সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়
অফিসে বেদম খাটুনির পর ভিড় বাসে, ট্রেনে চেপে যে কোনও নিপাট নিরীহ মানুষ নিজের বাড়ি ফিরতে চায়। যেখানে খানিকটা উদ্বেগ নিয়ে অপেক্ষা করে আছে তার স্ত্রী। উদ্বেগের কারণ, রাস্তা-ঘাটের বিপজ্জনক অবস্থা। ছেলে-মেয়েরা বাড়ি থাকলে ভাবে, এই বুঝি বাবা ফিরল। চা খেতে খেতে গল্প করা যাবে। ওরা উৎকণ্ঠায় ভোগে না। বাইরে একটা জগত আছে ওদের। ওরা তাতে অভ্যস্ত। আমি হচ্ছি সেরকমই এক নিপাট নিরীহ মধ্যবিত্ত প্রাণী। অফিস ছুটির পর বাড়ি আমাকে চুম্বকের মতো টানে। কিন্তু গত দু’দিন আমি ট্রেন থেকে আমাদের স্টেশনে নেমে বাড়ি যেতে পারিনি। পারব না আজও। কতদিন এরকম রুটিন চলবে, আন্দাজ করা যাচ্ছে না।
খানিক আগে অফিস ফেরত আমাদের স্টেশন দেবপাড়ায় নামলাম। আমার বাড়ি পুরোহিত পাড়ায়। সেখানে না গিয়ে এখন অটোতে চেপে চলেছি দোলতলা ঘাটে। ওখানে আমার স্কুলবেলার বন্ধু অনিলাভর ফ্ল্যাট। অনিলাভর মতো বন্ধু পাওয়া বিশাল ভাগ্যের ব্যাপার। অনিলাভর চেহারায় ছিল বড়লোক ঘরের ছাপ। ওরা, সত্যিই বড়লোক ছিল। আর আমার হাবে ভাবে পরিপূর্ণ ক্যাবলা মধ্যবিত্তের উদাহরণ। আমরা কিন্তু মধ্যবিত্ত ছিলাম না। তারও একটু নীচে। অনিলাভ ক্লাসে ফার্স্ট হত। আমার নম্বর থাকত অনেক পিছনে। তবু অনিলাভ ফার্স্ট বেঞ্চে না বসে আমার পাশে বসত। আমার রেজাল্ট ভাল করার জন্য প্রচুর হেল্প করত অনিলাভ। দু’জনের টিফিনও আলাদা। আমি আনতাম রুটি, তরকারি। অনিলাভ ফল, স্যান্ডউইচ ডিম সেদ্ধ। দুটো বক্সের টিফিন আমরা মিলিয়ে মিশিয়ে খেয়ে নিতাম। অনিলাভ দারুণ টেবিল টেনিস খেলত। বাড়িতে বোর্ড ছিল ওদের। আমি টেবিল টেনিসের টি-ও বুঝতাম না। ও আমাকে শিখিয়েছিল। আমি ফুটবলটা ওর থেকে অনেক ভাল খেলতাম। অনিলাভ যাতে স্কুল টিমে থাকে, সেই চেষ্টায় ট্রায়াল ম্যাচে নিজে গোল না করে ওকে বল বড়াতাম। অনিলাভ ধ্যাড়াত। আমাদের সময় ক্রিকেট বছরে দু’তিন মাসের বেশি খেলা হত না। আমরা ক্রিকেট খেলেছি, তবে ফুটবলের মতো মনপ্রাণ দিয়ে নয়।
একে অপরের জন্য দু’বাড়িতেই ছিল অবারিত দ্বার। মা বিশেষ ভাবে পছন্দ করত অনিলাভকে। মায়ের হাতের রুটি, বাটি চচ্চড়ির লোভে অনিলাভ প্রায়ই চলে আসত আমাদের বাড়ি। ওর মা, মানে কাকিমা, অনিলাভর দাদা, দিদি সকলেই আমাকে আপন করে নিয়েছিল। শুধু অনিলাভর বাবা আমার উপস্থিতিতে তেমন সন্তুষ্ট হতেন না। আমি আশপাশে থাকলে ওঁর কপালে এক্সট্রা দুটো ভাঁজ পড়ত। তার কারণ সমাজে আমাদের পরিবারের শ্রেণী অবস্থান। মেসোমশাই চাকরি করতেন সাহেরী কোম্পানিতে। বাড়িতেও মুখে ঝুলত পাইপ। গরমেও গাউন পরতেন। বসতেন চওড়া হাতল দেওয়া আরাম কেদারায়। সে জায়গায় আমার বাবা বাড়িতে লুঙ্গি, খালি গা। শীতে গায়ে ফতুয়া। বাবারও একটা সরু কাঠের ইজিচেয়ার ছিল। তাতে কোনও হাতল ছিল না। ওখানে বসে বাবা আমাদের তিনজনকে পড়াতেন। আমার দুই দিদি আর আমি। বাবা প্রাইমারি স্কুলের হেড মাস্টার। বাড়িতে বিড়ি খেতেন আর বাইরে চারমিনার।
অনিলাভ প্রসঙ্গে বাবা আমায় বলতেন, বড়লোক বন্ধুর সঙ্গে মিশছ, মেশো। কিন্তু ওর থেকে কোনও উপকার আশা কোরো না। ওরা ভীষণ স্বার্থপর হয়।
বাবার কথা মেলেনি। অনিলাভ আজ পর্যন্ত আমার অনেক উপকার করেছে। না চাইতেই করেছে। দুই দিদির বিয়ের পর আমার মা হঠাৎ মারা গেল। হার্ট অ্যাটাক। আমাদের সেভাবে ভুগতে হয়নি মাকে নিয়ে। বছর দুয়েক বাদে বাবা পড়লেন অ্যাকিউট নিউমনিয়ায়। কয়েক মাস অন্তর ভর্তি করতে হচ্ছিল নার্সিংহোমে। সেই সময় আমাদের মফস্বলের হাসপাতাল এখনকার মতন ভাল ছিল না। লোকে বলত ওয়ান ওয়ে। পেশেন্ট একবার ঢুকলে বেরত না। বাধ্য হয়েই আমাকে নার্সিংহোমের খরচা চালাতে হচ্ছিল। তখন সদ্য বিয়ে করেছি। চাকরিও বেশি দিনের নয়। খরচ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলাম। দুই দিদির বিয়ে দেওয়ার পর বাবার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট প্রায় শূন্য। অনিলাভ ততদিনে দিল্লিতে সেটেলড। আমার অনেক আগে থেকেই মাল্টি ন্যাশানাল কোম্পানিতে চাকরি করছে। ফোনে বাবার শরীর খারাপের খবর জানিয়েছিলাম। আকারে প্রকারেও সাহায্যের কথা তুলিনি। ও নিজে থেকে বুঝে একদিন হঠাৎ দিল্লি থেকে প্লেনে চেপে চলে এল দেবপাড়ায়। পঞ্চাশ হাজার টাকা তুলে দিল আমার হাতে। আজ থেকে চব্বিশ বছর আগে পঞ্চাশ হাজার টাকা মানে অনেক! টাকাটা দিয়ে অনিলাভ আমাকে বলেছিল, দেখ যদি কাকাবাবুকে বাঁচাতে পারিস।
বাঁচাতে পারলাম না। টাকাটা ধীরে ধীরে শোধ করতে চেয়েছিলাম। অনিলাভ নেয়নি। বলেছিল, কাকাবাবুর প্রতি আমারও কিছু কর্তব্য থাকে।
এইসব গল্প যখন আমার ছেলে, মেয়ের কাছে করি ওরা অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়। সেটা অবাক, না অবিশ্বাস বুঝতে পারি না। এ ধরনের বন্ধুত্ব আজকালকার দিনে একেবারেই বিরল। তাও তো ছেলে, মেয়ে, এমনকি অন্তরাকেও একটা কথা বলিনি। আমি যখন আর্ট কলেজে পড়ছি, অনিলাভ আমাকে আড়াইশো টাকা করে হাত খরচ পাঠাত। ততদিনে ও চাকরি পেয়ে দিল্লিতে চলে গেছে। আমার চাকরি পাওয়া অবধি হাত খরচটা দিয়ে গেছে অনিলাভ। টাকা পাঠানোর গোড়াতেই আমাকে বলে রেখেছিল এই ব্যাপারটা আমি যেন কোনওদিন কাউকে না বলি। এটা দুই বন্ধুর একদম পার্সোনাল বিষয়।
আসলে মহান সাজতে অনিলাভর চিরকালই ঘোর আপত্তি। তবে অনিলাভ কেন হাত খরচা দিত আমি বুঝি। ও মনে করত আমি একদিন বড় আর্টিস্ট হব। পাঁচটা দশটার চাকরি করব না। আমি যাতে স্বাধীন ভাবে কাজ করে যেতে পারি, টাকার অভাবে ছোটখাটো চাকরিতে যাতে ঢুকে না পড়ি, তার জন্যই ওই হাত খরচের সাপোর্ট।
কিন্তু আমি ক্রমে বুঝতে পারছিলাম বিখ্যাত পেন্টার হওয়ার প্রতিভা আমার নেই। ছবি বিক্রি হত না আমার। সংসার খরচের কথা ভেবে একটা প্রকাশন সংস্থায় চাকরি নিলাম। ইলাস্ট্রেটরের চাকরি। সেটাই করে যাচ্ছি এখনও।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার, আমি কী কাজ করি, অনিলাভর বাবাকে বহুবার বলেছি। উনি কিছুতেই মনে রাখতে পারেন না অথবা মনে রাখতে চান না। যতবারই দেখা হয় জিজ্ঞেস করেন, তুই এখন যেন কী করছিস? আমার মনে হয় উনি আমাকে এতটাই অপদার্থ ভাবেন, ভদ্রস্থ কোনও কাজ করতে পারি, এটা ওঁর বিশ্বাস হয় না। আমি যখন একেবারেই সংসারি, তখন অনিলাভকে বলেছিলাম, তোর বাবা কিন্তু আজ পর্যন্ত আমাকে ঠিক পছন্দ করে উঠতে পারল না।
অনিলাভ বলেছিল, বাদ দে তো ও সব। বিদেশি কোম্পানির চাকরি করার ফলে বাবার মধ্যে সাহেবি হ্যাঙওভার রয়ে গেছে।
অদৃষ্টের অদ্ভুত খেলায় অনিলাভর বাবা এখন আমার উপর নির্ভরশীল। হ্যাঁ, ঠিক তাই। আমি ওঁকে দেখতেই চলেছি। দোলতলা ঘাটের পাশে একটা আবাসনের ফ্ল্যাটে অনিলাভর বাবা একা থাকছেন। ওঁকে দেখাশোনা করার জন্য দু’বেলা দুটো কাজের লোক অবশ্য আছে। পারিবারিক ভাবে উনি ওই ফ্ল্যাটে একা।
পরশু এসেছেন। অনিলাভ দিতে এসেছিল। দিল্লি ফিরে গেছে সেদিনই। ওর অফিসে প্রচণ্ড কাজের চাপ চলছে। বাবাকে দেবপাড়ায় রাখতে আসার আগে আমায় ফোন করেছিল অনিলাভ। বলেছিল, বাবা ভীষণ বায়না ধরেছে শেষ বয়সটা দেবপাড়ায় কাটাবে। তুই তো জানিস কিছুদিন আগেই বাবার চোখ অপারেশন হয়েছে। তোকে বলেছিলাম। ভিউ সাইট সামান্য উন্নতি হয়েছে। ডাক্তার বলেছে এর চেয়ে বেশি আশা না করাই ভাল। এই অবস্থাতেই বাবাকে দেবপাড়ার ফ্ল্যাটে রেখে আসতে বাধ্য হচ্ছি। ভীষণ জেদ ধরেছে। বাবার দেখাশোনার জন্য দিন-রাতের কাজের লোক থাকবে। তুই কি রোজ অফিস ফেরত বাবাকে একবারটি দেখে আসতে পারবি? কাজের লোকের থেকে বাবার রিপোর্ট আমি অবশ্য পাব। কিন্তু তুই দেখে এলে খানিকটা বেশি নিশ্চিন্ত হই আর কী।
আমি তখনই বলতে পারতাম, রোজ আমার পক্ষে সম্ভব হবে না রে। অফিসে ছুটির কোনও সঠিক সময় নেই। এছাড়া সাংসারের অনেক দিক সামলাতে হয় আমাকে। সপ্তাহে দু’তিন দিন আমি কাকাবাবুকে দেখতে যেতে পারি।
অনিলাভ সেটাই মেনে নিত। এতটুকু ক্ষুণ্ণ হত না। তবু ও কথা আমি বলিনি। কারণ, খুব তাড়াতাড়ি অনিলাভর সাহায্য আমার দরকার পড়বে।
অটো জোরে ব্রেক মারতে সম্বিত ফিরল আমার। পৌঁছে গেছি দোলতলা ঘাট স্টপে। অটো থেকে নেমে ভাড়া মেটাই। সামনে জি টি রোড। পেরোলে ঘাট। গঙ্গা থেকে শীতল হাওয়া উঠে আসছে। জি টি রোড পেরিয়ে মিনিট দুয়েক হাঁটলেই অনিলাভদের কমপ্লেক্স। যার চারতলায় ওর ফ্ল্যাট। ইংরেজিতে থার্ড ফ্লোর। ফ্ল্যাটের জানলা, ব্যালকনি সব রিভার ফেস। প্রচুর আলো-হাওয়া। সামনে দক্ষিণেশ্বর মন্দির, বিবেকানন্দ ব্রিজ দেখা যায়।
অনিলাভদের বাড়ি ছিল জয়কৃষ্ণ স্ট্রিটে। প্রথমে অনিলাভর দাদা চাকরি পেয়ে চলে গেল। মুম্বাইতে। অনিলাভর দিদির বিয়ে হল বিদেশে বসবাসকারী পাত্রর সঙ্গে। এরপর অনিলাভ চাকরি পেয়ে দিল্লি চলে গেল। এখানকার বাড়িতে শুধু কাকাবাবু, কাকিমা। অনিলাভ আর ওর দাদা ঠিক করল দেবপাড়ার বাড়িটা বিক্রি করে মা-বাবাকে নিজেদের কাছে রাখবে। ছ’মাস করে দুই ছেলের সংসারে থাকবে বাবা, মা। কাকাবাবু, কাকিমা এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি প্রথমে। দু’জনেই যেতে চায়নি দেবপাড়া ছেড়ে। কত বছরের বাস এখানে! দুই ছেলে অনেক বুঝিয়ে নিয়ে গেল বাবা, মাকে। বলল, তোমাদের কে দেখবে? বয়স বাড়বে আরও। অক্ষম হয়ে পড়বে। অবশেষে রাজি হলেন কাকাবাবু, কাকিমা। অনিলাভরও দেবপাড়ার প্রতি বিশেষ দুর্বলতা আছে। তাই এখানকার বাড়ি বিক্রির যে টাকাটা সে পেয়েছিল, তা দিয়ে গঙ্গার ধারের ফ্ল্যাটটা কিনে রাখল। অফিসের কাজে তাকে যখন কলকাতায় আসতে হয়, হোটেলে না থেকে সে দেবপাড়ার ফ্ল্যাটে থাকে। দুর্গাপুজোতে সপরিবারে বেশ কয়েকবার এসে থেকেছে। আর এখন সব চেয়ে বেশি কাজে লাগছে ফ্ল্যাটটা। অনিলাভর মা বছর দুয়েক হল মারা গেছেন। তার পর থেকে ওর বাবা দেবপাড়ায় শেষ বয়সটা কাটাব বলে জেদ ধরলেন। বাবাকে শান্তি দিতে অনিলাভ এনে রাখল এখানে। গত পরশু, মানে রবিবার আমি এসেছিলাম অনিলাভ আর কাকাবাবুর সঙ্গে দেখা করতে। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম আমার উপস্থিতিতে অনিলাভর বাবার চেহারায় কোনও অসন্তুষ্টি নেই। কপালের ভাঁজ দুটো উধাও। খুব আপনজনের মতো কথা বলছিলেন। কেন বলবেন না, এখন যে উনি অনেকটাই আমার উপর নির্ভরশীল। তবু তিনি আবারও একবার জিজ্ঞেস করলেন, রজত তুই এখন যেন কী করিস?
আমি উত্তর দিইনি। অন্য কথায় চলে গিয়েছিলাম।
উত্তর দিতে গিয়ে হয়তো কড়া কথা বলে ফেলতাম। এখন মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। অচিরেই অনিলাভর সাহায্য লাগবে আমার। আমি কালও দেখা করে গেছি কাকাবাবুর সঙ্গে। রিপোর্টও দিয়েছি অনিলাভকে। আজও লিফটে চেপে উঠে এলাম থার্ড ফ্লোরে অনিলাভর ফ্ল্যাটের দরজায়।
ডোরবেল টিপে দাঁড়িয়ে আছি। দরজা খুলল কাজের মেয়ে। জুতো খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছেন কাকাবাবু?
–এমনিতে ভালই। বলল বউটি। ভিতর ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে জানতে চাই, আর ওমনিতে?
–আপনি কথা বলে দেখুন না।
বুঝলাম কিছু একটা গণ্ডগোল আছে। ড্রয়িং রুমে ইজিচেয়ারে বসে রয়েছেন কাকাবাবু। বেশ খানিক দূরে খোলা জানলা দিয়ে নদীর হাওয়া আসছে। আমার পায়ের আওয়াজ পেয়ে জানতে চাইলেন, কে, রজত এলি?
–হ্যাঁ, কেমন আছেন আজ?
–বস। বলছি।
সোফাটায় গিয়ে বসলাম। কাজের বউটি ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে। বলে, বাবু তো আজ বাজার গিয়েছিল।
চমকে উঠে বলি, সে কী আপনার চোখ তো এখনও পুরোপুরি ঠিক হয়নি।
–সঙ্গে সকালের কাজের মাসি ছিল। ফের বলল কাজের বউটি। আমি কাকাবাবুকে বলি, বাজার যাওয়ার দরকার কি? এরা তো আছে আপনার জন্য। যা চাইবেন এনে দেবে।
–সারাক্ষণ বাড়িতে বসে থাকতে কার ভাল লাগে! তা ছাড়া চোখে তো আমি এখন ভালই দেখছি। ওই তো দেখতে পাচ্ছি দক্ষিণেশ্বর মন্দির, বালি ব্রিজ। কী সুন্দর আলো দিয়ে সাজিয়েছে।
আমার আর কাজের বউয়ের চোখাচোখি হল। কাজের বউটি মুখ টিপে হাসছে। কারণ, আজ ব্রিজের আলো জ্বলছে না।
কাজের বউটা এবার বলে ওঠে, দাদাকে তোমার ওই ব্যাপারটা বলো, দাদু।
কাকাবাবু বলেন, ও হ্যাঁ, বুঝলি রজত, বিচ্ছিরি একটা গন্ধ পাচ্ছি। পচা পাঁকের গন্ধ। ফ্ল্যাটের নীচে গঙ্গার পাড়ে কি ময়লা জমে আছে কোনও?
বড় করে শ্বাস নিই। বলি, কই আমি তো কোনও গন্ধ পাচ্ছি না।… এরপর কাজের বউয়ের দিকে তাকিয়ে জানতে চাই, তুমি পাচ্ছ কোনও গন্ধ? বউটি মাথা নেড়ে বলে, নাঃ, আমি তো পাচ্ছি না।
–আমি কিন্তু পাচ্ছি, পরিষ্কার করে পাচ্ছি। বললেন অনিলাভর বাবা।
বউটি বলে, সকালের দিদি নীচে গিয়ে দেখে এসেছে গঙ্গার পাড়ে ময়লা জমেছে। তবে গন্ধ ছড়ানোর মতো নয়। তাই যদি হত, অন্য ফ্ল্যাটের লোকরাও পেত। আমরাও পেতাম।
একটু ভেবে নিয়ে আমি কাকাবাবুকে বললাম, আমরা বোধহয় এই গন্ধে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তাই আলাদা করে পাচ্ছি না। আপনি দিল্লি থেকে এসেছেন, তাই টের পাচ্ছেন গন্ধটা। আস্তে আস্তে আমাদের মতন অভ্যেস হয়ে যাবে।
–কী জানি বাবা! দেবপাড়ায় তো আমিও অনেক বছর কাটিয়েছি। গঙ্গার ঘাটে গিয়ে বসেছি। গঙ্গার হাওয়ায় সেই পলিমাটির গন্ধটা পাচ্ছি না।
এর কী উত্তর হবে জানি না। চুপ করে থাকি। অনিলাভর বাবা বাঁদিকে ঘাড় ফিরিয়ে বলে ওঠেন, রজত এসেছে চা বসাও।
কথাটা কাজের বউয়ের উদ্দেশে বললেন। বউটি আর আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। চা করতে কিচেনে ঢুকে গেছে। কাকাবাবু এখন শূন্যে নির্দেশ দিলেন। বুঝতে পারছি কত বড় দায়িত্ব অনিলাভ দিয়ে গেছে আমায়। কাকাবাবুর যা বয়স এবং রোগভোগ, এ সময় নিজের ছেলের সংসারে থাকাটাই উচিত ছিল।
# # #
বাড়ির সবাই মিলে ডিনার করতে বসেছি। আমাদের বাড়ির নিয়ম হচ্ছে খাবার সব টেবিলে এনে রাখা হয়। যে যার নিজের মতো নিয়ে নিই। অন্তরা ছেলে ধ্রুবকে বলল, কী রে, আজ এত কম খাচ্ছিস কেন তুই? বাইরে ভারী কিছু খেয়ে এসেছিস নাকি?
ধ্রুব কোনও উত্তর করল না। অন্যমনস্ক ভাবে খেয়ে যাচ্ছে। দেখে বোঝাই যাচ্ছে ছেলের মন মেজাজ আজ ভাল নেই। ভাল না থাকারই কথা। এক বছর হতে চলল প্রাইভেট কলেজ থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বসে আছে। ক্যাম্পাসিং-এ ভদ্রস্থ কোনও চাকরি পায়নি। ঠিক করেছে ওর বড়লোক বন্ধু রাহুলের সঙ্গে প্রোমোটিং–এর বিজনেস করবে। চল্লিশ করে আশি লাখ মূলধন জোগাড় করতে হবে দুই পার্টনারকে। চারকাঠার একটা জমি পেয়েছে ওরা। ওখানে ফ্ল্যাট কমপ্লেক্স বানাবে। রাহুলের টাকা রেডি আছে। ধ্রুব ব্যাঙ্ক থেকে লোন নেওয়ার চেষ্টা করছে। ধ্রুবর খাওয়া শেষ। উঠে যাচ্ছে টেবিল ছেড়ে, আমি বলে উঠি, তোর লোনের কোনও পজেটিভ খবর হল?
–না, নেগেটিভ। আমাকে লোন দিতে ভরসা পাচ্ছে না ব্যাঙ্ক। বলছে এডুকেশন লোনের একটা টাকাও শোধ করতে পারোনি। শুধু ইন্টারেস্ট দিয়ে গেছ। এডুকেশন লোনের আসল কিছু শোধ দাও, তারপর লোন দেব। এদিকে রাহুল বলছে এক মাসের মধ্যে টাকা জোগাড় কর। নয়তো অন্য পার্টনার নিয়ে নেব।
–কত টাকা শোধ দিতে হবে ব্যাঙ্কে?
–লাখ পাঁচেক।
–হয়ে যাবে। চিন্তা করিস না। বললাম আমি।
ধ্রুব ঘর ছেড়ে চলে গেল। অন্তরা জিজ্ঞেস করে, কী ভাবে হবে? কোথা থেকে জোগাড় করবে তুমি? এডুকেশন লোনের ইন্টারেস্ট তুমিই তো দিয়ে যাচ্ছ। ব্যাঙ্কে ক’টাকা আছে তোমার? মেয়ের বিয়ে দিতে হবে, সেটা যেন খেয়াল থাকে।
ছেলের এবং নিজের থালা তুলে নিয়ে অন্তরা খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে গেল। ওর মাথাটা ইদানীং চট করে গরম হয়ে যায়।
টেবিলে এখন আমি আর পলি। আমার মেয়ের মাথাটা অনেক ঠান্ডা। শান্ত গলায় বলে, পাঁচলাখ টাকা তুমি অনিলাভ কাকুর কাছে চাইবে, তাই না বাবা?
মাথা উপর নীচ করে ‘হ্যাঁ’ বোঝাই। পলি ফের বলে, টাকাটা তো কম নয়, চাইলেই দিয়ে দেবে কাকু?
–আশা করা যায় দেবে। বললাম আমি।
পলি বলে, আর যদি না দেয়? তুমি তো কথা দিয়ে ফেললে দাদাকে।
মেয়ের কথায় চিন্তায় পড়ে যাই। ও তো ঠিকই বলছে। হয়তো কোনও কারণে এক সঙ্গে এত টাকা দিতে পারল না অনিলাভ, ওরও এখন টাকার টান চলতে পারে। নাঃ, ধ্রুবকে কথা দিয়ে দেওয়াটা ঠিক হয়নি আমার।
দশদিন কেটে গেল। মাঝের ক’দিন অনিলাভর বাবা নাকানি চোবানি খাইয়েছেন আমাকে। আজ আবারও অফিসের পর চলেছি তাঁর কাছে। বাসের পর এখন আমি ট্রেনে। আজ বড় কঠিন দায়িত্ব আমার, কাকাবাবুকে রাজি করাতে হবে সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে যেতে।
সেই যে পচা গন্ধ পাচ্ছিলেন কাকাবাবু, সেটা ক্রমশ বাড়ল। অস্থিরতা দেখা দিল ওঁর মধ্যে। আমরা যে গন্ধটা পাচ্ছি না, উনি বিশ্বাস করছেন না। আমায় একদিন পাঠালেন কমপ্লেক্সের নীচে। বললেন, যা দেখে যায়। নিশ্চয়ই কোনও মরা কুকুর বা গরু আটকে আছে।
দেখে এলাম। বললাম, কিছু নেই। উনি বললেন, তা কী করে হয়। আমি স্পষ্ট গন্ধটা পাচ্ছি।
সমস্যাটা জানালাম অনিলাভকে। ও বলল, তুই কী কোনও ইএনটি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবি?
আমাদের এলাকার সব চেয়ে ভাল ইএনটি’র কাছে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার এক্সরে, ওষুধ দিলেন। এক্সরে করিয়ে রিপোর্ট নিয়ে গেলাম ডাক্তারের কাছে। রিপোর্ট দেওয়ার মাঝে ওঁর প্রেসক্রাইব করা নাকের ড্রপ দিনে তিনবার করে দেওয়া হয়েছিল। কোনও উন্নতি হয়নি। এক্সরে দেখে ডাক্তার নাকের ড্রপ পাল্টে দিলেন। কাকাবাবু চেম্বার থেকে বেরিয়ে যেতে ডাক্তার আমাকে বললেন, ওঁর কিচ্ছু হয়নি। পুরোটাই মানসিক। নাকের ড্রপটা দিলাম মন ভোলাতে। ওই ওষুধটা নেজাল চ্যানেল পরিষ্কার রাখে। যে কেউ নিতে পারে। আপনি ওঁকে কোনও সাইক্রিয়াটিস্ট দেখান।
অনিলাভকে ফোনে জানালাম ইএনটি’র অবজারভেশন। অনিলাভ বলল, নিয়ে যা সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে।
আমি বললাম, কাকাবাবু কি রাজি হবেন যেতে? পুরনো দিনের মানুষ, মানসিক ডাক্তার শুনলেই ধরে নেবেন পাগলের চিকিৎসা।
অনিলাভ বলে, রাজি না হলে তোকে বোঝাতে হবে। যদি কনভিন্স করতে না পারিস, সব কাজ ছেড়ে যেতে হবে আমাকে।
যা দাঁড়াল, যে করে হোক কাকাবাবুকে বুঝিয়ে সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে নিয়ে যেতে হবে আমাকে। না পারলে কোন মুখে চাইব ধ্রুবর জন্য পাঁচ লাখ টাকা?
ট্রেন ঢুকছে দেবপাড়া প্ল্যাটফর্মে। এমন সময় ফোন বাজতে শুরু করল আমার। ঠিক করলাম প্ল্যাটফর্মে নেমে ফোন ধরব।
ফোন কেটে গেছে। প্ল্যাটফর্মে নেমে মোবাইল বার করে দেখি অন্তরার মিসড কল। এ সময় তো ফোন করে না! কী হল আবার? কলব্যাক করলাম। ও প্রান্তে ফোন ধরে অন্তরা জানতে চাইল, তুমি এখন কোথায়?
–কেন? এই মাত্র ট্রেন থেকে নামলাম।
–এখনই বাড়ি চলে এসো। একটা দারুণ খবর আছে। অন্তরার গলায় উচ্ছ্বাস।
–কী খবর? ফোনেই বলো না।
–না, বাড়ি এলে বলব। খবরটা শোনার পর তোমার এক্সপ্রেশন দেখতে চাই।
কী এমন ভাল খবর দেবে অন্তরা? আমার এই ছা-পোষা জীবনে ভাল খবর কত আর ভাল হবে? কৌতূহল দমন করে অন্তরাকে বললাম, আজ একবার অনিলাভর বাবার কাছে যেতেই হবে। খুব আর্জেন্ট। ওদের বাড়ি ঘুরে এসে তোমার ভাল খবর শুনছি।
চুপ করে আছে অন্তরা। ফোন কাটছে না। হঠাৎ বলে ওঠে, ধ্রুব চাকরি পেয়েছে। সরকারি চাকরি। ওর সাবজেক্টেরই চাকরি।
আকাশ থেকে যেন আছড়ে পড়ি মাটিতে। বলি, কী বলছ তুমি! ও চাকরির পরীক্ষা দিল কবে?
–দিয়েছে। চুপিচুপি। আমাদের জানায়নি। ইন্টারভিউও দিয়েছে। আজ মেল-এ কনফার্মেশন পেল।
ফোনে কথা বলতে বলতে কখন যে অটো স্ট্যান্ডে চলে এসেছি খেয়াল করিনি। এখন মাথার উপর কেউ যেন ঠান্ডা জলের সাওয়ার খুলে দিয়েছে। অন্তরাকে বলি, রাতে হোটেল থেকে খাবার আনাও।
–সে তোমার মেয়ে অলরেডি অর্ডার করে দিয়েছে। তুমি কাকাবাবুকে দেখে ফেরার পথে শীতলামাতা থেকে মিষ্টি এনো।
–আচ্ছা। বলে ফোন কাটলাম। বসলাম অটোতে গিয়ে।
# # #
ডোরবেল শুনে মতো দরজা খুলল কাজের বউটি। রোজকার মতো জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছেন আজ?
–বলছে তো ভাল আছে। দেখুন গিয়ে। বলল কাজের বউ।
ড্রইংস্পেসে ইজিচেয়ারে বসে আছেন কাকাবাবু। পায়ের আওয়াজ শুনে বুঝে গেলেন আমি এসেছি। বললেন, আয়। বোস।
চেয়ার টেনে বসলাম। যাক, কানটা ভাল আছে। ধ্রুবর চাকরি পাওয়ার খবরটা বুকের ভিতর টগবগ করে ফুটছে। এক্ষুণি যেন কাউকে বলতে পারলে ভাল হয়। তাই অনিলাভর বাবাকেই বললাম। আজ একটা দারুণ খবর আছে কাকাবাবু। আমার ছেলে ধ্রুব সরকারি চাকরি পেয়েছি। বিরাট একটা টেনশান মাথা থেকে নামল আমার।
–বাহ্। এ তো খুব ভাল খবর! মিষ্টি নিয়ে আসিসনি? –আপনার তো সুগার।
–হোক না সুগার। তা বলে এত আনন্দের খবরে মিষ্টি খাব না! বলে হাসছেন কাকাবাবু। ফের বলেন, আজকের দিনটাই খুব ভাল বুঝলি। আজ বিকেল থেকে খেয়াল করছি পচা গন্ধটা আর নেই। পাচ্ছি না গন্ধটা। তোর ইএনটি ডাক্তার বেশ ভাল, মানতেই হবে।
চুপ করে আছি। কী করে রোগটা হঠাৎ সেরে গেল বুঝতে পারছি না! ডাক্তার তো মন ভোলানোর ওষুধ দিয়েছিল। কাকাবাবু স্বগতোক্তির মত বলে ওঠেন। কী আশ্চর্য ব্যাপার না? একদিনে জোড়া সুখবর!
আমি চওড়া করে হাসলাম বটে, কিন্তু মনের মধ্যে কেমন একটা খটকা রয়ে গেল। এরপর অনেক গল্প হল। চা-বিস্কুট খাওয়া হল। অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু তাড়াতাড়ি উঠে পড়লাম।
লিফটে করে যখন নামছি, তখনও দেখছি, এই কাকতালীয়টা ঠিক যেন হজম হচ্ছে না। একই দিনে ধ্রুব চাকরি পেল আর কাকাবাবুর রোগটা সেরে গেল! কাকাবাবু কি তা হলে আমার স্বার্থের গন্ধটা পাচ্ছিলেন?
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন
খুব ভালো কথন। জমাটি লেখা
চমৎকার গল্প। স্বার্থের কত পরত। স্বার্থেরই তো রঙ হয়, গন্ধ হয়। আর সেই দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। স্বার্থপর মানুষেরা তো আর নিজের শরীর-মন থেকে উঠে আসা সেই গন্ধ পাবে না। প্রকৃত নিঃস্বার্থ, অনুভবী, ক্রান্তদর্শী মানুষের পক্ষেই সম্ভব সেই পচা গন্ধকে অনুভব করা। বড়োলোক সম্পর্কে গরিব মানুষের যে তথাকথিত ধারণা, তাকেও ভেঙে দিয়েছে এই গল্প। অনেক ক্ষেত্রে দারিদ্রই মানুষকে স্বার্থপর করে। নিজের স্বার্থ সিদ্ধির পরিকল্পনায় সহানুভূতি দেখাতে হয়।
আসলে ধনী-গরিবের উপর স্বার্থপরতা নির্ভর করে না।