ঢুকতেই কফির তীব্র গন্ধ, অন্ধকার মাঠে নাকে ধাক্কা দেয়া ছাতিম ফুলের গন্ধের মতো ঘোরগ্রস্ত করে। আমি মফস্বলের মেয়ে, ছাতিম ফুলের চেয়ে বেশি ঘোরলাগা গন্ধের সন্ধান নেই আমার অভিজ্ঞতায়। কাউন্টারের উপরে ইংলিশ সিনেমায় দেখা ঝাড়বাতির মতো আলোর সারি। সেখান থেকে একসাথে ছিটকে আসা সমপরিমাণ আলো আঁধারিতে চারপাশটা আমাকে আজ এখানে ডাকার কারণের মতোই রহস্যময়। মানিব্যাগ থেকে কার্ড বের করে আগাম বিল মিটিয়ে খালি টেবিলের খোঁজে ভেতরে তাকায় দীপ। আমি ওর চোখের দৃষ্টি গভীর পর্যবেক্ষণ করি। কিন্তু রহস্যের কোন কূলকিনারা পাইনা। শেষ মাথায় একটা খালি টেবিলে সামনা-সামনি বসার ইশারা দিয়ে নিজেও নির্লিপ্ত বসে দীপ। সে বসার ভঙ্গিতেও আমাকে এখানে ডাকার রহস্যভেদের কোনোই কিনারা নেই। এমন পরিবেশে নিজের অনভ্যস্ততা বুঝতে না দিয়ে আমি এক ঝটকায় চারপাশটায় দ্রুত চোখ বুলিয়ে নেই। একটা টেবিলে চার-পাঁচজন মধ্যবয়সী লোক। আমার আন্দাজ তাদের পেশা, সামাজিক অবস্থান কিছুই স্পর্শ করতে পারে না। তবে আরেকটা টেবিলে গোটা কয় তরুণ তরুণীর সেল্ফি নিয়ে হুড়োহুড়ি আমাকে নিশ্চিত করে এরা কোন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে রাস্তার উল্টোপাশের এই চেনা ভঙ্গি দেখে দেখেই কাটে আমার সব নিঃসঙ্গ দুপুর।অস্বীকার করিনা খোদ ঢাকা শহরে শুধু কফি খাওয়ার জন্য এমন সুসজ্জিত দোকান থাকতে পারে আমার কল্পনাতেও ছিলো না। আমার নিত্য নুন লবণ ভাতের জীবনে খুব প্রত্যাশিত কল্পনা রাস্তার মোড়ের মুদি দোকানে গিয়ে হুমড়ি খায়। পঞ্চাশ টাকা কেজি দরের চাল না খেয়ে ত্রিশ টাকা দরের চাল খেলে মাসে ছয়শ টাকা বাঁচে। নিত্য ফাহমির কাছে এ খোঁটা শুনতে শুনতে আমি প্রতিমাসে প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষায় কল্পনা করি সরু নাজিরশাইল চালের দাম সত্যি কমে গেছে। বাস্তবে চালের বস্তা কিনতে গিয়ে আশাহত হয়ে ফাহমির গালি শুনার আগে নিজেই নিজেকে গালি পাড়ি, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী বাপ কেন যে মোটা চালের ভাত খাওয়াটা শিখালো না! আজ এখানে আসা দীপের অপ্রত্যাশিত আহ্বানে। দুই দশক আগের প্রায় একতরফা ব্যাপারটাতে হঠাৎ ইদানিং দীপের তরফ থেকে ঘটা পরপর দুটো ঘটনা আমাকে বিভ্রমে ফেলে দিয়েছে। যে বিভ্রমের ঘোর কাটাতে না পেরে আজ প্রথমবারের মতো দীপের একবারের আহ্বানে ওর পিছন পিছন চলে এসেছি আগুনে ঝাঁপ দেয়া অপরিণামদর্শী পতঙ্গের মতো। এই অতি আগ্রহের ফাঁদে ফেলে দীপ আমাকে রেপ টেপ করে মেরে ফেললেও কিছু করার থাকবে না আমার। ভাগ্যিস আমার সে বয়স নয় আর দীপেরও সে স্ট্যাটাস নয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওয়েটার দু’কাপ কফি রেখে যায় আমাদের সামনে। অস্পষ্ট ধোঁয়া ছাতিম ফুলের তীব্র ঘোরলাগা গন্ধের সাথে মিশে টেবিলে রাখা ফ্লাওয়ার বেজের প্লাস্টিকের ফুলে আহ্লাদী নববধূর মতো লেপ্টে যেতে থাকে,আর তাতে আরো ঘনীভূত হয় দীপের আমাকে এখানে ডাকার রহস্য। দীপের সাথে আমার যোগাযোগটা হঠাৎ। এই যুগে প্রযুক্তির কল্যাণে একটা হারিয়ে যাওয়া সুঁইও যেখানে চুম্বকের বিনা আকর্ষণেই চোখের সামনে এসে পড়ে, সেখানে দীপের সাথে আমার যোগাযোগটা ভার্চুয়ালি হলেই স্বাভাবিক হতো বেশি। কিন্তু না, ওর সাথে আমার দেখা হয় আশিকের বিয়েতে। আশিক ফাহমির বসের একমাত্র ছেলে। আর দীপ ফাহমির বসের একমাত্র কাজিন। কিন্তু দীপ যে ফাহমির বসের কাজিন তা আমি বা দীপ কেউ জানতাম না। আর ফাহমি বা তার বসের সেটা জানবার কোন প্রয়োজনই ছিলো না। আশিকের বিয়েতে আমরাও নিমন্ত্রিত অতিথি, দীপেরাও। তবে আয়োজনের বৈষম্যে অতিথি হিসাবে দীপ এবং আমাদের অবস্থানের পার্থক্যটা ছিলো চোখে পড়ার মতো দৃষ্টিকটু। অফিস স্টাফদের জন্য মূল কমিউনিটি হলের বাইরে সামিয়ানা খাটিয়ে খাবারের আয়োজন, আর দীপদের জন্য ভেতরে। ভেতর থেকে উদ্দাম গতিতে উচ্ছল বর্ণাঢ্য আয়োজনের গুঞ্জন আর ফিরনি, জর্দা পোলাওয়ের গন্ধের সাথে সুবর্ণ কঙ্কন পড়া ফরসা রমণীদের অবিরল হাসির শব্দ আমাদের সামিয়ানার নীচে ছিটকে পড়ছিলো কিন্তু আমাদের সেখানে প্রবেশাধিকার ছিলো না। দীপ নিজে থেকে মূল আয়োজনের বিভাজন ডিঙিয়ে এসে পরিচয় না দিলে আমার ওকে চেনার কোন কারণই ছিলো না। স্কুলের চৌকাঠ পেরিয়ে দু’জন দু’দিকে ছিটকে গেছি তাও প্রায় দু’দশক। হালকা পাতলা ছিপছিপে সরু গোঁফঅলা ছেলেটা এখন পুরোদস্তুর ভদ্রলোক। সম্ভ্রান্ত স্বাস্থ্যের সাথে মানানসই ভুঁড়ি। কপাল উজাড় করা চকচকে টাকে প্রতিষ্ঠার চমক।দীপ আমাকে চিনলো কি করে! কারণ এতদিনে আমারও তলপেটে চর্বি, চোখের নীচে বয়সের ছাপ, বাহুতে-কোমরে এবড়োথেবড়ো মাংস জমে আমার মানচিত্রও অনেকখানি বদলে দিয়েছে। আর চিনলেও শ্রেণির দেয়াল টপকে কেন কথা বলতে এলো সেই রহস্যই এখনো আমার কাছে উন্মোচিত হয়নি। তার মধ্যে আজ এই কফির জন্য আহ্বান! অবশ্য প্রশ্নটা আমি সেদিনই ওকে করতে পারতাম। কিন্তু আমার পাশে দাঁড়িয়ে দীপের পরিচয় পেয়ে ফাহমি এমন বিনয়ে হাত কচলাচ্ছিলো যে মনে হচ্ছিলো এই কচলানোতে সামান্য ত্রুটি ঘটলেই দীপ তার বসের কাছে কমপ্লেইন করবে আর ফাহমির চাকরিটা যাবে। দুজনের মাঝখানে বিব্রত আমি স্বাভাবিকই হতে পারছিলাম না।
(২)
সেদিন বাসায় ফিরেই ফেসবুকে দীপকে খুঁজে বের করে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাই। সঙ্গে সঙ্গেই এক্সেপ্ট করে দীপ। আমি ওর টাইমলাইনের অনেক দূর পর্যন্ত ঘুরি স্বাভাবিক কৌতুহলেই। ফটো, এলবাম, দীর্ঘ টাইমলাইন। সুখী দাম্পত্য, সমৃদ্ধ জীবনের চোখ ঝলসে দেয়া জৌলুস। দুই মেয়ে আর স্ত্রী সহ পরিপূর্ণ যাপন। হংকং, থাইল্যান্ড,সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইংল্যান্ড, আমেরিকা কোথায় নয়! ম্যারেজ এনিভার্সেরি, জন্মদিন, অফিস কনফারেন্স সবই তাঁর সুপ্রতিষ্ঠার সাক্ষ্য। সবকিছুই প্রত্যাশিত। তবু কোথায় যেন চিনচিনে ব্যথা বাজে অকারণ বেসুরে। আমি বড় বেমানান আর অপ্রয়োজনীয় ওর সবকিছুতে। তবু দীপ এগিয়ে এসে কথা বললো কেনো? যত না আকর্ষণ, তার চেয়ে অনেক বেশি কৌতুহলে ওকে ম্যাসেঞ্জারে নক করি, তুমি আমাকে চিনলে কী করে? দীপ সিন করে দেখতে পাই। কিন্তু রিপ্লাই দেয় না। আমি আবারো লিখি, কতদিন পর দেখা, কিন্তু ভাল করে কথাই হল না। এবারো দীপ সিন করে। উত্তর দেয় না। এ আর আমার জন্য নতুন কী? আমি তো একতরফা লিখে যাওয়াতেই অভ্যস্ত। তখনই উত্তর দিতো না, আর এখন! যখন তার চারপাশ বেষ্টন করে আছে সুখী দাম্পত্য, সামাজিক আর পেশাগত প্রতিষ্ঠা। ওর বউয়ের সৌন্দর্য স্মার্টনেসের ঝাঁ চকচকে জৌলুসের কাছে আমি সুসজ্জিত ফ্ল্যাটের স্টোরে অযত্নে পড়ে থাকা ছাল-বাকল ওঠা মিটসেফ।কিন্তু আজ ওর উপেক্ষায় টের পাই বয়ঃসন্ধিকালের আবেগ আচ্ছন্নতা এখন পরিণত বয়সের কারণেই হয়তো বা অনেকটাই স্থিত। বরং দীপের এই নিরুত্তর থাকা কোথায় যেন আমার অযোগ্য অবস্থানেও একটু অপমানের হুল ফোটায়। আমি তো ইচ্ছে করলেই ওর মতো সুখী দাম্পত্যময় জীবনের উচ্ছল ছবি আপ্লোড করতে পারবো না। বিদেশ ভূমি না হোক অন্তত দেশের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত কিংবা রাঙ্গামাটি। আমার দাম্পত্যে কোন মধুচন্দ্রিমা নেই। ছুটিছাটায় বেড়াতে যাওয়া নেই। মাথায় কাপড় তুলে দুই ঈদে কেবল শ্বশুরবাড়ি আছে। আর ছবি বলতে আছে কাবিন আর ওয়ালিমার কিছু রংচটা এলোমেলো মূহুর্তের স্থির ফটোগ্রাফ। যেখানে আমার নত গোমড়া মুখের অর্ধেকটা ঢেকে আছে সোনালি জড়ির লাল উড়নায়, বাকি অর্ধেক শরবতের গ্লাসে। ওর সুখী দাম্পত্যের ছবি বেদনাহত করে কেন আমাকে? হঠাৎ এগিয়ে এসে একটু কথা বললো বলে সব ভুলে ম্যাসেঞ্জারে আড্ডা জমিয়ে ফেলতে হবে? ভুলে যেতে হবে দুই জনের দুই গ্রহ ব্যবধান? দীপের সাথে পরিচিত হবার পর বেশ দু-চারদিন ভিআইপি সম্মান মিলে ফাহমির কাছে। নানা প্রশ্ন করে ফাহমি পরিমাপ করতে চায় দীপের সাথে আমার পরিচয়ের ঘনিষ্ঠতা। স্বভাবজাত সন্দেহবাতিক ছাড়াও এক্ষেত্রে খোঁজখবর নেয়ার অন্তরালে অন্য উদ্দেশ্যটি আমার কাছে অস্পষ্ট থাকে না, সময় সুযোগ মতো বসের কাছে কাজে লাগানো। আমি সত্যিটাই বলি, তবে অর্ধেক লুকিয়ে। দীপের বাবা ছিলেন আমাদের মফস্বল শহরটির সবচেয়ে বড় সরকারি কর্মকর্তা। আর আমার বাবা সে অফিসের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারি। সেই শহরের একমাত্র কোএডুকেশন হাইস্কুলে আমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয় ছিলো দীপ। আর আমি বলতে গেলে প্রায় লাস্ট বেঞ্চের ফাজিল মার্কা ছাত্রী। কিন্তু আমার মায়ের সাথে দীপের মায়ের এক অসম খাতির গড়ে ওঠার কারণে ঈদে পার্বণে তো বটেই, অকারণেও তাদের বাড়িতে আমার মায়ের যাতায়াত ছিলো অবাধ। আর মায়ের সাথে আমার। আসলে আমার মা গিয়ে দীপের মায়ের নানা গেরস্থালি কাজে হাত লাগাতো। এতে দীপের মায়ের আন্তরিকতার চাদর মোড়ানো সামাজিকতা ছিলো। যা কিনা আমার মাকে বুয়া টাইপ গ্লানি থেকে আগলে রাখতো। বিনিময়ে প্রতি ঈদে আমার মায়ের মিলতো নতুন শাড়ি আর আমার নতুন ফ্রক। বাড়তি হিসাবে আমার মা পাড়ায় একটু আলগা ভাব দেখানোর সুযোগ পেতো। পড়শীগত সম্পর্কের আড়ালে এই পারস্পরিক লেনদেনের ব্যাপারটি উহ্য হয়েই লেপ্টে থাকতো। বাকি যে অর্ধেক সত্য অনুচ্চারিত আর অপ্রকাশিত রেখে দিয়েছি নিজের গোপন সঞ্চয়ের মতো তা হলো, আমি লুকিয়ে লুকিয়ে দীপকে চিঠি লিখতাম। আর তাতে কখনো লিপস্টিক মাখানো ঠোঁট লেপ্টে কখনো কাগজের ভাঁজে গোলাপের পাপড়ি দিয়ে ওর বইয়ের ভেতরে রেখে আসতাম। কিন্তু দীপ কোনদিন সে চিঠি পড়তো কিনা সেটা জানা দূরে থাক, আদৌ দেখতো কিনা কোনদিন ওর আচরণে তাও টের পেতাম না। শুধু একদিন। এসএসসি পরীক্ষার পর ঢাকা চলে যাবার আগেরদিন সন্ধ্যায় ও আমাদের বাসায় এসেছিলো। আমার মায়ের কাছে বিদায় নিতে। যাবার সময় আমাকে ডেকে সাথে নিয়ে গিয়েছিলো ওদের কোয়ার্টারে। আর দু’বাসার মাঝখানে যে বিশাল মাঠ, সেই মাঠের ছাতিম গাছের নিচে আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছিলো। আমি কাঁপছিলাম ব্যাধের হাতে বন্দি পাখির মতো, সারারাত কেঁপেছি। সমস্ত চিঠির উত্তর সেদিন ছাতিম ফুলের গন্ধ হয়ে আমার দমবন্ধ করে দিয়েছিলো। সেই প্রথম। আর সেই শেষ? দীপ আজ এই কফিশপে আমাকে ডেকে এনেছে কেন? নীরবতার কাছে নিজেদের কৌতুহল কিংবা উদ্দেশ্য জিম্মি রেখে আমরা দু’জনে কফিতে চুমুক দেই।
(৩)
অর্ধেক সত্য লুকিয়ে আমি দিব্যি বিস্ময় প্রকাশ করেছি ফাহমির কাছে, এতদিন পর দীপ আমাকে চিনল কী করে? আমার বিস্ময়ে ফাহমির অযৌক্তিক শ্লাঘা ফুলে ফেঁপে ওঠে জন্মদিনের আনন্দময় বেলুনের মতো। পরদিন চুপসে যাবে জেনেও যে বেলুন আগের সন্ধ্যায় ঝলমল করে। বুঝলা না, ভদ্রলোকের বংশ এরেই কয়। সাত পুরুষের শিক্ষিত এরা। আমি মনে মনে হাসি। শুনেছি ফাহমির মতো সব মার্কেটিং কর্মীদের দিন শুরু হয় বসের ‘হারামজাদা’ গালি দিয়ে আর শেষ হয় ‘মাদারচোদ’ গালি দিয়ে। অবশ্য ফাহমি বলে, মার্কেটিং-এর চাকরিতে এসব আদিম শব্দমালার ব্যবহার অনিবার্য এবং নস্যি। নইলে আর মাসের টার্গেট ফিলাপ করতে হবে না। শ্বশুর-শাশুড়ির ওষুধ, ভাই বোনের প্রাইভেট মাস্টারের বেতন, ঘরের চাল ডাল, আজ পানির ট্যাপ নষ্ট, কাল টয়লেটের ময়লা সরে না ইত্যাদি নিত্য সমস্যায় আটকে থাকা ফাঁদের ইঁদুরের জীবনে মাঝে মাঝে অফিসের এসব গল্প ফাহমি নিজেই করে। যখন বেশ ফুরফুরে মেজাজে থাকে। সে কালেভদ্রে। কোন এক সাপ্তাহিক ছুটির আগের রাতে নেট ঘেঁটে দুনিয়ায় পর্ণ দেখে আর কাবিনের অধিকারে তা আমার উপর নির্বিচারে প্রয়োগ করে নিজেকে সফল পুরুষ ভাবে। তারপর তার তৃপ্ত কণ্ঠ থেকে কথার খই ফোটে। আর আমার তীব্র ঘুম পেলেও চোখ খুলা রেখে তা শুনতে হয়। বুঝলা ত, টার্গেট ফুলফিল করলেও বিরাট ক্যাঁচাল, পরের মাসে ডাবল কইরা দ্যায়। ফাহমির সামনে আমি পারতপক্ষে মোবাইলে হাত দেই না। শুধু কল আসলে রিসিভ করি আর জরুরি প্রয়োজনে কল করি। এই তালিকাও শুধু আমার বাপের বাড়ি আর শ্বশুর বাড়িতেই সীমাবদ্ধ। ফাহমির ধারণা, এই ফেসবুক, হোয়াটসআ্যপ, ম্যাসেঞ্জার, ভাইভারে মানুষ খালি প্রেম আর সেক্স করে বেড়ায়। দুয়েকদিন বুঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। ও তেড়ে এসেছে, আমারে বুঝাইতে আইসো না, তোমার চেয়ে কম বুঝি? হাছাই তো। ও কি কম বোঝে? মোটেই না। বোঝে না বলেই তো সকাল নটায় বেরিয়ে যায় আর রাত নটায় বাসায় ঢোকে। আর এই বারো ঘন্টায় আমি দিব্যি স্কুল বন্ধুদের সাথে হোয়াটসঅ্যাপে জোক শেয়ার করি, ‘করোনার ভয়ে যারা খাবার কিনে গুদাম ভরতি করছেন, তারা পর্যাপ্ত কনডমও কিনবেন,যেন এই ছুটিতে আপনার মতো আরেকটা বেয়াক্কেলের জন্ম না হয়’। ফেসবুকে গ্রুপ পেইজ খুলে ব্লক বাটিকের কাপড়ের ব্যবসা করি ফাহমি টেরও পায় না। তবে ম্যাসেঞ্জারে যারা “হাই সেক্সি” “হাই সুন্দরী ” বলে গ্যাজাইতে চায় তাদের বিনা বাক্যব্যয়ে ব্লক করে দেই। বিনা লাভে কে হায় ঝামেলা বাড়াতে ভালোবাসে! শুধু দীপের বেলায় লাভ-ক্ষতি হিসাব করি না। একটা ছাতিমের গন্ধ মাখা সন্ধ্যা হঠাৎ অকারণে আমাকে বিস্রস্ত করে দেয়। বারবার ওর উপেক্ষা সত্ত্বেও ভাব জমানোর চেষ্টা করি। আর তারই ফলে কিনা কে জানে আজ হঠাৎ দীপের এই আহ্বান। আমাদের কফির কাপ শেষ হয়ে আসে। কথা শুরু হয় না, জড়তা ভাঙতে আমরা দুজনেই যেন সাঁতার না জানা যাত্রী, ডুবতে থাকা গভীর জলে হাবুডুবু খাই। দীপ কি আমাকে ম্যাসেঞ্জারে মেসেজ দিতে নিষেধ দেবে? এ’কথা বলার জন্য এই কফিশপে ডাকতে হয় নাকি? দিনের পর দিন ওকে মেসেজ দিয়ে গেছি। একদিন রিপ্লাই দিয়ে বলে দিলেই হতো! আমি উন্মোচনের আলোহীন রহস্যের অন্ধকার থেকে বের হতে পারি না। তখনই হঠাৎ নীরবতা ভাঙে দীপ। দীর্ঘ দু’দশকে অতীতের সমস্ত উপেক্ষা-নির্বিকারত্ব, বর্তমানের সমস্ত উদাসীনতা-অবহেলা এক ঝটকায় ঝেড়ে ফেলে দিয়ে টেবিলে রাখা আমার হাত দুটো মুঠোয় পুরে। আর তারপর আমার রহস্যের ঘোরলাগা অস্তিত্বে আরো রহস্যের অন্ধকার ঢেলে দিয়ে আকুল কণ্ঠে জানতে চায়, আমি খুব একা মিলি, তুমি সব ছেড়েছুড়ে আমার কাছে চলে আসতে পারবে? কফি নাকি ছাতিম ফুলের গন্ধ আমাকে আবার ঘোরে ফেলে দেয়!
ছাতিম ফুলের অনুষঙ্গে গল্পটি এগিয়েছে ছন্দের বারান্দায়…..
ভালো লেগেছে। এই সময়ের গল্প।