দিনকে আরেকটু গালাগালি দিয়ে নিচ্ছে যাতে এভাবে আর কখনো চিতপাত হওয়ার সমান গুরুতর অপরাধ না-করে। বাতাসের আরেকটি স্ফীত তাড়নায় বৃষ্টির ঝাপটা ঝরে পাখনার উপর আনন্দ চকমকি জ্বলে উঠেছে পরিসর নিয়ে। স্ত্রী এ দৃশ্য দেখে বাইরে ফেলা পা-খানা তড়িৎ ভেতরে ঢুকিয়ে এসে দরোজা বন্ধ করে, এবং স্বল্পজ্ঞাত-অজ্ঞাত দুয়া-দুরুদ দ্রুত জপে জপে বুকে থুতু ছিটিয়ে ভিজিয়ে দেয়। বাইরে মইজ্জুদ্দিনের পিণ্ডিচটকায় অন্ধকার— মাগি তুই আঁরে বাইরে রাইকখা দুয়ার বন্দ করচছ। আঁরে উডাইয়া নে কইলাম। মইজুদ্দিনের বুকভাঙ্গা আহাজারিতে কষ্ট ভয় জেদ একত্রে মিশে বৃষ্টির বইচাজালে ঢুকে পড়ছে পইপই।

শ্বসিত আবহাওয়ায় আসলামের চরে পাখিরা মাছের লোভে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। চরের পূর্ব দিকে ডাকাতিয়া নদীতেও তাদের অনেকে জমে গেছে। সওদাগর বাড়িতেই এসব পাখির নির্ভীকারণ্য। উঁচু উঁচু গাছ হতে পাখিরা সসুরে যাতায়াত করছে, এ জোলো পরিবেশে বাড়ির গেটে দুইট্রাক কাঁচামাল ও সরঞ্জামাদি এসে থামলো। পাখনা পাহারাঅলা ন্যাওটা ছেলেরা ট্রাক হতে নেমে মইজুদ্দিনকে বলে, চাচা, কয়েকবচ্ছর ধইরা পাখনা দুইটার শেল্টার চাইয়া আইতেছি সরকারের কাছে। আমগো চেষ্টা সফল হইছে। ডিসি সাহেব ডাইকা জানাইছে, পাখনাজোড়ার লাইগা একটা অত্যাধুনিক জাদুঘর বানাইয়া দিবে।

আমার হোগাডা আর কত মারবি তোরা ফাজিল পোলাপাইন! মইজুদ্দিন নিজের মনের কাছে এই কথা বলতে বলতে ছেলেরা মালপত্র ট্রাক থেকে নামাতে শুরু করলো। তার কিছুই করার নেই কারণ সে এ বাড়ির মালিকশূণ্যতার সুযোগে উটকো বাসিন্দা। নয়তো সে এই পাখনাজোড়া সহসায় মাটিতে পুঁতে ফেলতো, অথবা ডাকাতিয়ায় জাগ ফেলে মাছ ধরতো। অন্তত মাঝরাতে চিতপাতভোগী না-হওয়ার বন্দোবস্ত তো হতো যেকোনভাবে।




আলেফ সওদাগর পাখি ডেকে আনে। হাজার হাজার পাখি। হাজার পদের। পাখিরা তার ডাক শুনে কাছে ভিড়ে করে। দলে দলে। থরেথরে বিছিয়ে রয়। ডালে ডালে, ঘাসের উপরে, হাওয়ার উপরে, পুকুর ঝাড়ে। আলেফের বাঁশের মাচান ছড়িয়ে থাকে পাখির উদ্দেশে। তার কাঁধে, মাথায়, বাহুতে, হাতের ডগায় পাখিরা বসে থাকে। সে ঘুমিয়ে গেলে চোখের পাতায় পাখির পাখনার ছায়া। ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরলে পাখিরা নিজের ভাঁজ খুলে জায়গা করে দেয়। স্বপ্নের ভেতর পাখির চঞ্চু ঢুকে যায় নির্মল বাদ্যে।

আলিপ্পা কিয়াত্তো হইক ডাকতো! হইকরে ক্যান্নে ডাহে? তামাম দুইন্নির হইক কি হেঁইগগার ডাক হুইন্না আইতোনি? কোনোদিনো ডাকতো না। এন্নেই আঁইয়া হট্টো। হেঁইগগায় হইকরে আধার খাইতও দিতো না। কড়া প্রতিবাদ করে মইজুদ্দিন নিজের কালো চিবুক ঠাঁসিয়ে আলোচকদের দিকে তাকায়। আলিফের কাছে পাখিরা কোনো আহ্বান ছাড়াই আসতো। নাকি সেই অব্যক্ত সার্থক আহ্বান কেউ শোনেনি! তার আঙুলের ছোঁয়ায় পালক, পশম খুলে খুলে বেরিয়ে যেতো। শ্রুতিঅগোচর ভাষায় আলেফ কথা বোলতো। অথবা পাখিরা তার সঙ্গে কথা বোলতো। অনন্য বাকবিনিময় প্রথা তাদের মাঝে। রাতে সে ঘরে আসেনা, তার মায়ের ব্যাকুল ডাকাডাকি তার গাহ্যে আসেনি কিছুতে। হোগু সওদাগর ছাড়াও আশেপাশে কয়েক পরিবার বাস করে। তারা রাতে ঘরবাহিরে আসতে পারে না ভয়ে। কালামের বউ একদিন প্রস্রাবরত অবস্থা হতে বদনা ফেলে দৌড়ে ঘরে গিয়ে মূর্ছা গেছে। সে আর কোনো রাতে বের হয়নি, সাবধানতা অবলম্বন করে— রাতে সে পানিই খায়না না, পাছে প্রস্রাব করতে বাইরে যেতে হয়। ফারুক পাটোয়ারি প্রথম দেখেছিল দৃশ্যটি। বিলে মাছ শিকার করতে এসে কতক্ষণ পর্যন্ত সে দাঁড়িয়ে থাকতে পেরেছিল জানেনা কেউ। লুঙি খুলে পথে পড়ে থাকলেও দৌড়ে জান বাঁচিয়ে সে যে বাড়ি পৌঁছাতে পেরেছে, তার জন্যে ঘন্টাধরে মজ্জিদে গিয়ে শুকরিয়া জানিয়েছে পরে।

রাত গভীর হলে আলেফের দেহ প্রলম্বিত ও বিস্তারিত বেড়ে ওঠে, আয়নার মতো স্বচ্ছ ও পরিবাহী হয়ে যায়, আরো অধিক ধোঁয়াধোঁয়া— পাখিরা দল বেঁধে আলেফের শরীরে ঢুকে পড়ে। অথবা আলেফ পাখিদের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিন্নভিন্ন চূর্ণ গুড়োগুড়ো এবং ধোঁয়া ধোঁয়া। এন্নেই সুইজ্জ গহন লাগে। চান্দে সুইজ্জরে গিইল্লা খাইহালায়। সুইজ্জ চান্দেরে খায়। ওরে বাভারে আঁই কি দেকলাম। বলেই ফারুক পাটোয়ারি কাঁপতে থাকে। কিন্তু গ্রামের লোক এসব বিশ্বাস করেনা। কারণ মইজুদ্দিন পাটোয়ারি বাড়ির মোচ্চিদের সামনে দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দেয়, ইগুলি ফাও কতা। আলিপ্পার মাতায় ইট্টু ডিপট (সমস্যা) অইছে। একলা গাছের নিচে বইয়া থায়ে। কতা কয় না। গরো আইয়েন্না। হইকগুলি য়াইয়া হেঁইগগার লগে বইয়া থাহে। হইকরে হেঁইগগায় ডাহে না। জোয়া (জবাই) কইরা খায়না। হইকরে কিচ্চু করে না হেয়ায়।

এসমস্ত আলোচনার বাইরে থাকে আলেফ। একটা গন্তব্যে রওয়ানা দেওয়া। পরিচিত গন্তব্য হতে বিচ্ছিন্ন সে রূপালঙকার। পথের ভেতর নিজেকে সেঁধিয়ে দূরীভূত হওয়া। ফাঁপা নলের আকারে সে পথ, গুহ্যের আঁটসাঁট ও কোমলতায় নির্জন। সে পথে সমস্ত পাখির বুক সাধা, ঝরেঝরে থেঁতলে পড়েছে পশমের কাই— আলেফের রক্তে কি কুশলে সংক্রামিত হয়, ঢেউ খেলে যায়, চিৎকার সৃষ্টি করে, নির্বিঘ্ন সংশ্লেষ। হোগু সওদাগরের বউ বাঁচতে পারছেনা ছেলের চিন্তায়। হোলাগা আঁর কীরুম অইয়া গেলো! আঁর হোলাগারে আল্লা হিরাইয়া দ্যান। আলেফ বসে বসে পাখির ফরে বিলি কাটে, খুটে খুটে পোকামাকড় সরায়, পাখনার গঠন ও শক্তি পরখ করে, চামড়ার শুষ্কতা নিয়ে চিন্তায় বসে। তারপর অনির্দিষ্ট উপায়ে স্তব্ধীভূত হয়। রাতের কেশগাঢ়ত্ব পেরিয়ে আলেপের কান্না উঠে আসে; যেন রাতকে ধোপা আছড়ে ধুয়ে নিচ্ছে হঠাৎ। রাত কাতরে উঠছে। এই দমকে শেয়ালের সমরাগ বেজে উঠে পাটখেত এড়িয়ে। হোগুর স্ত্রীকে তখন বেঁধে রাখাও দুঃসাধ্য ঠেকে। আঁর হোলাগা মইরা গেলো রে। হেতিয়ালে খাইয়া হালাইতাছে আঁর হোলাগারে। আঁর হোলাগারে বাঁচান আন্নেরা। তারপর আলেফ খুব স্পর্শনীয় বোলে হাসি করে, ঊনশব্দে সে হাসি বাতাসে স্থিরতা বসায়, পত্রপুষ্প ধ্যান আত্মস্থ করে, ডাকাতিয়ার জলে ঢেউ আর চলে না, নিমজ্জিত পানকৌড়ি মাছে ঠোকর দিতে যেয়ে দেয় না। তার হাসির সোনা নিরবে হোগুর বউয়ের বুকে বিঁধে যায়, আকস্মিক আলোয় তার চোখ বন্ধ হয়, হোগুর বউ বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকে। এতোসব ব্যাপারে আলেফ কোনো মন্তব্য সৃষ্টি করার আগ্রহ ভুলে গেছে। ভুলে গেছে পরিচিত অনুভূতি।




এরূপ নির্জনা সুন্দরে নিকানো নয় তার শৈশব! সেও নাক-মুখ-গালে কাদাকালি মেখে বৃষ্টির কামড় সহ্য করা নিলজ্জ উঠানের করেছে পরিবাদ। মজ্জিদে নামাজ পড়ার ফাঁকে নামাজির লুঙ্গি টেনে নামিয়ে দৌঁড়ে লুকিয়েছে জাম গাছের আড়ালে। ফড়িঙের কেন প্রজাপতি রঙে পাখনা গজায়নি চিন্তায় ফুরিয়েছে গবেষণ বিকেল। পরিত্যক্ত জমির পাশ বেয়ে নবিচক্ষণ হাঁসের চাম-আণ্ডা তড়িৎ কুড়িয়ে এনে মায়ের হাতে সমর্পণ করে লাফিয়ে লাফিয়ে বলেছে, এই চাম য়ান্ডা আঁই হাইছি আম্মা, আঁই হাইছি। সেই চিৎকার মায়ের চোখ-মুখ-কান ও শরীর ভরে উঠে সারা বাড়ি গাছের ফুকরে চড়ুইয়ে উড়ে উঠোনে চুইয়ে চুইয়ে পড়েছে, আম্মা চাম য়াণ্ডা, আম্মা চাম য়াণ্ডা। ওলানের যে বাঁটে দুধরাজ সাপ প্রতি রাত্রিকালে এসে দুধ খেয়ে যায়, সেটি মুখে নিয়ে সে অধিক গলা ফুলিয়েছে দুধে। হাডারি বাড়ির মকতবে আমপারা শিখতে যেয়ে রাবেয়ার চুলে কালো খোঁপায় রেহেল বেঁধে, খেয়েছে হুজুরের বেতের মার। হিন্দু বাড়ির নগেনের সঙ্গে চরকুমিরা স্কুলে যেতে খড়ের স্তুপে বই লুকিয়ে, দেখে এসেছে মণিহার সিনেমা হলে অশ্লীল ছবি।

—— মইজুদ্দিনের এপ্রকার শিষ্ট বিশ্লেষণ ছিঁড়ে ফেটে গ্রামবাসীর বিস্তারে বেরিয়ে আসে অরূপমূর্তি আলেপ সওদাগর। তার অতিবাড় দেহ বুঝে ফেলতে সবার গরিব চোখকে নিক্ষম হতে হয় নি। নগেনের পাশ দিয়ে হাঁটতে স্পষ্ট ঢেরগুণ লম্বা আলেপের হাতপা কলাগাছের ন্যায় স্বচ্ছ ও দৃঢ়। নগেন হয়তো উদ্বিগ্ন নয় যতটা শঙ্কিত হয়ে চায়ের দোকানে বসে থাকারা কাপ হতে হঠাৎ ফিরে সটান দৃষ্টিতে বলে ফেলে, বালাইষাট! কাম সাচ্ছে।

ছি কুত কুত খেলার সমবয়সীরা কুলোয় না কেউ, ফুটবল মাঠে সবাই তাকে নিজ দলে যুক্ত করতে রীতিমতো ঝগড়া বাঁধিয়ে ফেলে, কারণ তার গতির কাছে বাকিরা প্যাঙ্গুইন যেমতো হেলেদুলে কাঁত হয়ে যায়; একাই সারামাঠ দৌড়ে গোল মেরে আসে। আসলামের চরে ডুবিয়ে ডুবিয়ে ধান কেটে স্তুপ করে ফেলে আলেপ, যখন অতো ভরাজলে দু’গোছা ধান কাটতেই শ্বাসযুদ্ধ আরম্ভ হয় যুবকদের বুকে। ডাকাতিয়ায় নেমে খাড়ি ভরে মাছ তুলে আনে বড় জেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। সে মাছে উঠোন ভরে হোগু সওদাগরের।

হোগু অতো চিন্তা করবার ফুরসত পায়না। তার হাঁকপাঁক কাটে কাশির আক্রমণ সামলাতে। জন্মগত রোগেপড়া হোগু হাড় জিরজিরে সরু দেহ টেনে অবসরে প্রকৃতির খেলনা ধরিত্রী ও মানুষের মুখ ও মুখের কথা জানতে বল নেই। সকল ডাক্তার কবিরাজ বেটে খাইয়েও বুকের হাড় চামড়ার নিচে রাখা যাচ্ছে না। এ শরীরে হাঁপানির অজাচার যেকোনো দেশের আইনে অবৈধ ঠেকে।

যদিও হোগুর স্ত্রী— ঘাটলায় শাক-সব্জির ঝুড়ি ধুত (ঝাঁকিয়ে ধৌতকরণ) করতে করতে, বাড়ির উত্তর ধারে তরকারির ঝাঁয়া থেকে ঝিঙা ধুন্দুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে, হোগুর পাতে ভাত ঢালতে ঢালতে— কখনো অনুচ্চার ছাড়ে— হোলাগারে মাইনসেরা চোক দিয়া গিইল্লা খাইয়া হালায়। মুকের উরপে দ্যাঅ-দইত্ত-দানব কইয়া ক্ষয় কইরা হালাইছে। আঁর কইলজাডা কেবল জ্বলে, আর কেউ কি বুজে নি কির’ম কস্টে হোলাগারে হালছি। কাঁন্না বানিয়ে মুখ-নাক মুছে হোগুর স্ত্রী হোগুর উদ্দেশে বলে, আন্নে মজ্জিদো যাইয়্যা হুজুরেত্তেন হানি হড়া আর ওগ্যা মোক দোশের তাবিজ আইন্নেন।

বিলের কাঁকড়া শুকিয়ে দেওয়া রোদ শিমুল, কদম, আম, কড়ই গাছের পাতায় মরিচ-মরিচ গরম ঝরিয়ে ক্রমে বিকেল পাল্টায়। ধানের খড়ে, খড়ের স্তুপে তরতাজা উল্লাসে ভরা গুমোট। পুকুরের ঝোপঝাড় ছেড়ে যেতে বিলম্ব করে হাঁস। চুলে আঙুল চষে উকুন ধরতে বসে বাড়ির বউয়েরা ব্লাউজ খুলে রাখে কোলে, হাতপাখায় বাতাস করতে করতে কথা বলে, হায় হায় গো আর কইয়েন না, হোগুর হোলার লগে দ্যাঅ আছে। দশ গাবরের কাম একলাই খতম করে। কোনো জিরানতি নাই। সেখানে বয়স হারানো চাচি-জেঠিরা যোগ দেয়— এইডা বশিরের আরেক রূপ। দেহছ না, বশিরের লাহান শইললের গটন! আংগ চমিদের বাহে কইছে, বাঁইচ্চা থাকতেই বশির কইয়া গেচে, তার বংশো’ত্তেন বশির আবার বাঁইচ্চা উডবো।

সেলগ্নে ঊনবয়সী ছেলেরা বউদের মোটা স্তনমূল দেখার লোভে কাছঘেঁষে বসে, এবং অবহেলায় জিজ্ঞেস করে, বশির? ঘর থেকে হতে পারে চমিদের বাপ, অথবা চমিদের বাপের বয়সী অন্যকোন পুরুষ জবাব দেয়, অই দানবডার কতা উডাছ কিত্তি? রাইত গুমাইতি হাত্তি না হুইননা। বউরা সে সুযোগে সামান্য সংযত হওয়ার ভান করে নড়াছড়ায়। চমিদের বাপ, অথবা চমিদের বাপের বয়সী অন্যকোন পুরুষ উপস্থিত কারো কাছেই (বশির বিষয়ে বিস্তারিত জানার) অসংগত আগ্রহ না পেয়ে, নিজ প্রণোদনে ফের পুরাতন দমসারা পুথিখান নিয়ে বসে বৈঠকখানায়। গলা খাকাড়ি দিয়ে শুরু করে পড়া।

শোনো ভাই সভাজন অধমের নিবেদন
বশির সদাগরের কথা করিব বর্ণন
বশিরে মানুষ আছিল না ছিল অন্যকিছু
এমনো শরীলের গড়ন ভয়ে বক্ষ নিচু
এললাইগ্যা থাকিত একা ন থাকিত লোকে
হগারে বসিয়া সদা মজিত ধ্যানযোগে

এখন যেখানে সওদাগর বাড়ি, সেখানে ঘন বন থাকার সম্ভাবনা উঠে আসে চমিদের বাপ, অথবা চমিদের বাপের বয়সী অন্যকোন পুরুষের পুথিপাঠ হতে। এভাবেই আলেপের দাদাজান বশির সওদাগর জনেজনে আলোচিত হয়।

পুরানো বাজার হইতে রামনাও লইয়া
আটাছোলা তেল ডাল সাজাইয়া গোছাইয়া
একাই গুদারাঘাটে টানিয়া ভিড়া’ত
বারো গাবরের নাও পিঁছেই হাঁপি’ত
গাবরের দল দ্বেষে মুছিয়া কপাল
জাউরা দইত্ত বলি বলি শুনায়িতো গা’ল

নানান গল্প রটানো আছে। চমিদের বাপ, অথবা চমিদের বাপের বয়সী অন্যকোন পুরুষ এবং অন্যান্যজনের মুখে অবশ্যবাক্য দুইটি ঘটনা।

জমিদারের বড় কন্যা করিয়াছে বিয়া
যমদূত জিনজাতির সামোনে দাঁড়াইয়া
জমিদারের কন্যা আছিল সুন্দরী বানু
কলা গাছের ঢ্যাগা ডগা তার দুই জানু
রূপে মজে জিনের রাজা হয়িছে প্রেমিক
বৃক্ষ ডালে তুলে নিত কৈশোরের দিক।
ঠাডাপোড়া নাইলগাছে, রেইনট্রি ও কড়ই
কুড়াইয়া আনিতে পিতা কাঁদিত বড়ই

যেমতে ছড়াঈ গেল সৌন্দর্য বানী
অধিক রটিল জিনে আছর কাহিনি
সেমতে মেঘলা দিনে বকেরো শিকার
পুটি মাছের বুকে গাঁথা ছায়েরো খাবার
হপ্তাহাটে হাতজাল টেঁডা কিনে লোকে
মচজিদে তোসবি নড়ে মুসল্লির নখে
বান্দরের বানরামি বসে রাস্তার কিনার
কাদাখেতে ভিড় জমি’ছে ফুটবল খেলার।

হঠাৎ আহত পাখির নিনাদ আসে কানে
সেদিক ছুটিয়া যায় মন্ত্রগ্রস্থ ধ্যানে
উঠিয়া দেখিতে পায় সুন্দরী উন্মাদ
সারাগায়ে বান্ধা আছে শিকল,অপবাদ…
বাগানঘেরা ঘরে ঢোকে গতবছরেরা
জানালায় উঁকি মারে খুশরোদেরো বেড়া

সুন্দর বাধিয়া রাখা বড়ই কঠিন।
যেরূপ তাপে’র জল উড়িয়া বিলীন
আলো অন্ধকার ছেদে উঠে গগনে
বৃষ্টি হয়ে ঝরে সবের উঠোনে উঠোনে
সুন্দরও বাঁচিয়ে রাখে যাবতীয় গরিব
পাপ হয় বন্দি রাখা এমনও প্রদীপ

এমন প্রদীপে পোড়ে বশিরের চোখ
জমিদার কায়েসের এতে বেড়ে ওঠে রোখ।
বিবাহের শর্ত বশির প্রস্তাব করিল
শুনিয়া গেরামবাসী চমকিত হয়িল
“বিয়া করমু যদিও যাই এই বশির মরে
জিনের আছর কেটে সুন্দরী বানুরে।”

নিগূঢ় রাতের শরিল কালো কাজল মাখি
কালো রস চুইয়ে পড়ে বাঁশ বাগানের ঝাঁকি
অধিক চুয়াইয়্যা পড়ে বানু জি’র শালায়
অনন্ত রজনী বুঝি ভিনগ্রহে পালায়।

হয়িল আইন জারি প্রতিবেশে সব
সন্ধ্যাতে ঘুমায়ে পড়ে হয়িবে নিরব
জরুরি কাজেও যেন নাহি রয় বাইর
নচেত খারাপি নসিব গুছিবেনা তাইর

জিন তাড়ানোর সে রাত জমিদার বাড়ির
অঞ্চলে ঘাপটি মেরে করিতেছে ভিড়
যেভাবে কুনোব্যাঙ ঘরে থাকে, পোকা খায়
সন্ধ্যা বাদে ঠোকড়ায় গেরস্তের কলিজায়
গেরস্তবউ’র কলিজা খাওয়া কুনোব্যাং যদি
বউর মালিকানা চায় দখল নিয়া গদি
সাদা শরিলে রক্তিম ফুলে ছেঁয়ে যায়
রক্তে বেদনার সৌরভ আনন্দে গীত গায়
প্রতিবেশে এই গীত লেখা থাকে জোড়া
যেমতে তালের পিঠা চুলাতে যায় পোড়া

সাবধান করেছিল কড়া মোচ্চিদে হুজুর,
“বদ এ জিনডা খারাপ যাইবো না এ-দূর।
হুদাহুদি মাইডার নষ্ট কইরবো রান;
নাইলে জিনের হাতে বশির খোয়ায়িব প্রাণ।”

পরিশেষে বিয়ে করে বশির সওদাগর
সুন্দরি বানুকে আনে আপন বুনোঘর
পথিমাঝে ঘটে যায় লঙ্কাকাণ্ড ঋত
বউজামাই লোয়িয়া নাও ডুবিল নদিত।
নদিচর বেঘোর ঝড় আছ্ড়ে খায়িতেছে
জেলেচাষি দৌড়ে পালায় গতির বিপরীতে
বিকট ঠাডার আওয়াজ বিজলি স্ফীত
দেখিয়া ভাবিতে সবে হোয়িলো উদিত
বশিরের কিচ্ছাতে বুঝি আইলো অবসান
স্বস্তিতে চারিপাশ মনে পাইলো পরিত্রাণ

তখনি স্পষ্টদর্শী কী দেখিয়া হায়
খোয়াবি দৃশ্যের ভিত্তে তাজ্জবে চমকায়
নদিতলদেশ হতে উঠিল বশির
সুন্দরি বানু জুড়িয়া আছে গ্রীবা শির
জিনজাতির রাজা বুঝি হয়ে কুপোকাত
বশিরের হাতে বিসর্জন দিল নিজো-জাত




পরকিয়া প্রেমিকের কানে তিন সন্তানের মা যেরূপ অনুঢ়া দাবি নিয়ে হেসে উঠে, ওরূপ মিথ্যার মাধুর্য নিয়ে শতবর্ষী গাবগাছের পুরুপাতা পাশ কাটিয়ে নেমে আসে শ্বেতকাঞ্চন চাঁদ, দীঘির জলে গতর মেলে ধরে, নিরব লতা নাড়িয়ে দিলে হালকা বাতাস, খোঁপখোঁপ জোছনার পাটি, দুলে যায় সারি বেঁধে— এরূপে স্কুলের ছেলেমেয়ে একসঙ্গে দু’হাত দু’পাশে ছড়িয়ে দৌড়ে পার হয় খেলার মাঠ। আকাশ এক আলোর বাগান, থোকায়থোকায় ঝুলিয়ে রাখে তেলের হারিকেন, পাকনা হারিকেন ফেটে ফেটে চুইয়ে পড়ছে দীঘির চারতীরে, শিকড়ে, শিকড় খোঁড়লে। লুকিয়ে থাকা টিকটিকি, নলা সাপ, গেছো ব্যাঙ, ইঁদুর চোখ উল্টিয়ে তাকালেই ঝাপটা আলোয় মুখ ভছকে যায়। আলেপের মাচান ঘিরে কচি তালের শাঁস ধরা কোমরে নেচে বেড়ায় শুক্লাম্বর। সে তৃপ্ত অবয়বে লিচু গাছের ডালে বাদুড়ের তামাশা দেখছে। সেদিকে সুতানালি সাপ বেঁকে বেঁকে পাখির গুয়ে ভরা আলেপের শরীরে নেমে আসে। ত্বক কিংবা শ্যাওলা বিচ্ছুরিত অঙ্কুরিত আবরণ খুটে-খুটে প্ররখ করে। মাচান ও নিকট পরিবেশে বিষ্ঠা, আবর্জনা ও ঝোপঝাড় আপন করে বেঁধেছে আলেপকে। শরীরে সবুজ শ্যাওলার নির্ভয়ে স্বাচ্ছন্দ বিস্তার। বকের ঝগড়াঝাঁটির চাপে ঝরে পড়ছে লাল জামরুল, আলেপ লাল জামরুল চিবিয়ে খাচ্ছে। আহ! অতিকাল ধরে মায়ের হাতে চালম মাখানো ভাত মুখে তোলেনি সে। রাতটা সম্প্রতি বুকে প্রস্তর ধরে থাকতে পারলেও, বাদ ফজর দৌড়ে ছেলের কাছে আসতে চায় মা। এসে জড়িয়ে কোলে চাপতে চায়। জড়িয়ে দেখে, শরীর আর শরীর নেই, হাড়ের খাঁচা, হাঁপানি-বুক করে তাকিয়ে আছে। চুল পাটের রোঁয়া বেয়ে নেমে পড়েছে কাঁধ পেরিয়ে। অনুজ্জ্বল চোখ দূর গন্তব্যে প্রসন্ন। থালায় আলেপের পছন্দের ইলিশ মাছ ভাজি, ভাত, ভর্তা মেখে, মা তিন আঙ্গুলে তুলে মুখে দিতে চায়; আলেপের জিহ্বায় এ খাবারের রুচি নেই, সে ফিরিয়ে নেয় চিবুক। মা ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলে, জল পড়ে থালে— তুই আঁর আতে ভাত খাইতি না আর? বাবারে… কতা ক। ঈয়ানো বইয়া থাঅছ কিল্লাই? ঘরো আয়। তুই আঁরে মাইরা লা, তবু এমনে থায়িছ না। তোর মা’র কি মরা মোক দেখতি চাচ? তুই না ইলিশ মাচ খাইতি চাইতি। কত হাগলামি করতি মা’র আতে ইলিশ ভাজি দিয়া ভাত খাইতি? এই ল, মা’য় ভাত আনছি তোর লাই।

আলেপের স্মৃতিতে তখন অতীত চিত্র দৃশ্যভূত হয়, জীবনগ্রহণ করে; অথবা কিছুই হয় না। মা আলেপের হাত ধরে টান দিয়ে ভড়কে পড়ে, বিস্ময়াবহ বিলাপ ছুড়ে দেয় চারদিকে— আঁর হোলাগার আত পাও কিরুম হোরমুলের লাহান অইয়া গেছে গো…। হায় হায় গো… কিল্লাই গো এরুম অইছে গো…। ইট্টুও ওজন নাই শইল্লে গো…। হায় হায়, আঁই কিয়াত্তাম। আঁর কইলজার টুকরা শেষ অইয়া গেলো। মা কেঁদেকঁকিয়ে ঘরে ফেরে। কখনো টানাটানি করে ঘরে ফিরিয়ে নিতে উদ্যত হয় ফাঁফা শরীর, পাথরস্তম্ভ তবু তো সরানো যায়না। ভাটিয়ালপুর হতে পিন্টা হুজুরের আবার মোচ্চিদের ঈমাম সাহেবের ফুঁ ও থুথু দেওয়া তাবিজ এনে গলা, কোমরে লাগিয়ে দেয়। তাবিজের থোকা বেশ ঝাঁকড়া হয়ে উঠলেও, মায়ের ছেলে ঘরে ফেরে না। কান্না বেড়ে গেলে শুধু বলে, ঘরঅ যান আম্মা। আঁললাইগ্যা কাইন্দেন না।

লাল জামরুল চিবিয়ে খেয়ে আলেপ উপরে তাকায়। রাত ও চাঁদকে মহৎ করে দেওয়ার সম্পূর্ণ পায়তারা তার চোখেমুখে জ্যোতির্ময়। রাতজাগা পাখিরা গাছ কিংবা ডাল পাল্টায়, বাঘডাসের ডরে লাফিয়ে ওঠে বক। দীঘি ছেড়ে ফুঁসে উঠছে মেঘমেঘ ধোঁয়া। আলেপের উত্তেজনা গিজগিজ বাড়ে, বাহুর চামড়া ভেদ করে ঢুকে গেছে ফরসা বাজার, রমরমা বাজার কাত করে তুলট দোকান ঢেলে গেছে রক্তে। তুলকালাম প্লবতা হাড়ে হাড়ে ঢোলে বাড়ি মেরে জানিয়ে ফিরছে, অত্যন্ত হাসিতে আলেপের শরীর খিচানি দিয়ে লাফিয়ে উঠেছে— কিছু বাষ্পাচ্ছন্ন বোধ তাকে তুলে তুলে নিয়ে যায় গাছের উপরে। ডালে নিদ্রাতুর চিলের পাশে, বাদুড়ের কাছে বসে পেয়ারা দাঁতে কাটে। বাদুড়ের সঙ্গে সেও কিছুমাত্র ঝুল দিয়ে থেকে অন্য ডালে যায়। গ্রন্থিবন্ধনে ক্যাস্ফোর বৃক্ষের নির্যাস ঢেলে দেওয়া বাতাস উচ্ছল বাঁশি বাজিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে শরীর প্রসারণ দিচ্ছে, আরো হালকা আরো মজবুত। নিঃসহায় মাথা নিয়ে বিনাশব্দে উড়ে রাতচরা, শুকনো পাতার আড়াল ডিঙিয়ে উড়ন্ত পোকা ঠোকর দিয়ে গিলে ফেলে, তারপর নিজেই উড়ে যেয়ে ঝোপের ভেতর মাটির উপড়ে বাঁধা বাসায় তার দুইটি ছায়ের মুখে কায়দা করে ঢুকিয়ে দিলো আধার। প্রতিরূপ করে আলেপ, দুই হাত মেলে আলতো ঝাপ দিয়ে ধরে ফেলে পতঙ্গ, মড়মড় চিবানিতে থেঁতলে পিছলে দেয় গলার রাস্তায়। একই ভঙ্গিতে এগিয়ে যায় কুনোব্যাঙের পশ্চাতে। আলেপের চ্যাপ্টে যাওয়া হাতের পাতে চাপা পেয়ে ব্যাঙ ক্যাঁৎ ক্যাঁৎ করে উঠে, কেমন সারিগত ভেড়ার দৃশ্যে জেগে যায় পুরো বাগান চবুতর। নাতিবিলম্বে কচুরিভিড়ে জোঁকের রিমিকি চালে নিরন্তর চলে যাওয়া শব্দ পায়ে বেঁধে জড়ো হলো হাঁসের সারি। চখাচখির দল পুষ্পের নিরবতা বিছিয়ে বিছিয়ে নড়ে, চাঁদের আলো এসে পড়ে বিবাহ-রঙ পিঠে, যথোচিত উল্লাসে কেঁপে ওঠে সওদাগর বাড়ির এই নির্জন বাগান পরিবেশ। দীর্ঘ বৃক্ষের ডালে ডালে ফেনের ফর্সা আলোয় গা ঝেড়ে নিয়ে পাখি সম্প্রদায়, দেখে এক নকশাদার পাখির সম্মিলন। দেখে পাখির পিঠ, যেমন আনন্দে বহুরৈখিক রঙ বিচ্ছুরিত করে তেমন এ প্রতিটি পাখির পিঠ, তন্তুর বান্ডিল মাতালের মতন পড়ে পড়ে নাচছে। মধ্যিমণি হয়ে হাঁটু মুড়ে বসে আছে আলেপ। তন্তুকীট আনন্দমরণ নেয় পাখিদের ঠোঁটে ঢুকে। এ রেশমনগরী আরো পরিপূর্ণ হয়ে উঠে ডাল হতে নেমে আসা অন্যসকল পাখির শোভাযাত্রায়। আকাশ ছেড়ে নেমে আসে আলোর প্রস্রবণ, দীঘি ছেড়ে উঠে আসে মশারি মশারি ধোঁয়া। চখাচখির ভিড়ে পটের উপর আঁক হয়ে দাঁড়ায় সুন্দরি হাঁস, পেইন্টেড হাঁস, কাঠহাঁস এবং, রাঙা মানিকজোড় সঙ্গে করে রকমারি বক। নিভিন্নতানে পাখিদের কাকলি আয়তন বাড়িয়ে দিলে, এ জঙ্গল হয়ে উঠে পেশিময় ষাঁড়, দৌড়ে দৌড়ে পৃথিবী সারা প্রদক্ষিণ করছে, যে ষাঁড়ের পিঠে হাঁটু গেড়ে বসে আলেপ উদ্বেলিত। রাতের আপাদমস্তক নাড়িয়ে দেওয়া হাসি তার গাল বেঁধ করে বেরিয়ে পড়ে, আবাল হাসি দিয়ে প্রারম্ভ, ক্রমে হিহি হাসি, হোহো হাসি, হাহা হাসি, এবং সভিন্নপ্রকারে। চলে যায় হাসি আরো কতদূর, পাশের বাড়িগুলিতে, মক্তবের হুজুরের কানে। স্নেহের স্পর্শবহ বৃষ্টি আসে, ঝরে আলেপের গায়। বীজধান যেভাবে ভাপিয়ে ওঠে, তিরতির বিলম্বে তার হতাদরী শরীর ফুঁসে যায়, খুলে রয় বৃষ্টিকে চষে বেড়ানো বজায় রাখতে।

সকালবেলা, ভেজা জঙ্গলে প্রবেশ করে আলেপের মা, দেখে, সচরাচর স্থান হতে বেশ খানিক পার্থক্যে যেয়ে উবু হয়ে পড়ে আছে আলেপ। পায়ে গতি নামিয়ে সে সেখানে ছুটে যেয়ে দুবাহুতে ধরলো, তা নেওয়া ডিমের গরম খেলছে মাংসের ভেতর। তড়িৎ চিত করে ফেলে তাকে। মাথার স্তুপ চুল কাঁধ বেয়ে ঝরছে। গালভরা সুতলি দাড়ি। ও চেহারায় চোখ মেলে বিলাপ আটকে রাখতে পারেনা মা— রাইতভর আঁসতে আঁসতে কুডাকুডা অয় হোলাগায়, অই আঁসির আওয়াজ আঁর হোলাগারে মাডার কইরালায়— এমতো চিন্তা কলকল জল উৎপাদন করে তার বুকে। মার কান্নার সামনে এক আশ্চর্য এসে দাঁড়ায়— আলেপের অধিকতর পাতলা চামড়ায় দুর্গন্ধী আস্তরণ কাদা, বিষ্ঠা আর পাখির খসে যাওয়া পশমে ছোপ ছোপ দৃশ্যগ্রহণ করেছে, গৌর ত্বকে জন্মেছে আঁশ। এ আঁশ শ্যাওলার ধরণ, আগাছার প্রকরণ পাটের নরম কিন্তু দৃঢ়। উদ্ভিন্ন বিস্ময়জাগানীয়া এ আবরণ বর্ণেও বেশ সুচারু— কোথাও লালচে, কোথাও বেগুনি। আলেপের মা চক্ষুদ্বয় কুঞ্চিত করে তাকালে পায়, আগাছা গুচ্ছ ঝিকমিকিয়ে ওঠে— নোয়াবউয়ের কাপড় জমানো লাগেজ, হাতের নাড়াচাড়ায় বেরিয়ে আসা স্নোর কৌটা, কাজলদানী, কসকোসাবানের ভাঙা প্যাকেট, বুকবাঁধনী— এসব অন্বিত চিহ্ন দেখিয়ে আলেপের দেহ হতে ভেসে উঠে আসে। হঠাত সতর্কতায় জলশূন্য মায়ের চোখ— তালগাছের কর্কশ শরীরেও পরগাছা জন্মে যায়; তবু তো মানুষের গায় জন্মায় না। মানুষ বড় অপ্রকৃত বলেই তার গা প্রকৃতির পছন্দমত নয়। পৃথিবীর এ প্রতিবেশ আর মানুষ খুবই বেমানানরকম ভিন্নমুখী। এ ভিন্নতাকে পোষ মানাতে এরা মাটি হতে দূরে আছে, পাখি হতে দূরে, মাছ হতে দূরে, জঙ্গল হতে দূরে। তাই পৃথিবীর পরিবেশ গুমরে গেছে। পর্যাপ্ত কদাকার হয়ে উঠতে পেরে আলেপ প্রকৃতির হয়ে উঠেছে, খুলে গেছে গুপ্তঘর, এবার যখনতখন আলেপ সেখান থেকে অলংকার তুলে নিয়ে গেঁথে রাখতে পারে নিজ দেহের আলনায়। এইতো এখন, লালচে এবং বেগুনি আবরক পরে নিলো।

হোগু সওদাগর তার জীর্ণ দেহে অধিক জীর্ণতা আনয়ন সেরে নিয়ম-মতো রাতের একাঙশ এবঙ দিনের উপাঙশ অনবরত কাশি ও হাঁপানির গভীরতর টান দিয়ে আবৃত করে দিতে থাকেন। বুকের অর্ধেক ঢেবে গেছে, সেই ঢেবে যাওয়া গর্তে বড়বড় কড়িপাথর ঝুলিয়ে রেখেছেন। চমিদের বাপ, অথবা চমিদের বাপের বয়সী অন্যকোন পুরুষ উঠোনে দাঁড়িয়ে আরো বলে, বইশ্যার লাহান পাহারের ঘরো, জ্বীনের আতেত্তেন মুক্তি পাওয়া পরির লাহান সুন্দরি বানুর হ্যাডেত্তেন যে এরু’ম বরকির দানা বাইর অইবো, এডা কেউ বাভছে নি?

আগ্রহ চোখেমুখে বিরাজ রেখে দুগ্রামের মানুষ হা করে তাকিয়ে ছিল, কোন ফ্যাসাদ না-জানি পয়দা অইতাছে আল্লা-ই জানে। তখন বশিরের সন্তান হলো অসহায় শরীর নিয়ে, উপরন্তু মৃত। কাছবর্তী কবিরাজ আজুর মা বুকে দলাইমলাই ও অভিজ্ঞতালব্ধ কৌশল ব্যবহার করে যদিও ফিরিয়ে এনেছিল জীবন। নাম রেখেছে হোগু— মরণপ্রবণ সন্তানের নাম এর’ম নিন্দ্য ও ফেলনা কিছু রাখলেই তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা থাকে। হোগুও বেঁচে যায়। ৭১-এ গ্রামময় মিলিটারির আগ্রাসন শুরু হলে, বাড়িবাড়ি ঘরদোর জ্বলতে থাকে, ভূঁইয়া বাড়ির হাবিবুর রহমান তখন আর্মি ক্যাম্পে বন্দি, এদিকে পুড়ছে তার ঘর। বশিরের প্রবল পেশি তখন মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত। এ দোষে সুন্দরি বানুকে শকুনের দল ছিঁড়ে-ফুঁড়ে খায়। এ সংবাদ শুনে সংনমিত বশির কোথায় কীভাবে হারিয়ে গেছে, কেউ জানতে পারেনি। তবে শ্বাসকষ্টে ভোগা হাড় জিরজিরে হোগু সওদাগরকে গুলি করার অপচয়ে যায়নি পাকসৈন্যরা।

হোগু স্টিলের ব্রিজের গোড়ায় কতেক চায়ের দোকানের জটলায় যেয়ে বসে। চা খেতে চায় বনরুটি ভিজিয়ে ভিজিয়ে। অনতিবিরামে আগত কাশি বনরুটি খাওয়া সহজ হতে দেয় না। জোর দিয়ে মুখে রুটি ভরতে গেলে ক্ষেপে যাওয়া কাশি তীব্র সৈন্যসামন্ত পাঠিয়ে দেয় নাকেমুখে, লালাসমেত রুটির দলা ছুটে বের নেয় তাড়া খাওয়া মৌমাছির গতিতে। চোখে জল এসে যায় বেচারার। কবজি ঘষে চোখের অনিমন্ত্রিত জল মুছে তাকায় চারিদিক। ভিড় বাঁধিয়ে লোকজন সমিল আলাপ চালাচ্ছে তখন। অনর্গল চোপা বাজিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছে ঘন্টা। সেখান হতে দুএকজন এসে তার কাঁধে হাত রাখে, আলেপ সওদাগরের তত্ত্বতালাশ জানতে চায়, আফসোস করে, আ-রে, তোর হোলাগা কামের আছিল্। অহন তো আকাইম্মা অইয়া বইয়া রইছে। এয়ারে তুই বালা কবিরাজ দেহাইয়া চিকিস্যা কর। নাইলে সেস হইয্যন্ত হোলাগা মইরাই যাইবো। মাঝে ঢুকে আধুনিক জ্ঞানে দীক্ষিত কেউ গলায় ভার দিয়ে বলে, চিকিটসা বিগগানে এইরম সমসসা ভালা হইয়া যায়। খালি ভালা একজন মানুসিক ডাকতর দেখাইলেই হইবো। কিন্তু সাদা দাড়িটুপিপাঞ্জাবি পরা কোন বুড়া তার দাঁতবিনা মাড়ি নেড়ে সিদ্ধান্ত দেয়, বায়ি বন্দ কর তুই, হুজুর নিয়া গর বন্দ কর। তোর হোলারে তাবিজ কচ্ছে। বাণ মাচ্ছে। বালা হুজুর বাইত নে। টিঁয়া হইসা খরচ কইরা অইলেও বাইত্তেন আলগা জিনিশ খেদা।

বৃষ্টির পর মেঘ যখন সরে গেলো আকাশ ছেড়ে অথবা দূর কোন মাঠের উপর দিয়ে মধ্যবয়সী পাগলের লুঙ্গি উঠানো পোঁদ নিয়ে দৌড়ে ফিরছে যখন— কচুরিপানার নিচে নীলাভ অন্ধকার পাশ কেটে রোদের শাণিত গাল যেমতি ভাঙা কাচের ছুটকো, ঢুকে যাচ্ছে দীঘির প্রাজ্ঞ জলের গতরে, তিড়বিড়িয়ে এসে পড়ে আলেপের চোখে। নড়ে উঠে রূপসী পদ্মের গ্রীবা। নড়ে ওঠে লম্বা গলার হাঁস দম্পতি। সে সেখন তাকায় বাড়ির সীমানা দেয়ালে, ইটের উপর ইট গাঁথানো, আস্তরণ দেয়া নেই— গতবৃষ্টির প্রেম নিয়ে বুকে ছড়িয়ে শ্যাঁতানো দেয়ালে এঁকে আছে সেক্রোপিয়া শুঁয়াপোকা সারির দৃশ্য পাওয়া সবুজ শৈবাল, কোথাও শৈবালেরা কার্পেটের ছদ্মবেশে শুয়ে আছে। জনসমাগম নেই বলে জঙ্গলের এ-পাশের দেয়াল সালঙকারিত হতে পারে, সে-সুযোগ নেই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অংশে।

মানুষ ভয়াল বিপুলমারি ট্রাক্টর, জমি মাড়িয়ে যেতে যেতে সেখানে সম্ভ্রম তীর্ণ হয়। এ বাগানে ঐশ্বর্য তাই সম্মান টিকিয়ে দেহসৌষ্ঠব বাড়াতে পারে। যদিও ক্রমে দিনদিন বাড়ির গরিব বউয়েরা বাগানের নিচে কচুর লতি ফুল ও শাক তুলতে আসে, মেয়েরা ঝাড়ুতে খুঁচিয়ে জমে থাকা শুকনা পাতা কুড়ায়, ছেলেরা আসে নোনাফলের লোভ ফুসলিয়ে সেই মেয়েদের অপোক্ত বুকের মাংস লাল করে দিতে। এদের মধ্যে থেকে কেউ এগিয়ে যেয়ে অবলোকন করে, আলেপ উবু শুয়ে আছে মাচানে, মাচান ফুঁড়ে বের হচ্ছে পাঁপড় গাছেদের তোরজোড়, সেরূপ উঁকিঝুঁকি আলেপের শরীর জুড়ে, মাথা তুলে গুছিয়ে গেছে পশম, বুকের পাশদিকে যেটুকু দৃশ পেয়েছে, সেটুকুতে নরম; কিন্তু পিঠের দিকে তীব্র পশম দর্পোদ্ধত চলন দিচ্ছে সুন্দর। কাঁধে, শীনার গোড়া হতে, যেখানে হাতের গোড়ার পত্তন, শিকড় ছড়িয়ে গজিয়েছে চারা-তালগাছের মোড়ানো দেখায় অমন দুইগুচ্ছ পালকচারা। এ গজবকাণ্ড দেখে কিশোর দলে প্রচণ্ড হাবাক্য খেলে বেড়ায়, ছেলেদের যৌনাকাঙ্ক্ষা দমে যেয়ে ফিরে আসে ‘দাদির মুখে বনমানুষের কিচ্ছা’ স্মরণ নিয়ে, বাগনঅ থাকতে থাকতে বনমানুষ অইয়া গেচে। কেউ একজন বলে দেয়, না রে, এরুম হর হইকের গা’ত্ উডে। আলেপ্পায় মনে অয় হইক অইয়া যাইতাচে। এরইমধ্যে তাদের শরীরে ভয় বিরাজ আনে, লোম দাঁড়িয়ে পুরো দেহ একবার ঝাঁকি দিয়ে দেয়— এতেই তারা দীর্ঘ চিৎকার বাতাসে চড়িয়ে এলোমেলো দৌড়ায়। মেয়েদের পাতাভরা খাঁচা ও আলগা হয়ে পড়া সেলোয়ারের গিট অসহায় থাকে।

এরপর সচরাচর কণ্ঠগুলি রেডিয়ো বাটন ঘুরিয়ে দিলে প্রতিবাড়ি প্রতিঘরে প্রতিকানে পৌঁছে যায়, আলেপ্পায় হইক অইয়া গেছে। হদ্দার বাইর ধারেকাছেও কেউ যাইছ না। আলেপ্পার হুরা শইল্লে হইক অইয়া গেছে। যারা নিষেধ করছে, তারাও অন্তত একবার ভয়কে থুথুর সঙ্গে গিলে নিয়ে উঁকিঝুঁকিতে দেখে গেছে এ অদ্ভুত কাণ্ড। দোকানের কাছে লোকজনের আফসোস আহাজারিতে এবং কখনো বিলাপের সান্নিধ্য খোঁজে— দুইন্নি খতম অইয়া যাইবোগো…। শেস জমনা আইয়া হসসে। পাপে পাপে ভইরা গেছে দুইন্নি। আরেকজন জিহ্বায় ফিসফিস বানিয়ে বলে, যহনোই চোককের সামনে আলেপ্পায় ভাইসসা উডে, গা’ হিরহিরাইয়া উডে। কি তাইজ্জব রে বাবু! পুকুরজলে নেমে, লুঙ্গির ভেতর হাত ঢুকিয়ে ঝুলে পড়া বিচিতে সাবান কসলাতে কসলাতে তখন কোনজন কারণ দর্শিয়ে দেয়, পাপের হসল, পাপের হসল। কত্ত বড় পাপ কললে মাইনসে হইক অইয়া যায়! হইকের লগে রাইত কাডাইছে। একরাইত না, দুই রাইত না; রাইতের হরে রাইত জঙ্গলঅ হইকের লগে আছিলো। ছিঃ ছিঃ। আল্লাহ্‌ আংগো রে মাপ কইরেন। সন্ধ্যা হতেই মায়েরা হাঁস-মুরগি সামলে, বাচ্চাকাচ্চার পা ধুইয়ে দ্রুত ঘরের দরোজা বন্ধ করে। খাবার খেতে কিংবা ঘুমাতে বাচ্চাদের কেউ দীর্ঘসূত্রতা আনতে চাইলে, মায়েরা ভূতের ভয় না-দেখিয়ে ‘আলেপ্পা’র পাখি হয়ে যাওয়া কিচ্ছা শুনিয়ে দিলেই কাজ হয়, ‘কানলে আলেপ্পায় আইবো। আইলে তোর গা’ত হইকের হশম উটবো।’ অথবা, ‘আর যদি হয়ালেহি না করোছ, বাগনঅ বাগনঅ আঁডছ— আলেপ্পার লাহান বনমানুষ অইবি। দেহছ না, আলেপ্পা জঙ্গলো থাইক্কা কিরম বড়বড় হশম গা’ত উইড্ডা জোংলি অইয়া গেছে।’

আলেপের গোডিম পরিস্থিতি কেটে যাওয়া সময়ের দীর্ঘতা কত লম্বা ছিলো জানা নেই। তার মা স্বভাব মেনে এসে ছেলের পাশে বসে; কাঁদে না, ভারাক্রান্ত ভাব নেই, স্বাভাবিক। খাবার এনে খেতে বলে না, আলেপ যে কীটপতঙ্গ আহার হিসেবে পছন্দ করে। দেখে, ছেলের অঙ্গে অঙ্গে কত বাহারি রঙ এসে আশ্রয় পেয়েছে, মা হাত বুলিয়ে দেয় পরম যত্নে, হাত বুলায় শীনায় বড় হতে থাকা লালাভ এবং বেগুনির অন্বয়ে চিত্রিত দুটি ডানায়। আলেপের দেহ যত হালকা হয়েছে, সেমতো তাল মিলিয়ে সমৃদ্ধি পেয়েছে ডানাসৌষ্ঠব। এখন তার চিত হয়ে শুতে কষ্ট হয়। পারে না কাত হয়ে শুতে। মাকে এরূপ বেদনা দেখানো যায়না। তাই মায়ের অবস্থানকালে নিশ্চল উবু পড়ে থাকে। প্রস্থানপর উঠে দাঁড়ায়, হাঁটতে প্রয়াস করলে গাছের চিপা-চাপায় আটকে যায়। কিছুতে সামাল নিতে পারছেনা এ নিবেশিত উপাঙ্গ দুখানির।

এ সময়ের ভেতর লোকজন আলেপ বিষয়ে ধাতস্থ হয়েছে, অথবা হতেই হয়, যেমনি মানুষ কোনো বস্তু দীর্ঘপথ টানতে সমর্থ নয়— সেভাবে রোগী বহুকাল ধরে ক্রমে তার অসুখের কথা ভুলে যেয়ে এক সকালে জেগে নিজেকে সুস্থ দাবি করে দাঁড়িয়ে যায়; হয়তো মানুষ পেছনে না-তাকিয়ে সামনের দৃশ্য সাজাতে নিজে রঙ বেশে প্রস্তুত হয়, এটাই ধর্ম।

ন্যূনবয়সী কিশোর দল প্রারম্ভে ধীরে পা ফেলে বাগানে ঢুকে, তারপর অভ্যস্ত ভঙিমা এসে গেলে অন্য অসুবিধা পায় না। অসুবিধা না থাকলে মানুষের রগে প্রচণ্ড বল সঞ্চালন পড়ে, এ বল চোখে অসুন্দরকে প্রীতি জানায়। সুন্দরের প্রতি প্রতিযোগ তাকে যথেষ্ট অসুন্দর দেখাতে পারে। অখুঁত প্রত্যাশি তারা আলেপের দিকে অন্বেষণ চালু করে, নিবাক হয়ে পর্যবেক্ষণে ওজন চড়ে বসলে আলেপকে কেন্দ্রে রেখে ঘুরতে থাকে। এবং দেখতে থাকে— আলেপের সফেদ শরীরের প্রায় পুরোটাই ঢেকে আছে জরির বৈচিত্রে রকমারি পালক; ঘাড়ের দিকে কালচে ফিরোজা পিঠে নেমে সবুজবর্ণে সুযোগ্য আসন পেয়ে নিয়েছে; গলা ও বুকে বিন্দু বিন্দু সিঁদুর ছোঁয়া নিয়ে শাদা রঙ সম্পূর্ণ তুষ্টি চিহ্ন জানাচ্ছে; কিন্তু কোমর হতে পায়ের দিকে দাঁড়িয়েছে লেজ, এবং ডান ও বাম হাত অনুসরণ করে প্রসারিত দুইটিডানায় লাল ও বেগুনি রঙে অভিনব মিশ্রণ।

কি সোন্দর, দেকচোচ নি! মধ্য থেকে একজন বলতে পেরেছে; অন্যরা নিমজ্জন ছেড়ে উঠতে পারেনি। অখেয়ালে জবাব দেয়, এরুম ঝকমইক্কা সোন্দর আঁই জীইবনেঅ দ্যাহিনা। তখন হয়তো মোচ্তাগ মুড়া থেকে ডাহুকের বাচ্চারা নেমেছে খেতের কচুরিপানার উপর, টুকটাক ঠোকরে মরা মশা বা সেরকম কোনো তুচ্ছাঙ্গ পোকা খাচ্ছে। কিশোরদের কেউ দৌড়ে তাদের ধরতে চেষ্টা করছে। ডাহুকের ছা ধরা অতো সহজ নয়। তবু ধরা পড়ে, মোচ্তাগ মুড়ার চিপা হতে বের করে কিশোরদল হয়তো খেলে, বাড়িতে কিছুক্ষণ বেঁধে রাখে, অথবা কখনো মেরে ফেলতে হয়। ছেড়েও দেয় কেউকেউ। সেদিকে সচেতন হয়ে আলেপ উঠে দাঁড়ায়। হেঁটে দু’পা এগুলে গাছের সঙ্গে বিঘ্ন আসে। ফের উঠে দাঁড়ায়, এবার অন্যপাশ ফেলে হেঁটে বেশ এগিয়ে গেলে সুপারি ও কড়ইগাছের চিপায় আটকে যায়। নাতিপূর্বে নিমগ্ন কিশোর দল এ মুহূর্তে বেশ আনন্দ পায়, এবং নিবিলম্বে উদযাপন করে নেয়, উদযাপনের অধিক সুযোগের জন্যে সুনিবিড় দৃষ্টি ফেলে রাখে সেদিকে। আলেপ কসরত করে বের হতে গেলে মান্দার গাছে লেগে, কলাপাতা যেরকম ছিঁড়ে যায়, পালকের কিছু সেভাবে হলে, কিশোরদল পর্যাপ্ত উল্লাস ও তিরস্কার হৈহুল্লোর রূপে সারা বাগানে ছড়িয়ে দেয়। প্রতিফলিত ধ্বনি কানে এসে ছেলেদের অধিক তাতিয়ে দেয়, শালারে ইট্টু নাচাইয়া লই। হাকনাডা খুইল্লালামু টান দিয়া খাড়া, এ বলে বেটেজন এক শলাকা পালক আচমকা টান মেরে খুলে ফেললে, আলেপ ‘মাগো’ স্বর পেটের বাইরে ছুড়ে খাটো গড়নের একটা লাফ দেয়। এতে আরেকটি বৃহৎ আনন্দে তারা হাসতে শুরু করে। আলেপ বেশ অসুবিধা অনুভব করে ইতস্তত। অত্যন্ত বিরক্তিতে সে ভাবলো বাগানের অন্যপাশে চলে গেলে এ আপদ নিস্তার হবে। এরপর, পায়ে সে মনে মনে রাজহাঁসের ভঙিমা করে দু’ডানা উঁচিয়ে যেতে যেতে, একটি পেয়ারাগাছে ‘দ্রিম’ শব্দে আঘাত পেয়ে পড়ে যায়। এবার ছেলেদের পৈচাসিক আনন্দ বাধ মানে না। এ সময় আলেপের মা এগিয়ে এসে বদমাশ দলকে দৌড়ানি দেয়, ওই কুত্তার জাত তোরা কইত্তেন আইছস? আঁর হোলাগারে তোরা কি মাইরালাবি নি। খাড়া কুত্তার জোরমিলা, আইজ্জা তোগো ঠ্যাঙ ভাইঙ্গা গাছের লগে বাইন্দা থুমু।

হামাগুড়ি আসনে আলেপ জাম্বুরা গাছের ডালে তাকিয়ে রইলো। সেখানে এসে খুব নরম হয়ে বসলো পিকক মুনিয়া, রঙজ্বলে ওঠা লালের উপর ফোটাফোটা শাড়ি একদম মাথায় ঘোমটাপরা, ঠোঁটে লিপস্টিক– আন্নে কোন বাইর বউ গো? আলেপের সেরকম বেহায়াপনায় পাখিটি লজ্জায় কুটিকুটি। মনে হল, লুচ্চা বেলাজা বেডা কি মান-সনমানের মাতা খাইছে নি, বলে উড়ে গেলো দূরে। এমন ভেলকিবাজির পর আলেপ, চিত হয়ে শুলো। আকাশে নিবিষ্ট চোখ। নাহ, আঁর লাইগগা জমিনে থাঅন মানায় না, আকাস যারে হারাদিন ডাহে, হের জমিনে থায়ন পাপ।




থকথকে গাঢ় রোদ স্পোর্টি রঙে প্রথম সকাল ছিঁড়ে বেরিয়েছে আহ্লাদী ভোঁদড়ের পশম নিয়ে এবং প্রলিপ্ত রেখেছে পুরান রাস্তার বাতাসভরা অঞ্চল। রোদের পুরুত্ব ঘেটে ঘেটে আলেপ বাগানের খালি জায়গা খুঁজে নেয়, মেরুদণ্ড সটান রেখে পাখা ঝাপটানো করে। এতে শরীরের নানাপ্রান্ত ছুঁয়ে রস দৌড়াদৌড়ি দিয়ে পাখনার গোড়ায় এসে হেসে হুল্লোড়, যেন রক্তেরা টুকপলান্তি খেলতে যেয়ে হঠাৎ প্রকাশ পেয়ে যায়।

আস্ত তালগাছের পেট হতে কুঠার দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে সমগ্র নাড়িভুঁড়ি বের করে কান্দি নৌকা বানাচ্ছে ছুটা-জেলে। এ কান্দি নৌকায় কোন পটি নেই। বানানো হলেই নদীর জলে নামিয়ে চলে যাবে কেরোয়াচর, সেখানে জাল টেনে টেনে ধরবে গুড়ামাছ, শিং টাকি গজার ও শোল। রাস্তার মধ্যবিন্দুতে যোনি আকৃতির গর্ত করে ডাঙগুলি খেলছে অশিষ্ট ছেলেরা, খালি গা পরনে শুধু ছোট লুঙি গোছ্ দেওয়া। স্কুলের দিকে যেতে উদ্যত ছেলেরাও বইখাতা, খুলে গা থেকে সাদা স্কুলড্রেস ঘাসের উপর রেখে, যোগ দিচ্ছে খেলায়। সৃষ্টি জানান দিয়ে বলিষ্ঠ হচ্ছে হইচই। বাগানে থেকে শুনতে পেয়ে, আলেপ তখন স্থির নয়, তার ভেতরে, রক্তের প্রবাহে অমন চার দল ছেলে কাবাডি খেলছে।

আলেপ ধীরে বের হয়, উঠোনে ঘাসের উপর দাঁড়িয়ে দীর্ঘ ডানা দুটি ঝাপটাতে নেয়। তার ভালো বোধ হয়। সে আর সময় দাঁড়ায়। একটু তাকায়। অত:পর পাখা গুটিয়ে নিয়ে বাড়ির গেট পার হয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। পাখনা ঝাপটে দৌড়ানোর চেষ্টা করে। নিবাঞ্চিত ধুলো, পাতার শুকনো লাশ, ওইল্লা হাগলার গায়ে জড়ানো বস্ত্রস্তুপ বাতাস টের পায়। দোয়েল পায় অপূর্ব অবাক।

খেত নিড়ানির মাঝে জাঙ্গির, মাছের আধার ছিটাতে যেয়ে বকুল, নৌকার বৈঠা হাতে গুদারার মাঝি, ছেলেপেলে ডাঙগুলির ফড়িঙ আচরণে ঘূর্ণিত হবার ফাঁকে পাখনার বাতাস পেয়ে প্রশান্ত হয়ে ওঠে।

আঙ্গো আলেপ্পায়। কির’ম সোন্দর হাকনা। আঙ্গো আলেপ্পায় উড়তো হারবো— বলে হিন্দুবাড়ির নগেইন্না আলেপের প্রতি এগোয়। সঙ্গে রাজিব্বা ও শামসুইল্লা যেন উদগ্রীব প্রকাশ করে ফেললো। আলেপ ততক্ষণে ফতফত আওয়াজ বাজিয়ে গুদারাঘাটের দিকে রাস্তা বাড়ালে, যারা স্কুল ফাঁকি মেরে অভিসার কাটাতে এলো, গঞ্জ থেকে সদাইয়ের ব্যাগ নিয়ে ফিরতি পথিক— কেউ হয়তো, সাপ খেলা কিংবা বানর খেলা অথবা অষ্টধাতুর বাতের আঙটি বিক্রেতার মসলাবয়ান দেখার অনুভূতি গিলেছে। আলেপ মাঝে খানিক যেয়ে ডিগবাজিতে পড়ে যায়, একেবারে মাটিতে কদর্য করে নাকগাল। কয়েক শলাকা নিহৃষ্ট পালক খসে পড়ে।

পরদিন আলেপ পুনরায় অধিক অনাবিল পাখনা নিয়ে অঙ্গচালনায় নিয়োজিত হয়।

যেদিন সে ধানের বিলের দিকে নেমে গেলো উড়ে। উড়তে উড়তে বিল পেরিয়ে নদী পেরিয়ে আরো অনেক দূরে চলে যাচ্ছে, পাখিরা তার পাখনা ঘিরে উড়ছে। শঙ্খচিল উড়ছে। ঈগল উড়ছে। মেঘের পাহাড় ছিন্নভিন্ন করে পেরিয়ে যাচ্ছে আকাশ; সেদিন সাধারণ লোকজন বুঝতে পারলো, তারা আলেপের মতো উড়তে পারেনা। তাদের কাছে আলেপের উড়াটাকে ঔদ্ধত্য বলে মনে হচ্ছে। বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে। অহেতুক মনে হচ্ছে। এই বাড়াবাড়িটা উড়তে অক্ষম লোকজনের মাঝে ভীষণ লজ্জা ধরিয়ে দিলো।

নদীর উপর দিয়ে কচি ওলানের গমকে দোল ভরা ধানের বিলের দিকে উড়ে নেমে পড়ে আলেপ— যেদিন তুলার দোকান মালগাড়িতে করে পরিবহণে নিমগ্ন আকাশ— সেদিন খেত নিড়ানির মাঝে জাঙ্গির, মাছের আধার ছিটাতে যেয়ে বকুল, নৌকার বৈঠা হাতে গুদারার মাঝি, ছেলেপেলে ডাঙগুলির ফড়িঙ আচরণে ঘূর্ণিত হবার ফাঁকে তার এই উড়ে চলার দিকে চোখমুখ খুলে হামাগুড়ি খায়— নগেইন্নার রাজিব্বার শামসুইল্লার গালে মেঘের চারকিনারে সুপ্ত সূর্যের কমলারঙ উড়না উঁকি মারে। আলেপ্পারে ভূতে লইয়া গেচে। কেউ স্বভাবত বলে। কোনানো নিয়া জানি মাইরা থুয়এ, আল্লায় জানে। চমিদের বাপ, অথবা চমিদের বাপের বয়সী অন্যকোন পুরুষ বাড়ি থেকে বেরিয়ে জানায়, সুন্দরি বানুর লগে যেই জিন আছিল, হেইডায় আইস্যা লইয়া গেচে আলেপ্পারে। নগেইন্না মুহূর্তে হাততালি দিয়ে লাফিয়ে উঠলে সকলে দেখে বিশাল পাখনা নাড়িয়ে আলেপ ফিরে আসছে এবং গোলাকৃতি গোত্তা তৈরি করে দর্শকদের একেবারে নিকট চলে এসে ফের আকাশে উঠে যায়, লোকজন নাগরদোলার উত্তেজনা উগরে দিয়ে উচ্চরব বানায়। শঙ্খচিল সহগ করে আলেপ উড়ে গিয়ে বসে লোহাগড় মঠের শিখরে। সকলে ফের নিরব হয়, ভাবে, তাদের মধ্যে আলেপই শুধু উড়তে জানে। জেলে প্রাণকৃষ্ণের মনে হয়, উড়াল দেওয়া ঠিক জলে সাঁতার কাটার মতো। আমরা মাছের মতো জলে সাঁতার কাটার কৌশল রপ্ত করলে পাখির মতো বাতাসে উড়তেও পারবো— শুধু জলের মতো বাতাসকে অঙ্গে অঙ্গে সুসিঞ্চিত হতে হবে। মেঘের ভাঙা ভাঙা মরাই যান বিস্তীর্ণ করে ফের আলেপ ফিরে আসে আসলামের চরের দিকে, পুনরায় গোত্তা মেরে একঝাঁক বাতাসে সকলকে ডুবিয়ে দিয়ে উপরে উঠে যায়, গ্রামে কয়েকখণ্ড চক্কর মেরে রূপসা জমিদার বাড়ির মিনারে যেয়ে বসে। মচ্চিদের ইমাম সাহেব বলে, লা হাওলা অলা কু আতা। এইসব আল্লায় কী দ্যাহায়। সেশ যামানা আইয়্যা পরচে!




কাপড়ের টুকরো ভেদ করে শাস্ত্রীয় নৃত্য লয়ে নারকেলের দুধ ছেঁকে ছেঁকে আলাদা হয় বাড়ির রসুই ঘরে। এভাবে, পদ্মপাতায় সূর্যরশ্নি ছুটে পড়ে, কোমল আলো নারকেলের দুধের মতন ছুইয়ে প্রবেশ নেয় জলের গভীর দিকে। চলচিত্ত নিয়ে ফেরে মাছ ও জলজ পোকা। আলেপের বিচিত্র দৃশ্যের পাখনায় সূর্যের বিকিরণ অগত কার্যকলাপে পড়ে গিয়ে লাল উজানি বের হয়, নানান রঙের ছায়া গড়িয়ে গড়িয়ে ছেদ করে গ্রামে টিনের চালে, উঠোনে মেলে দেওয়া ধানে, ছাগলের লোমে। যেখানে কিশোরীরা তাদের হাত উলটপালট দিয়ে পাঁচগুটি খেলে, এক্কাদোক্কা খেলে।

কোথা হতে এত বাতাস ধরে, নাকি সমুদয় শূন্য তন্নতন্ন ফেলে দিয়ে এরা আলেপের খোঁজে, অবশেষে পেয়ে উল্লাসে ফেটে, একে অন্যের ভেতর মোস্তাক বেতির পাটি-বোনা রেখায় পেচিয়ে পেচিয়ে আলেপের পাখনার দাসত্বে খুব ভালো ভারি হতে থাকে।

নিজেকে সজ্জিত করে যারা হাঁটে স্কুল এবং অফিস পথে, বাতাস তাদের চুল অপরিপাটি করে দেয়। সাজদেহ নারী আচমকা পায়, তার চুলে এলোমেলো দিয়ে যায় বাতাস, অঙ্গে কলকল করে বাতাস। বাতাস উল্টে ফেলে মিলন গাজীর শরীর, লুঙ্গি তখন তার পাছাকে রক্ষণ দিতে না-পারলে সবাই দেখে নেয় ফক্সের দাগে ভরা মিলনের ল্যাঙটা, কি বিশ্রি কুচকুচে চামড়া সহ্য করে গেছে বেচারা লুঙ্গি; অথচ এতদিন মিলনের ফকফকা মুখ দেখে দেখে ভেবে নিয়েছিল, মিলনই সুশ্রী পুরুষ। কিন্তু কাপড়ের নিচে মানুষ বীভৎস উলঙ্গ। বাতাস এ-রূপে অবিস্তীর্ণ করে পুরান রাস্তার জুয়ারিদের তাস, রাজনীতিক পোস্টার, জনসভার প্যান্ডেল, নেতার বক্তৃতা।

ধীরেধীরে আলেপের উড়াল আরো বেশি বাতাস ধরতে শেখে। আরো বেশি আলো ধরতে শেখে। আরো বেশি রঙ প্রকরণ। রঙিন মাছের লেজ দোল দেয় রঙ, নৃত্যসম্ভবা ওড়না ভরা রঙ। সবুজ সুতো, নীল সুতো, লাল সুতো একত্রে ডুবে কাচা হলুদ সুতোর গোসতে উন্মাদ রঙ। নোয়াজি সাপের নির্ভার নিয়ে বুঝি চলে রঙসব। পাখনার ফসফস শব্দ এই রঙদের পরে নেয়। রাস্তার বালির রগে জায়গা করে। ঝাপিয়ে উঠে ঘাসের উপর। ঢলে নামে নদীর ঢেউয়ে মাছের সাঁতারে। ধান খেতে নিরানি দেয় জাঙির বোধ করে রঙ তার হাত পা এবং শরীর খেয়ে ফেলেছে, রঙ তাকে পুড়িয়ে ভস্ম করে তুলে তুলে ছুড়ে মারছে কচুরিজলে, হাড়গোড় খেয়ে নিচ্ছে পোকা ও গুইলে। তবু কোথা হতে বেরিয়ে আসে তীব্র আনন্দ। এ আনন্দের বাড়ির ঠিকানা তার নেই। নগেন এবং সুমন এ-ই হয়তো দেখে— গ্রামটি চারদিকে কাচের দেয়াল ঘেরাও জলের জার, উল্লসিত রঙবিদ থরে সাজানো তরল রঙের পিচকারি চেপে চেপে জার ভরিয়ে দিচ্ছে উড়ালের থেকে।

উড়ালের রঙ গ্রামময় ছড়ানো হয়ে গাছের পাতায় ছোয়াচে পড়ে, ব্রিজের কিনারে ছোঁয়াচে পড়ে, গৃহে পশুর মুখে ছোয়াচে পড়ে। মুরগির কুক্কুরুত কুক-এর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে। আলেপের উড়ালের সঙ্গে এই বাতাস এই রঙ পদ্মায় ইলিশের নৌকায় লাফ দিয়ে দেখে চিৎকার বেরিয়েছে মেছোদের সুখে, যাত্রী-সহ লঞ্চে রঙের এক ঝাপটা বিহ্বল প্রিন্ট করে দেয়। বালুর জাহাজ উলটপালট।

উড়াল জানা আলেপ বিষয়ে চিন্তার বর্ণ পরিবর্তন নিয়ে গ্রামের মানুষ লাডি মাছের কাদায় ঢুকে যাওয়ার মোছরামুছরি করে পৌঁছে যায় রঙের নিবেশে। এ রকম আশ্চর্য যে, যেই মাঠে জনসভা হয়েছিল, আলেপের ডানার বাতাসে অশৃঙখল করে দেওয়া শেষে সেসব ব্যানারে পোস্টারে বক্তৃতায় শ্যাওলা জমে যায়, সেই মাঠে ঘাস বড় হয়ে গাছ ডালপালা বাড়িয়ে দিয়ে জঙলা তবু কেউ সাধারণ আর সেখানে যাওয়ার কথা মনে করতে পারে নি।

রাজনীতিকরা রঙমিলান্তি খেলায় ফেঁসে যেয়ে ভুল করে কোথায় হয়তো ফেলে আসে টেন্ডার সংক্রান্ত আলাপ। চুরি। বা ও তা বা জি।

বৃষ্টির পরে আলেপ নদীর পাড়ের দীর্ঘ বৃক্ষের আগায় ভেজা পাখনা নিয়ে বসে। হাতের আঙুল সঞ্চারিত করে পালক নেড়ে নেড়ে আলগা করে দিলে, গোড়া হতে তেল খুব ঝরঝরা দিয়ে দেয়। অবান্তর কয়েকটি পালক ঝরে এসে ঘাস এবং ছোট ছোট ঘাসফুলের শরীরে লেগে আবেশিত। মৌনী চোখ খুলে হোগুর স্ত্রী চিন্তা করে, কোনাই কোনাই ঘুইরা-ঘাইরা আইয়্যে হোলায়। কই যায়! কাগোল্লগে চলে কে জানে! বাইত য়াইয়া ইট্টু জিরাইত যদি! নিস্বর কথাগুলি দেখায় বুঝি শুনতে পেয়ে, আলেপ সেক্ষণ ঝুপ দিয়ে মাটিতে নেমে এসে পাখনা বিছিয়ে বসে মায়ের সামনে। আয়ত পাখনার বাহারি রঙের প্রাচুর্যে মা চোখভ্রমে আচ্ছন্ন যায়। হয়তো ভাবে, দুইন্নির বে’ক রঙ টোগাইয়া আইন্না গা’ত লোইয়া গুরে হোলায়। নয়তো, কেন্নে এতো ফর আলেপের শইল্লেত্তেন বাইরাইছে। এইগ্গার গোস্তের ভিত্তেনি এডি হলাইয়া আছিলো! – ইত্যাদি বিড়বিড় বের করে আলগোছে হাত বুলিয়ে পশমে পশমে স্নেহ সাজায়; এমন করে গাভী তার বাছুরের শরীর লেহন করে। সুখে আলেপের নিদ্রা পায়। নিদ্রারা তরতাজা সুখ খেয়ে বাঁচে।

ঘাস এবং ছোট ছোট ঘাসফুলের উপর হতে ঝরিত পালক টোগাইয়া আনে নগেন এবং সুমন। আতরেজল মুছে নিয়ে বুঝি-বা কেউ দেখতে না-পায়; বুঝি-বা কেউ কেড়ে নিতে না-চায়; অথবা এমন, হাত ফসকে পড়ে যেয়ে হারিয়ে না-যায়, সেভাবে স্নেহহাতে পাতলা কাঁথায় মুড়িয়ে রাখে। দেখলে মনে হবে, নতুন বউ টিনের টাঙকে নেপথলিন মাখিয়ে উঠিয়ে রাখে বিয়ের শাড়ি; রাস্তায় হাটতে ময়লা থেকে তুলে মুসল্লি চুমু খায় আরবি লেখা কাগজে; কুরআনের পাতায় পাতায় নরম হয়ে শুয়ে থাকে ময়ুরের ফর।

মিলের ভাঙানো মরিচের গুঁড়ো চিরে ঘ্রাণের তীব্র অথচ মিষ্টি ভরপুরে চড়ে শীত এসে বেঁধে ফেলে আস্ত গ্রাম, তার উপর ভর করে বসে ভিড় বাঁধায়, এক-এক গুণে শত-শত গুণে হাজার-হাজার গুণে লাখ লাখ গুণে এবং এমন সময় আসে আর গোনা যায়না, নানান দেশের পাখির নিস্বন।

শিশুসবুজের কেউ গালে হাত ঠেকিয়ে বসে নদীর পাড়ে, দেখে পাখিদের খেলাকলাপ। যেহেতু, জ্যান্ত চিত্রকর্ম বিষয়ে তাত্ত্বিক জ্ঞান নেই তাদের, যেখানে চিত্রকর আঁকিবুঁকি চলমান রাখলে অতৃপ্ত কাঠি নেড়ে কোথাও দৃশ্যে অপূর্ণতা আছে সেখানে একঝাঁক পাখি উড়িয়ে এনে বসিয়ে দেয়; অন্যখানে অকস্মাৎ একটি কি দু’টি পাখি লাফিয়ে উঠলে পুরো দল ফুরফুরিয়ে অব্যবহিতে আবার গুটিয়ে বসে। এ সঞ্চালিত চিত্রকর্মে না তাকিয়ে নগেন এবং সুমন যেরূপ আলেপের রঙমিলান্তি নিয়ে পড়ে থাকে তখন, যে ছেলেপেলে, জনসভা ভুলে বসা মিছিল ভুলে বসা খিদে ভুলে বসা রাজনীতি ভুলে বসা রাজনৈতিক নেতাদের ঘরোয়া আয়োজনে খাসিভূনা হাঁসভূনা খায়নি বহুদিন; তারা পেটে তোলপাড় নিয়ে দেখে থুলথুলে ম্যান্দারিন, পুরুষ হাঁস। তোলপাড়ের শক্তিমত্তায় সকলেই বেশ হকচকিয়ে যায়। বিস্মিত শরীর নিয়ে রাতে, গালায়ালা টেঁডা হাতে নামে।

হরেকদেশি পাখি, হরেক আকারে পাখি, হরেকরঙে পাখি কিনা মাংসের স্বাদে বৈচিত্র্যময় নিয়েছে। গৃহে পালিত পাখির মাংস উড়াল পাওয়া পাখিদের সমান উত্তেজনা করায় না। উড়াল বুঝলেই শুধু মাংসের ভেতর এলকোহল জন্মানো শুরু করে। রঙ আয়ত্ত্ব করা পাখিদের ভেতর এলকোহল জাগ দিয়ে রাখা আছে। গয়ারের বুকের মাংসে দাঁত বসিয়ে ছেলেরা ভাবে, আলেপের মাংসেও এরূপ জাগ দেওয়া কিয়ারির গন্ধ জমাট বেঁধে আছে?

উদযাপনের জটলায় এক কানাবুসা এবং নিশব্দপাত পড়ে যায়, সম্ভাব্য নেশায়। ঘোলাটে আসক্তিতে পাখমার পর্যুদস্ত হলে তাদের ফিসফিস পুষ্ট হয়।

নগেন এবং সুমন কানাবুসা শোনে, নিশব্দপাত শোনে, সম্ভাব্য নেশা শোনে, পুষ্টতা শোনে। যদিও এসকল আবছা খুব, আলেপের উড়ালে দুজনের মুগ্ধতায়।

তারা পাখনায় আনন্দিত থাকে। পাখনা জোরে উড়তে উড়তে, গোত্তা খেয়ে উড়তে উড়তে, রঙ ছিটিয়ে উড়তে উড়তে, শ্লথ হয়ে আসে। মাটির দিকে এসে সন্তর্পণে, ঘাসে, বিছিয়ে যায়। আলেপের শরীরে রঙ বুঝি কোথায় চলে যায়, রঙের পরিবর্তে রক্ত। শরীর ধীরে মোমের বৈশিষ্ট্যে নিভে যাওয়া দেখায়। নগেন এবং সুমন আতঙ্কিত মুখ চোখ কপাল ও ভ্রু নিয়ে দেখে আলেপের শরীর নাই হয়ে যাচ্ছে, নাই হয়ে যায়। তারপরক্ষণে, শুধু সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, তারা এখনি ভিড়স্বপ্ন ভেঙে জেগেছে, জেগে আর আলেপের শরীর নাই, অথবা তার শরীর নাই-ই ছিল।

নগেন এবং সুমন আলেপের পাখনা জোড়া টোগাইয়া আনে। আতরেজল মুছে নিয়ে বুঝি-বা কেউ দেখতে না-পায়; বুঝি-বা কেউ কেড়ে নিতে না-চায়; অথবা এমন, হাত ফসকে পড়ে যেয়ে হারিয়ে না-যায়, সেভাবে স্নেহহাতে পাতলা কাঁথায় মুড়িয়ে রাখে। দেখলে মনে হবে, নতুন বউ টিনের টাঙকে নেপথলিন মাখিয়ে উঠিয়ে রাখে বিয়ের শাড়ি; রাস্তায় হাঁটতে ময়লা থেকে তুলে মুসল্লি চুমু খায় আরবি লেখা কাগজে; কুরআনের পাতায় পাতায় নরম হয়ে শুয়ে থাকে ময়ুরের ফর।



এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *