সুজয় দত্ত
“খোকনসোনা — ও খোকনসোনা। খুকুমণি — আয় মা আয়। খেয়ে যা। বেলা গড়িয়ে গেল যে –”
যাদের উদ্দেশে বলা, ডাক শুনে তারা কোথা থেকে যেন লাফাতে লাফাতে আসে, প্লাস্টিকের থালা থেকে কাড়াকাড়ি করে খায়। খাবার বলতে চানঘরের পিছনের অযত্নলালিত পেয়ারাগাছটা থেকে কয়েকটা শুকনো পেয়ারা, প্রতিবেশীর বাগান থেকে দু-চারটে কলা আর বাড়ির সামনেই রেললাইনের ধরে জলাজমির আশেপাশে গজানো নটেশাক-কলমিশাক। হপ্তায় দুদিন বাজার করে দিয়ে যায় যে ছেলেটা, তাকে একটু বাবা-বাছা করলে, চা খাবার পয়সা দিলে সে তুলে এনে দেয়।
নিজের তো আর এখন ওসব করার ক্ষমতা নেই সদানন্দের। পঁচাত্তর পেরিয়েছেন গত ফাল্গুনে, দুপায়ে আর্থ্রাইটিস। বাড়ির বাইরে বেরোনোর পাট চুকে গেছে বহুদিন। মাঝে মাঝে ব্যথা যখন বাড়ে, মনে হয় পা দুটো কেটে বাদ দিয়ে দিলে ভাল হত। বিছানায় শুয়ে কাতরাতে কাতরাতে আদ্যিকালের রংচটা মোবাইল-টার দিকে হাত বাড়ান — পাড়ার ছেলেগুলোকে যদি ডাকলে একটু আসে। মোবাইলের ব্যাটারিটা বেশ কমজোরি হয়ে গেছে আজকাল, নম্বর আর হরফগুলোও প্রায় উঠে গেছে। অতিকষ্টে একে একে হাবুল, বাপী, সমীর, সঞ্জয়ের নম্বর ডায়াল করতে থাকেন। ভাগ্য ভাল থাকলে ওদের কেউ হয়তো বড়রাস্তার মোড়ের দোকান থেকে ব্যথার ওষুধটা এনে দিল। কিন্তু পায়ের মালিশটা? সেটা করবে কে? বাজার করার ছেলেটাকে একদিন বলেছিলেন, সে সটান বলে দিল, “আমি পারব না, আয়া সেন্টার থেকে লোক রাখুন”। এযুগের ছেলে তো, বেশী মায়াদয়া দেখানোর সময় কোথায়? তাই দিনের পর দিন হাঁটুদুটো ফুলেই থাকে। হাঁটুর নীচ থেকে পা দুটো একটু একটু বেঁকেও যাচ্ছে। পাড়ার লোকজন এ-বাড়ীর দিকে খুব একটা আসেনা। এটা বাজার-দোকান বা স্কুল-কলেজের পথে পড়ে না তো। ক্কচিৎ কদাচিৎ বসাকবাবু বা দস্তিদারবাবু মর্নিং ওয়াক করতে করতে এসে পড়লে গেট পেরিয়ে ঢুকে খানিক গল্পগাছা করে যান। বসাকবাবুর বড় মেয়ে সেক্টর ফাইভের মাল্টিন্যাশনালের চাকুরেকে বিয়ে করে এখন বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা, সম্প্রতি দামী এসি গাড়ী কিনেছে। দস্তিদারবাবুর ছেলে হায়দ্রাবাদে চাকরি করত, এই সবে কলকাতায় ট্রান্সফার হয়ে এসেছে। সামনের অঘ্রাণে বিয়ে। এইসব বৃত্তান্ত সবিস্তারে বলতে থাকেন ওঁরা — বলতেই থাকেন। চোখে গর্ব ঠিকরে বেরোয়, মুখে তৃপ্তি চুঁইয়ে পড়ে। একতরফা সেই বাক্যালাপে সদানন্দ শুধুই শ্রোতা। তবু ভাল লাগে। দিনের বাকী সময়টা কাটে যাদের সঙ্গে, সেই খাট-আলমারী-টেবিল তো আর কথা বলে না। একাকিত্বের জীবন শুরু হওয়ার পর প্রথম প্রথম এতটা অসহনীয় লাগত না। নিরিবিলিতে দুচোখ বুঁজে মনের পর্দায় স্মৃতির ভিডিওটেপ চালিয়ে দিতেন, ইচ্ছেমতো রিওয়াইন্ড করে করে দেখতেন। কিন্তু এখন — এতগুলো বছর পরে নিভৃত মনের প্রেক্ষাগৃহ আর টানে না, স্মৃতির ওপর কেমন একটা গভীর নিরাসক্তি জন্মে গেছে। নতুন করে মানুষের সঙ্গ পেতে ইচ্ছে করে।
কিন্তু ইচ্ছে করলেই তো আর মেলে না। সারাদিন বাড়ীতে দ্বিতীয় মানুষ বলতে শুধু শ্যামলীর মা। একবার আসে, ঘন্টা দুই থাকে, ঘর ঝাড়পোছ আর রান্নাবান্না-বাসনমাজা সেরে “যাই গো মেসো, দরজাটা দিয়ে দ্যাও” বলে চলে যায়। তারও মুখে রা নেই, কেবল কামাই করার থাকলে “কাল আসবোনি মেসো” বা “দুদিন থাকবোনি মেসো” আর মাইনে নেবার আগের দিন “কাল সকালে ট্যাকাটা বের করি রেখো, ভুলি যেও না”। ও কাজ করে চলে গেলে সেই যে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গিয়ে গ্রিলের গেটে তালা দেন, ব্যস, সে আর সারাদিন খোলে না। এক যদি না ইলেক্ট্রিকের মিটার দেখতে আসে বা রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার বদলাতে আসে। তা তারা তো মাসে-দুমাসে একবারের বেশী এধার মাড়ায় না। আকাশ, মানে বাজার করার ছেলেটা শনি-মঙ্গল সকালবেলা এলে ওর সঙ্গে দুচারটে কথা হয় ঠিকই, কিন্তু ইদানিং কথাকাটাকাটিই বেশী হচ্ছে। ছোঁড়াটার হাবভাব ভাল নয়, সদানন্দের অক্ষমতার সুযোগ নিতে শুরু করেছে। বাজারের পয়সা ঠিকঠাক ফেরত দেয় না। অভাবী ঘরের ছেলে, হাতে কাঁচা পয়সা পেলে যা হয় আর কী। বকাঝকা বেশী করলে আবার ছেড়ে চলে যাবে। তখন তো জগৎ অন্ধকার। যাইহোক, সপ্তাহের অন্য পাঁচদিন শ্যামলীর মা কাজ করে বেরিয়ে যাবার পর সদানন্দের বাকি দিনটা কাটে বন্ধ গ্রিলের গেটের লাগোয়া বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়ে, গেটের ঠিক সামনেই ছোট্ট একফালি পাঁচিলঘেরা বাগানটার শুকিয়ে আসা গাছগাছালিতে কাক-চড়ুইয়ের আনাগোনা দেখে, দূরে বড়রাস্তায় সশব্দে ছুটে যাওয়া গাড়ীঘোড়া গুনে, আর খোকনসোনা-খুকুমণির সঙ্গে কথা বলে।
না, ওরা মানুষ নয়। গায়ে বড় বড় লোম, লম্বা লম্বা কান, চারপায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে সারা বাড়ী ছুটোছুটি করে বেড়ায় আর সারাক্ষণ নাক কুঁচকে কুঁচকে কী যেন শোঁকে। একটা ধবধবে সাদা, পুঁতির মতো গোলাপি চোখ। অন্যটার গায়ে সাদার ওপর বাদামী ছাপছাপ। নাকের কাছটা ঘন কালো। সদানন্দ ওদের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলেন, বাড়ীর বাইরে থেকে শুনলে মনে হবে ওঁর নাতিনাতনী আছে। ওরাও নাতিনাতনীর মতোই কখনো লাফিয়ে কোলে উঠে পড়ছে, কখনো পাজামা কামড়ে ধরে টানছে, কখনো আবার ঘরের টেবিলের তলায় রাখা পুরোনো খবরের কাগজগুলো ছিঁড়ে কুটিকুটি করছে। ভাগ্যিস গ্রিলের দরজার গায়ে তারের জাল লাগানো আছে, নাহলে ঠিক ফাঁক গলে বাগানে বেরিয়ে যে হাতে-গোনা দুচারটে গাছ আছে সেগুলোরও দফারফা করত। শুধু একটা ব্যাপারে বাঁচোয়া — সারা বাড়ীর যেখানে খুশী প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে নোংরা করে রাখে না। রান্নাঘরের ঠিক বাইরে প্লাস্টিকের বালতিতে, যেখানে শ্যামলীর মা রোজ তরকারি কুটে আর বাসন মেজে আবর্জনা, এঁটোকাঁটা ফেলে — সেটাকেই কোনো অজ্ঞাত কারণে ওরা শৌচাগার ঠাউরেছে। ছোট বড় — সব বাথরুম ওখানেই হয়। এটা কোথা থেকে শিখল, ভেবে পান না সদানন্দ। ওদের মা কিন্তু পছন্দ করত খাটের তলার বাক্সপ্যাঁটরার আড়াল। মাঝে মাঝেই দেখা যেত ভাল করে জলন্যাতা দিয়ে ঘর মোছার ঠিক পরেই খাটের নীচে ঝাঁঝালো তরলের ধারা অথবা কালো কালো কিশমিশের মতো একরাশ বিষ্ঠা। মহা আক্রোশে ঝ্যাঁটা নিয়ে তাড়া করত ওকে ভোলার মা। গজগজ করত, “খাঁচার মধ্যি রাখতি পারোনা খরগোশটাকে?” হ্যাঁ, তখন ভোলার মা কাজ করত এই বাড়ীতে। শ্যামলীর মা তো ঢুকেছে এই সেদিন। যাইহোক, পাছে এইজন্য কাজের লোক ছেড়ে যায়, তাই সদানন্দ ঠিকই করে ফেলেছিলেন খাঁচায় রাখবেন ওটাকে, নিদেনপক্ষে ঢাকনা দেওয়া কাঠের পেটিতে। কিন্তু তিতলি রাখতে দেবে? কেঁদে পড়ল দিদার কাছে, “টুসিকে খাঁচায় রাখলে আমি তোমার সঙ্গে খেলব না, তোমার কাছে ঘুমোব না, কথা বলব না তোমার সঙ্গে।” ব্যস, গলে গেলেন শতরূপা। স্বামীকে বোঝালেন, ভোলার মা যতই রাগ দেখাক, অত সহজে কাজ ছাড়বে না। এমন ভাল মাইনে, পুজোয় শাড়ী, বোনাস — এসব পাবে কোথায়? শুধু শুধু একটা একরত্তি মেয়েকে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই। মা-মরা মেয়ে, দিনরাত ওই খরগোশ নিয়েই তো ভুলে থাকে। চটকায়, আদর করে, কোলে নিয়ে ঘুম পাড়ায়। অতএব নো খাঁচা — সারা বাড়ীতে টুসির অবাধ চারণক্ষেত্র।
খোকনসোনা-খুকুমণির খাওয়া দেখতে দেখতে কখন নিজের অজান্তে স্মৃতিতে ডুব দিয়েছিলেন সদানন্দ। ‘মা-মরা মেয়ে’ — কথাটা মনে হতেই ঘরের জানলার দিকের দেওয়ালে টাঙানো ছবিটায় চোখ চলে যায় ওঁর। হ্যাঁ, সে আজও হাসছে। রোজ যেমন হাসে। সদ্যবিবাহিতা এক ঝলমলে যুবতী। মাথায় সিঁদুর, মুখে কুমকুম-চন্দন, গায়ে কনের সাজ। একমাত্র মেয়ে, আদরযত্নে মানুষ, লেখাপড়া শেষ করে চাকরিতে ঢুকেছিল একটা স্কুলে। অনেক দেখেশুনে ভাল ঘরেই বিয়ে দিয়েছিলেন সদানন্দ। অবস্থাপন্ন পরিবার, তেমন রক্ষণশীলও নয়, নববধূর চাকরি করা বা সামাজিক মেলামেশা নিয়ে কেউ কখনো আপত্তি করেনি। স্বামীর পারিবারিক ব্যবসা, দিনরাত ব্যস্ততা, তবু বৌয়ের শখআহ্লাদ মেটাতে যথাসাধ্য সময় দিত। এখানে ওখানে বেড়াতে নিয়ে যেত। সুখেই ছিল মিতু। বিয়ের পর প্রথম জামাইষষ্ঠীতে যখন এল, চুপিচুপি মাকে জানিয়ে গিয়েছিল সুখবর। পরের জামাইষষ্ঠীতে আর দুজনে নয়, তিনজনে আসবে। রাতে শোবার সময় স্ত্রীর কাছে সে-খবর শুনে আনন্দে উত্তেজনায় কী করবেন ভেবে পান না সদানন্দ। ষাট না ছুঁতেই দাদু! কী দিয়ে মুখ দেখবে, কী নাম রাখবেন — এইসব ভাবনায় আর ঘুম আসতে চায়না সেই রাতে। দেখতে দেখতে জন্মাষ্টমী আর বিশ্বকর্মা পুজো পেরোলো, পুজোর ঢাক বেজে উঠল। ওঁর ‘দাদুত্বে’ প্রোমোশনের দিন ক্রমশঃ এগিয়ে আসছে আর উনিও প্রস্তুতির বহর বাড়িয়েই চলেছেন। হয় মা লক্ষ্মী নয়তো কার্তিকঠাকুর আসছেন, ঠিকঠাক বরণ করে নিতে হবে তো। মেয়ে তার সদ্যোজাত সন্তান নিয়ে বাপের বাড়ী এসে কয়েকমাস থাকবে, তাই পোস্টঅফিসের এম আই এসে জমা পুরো টাকাটা দিয়ে তাঁর ছোটখাটো দু-কামরার বাড়িটাকে ঢেলে সাজালেন তিনি। পূবদিকের বেডরুমটাকে বাড়ালেন, একটা অ্যাটাচ্ড বাথরুম জুড়লেন, সারা বাড়ীর ফুটোফাটা সারিয়ে বাইরেটা নতুন করে প্লাস্টার করালেন। দিওয়ালীর দুদিন আগে শুধু বাড়ীটা রং করানো বাকি। রঙের মিস্ত্রী অ্যাডভান্স নিয়ে গেছে।
নাঃ, সে-রং আর করানো হয়নি। কালীপুজোর দিন ভোরবেলায় তলপেটে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে নার্সিং হোমে ভর্তি হল মেয়ে। কাগজেকলমে তার ডিউ ডেট তখনও প্রায় মাসখানেক দূরে। বাড়ীতে ল্যান্ডলাইন ফোন নেই, মোবাইলের যুগ তখনও শুরু হয়নি, পাশের বাড়ীর তোতন যখন ফোন পেয়ে ঘুমচোখে উঠে এসে খবরটা দিল, হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গিয়েছিলেন নার্সিংহোমে। “কী — কী ব্যাপার বেয়াইমশাই? এই যে সুমন্ত, কী হয়েছে বাবা? ডাক্তার কী বলছে? এখন কেমন আছে? আমি — আমি একটু দেখে আসতে পারি?” প্রশ্ন ছিল অনেক। উত্তর খুবই সংক্ষিপ্ত। আই সি ইউতে আছে মেয়ে, হঠাৎ করে জটিলতা তৈরী হয়েছে। ফিটাল মুভমেন্ট পাওয়া যাচ্ছে না, সম্ভবতঃ ইমার্জেন্সি সিজারিয়ান করতে হবে। বাড়ীতে শতরূপাকে জানালেন না কিছু, শুধু বললেন “ভাল আছে, চিন্তা নেই”। এক-একটা পল অনুপল যেন এক-একটা বছর। ও টি রুমের অ্যান্টিচেম্বারের কাচের দরজা খুলে নার্স জানিয়ে গেল, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই অপারেশন শুরু হবে, রক্ত চাই — রক্ত। পেশেন্ট এমনিতেই অ্যানিমিক, তার ওপর এই অপারেশনে প্রচুর ব্লাড লসের সম্ভাবনা। নার্সিংহোমের নিজস্ব ব্লাডব্যাংক নেই। শুরু হল উদ্ভ্রান্ত ছোটাছুটি। কিন্তু হায়, মিতালীর ব্লাডগ্ৰুপ যে এ-বি নেগেটিভ — অতি দুষ্প্রাপ্য। সেই ছুটির দিনে হাজারটা ফোন করে আর হাজার জায়গায় মাথা খুঁড়েও পাওয়া গেলনা যথেষ্ট পরিমাণে। এদিকে পেশেন্টের অবস্থার অবনতি হচ্ছে, আর-এম-ও আর নার্সদের মুখে শীতল কাঠিন্যের পিছনে লুকোনো উদ্বেগ ক্রমশঃ স্পষ্টতর, তবু জামাই কিছুতেই তাঁকে একবার ভেতরে উঁকি মারতে দেবেনা। তাঁর যে হার্টের রোগ। অবশেষে এল সেই নিষ্ঠূর মুহূর্ত। সার্জন এসে নতমুখে বললেন যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন, কিন্তু দুজনকে বাঁচানো গেলনা। প্রিম্যাচিওর বার্থ, তাই বেবি এখন স্পেশ্যাল ইনকিউবেটরে। মাথাটা দুম করে ঘুরে গিয়েছিল সদানন্দের — সবকিছু কেমন অন্ধকার হয়ে এসেছিল।
বেবি দেখতে হল একদম মায়ের মতো। সেই চোখমুখ, সেই একমাথা কোঁকড়া কোঁকড়া চুল। শক্তিপুজোর দিন পৃথিবীর আলো দেখেছে, তাই দিদিমা নাম রাখলেন শক্তিরূপা। মেয়ে হারানোর খবর যখন পৌঁছেছিল তাঁর কাছে সেই আলো-ঝলমল উৎসবের রাতে, আশ্চর্যরকম শান্ত ছিলেন তিনি। আসলে কান্না জিনিসটা মানুষের হৃদয়-নিংড়ানো হাহাকারের খুবই দুর্বল প্রকাশমাধ্যম। শুধু মর্গের ওয়েটিং রুমে বেয়ানের দুটো হাত জড়িয়ে ধরে অনুনয় করেছিলেন, “দিদি, আপনার ছেলে তো রইল, আমাকে মেয়ের এই স্মৃতিটুকু দেবেন?” দিদি বাধা দেন নি। তারপর থেকে নাতনি দাদু-দিদার কাছেই মানুষ। প্রাণবন্ত, আদুরে, অভিমানী, জেদী। তার মনে আঘাত দিতে দাদু-দিদা যে কোনোভাবেই রাজী নন, সেটা বুঝে যাওয়ায় বাড়ীর একচ্ছত্র সম্রাজ্ঞী সে। তাকে নিয়ে প্রৌঢ়-প্রৌঢ়ার জীবন কাটছিল বেশ। মিতু নেই — সেকথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। ছোট্ট ‘মিতু’কেই তো আবার মানুষ করছেন। একদিন মন্টেসরি স্কুলের এক বন্ধুর জন্মদিনে তার বাড়ীতে গিয়ে বাগানে সাদা ধবধবে খরগোশ চরে বেড়াতে দেখল মেয়ে। ব্যস, অমনি বায়না — ওরও চাই। এই বুড়ো বয়সে আবার খরগোশের ঝামেলা নেওয়া কি চাট্টিখানি কথা? অনেক বোঝালেন ওঁরা, কিন্তু ভবী ভোলবার নয়। শেষে শিয়ালদার এক অফিস কলিগের বাড়ী থেকে সাদা-বাদামী ছোপছোপ একটা খরগোশ ছানা এনে দিলেন ওকে। টুসিকে পেয়ে মেয়ে তো আত্মহারা। নাওয়াখাওয়া ভুলে কেবল খরগোশ নিয়েই পড়ে আছে। তাকে গোলাপি রিবন বেঁধে দিচ্ছে, চিরুণি দিয়ে লোম আঁচড়ে দিচ্ছে, হাতে করে খাওয়াচ্ছে।
ঝনাৎ করে একটা জোরালো শব্দে এক ঝটকায় স্মৃতি থেকে বাস্তবে ফেরেন সদানন্দ। খোকনসোনা লাফিয়ে উঠেছে কাঠের শোকেসটার ওপর, ভেতরে রাখা কাঁচের কাপ-ডিশগুলো তাই ঝনঝনিয়ে উঠেছে। বড্ড দুরন্ত হয়েছে আজকাল। ধমকাতে গিয়েও থেমে গেলেন তিনি। এই অবস্থায় তিতলি থাকলে কী করত, মনে হওয়ায় ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে তাঁর। তিতলির সঙ্গে হুটোপাটি করতে করতে টুসি মাঝেমাঝেই তার দিদার ঠাকুরঘরের সিংহাসনটার মাথায় উঠে বসে থাকত। সিংহাসনটা বেশ উঁচু, তিতলির তখন পাঁচও হয়নি। টুসিকে নামাবার জন্য ও ঠাকুরঘরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলত “আয়, লক্ষ্মীসোনা, কলা দেব, বাতাসা দেব, লজেন্স দেব। আসবিনা? দাঁড়া, তোর সব ঘাস আমি খেয়ে নিচ্ছি।”
এভাবেই পাশাপাশি বেড়ে উঠছিল দুজনে। মন্টেসরি ছাড়িয়ে প্রাইমারী স্কুলে গেল তিতলি। বাড়ীর কাছেই স্কুল আছে, কিন্তু একটামাত্র নাতনীকে ভাল স্কুলে দিতে হবে না? মেয়ের বেলায় নাহয় নানা কারণে সেটা হয়ে ওঠেনি। সেন্ট অ্যাগনেস বাড়ী থেকে বেশ খানিকটা দূর হলেও স্কুলভ্যান আছে। রোজ সকালে কলকাতার দক্ষিণপ্রান্তের এই শহরতলী থেকে একগোছা ছেলেমেয়েকে তুলে নিয়ে যায়, আবার দুপুরবেলা নামিয়ে দিয়ে যায়। নতুন স্কুলে গিয়ে তিতলিও চমৎকার মানিয়ে নিয়েছিল। নতুন টিচার, নতুন বন্ধুবান্ধব, নিত্যনতুন অভিজ্ঞতা — প্রতিদিন এসব গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে কানের পোকা নড়িয়ে দিত দিদার। পড়াশোনায় খুব মন, কক্ষণো বলতে হতনা হোমওয়ার্ক করার কথা। আর বাড়ীতে যতই দুরন্তপনা করুক, স্কুলে শান্তশিষ্ট হয়ে থাকত বলে ক্লাসটিচারের হাত থেকে গুড কন্ডাক্টের প্রাইজও পেত বছর বছর। টুসিও তখন আর ছোট্ট ছানাটি নেই, চার-পাঁচ বছরের পূর্ণ যুবতী। অন্যদিকে মন হয়েছে। গ্রিলের দরজার কাছে উবু হয়ে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে, কান খাড়া করে কী যেন শোনে। একবার দরজা খোলা পেয়ে হুট্ করে কোথায় চলে গেল। ব্যস, দুদিন উধাও। তিতলি তো কেঁদেকেটে একশা। সদানন্দ বুঝলেন, অভিসারে গেছে। শহরতলীর এদিকটায় গাছগাছালি, ঝোপঝাড় অনেক। বুনো খরগোশও নিশ্চয়ই আছে। অতএব রোমিওর অভাব নেই। সে-কথা তো আর দশ বছরের মেয়েকে বলা যায়না।
“ও মেসো, দরজাটা দিয়ে দ্যাও, আমি গ্যালাম।” শ্যামলীর মার গলায় চিন্তার জাল ছিন্ন হয় ওঁর। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে রান্নাঘরের পিছনের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আর গ্রিলে তালা দিয়ে এসে বসেন বারান্দায়, খবরের কাগজ হাতে। কাগজে তো আজকাল খবর বলতে তিন ‘খ’ — খেয়োখেয়ি, খুনখারাপি আর খেলা। চশমাটা নাকে দিয়ে চোখ বোলাতে বোলাতে ভেতরের পাতার একজায়গায় এসে থমকে গেলেন। ধক করে উঠল বুকের ভেতরটা, কেঁপে উঠল হাত। রুদ্ধশ্বাসে পড়তে থাকেন লাইনগুলো — “বাস-ভ্যান সংঘর্ষে মৃত তিন শিশু, আহত সাত। গতকাল দুপুর বারোটার একটু আগে বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে একটি বেসরকারী বাস ও স্কুলভ্যানের মুখোমুখি সংঘর্ষে তিন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। ভ্যানটির চালকসহ আরো পাঁচজন আরোহীকে আশংকাজনক অবস্থায় কাছের একটি সরকারী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পুলিশ-সূত্রে জানা গেছে মৃত ও আহত শিশুরা সবাই হোলি চাইল্ড স্কুলের ছাত্রছাত্রী। পুলিশ বেসরকারী বাসটির চালককে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি”, ইত্যাদি। মনের পর্দায় আপনা থেকেই একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের রিপ্লে শুরু হয়ে যায় ওঁর — সেই দুঃস্বপ্ন যাকে বিগত পাঁচ বছর ধরে প্রাণপণে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছেন। বুকের মধ্যে একটা চিনচিনে অস্বস্তি জাগছে, মাথাটা ঝিমঝিম করছে। চেয়ার ছেড়ে টলতে টলতে গিয়ে বিছানায় বসেন। সেদিনও যে ছিল বৃহস্পতিবার, সেটাও যে ছিল বালিগঞ্জ ফাঁড়ি। শুধু হোলি চাইল্ডের জায়গায় সেন্ট অ্যাগনেস আর বাসের বদলে লরি। পাঁচ বছর আগে এপ্রিলের এক রোদঝলমলে সকাল। আগের রাতে নাতনী একটু বেশীক্ষণ টিভি দেখায় ওর শুতে যেতে দেরী হয়েছিল। তাছাড়া দুদিন ধরে একটু সর্দিসর্দি ভাবও ছিল মেয়ের। তাই সেদিন সকালে উঠে স্কুল কামাইয়ের বায়না করছিল। গায়ে তেমন জ্বর নেই, তাই দিদা অনেক বলেকয়ে স্কুলে পাঠালেন। দু-দুটো উইকলি টেস্ট আছে পরের দিন — কামাই করলে পিছিয়ে পড়বে যে। রোজকার মতো ওকে স্কুলভ্যানে তুলে দিয়ে বাজারে চললেন সদানন্দ। মেয়েটার জ্বর এলে মুখে অরুচি হবে, তাই ও যা যা খেতে ভালবাসে একটু এনে রাখা দরকার। তাছাড়া টুসির খাবারও ফুরিয়েছে। ও এখন ভরাভর্তি অন্তঃসত্ত্বা — চলাফেরা শ্লথ হয়ে গেছে। খিদেও বেড়েছে খুব — অনেকের জন্য খাচ্ছে তো। বাজার থেকে ফিরে জলখাবার খেয়ে গেলেন গড়িয়া বাসডিপোর কাছে ব্যাংকে। সেখানে অনেক কাজ, তাছাড়া লম্বা লাইন পড়েছে, তাই থাকতে হল বেশ কিছুক্ষণ। দুপুর নাগাদ ব্যাংক থেকে বেরিয়ে ডিপোয় এসেছেন বাস ধরবেন বলে, পকেটে মোবাইল বেজে উঠল। বালিগঞ্জ থানা থেকে ফোন। উনি শক্তিরূপা রায়ের কেউ হন কিনা জানতে চাইছে। ওর স্কুলব্যাগের ভেতরে ওঁর নম্বর ছিল।
“হ্যাঁ, আমি ওর দাদু বলছি। কেন, কী হয়েছে?”
“আপনাকে এক্ষুণি একবার এস এস কে এম-এ আসতে হবে।”
“মানে? কী — কী বলছেন কী?”
পুরো দুদিন যমে-মানুষে টানাটানি চলেছিল এরপর। আই সি ইউ-এর নরম আলোয় আর শীতল নিস্তব্ধতায় মৃত্যুর সঙ্গে সংগ্রামরত সেই ছোট্ট শরীরটা দেখে সেদিন বুকের ভেতর যে জমাটবাঁধা, দম-বন্ধ-করা অনুভূতিটা হয়েছিল, সেটাই আবার এখন হচ্ছে। বুকের বাঁদিকটা চেপে ধরেন সদানন্দ, বিছানায় শুয়ে পড়েন আস্তে আস্তে। রান্নাঘর থেকে একটানা খুটুর খুটুর শব্দ আসছে — নিশ্চয়ই খোকনসোনা আর খুকুমণি সাজিয়ে রাখা কৌটোবাটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। দিন দিন আরো দুষ্টু হচ্ছে ওদুটো। অথচ পাঁচবছর আগের সেই দিনটায় ওরা ছিল লোমহীন, গোলাপী দুটো ছোট্ট ইঁদুরছানা। এস এস কে এম থেকে তিতলির দেহ নিয়ে বাড়ী ফিরলেন যখন, গেটের সামনে ভীড় জমেছে পাড়াপ্রতিবেশীদের। শ্মশানে যাবেন কী, বুকের ভেতরেই তো তখন শ্মশান। চিতা জ্বলছে সেখানে। বাড়ীতে ঢুকে দেখেন খাটের তলায় এক কোণে গায়ের লোম ছিঁড়ে বিছানা তৈরী করেছে টুসি। আর তাতে ওর পাশে শুয়ে আছে দুটো সদ্যোজাত বাচ্চা। হায়রে, জন্মানোর আর দিন পেলি না তোরা?
একটা তীব্র, কামড়ে ধরা ব্যথা একটু একটু করে বুকের বাঁদিক থেকে ছড়িয়ে যাচ্ছে হাতে, কাঁধে, ঘাড়ে। পাখা চলছে প্রায় ফুলস্পীডে, তাও এতো ঘাম হচ্ছে কেন? হাতড়ে হাতড়ে মোবাইলটা খুঁজতে থাকেন। সেটা না পেয়ে খাটের অদূরে গোলটেবিলের ওপর রাখা জলের জগ আর গ্লাসের দিকে অসহায় হাত বাড়ান। গলা শুকিয়ে কাঠ। কাঁপা কাঁপা হাতের ধাক্কায় মাটিতে পড়ে যায় গ্লাস, উল্টে যায় জগ। মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেরিয়ে আসে “রূপা — রূপা — একটু এসো তো এদিকে। কষ্ট — খুব কষ্ট।” সে-ডাক যাঁর উদ্দেশে, তিনি আর আসবেন কী করে? মেয়ে আর নাতনীর সঙ্গে তিনিও যে দেওয়ালে ছবি হয়ে আছেন। নাতনীর দুর্ঘটনার শোক সামলাতে পারেননি, স্ট্রোক হয়ে গিয়েছিল। আংশিক প্যারালিসিস নিয়ে আরও বছরখানেক টিকেছিলেন স্বামীর যত্নে। সে-ডাক শুধু পৌঁছল বাড়ীর অন্য দুই বাসিন্দার কানে। তারা তখন রান্নাঘরে প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ নিয়ে কাড়াকাড়ি করে খেলতে ব্যস্ত।
নাঃ, এখন আর কোনো দুঃখ-কষ্ট জ্বালাযন্ত্রণা নেই সদানন্দের। নেই কোনো আফসোস। শরীর-মন ফুরফুরে। বড় সুন্দর দিনটা আজ। অনেকদিন বাদে তিনি হাঁটতে বেরোলেন রাস্তায়। অচেনা সে-রাস্তার দুধারে মখমল-সবুজ ঘাসে ফুটে আছে নাম-না-জানা কত ফুল। যেমন তাদের রংবাহার, তেমনি সৌরভ। রাস্তাটা এঁকেবেঁকে চলে গেছে মুক্ত আকাশের দিকে। সেই আকাশে জেগে আছে অদ্ভুত মায়াবী এক আলো। ধীরপায়ে সেই আলোর অভিমুখে এগিয়ে চললেন তিনি।
বারংবার ধাক্কাতেও কেউ দরজা না খোলায় শ্যামলীর মা-র চীৎকারে পাড়ার লোক যখন গ্রিলের গেটের তালা আর কাঠের দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকল, দেখল সদানন্দের নিস্পন্দ বুকের ওপর নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে একটা সাদা ধবধবে খরগোশ। আরেকটা তাঁর পাজামা কামড়ে ধরে টানাটানি করছে। বেলা গড়িয়ে যায় — ওদের খাবার সময় হল যে।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন