শিক্ষানবিশের রহস্যভেদ

শিক্ষানবিশের রহস্যভেদ
অনন্যা দাশ

রিয়ানার কেসটা আমার কাছে আসার কথা ছিল না কিন্তু অদ্ভুত ভাবে আমার কোলেই এসে পড়ল। আমি আসলে মিস্টার ব্যারি লাইটের কাছে ট্রেনি গোয়েন্দা হয়ে ঢুকেছি। এক বছরের ওপর হয়ে গেছে কিন্তু এখনও ব্যারি আমাকে রিসার্চ ছাড়া তেমন কিছুই করতে দেয়নি। আমি কোন কেস চাইলেই বলবে, “না, ক্রিস এখনও সময় হয়নি। আরো কয়েকদিন যাক!”

আমি কী আর করব, সহ্য করি। ব্যারির নাম আছে প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার হিসেবে। ব্যারির কাছে ট্রেনিং পেলে আমি বেশ কিছু জিনিস শিখতে পারব ভেবেই ওর কাছে ইন্টার্ন হয়ে ঢুকেছি। মাইনে কড়ি তো কিছু পাই না আর শেখাও ছাই হচ্ছে, শুধু ইন্টারনেট ঘেঁটে রিসার্চ করে মরি। এদিকে ব্যারি এক বিশাল বড়লোক বয়স্কা মহিলার হিরের হার উদ্ধার করতে ব্যস্ত আর আমি সকাল থেকে সন্ধ্যে ওর অফিস সামলাই। আমার বাবা দুঁদে পুলিশ অফিসার ছিলেন কিন্তু বাবার সঙ্গে আমার কোনদিনই খুব একটা বনিবনা হত না তাই আমি এই শহরে এসে, একা থেকে, ব্যারির কাছে কাজ শিখছি।

সেই রকমই একদিন সারাদিন অফিস সামলানোর পর বন্ধ করে বেরবো ভাবছি এমন সময় ব্যারির ফোন এল, “ক্রিস? তুমি এখনও অফিসে আছো?”

“হ্যাঁ, এবার অফিস বন্ধ করে বেরিয়ে যাবো ভাবছিলাম,” আমি বললাম।

“শোনো, তুমি নিজের একটা কেস চাইছিলে না কিছুদিন ধরে? তা একটা কেস আসতে চলেছে। এক মহিলা আসবেন অফিসে আর দশ মিনিটের মধ্যে। তুমি তাঁর সঙ্গে কথা বলে ওই কেসটা নিতে পারো। আমার এই হিরের হার খোঁজা নিয়ে মরার সময় নেই। কাল হয়তো মেরিল্যান্ড যেতে হতে পারে তাই ওই কেসটা তুমিই সামলাও। মহিলাকে অবশ্য বোলো তুমি আমার কাছেই সব রিপোর্ট করছ। মানে যেন আমিই প্রধান গোয়েন্দা, নাহলে উনি অন্য জায়গায় চলে যাবেন। আর আমাদের যা রেট তাই চাইবে, কেমন?” বলে ফোনটা কেটে দিল ব্যারি।

আমার বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটা হতে শুরু করেছে। আমার প্রথম কেস, আমার, মানে কৃত্তিবাস সেন ওরফে ক্রিসের প্রথম কেস!

সত্যিই দশ মিনিটের মধ্যে এক মহিলা এসে হাজির হলেন। আমি টিভির খবর খুব একটা দেখি না, মানে সময় পাই না, কিন্তু এই মহিলাকে দেখেছি দেখেছি মনে হচ্ছিল। বয়স আন্দাজ পঞ্চান্ন মতন হবে। মোটাও নন আবার রোগাও নন। ছোট করে কাটা সোনালি চুল, পোশাক বেশ ভদ্রোচিত।

আমাকে বললেন, “ব্যারির সঙ্গে কথা হল। সে বলল তোমাকে সব জানাতে।”

আমি খুব গম্ভীর ভাবে বললাম, “হ্যাঁ, আমি সব রেকর্ড করে নিচ্ছি। ব্যারি ফিরলেই ও সব দেখে নেবে।”

“আমার নাম লিডিয়া। লিডিয়া হ্যারিস। আমি গ্লেন হ্যারিসের স্ত্রী, মানে ছিলাম আর কী, এক্স ওয়াইফ। আমাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল,” এতটা বলে মহিলা থেমে আমার মুখের দিকে তাকালেন যে আমি গ্লেন হ্যারিস কে সেটা মনে করতে পারি কিনা। পারলাম কারণ কয়েকদিন আগে যখন বাড়ি গিয়েছিলাম তখন খাবার টেবিলে আমার বোন রাধিকা ওই কেসটা নিয়ে খুব চেঁচামেচি করছিল। একটা রেপ কেসে জড়িত গ্লেন হ্যারিস। রিয়ানা মরিসন বলে একটা মেয়েকে রেপ করতে গিয়ে খুন হয় গ্লেন হ্যারিস। বিশ্রী ব্যাপার একেবারে।

আমি বললাম, “হ্যাঁ, আমি গ্লেন হ্যারিসের কেসটা জানি। মানে টিভিতে বা কাগজে যা দিয়েছে সেই মতন আর কী। তা আপনি আপনার দিকটা বলুন।”

মহিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “গ্লেনের সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়েছে তিন বছর হল। আমাদের বৈবাহিক জীবন কোনদিনই খুব একটা সুখের ছিল না। দুটো ছেলেমেয়ে আমাদের। তাদের মুখ চেয়েই আমি এতগুলো বছর সহ্য করেছিলাম। তারা কলেজে যেতেই আমিও বেরিয়ে যাই। গ্লেনের অনেক দোষ ছিল, মানে সে খুব কিপটে আর অসম্ভব টাকার লোভ তার। বেশি কথাও বলে কিন্তু চারিত্রিক দিক থেকে কখনও কিন্তু কোন নালিশ আমার ছিল না। আমি বিশ্বাস করি না গ্লেন কোন মেয়েকে ধরে রেপ করতে পারে। মানে সেদিক দিয়ে সে ভদ্রই ছিল। আমি সেদিন ঠিক কী হয়েছিল সেটা জানতে চাই। আমার ছেলেমেয়েরা খুব কষ্ট পাচ্ছে তাদের বাবা রেপিস্ট ভেবে। গ্লেনের নাম থেকে সেই বদনাম সরাতে চাই আমি।”

“ওই মেয়েটা তো গ্লেনের বাড়িতেই গিয়েছিল, তাই না?”

“গ্লেন বাড়িটার একটা অংশ ভাড়া দিতে চাইছিল। কিপ্টের হাড্ডি বলে বাড়ি ভাড়া দেওয়ার জন্যে কোন এজেন্ট রাখেনি। নিজেই সবাইকে দেখাচ্ছিল। মেয়েটাও বাড়ি দেখবে বলেই গিয়েছিল আমার ধারণা। তারপর কী হয়েছিল সেটাই আমি জানতে চাই। ওই রিয়ানা বলেছে যে গ্লেন ওকে ধর্ষণ করতে চেষ্টা করে এবং সে তখন আত্মরক্ষার জন্যে ব্যাগ থেকে বন্দুক বার করে গুলি চালাতে বাধ্য হয়। তুমিই বলো কোন মেয়ে ওই রকম ভাবে ব্যাগে পিস্তল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়?”

আমি চুপ করে রইলাম। যতদূর শুনেছি মার্কিন দেশে একা মেয়েরা অনেকেই ব্যাগে ছোট পিস্তল বা রিভলবার রাখে আত্মরক্ষার জন্যে।

লিডিয়া হ্যারিস আবার বলতে শুরু করলেন, “আমার কাছে কিছু অর্থ আছে। তাছাড়া আমি এখনও কাজ করি। তাই আমি চাই ব্যারি ব্যাপারটার সত্যি মিথ্যে একটু খতিয়ে দেখুক। পুলিশ কিছু করবে না। ওদের কাছে ব্যাপারটা ওপেন অ্যান্ড শাট কেস।”

“আচ্ছা গ্লেন কি চাকরি করতেন?” আমি জিগ্যেস করলাম।

“আগে তো একটা সরকারি চাকরি করত এবং রিটায়ার করে। কত মাইনে পেত সে সব আমি জানি না। ও বরাবরই ফাইন্যান্সের সব কিছু নিজের দখলে রাখত। তবে বাড়িটার সব লোন শোধ হয়ে গিয়েছিল এটা আমি জানি। ওটা ডিভোর্সের সময় জেনেছিলাম।”

“উইল করেছিলেন কোন?”

লিডিয়া একটু ভেবে বললেন, “বলতে পারব না। ডিভোর্সের সময় তো উকিল করতে হয়েছিল ওকে বাধ্য হয়ে। তার নাম টম হার্পার। রাইলি স্ট্রিটে ওদের অফিস। ওদের কাছে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারো।”

“আচ্ছা বাড়িটা কী একবার দেখতে পাওয়া যাবে মানে ভিতরটা?” আমি বললাম।

“পুলিশ তো যা করার করে নিয়েছে। এখন উইল না থাকলে বাড়িটা তো মনে হয় ছেলে-মেয়ে পাবে। ওদের কোন আপত্তি হওয়ার কথা নয়। তোমরা দেখতে পারো। যদি কিছু পাও,” লিডিয়া বললেন।

কত ফিজ হবে সেই সব নিয়ে আলোচনা করে লিডিয়া চলে গেলেন। আমিও অফিস বন্ধ করে বাড়ির দিকে চললাম। মাথায় নানা রকম আইডিয়া গিজগিজ করছে। প্রথমেই রিয়ানার সঙ্গে কথা বলতে হবে। এই সব ভাবতে ভাবতেই খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়লাম। পরদিন সকাল সকাল শুরু করতে হবে।

পরদিনই রিয়ানার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম আমি।



রিয়ানার সঙ্গে কথোপকথনটা যে ভাবে আমরা লিডিয়াকে দিয়েছিলাম সেটাই এখানে তুলে দিলাম। আসল ভিডিওটা লিডিয়াকে দেওয়া হয়নি, টাইপ করে দেওয়া হয়েছিল তাই উনি মনে করছিলেন ব্যারি ইন্টারভিউটা নিয়েছে, কিন্তু আসলে নিয়েছিলাম আমি। ব্যারি তখনও অন্য কেসে ব্যস্ত। ওর তো সময় নেই।

রিয়ানাকে দেখে বেশ কষ্টই হচ্ছিল আমার। চোখের নিচে কালো কালো ছোপ, সাদাটে, ফ্যাকাসে মুখ। কোন মেক আপ নেই। ওর এমনি সময়কার ছবি আমি দেখেছি। সেজেগুজে বেশ সুন্দর লাগে ওকে কিন্তু এখন কেমন যেন একটা হয়ে গেছে। সর্বক্ষণ ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, যেন এই বুঝি কেউ ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

ব্যারি লাইট অ্যান্ড কো: তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব। ঠিকঠাক জবাব পাবো আশা করছি। তার আগে সেদিন যা যা ঘটেছিল সব যদি খুলে বলো।

রিয়ানা: পুলিশকে সব বলেছি আগেই কিন্তু লিডিয়া যখন তোমাদের নিযুক্ত করেছেন তখন…লিডিয়ার প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই। ওঁর কোন দোষ নেই আমি জানি। উনি তো ডিভোর্স করেই দিয়েছেন, তাও ছেলেমেয়েদের বাবা ওই রকম করলে খারাপ তো লাগবেই। আসলে আমি এখন যেখানে থাকি সেই বাড়িটা মোটেই ভালো নয়, সব সময় এটা সেটা খারাপ হতে থাকে আর বাড়িওয়ালা লোকটা এত পাজি যে কিছু তো সারাবেই না উলটে বছর বছর ভাড়া বাড়াতে থাকে। আমার কয়কজন বন্ধু একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে রয়েছে তাই আমি ভাবছিলাম আমিও একটা বাড়ি দেখি। তা কমিউনিটি সেন্টারের নোটিসবোর্ডে ওই বাড়িটার ‘ফর রেন্ট’ বিজ্ঞাপনটা দেখে মনে হয়েছিল বাড়িটা ভালো তাই যোগাযোগ করেছিলাম। ফোনে খুব ভাল করে কথা বলল সে। বিকেল পাঁচটা নাগাদ সময় দিয়েছিল আমাকে। তা এখন তো শীতকাল, পাঁচটার সময় তো অন্ধকার হয়ে যায়। আমি তাও ভাবলাম অফিস থেকে ফিরে হয়তো দেখাবে তাই বিকেলে ডাকছে। ঠিক পাঁচটার সময় গিয়ে পৌঁছলাম। দরজা খুলে আমাকে দেখে হাসি মুখেই ভিতরে আসতে বলল লোকটা। তখন তো আমি কিছুই বুঝিনি ওর কুটিল অভিসন্ধি। যে অংশটা ভাড়া দিতে চায় সেটা বলল বেসমেন্টের একটা অংশ তাই আমাকে নিয়ে বেসমেন্টে গেল। তার পরই আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল একেবারে! আমার জামা ছিঁড়ে দিল। আমি ছিটকে পালালাম। ও তখন ঘরের দরজাটা বন্ধ করে সেটার দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে বিশ্রীভাবে হাসতে লাগল। বলতে লাগল, ‘পালাবার আর অন্য কোন পথ নেই কিন্তু। আমরা দুজনেই প্রাপ্তবয়স্ক, এসো একটু মজা করি!’ আমি তখন ছেঁড়া জামা নিয়ে ভয়ে কাঁপছি। আমার বুপ ঢিপঢিপ করছিল, মাথা কাজ করছিল না। ও এক পা এক পা করে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আমি আর কী করব বুঝতে না পেরে চট করে ব্যাগটা খুলে বন্দুক বার করে ওর দিকে তাক করে বললাম, ‘এগোলেই কিন্তু আমি গুলি করব!’ লোকটা কথা শুনল না, এগিয়ে আসতে লাগল আর আমি গুলি চালিয়ে দিলাম!

ব্যারি লাইট অ্যান্ড কো: লোকটাকে আটকাতে তিনটে গুলি চালাতে হল? একটাতেই তো কাজ হয়ে যেত!

রিয়ানা: আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম! তখন কী করছি সেই সব জ্ঞান ছিল না। আত্মরক্ষাই মোক্ষ হয়ে উঠেছিল। তোমরা ছেলেরা কিছুতেই অনুমান করতে পারবে না একটা হিংস্র পশু যখন একটা মেয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় তখন মেয়েটার মনের অবস্থা কী রকম হয়!

ব্যারি লাইট অ্যান্ড কো: আচ্ছা তোমার পরিবারে আর কে আছে?

রিয়ানা: কেউ নেই। বাবা আমার জন্মের পরই বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিলেন আর মা অনেক বছর হল মারা গেছেন।

ব্যারি লাইট অ্যান্ড কো: ও আচ্ছা, দুঃখিত।

রিয়ানা: লিডিয়াকে বোলো আমি ইচ্ছে করে কিছু করিনি, হয়ে গেছে।

ব্যারি লাইট অ্যান্ড কো: আচ্ছা তুমি ব্যাগে সব সময় গুলি ভরা বন্দুক নিয়ে ঘোরাফেরা করো?

রিয়ানা: আমার বন্দুকের লাইসেন্স আছে। আমি ট্রেনিং ও নিয়েছি। একজন একা মেয়ের এত বড়ো শহরে ঘুরে বেড়ানোটা যে নিরাপদ নয় সেটা একা থাকতে থাকতে আমি অনেক ছোট বয়সেই বুঝে গিয়েছিলাম। শুধু আমি কেন আমার অনেক বন্ধুরাই ব্যাগে অনেক কিছু নিয়ে ঘোরে। পেপার স্প্রে, ছুরি, ছোরা আর হ্যাঁ বন্দুকও। তুমি এতে আশ্চর্য হচ্ছ কেন আমি বুঝতে পারছি না। আর বন্দুকে গুলি না ভরা থাকলে সেটা কোন কাজে লাগবে শুনি? কেউ আমার ওপর আক্রমণ করলে আমি তখন তাকে একটু থামতে বলে বন্দুকে গুলি ভরব বুঝি?



লইয়ারের সঙ্গে কথা বলে যখন নতুন কিছু জানতে পারলাম না তখন গ্লেন হ্যারিস কী রকম লোক ছিল সেটা বোঝার জন্যেই আমি তার পুরনো অফিসে গিয়েছিলাম। ওর প্রাক্তন সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বললাম। গ্লেন হ্যারিসের সম্পর্কে কেউ বাজে কিছুই বলল না। সাতে পাঁচে থাকত না লোকটা। মহিলা সহকর্মীরাও খারাপ কিছু বলল না। কোনদিন কারো সঙ্গে ওই রকম ব্যবহার করেনি সে। একটু বেশি কথা বলত আর খুব কিপ্টে ছিল সেটা সবাই বলল। কোনদিন কাউকে খাওয়াত না বা অফিসের কারো কোন অনুষ্ঠান হলে উপহার দিতে হবে বলে যেত না কিন্তু কোন মেয়েঘটিত ব্যাপার কোনদিন কেউ দেখেনি বা শোনেনি। অফিসের লোকজন তাই ওর ওই অদ্ভুত মৃত্যুতে বেশ আশ্চর্য। লিডিয়াও তো একই কথা বলেছিলেন। আমার মনেও একটা খুঁতখুঁতানি দানা বাঁধছিল। মানুষের চরিত্র কী খুব বদলায়? আমি যতদূর জানি বদলায় না। তাহলে কেন সে হঠাৎ ওই ভাবে রিয়ানার ওপর হামলা করল?

আমি অফিস থেকে বেরিয়ে হেঁটে গাড়ির দিকে যাচ্ছি এমন সময় একটা ভবঘুরে মতন লোক দুম করে আমার সঙ্গে এসে ধাক্কা খেল। আমি বেশ রেগে গেলাম। সরকারি অফিসের বিশাল পার্কিং লট, সেখানে ওই লোকটাকে আমার ঘাড়ে এসেই কেন পড়তে হল? আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। লোকটা কিন্তু ফিরেও তাকালো না, দ্রুত পায়ে হেঁটে পালিয়ে গেল। ওর মুখও আমি দেখতে পেলাম না। কী অদ্ভুত রে বাবা। হঠাৎ খেয়াল হল, আরে পকেটমার নয় তো? পকেটে হাত ঢুকিয়ে মানিব্যাগটা বার করতে তার সঙ্গে এক চিলতে একটা কাগজ বেরিয়ে এল। তাতে লেখা রয়েছে কিছু। আমি তো কোন কাগজ নিয়ে বেরোইনি! কাগজে লেখা রয়েছে, ‘গ্রেস পেরেরার সঙ্গে দেখা করো, তাহলেই বুঝতে পারবে। বিভার লেন।’।

ভীষণ অবাক হলাম আমি। কে গ্রেস পেরেরা? কেনই বা আমি তার সঙ্গে দেখে করব? ওই ভবঘুরে লোকটাই আমার পকেটে ওই কাগজটা ঢুকিয়ে দিয়ে গেল ধাক্কা খেয়ে, কিন্তু কেন? অফিসে ফিরে এসে গ্রেস পেরেরার খোঁজে পড়লাম। ভাগ্য ভালো বিভার লেনে একজন গ্রেস পেরেরাই থাকে দেখলাম। অফিস থেকে বেরিয়ে বিভার লেনের উদ্দেশ্যে চললাম। কী আছে সেখানে কে জানে। একেবারে অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার ব্যাপার কিন্তু লেগে যদি যায় তাহলে ক্ষতি কী। বলা বাহুল্য, ব্যারিকে ওই সব নিয়ে কিছুই বললাম না। এই ভাবে সময় নষ্ট করছি জানলে সে মোটেই খুশি হত না।

গাড়ি নিয়ে বিভার লেনে যেতে যেতে হঠাৎ লক্ষ করলাম যে আমার লেজ গজিয়েছে। একটা ছাই রঙের গাড়ি চুপিসারে আমার পিছু নিয়েছে। দেখতে চেষ্টা করলাম কিন্তু বুঝতে পারলাম না। চালক কালো টুপি পরে আছে এবং সেটা মুখটাকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে। যাক আমার পিছু নিয়ে যদি আনন্দ পায় তো পাক! বিভার লেনে যে ঠিকানায় গ্রেস পেরেরা থাকেন সেটা একটা নিম্ন মধ্যবিত্তদের আস্তানা। এলাকাটাও খুব একটা সুবিধার মনে হচ্ছিল না, চারিদিকে জঞ্জাল আর ভাঙ্গা বোতলের ঢের। অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় লক নেই। আমি অনায়াসেই দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে তিনতলায় গ্রেস পেরেরার ফ্ল্যাটের সামনে পৌঁছে গেলাম। দরজার নক করতে ভিতর থেকে কড়া সুরে কে একজন বলল, “আমি কিছু কিনতে চাই না। তুমি যেতে পারো!”

আমি অম্লানবদনে মিথ্যে কথা বললাম, “আমি গ্রেস পেরেরার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। জরুরি সরকারি কাজে!”

একটু পরেই গজগজ করতে করতে এক মহিলা দরজা খুললেন। দেখে মনে হল তাঁর বয়স প্রায় সত্তর মতন হবে।

“আমিই গ্রেস পেরেরা। কী দরকার?”

“না মানে আমি গ্লেন হ্যারিসের পরিচিত…”

অতটা বলতেই মহিলা প্রচন্ড শক্তি দিয়ে আমাকে টেনে ঘরে ঢুকিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বললেন, “গ্লেন ব্যাটা তো মরেছে শুনেছি, তা তুমি কী তার জায়গায় কাজ করছ নাকি? খবরদার, আমি বল দিচ্ছি, আমার কাছে আর একটা পেনিও পাবে না! আমার যা সর্বনাশ করার করে দিয়েছো আর আমি কিছু দেব না!”

আমি বললাম, “না, আমি কিছু চাইতে আসিনি। গ্লেন হ্যারিস সম্পর্কে আপনি যা জানেন তাই বলুন আমাকে।”

মহিলা চোখ ছোট করে বললেন, “ব্যাটা মরেছে আমি খবরে শুনেছি! ওই রিয়ানা মেয়েটা ওকে শেষ করেছে, বেশ করেছে। আমার রক্ত শুষে খেয়েছিল ওই পশুটা!”

আমি বললাম, “কী হয়েছিল নির্দ্বিধায় আমাকে বলতে পারেন। আমি ওই কেসটার তদন্ত করছি।”

আমার কথায় কী পেলেন আমি জানি না কিন্তু গ্রেস পেরেরা আমাকে সোফায় বসতে বলে নিজেও বসে পড়ে বলতে শুরু করলেন, “এটা অনেকদিন আগেকার কথা। আমি তখন বয়সে জোয়ান। আমার একটা ছেলে ছিল। বরটার চরিত্রের ঠিক ছিল না তাই আমি তাকে ছেড়ে দিলাম। ছেলেটার বয়স তখন পাঁচ কী ছয় ঠিক মনে নেই। আমার একটা বয়ফ্রেন্ডও জুটেছিল। বদ ছিল লোকটা। আমাকে মারত আর ছেলেটাকেও। তা তাকে আমি বিদায় করে দিয়েছিলাম কয়েকদিন পরই কিন্তু ততদিনে যা হওয়ার হয়ে গেছে। স্কুলের টিচার মারের দাগ দেখতে পেয়ে সিপিএস ডেকে বসেছে। আর তার পরই গ্লেন এসে হাজির হল। সে আমাকে বলল আমি যদি ওকে খুশি করার জন্যে কিছু অর্থ না দি তাহলে সে তার রিপোর্টে লিখে দেবে যে আমি জেরির ওপর অত্যাচার করি আর সরকার তাকে কেড়ে নিয়ে ফস্টার হোমে রেখে দেবে! আমার ছেলেই আমার সব তখন। তাই আমি যা হোক করে হোক ওর কথা মত ডলার দিয়ে দিলাম। কিন্তু সেটাই শেষ নয়। ওর অত্যাচার চলতে থাকল। আমাকে নিংড়ে শুষে ছিবড়ে করে ছাড়ল ব্যাটা!”

আমার মাথায় বাজ পড়ল। সিপিএস অর্থাৎ চাইল্ড প্রোটেকটিভ সার্ভিসেস, আমি বললাম, “আপনি পুলিশে নালিশ করতে পারতেন!”

“হ্যাঁ, একজন ভদ্র সরকারি কর্মচারীর কথা না শুনে তারা এক বেশ্যার কথা শুনবে বুঝি! তোমার বয়স কম তাই তুমি কিছুই জানো না, এই পৃথিবীটা গরিবদের কথা শোনে না!”

“আচ্ছা আপনিই কী একা নাকি আরো কাউকে গ্লেন এই ভাবে ব্ল্যাকমেল করেছে?”

“সেটা আমি বলতে পরব না কিন্তু আমার মনে হয় যার অত লোভ সে কী একজনেতে থামবে?”

“আর জেরি?” আমি জিগ্যেস করলাম, “জেরি কী করে?”

“কী আবার, ওই সিপিএস চত্বরেই ছোট খাটো কী সব কাজ করে শুনেছি। আমার সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা করতে আসে। কিছু অর্থকড়ি দিয়ে যায়। ছেলেটা ভালো, মাঝে মাঝেই কিছু লোকজনকে আমার কাছে পাঠায় কী ভাবে সিপিএসের অত্যাচার থেকে বাঁচতে হবে সেই সব ফন্দি ফিকির জানতে। আমার প্রচুর অভিজ্ঞতা তাই আমি সবাইকেই কিছু না কিছু উপায় বলে দিয়ে সাহায্য করি, বদলে তারা আমাকে কিছু ডলার দিয়ে সাহায্য করে। তবে তারা সবাই গরিব। বড়োলোকদের আমার সাহায্যের দরকার হয় না।”

মিসেস পেরেরাকে কিছু ডলার দিয়ে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠতে উঠতে দুটো কথা মনে হচ্ছিল। প্রথম যে ভাগ্যিস আমার গাড়িটা বেশ পুরনো, নাহলে এই পাড়ায় গাড়ি পার্ক করে রেখে চলে যাওয়াটা মোটেই নিরাপদ নয়। আর দ্বিতীয় আজ সকালে যার সঙ্গে আমার ধাক্কা লেগেছিল সে জেরি ছাড়া আর কেউ নয়! আমার গাড়ি আর জামাকাপড়ের অবস্থা দেখে তার মনে হয়েছে আমার গ্রেসের সাহায্যের প্রয়োজন হতে পারে তাই ওই চিরকুট!

অফিসে ফিরে গেলাম আমি আর আমার পিছন পিছন ওই ছাইরঙা গাড়িটাও।



বাকি সময়টা আমি রিসার্চ করেই কাটালাম। যা যা পেলাম তাতে আমার মাথা বোঁ বোঁ করে ঘুরছিল। সন্ধে সাতটা নাগাদ যখন আমি অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়ির দিকে হাঁটছি এমন সময় ব্যারির ফোন এল। কেমন কী এগোচ্ছি জিগ্যেস করছিল।

আমি বললাম, “ব্যারি, এখন আমি অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়ির দিকে যাচ্ছি। এখন সব কিছু বলতে চাই না। তবে এইটুকু বলতে পারি কাল সকালে যদি ফোন করো তাহলে আমি তোমাকে সব কিছু বলতে পারব। গ্লেন হ্যারিসের মৃত্যুর রহস্যের সমাধান হয়ে গেছে মনে হচ্ছে!”

গাড়ির কাছে পৌঁছে পকেট হাতড়ে চাবিটা বার করতে গিয়েই দেখতে পেলাম আমার গাড়ির সব কটা টায়ার ফালা ফালা করে কাটা! আর কিছু ভাবার আগেই দুম! একটা গুলি এসে লাগল গাড়িতে একেবারে আমার কান ঘেঁসে! পার্কিং লট খালি। শীতের দিনে এই অফিস এলাকায় যারা কাজ করে তারা সবাই অন্ধকার হতে না হতেই বাড়ি পালায়। আমি দৌড়ে উলটো দিকে গিয়ে প্যাসেঞ্জার সাইডের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে গাড়ি লক করে ফেললাম। আরো কয়েকটা গুলি এসে লাগল গাড়িটার গায়। একটা জানালার কাচ ফুঁটো করে ঢুকল। আমি একেবারে সিটের তলায় ঢুকে রয়েছি প্রায় । এমন সময় জানালায় একটা মুখ দেখতে পেলাম – রিয়ানা!

গাড়ির ভাঙা জানালার মধ্যে দিয়ে বন্দুক ঢুকিয়ে সে বলল, “তোমার খেল খতম!”

আমি ফোনটা দেখিয়ে বললাম, “আমাকে মেরে ফেলতে পারো তুমি কিন্তু আমার বস ব্যারি সব জানে! তোমার নাম আসলে লরা নেলসন। তুমি সুসান নেলসনের মেয়ে। ছেলেমেয়েদের ওপর অত্যাচার করার জন্যে পুলিশ সুসানকে গ্রেপ্তার করে এবং পুলিশের লকাপেই আত্মহত্যা করে সুসান! যাতে কেউ সুসানের সঙ্গে তোমার সম্পর্কটা না বুঝতে পারি তাই তুমি নিজের নাম বদল করেছো, তাই তো?”

“আমার মা আমাদের ওপর কোনদিন অত্যাচার করেনি!” হিস হিস করে বলল রিয়ানা।

আমি যথাসম্ভব শান্ত গলায় বললাম, “আমি জানি! গ্লেন হ্যারিস মিছি মিছি তোমার মাকে ব্ল্যাকমেল করছিল তাই তো?”

এবার কেঁদে ফেলল রিয়ানা ওরফে লরা, “আমার মা খুব গরিব ছিল। মার ক্ষমতা ছিল না গ্লেন হ্যারিসের ওই অর্থের লোভ মেটানোর। তাই সে ব্যাটা বদমাইশ মার নামে নালিশ করে দেয় সিপিএসে। মা গরিব ছিল তাই মার কথা কেউ শোনেনি আর কেস কোর্টে ওঠার আগেই মা লজ্জায় অপমানে নিজের প্রাণ নিয়ে নেয়! সেই থেকে আমি আর দাদা এক ফস্টার হোম থেকে আরেক ফস্টার হোমে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। দাদা তো আর না পেরে ড্রাগ ধরল। ছ’মাস আগে সেও মার কাছে চলে গেছে! বেঁচে রয়েছি আমি। আমার দাদা আর আমার মার প্রাণ নিয়েছে যে বদমাইশ তাকে আমি মারব না তো কাকে মারব? শুধু কী আমাদের, গ্লেন হ্যারিস অনেকের জীবন নষ্ট করেছে তার ওই অর্থের লোভের জন্যে! সেটা অবশ্য তুমিও জানো এখন। তুমি তো গ্রেসের বাড়ি গিয়েছিলে আজ দেখলাম।”

ও তার মানে ছাই রঙের গড়ি করে রিয়ানা ওরফে লরাই আমার পিছু নিয়েছিল। আমি সব জেনে গেছি তাই মনে হয় ও আমার জন্যে পার্কিং লটে অপেক্ষা করছিল আমাকে শেষ করবে বলে।

আমি সিটের নিচ থেকে কোন রকমে বললাম, “লরা, আমাকে মেরে তোমার কী লাভ হবে? আমিই বরং তোমাকে বাঁচাতে পারি। আমি তো জানি গ্লেন কী ধরনের শয়তান।”

দূরে পুলিশের গাড়ির সাইরেন শোনা যাচ্ছে। ব্যারি প্রথম দিকের কিছুটা কথা আর গুলির শব্দ শুনতে পেয়েই পুলিশ ডেকেছে। বন্দুকটা ফেলে দিল লরা, ক্লান্ত স্বরে বলল, “গুলি শেষ, আর কিছু করতেও পারব না। তবে একটা কথা বলে রাখি, শুধু যে গ্লেনের দোষ ছিল তা কিন্তু নয়। আরো বেশ কিছু লোভী শয়তান মানুষ গ্লেনের সঙ্গে মিলে সিপিএসের সাহায্য নিয়ে গরিবদের রক্ত চুষছিল। তার মধ্যে একজন তোমার বাবা পুলিশ অফিসার কল্লোল সেনও ছিলেন।”

এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন

2 thoughts on “শিক্ষানবিশের রহস্যভেদ

  1. প্লট ভাল ছিল । কিন্তু গোয়েন্দা গল্পে কোন ধোঁয়াশার জায়গা থাকে না । যতই রিসার্চ ওয়ার্ক হোক না কেন গোয়েন্দা গল্পে কেনর উত্তর দিতে হবে । হটাত্ করে সুসান লেনসনের খবর কি ভাবে পেল গোয়েন্দা সেটা পাঠককে জানাতে হবে । তবে লেখনী সাবলীল । প্লট পরিবেশনা আর একটু ঘষামাজা জরুরী ।🙏

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *