শহিদের রক্ত
(সৌরভ মুখোপাধ্যায়)
ফের একটা মড়া যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। হরিবোল দিচ্ছে লোকগুলো। এটা নিয়ে তিনখানা হল সকাল থেকে। আজ কি একটু বেশি লোক মরল?
বুড়ো সৈদুলের মনটা আজ ভারি বেতালা। মগজের মধ্যে যেন জোঁক শুষছে, ছিনে জোঁক!
মাথার ওপর একটুকরো কালো পলিথিন ত্যারছা করে টাঙানো আছে, দু’খানা বাঁখারির ঠেকনায়। কিন্তু খেঁকি ভাদুরে রোদ্দুরটা তারই ধার ঘেঁষে তেড়ে-তেড়ে আসছে ক্রমাগত। যত বেলা বাড়ছে, যেন সুলসুলিয়ে উঠছে হতচ্ছাড়া!
ফুটপাথের পাশের দেয়ালটার দিকে গুটিসুটি মেরে কুঁকড়ে বসে থাকে সৈদুলবুড়ো। ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকে। সামনেই চট পাতা আছে একটা, ফুটপাথ দিয়ে যাওয়ার সময় রোজ যেমন একটা-দুটো করে কয়েন ফেলে যায় লোকজন— আজও পড়েছে কিছু। কিন্তু আজ সৈদুল অন্য দিনের মতো গলা তুলে ‘বুড়ো লাচারকে দুটো পয়সা দ্যান দাদা দিদিরা’ বলে চ্যাঁচাচ্ছে না। থম্ মেরে বসে আছে। তাই পয়সাও পড়ছে অন্য দিনের চেয়ে কম। অন্যদিন ঘণ্টায় ঘণ্টায় ঝুঁকে পড়ে কয়েন গোনে সৈদুল, যদি একটু কমসম পড়েছে বলে মনে হয় তো ‘দাদা গো দিদি গো’ চিত্কারটা চৌদুনে তুলে দেয়। আজ গোনারও তাগিদ নেই, গলারও সে তেজ উধাও। আজ বড় আনমনা লাগে।
রাস্তার উল্টোদিকে অন্যমনস্ক চোখে তাকিয়ে থাকে বুড়ো সৈদুল। হিন্দুদের বডি নিয়ে যাওয়ার সময় খই আর খুচরো পয়সা ছড়ায়। বেশির ভাগই অচল সিকি-আধুলি। ও-ফুটের হাতকাটা লাখু ভিখিরিই ওইগুলো কুড়োয় বেছে-গুছে, যদি এক-আধবার কিছু চালু কয়েন মেলে! হ্যাঁ, আজও ছুটে ছুটে যাচ্ছে বারবার, খুঁজেপেতে ঝোলায় পুরছে।
তা নিক, লাখুই নিক গে। সৈদুল কোনোদিন কাফের-মড়ার খুচরো ছোঁয় না। মৌলবী সাহেবের বারণ আছে। ওতে গুনাহ হয়।
আর, সত্যি বলতে কী, সৈদুলের ওতে মাথাব্যথাও নেই। তার চটে দুটাকা পাঁচটাকা তো পড়েই, কখনও-সখনো দশের নতুন চাকতিও। বাবুবিবিরা কখন হামলে পড়ে ভিক্ষে দেয়, বেশ জানে সৈদুলবুড়ো। মামলা লড়তে যাচ্ছে কিংবা জিতে ফিরছে, পরীক্ষা দিতে বা রেজাল্ট জানতে যাচ্ছে, হাসপাতালে কাছের লোককে দেখতে যাবে— এই সব সময়ে মানুষজনের দিল্ একটু বেশি ধুকপুক করে, নয়তো বেশিরকম দরাজ হয়। ফুটপাথের ধুলো ধোঁয়া আর আকাশের রোদ-বিষ্টি-ঝড় খেয়ে জ্ঞান টনটনে হয়েছে সৈদুলের। ভিখিরি-জীবন তো কমদিন হল না। নয়-নয় করে বছর আষ্টেক তো বটেই; সেই যবে বাঁ পা’টা ভেঙে গিয়ে রংমিস্তিরির কাজটা ঘুচে গেল আর ভাতিজারা কিছুতেই নিঃসম্বল চাচাকে গাঁয়ের ভিটেতে জায়গা দিলে না— বরাবরের মতো সব সম্পক্ক চুকিয়ে শিয়ালদার ট্রেনে চেপে বসেছিল সে। এই আট বছরে তারাও আর কোনও খোঁজ করেনি।
শালা, দুনিয়ার হাল ভারি আজব। আপন-পরের কোনও ঠিকঠিকানা নেই কোথাও।
# #
সৈদুল চিন্তিত মুখে মড়া-নিয়ে-যাওয়া লোকগুলোকে দেখতে থাকে। ওইদিকে শ্মশান, কাছেই। হিন্দুরা বডি পোড়ায়। সৈদুলের বডির কী হবে? সে তো পোড়ার নয়, দাফনের বডি। এদিকে কবরখানা নেই, সে বহুত দূর। কে তার লাশ অদ্দূর বয়ে নিয়ে গিয়ে দাফনাবে? একে সে মোছলমান, তায় ভিখিরি। তার দেহখানার গতি করবে এমন ফেরেশতা কে আছে!
চোখের সামনে নাহক খানতিনেক ভিখিরিকে মরতে দেখেছে সৈদুল, তার মধ্যে একজন মোছলমানও ছিল। বড় রাস্তার ক্রসিংয়ের ধার ঘেঁষে বসত, বুড়ি আফরোজা বিবি। সে কতকাল আগের কথা, কিন্তু আজকাল বড্ড মনে পড়ে। বৃষ্টিতে ভিজে নিউমোনিয়া ধরল, সপ্তাহখানেক কেশে ককিয়ে ধড়ফড়িয়ে শেষ অবধি মরে কাঠ হয়ে রইল এক রাতে। আশপাশের লোক ত টেরই পায়নি যে, টেঁশেছে বুড়ি! যেন হাঁ করে ঘুমোচ্ছে। সেই হাঁ-মুখে মাছি ভনভনাচ্ছে দেখেই তো বোঝা গেল ব্যাপার। কিন্তু, তার পর? লাশের গতি করবে কেডা? তিন কুলে কেউ নেই, তার ওপর মোছলমান। গোর দেওয়ার হ্যাপা। লোকজন পাশ দিয়ে কাপড় গুটিয়ে চলে যায়, ভোঁ শব্দে গাড়ি ঘোড়া দৌড়োয়— আফরোজা বুড়ি পড়ে থাকে সন্ধে তক। পিঁপড়েয় ছেঁকে ধরে তার ঠান্ডা হাত-পা। ভটকানি গন্ধ ছাড়ে বুঝি। তারপর করপোরেশন না পুলিশ কোত্থেকে যেন বাবুরা এল, নীল প্লাস্টিকে গু-পোঁছার মতো তুলে নিল বুড়িকে, কালো গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে গেল কোথায় কে জানে।
সৈদুল শুনেছে, বেওয়ারিশ সব লাশ মর্গে গিয়ে ডাঁই হয়। তারপর পচে গলে মিশেই যায় মাটিতে, নাকি শেয়াল কুকুরে ছিঁড়ে খায়, না কি মেডিকেলে হাড়গোড় হয়ে ঝোলে— একেকজন একেক রকম বলে। মোটের ওপর, ঠিকঠাক গতি হবে না কিছুতেই!
ইয়া আল্লা ইলহমদিদুল্লাহ! এর চাইতে সব্বোনেশে কথা আর আছে কিছু?
সেই যবে খৎনা হয়েছে তার, নাকি তারও আগে— হামা-টানার বয়স থেকে, মৌলবীর মুখে শুনে আসছে সৈদুল, লাশের যদি গোসল-দাফন-মাটি বা জানাজা-নামাজ না হয় রীত-রেওয়াজ মেনে, যদি কুরআন হাদিসের বিধান অনুযায়ী পরলোকের কাজ না হয়— তবে দোজখের আগুনে পুড়তে হয় অনন্তকাল! ইবলিশ এসে রুহ্ পাকড়াও করে। বেহেশতের পথ চিরকালের জন্যে বন্ধ!
হাতকাটা বিহারী লাখু মাঝে মাঝে ওই ফুটপাথ থেকে বিড়ি খেতে আসে তার কাছে। ওরও খুব নরকের ভয়। ওই-যে পুরুতমশাই দোকানে দোকানে ফুলচন্দন ঠেকিয়ে আর গঙ্গাজল ছিটিয়ে পুজো করে বেড়ায়— তাকে খুব ভক্তি করে লাখু। ওই পুরুতও না কি বলেছে, হিন্দুর মড়ার অন্তত একটু মুখে-আগুন, একটু মন্তরটন্তর পড়া না হলে আত্মার মুক্তি নেই। নরকে চাবুক খাও কিংবা তেলের কড়ায় সেদ্ধ হও। শুনে থেকে ভয়ে কাঁটা হয়ে আছে লাখু ভিখিরি।
শালা, দোজখের ভয় সব্বার সমান, কিবা হেঁদু কিবা মোছলমান!
রাস্তা পেরোতে গিয়ে সেবার অন্ধ রামলাল ট্যাক্সির ধাক্কা খেল, রক্তে চুবুচুবু হল কালো পিচ। সেই নীল প্লাস্টিক আর কালো গাড়ি। লোকে বলাবলি করছিল, লাশকাটা ঘরে প’চে মাটি হবে রামলালের বেওয়ারিশ লাশ! আর পুরুতমশাই নাকি তখনই বলে দিয়েছিলেন, নরকে অনন্ত দুর্গতি বাঁধা আছে রামু বেচারির। …বলতে বলতেই কেমন শিউরে উঠছিল নুলা ভিখিরি লাখু যাদব। তারও বিবি বাচ্চা ভাই বেরাদর কঁহি কোই নেহি। বিলকুল অকেলা। জীয়ন্তে এই নরক, ফের মরার পরেও? “ওহি হাল হোগা মেরা ভি… মওত কে বাদ? মুর্দাঘরমেঁ সড়তে-হুয়ে লাশ… হায় সিয়ারাম,” বলে চুপ করে গেছিল লাখু।
ভয়টা সৈদুলের মনেও গেড়ে বসেছে জোরদার। কিন্তু রাস্তা পাচ্ছে না কিছুতেই। বয়স তো তারও হল কমসে কম তিন কুড়ি দশ। ঘন্টি তো বেজে এল তারও। কোন্দিন এই ফুটপাতের ওপরেই কুত্তার মতো হাঁফাতে হাঁফাতে ফৌত হয়ে যাবে সে। তারপর কী হবে। কে গতি করবে তার।
মাঝখানে একটু একে-ওকে জপানোর চেষ্টা করেছিল সৈদুলবুড়ো। সন্ধেবেলা খুচরো পয়সা নিতে আসে বাসের কন্ডাক্টর ছোকরাগুলো, ওদের মধ্যে একটা মোছলমান আছে— ইসমাইল। তাকে পাকড়ে একদিন তুতাইপাতাই করে বলেছিল সৈদুল, “হ্যাঁ রে বা’জান, আমি ম’লে একটু দেখিস না— যাতে হুই টেরাম-ডিপোর পাশের গোরস্তানে একটু বয়ে নিয়ে গিয়ে… মাটি দেওয়ার একটু বন্দোবস্ত…?”
ছেলেটা থমকে গেছিল প্রথমটায়। তারপর একটু ভেবেচিন্তে বললে, “বহুত দূর। আমার তো একার কম্ম নয় চাচা। ইউনিয়নকে বলো।” …ইউনিয়ন মানে? ওদের সর্দার হচ্ছে বিকাশ। পাঁড় মাতাল আর রগচটা, হাত চালিয়ে দেয় কথায় কথায়। অতদূর এগোনোর সাহস হয়নি বুড়ো সৈদুল ভিখিরির।
# #
ঘোলাটে চোখে রাস্তার দিকে চেয়ে এইসব ভাবছে সৈদুল, এমন সময় ওর চোখের সামনেই ঘটনাটা ঘটল। একদম জ্বলজ্যান্ত দিনের আলোয়!
বছর সতেরো-আঠারোর একটা মেয়ে, বিনুনি-চুল, ফুল-ছাপ সালোয়ার কামিজ, কাঁধে ব্যাগ— ফস করে দুটো লাফাঙ্গা ছোকরা একটা গাড়ি থামিয়েছে ঠিক তার গা ঘেঁষে। একটা লাল গেঞ্জিপরা ছেলে চটপট দরজা খুলে নেমে এসে মেয়েটার হাতটা ধরে দিয়েছে হ্যাঁচকা টান! টেনে তুলতে চাইছে গাড়িতে! মেয়েটা ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চেঁচাচ্ছে, ছোকরা ওরই মধ্যে ফস্ করে একটা পিস্তল বার করে ফেলল পকেট থেকে— রাস্তার লোকেদের দিকে লাল চোখ দেখাচ্ছে। চারপাশের লোকজন সব যেন পুতুল হয়ে গেছে এক পলকে, হাত-পা আঠা দিয়ে রাস্তায় সাঁটা, মুখে কুলুপ! শুধু মেয়েটা হাত-পা ছুঁড়ছে— “ধরে নিয়ে যাচ্ছে, বাঁচাও”—
কিন্তু কে বাঁচাবে, পিস্তলের মুখে? তাকে অর্ধেক ঢুকিয়েই ফেলেছে গাড়িতে এর মধ্যে। ওই, মুখ চেপে ধরল… মেয়েটা ছটফটাচ্ছে কসাইয়ের হাতে মুরগির মতো…
হঠাৎ বুকের ধড়ফড়ানিটাও যেন নিমেষের মধ্যে বন্ধ হয়ে গেল সৈদুলের। চোখের সামনে যেন ভয়ঙ্কর কোনও বায়োস্কোপের ছবি সত্যি হয়ে উঠল! ওদিকের ফুটপাত থেকে লাখু ভিখিরি লাফিয়ে উঠেছে আচমকা… লাফ মেরে এগিয়ে এসে তার একমাত্র আস্ত হাতখানা বাগিয়ে পিস্তলওলার পেটে দিয়েছে এক ঘুষি! একটু বেসামাল হয়ে পড়েছে মস্তান, আর লাখু ওই হাতেই মেয়েটাকে টেনে আনার চেষ্টা করছে…
একটা ভোঁতা গোছের ফটাস্ শব্দ!
চমকে উঠল সৈদুল। মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়েই ছোকরা ঝটিতি গাড়িতে উঠে দরজা বন্ধ করেছে… ভোঁ শব্দে চম্পট দিচ্ছে গাড়ি…
আর লাখু? লাখু… বিহারী নুলা ভিখিরি ওরকম লাট খেয়ে ঘুরতে ঘুরতে, বুকে হাত চেপে, মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়ল কেন?
‘খুন’ ‘খুন’ চিৎকার… লোকজন দৌড়ে আসছে এতক্ষণে… আর লাখুর বাদামি গেঞ্জি ফুঁড়ে টকটকে লাল রক্ত…
জনাপঞ্চাশ লোকের সামনে জ্যান্ত লাখু ভিখিরি ঠিক দু’মিনিটের মধ্যে একদম স্থির হয়ে থেমে গেল! ইয়া খুদা!
বুড়ো সৈদুলের বুকটা হাপরের মতো ওঠে নামে। গলার ভেতরটা কাঠ। হঠাৎই পেট গুলিয়ে টক জল উঠে আসতে চায়, চারপাশের খেয়াল থাকে না আর। মগজের মধ্যে আঁধার নেমে আসে, দেয়ালে ঠেস দিয়েই এলিয়ে পড়ে বুড়ো শরীরটা। ধোঁয়া হয়ে আসে সব।
# #
বেহুঁশ হয়ে ছিল অনেকক্ষণ, তারপর হঠাৎ চেঁচামেচি শুনে চটকা ভাঙে সৈদুলবুড়োর। ধাতস্থ হয়েই চোখের সামনে এক অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা দেখে সে থমকে যায়।
রাস্তার পাশে লাখুর বডিটাকে ঘিরে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা আর প্যান্ট-শার্ট পরা বাবুদের ভিড়! কারা ওরা? চোখ কুঁচকে দেখে সৈদুল। পার্টির বাবুরা না? হ্যাঁ, সৈদুল ওদের মুখ চেনে— রাস্তা দাপিয়ে স্লোগান ছাড়তে ছাড়তে মিছিল করে সব। ওদের পাণ্ডা ওই যে, ভোটের আগে হাত জোড় করে হাঁটছিল না ওই টাকমাথা মোটা লোকটা? ইন্দরবাবু না কী যেন ওর নাম! ইউনিয়নের কন্ডাকটর-খালাসিরা ওকে খাতির করে খুব, বড়গোছের নেতা। রাস্তার হকার আর ভিখিরিদের কাছে তোলা নিতে আসে যে-হারামিগুলো— তারাও কেমন ভিজে বেড়ালের মতো ওর চারপাশে ঘুরঘুর করছে দ্যাখো! আবার পার্টির ঝান্ডাও টাঙানো হয়ে গেছে এপাশে ওপাশে।
সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা— লাখুর বডির ওপরেও একখানা ঝান্ডা বিছানো টানটান! তার পরে ফুলের মালা গোটাকতক।
ব্যাপারখানা কী দাঁড়াল?
পাশের ছোলা-মটর-ওলা যাদবের কাছে ফিসফিস করে জানতে চাইল সৈদুলবুড়ো। সব শুনে চক্ষু চড়কগাছ!
ওপাশের ফুটপাতে কারা চেঁচিয়ে উঠছে, “কমরিড লাখু অমর রহে! শহিদ লাখু যুগ যুগ জিয়ে!”
আর টাকমাথা লিডারসাহেব একটা মাইক ধরে বক্তিমে শুরু করেছে, “আমাদের পার্টির দীর্ঘদিনের সক্রিয় সমর্থক কমরেড লাখু আজ নারীনিগ্রহের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে বুর্জোয়া দলের আশ্রিত সমাজবিরোধীদের হাতে প্রাণ দিয়েছেন… কিন্তু আমাদের লড়াই চলবে… এই চক্রান্ত আমাদের দমাতে পারবে না…”
সাঙ্গোপাঙ্গরা চিল্লিয়ে ওঠে, “ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও! জবাব চাই জবাব দাও!”
শুনে থ হয়ে যায় সৈদুলবুড়ো। লাখু-ভিখিরি, কমরিড?
জিন্দেগিতে কোনও পার্টির ধারকাছ ঘেঁষেনি লাখু। পার্টিওলাদের বরং গালাগালই দিত সে। সব পার্টিকেই। ভোটের মিছিলে লিডারসায়েবদের হাতজোড়ের ঘটা দেখে কতবার ঘেন্নার গলায় বলেছে, “শালা হারামি বাবুলোগ… আ গ্যয়ে সব, সফেদ কুর্তা প্যাহেনকে, হমদরদি জতানেওয়ালে…”
কিন্তু আজ মাইক ঝনঝনিয়ে উঠছে, “সুখে দুঃখে কমরেড লাখু সর্বদা আমাদের পার্টির কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন… কমরেড লাখু তোমায় আমরা…”
“ভুলছি না, ভুলব না…”
যাদব গম্ভীর মুখে লঙ্কা কুঁচোয় আর বলে, “হেঃ। লাশের পলিটিক্ছ। এরা আগেভাগে দখল নিয়ে ফেলেছে তাই, নাহলে অন্যরাও রেডি ছিল। শুঁকতে এসে দেখেছে, মাল দখল হয়ে গেছে। আর ফয়দা নেই। তখন সরে পড়ল। কম্পিটিশান মার্কেট গো চাচা! অন্য পার্টি দশটা মিনিট আগে এলে, তখন দেখতে ওদের ফেল্যাগই উঠত বিহারীর গায়ে…”
সৈদুল থুতু ফেলে বলে, “ভাগাড়ে গরু পড়ার মতন যে গো! শুকনিরা আগে এসে পড়েছে বলে দাঁড়কাকেরা আর জায়গা পেলে নে… সেইরকমধারা, অ্যাঁ?”
তেতো হাসে যাদব। বলে, “তা, খারাপ কী বলো না! মুফতে কাচ-ঢাকা গাড়ি চেপে ফুলের মালাটালা নিয়ে ইলেকটিরি চুল্লিতে পুড়বে শালা… এমনি এমনি রোগে-ভোগে বেফালতু মরলে এত সব হত? পরকালের গতিটা তো হয়ে গেল ব্যাটার! জীয়ন্তে ভিখিরি, মরণে রাজা… হেঃ! ক’জনের হয়?”
কথাটা শুনে বুড়ো সৈদুল এক নিমেষে কেমন যেন হয়ে যায়। হাঁ করে তাকিয়েই থাকে। যেন আচমকা বাক্যি হরে গেছে! চোখ দুটো স্থির।
# #
কাচের গাড়ি করে পতাকা-মোড়া হাতকাটা ভিখিরির লাশ চলে যাচ্ছে। হাসপাতালে চির-ফাড় হবে, তারপরেই সো-জা চুল্লি। রাজার মতো যাচ্ছে লাখু, বাবুরা যত্ন করে নিয়ে যাচ্ছে কেমন। সামনে পিছনে অনেক মাথা। জুতোর মশমশ শব্দ। ইনকেলাব জিন্দাবাদ। শহিদের রক্ত, হবে নাকো ব্যর্থ…
সৈদুলবুড়ো চেয়ে দেখতে থাকে, চোখে পলক পড়ে না।
হঠাৎ চিক্কুর ছেড়ে কেঁদে ওঠে বুড়ো। ফুটপাতে লুটিয়ে পড়ে মাথা খুঁড়তে থাকে। মুঠো পাকিয়ে ঘুষি মারে ধুলোয়।
যাদব একটু থতমত খেয়ে ডাকে, “ও চাচা!”
সৈদুলবুড়ো পাথরে মাথা ঠুকতে ঠুকতেই বিকৃত গলায় বলে, “শালা… হাতকাটা বিহারী দাঁও মেরে বেরিয়ে গেল… ওহহ্ হো হো হো… আমি যদি একটু সাহস করে আগিয়ে যেতুম রে…! নিজের নামটাও যদি একটু ঠিকঠাক করে মনে পড়ত রে শালা… নামটা পর্যন্ত, শালা…”
“আরে, হল কী!” যাদব চেঁচায়।
“আব্বায় নাম রেখেছেল শহিদুল! শহিদ-উল… বুঝলি শালা, শহিদ রে, শহিদ…! কচু শহিদ, আমড়ার শহিদ, শালা! বুজ্দিল, বুড়্বক, নিকম্মা শালা! হায় গো আল্লা… স্রেফ নামেই শহিদ হয়ে রইলুম! এট্টু মনে পড়ালে না ঠিক সময়ে… অন্য লোকে আস্লি শহিদ হয়ে গেল, আমি ফসকে ফেললুম…”
-সমাপ্ত-
কঠিন বাস্তব। চিত্তাকর্ষক এক গল্প। বেশ ভালো লাগলো।