রেহান কৌশিক
ভুবন স্পষ্ট শুনল নদী তাকে ডাকছে। শরীরে জোর নেই। তবু দাওয়া থেকে উঠে দাঁড়াল। হাতের লাঠিতে ভর দিয়ে কয়েক পা হেঁটে নেমে এল বাঁধের ওপর।
নদীবাঁধের গায়ে দশ গ্রামের মানুষ বানিয়ে দিয়েছে মাটির ঘর। ঘরটা ছোটো, ছিমছাম। লাল টালির ছাউনিতে ছাঁচি কুমড়োর গাঢ় সবুজ লতা। সঙ্গে চিলতে উঠোন, অল্প সবজি খেত। যদিও এ-সমস্তই দেখভাল করে উলকি। হপ্তায় হপ্তায় গোবর দিয়ে নিকোনো, খেতের আগাছা পরিষ্কার করা, নতুন চারা বসানো— সবই উলকির দায়। কারণ, এমন পরিচ্ছন্ন উঠোন, গোছানো ঘরদোর, রোপণ করা গাছপালা, নিপুণ গৃহস্থালি ভুবনের পছন্দ নয়।
ভুবন মনে করে, প্রকৃতি নিজের হাতে নিজেকে যেভাবে সাজিয়েছে, নতুন ক’রে সাজানোর নামে মানুষ তা এলোমেলো করে। সুন্দরের অছিলায় অসুন্দরের সাধনা করে। কিন্তু কে কাকে বোঝাবে? কতবার বলবার চেষ্টা করেছে, চারপাশের মানুষ তা বোঝেনি। তাই ভুবন এ-সব নিয়ে আর একটাও কথা বলে না। চুপ করে থাকে।
যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধে হয়। তাই হল। ভেবেছিল, একটু এগিয়ে বাঁধের গা থেকে ঢালু রাস্তা ধ’রে নদীর জলের কাছে নেমে যাবে, তা হল না। যার চোখ ফাঁকি দিতে চেয়েছিল, সেই উলকির চোখে পড়ে গেল। বাঁধের অদূরে তিনরাস্তার বাঁকে বাপের চায়ের দোকান সামলায় উলকি।
উলকি বলল, “এই শরীর নিয়ে আবার বেরিয়েছিস? ভুবন, তুই এত বেয়াড়া কেন?”
ভুবনের ঠোঁটে স্মিত হাসি। মৃদুস্বরে বলল, “নদী ডাকছে।”
“তুই কি আমাকে পাগল ভেবেছিস?”
“ভাবতে পারলে ভালো লাগত। মানুষ চাইলে কতকিছু হতে পারে— ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, কসাই, বাঁশিওয়ালা, মাছের আড়তদার। কিন্তু পাগল হতে পারে না।”
“যত সব ফালতু কথা।”
ভুবন একবার আকাশের দিকে তাকাল। তারপর বলল, “যারা শুধু নিজের লাভ-লোকসানের খতিয়ান বুকে চেপে ঘুরে বেড়ায়, তারা কোনোদিন পাগল হতে পারবে না।”
“আর পাগলরা?”
“তাদের বিষয়বুদ্ধি থাকে না। লাভ-লোকসানের হিসেব কষে তাদের মিথ্যে বলতে হয় না। তাদের কৌশলী হতে হয় না। তারা নিজের জন্য নয়, জগতের জন্য বাঁচে। গাছপালা, নুড়ি-পাথর, ধুলোমাটি, পিঁপড়ে, পাখি, নদী ও নক্ষত্রদের জন্য ভাবে, চিন্তা করে।”
“বিষয়বুদ্ধি কেন, আমার তো মনেহয় তাদের কোনো বুদ্ধিই থাকে না।” উলকি মজা করল।
ভুবন বলতে চাইল— আমি যে পাগলের কথা বলছি, তাদের জাত আলাদা। তোর মাথায় ঢুকবে না। কিন্তু মুখে এসব কিছুই বলল না। বলল, “তুই খদ্দের সামলা। আমি যাই।”
“এই ঠা ঠা রোদে তোকে যেতেই হবে?”
“নদী ডাকছে, যাব না?”
“এ-বুড়ো শুধরোবে না”, উলকি গজগজ করতে করতে ভুবনের হাত ধ’রে ঢালু পথে নদীর দিকে এগিয়ে দেয়। ভুবন ধীরে ধীরে এগোয়। পিছন থেকে উলকি হাঁক দেয়, “নদীর কাছেই থাকবি। নিতে আসব।”
যে ভুবন আজীবন কাউকে তোয়াক্কা করেনি, তাকেই কিনা উলকিকে ইদানীং সমঝে চলতে হয়! কিন্তু কেন? অনেক ভেবে ভুবন অবশ্য উত্তরও খুঁজে পেয়েছে— ভালোবাসা দিয়ে অধিকার অর্জন করার আশ্চর্য এক সহজাত ক্ষমতা নারীদের থাকে। সেই ক্ষমতার কাছে পুরুষের পরাজয় অনিবার্য। সে ভালোবাসা জননীর হতে পারে, প্রেমিকার হতে পারে, স্ত্রীর হতে পারে। হতে পারে সন্ততি অথবা বন্ধুর। এবং এটাও আবিষ্কার করেছে— সমস্ত ভালোবাসাই যৌনতার অলংকারে সাজানো প্রতিমা। এই যৌনতা পবিত্র। সাদা ও সুন্দর। অনেকটা দুর্গামায়ের শরীরে সফেদ ডাকের সাজের মতো।
মরা নদীর গোড়ালি ডোবা জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকে ভুবন। স্বচ্ছ জলের নীচে নুড়ি ও পাথরে পায়ের আঙুল নড়াচড়া করতে করতে এইসব সাতপাঁচ ভাবে। নদীর কাছে এসে এখন আরামবোধ হচ্ছে।
হাঁটুতে এমন ব্যথা লেগেছিল যে হপ্তাখানেক নড়াচড়া করতে পারেনি। উলকি দাওয়ায় আসন পেতে বসিয়ে চলে যেত। সময় মতো খাবার নিয়ে আসত। ঘরদোর সাফসুতরো করত। তারপর আবার উধাও হয়ে যেত। ফিরত রাত্রি হলে।
সত্যি বলতে কী ভুবনের খুব অস্বস্তি হয়। কারও সাহায্য নিতে হলে প্রবল কুন্ঠা জাগে। কারণ, যে সারাজীবন কারও জন্য কিছুই করেনি, সে সাহায্য নেয় কোন্ মুখে? কিশোর বয়সেই এ তল্লাট থেকে পালিয়েছিল। একমাত্র ছেলে হয়েও বাবামায়ের মৃত্যুর সময় হাজির থাকেনি। আজীবন জলে-জঙ্গলে, পথে-প্রান্তরে ঝোলা কাঁধে ঘুরে বেড়িয়েছে। বেশকিছু বছর অন্তর ফিরে এসেছে অদ্ভুত এক টানে, কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই ঘরের টান ফিকে হয়েছে। আবার বেরিয়ে পড়েছে অজানা মুলুকের দিকে। থিতু হবে না বলে কারও সঙ্গে নিজের জীবন জড়ায়নি। কোনো সম্পর্কের ত্রিসীমানায় পা দেয়নি। অথচ সেই ভুবনই আজ জীবনের শেষ-প্রান্তে উলকির কাছে বন্দি!
ভুবন জীবনে কোনোদিন কারও সঙ্গে ঝগড়া করেনি। উচ্চস্বরে কথা বলেনি। তর্কের খাতিরে দু-এক কথা বললেও, তা বলেছে মৃদুস্বরে। এমন মানুষকে ভালো না-বেসে উপায় আছে? নাহ্, ভুবনকে ভালোবাসার এগুলোই একমাত্র কারণ নয়। ভুবন এলাকার চোখের মণি, মাথার মুকট অন্য কারণে। তা হল ভুবনের কণ্ঠ। ভুবনের কণ্ঠে জাদু আছে। নদীজলের ছলাৎছল, ঝরাপাতার হাওয়ায় ওড়া, মেঘের ডাক, ঝড়ের আওয়াজ, বৃষ্টিপাতের রিনরিন থেকে সমস্ত পশুপাখিদের ডাক ভুবনের কন্ঠে অবিকল জেগে ওঠে। ভুবনের ডাকের কাছে মানুষ বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যায়। চোখ-বন্ধ করে গলায় আওয়াজ তোলা ভুবন হরবোলার মুখের দিকে তারা গভীর মুগ্ধতায় তাকিয়ে থাকে। চোখের পলক ফেলতে ভুলে যায়।
বছর তিন আগে ফিরে আসার পর আশেপাশের গ্রামের লোকজনই চায়নি তাদের ভুবন আবার উধাও হয়ে যাক। নিজেরা ঘর বেঁধে দিয়ে বলেছে, “সারাজীবন তো পথেই কাটিয়ে দিলি, ভুবন! শেষ বয়সে অন্তত ঘরের ছায়া গায়ে মেখে দেখ, ঘরের ছায়ার মতো এমন আদর আর কেউ দেয় না।”
মুখে কিছু না-বললেও, তাদের এই যুক্তি ভুবন মন থেকে মানতে পারেনি। বলতে ইচ্ছে করছিল— এই মাটির দেয়াল, টালির ছাউনি, দাওয়া, উঠোন— সবমিলিয়ে ঘর ঠিকই, কিন্তু নকল ঘর। আসল ঘর হল পথ, প্রান্তর। যার মাথার ওপর আকাশের চাউনি। জ্বলতে থাকা শত সহস্র নক্ষত্ররা যে-ঘরের ঝাড়বাতি। সে-ঘরে যে বাস করেছে, এ-ঘরে তার মন ঠিকবে কী করে? নিরুদ্দেশ হওয়ার ভাবনা মাথায় এলেও শরীর সঙ্গ দেয়নি। তাই নিরুপায় হয়ে থেকে যেতে হয়েছে।
যদিও নামেই তার ঘর, আসল মালিকানা যেন উলকির। উলকির ভাবভঙ্গি দেখে তেমনই মনে হয়। কী পরম যত্নে ঘরদোর পরিষ্কার করে! কী নিপুণ হাতে চারপাশ ঝকঝকে তকতকে করে রাখে! বেশ কয়েকবার ধনঞ্জয়কে বলেছে, “এখানে সময় নষ্ট করার চেয়ে উলকি যদি দোকানে আরও বেশি সময় দিত, দু’পয়সা আয় বাড়ত।”
“যে-মানুষ বাউন্ডুলের মতো আশমান-জমিন চষে বেড়িয়েছে, নিজের জীবনের হিসাব নিয়ে যে-মানুষ কোনোদিন ভাবেনি, সে আজ দোকানের আয় নিয়ে ভাবছে? অবাক করলি রে, ভুবন!” প্রতিবার এমন করেই কড়া জবাব দিয়েছে ধনঞ্জয়।
মাস ছয় আগে ধনঞ্জয়ের জবাবের সামনে ভুবন চুপ করে গেলে, ধনঞ্জয় ভুবনের পিঠে হাত রেখে বলেছিল, “সেদিনের কথাটা কী করে ভুলি, বল?”
বছর দশ আগে এক বর্ষার সময় ভুবন গ্রামে ফিরছিল। তখন নদীবাঁধ এমন মজবুত হয়নি। ইস্পাত রংয়ের মেঘে আকাশ ঢাকা। চারপাশ কেমন যেন মৃদু আলোর নীচে থম মেরে আছে! কালচে আকাশের গায়ে উড়ে চলা একদল বকও যেন বিভ্রান্ত। তাদের দ্রুত এবং এলোমেলো ডানা ঝাপটানোতেই তা স্পষ্ট। ভুবনের কেমন যেন মনখারাপ হয়ে গেল।
মনখারাপ আরও গাঢ় হল যখন দেখল পাড়ের বিভিন্ন অংশ ধসে, মিশে যাচ্ছে হিজলনদীর ঘোলা জলে। সারাবছর শাপলা ডাঁটার মতো শুয়ে থাকা রোগা হিজল বর্ষার জলে রাগি গোখরে হয়ে ফণা দোলাচ্ছে। ফুঁসছে। পাড়ের ওপর আতঙ্কিত মানুষজন ছোটাছুটি করছে। এমন সময় সেই হাড়হিম করা ঘটনাটা ঘটল। কে যেন ধসে যাওয়া পাড়ের সঙ্গে পড়ে গেল নদীর জলে। রাক্ষুসে ঘোলা জলের দিকে তাকিয়ে হাহাকার করে উঠল লোকজন। স্রোত বিপরীত মুখী হওয়ায় ভুবন দেখল কালোরংয়ের একটা ছোট্টো দেহ তারদিকেই ভেসে আসছে। উত্তাল স্রোতের টানে দেহটা জলের ভিতর পাক খাচ্ছে। একবার উপরে উঠছে, পরক্ষণেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।
ভুবন ঝাঁপিয়ে পড়ল। স্রোতের ভিতর থেকে টেনে বার করল মেয়েটাকে। অনেক কসরত করে তুলে আনল পাড়ে। মেয়েটা অচেতন। সবাই ভেবেছে মারা গেছে। ভুবন আশ্চর্য কায়দায় পেটে চাপ দিয়ে মেয়েটার মুখ দিয়ে ঘোলাজল বার করে দিল। কিছুক্ষণ পর সে চোখ মেলল। ভিড়ের ভিতর হাউমাউ করে ওঠে ধনঞ্জয়। ভুবনকে বলেছিল, “উলকিকে জন্ম দিয়েছি ঠিকই, কিন্তু ওর আসল বাপ তুই। যে বাপ নিজের মেয়েকে বাঁচানোর জন্য বিপদের মুখে জানবাজি রেখে ঝাঁপায় না, সে বাপের দাবি জানানোর হকদার হতে পারে না।”
ভুবন অনেকবার বলেছে— সেদিন অত ভাবনাচিন্তা করে কিছুই করেনি। একটা গরু-ছাগলও যদি জলে পড়ত, সে একইভাবে ঝাঁপ দিত। উলকি বেঁচেছে, তার নিজের বরাতে, এ-ব্যাপারে তার ভূমিকা গৌণ।
ধনঞ্জয় ভুবনের কথাকে পাত্তা দেয়নি। সেই দশবছর থেকেই উলকির কানে মন্ত্রপড়ার মতো করে গেঁথে দিয়েছে— ভুবনই তোর আসল বাপ।
উলকি অবশ্য তা মেনেও নিয়েছে, কিন্তু আর পাঁচজনের মতোই ভুবনকে নাম ধরে ডাকে। তুই-তোকারি করে। এ তল্লাটে ভুবনকে কেউ তুমি বা আপনি বলে না। এমনকি কাকা, মামা বলে সম্মোধনও করে না। কারণ, ভুবন তা পছন্দ করে না। ভুবন আজীবন সবাইকে বলেছে, সে এই জগতের সবচেয়ে তুচ্ছ মানুষ। কেউ তাকে আপনি বা তুমি বলুক, তা সে একেবারেই চায় না। তাছাড়া সবাই যেন তাকে নাম ধরে ডাকে। কারণ সে মুক্ত মানুষ, তাই কোনো সম্পর্কের বাঁধনে পড়তে চায় না।
এমন আজব স্বভাবের জন্য ভুবন সবার কাছে শুধুই ভুবন। অন্যকিছু নয়। কেবল নাছোড়বান্দা ধনঞ্জয়। উলকির ভয়ে ভুবন সেই বর্ষারদিনেই আবার তল্লাট ছেড়ে পালিয়ে ছিল। ভেবেছিল, ধনঞ্জয়ের আবেগ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজে থেকেই মুছে যাবে। কিন্তু তা হয়নি বলে, ভুবনের ভিতরে অল্প দুঃখ যে নেই তা নয়, তবে বছর তিন আগে ফেরার পর ক্রমশ উলকিই তার দেখভালের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। এখন অবশ্য জোর করে জুড়ে দেওয়া সম্পর্কের খারাপ লাগা মুছে গেছে প্রায়। কখনও কখনও যেন উলকির প্রতি সামান্য মায়ায় মন আর্দ্র হয়ে ওঠে।
ভুবন হাত নেড়ে মাছি তাড়ানোর মতো চেষ্টা যে করেনি, তা নয়, কিন্তু সেই মায়ার অদৃশ্য দাগ মুছছে না কিছুতেই।
হঠাৎ চোখে পড়ল একটা সারস জলের মাঝে জেগে ওঠা চরে দাঁড়িয়ে আছে। ভুবন গভীর দৃষ্টিতে পাখিটাকে ভালো করে দেখল। বুঝতে পারল পাখিটার মন ভালো নেই। ভুবন জীবনে কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলায় না। তাই কিছুটা ইতস্তত করল। তারপর ঝোঁকের মাথায় জিজ্ঞেস করল, “কী গো, মন এত খারাপ কেন?”
সারস মাথা তুলে ভুবনকে শুধু দেখল। কিছু বলল না। ভুবন আবার জিজ্ঞেস করল, “চুপ করে আছ কেন? কথা বলবে না?”
তারপর অনেকটা স্বগতোক্তির মতো করে বলল, “দুঃখ হল জগতের সবচেয়ে জীবন্ত ও সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অনুভব। দুঃখ এত তাড়াতাড়ি বাড়ে ও এত দ্রুত নিজের ভার বাড়িয়ে তোলে যে জগতের অন্যান্য জীবিত সত্তা তার কাছে তুচ্ছ, অতি সাধারণ।”
সারস মুখ খুলল, “এক হপ্তা হল আমার সঙ্গিনী মারা গেছে।”
“কেন? কী হয়েছিল?”
“এক শিকারী গুলি করে খুন করেছে।”
ভুবনের বুক মুচড়ে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই সে অবাক হল। সে তো কোনোদিন কোনো সম্পর্ককেই আমল দেয়নি, তাহলে একটি সারসের মৃত্যুসংবাদ তাকে বিচলিত করল কেন? মুখে বলল, “জগতের কোনো ভাষাতেই শোক নিবারণের জন্য সঠিক কোনো শব্দের জন্ম হয়নি। ফলে এই পরিস্থিতিতে আর কী বলব! বলার শুধু এটুকুই যে, জীবনের যে কোনো কঠিন সময়ে আকাশ দেখতে হয়। আকাশ দেখলে ভিতরের যন্ত্রণা কমে। দুঃখের ভার লাঘব হয়।”
“আত্মহত্যা করব। এ-জীবন ভয়ানক ভারী হয়ে উঠেছে।”
“আত্মহত্যা কোনো সমাধান? নিজেকে ধ্বংস করা নিতান্ত সহজ। বেঁচে-থাকার লড়াইটাই কঠিন।”
“বেঁচে-থাকা এবং টিকে-থাকার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য আছে, ভুবন। এ তুই বুঝবি না। যে স্বার্থপর, যে ভিতু, যে সম্পর্কের দায় বহন করবার ভয়ে পলাতকের জীবন যাপন করেছে, সে সম্পর্কের মাধুর্য, সে সম্পর্কের গুরুত্ব বুঝবে কী করে? সুতরাং এব্যাপারে তোর উপদেশ দেওয়ার কোনো অধিকার নেই।”
ভুবন স্তব্ধ হয়ে গেল। বলতে চেয়েও বলতে পারল না— মধ্যরাতে চকোর সানন্দে জ্যোৎস্না পান করে, যারা চকোরের মতো দুঃখকে জ্যোৎস্না ভেবে নির্দ্বিধায় পান না করতে পারে, এ-জগতে তাদের বেঁচে থাকা খুব মুশকিল। প্রতিমুহূর্তে মৃত্যু তাদের হাতছানি দেয়।
“শরীর ভালো নেই, এই অবস্থায় মাথায় রোদ লাগাচ্ছিস, অনর্থ একটা হবেই।” গজগজ করতে করতে হাজির হয়েছিল উলকি। নদীপাড়ে আর বসা হল না ভুবনের। উঠে দাঁড়ানোর সময় দেখল সারস তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ভুবন যেন সারসকে শুনিয়ে বলল, “উলকি তোর হাতটা দে, ধরে দাঁড়াব। শরীরে জোর পাচ্ছি না।”
আজ সাবান মাখিয়ে ঘষে ঘষে স্নান করিয়েছে উলকি। উলকি বেশ অবাকই হয়েছিল যখন তাকে সাবান মাখিয়ে স্নান করিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিল ভুবন। চেনা ভুবনকে বেশ অচেনা ঠেকেছিল উলকির। ভুবনকে নিজের হাতে স্নান করাতে পেরে উলকির মন আনন্দের প্রজাপতি হয়ে সারাদুপুর তিরতির করে উড়েছে। সেই কারণেই বোধহয় নিত্যদিনের সালোয়ার কামিজ না-পরে আজ একটা শাড়ি পরেছে।
দাওয়ায় বসে আছে ভুবন। লালকালো ডুরে শাড়িতে উলকিকে দেখে ভুবন বিস্মিত। এতদিন খেয়ালই করেনি মেয়েটা কত বড়ো হয়ে গেছে। ভুবনের দিকে পিছন ফিরে উবু হয়ে বসে উলকি উঠোনে গাঁদাফুলের গাছগুলোর গোড়ার মাটি খুরপি দিয়ে আলগা করে দিচ্ছিল। শুকনো গোবর ও খোলজল মিশিয়ে গোড়ায় দেবে। ফুলের সাইজ বড়ো হবে।
দৃশ্যটা বড়ো মধুর লাগল ভুবনের। মনে পড়ে গেল রামপ্রসাদের কথা। কালীসাধক রামপ্রসাদ যখন নিজের বাস্তুভিটেয় বেড়া বাঁধছিলেন তখন স্বয়ং মা কালী নাকি ছোট্টো এক মেয়ের ছদ্মবেশে রামপ্রসাদকে বেড়া বাঁধার কাজে সাহায্য করেছিলেন।
ধুর, কী সব ছাইভষ্ম মাথায় আসছে! নিজেকে ধমক দিল ভুবন। যে মানুষ কোনোদিন কোনো ধর্মের কথা বলেনি, শুনতেও চায়নি, যে মানুষের কাছে গীতা কোরান বাইবেল হল আকাশ ভূমি ও জল, যে মানুষের কাছে হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান বলে আলাদা কোনো জাতের অস্তিত্ব নেই, আছে কেবল মানুষ, শুধুই মানুষ, সে কীভাবে একটি ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে জন্মানো গল্পের সঙ্গে এমন সুন্দর একটি বাস্তব দৃশ্যের তুলনা করে? নাহ্, আজ কেমন যেন সবই গোলমাল হয়ে যাচ্ছে ভুবনের।
এই মুহূর্তে মাটি আলগা করছে ঠিকই কিন্তু উলকি যেন বেশ অন্যমনষ্ক। নজর এড়াল না ভুবনের। দাওয়া থেকে ভুবন বলল, “কার কথা ভাবছিস? আসগরের?”
আসগর এ-তল্লাটে দুধ দেয় দোকানে দোকানে। সুদর্শন, ব্যবহারও চমৎকার। উলকির সঙ্গে ভাব। তাই অনেকেই আসগরকে বাঁকাচোখে দেখে। বিশেষ করে ধনঞ্জয়।
ভুবনের কথায় চমকে উঠল উলকি। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। হাতের খুরপি ফেলে দিয়ে নিঃশব্দে উঠে এল ভুবনের কাছে। ভুবন এই স্তব্ধতার অর্থ জানে। বলল, “ভালোবাসার কোনো ধর্ম নেই, ভালোবাসা ছাড়া। দেখবি, একদিন সবাই মেনে নেবে। ভালোবাসার বিরুদ্ধে কেউ জিততে পারে না। ভালোবাসার শক্তির কাছে অন্য সব ক্ষমতা তুচ্ছ।”
উলকি এই প্রথম ভুবনের পাশে বসে ভুবনের কাঁধে মাথা রাখল। ভুবন বলল, “দাঁড়া, দেখি তোর আসগর কোথায় আছে।”
সামনে ইউক্যালিপটাসের ডালে বসে থাকা ফিঙেকে ভুবন আকারে ইঙ্গিতে কী যেন বলল। ফিঙেটা তৎক্ষণাৎ উড়ে গিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এল। ভুবন আবার ফিঙের সঙ্গে কী যেন বিড়বিড় করল। তারপর উলকির দিকে তাকিয়ে বলল, “আসগরের বাইক পাংচার হয়েছে। সারাচ্ছে। তাই দেরি হচ্ছে। বাইক ঠিক হলেই দুধের ক্যান নিয়ে আসবে।”
উলকি অবিশ্বাসী চোখে ভুবনের দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবছে— এ-মানুষটা পাখির ডাক নকল করতে পারে সবাই জানে। কিন্তু পাখির সঙ্গে কথাও বলতে পারে? পাখির ভাষা বুঝতে পারে?
ভুবন অল্পক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, “কী রে বিশ্বাস হয়নি, না? দাঁড়া, জাদু দেখাচ্ছি।” বলেই টালির ছাউনির ওপর বসে থাকা শালিক পাখিকে দেখিয়ে বলল, “ওকে আমি যা করতে বলব, ও এক্ষুনি তাই করবে। দেখ…”
উলকি বড়োবড়ো চোখে তাকিয়ে থাকে। ভুবন উলকিকে বলল, “আমি এখন ওকে কৃষ্ণচূড়ার মগডালে বসতে বলছি। দেখ, ও উড়ে গিয়ে মগডালে বসবে।”
হলও তাই। ভুবন কী যেন বলল। সঙ্গে সঙ্গে শালিকটা মগডালে গিয়ে বসল। হিজল নদীর বাঁধের পাশে নিরালা বাস্তুভিটে যেন ম্যাজিক মঞ্চ। পড়ন্ত বিকেলের লালচে-হলুদ রোদ যেন এই ম্যাজিক-মঞ্চকে রহস্যময় করে তুলেছে। এই মুহূর্তে ভুবন শুধু হরবোলা নয়, সে জাদুকরও। তার ইশারায় শালিকপাখি দুর্দান্ত জাদু দেখাচ্ছে। যার একমাত্র দর্শক উলকি।
সত্যিই ভুবনের কী যেন হয়েছে! তার এতকালের সংযমের বরফ আজ এক অদৃশ্য উষ্ণতা স্পর্শে গলে যাচ্ছে! ভুবন ভেঙে যাচ্ছে। এলোমেলো হয়ে পড়ছে। বাহবা, হাততালির মতো তুচ্ছতা যাকে কোনোদিন কাবু করতে পারেনি, সেই ভুবন আজ উলকির বিস্ময়ের সামনে নিজের কৃতিত্ব ফলাও করে দেখাতে কোনো কুণ্ঠাবোধ করছে না। বরং উন্মাদের মতো লাফঝাঁপ দিয়ে কেরামতি দেখাচ্ছে!
সূর্য অস্ত গেছে। গোধূলি আলোয় পাখিটাকে বিদায় করে ধপ করে দাওয়ায় বসে পড়ল ভুবন। ভীষণ হাঁফাচ্ছে। উলকিরও যেন সম্বিত ফিরল। ভুবন ও পাখির জাদুতে এতক্ষণ সম্মোহিত হয়ে ছিল। তাড়াতাড়ি ভুবনের কাছে এসে জিগ্যেস করল, “কষ্ট হচ্ছে, ভুবন?”
ভুবন ঘোরলাগা কণ্ঠে জোরে শ্বাস নিতে নিতে বলল, “এখানেই মাদুর পেতে দে। শোবো।”
দাওয়ায় তড়িঘড়ি মাদুর পেতে ভুবনকে শুয়িয়ে দিয়ে পাশেই বসল উলকি। বুঝতে পারছে না সুস্থ মানুষটার কী এমন হল যে এমন করছে!
কিছুক্ষণ পরেই চোখবন্ধ করে থাকা ভুবন উলকিকে বলল, “শালিকটা কবুতর হয়ে ফিরে এসেছে, উলকি। নিজের শরীরের রং-ও বদলে ফেলেছে। ওই দেখ, ঝিমকালো মস্ত আকাশে উড়ছে সোনালি রংয়ের কবুতর। দেখ, কী বেপরোয়া ভাবে ডানা ঝাপটাচ্ছে! ওর উড়ান যেন কালো আকাশের বুকে বিদ্যুতের ঝিলিক। যেমন চঞ্চল, তেমনই দীপ্তি। উলকি, কবুতরটা আমাকে ডাকছে। যাব? কী রে যাব? যাই, হ্যাঁ?”
উলকি হতচকিত। বিভ্রান্ত। দেখল, ভুবন স্থির হয়ে গেছে। উলকি হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠে লাফ দিয়ে দাওয়া থেকে নেমে ছুটে গেল নদীবাঁধের ওপর। তারপর নদীপাড় ধরে দৌড়তে দৌড়তে চিৎকার করছে, “এই কে আছ, আমাদের ঘরে এসো। আমার বাবা পাখির সঙ্গে উড়ে যাচ্ছে…”
বুকে হাহাকার নিয়ে নির্জন নদীবাঁধে উলকি পাগলির মতো ছুটছে। সন্ধের হাওয়া আর গুঁড়ো গুঁড়ো অন্ধকার মেখে এলোমেলো উড়ছে তার লাল-কালো ডুরে শাড়ির আঁচল।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
আমার কয়েকজন প্রিয় সাহিত্যিকদের মধ্যে রেহান হলেন এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। গতানুগতিক ছকের বাইরে গিয়ে, মনস্তত্ত্ব নিয়ে সুক্ষ্ম বিশ্লেষণ তাঁর প্রতিটি লেখায় সুস্পষ্ট । বন্ধন থেকে মুক্তির টানে সুন্দর এক সাবলীল ছন্দে ভুবনের মধ্যে এঁকে দিয়েছেন জীবন পথের নিশানা। ধন্য আপনার লেখনী। তাঁর প্রথম ইতিহাস নির্ভর বিখ্যাত উপন্যাস “রূপমতী” পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে, আমাদের মুগ্ধ করেছে, শব্দের বিন্যাস এমন মধুর ছন্দে হৃদয় ছুঁয়ে যেতে পারে, রূপমতী না পড়লে বোঝা মুশকিল। সম্প্রতি তাঁর এই উপন্যাস ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ হয়ে বিশ্বের আঙিনায় পা রাখতে চলেছে। আমার প্রিয় সাহিত্যকের এই প্রয়াস চুড়ান্ত সাফল্যের শিখরে চিরস্থায়ী আসন লাভ করুক, এই কামনা রইল। আমরা পাঠককুল রেহানের কাছে “রূপমতী” র পরবর্তী ইতিহাস নিয়ে আরও কিছু পাওয়ার অপেক্ষায় রইলাম। আশা করি লেখক নিরাশ করবেন না। এছাড়া আমার সবচেয়ে প্রিয় সাহিত্যিকদের মধ্যে একজন শ্রী সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় এর হাত ধরে প্রকাশিত
রেহানের ” চিত্রকর” আরও একটি অসাধারণ সাহিত্য সৃষ্টি। না পড়লেই নয়।
কি বলব জানি না তবে ভুবন হয়ে বাঁচতে ইচ্ছে করলেও একদিন সম্পর্ক শহস্র শৈবাল দামের মত আষ্ঠে পৃষ্ঠে বেধে মুক্ত শ্বাসের বাসনাকে গলা টিপে খুন করেছিল।তারপর আর কোনদিন ভুবনের জগতে বিচরনের ন্যনতম সুযোগটুকুও কেউ দেয়নি বা হয়ত নিজে তা করার চেষ্টাও করিনি।তারপর একদিন সম্পর্কগুলো যেন পাখির মত আজানা নীলের দিকে ডানা মেলে দিল,আর ফিরে এল না।আমি একা হয়ে গেলাম ভুবনের মতই, বসে আছি নদী কূলে ওপারের অপেক্ষায়, একরাশ শূন্যতা বুকে নিয়ে।